( Dostoevsky, Fyodor; Jessie Coulson (trans.) (1966). A Nasty Story. London: Penguin Books. ISBN 0-14-044179-4.)
দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলো তখন ঘটেছিলো যখন এক অপ্রতিরোধ্য আবেগ ও প্রাণবন্ত ভালোবাসায় ও সরলসোজা উচ্ছ্বাসে আমাদের মাতৃভূমি এক নতুন দিশার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো । আমাদের দেশপ্রাণ সুসন্তানেরা সকলে মিলে সেই অভিমুখে চলছিলেন, নতুন নতুন আশা-স্বপ্নে, নতুন নতুন কল্পনায়, আশায় বুক বেঁধে রাখা সেই সময় । সেই দিনগুলোর তুষারপাতে শীতল কোন এক রাতে সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এর এক সুন্দর দোতলা প্রাসাদের একটি ঘরে সামাজিক প্রতিপত্তি সম্পন্ন অভিজাত তিন ব্যক্তি বসে আলচনা করছিলেন । ঘরটি বেশ জমকালোভাবে সাজানো । কিছু একটা গুরুগম্ভীর বা মনোজ্ঞ বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে তাঁদের আলোচনা চলছিলো । তিনজনেই পদমর্যাদায় ‘হুজুর’ । একটা ছোট টেবিল ঘিরে থাকা তিনটে গদিওয়ালা আরাম কেদারায় তাঁরা বসেছিলেন । তাঁদের প্রত্যেকেরই হাতে শ্যাম্পেন, গদিতে গা এলিয়ে সেই গ্লাসে তাঁরা মাঝে মাঝেই চুমুক দিচ্ছিলেন । টেবিলের উপর একটা কারুকাজ করা রূপোর বালতিতে শ্যাম্পেনের বোতলটি রাখা । অর্ধেক তার বরফে ঢাকা, উর্ধ্বাংশ জলের উপরে । ব্যাপারটা আর কিছুই না, গৃহস্বামী পিভি কাউন্সিলার স্তেফান নিকিফরভিচ নিকিফরভ, পয়ষট্টি বছর বয়সের এক ব্যাচেলার, তাঁর সদ্য কেনা বাসায় গৃহপ্রবেশ উদযাপন, এবং আর একটি বিষয়, এই প্রথম তিনি তাঁর জন্মদিন পালন করছেন । তাঁর নতুন বাসায় দুইটি আনন্দের একটিই দিনে উদযাপনের আয়োজন করছেন । তবে একে কতটা উৎসব বলা যায় তা একমাত্র ভগবানই বলতে পারবেন, মাত্র তিনজন মিলে এই উদযাপন ! অতিথি দুজন নিকিফরভের পূর্বতন সহকর্মী ও অধস্তন ছিলেন । উভয়েই দেশের ‘কাউন্সিলর’, এঁদের নাম সেমিওন ইভানভিচ শিপুলেঙ্ক এবং ইভান ইলিয়িচ প্রলিনস্কি । রাত নটায় এসেছিলেন তাঁরা, চায়ের আমন্ত্রণ ছিলো । চা চক্রের পর শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হলো । কিন্তু অতিথিদের আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠতে হবে, কারণ গৃহস্বামী বরাবর ঘড়ির কাটা মেনে চলেন । এই আসর সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত চলবে বলে ঠিক করা ছিলো ।
গৃহস্বামী স্তেফান নিকিফরভিচ নিকিফরভ সম্পর্কে দুএকটি কথা পাঠকদের জানাচ্ছি । অল্প মাইনের এক ক্ষুদে কর্মচারী হিসাবে তিনি জীবন শুরু করেন, পয়তাল্লিশ বছর ধরে দিনগত পাপক্ষয় করে গেছেন, তাঁর লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, জানতেন তাঁকে কি করতে হবে । আকাশের তারা ধরার শখ ছিলো না তার, তবে ক্ষমতা অর্জনের চিহ্ন হিসাবে বুকে দুটি তারকা হাসিল করেছিলেন । যেকোনো বিষয় নিয়ে নাক গলানো তাঁর চরিত্র বিরোধী ছিলো । ভদ্রলোকটি সৎ, অর্থাৎ তাকে বিশেষভাবে কোনো অসৎ কাজে যুক্ত হতে হয় নি ; ব্যাচেলার থেকেছেন তার কারণ তাঁর কৃপণতা ও স্বার্থপরতা । তিনি মোটেও নির্বোধ নন, যদিও তার বুদ্ধির পরিচয় সবসময় দেওয়াটা বা জাহির করাটা তাঁর চরিত্র বিরোধী ছিলো । শৈথিল্য বা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি । উছ্বাসকে তিনি মনে করতেন নৈতিক শৈথিল্য । অবসরের জীবনে তিনি দুশ্চিন্তামুক্ত আরামের আয়েশি জীবন কাটানোই শ্রেয় মনে করে সেভাবেই দিনযাপন করছিলেন । অভিজাত ব্যক্তিদের বাসায় মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন, কিন্তু তাঁর বাসায় এমন আয়োজন করা তাঁর ভীষণ অপছন্দের ছিল । ইদানিং তিনি একা একা গ্রান্ড পেসেন্স তাস খেলা ছেড়ে দিয়ে নিজের মৌতাতেই মশগুল আছেন, তার প্রিয় ঘড়িটির টিক টিক শব্দ তার সঙ্গী এখন - ম্যন্টেলপিসের উপর কাচের বাক্সের তলে ওই টিকটিক আওয়াজ মধুর হয়ে উঠতো, আর গদি চেয়ারে ঢুলতে ঢুলতে ওই শব্দ শুনতে শুনতে বিকাল সন্ধ্যা রাত কেটে যেতো তার । চেহারায় তিনি অভিজাতের মত মান্যগণ্য ছিলেন, দাঁড়ি গোফ কামানো মুখ, চকচকে মুখ দেখে তাঁর অত বয়স বোঝা যায় না । শরীরটাকে ধরে রেখেছেন বেশ । দেখে মনে হয় তিনি আরো অনেকদিন বাঁচবেন । আচার আচরণে তিনি একজন সুভদ্র মানুষ ছিলেন । চাকরিটা তাঁর বেশ আরামেরই ছিলো । মাঝে মাঝে বৈঠক , আলোচনা আর এখানে সেখানে স্বাক্ষর করা ছিল তাঁর কাজ । অফিসে তার কাজের সুনামই ছিলো, সবাই তাকে ভালোমানুষ বলেই মানতেন । শুধু একটাই নেশা ছিলো তাঁর বা সহজ করে বললে একটাই উগ্র বাসনা ছিলো – নিজের একটি বাড়ি । সাদামাটা বাড়ি নয়, বেশ কেতাদুরস্ত নবাবী চালের প্রাসাদোপম বাড়ি । এই ইচ্ছাটা তাঁর পুর্ণ হয়, পছন্দ করে একটি বাড়ি কেনেন, নগরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি, সেন্ট পিটার্সবুর্গ এলাকায় পছন্দ করে একটি বাড়ি কেনেন । বাড়িটা কিছুটা দূরে হলেও এর সঙ্গে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলামেলা পরিবেশ, কিছুটা জমি নিয়ে বাগান আছে, আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাড়িটির সৌন্দর্য । নতুন গৃহস্বামীর বাড়িটি পছন্দের আরও কারণের একটি, তিনি চাইছিলেন কিছুটা দূরত্ব, বাসায় স্বেচ্ছায় আসা অতিথি তাঁর পছন্দের নয় । আর তাঁকে যদি নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য যেতেই হয় তবে তো তাঁর দুই আসনের চমৎকার চকলেট রঙের ঘোড়ার গাড়ীটিই রয়েছে, সঙ্গে মিখেই নামে এক কোচয়ান ও ছোট ছোট দুইটি শক্তসমর্থ ঘোড়া । এগুলি তার চল্লিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে সঞ্চয় করার ফসল । এখন, অবসর কালে মনপ্রাণ ডুবিয়ে আনন্দ করার অধিকার তার আছে । এই কারণেই নতুন বাসায় আসার পর মন এতো আনন্দিত যে ঘণিষ্ট দুই বন্ধুকে আমন্ত্রণ করেই ফেললেন । জন্মদিন উপলক্ষে এই আয়োজন ও আমন্ত্রণ, যদিও এই দিনটির কথা এতদিন তিনি বন্ধুদের থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন । আমন্ত্রিত দুই বন্ধুর মধ্যে একজনকে আমন্ত্রণের বিশেষ কারণ ছিলো । দ্বিতলের এই বাড়িটির উপরের তলা তাঁর একার থাকার পক্ষে যথেষ্ট । নিচের তলার জন্য তাই তাঁর একটি ভাড়াটিয়ার দরকার ছিলো । এই নীচের তলাটা উপরের তলার মত করেই বানানো । বন্ধু সেমিওন ইভানভিচ শিপুলেঙ্কোর উপর তাঁর ভরসা ছিলো যে সে ভাড়া নেবে । সেই কারণে বারেবারে প্রসঙ্গটি টেনে আনছিলেন । কিন্তু সেমিওন কোনরকম ট্যা-ফু করেনি এই নিয়ে । উনিও ধীরে ধীরে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলেন অধ্যবসায়ের সাথে । চুল আর গালপাট্টায় তার চেহারাটায় যেনো চিরকালের পিত্তরোগীর মতো ভঙ্গি নিয়ে আছে । বিয়ে করেছেন, দিন-রাত মুখ ভার করে বাসায় পড়ে থাকেন, পরিবারের সবাই তার জন্য তটস্থ; একান্ত নিজের উপর আস্থা রেখে নিজের মতই চলেন তিনি । তিনি জানতেন তিনি কি করতে পারেন বা পারেন না, সেই অনুযায়ী চলেন । চাকরিটায় পাকাপোক্তভাবে কায়েম হয়েছেন । দেশে বর্তমানে যে পরিবর্তন আসছে তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা থাকলেও তার এতে কোনো রকম আশঙ্কা নেই সেটাও সে জানে । নিজের উপর তার অগাধ আস্থা । এই সময়টা নিয়ে তিনি ইভান ইলিয়িচ প্রালিনস্কি যে ভাষণ দিচ্ছিলেন সেটা তিনি শুনছিলেন, যদিও মনেমনে তাঁর অন্তরে বিদ্রুপ ব্যঙ্গ জন্মাচ্ছিলো । শ্যাম্পেনের নেশা তাদের মধ্যে ততক্ষণে কাজ শুরু করেছে । স্বয়ং গৃহকর্তা নিজেও নতুন এই সময় নিয়ে একটু হালকা তর্কে জড়িয়ে গেলেন স্বেচ্ছায় । আমরা এবার সেই মহামহিম প্রলিনস্কি সম্পর্কে কয়েকটা কথা জানি, কারণ এই আখ্যানের তিনিই প্রধান চরিত্র ।
মাস চারেক হলো তিনি, ইভান ইলিয়িচ প্রালিনস্কি জেনারেন পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন বা অফিসার হয়েছেন । বয়সে এখনো প্রবীণ হননি, তেতাল্লিশ হয়নি, কিন্তু চেহারাটাকে তিনি এমন রেখেছেন যে তাঁকে আরো কম বয়সি দেখায় । দীর্ঘদেহী সুপুরুষ চেহারা, পোশাক ফিটফাট, সাজপোশাক নিয়ে তাঁর একটা গর্ব আছে । ছোটবেলা থেকেই আভিজাত্যকে যাপনে রপ্ত করেছেন । বিয়ে করেননি, কিন্তু আশা রাখেন যে একজন সুপাত্রী তাঁর জীবনে আসবে । বুকের মধ্যে এখনো রঙ্গিন স্বপ্ন রাখা আছে তার । বক্তৃতায় মাত করেন, পার্লামেন্টের সদস্যের মতো, জেনারেলের সন্তান বড় হয়েছেন তেমনি আভিজাত্যে । ছোটবেলায় ভেলভেটের জামা আর কেম্ব্রিজের জুতো পড়ে ঘুরে বেড়াতেন । পড়াশোনা অভিজাত স্কুলে । স্কুলের ছাত্র হিসাবে নজরকাড়া না হলেও অফিসের কাজে তিনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে সফল, ধাপে ধাপে তাই জেনারেল পদে উঠে এসেছেন । উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আস্থা আছে তার উপর, তার যোগ্যতার উপর আস্থাও আছে । কিন্তু সূচনায় তিনি যার অধীনস্থ ছিলেন সেই স্তেফান নিকিফরভিচ তাকে একদম পছন্দ করতেন না, ভরসাও করতেন না । তবে, এই ইভান ইলিয়িচ অভিজাত বংশের ছেলে এবং টাকাপয়সা ও বাড়িঘর আছে ভালোই, এই বিষয়টা ছিলো বেশ উপভোগ্য । তাঁর আত্মীয়স্বজন সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষজন । তবে তাঁর অতিরিক্ত আবেগ ও চঞ্চলতা তাঁর বিপক্ষে যেতো । ইভান নিজেও এটা অনুভব করতেন যে তিনি কখনো কখনো অতিরিক্ত অভিমানী হয়ে যান । সবচেয়ে বিচিত্র এটা যে তিনি বিষন্ন মন নিয়ে ভাবতেন যে তিনি তাঁর স্বপ্নের মতো সফল নন । এমন মুহুর্তগুলোতে তিনি খুব বিষন্ন থাকতেন । পুরোনো অর্শের সমস্যাটা যখন তাঁর কাছে খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতো তখন তিনি ভাবতেন তার জীবনটাই ব্যর্থ । এই হতাশার ছায়া তার সাংগঠনিক জীবনেও পড়তো, নিজেকে বাকতাল্লাবাজ বলে ধিক্কার দিতেন মনে মনে । এমন আত্মসমালোচনা প্রশংসনীয় বটে তবে এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতেন, দু হাত বাড়িয়ে দিতেন । আরো চাঙ্গা হয়ে উঠতেন এই সময় । আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি দেখাতেন যে তাঁর অনেক কিছু করার মত সক্ষমতা আছে, ভবিষ্যতে এমন এক রাষ্ট্রনায়ক হবেন যার কথা মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে, এবং এই সময় তার মনে সেই আগামীর স্মারকচিহ্ন ভেসে উঠতো । এই সমস্থ থেকে এটা পরিস্কার যে ইভান ইলিয়িচের জীবনের লক্ষ্য উঁচুর দিকে । যদিও এই স্বপ্নগুলো তিনি মনের গভীরে পোষণ করে চেপে রাখতেন । মোদ্দা কথা তিনি লোকটা ভালো এবং মনের দিক দিয়ে সৃজনশীল । গত কয়েকবছর ধরে এই মনখারাপের প্রকোপ বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছিলো তাঁর মধ্যে । কেমন যেন রগচটা ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন তিনি । সামান্য বিরোধিতাকেই অপমান বলে ভাবছিলেন । কিন্তু রাশিয়ার নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে আবার আশাবাদী করে তোলে । সেই আশা ফলপ্রসূ হলো তাঁর জেনারেল পদে উন্নতির মাধ্যমে । মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন তিনি । নানা বিষয়ে নানা কথা বলা শুরু করলেন আত্মবিশ্বাসী বাগ্মীতার সঙ্গে । নতুন নতুন বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করতেন ও বাস্তবায়ন করতেন প্রবল উদ্যমে । গোটা নগর তাকে জানতো উদারপন্থী হিসাবে, মতামত আদানপ্রদানের জন্য প্রত্যেকের কাছে যাওয়ার চেষ্ঠা করতেন । আজ, এই বিশেষ দিনটিতে তিন চার পেগ মদ্যপানের পর তাঁর নিজেকে উজার করে কথা বলার ইচ্ছা জাগলো । যে স্তেপান নিকিফরভিচের সঙ্গে তাঁর বহু দিন পরে দেখা হলো তাঁর প্রতি এতদিন শ্রদ্ধা করে এসেছেন, নানা বিষয়ে মতামত নিতেন সেই মানুষটার প্রতিটি মতকেই আজ পালটে দিতেই জেদ চাপলো । এদিন হঠাৎই স্তেপানকে পশ্চাৎপন্থী বিবেচনা করে অতি উৎসাহে আক্রমণ করতে শুরু করলেন । আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের পক্ষে কোন কথাই বলছিলেন না স্তেপান নিকিফরভিচ, মৃদু মৃদু হাসছিলেন চতুরের মতো, মজাই পাচ্ছিলেন ব্যপারটায় । ইভান ইলিয়িচ যতই গরম হয়ে উঠছিলেন এবং সেটাকে তিনি আলোচনা বলে ভাবছিলেন সেই আলোচনার তাপে যতটা উচিত তার চেয়ে বেশি ঘন ঘন হাত বাড়াচ্ছিলেন মদের গ্লাসের দিকে । গ্লাসটা যতবারই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিলো সঙ্গে সঙ্গে অতিথির সেই গ্লাসে শ্যম্পেন ভরে দিচ্ছিলেন স্তেপান । তাতে কেন জানি ইভান ইলিয়িচের হঠৎ অপমান বোধ হতে লাগলো । এটা আরো বেশি লাগছিলও যখন তিনি ভাবলেন তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে, আসল কথাটা হলো বদমেজাজের জন্য তাঁকে সবাই ভয় পায় । এহেন সেমিওন ইভানভিচ শিপুলেংকো তাঁর পাশে বসে মহা ধূর্তের মতো একেবারে মুখ বুজে আছেন এবং যতটা একান্ত দরকার তার চেয়েও বেশি হাসছেন । ‘ওরা আমাকে বাচ্চা ছেলে ভাবছে’ – কথাটা মনের মধ্যে তারাক করে উঠলো ।
‘না না, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার, অনেক্ষণ হয়ে গেলো’, উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন তিনি, ‘আমাদের বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে । আমি মনে করি মানবিকতাই হচ্ছে প্রধান বিষয় । মনে রাখতে হবে যে তারাও মানুষ । মানবিকতাতেই সবকিছু বেঁচে থাকে, ঠিকিঠাক টিকে থাকবে...’ ।
যেখানে সেমিওন ইভানভিচ বসেছিলেন সেখান থেকে একটা হাসির শব্দ শোনা গেলো, ‘হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ !’
‘তবে আমাদের এত ধমক দিচ্ছেন কেন, বলুন তো ?’ হাসির প্রত্যত্তরে অবশেষে প্রতিবাদ করে উঠলেন স্তেপান নিকিফরভিচ । ‘সত্য বলছি ইভান ইলিয়িচ, আপনি কি বলতে চাইছেন ঠিক ধরতে পারছি না । আপনি মানবিকতার কথা বলছেন । তার মানে আপনি কি মানবপ্রেমের কথা বলছেন ?”
‘মানে, হ্যা তাই, মানবপ্রেমের কথাও বলতে পারেন । আমি...’
‘আরে, দাঁড়ান দাঁড়ান । যা বলছেন বলে মনে হচ্ছে আসলে ব্যাপারটা ততটা সহজ নয় । মানব প্রেমের কথাটা চিরকাল বলা হচ্ছে । কিন্তু সংস্কারের বিষয়টা সেখানেই আটকে নেই । কৃষক প্রশ্ন তোলেন, আদালত, অর্থনীতি, ক্ষতিপূরণ, মামলা, নীতি আদর্শের কথা... একরাশ প্রশ্ন উঠে আসে সর্বত্র । সব নিয়ে একটা তালগোল পাকানো অবস্থা । একটা দ্বিধা-দন্দময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এতে । আমি তাই এই ভাবনাটিকে মুখ্য ধরছি না, শুধু মানবিকতার প্রশ্নই নয়...’
‘হ্যা, ব্যাপারটা আরো গভীর।‘ মন্তব্য করলেন সেমিওন ইভানিচ ।
‘আমি এই বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, মাফ করবেন সেমিওন ইভানিচ, বোঝবার ক্ষমতা আমার আপনার চেয়ে কম নয়,’ ইভান ইলিয়িচ বললেন বাঁকা করে, গলার স্বর অযথা রূঢ়, ‘আপনাকেও বলি স্তেপান নিকিফরভিচ, আপনিও আমায় ঠিক বুঝতে পারছেন না...’
‘তা পারছি না’ ।
‘তবু আমি সমর্থন করে যাচ্ছি এবং নিষ্টা নিয়ে অনুসরণ করে যাচ্ছি এই আইডিয়াটা যে মানবিকতা - বিশেষ করে অধস্তনদের প্রতি মানবিক আচরণ, উচ্চপদস্ত আমলা থেকে সাধারণ করনিক, কেরানি থেকে বেয়ারা, বেয়ারা থেকে চাষা- সকলের প্রতি মানবিকতাই হবে, বলা যেতে পারে, ভবিষৎ সংস্কার আর সাধারণভাবে সবকিছুর নবায়নের বুনিয়াদ । কেন? কারণ এই, ধরুন এই ব্যাপারটা ঃ আমি মানবিক - সুতরাং লোকের আমার ওপর বিশ্বাস আছে, আমাকে তারা ভর্সা করে । ভর্সা আছে তাই তাদের ভালোবাসাও পাচ্ছি । এই কথার বয়ানে আমি আসলে বলতে চাই যে লোকে যদি ভর্সা পায় তাহলে তাদের সংস্কারের উপরেও ভর্সা আছে, এই পরিবর্তনের মর্মবস্তু সম্পর্কে তাদের ধারনা থাকবে । বলা যেতে পারে যে এভাবেই একটা নীতিগত সখ্য গড়ে উঠবে এবং সবকিছুরই মীমাংসা হবে সহমতের ভিত্তিতে, আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে । এতে অমন হাসির কি আছে সেমিওন ইভানভিচ? কথাটা পরিস্কার করে বুঝাতে পারলাম কি?’
স্তোপান নিকিফরভিচ নীরবে মাথা তুললেন । একটু অবাক লাগছে তাঁর ।
‘আমি বোধ হয় একটি বেশীই মদ খেয়ে ফেলেছি’, তির্যক মন্তব্য করলেন সেমিওন ইভানভিচ, ‘তাই ঠিক ধরতে দেরি হচ্ছে । মাথাটা খানিকটা ঝিম ঝিম লাগছে ।’
ইভান ইলিয়িচের একেবারে খাবি খাওয়ার দশা ।
একটু ভেবে নিয়ে স্তেপান নিকিফরভিচ হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এসব চালানো যাবে না’ ।‘’
‘চালানো যাবে না বলে কী বলতে চাইছেন?’ স্তেপান নিকিফরভিচের আচমকা এই আলপটকা মন্তব্যে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ইভান ইলিয়িচ ।
‘আমরা ঠিক এই পথে চলতে পারবো না’ । বোঝা গেল ব্যাখ্যা করে বলার বিশেষ আগ্রহ তাঁর নেই ।
‘এটা আপনার নতুন মদের পুরোনে পাত্রে ঢালার ব্যপার নয় । (এখানে ‘মশক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে বাইবেলের সূত্র ধরিয়ে, নতুন মদ পুরোনো পাত্রে ঢালে না’) একটু ব্যঙ্গের স্বরে বললেন ইভান ইলিয়িচ, ‘আজ্ঞে না মশাই, অন্তত আমি সেটা চালাতে পারব’ ।
ঠিক তখনই ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজার সংকেত এলো ।
‘অনেকক্ষণ আমাদের একসঙ্গে সময় কাটলো, এবার উঠতে হয়’, চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন সেমিওন ইভানভিচ । কিন্তু ইভান ইলিয়িচ তার আগেই চটপট চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ম্যান্টেলপিস থেকে তাঁর ফারের টুপিটা তুলে নিলেন । কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছিলো তাকে, মনটা কিছুটা আহত ।
‘তাহলে সেমিওন ইভানভিচ, একবার ভেবে দেখবেন ?’ অতিথিদের বিদায় দেবার সময় বললেন স্তেপান নিকিফরভিচ ।
‘বাড়ির ব্যাপারটা তো? হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেবে দেখবো ।’
‘কী ঠিক করলেন সেটা তাড়াতাড়ি আমাকে একটু জানাবেন’ ।
‘সবসময় আপনার মাথায় কাজের কথাই থাকে, তাই না?’ হাতের টুপুটা তুলে নিয়ে একটা আনুগত্যমাখা ভঙ্গী করে কথাগুলো বললেন প্রালিনস্কি । তাঁর মনে হচ্ছিলো, সে যে রয়েছেন সেটাই সবাই ভুলে গেছেন ।
স্তেপান নিকিফরভিচ ভ্রু তুললেন, কিন্তু কিছু বললেন না, যেন দেখাতে চাইলেন অতিথিদের তিনি দেড়ি করাতে চাইছেন না । সেমিওন দ্রুত বিদায় নিলেন ।
‘খুব ভালো... সাধারণ সৌজন্য বোধও যখন আপনাদের নেই...’ মনে মনে ভাবলেন প্রালনস্কি এবং প্রায় স্পর্ধার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন স্তেপান নিকিফরভিচের দিকে ।
বারান্দায় এসে ইভান ইলিয়িচ তাঁর হালকা মূল্যবান ফারের কোটটি গায়ে চাপাতে লাগলেন, ভাব করলেন যেন সেমিওন ইভানভিচের জীর্ণ রেসুনের লোমের ওভারকোটটা তাঁর চোখে পড়ছে না । অতঃপর দুজনেই নামতে লাগলেন সিঁড়ি বেয়ে ।
চুপ করে থাকা ইভান ইলিয়িচের উদ্যেশ্যে বললেন, ‘বুড়ো একটু চটেছেন মনে হচ্ছে’ ।
‘আরে না । কেন এমন মনে হচ্ছে?’ ঠান্ডা ও নির্বিকার গলায় সেমিওন বললেন ।
‘একেবারে চাটুকার !’ মনে মনে ভাবলেন ইভান ।
গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন ওঁরা সবাই । সেমিওন ইভানভিচের ঘোড়ার গাড়িটা এসে থামলো । খুব সাদামাটা একটা ধুসর রঙের মামুলী ঘোড়ার গাড়ি ।
‘শালার ব্যাপার কী ! আমার গাড়িটার কি হাল করেছে ত্রিফোন ?’ নিজের গাড়িটা কোথাও দেখতে না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ইভান ইলিয়িচ ।
এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন তিনি, কিন্তু গাড়িটার হদিস নেই । স্তেপান নিকিফরভিচের খানসামাটাও কোনো খবর দিতে পারলেন না । জিজ্ঞাসা করা হল সেমিওন ইভানভিচের কোচয়ান ভার্লামোকে । সে জানালো যে ইভান ইলিভিচের গাড়ি আর কোচয়ান সারাক্ষণ সেখানেই ছিল, কিন্তু এখন কোথায় সেটা বলা যাচ্ছে না, দেখাও যাচ্ছে না ।
‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক কান্ড!’ শিপুলেংকো বললেন, ‘আমার গাড়িতে আসবেন কি?’
‘কী বদমাইস একেকটা লোক’, ক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রলনস্কি, ‘ছুটি চাইছিল কুকুরের বাচ্চাটা, কোন এক বিয়ের নেমন্তন্যে যাবে, এই পিটার্সবুর্গ এলাকাতেই তার কোনো এক প্রিয়বন্ধুর বিয়ে, শালার মরণও হয় না । পইপই করে বলেছিলাম, ছুটি হবে না । তবুও আমি বাজি ধরে বলছি, সে সেখানেই গেছে’ ।
‘সেখানেই গেছে’, ভার্লাম বললেন, ‘ওখানেই গেছে । বলছিলো যে সে মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসবে । আর বলছিল যে আপনারা ফিরে আসার আগেই সে ফিরে আসবে’ ।
‘দেখলেন তো ! আমি ঠিক জানতাম সে ওখানেই যাবে । দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজাটা’ ।
‘আচ্ছা করে দুতিন ঘা দিলেই বেটার মনে থাকবে কিভাবে হুকুম মানতে হয় !’ বলতে বলতে গাড়ির মধ্যে ঢেকেডুকে বসলেন সেমিওন ইভানভিচ ।
‘সে আমি দেখে নেবো, আপনাকে তা নিয়ে ভাবতে হবে না ইভানভিচ’ ।
‘তাহলে আপনি আসছেন না! আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারতাম ‘ ।
‘শুভ রাত্রি ! ধন্যবাদ’
সেমিওন ইভানভিচ গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন । ফুটপাথের ওপর দিয়ে ইভান ইলিয়িচ পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করলেন । মেজাজ ভয়ানক খারাপ তাঁর ।
‘দাঁড়া না তোকে দেখাচ্ছি মজাটা, হারামজাদা !’ তোর ওপর রাগ করে এই ফুটপাথ দিয়েই আমি হেটে যাবো, একটু বুঝুক ও, ভয় পাক । ফিরে এসে শালা শুনবে তাঁর মনিব পায়ে হেটেই ফিরে গেছেন ।’
এরকম ভাবে গালাগালি ইভান ইলিয়িচ এর আগে কোনোদিন করেন নি ! কিন্তু এবার সত্যিই তিনি খুব ক্ষেপে গেছেন । তাছাড়া মাথাটও বেশ ঘুরছিল । খুব একটা মদ খান না তিনি, পাঁচ ছয় পেগেই বেশ ধরেছে । কিন্তু রাতটা ছিল সুন্দর, হালকা তুষার পড়ছিলো, এরওপর চারদিক শুনশান, অস্বাভাবিক শান্ত । তার ভরা ঝকঝকে আকাশ । পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ধরিত্রী ভিজে উঠছে এক রূপালি আলোয় । বাইরেটা এত চমৎকার যে পঞ্চাশ পা যাবার পরেই ইভান তাঁর সেই দুর্ঘটনার কথাটা প্রায় ভুলেই গেলেন । অসম্ভব একটা স্বাচ্ছন্দবোধের অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো । তাছাড়া একটু নেশাও ভেতরে কাজ করছিলো, নেশা হলে মানুষের মেজাজটাও বদলাতে থাকে । হাটতে হাটতে দুপাসের জীর্ণ বাড়িগুলো দেখছিলেন, কাঠের সেই বাড়িগুলোর মধ্যেও একটা সৌন্দর্য খুজে পাচ্ছিলেন তিনি ।
হাটতে হাটতে তিনি মনে মনে ভাবছিলেন যে ‘পায়ে হেঁটে এই আসাটা তো ভালোই হল’ । ‘ত্রফোনের একটু শিক্ষা হবে, আর আমার পক্ষে তো আনন্দই । আরো বেশি হাঁটা উচিত আমার । বলশয় প্রসপেক্টে একটা গাড়ি পেয়ে যাব ঠিক । কী চমৎকার রাত ! কেমন ছোট ছোট বাড়িগুলো । এতে যারা থাকেন তারাও নিশ্চই সমাজের সেই অংশের মানুষ, সামাজিক অবস্থানে যারা কিছুটা পিছিয়ে, সেই সব কেরাণি বা ছোট ব্যবসায়ী । কিন্তু এই স্তেপান নিকিফরভিচ লোকটা ! কী সব একএকটা রিয়াক্সনিস্ট মানুষ এঁরা ! পুরোনো কাপড়ের মতো... । তবে খুব ধূর্ত মানুষটা । সময়োপযোগী কান্ডজ্ঞান রাখেন তিনি, সাংসারিক জ্ঞান রেখে তালমিল বজায় রেখে চলেন । কিন্তু বুড়োর দল, এই একদল বৃদ্ধ ! এদের মধ্যে সেই জিনিষটারই অভাব... যাকগে... চালু রাখা যাবে না, মানেটা কি? বলার আগে একবার আবার ভেবেও দেখেছিলাম । আমার অবশ্যই মন বলছে তিনি বুঝতেই পারেন নি ! না বুঝে উপায় আছে? বোঝার চেয়ে না বুঝে থাকাই ভালো । সবচেয়ে বড় কথা, আমার বিশ্বাস, একটা দৃঢ় প্রত্যয় এসে গেছে । মানবিকতা.... মানুষের প্রতি ভালোবাসা । মানুষকে তার নিজের কাছে ফিরিয়ে আনা ... ব্যক্তি মানুষের ভেতরের গুণগুলোকে জাগিয়ে তোলা, তারপর... তৈরি সামগ্রী নিয়ে আবার পুনঃউদ্যমে শুরু করা । এবার আশা করা যায় বিষয়টা পরিষ্কার হলো । আজ্ঞে হ্যা, এই যুক্তিটাও রাখা যায় যে, কোনো একদিন একজন দরিদ্র কেরাণির সঙ্গে দেখা হল । ‘কে তুমি”, । উত্তর এলো, ‘কেরানি’ । কোন অফিসের, কি কাজ ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও সেভাবেই কিসের কাজ কোথায় কাজ উত্তরে জানালেন ।
‘কাজ করো তুমি?’
‘করি’ ।
‘সুখি হতে ইচ্ছে করে তোমার?’
‘হ্যা, অবশ্যই সুখি হতে চাই’,
‘ তুমি কি পেলে সুখী হবে?’
‘আমার সুখের জন্য এই এই প্রয়োজন’ ।
‘কেনো?’ কারণ দুটো কথাতেই লোকটি বুঝিয়ে দিতে পারবেন । লোকটা তখন আমার কথার জালে জড়িয়ে পড়েছেন । তাকে নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি, মানে তার ভালোর জন্য যা যা দরকার । যাচ্ছেতাই মানুষ এই সেমিওন ইভানিচ ! কী বিচ্ছিরি তার মুখটা ! আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘দু ঘা দিয়ে দিন না লোকটাকে’ । আরে না, না তা হবে না , ধোলাই দিতে হয় আপনি দিন, আমি ওসবে নেই ! ত্রিফোনকে আমি শায়েস্তা করবো অন্য ভাবে, ওকে শাসন করে । ওকে শায়েস্তা করবো এমন ভাবে যে সে তা বুঝতে পারবে, দেখে নেবেন । আর শাস্তির বিষয়টা – হ্যা, এখনো এই সমস্যাটার সমাধান হয় নি । হ্যা... মাদমোয়াজেল এমেরাস-এর কাছে গেলে কেমন হয়? কথা বলতে বলতে হোচট খেলেন তিনি, ‘ধুত্যোরি, এই পাটাতনের পেভমেন্ট!’ রাগত ভাবে বললেন, ‘এই নাকি আমাদের রাজধানির অবস্থা! উন্নয়নের পথে! এক্ষনি আমার পাটা ভেঙেছিলো আরকি!’ ‘হ্যা, ওই সেমিওন ইভানিচ লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারি না – জানোয়ারের মতো মুখটা মনে হয় ! – নীতির কথা উঠলেই কেমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে । কিন্তু এটাই যদি হয় তবে আপনার কি যায় আসে? আমি তো আপনার সঙ্গে গলাগলি করতে যাচ্ছি না । কোলাকোলি বরং এক চাষার সঙ্গে করবো... কোনো কৃষকের সঙ্গে দেখা হলে তাকে দাঁড় করিয়ে কথা বলবো । নেশার ঘোড়ে হয়তো আমি গুছিয়ে বলতে পারিনি সে কথা । এখনো হয়তো সেভাবে স্বাভাবিক হই নি । হ্যা, আর এমন করে মদ খাবো না । মদ খেলেই সমানে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এর পরের দিন আফসোস হয় । তবে আমি তো সোজা দাঁড়িয়েই আছি । কিন্তু, এ কথাটা ঠিক যে, ওরা সবাই একএকটা হারামজাদা ।”
তাজা বাতাস বইছিলো তখন, পেভমেন্টের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই সমস্ত ছোট ছোট ঘটনার কথা মনে করে নিজেই নিজের সঙ্গে তর্ক করছিলেন ইভান ইলিয়িচ । এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্তি তাঁকে ঘিরে ধরতো, চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছিলো । কিন্তু বলশয় প্রস্পেক্টের পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগেই তিনি কোথাও গানের সুর শুনতে পেলেন । চারদিকে তাকালেন, রাস্তার ওপারে একটি ভয়ানক জীর্ণ কাঠের বাড়ি, লম্বা একতলা একটি বাড়ি । সেখান থেকে আনন্দ-ফুর্তির শব্দ আসছিলো । একটা উচ্ছল সুর সেখান থেকে আসছিলো, বেহালায় ‘ডাবল –বাস’ বাজছিলো, সঙ্গে বাঁশিতে একটা মিহি সুর বাজছিল । জানালার সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে, তাঁদের মধ্যে মেয়েরাই সংখ্যায় বেশী । গায়ে হাল্কা গরম জাম, মাথায় রুমাল বাঁধা, তারা জানালার খড়খড়ির ফাক দিয়ে ভেতরের আনন্দ উৎসব দেখতে চাইছে । বোঝা যাচ্ছে ভেতরে তুমুল ফুর্তি চলছে । রাস্তার এদিক থেকেই ভেতরের নাচের উদ্দাম পদশব্দ শোনা যাচ্ছিল। একজন পুলিশ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ইভান তাকে দেখে এগিয়ে গেলেন । গায়ের দামী ওভারকোটটার বোতাম খুলে বুকের জামায় লাগানো সরকারি গুরুত্ত্বপূর্ণ পদকগুলো বের করে সেদিকে এগিয়ে গেলেন ।
‘মশাই, এটা কার বাড়ি বলতে পারো ?’
“সরকারী কর্মী পেসলদনিমভের বাড়ি – উনি একজন রেজিস্টার,’ সোজা দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো পুলিশটি । বুকের পদকটা এর মধ্যেই সে দেখে নিয়েছিলো ।
“পেসলদনিমভ?’
‘হুঁ ! পেসলদনিমভ!’
‘... কি হচ্ছে? বিয়ে নাকি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, উনি বিয়ে করছেন টিটূলার কাউন্সিলারের মেয়েকে । টিটুলার কাউন্সিলার ম্লেকোপিতায়েভ.... কাজ করতেন মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলে । বাড়িটা কনের পক্ষে পড়েছে ।”
“ও! বাড়িটা তবে এখন পসেলদনিমভের, ম্লেকোপিতায়েভের নয় ।”
“হ্যা হুজুর ।”
“আমি এই কথা কেনো জানতে চাইছি জানো? পসেলদনিমভ যে অফিসে কাজ করেন আমি সেই অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্তা ।”
“জী হুজুর !” এই কথা বলে সেই পুলিশটি আরো সোজা হয়ে দাঁড়ালো ।
এই সময় অদ্ভূত কিছু ভাবনা ইভানের মাথায় এলো । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সব ভাবতে লাগলেন । এই পসেলদনিমভ তাঁর অফিসেরই একজন স্বল্প বেতনের অধঃস্থন কর্মী, মাসে দুশ রুবল পায় । সাথী প্রালিনস্কই এই অফিসের দায়িত্ব পেয়েছেন খুব সম্প্রতি, তাই তাঁর পক্ষে অধঃস্থনদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব নয় । কিন্তু এঁকে বিশেষভাবে মনে আছে তাঁর অদ্ভূত নামের জন্য । নামটা শুনেই ব্যক্তিটির প্রতি আগ্রহ জন্মেছিলো । এখন মনে পড়ছে, অল্প বয়স, শকুনের মতো টিকালো নাক, শুষ্ক ঝাকড়া চুলের রোগা মানুষটা । দেখেই মনে হয়েছিলো তাকে কিছু টাকা দিয়ে দেয় চেহারাটাকে একটু ভদ্রস্থ করতে । কিন্তু লোকটার মুখচোখ এতটাই নিরস ও রুক্ষ বিরক্তি মাখানো যে সেই ইচ্ছাটাও মিলিয়ে গিয়েছিলো । ইভান ইলিয়িচ আরো অবাক হলেন যখন গত সপ্তাহে এই পসেলদনিমভ তার বিয়ের অনুমতি চাইতে এলেন তাঁর কাছে, কারন সেই সময় বড় কর্তার অনুমতি লাগত বিয়ে করতে গেলে । কাজের ব্যস্ততায় ইভান ইলিয়িচের এই বিষয়টি নিয়ে সেদিন মনোযোগ দিতে পারেন নি, একবার চোখ বুলিয়েই দ্রুত বিষয়টি ছেড়ে দেন । সেদিনই জেনেছিলেন পসেলদনিমভ বিয়েতে বৌয়ের সঙ্গে পাবে একটা কাঠের বাসা ও নগদে চারশ রুবল । ম্লেকোপিতায়েভ ও পসেলদনিমভ , এই দুটোই অদ্ভূত নাম, এই নিয়ে হাসি ঠাট্টাও হয়েছে তাদের মধ্যে সেদিন । প্রথম নামের অর্থ ছদ্মনাম আর দ্বিতীয়টির মানে স্তন্যপায়ী ।
সবকিছুই ইভানের মনে পড়ছিলো ধীরে ধীরে । আর এই করনে আবার গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন । অনেক বড় বড় চিন্তা মনে দ্রুত এসে যায়, একটা অনুভূতি হয়ে আসে এগুলো, সাহিত্যের ভাষায় নয়, সাধারন মানুষের মুখের কথাও নয় এই চিন্তাগুলো । এই ভাবনাগুলো আমাদের পাঠকের সামনে রাখা হবে, তাঁরা এই ভাবনার গভীর শেকড়ের কাছে যেতে পারবেন । সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় আমাদের অনুভূতি বললে তা অনেক সময় অবিশ্বাস্য লাগবে । এই কারনের সাধারণ মানুষের অনেক চিন্তাই সকালের আলো পায় না, যদিও অনুভূতির সঞ্চারণ হয়ে যায় তবুও । ইভান ইলিয়িচার চিন্তা ভাবনা কিছুটা অসংলগ্ন ও এলোমেলো, এর কারণ আমাদের জানাই আছে ।
মনে মনে ভাবছিলেন ইভান ইলিয়িচের, ‘ব্যাপারটা দেখো তবে, আমরাতো শুধু কথা আর কথা দিয়ে জগত শাসন করি, কাজের বেলা কিচ্ছুটি নয় । আর এই পসেলদনিমভকে ! যেনো আলোর মঞ্চ থেকে নেমে এসেছে... জীবনকে সুখের আলোয় ভড়িয়ে দিয়েছে... জীবনের একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ দিন তার কাছে আজ... অতিথিদের আপ্যায়ন করছে আন্তরিক ভাবে । আচ্ছা এমন যদি হয় যে সে আমার উপস্থিতি জানতে পেরে যায়! আমি, তার উপরওয়ালা । অফিসের বড় কর্তা তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ভেতরের উৎসবের গান শুনছি । এটা জানলে সে কি করবে? আমি যদি সোজা বাসার ভেতরে চলে যাই তবে সে কি করবে?’ এসব ভাবতে ভাবতে সে আবার ভাবলো, ‘বোধহয় আমি গিয়ে তাদের আনন্দের ব্যাঘাত করবোই, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে... অন্য কোনো জেনারেল গেলে সেটাই হবে... কিন্তু আমি গেলে নয়...’।
মনে মনে তাঁর সেই বন্ধু অতিথির প্রতি বললেন, ‘স্তেপান, আমায় আপনি বুঝতেই পারেন নি । এই দেখুন, আপনার সামনে একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ’ । মানবিকতা নিয়ে আমরা চেঁচামেচি করে আসর গরম করি কিন্তু বাস্তবে কিছু করতে আমাদের দম নেই ।
এই ‘দম’ বলতে কী বুঝাতে চাইছি? সোজাসুজি ভেবে দেখুন, আমাদের সমাজের অন্যান্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে ! এই মাঝ রাত্রির পরে আমারই এক অধস্তন কর্মচারি, নূন্যতম আর্থিক বেতনভোগীর বাসার বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া – এক পাগলামির মতো মনে হচ্ছে, একেবারে যাচ্ছেতাই, সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত পাম্পেই নগরের শেষ দিনের প্লাবনের দৃশ্যের মতো । কেউ কিছু বুঝেই উঠতে পারলো না । স্তেপান নিকিফরভিচেরা এসব বুঝবেও না । ও তো বললোই যে আমি পারবো না, ধুর, পারবে না তো তোমরা, বৃদ্ধেরা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত গতানুগতিকেরা । আমি পারব ! পাম্পেইএর শেষ দিনের মতো ধ্বংসের প্লাবনের মধ্যেও আমি কাজ করে থাকবো । আমার অধঃস্থনদের জন্য আনন্দের দিন নিয়ে আসবো, আমার এই কাজ কে পাগলামো ভাবা হোক, তবুও আমি এঁকে পিতৃসুলভ কাজ বলেই মনে করবো । কেমন করে? তবে শুনুন...
ধরুন, আমি এই বাসায় ঢুকলাম । ওরা সবাই অবাক হয়ে যাবে, নাচগান বন্ধ করে দেবে, সবাই হা করে তাকিয়ে থাকবে আর পিছু হটবে । আমি ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবো । মুখে একটা স্বাভাবিক হাসি রেখে আমি পসেলদনিমভের দিকে এগিয়ে যাব । তাঁকে বলবো যে আমি গিয়েছিলাম স্যার স্তেপান নিকিফরভিচের সঙ্গে দেখা করতে । কাছাকাছিই থাকেন তিনি, তুমিও হয়তো চেনো সেটা । এরপর ত্রিফোনের ঘটনাটা বলবো, আমার হেঁটে আসার বর্ণনা দেবো তাকে । হাঁটতে হাঁটতে গানের আওয়াজ শোনার কথা বলবো । স্থানীয় পুলিশ বললো তোমার বিয়ে হচ্ছে । ভাবলুম, আমার অফিসের অধঃস্থনের বাড়ি, গিয়ে দেখি তারা কেমন আনন্দ ফুর্তি করে... তাদের বিয়েতে কেমন উৎসব হয় । বলবো, আমায় তাড়িয়ে দেবে না নিশ্চয় ! আমার ধারণা যে তাড়ানো তো দূর প্রাথমিক অবাক হওয়ার রেশ কাটিয়ে ওরা আমার জন্য আরাম কেদারা আনতে ছুটবে ।
আপনারাই বলুন, এর থেকে ভালো কি হতে পারে? কি জন্যে এসেছি সেটা মুখ্য নয়, যেটা ঘটলো সেটাই মুখ্য । এটাই মানবিক ধর্ম ।
ওহ! কি যেনো ভাবছিলাম এতক্ষণ ! ও, হ্যা, মানে, এরপর তারা আমায় নিয়ে গিয়ে মান্যগণ্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে । ওদের আত্মীয় ধরনের একজন লাল কোট ওয়ালা এক ক্যাপ্টেন পাশে তাঁকে বসাবে । গোগলের চরিত্রেরা অনেকেই হাজির মনে হচ্ছে এই অনুষ্ঠানে । পাত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল তাঁকে । আমি কনের প্রসংশা করলাম, এরপর অথিতিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করা হল । বললাম , দ্বিধার কারন নেই, আনন্দ করো, নাচ গান চলুক । এসব বলতে বলতে আমরা ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে লাগলাম, মোটের উপর নম্র আচরণে তাদের মনের দখল নিলাম । মন ভালো থাকলে অবশ্য চিরকালই ভালো ব্যবহার করি । আমি মাতাল না হলেও একটু মস্তিতে আছি আজ ।
ভদ্রলোকের মতো তাঁদের সঙ্গে সমানতালে আড্ডা চললো আমার, আলাদা কোনো সম্মানের চাহিদা রাখিনি , নৈতিকতার বিষয়টা যাই হোক । তাঁরা আমাকে বুঝবে, আমার প্রশংসা করবে… আমার ব্যবহারে তাঁদের মনেও মহানুভবতা জেগে উঠবে । এর পরেও আধা ঘণ্টার উপর তাঁদের সঙ্গেই কাটালাম । নৈশ ভোজের আগেই সেখান থেকে চলে আসার কথা ভাবলাম । ভাবলাম যে আমার চলে যাওয়ায় তাঁরা ব্যস্ত হয়ে উঠবে, আমাকে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করবে । আমি মাত্র এক পেগ পান করে চলে আসবো, নৈশ ভোজে অংশ নেবো না, বলবো যে আমার জরুরী কাজ আছে । একথা শুনে তাঁরা বিনম্র ভাবে সম্মতি জানাবে । এই কথার মধ্য দিয়ে আমার এই বার্তাটাও পৌঁছবে যে আমি তাঁদের থেকে ভিন্ন উচ্চতায় আছি । নৈতিক দিক থেকেও এই বার্তাটি দেওয়া দরকার । এর সঙ্গে সঙ্গেই আমি হেসে উঠবো, আমার হাসি মুখ দেখে তাঁরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে...। কনের সঙ্গেও হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠবো । হাল্কা ভাবে বলবো যে ন মাস পরে নবজাতকের ধর্মবাপ হিসাবে আবার আসবো । ততদিনে একটা সন্তানের খবর হবে নিশ্চয়ই । খরগোশের মতো এরা বংশ বৃদ্ধি করে । এই কথায় সবাই হেসে উঠবে, লজ্জ্বায় লাল হয়ে উঠবে কনের মুখটা । আশীর্বাদ হিসাবে কনের কপালে চুম্বন দেবো । পরের দিনই অফিসে আমার এই মহানুভবতার গল্প ছড়িয়ে যাবে । অফিসে আমি দৃঢ় ও কড়া ধাতের অফিসার, যাকে বলে অটল ও কঠিন, কিন্তু আমার ভেতরের ব্যক্তিটি কেমন তা নিয়ে চর্চা হতে থাকবে । আমার মনটাকে বুঝছে তারা, আমার দাম বেড়ে যাবে তাঁদের কাছে । তাঁরা বলবে, অফিসের কর্তা হিসাবে কড়া - কিন্তু মানুষ হিসাবে দেবতা । এভাবেই আমি জিতে যাবো । আমার অনুগত হয়ে যাবে সবাই । আমাকে সবাই অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে, মাননীয় স্তেপান নিকিফরভিচ, আপনার পক্ষে কি এমন হওয়া সম্ভব হতো? ভেবে দেখুন...
ভেবে দেখুন... জেনে রাখুন... পসেলদনিমভ তার ছেলেপেলের কাছে গল্প করবে কী ভাবে স্বয়ং জেনারেল এসে তাঁদের আনন্দানুষ্টানে যোগ দিয়েছেলেন । তাঁদের বাবার বিয়েতে এসে সবার সঙ্গে মদ্যপান করেছিলেন । তাদের ছেলেরা ছেলের সন্তানদের কাছে গল্প করবে । এভাবেই একটা ঐতিহ্যের গল্প তৈরি হবে, কিভাবে একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক, একজন রাষ্ট্রনেতা (আমি নিশ্চই ততদিনে রাষ্ট্রনেতা হয়ে যাবো) তাদের পূর্বপুরুষকে ধন্য করেছিলেন... একজন নিচু তলার কর্মীকে আমি এভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ করে দিলাম । মাত্র দুশ রুবল মাইনে ছিলো... বারে বারে এই কথা বলতে থাকলে সবাই আমার নাম করবে... প্রত্যকের মনেই এই কথাটা দাগ কাটবে । এর ফলে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়াবে সেটা ওরা কি জানে?
ইভান ইলিয়চের মনে এমন নানা কথা ঘুরতে থাকলো অনেক্ষণ । মানুষ নিজের মনে কত কি ভাবে ! বলা বাহুল্য নয় যে এই স্বপ্নচারণে মানুষের একটা অদ্ভূত তৃপ্তি জাগে । মনে মনে সেই তৃপ্তির আস্বাদন নিয়ে ও স্তেপান নিকিফরভিচকে ধিক্কার দিতে দিতে শান্তভাবে তিনি বাড়ি ফিরে ঘুমানোর কথা ভাবছিলেন । কিন্তু তখন দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি অপ্রাকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিলেন । আর তাঁর মনে ভেসে উঠলো স্তেপান নিকিফরভিইচ আর সেমিওন ইভানভিচের মুখ, আত্মতৃপ্তি মাখা মুখ । অনুগ্রহের ফিচেল হাসি মাখানো স্বরে সে বলছে, ‘চালু রাখা যাবে না’ । এর সঙ্গে সেমিওন ইভানভিচ একটা অসহ্য হাসি দিয়ে সমর্থন যোগাচ্ছিলো ।
‘দেখা যাবে, এটা চালু থাকে কিনা!’ আরো দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ইভান ইভানভিচ, আরক্ত মুখের পেশী এই কথার সঙ্গে তাঁর দৃঢ়তা আরো প্রকাশ করলো । পেভমেন্ট পার হয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন তাঁর অধঃস্তন কর্মী, রেজিস্টার পসেলদনিমভের বাসার দিকে ।
দুষ্টু গ্রহের তারনায় সে সগর্বে হেটে সেই বাড়ির বেড়ার গেটটা খুলে হেঁটে পার হলেন । পায়ের সামনে পড়ে থাকা একটা ঘেয়ো কুকুরকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলেন । আঘাত করার জন্য নয়, কুকুরটা তাঁর পায়ের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো । কাঠ বোর্ডে বানানো রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে গেলেন বারান্দার দিকে । উঠানের উপর সেটি একটি ঘুমটি ঘরের মতো লাগছিলো । কাঠের ভাঙ্গাচোরা তিনিটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে, বাড়ান্দায় উঠে গেলেন তিনি । এক কোণে মৃদু আলো নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বলছিলো । সেই আলোতে পা বাড়িয়ে দিতে আসুবিধা হলো না ইভান ইলিয়িচের, একটা মাংসের জেলি মতো কিছু ও গালেশ টালোশ ছিলো । কৌতূহলী হয়ে সে একটু ঝুকতেই দেখলেন আরো দুটো থালায় কী সব রাখা আছে , তাছারা আরো দুটো খাদ্য - সম্ভবত ব্লামেজ । পঁচে যাওয়া জেলীর মতো জিনিষটা চোখে পড়তেই কিছুক্ষণ হতবম্ব হয়ে গেলেন তিনি । মনে মনে ভাবলেন এখান থেকে পালানোই শ্রেয় । কিন্তু ভেবে স্থির করলেন যে পালানোটা কাপুষোচিত ঘটনা । কেউ তাঁকে দেখেনি, সন্দেহও করতে পারবে না এমন ভেবে তিনি গালোসটি মুছে ফেলে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলেন ফেল্ট মোড়া দড়জার দিকে, দড়জা খুলে পৌঁছলেন একটা ছোট বারান্দায় । বারান্দার অধিকাংশ জুড়ে পড়ে আছে ওভারকোট, ম্যান্টেল, ক্যাপ, টুপি, বলেট, মাফলার আর গালোশ । বাকী অর্ধেকটা বাজনাদারদের দখলে, তাদের দুটি গীটার একটা বাঁশি আর একটা ডাবল বাস । সব সমেত চারটি লোক সেখানে, চেহাড়া দেখে তাদের রাস্তা থেকে তুলে আনা মনে হয় । একটি রংচটা টেবিল, টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে । মোমবাতি ঘিরে সেই মানুষগুলো আপ্রাণ চেষ্ঠায় কোয়াড্রিলের অন্তিম পর্বের তান ধরেছে । সামনের খোলা দড়জা দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়, সেখানে ধুলো আর তামাকের ধোঁয়ায় আবছা দৃশ্যমানতা, এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে কতগুলো নাচিয়ে নেচে যাচ্ছে । চারদিকে একটা উদ্দাম আনন্দের হুল্লোড় । পুরুষ ও মহিলাদের সবমেত চিৎকারে গমগম করছিলো যায়গাটা । পুরুষেরা ঘোড়ার খুড়ের মতো পা দিয়ে মেঝে ঠুকছিলো । এই হট্টোগোলের মধ্যেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক চিৎকার করে নাচিয়েদের হুকুম দিচ্ছিলেন । ইভান ইলিয়িচ খুব সন্তর্পনে তার ওভারকোর্ট ও হ্যাট খুলে রাখলেন, এরপর শঙ্কিত চিত্তে ভেতরে ঢুকলেন ।
প্রথমটা কেউ তাঁকে লক্ষ্য করে নি, সবাই নাচের চূড়ান্ত পর্ব নিয়ে ব্যস্ত । সেই তুমুল হট্টগোলের মধ্যে কিছুক্ষণ সে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলেন । তাঁর সামনে দিয়ে ঘূর্ণিপাক খেয়ে যাচ্ছিল নৃত্যরত মেয়েদের পোষাক । চুরুট মুখে পুরুষেরা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে । একটা আকশী ওড়না তাঁর মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেলো, একজন ডাক্তারির ছাত্র তাঁকে ধাক্কা দিয়েই পিছুপিছু চলে গেলো । সামনে পাক খাচ্ছিলো এক লম্বা সৈনিক । এই ভিড়ের জনতার সঙ্গে তালমিলিয়ে নাচতে থাকা একজন হঠাৎ ছুটতে ছুটতে তার সামনে এসে সরু গলায় চেঁচিয়ে বললো, ‘পসেলদি…’ । ইভান ইলিয়িচের পায়ের তলের মেঝেটা, যেটা নিশ্চই মোম পালিস করা হয়েছিলো, মনে হচ্ছিলো আঠালো চটচটে করছে । ত্রিশ জনের মত অতিথি ঘরটাতে, বেশ বড়সড় ঘরটা ।
মিনিট খানেক পরেই গান থেমে গেলো । ইভান ইলিয়িচের কল্পনা মতোই এরপরের ঘটনাটি ঘটলো । একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছিলো, ফিসফিস কানাকানি হতে লাগলো অতিথি ও নৃত্যরতদের মধ্যে । তখনো তারা হাফাচ্ছিলো , ঘনঘন মুখের ঘাম মুছছিলো । প্রত্যেকের মুখ ঘুরে তাকালো অতিথির দিকে । এক মূহুর্তে সবাই পেছোতে লাগলো, যারা লক্ষ করেনি তাদের পোষাকে টান দিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো । এরাও ঘুরে দেখে পিছোতে লাগলো অন্যদের মতই । ইভান ইলিয়িচ তখনো দড়জায় দাঁড়িয়ে । এক পা-ও অগ্রসর হননি । এদিকে তাঁর ও জনতার মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বড় হচ্ছিলো । যায়গাটা জুড়ে চকলেটের মোরক । হঠাৎ এক যুবক সসংকোচে এগিয়ে এলো, গায়ে তাঁর কর্মচারীর ফ্রককোট, শণের মতো ঝাকড়া চুল, বাঁকা নাক । কুঁজো হয়ে এগিয়ে এলো, যেভাবে মার খাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে থাকা কুকুরেরা এগোয় মনিবের দিকে ।
‘কেমন আছো পসেলদনিমভ – চিনতে পারছো?’ বললেন ইভান ইলিয়িচ, বলেই মনে হল ভারি আনাড়ি ও বোকার মতো কথা বলা হল ।
‘হু-হু-জুর !’ বিড়বিড় করে বললো পসেলদনিমভ ।
‘আরে, হঠাৎ করেই চলে এলাম, তুমি নিশ্চই বুঝতে পারছ…’
কিন্তু পসেলদনিমভের বোঝার মতো অবস্থা বোধ হয় ছিল না । চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো সে ।
‘তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তাড়িয়ে দেবে না ! যখন অতিথি হয়ে এসেই পরেছি, ভালো লাগুক বা মন্দ লাগুক বসতে তো দিতেই হয়!’ বললেন ইভান ইলিয়িচ । তিনি টের পাচ্ছিলেন খুব হট্টোগোল চলছে , এই চিৎকার চেঁচামেচিতে খুবই কাহিল হয়ে পড়েছেন । মুখে হাসি হাসি ভাবটা রাখতে চাইছেন, কিন্তু ক্লান্তিতে সেটা পারছেন না । যেমন ভেবে এসেছিলেন তেমন ভাবে রসিয়ে রসিয়ে স্তেপান নিকিফরভিচ আর ত্রিফোনের গল্পটা করার মুড পাচ্ছিলেন না । পরিস্থিতিটা আরো জটিল করে গৃহস্বামী মুখের সামনে কিংকত্যব্যবিমূঢ় হয়ে বোকার মতো দাড়িয়েই থাকছে । ইভান ইলিয়িচ আশঙ্কিত হয়ে উঠলেন, মনে হল, এইভাবে যদি চলতে থাকে তবে পরিস্থিতি পালটে যেতে পারে । এই কারনে উপযাচক হয়েই বললেন, ‘আমি এসে আনন্দে কোনোরকম ব্যাঘাত করলাম না তো ? তবে ফিরেই যাই !’ কন্ঠে ক্লান্তি, চিবুকের মাংসপেশি কেঁপে উঠলো ।
এই কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন পসেলদনিমভ । ‘সে কী হুজুর… আমাদের পরম সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন !’ দ্রুত অভিবাদন করে বিনিত ভাবে বললেন, ‘বসবেন না?’ বলে সোফার দিকে ঈঙ্গিত করলেন, যে সোফাটি নাচিয়েদের জন্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ।
কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সেই সোফার উপর বসলেন ইভান ইলিয়িচি । একজন দ্রুত গিয়ে টেবিলটা আবার সোফার সামনে ঠেলে নিয়ে এলো । চারদিন তাকিয়ে তিনি দেখলেন একমাত্র তিনিই বসে আছেন । অন্য সবাই দাঁড়িয়ে, এমন কি মেয়েরাও দাঁড়িয়ে আছেন । ব্যপারটা দৃষ্টিকটু লাগছিলো । কিন্তু এসব বলে স্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করার পরিস্থিতি এখন নয় । আমন্ত্রিত মানুষেরা তখনো পিছিয়ে যাচ্ছেন, সামনে বিনত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পসেলদনিমভ । তার মাথায় কিছু ঢুকছে না, একটুও হাসি নাই মুখে তার । সেই মুহুর্তে আমাদের এই ‘নায়ক’এর যা অবস্থা তাতে হারুন-অল-রসিদ’এর মত দানবীরের আসন টলে যেতো । কিন্তু হঠাৎ এক বামন আকৃতির লোক সেখানে হাজির হলো । পসেলদনিমভের পাশে দাঁড়িয়ে সে মাথ ঝুঁকিয়ে সেলাম করতে লাগলো । তাঁকে দেখে ইভান ইলিইয়িচের মনে কিছুটা স্বস্তি এলো, চিনিতে ভুল হলো না যে তিনি তাঁদের হেড ক্লার্ক আকিম পেত্রোভিচ জুবিকভ । অফিসের বাইরে এর আগে জুবিকভের সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, তবে খুব দক্ষ ও চাপা স্বভাবের কর্মী হিসাবে তাঁকে জানেন ইভান ইলিয়িচ । তাঁকে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিলেন ইভান, একটা হাত নয় দুহাতেই জড়িয়ে ধরলেন জুবিকভের হাতটা । সসম্মানে আকিম পেত্রোভিচ সে হাতদুটি গ্রহণ করলেন নিজের হাতের তালুতে । সেনাবাহিনীর জেনারেলের সম্মান রক্ষিত হলো ।
ইভান ইলিয়িচির কাছে এটা স্বস্তির যে এর ফলে তাঁকে এই ‘মহানুভবতার’ কথা বলবার জন্য আরো একজন থকছেন । তিনি তাঁর গল্প এখন সরাসরি হেডক্লার্ককে শোনাতে পারবেন । একজন পরিচিত মানুষের সঙ্গে এই নিয়ে কথাও বলা যাবে । ওদিকে তখন পসেলদনিমভ সম্ভ্রমে কুণ্ঠিত থাকুক্, এতে ঠাটটাও বজায় থাকবে । তাছাড়া গল্পটা বলা দরকার, ইভান ইলিয়িচ সেটা বুঝতে পারছিলেন যে সকলেই কিছু শুনতে উদগ্রিব হয়ে আছে, এমনকি ভৃত্যেরাও দড়জায় এসে ভিড় করছে । এদিকে হেড ক্লার্ক তখনো বোকার মতো দাঁড়িয়েই আছে । ইভান তাঁকে বসতে বলে সোফার একটা দিকে ঈশারা করলেন ।
“আজ্ঞে না, আমি এখনেই বসি...’ আকিম পেত্রোভিচ চট করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন । পেত্রোভিচ দাঁড়িয়েই রইল, শুধু ঝুকে চেয়ারটা এগিয়ে দিলেন পেত্রভিচের দিকে ।
“কী ব্যপার জানেন !’ ইভান ইলিয়িচ শুরু করলেন শুধুমাত্র আকিম পেত্রভিচকে লক্ষ করে । কথা বলতে তখনো ক্লান্ত লাগছিলো, টেনেটেনে কথা বলতে হচ্ছিল । কথাগুলোয় ‘আ’ এর উচ্চারণ ‘অ্যা’ হয়ে যাচ্ছিল, বুঝছিলেন যে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না । কিন্তু বুঝছিলেন কিছু একটা শক্তি তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে । ভেতরে একটা যন্ত্রণা টের পাচ্ছিলেন তিনি ।
‘কী ব্যপারে জানেন, আমি এসেছি নিকিফরভিচ নিকিফরভের কাছ থেকে, জানেন নিশ্চই যে তিনি এখন প্রিভি কাউন্সিল মেম্বার । “
আকিম পেত্রভিচ সসম্ভ্রমে গোটা দেহ ঝুঁকিয়ে নিল, যেন বলতে চাইলেন, কে না জানে তাঁকে ।
‘ সে এখন আমাদের প্রতিবেশী’, এক মুহুর্তের জন্য পসেলদনিমভের দিকে তাকালেন তিনি । বুঝাতে চাইলেন যে তিনি সচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক । কিন্তু পসেলদনিমভের চোখেমুখের সেই নির্লিপ্ততা রয়ে গেছে এখনো ।
“জানেন তো, সারা জীবন ধরে এই বর্ষিয়ান মানুষটা একটা নিজের বাড়ির স্বপ্ন দেখে এসেছেন... মানে, তাই বাড়ি কিনেছেন । ছোট্টখাট্টো সুন্দর এই বাড়িটা । এর উপর আজ তার জন্মদিন । আগে কিন্তু তার জন্মদিনের কথাটা জানাতেন না আমাদের, খরচের ভয়ে হয়তো !” হাসলেন তিনি, ‘কিন্তু এবার নতুন বাড়িটা কিনে এতই আনন্দ হয়েছে তার যে আমাকে আর সেমিওন ইভানভিচকে নেমন্তন্য করেছেন । চেনেন তো শিপুলেংকোকে ।‘
এক কথায় খুব আগ্রহ নিয়ে ঝুকে এলেন আকিম পেত্রোভিচ, ইভান এতে খুশিই হলেন । তবে একটা দুশ্চিন্তাও মাথায় আসছে, এই হেড ক্লার্কটা বুঝে যায় নি তো য্বে সেই এখন ইভানের ভর্সা।
‘তাই যাওয়া হলো । ছিলুম আমরা তিনজন, টেবিলের ওপর শ্যাম্পেন, কাজের কথাবার্তা হচ্ছিল... এটা সেটা নিয়ে... । সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বলতে তর্কও বেঁধে যাছিল’ ।
আকিম পেত্রোভিচ সম্মানে চোখ তুলে তাকালেন, “তবে আসলে ব্যাপারটা তেমন নয় । শেষ পর্যন্ত চলে গেলাম, বৃদ্ধ ভারি সময় মেনে চলেন, জানেনই তো বুড়ো হয়েছেন, সকাল সকাল শুতে যান । আমি তো বেড়িয়ে এলাম... কিন্তু আমার চালক ত্রিফোনকে আর কোথাও পাই না! বেশ চিন্তায় পরে গেলাম । বুঝতে পারলাম আমার দেরি হবে মনে করে সে তার বোনের নাকি কার বাড়িতে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিল । এই দিকেই, পিটার্সবুর্গের কোথাও গাড়িটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে !” কথা বলতে বলতে পসেলদনিমভের মুখের দিকে জেনারেল তাকালেন একবার । পসেলদনিমভ সেই চাহুনির সামনে অস্বস্থিতে পড়লেন । মনে মনে হয়তো সে বললো, ‘না, দরদ নেই কর্তার, অন্তঃকরণ নেই !’
‘ওহ!’ স্বগতোক্তি করে উঠলেন আকিম পেত্রোভিচ ।
অতিথিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার অবস্থাটা বুঝুন একবার! ভাবলান, ‘ভয় কিসের ?’ হেঁটেই যাবো । বলশয় পর্যন্ত গিয়ে একটা গাড়ি না হয় ধরে নেবো !” এই কথার পরিপেক্ষিতে হেসে সসম্ভ্রমে প্রতিক্রিয়া জানালো আকিম পেত্রভিচ । ফের সেই জনতার মধ্যে একটা খুশীর গুঞ্জন উঠলো । ঠিক এই সময়েই দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটি বাতি দুম করে ফেটে গেলো । কেউ একজন দৌড়ে গেলো সেটা ঠিক করতে । পসেলদনিমভও চমকে গিয়ে সেদিকে তকালেন । কিন্তু এতো কান্ডের কোনো ছাপ জেনারেলের মুখেচোখে দেখা গেলো না ।
‘হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে গেলাম… শান্ত ও সুন্দর রাত্রি । হঠাৎ কোথাও বাজনার শব্দ, পায়ের তালের ধ্বনি কানে এলো, নাচের শব্দ কোথাও । রাস্তার পুলিশের কাছ থেক জানলাম যে পসেলদনিমভের বিয়ে । তুমি যে একটা বলনাচের আয়োজন করেছো সেটা গোটা পিটার্সবুর্গের মানুষজনকে জানিয়ে ছাড়বো দেখো !” বলে তিনি পসেলনিমভের দিকে তাকালেন । আকিম পেত্রভিচ সায় দিলো, ‘হে হে , যা বলছেন স্যার !’
আগত অতিথিরা অস্থির হয়ে উঠছেন । কিন্তু এবারও পসেলদনিমভ অভিবাদন করলেও তার মুখে কোনো হাসি ছিলো না । যেনো কাঠ দিয়ে বানানো পুতুল একটা ।
‘লোকটা হাবাগোবা নাকি?’ ভাবলেন ইভান ইলিয়িচ, ‘গর্ধবটা একটু হাসতেও তো পারে ! তবে সহজেই চালানো যেতো কথাবার্তা’ । ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির লাগছিলো তাঁর । ‘তাই ভাবলাম, যাই, গিয়ে দেখে আসি । আমাকে নিশ্চই বের করে দেবে না ! পছন্দ হোক না হোক আগন্তুককে তো ডেকে বসাবে । অসুবিধায় ফেলে দিলাম হয়তো! যাই হোক, এবার তবে আমি উঠি, তোমাদের শুধুমাত্র দেখতেই এসেছিলাম ।”
সবমেত জনতার মধ্যে এই কথার পর একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেল । আকিম পেত্রোভিচ অনুগত কন্ঠে বললেন, ‘স্যারের জন্য অসুবিধা কেনো হবে?’ অতিথিদের মধ্য থেকেও সমর্থন ভেসে এলো। সবাই অনেক সহজ হয়ে উঠলো, মহিলারা আবার বসে পড়লো । আবার মজা শুরু হলো, আত্মবিশ্বাসী মহিলারা রুমাল নাড়তে লাগলেন । ম্লান বসন পরা একজন মহিলা উচু গলায় কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু সেটার জবাব দেওয়ার কথা যার সেও চুপ থাকায় তিনিও চুপ করে গেলেন । অনুষ্ঠান সমাগত পুরুষদের অধিকংশই ছাপোষা কেরাণি অথবা স্কুল কলেজের ছাত্র । এরা নিজেদের মধ্যে চোখের ভাষার আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে সহজ হতে চাইছিলো্, কেউ কেউ গলায় কাশির আওয়াজ করলো, কেউ সাথীর গায়ে চিমটি কাটলো । সত্যি বলতে কি, অনুষ্ঠানে আগতদের অনেকেরই ইতস্থাত ভাব কেটে গিয়েছিলো, কেমন একটা অশিক্ষিত আচরণ ! কেউ কেউ হয়তো মনে মনে বিরূপ হচ্ছিলেন ইভানের উপর, ‘এই লোকটা আসাতেই আমাদের আনন্দে ছেদ পড়লো’ । অফিসারটিও নিজের অস্বস্তি কাটাতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন ।
‘ওহে, তোমার পুরো নামটা কি যেন ! বাবার নাম?’ ইভান ইলিয়িচ জিজ্ঞাসা করলো পসেলদনিমভকে ।
‘পরফিরি পেত্রোভ স্যার’, জবাব দিলো পসেলদনিমভ, তখন তার চোখমুখে বিস্ময়, কথা বলার সময় এমন আওয়াজ বেরুলো যেন ড্রিল সার্জেন্টের কমান্ডের জবাব দিচ্ছে । ‘তোমার নতুন বৌয়ের সঙ্গে আলাপ করাবে না? কোথায় তিনি, চলো সেখানে ।’ এই বলে সোফা থেকে উঠে পড়লেন জেনারেল । কিন্তু পসেলদনিমভ তখন পরিপরি করে ছুটলো ড্রেসিং রুমের দিকে । নববঁধু অবশ্য দড়জাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন । কিন্তু তার কথা হচ্ছে দেখে লুকিয়ে পড়লেন । এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পসেলদনিমভ তাকে হাত ধরে নিয়ে এলেন । সবাই সড়ে গিয়ে তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিলেন । ইভান ইলিয়িচ কেতাদুরস্ত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন । মুখে একটা অমায়িক হাসি নিয়ে তাকালেন তাদের দিকে ।
‘আলাপ করে খুব খুশি হলাম’, আভিজাত্য মিশ্রিত ভঙ্গিতে বললেন ইভান, ‘বিশেষ করে এই শুভদিনে’ ।
তার চপল হাসিতে মহিলাদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল জাগলো । সেই জীর্ণ গাউন পড়া ভদ্রমহিলাটি বললেন, ‘চমৎকার’ । পাত্রের উপযুক্ত পাত্রী । শীর্ণকায়া সপ্তদশী । রক্তশূন্য ফ্যাকাশে চেহারা, ছোট্ট মুখে খুদে নাক । ক্ষুদে ক্ষুদে চোখদুটো চঞ্চল, সবসময় ঘুরছে । ওই চোখমুখে বিব্রত ভাব নেই, উপরুন্তু কিছুটা বিরাগ ভাবই দেখা যাচ্ছে । পসেলদনিমভ একে নিশ্চই চেহারা দেখে বিয়ে করেনি । পড়নে তার গোলাপি জামার উপর সাদা মিহি কাপড়ের পোষাক । শীর্ণকায় শরীরটা পাখির মতো, মুখ ও কাঁধের হাড়গুলো স্পষ্ট । জেনারেলের কথার কোনো প্রতি উত্তরও দিতে পারলো না সে ।
‘বাহ! বেশ ভালো, সুন্দরী !’ জেনারেল নিচু গলায় বলছিলেন, যাতে শুধু মাত্র পসেলদনিমভ শুনতে পায় । কিন্তু এবারও সে একটি কথাও বললো না, এমনকি মাথাও ঝাকালো না । ইভান ইলিয়েচের মনে হলো তার চোখে যেনো বিদ্বেষমূলক, গোপন ও কঠিন কিছু একটা খেলছে । কিন্তু যে ভাবেই হোক তার মনের কথাটা বুঝতে হবে । সেই জন্যই ইভান ইলিয়িচের আসা।
‘কি রাজযোটক’ ভাবলেন ইভান, ‘তবুও...’ আবার তিনি নতুন বৌয়ের দিকে তাকালেন । সে এসে পাসে বসেছে । কিন্তু যে দু’একটি কথা বললেন তার ‘হ্যা’- ‘না’তে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েই চুপ । জেনারেল মনে মনে ভাবলেন, ‘মেয়েটা যদি একটুও ঘাবড়ে যেতো তবুও দুএকটি কথা বলা যেতো । মজা করা যেতো । কিন্তু সেরকমও করা যাচ্ছে না । আকিম পেত্রভিচও চুপ করে আছে আমাকে অস্বস্থিতে ফেলার জন্যেই ।
‘আপনাদের আনন্দ উৎসব মাটি করে দিচ্ছি না তো?’ জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি । বুঝতে পারছিলেন তার হাতের তালু ঘেমে উঠছে ।
‘স্যার, আজ্ঞে না না, তেমন ভাববেন না আপনি । খুব দ্রুতই আবার নাচগান শুরু করছি আমরা... এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিলাম আমরা ।’ সেই সেনা অফিসারটি উত্তর দিলো । নতুন বউ খুশি হয়ে তাকালো তার দিকে । লোকটা তার গায়ে একটা সামরিক পোষাক পড়ে আছে, খুব বেশী বয়সও নয় তার । পসেলদনিমভ তখনো বিনয়ের অবতার হয়ে মাথা নিচু করেই আছে, তার টিকোলো নাকটা আরো খাঁড়া লাগছিলো । সে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো কোনো গৃহভৃত্য মনিবের ওভারকোট হাত পেতে নিবে । ইভান ইলিয়িচ এমনই ভাবছিলো । মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছিল তার । খুব অপ্রস্তুত ও বিব্রত লাগছিলো নিজেকে তাঁর । পায়ের তল থেকে মাটি সড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছিলো । অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে খড়কূটো ধরার মতো কোনোভাবে এই অস্বস্থিকর অবস্থা থেকে নিস্তার চাচ্ছিলেন । এমন সময় একটা বেঁটেখাটো মহিলার প্রাদুর্ভাব হলো সেখানে । মধ্যবয়স্কা সেই মহিলার চেহারায় কোনো আভিজাত্যের ছাপ নেই । যে পোষাকটি পড়ে এসেছে হয়তো সেটিই তার একমাত্র ভালো পোষাক । বড় একটা চাদর সেপ্টিপিন দিয়ে আটকানো, মাথার টুপিটাও অনভ্যস্ত লাগছিলো । হাতে একটা ট্রে ধরা, সেখানে শ্যাম্পেনের বোতল । বোতলটি খোলা, কিন্তু ব্যবহার হয়নি তখনো । ট্রের উপর দুটো গ্লাস রাখা, দুজন মান্যগণ্য অতিথির জন্য অনুমান করা যাচ্ছে । মহিলাটি সোজা এসে জেনারেলের সামনে দাঁড়ালেন ।
‘স্যার, ক্ষমা করবেন ।’ অভিবাদন করে বললেন, ‘কিন্তু আমার ছেলের বিয়েতে এসে আমাকে ধন্য করেছেন আপনি । আমি অনুরোধ করছি বড়-কনের স্বাস্থ্য কামনা করে এটি গ্রহণ করুন ।’
ইভান ইলিয়িচের মনে হল যেন ইনি তাঁর মুক্তিদাত্রী হয়ে এসেছেন । ভদ্রমহিলাকে বৃদ্ধা বলা যায় না, পয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ হবেন । কিন্তু খুবই অমায়িক ও খোলামেলা, গায়ের রঙ লালাভ, গোলপানা রুশীদের মতোই মুখ, মুখে একটা সরল হাসি লেগে আছে । মহিলাটি অভিবাদন করতেই অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠলেন ইভান । সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও! আপনিই তবে বরের মা?’
‘আজ্ঞে হ্যা স্যার, আমার মা’ । মুখটা এগিয়ে গলা রের করে মৃদুস্বরে বললো পসেলদনিমভ । ।
‘পরিচিত হয়ে খুব খুশী হলাম !’
‘কিছু একটু খান, স্যার ‘ ।
‘নিশ্চই, আনন্দের সঙ্গে’। ট্রেটা তাঁর সামনে নামানো হলো । শ্যম্পেন ঢেলে দেবার জন্য ছুটে এলেন পসেলদনিমভ । দাঁড়ানো অবস্থাতেই একটি গ্লাস নিলেন ইভান ।
‘আমার... এই অনুষ্ঠানে... মানে, উপরওয়ালা হিসাবে... তোমাদের আশীর্বাদ করার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত’, এভাবেই কথা বলতে শুরু করলেন তিনি । ‘ম্যাডাম, আপনার জন্য এবং কনে তোমার জন্য, আপনাদের প্রত্যেকের উন্নতি ও আজীবন সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছি’ ।
আনন্দের সঙ্গে ইভান ইলিয়িচ পুরো গ্লাসটি পান করে ফেললেন । এই নিয়ে আজই সন্ধ্যায় তাঁর সপ্তম গ্লাস পান করা । ওদিকে পসেলদনিমভ সামনের দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে, গোমড়া মুখ তার । জেনারেলের এটা দেখে খুব রাগ হচ্ছিলো ।
অফিসারের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ‘আর ঐ ঢ্যাঙ্গা মানুষটার এখানে কি কাজ? ঘুরঘুর করছে কেনো? ... আনন্দের পরিবেশে একটু উল্লাস দেখাতেও তো পারে! পরিবেশটা স্বাভাবিক হয়ে যেতো তাহলে’ ।
‘আপনিও শ্যাম্পেন নিন, মিঃ আকিম পেত্রোভিচ” । হেড ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে বললেন পাত্রের মা । ‘আপনি আধিকারিক, আমরা অধনস্থ ! মা হিসাবে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেটিকে একটু দেখবেন । আগামীদিনেও আমাদের কথা ভুলে যাবেন না আকিম পেত্রভিচ, খুব ভালো মানুষ আপনি ।’
‘কী সুন্দর এই রুশ মেয়েরা, পুরোনো ঐতিহ্য ও গরীমাকে ছুঁয়ে আছে এরা । সবাইকে মাতিয়ে রাখছে ।’ ইভান ইলিয়িচে ভাবছিলেন, ‘জনগনকে আমি তো বারবর ভালোবাসি’ ।
আবার আরও একটি ট্রে এলো । একটি মেয়ে সে’টি নিয়ে এলো, তার গায়ে ক্রিনোলিনের ওপর একটি নতুন ছাপা জামা । খসখস করছে সেটা। ট্রেটি খুব বড়, মেয়েটি দুহাতে সেটা সামলাতে পারছিলো না । তার ওপর নানা ধরনের ফল ও খাদ্য, আপেল, মোরব্বা, আখরোট প্রভৃতি । এতক্ষণ অতিথিদের জন্য রাখা ছিলো ট্রেটি, এবার সেটি জেনারেলদের সামনে আনা হলো ।
‘আমাদের এই ক্ষুদ্র আয়োজনে না করবেন না স্যার, বাসায় যা কিছু ক্ষুদ্রাতিখুদ্র আছে সেটাই আমাদের আয়োজন ।’
‘সে কী! এমনভাবে বলবেন না ।‘ একটা বাদাম তুলে নিয়ে ইভান ইলিয়িচ বললেন, তার বেশ আনন্দই লাগছিলো । দুহাতে চাপ দিয়ে বাদামটা ভাঙলেন । ভাবছিলেন এমন জনপ্রিয় হওয়ার মতো কথাবার্তা চালিয়ে যাবেন । এমন সময়েই হেসে উঠলো কনে । ইভান তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হলো ?’ কনের মধ্যে প্রাণ আছে দেখে তাঁর ভালোই লাগছিলো । মুখ নিচু করে সে জবাব দিলো, ‘এই ইভান কস্তেনকিনিচটা এমন সব মজার কথা বলেন !’
জেনারেল দেখতে পেলেন যে সোফার পেছনে আড়াল নিয়ে একটি ছেলে পসেলদনিমভকে কানে কানে কিছু বলছে । ছেলেটির শনের মতো চুল, দেখতে খারাপ না, আচরণে বেশ লাজুক এই যুবকটি । উঠে দাঁড়ালো সে । নম্রভাবে বিনিত উচ্চারণে বললো সে, ‘আমি ওকে ‘স্বপ্ন- পুস্তক’ বইটার কথা বলছিলাম” । পাঠকের জন্য উল্লেখ করা যায় যে এই বইটি কবি নিকোলাই শ্চের্বিনারের লেখা একটি রসালো ব্যঙ্গাত্মক রচনা, ‘সাম্প্রতিক রুশ সাহিত্যের স্বপ্নবেদ’ নামে তিনি এই রস রচনাটি লিখেছিলেন ।
‘কোন ‘স্বপ্ন-পুস্তক’ ?’
‘নতুন একটি ‘স্বপ্ন-পুস্তক’ বেড়িয়েছে, সাহিত্য বিষয়ক । ওনাকে তাই বলছিলাম, যদি কেউ পানায়েভকে স্বপ্নে দেখেন তাহলে তার মনে হবে একজনের শার্টের ওপর আর একজন কফি ফেলে দিচ্ছে ।’
‘কী ছেলেমানুষ!’ কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ভাবলেন ইভান ইলিয়িচ । কথা বলতে বলতে ছেলেটি লালাভ হয়ে উঠছিলো, কোনোক্রমে পানায়েভের প্রসঙ্গ তুলতে পেরেই সে খুশি ।
“হ্যা, হ্যা, শুনেছি বটে... ,’ বললেন মহামান্য জেনারেল ।
‘এর থেকেও ভালো একটা বই আছে’, ইভান ইলিয়েচের পাশের থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন । ‘নতুন একটা ডিকশানেরি বেরুচ্ছে, এর থেকেও ভালো’ । এখানে মিঃ ক্রয়েভস্কি একটি প্রবন্ধ লিখবেন বলে শুনলাম, যেখানে আলফেরিক ... সাহিত্যের ‘স্বরূপ উদ্ঘাটন’ নিয়ে লিখবেন । উল্লেখ থাকে যে ১৮৬১তে ‘রুশ পন্ডিত ও সাহিত্যিকগণ’এর দ্বারা সংকলিত ‘বিশ্বকোষ অভিধান’ প্রকাশিত হয়, যার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন প্রকাশক আন্দ্রেই ক্রায়ভস্কি । এই বই নিয়ে বিশেষ ক্ষোভের জন্ম হয়েছিলো । যে ছেলেটি এই কথা বলছিলো তার একটু গায়ে পড়া ভাব ছিল । গ্লাভসে ঢাকা হাত, শাদা ওয়েস্ট কোর্ট গায়ে, টুপি হাতে নাচাচ্ছিলো আর চোখে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে দেখছিলো সবকিছু । ‘দ্যা ব্রান্ড’ নামের একটা ‘ব্যাঙ্গ’ পত্রিকায় সে ফিচার লেখে । হঠাৎ করেই তার এই বিয়েতে আসা, পসেলদনিমভই তাকে নেমতন্ন করে এনেছে সম্মানিয় অতিথি হিসাবে । তাদের পরিচয় হয়েছিল বছর খানেক আগে এক জার্মানের বাসায়, যেখানে অধিকাংশ সময় দুজনে ক্ষুধার্ত হয়েই দিন গুজরান করতো । ভদকাতে অবশ্য ছেলেটির কোনো আপত্তি ছিল না, ভদকা খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝেই সে পাশের ঘরে যাচ্ছিল, এই আস্তানাটা অনেকেই জেনে গেছে । তখনই ছেলেটির প্রতি বিরক্তি ও বিরূপ হয়ে উঠলো জেনারেলের মন ।
‘জানেন হুজুর, একটা মজার বিষয়’, হঠাৎ কথার মধ্যেই বলে উঠলো সেই লাজুক ও সাদা শনের মতো চুলের ছেলেটি, যে সার্টের উপর কফি ফেলার গল্প করছিলো, শাদা ওয়েস্ট কোট পড়া ছেলেটি যাকে পাত্তাই দিতে চাচ্ছিল না । কিন্তু ছেলেটির কথা আর শেষ হল না, জেনারেল তার আগেই চোখের ঈশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এসব কথা তার জানাই আছে । ছেলেটি থতমত খেয়ে চুপ করে গেলো । আবার আগের মতই পেছনের দিকে গিয়ে মনমরা হয়ে চুপটি করে বসে থাকল । সেই যায়গাটা দখল নিলো ‘অঙ্গার’ এর সেই স্মার্ট সাংবাদিক ছোকড়াটি । জেলেরেলের আরো ঘণিষ্ঠ হতে চেষ্ঠা করছিলো সে। জেনারেল বঝলেন এই অতি ঘণিষ্টতা একটু বারাবাড়িই হয়ে যাচ্ছে ।
কিছু একটা বলার জন্যেই যেনো কথা শুরু করলো সে, ‘আচ্ছা পরফিরি, বলোতো, অনেক দিন থেকেই আমি ভাবছিলাম বলবো - তোমায় কেনো পসেলদনিমভ বলা হয় কেনো? তোমার নাম তো পসেভদনিমভই ?’
‘ঠিক বলতে পারবো না স্যার’ উত্তর দিলো সে।
‘মনে হয় ওর বাবা কাজে ঢুকবার সময় কাগজপত্র ভুল করে ফেলেছিলেন । এই ভুলের ফলেই ‘পসেলদনিমভ’ হয়ে গেছে । কেননা, সাহিত্যর পাতায় পসেভদনিমভই একটা পরিচিত শব্দ, যার মানে ওই ‘ছদ্মনাম’এর মতো কিছু একটা । কিন্তু পসেলদনিমভ কথাটার তো কোনো অর্থই নেই!’
‘মুর্খামি, আর কি!’ আকিম পেত্রোভিচ বললেন ।
‘মুর্খামি বলতে কি বলতে চাইছেন আপনি?’
‘রাশিয়ার মানুষজন , মুর্খের মতো তারা শব্দের মাঝের অক্ষর অদল বদল করে নেন । উদাহরণ হিসাবে দেখুন, ইনভালিদ না হয়ে নিভালিদ করে নিয়েছে ।”
জেনারেল এই কথায় হেসে উঠলেন, ‘নিভালিদ…হা হা হা ‘ ।
‘ওরা মম্বর বলে স্যার !’ ‘মানে?’ ‘নম্বরের বদলে মম্বর!’
“ওহ! নম্বরের বদলে মম্বর! হা হা হা...’
গলার কাছে হাত এনে টাইয়ের গিটটা ঠিক করে নিলো সেই অফিসার ।
‘আরে বৃত্তান্তের বদলে ‘বেত্তান্ত’ বলে তারা’ এভাবেই আরো উদাহরণ টানলো ‘অঙ্গারের’ রচয়িতা । কিন্তু জেলারেলের এইসব ভালো লাগছিলো না। সে উপেক্ষা করলো । ওদিকে নাছোড় লেখক আবার বললো, ‘বৃত্তান্তর বদলে বলে কিনা বেত্তান্ত!’
এবার ইভান ইলিয়িচ কড়া নজড়ে তাকালেন লেখকের দিকে । ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো পসেলদনিমভ, তার কানেকানে বললো, ‘এসব ছাড় এখন’ ।
মরিয়া লেখক তখন ফিসফিস করে বলেতে বলতে ঘর থেকেই বেড়িয়ে গেলো, ‘কথা বলছি, কথা বলাতেও মানা আছে নাকি!’ ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা সেখানে গেলো যেখানে পুরুষ নাচিয়েরা জন্য একটা সুসজ্জিত নকশা কাটা ইয়ারোস্লাভ্ল টেবিল ক্লথের উপর ভদকা, নোনা হেরিং, মাছে ডিমের চাটনি রাখা ছিলো । আর রাখা ছিলো এক বোতল কড়া শেরি । মনে মনে গুজগুজ করতে করতে লেখক যখন তার গ্লাসে ভদকা ঢালছে তখন অবিন্যস্ত চুলেভর্তি মাথার ডাক্তারি ছাত্রটি ছুটে এলো । পসেলদনিমভের নাচের আসরে সেই শ্রেষ্ঠ নাচিয়ে নির্বাচিত হয়েছে, সেই ছাত্রটি ঐতিহ্যবাদী ক্যানক্যানে নাচও জানে । লোভী চোখে সে পানপাত্রটি মুঠোয় চেপে ধরলো । এক নিশ্বাসে সেটি পান করে বললো, ‘চলো, শুরু হচ্ছে আবার । হাতের উপর দাঁড়িয়ে একটি একক নাচ নাচবো আমি । ডিনারের পর একটা রগরগে মেছোও চালাব । একট মেয়েকে নজরে পড়েছে, ক্লিওপেত্রা সেমিওনভনাটি, পসেলদনিমভের এই আসরের সেরা, যা খুশি করতে ইচ্ছা হয় । ওর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা এগোনো যায় কিনা দেখছি ।
‘মানুষটা রিয়াক্সানিস্ট’ বললো লেখক ।
‘কে ?’
‘কেন, ওই যে যার মুখের সামনে খাওয়ারের প্লেট সাজিয়ে দেওয়া হলো ! আমি জোরের সঙ্গে বলছি, সে একটা প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ ।‘
‘ খুব বারাবারি হয়ে যাচ্ছে’। এই বলে দ্রুত ছুটে চলে গেলো ছাত্রটি ।
লেখক তখন একলা, মনে সাহস ও শক্তি আনার জন্য গলায় আরো একগ্লাস ঢেলে দিলো সে । এই মূহুর্তেই ‘অঙ্গার’ এর লেখকের মনের মধ্যে প্রতিহিংসা জেগে উঠছিলো । মনে পড়ছিলো ইভান ইলিয়িচের তার প্রতি বিরূপ আচরণ । পেটে কয়েক পেগ ভদকা পরেছিলো, এতেই তার মধ্যে সেই চরম শত্রু, অতৃপ্ত প্রতিহিংসা চাগিয়ে উঠছিল । জাতীয় কাউন্সিলে এর আগে তেমন কোনো শত্রুতার মুখোমুখি হননি ইভান ইলিয়িচ । এখানে তেমন কোনো কিছু ঘটবে এমন সন্দেহও ছিল না তাঁর মনে । কোনো সন্দেহই থাকার মত কারণ ছিলো না অথচ এর পরের ঘটনা প্রবাহ ছাপ রাখলো জেনারেলের পরবর্তী সমস্ত সম্পর্কের উপরেই । ঘটনাটি এই যে, কোনো অধস্তন কর্মীর বিয়ের আসরে যদিও নিজের উপস্থিতি নিয়ে একটি মোটামুটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ উপস্থিত করতে পেরেছিলেন তিনি । তবুও অনেকেরই সন্দেহ মন থেকে মুছে যায়নি, নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেকেই তখনও বিব্রত ছিলো তাকে নিয়ে ।
হঠাৎ সবকিছু জাদুমন্ত্রে পালটে গেলো ! উপস্থিত অতিথিদের মন থেকে সেই অস্বস্থিটিও চলে গেলো । হৈ হুল্লোরে সবাই এমন মেতে উঠলো যে সেই অনাহূত অতিথিটির কথা ভুলেই গেলো সবাই । কারণ, কোনো এক অজ্ঞাত কারনে একটা গুজব, একটা কানাঘুষো, একটা কথা রটে যাচ্ছিলো যে ‘অতিথি’টি একটু নেশায় আছেন আরকি ! এবং এটি একটি খুব গর্হিত কুৎসা হিসাবে দেখা হচ্ছিলো । কিন্তু ধীরে ধীরে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছিলো । সবকিছু স্বচ্ছ হয়ে ওঠার পর পরস্থিতি আরো সহজ হয়ে ওঠে । সকলেই নিজেদের মধ্য সেই স্বাচ্ছন্দ খুঁজে পায়, যা পার্টিতে প্রয়োজন । সেই মুহুর্তেই শুরু হলো বাজনা, ডিনারের আগে এই শেষ বারের মতো নাচ । এই নাচের জন্য ডাক্তারি ছাত্রটি অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলো ।
ইভান ইলিয়িচ ভাবছিলেন নতুন বৌয়ের সঙ্গে আবার কথা বলবেন । একটা দূর্দান্ত রসিকতা তাঁর মাথায় এসেছিলো । সেটি দিয়ে জমিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন । এমন সময় সেই লম্বা মতন অফিসারটি ছুটে এসে হাঁটু মুড়ে বসে তাঁকে নাচার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো । সঙ্গে সঙ্গে নতুন বৌও নাচের দলে যোগ দিতে লাফিয়ে চলে গেলো আসরের মাধ্যখানে । জেনারেলের কাছে এই জন্য সেই লম্বা লোকটা একটু ক্ষমাও চেয়ে নিলো । নতুন বৌ একবারের জন্যেও জেনারেলের দিকে তাকালোনা পর্যন্ত, ভাবোটা এমন যে সে যেনো হাপ ছেড়ে বাঁচল । ইভান ভাবলেন, এমন সে করতেই পারে, নিজের যা ভালোলাগে । এদের কাছ থেকে ভব্যতা খুব একটা আশা করা যায় না।
‘হুম... আমার সঙ্গে সৌজন্যতা ভদ্রতা দেখানো নিয়ে ভেবোনা পরফিরি,’ বললেন পসেলদনিমভের দিকে তাকিয়ে, ‘হয়তো – ওদিকে কিছু দেখাশোনা – কিংবা... এটা ওটা আর কি কিছু করবার আছে হয়তো তার, সংকোচ করো’ । এবং আত্মগত ভাবে আরো বললেন, ‘ও কি আমার পাহারাদার নাকি?’
পসেলদনিমভের ঢ্যাঙা গলা আর একদিকে তাকিয়ে থাকা স্থির চোখের দৃষ্টি ইভানের আর ভালো লাগছিলো না । মোটের উপর যা কিছু ঘটছে সেসব মোটেই তাঁর আশানুরূপ নয়, যদিও সে কথা স্বীকার করতে ইভান ইলিয়িচ রাজী ছিলেন না ।
ওদিকে নাচ শুরু হয়ে গেলো । আকিম পেত্রভিচ সসম্ভ্রমে বোতলটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘একটি দিই, স্যার’ । মনিবের গ্লাস ভর্তি করার জন্য সে উন্মুখ ।
“আমি... আমি... আর - মনে হয় ঠিক হবে না’ ।
কিন্তু আকিম পেত্রোভিচ ততক্ষণে সম্ভ্রমে গদগদ হয়ে গ্লাসে ঢালতে শুরু করে দিয়েছে । গ্লাস ভর্তী হলে সে নিজের গ্লাসে ঢালে, খুব সন্তর্পনে, কাঁধ নিচু করে ও ভয়ে ভয়ে । নিজের গ্লাসে জেনারেলের থেকে আধ ইঞ্চি কম ঢাললো । অফিসের বড়কর্তার পাসে বসে মদ খাওয়ার সময় নিজেকে প্রসব যন্ত্রণা ওঠা নারীর মতো লাগছিলো । বলার মত কথাই খুঁজে পাচ্ছিলো না । এদিকে বড়কর্তাকে আপ্যায়নের দায়িত্ব তারই কারণ তিনিই তাঁকে কাছে ডেকে নিয়েছেন । শ্যাম্পেন এ ক্ষেত্রে তার পরিত্রাতা হয়েছে, বড়কর্তার ভালো লেগেছে এটা তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছিলো । শ্যাম্পেনটার জন্য ততটা নয় যতটা নৈতিক আনুগত্যের জন্য, কারণ শ্যাম্পেনটা ছিলো গরম ও খুব নিম্নমানের ।
ইভান ইলিয়িচ ভাবছিলেন যে এই বুড়টার খাওয়ার ইচ্ছে খুব, কিন্তু আমি না খেলে সে খেতে পারছে না ! সে বাধাও দিতে চাইছিলো না । সামনে সাজিয়ে রাখা বোতল, না খাওয়াটা বোকামি । চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে গ্লাসে চুমুক দিলেন । এভাবে, চুমুক না দিয়ে বসে থাকার থেকে পান করাটাই ভালো ।
‘এই যে, এসে পড়েছি’, কেটে কেটে শব্দের উপর চাপ দিয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘খানিকটা হঠাৎই চলে আসা’ । কেউ কেউ হয়তো ভাবছে আমার এমন ভাবে এই অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া উচিত হয় নি । বিশেষত আগত ওই অতিথিদের ভিড়ের কেউ কেউ এমন ভাবতেই পারে ।’
কোনো জবাব না দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে আকিম পেত্রভিচ শুনে যাচ্ছিলেন ।
“কিন্তু আমার মনে হয় আপনি বুঝবেন যে আমি কেনো এসেছি – কেবল মদ্যপানের জন্য নয় নিশ্চুই !” বলে হো হো করে হেসে উঠলেন । আকিমভ ভাবলেন স্যারের সঙ্গে তিনিও হেসে ওঠেন । কিন্তু কোনো অদৃশ্য কারনে নিজেকে সংযত করলেন ।
“আমি এসেছি… উৎসাহ দিতে চেয়েছি… নৈতিক যায়গা থেকে আমার এই ইচ্ছা…’ বললেন ইভান ইলিয়িচ। আকিম পেত্রভিচের বোকামি ও মুর্খতায় খুব বিরক্ত লাগছিলো তাঁর । ওদিকে বেচারা পেত্রভিচের অপরাধীর মতো মাথা নামিয়ে নেওয়ায় সে একদম চুপ করে গেলেন । খানিকটা অবসাদ থেকেই গ্লাসে এবার আরো একটা চুমুক দিলেন । আকিম পেত্রভিচও যেনো পানের মধ্যদিয়ে মুক্তির পথ খুজে নিল ।
“তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি নাই একাবারে’, বেচার আকিম পেত্রভিচের দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে এই কথা বললেন ইভান ইলিয়িচ । আকিমও গো ধরে সেভাবেই মাথা নিচু করে বসে রইলেন । মিনিট দুয়েক এমন চললো । এই সময়টা আকিম পেত্রোভিচের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো । এ আকিম সম্পর্কে কিছু বলি । যাকে মেষ শাবক বলে তেমনি নিরিহ গোছে মানুষ সে। পুরোনো আমলের ও মোসাহেব চরিত্রের মানুষটা মনের দিকদিয়ে উদার । পিটার্সবুগেই আদি নিবাস তাঁদের, রুশী ।এখানেই তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার জন্ম ও তাঁর লেখাপড়া, চাকরি । এখানেই তাঁদের শেকড়, এই রুশিরা একটু অদ্ভূত ধরনের, বৃহত্তর রাশিয়া সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা নেই, এই নিয়ে এদের কোনো সঙ্কোচও নেই । কুয়োর ব্যাঙ্গের মতো পিটার্সবুর্গই তাদের জাগতিক সীমা । এদের যাপন ভাবনা, কেনাকাটা, তর্কবিতর্ক সবটাই এই সীমাবদ্ধ অঞ্চলটা নিয়েই । রুশ সংস্কৃতি নিয়ে এদের ধারনা নেই কোনো, দেশীয় আচার আচরণ কিছুই জানে না তারা । ‘লুচিনুশকা’ ছাড়া কিছুই জানে না, এটি তারা জানে কারণ ভবঘুরে ছোকড়ারা এই গানটি অর্গানে বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে । রাশিয়ার সাধারণ রুশিদের সঙ্গে এই পিতার্সবুর্গের রুশিদের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে । প্রথমতঃ, পিটার্সবুর্গের রুশিরা বলেবে ‘আকাদেমি গেজেট’, কখনো বলবে না ‘পিটার্সবুর্গ গেজেট’ । দ্বিতীয়টি প্রাতরাস নিয়ে, পিতার্সবুর্গের রুশিরা কখনো বলেবে না ‘ব্রেকফাস্ট’, বলবে ‘ফ্রিঃস্তক’, ‘ফ্রীঃ’ এর ওপর জোর দিয়ে বলবে । এই দুটি পার্থক্যের কারনে অনায়াসে এদের চিহ্নিত করা সম্ভব । গত অর্ধশতকে জমাট বাঁধা একটি জনগোষ্টি এই ‘পিটার্সবুর্গ’এর রুশিরা, আপাত নিরীহ । তবে এই আকিম মোটেই বোকা নন । তার মনের মত কোনো কথা যদি জেনেরেল জানতে চাইতেন তবে সে উত্তর দিতো, আড্ডা চালু থাকতো । কিন্তু যে ধরনের কথাবার্তা জেনারেল চালাচ্ছিলেন সেখানে একজন অধঃস্তনের পক্ষে সে সব কথায় যোগ দেওয়া সমুচিন নয় । কিন্তু স্যারের মনের কথা বুঝবার জন্য তার মন অধীর হচ্ছিলো ।
এদিকে ইভান ইলিয়িচ ধীরেধীরে খুব চিন্তিত হয়ে উঠছিলেন, এক ধরনের কল্পনা তাকে পেঁচিয়ে ধরছিলো । খুব অন্যমনস্ক হয়ে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি । আকিম পেত্রোভিচও আগ্রহের সঙ্গে তার শূন্য গ্লাস পানীয়তে ভরে দিচ্ছিলেন । কেউ কোন কথা বলছিলো না । ইভানের নজর তখন নাচের দিকে, যেনো হঠাৎই তার সেদিকে খুব মনোযোগ লক্ষ্য করা গেলো । কিন্তু একটা বিষয় খুব আশ্চর্য লাগছিলো ইভান ইলিয়িচের ।
ওদিকে নাঁচের আসর খুব জমে উঠছিলো । প্রবল আনন্দে মেতে উঠছিলো সবাই । পুরুষদের থেকে মেয়েরা অনেক বেশী মুন্সিয়ানায় নাচছিল । পুরুষদের অনেকেই ততটা ভালো নাচ না জানলেও এমন ভাবে নাচছিলো যেনো তারা সবাই নাচে ওস্তাদ । বিশেষ করে ওই অফিসারটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলো । নাচের মুন্সিয়ানা দেখাতে উদগ্রীব সে একা একাই নাচছিলো । তার নৃত্যের ভঙ্গী ছিলো নজর কাড়া, এখনো সে লম্বা কাঠির মতো সোজা দাঁড়িয়ে, কখনো একপাসে হঠাৎ এমন বেঁকে গেলো যে মনে হয় যেনো সে পড়ে যাবে, পরের মুহুর্তেই তেমনি হঠাৎ উল্টোদিকে বেঁকে গেলো, মেঝের উপর তেমনি তৃক্ষ্ণ একটা কোণ তৈরি করে সে নাচছিল । মুখে তার এমন একটা ভাব যেনো সবাই তাকে তারিফ করছে । প্রথম কসরতের পরেই একজন মহিলা, যিনি নাচছিলেন ঘুমে ঢলে পড়লেন । তিনি নাচ শুরুর আগেই পান শুরু করেছিলেন, ফলে প্রবল নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন । ফলে একজন মহিলাই তখন নাচতে লাগলেন । নীল ওড়না গায়ে যে মহিলাটি সেই তরুণ রেজিস্টারের সঙ্গে নাচছিল, সন্ধ্যায় পাঁচ পাঁচটা কোয়াড্রিল নৃত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা নেচেছেন একই ভাবে । এই লোকটাই তার সঙ্গিনীর কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তার ওড়নার কোনটা ধরে সঙ্গিনী পালটে নেওয়ার সময় কয়েকটি করে চুমু দিচ্ছিল । মহিলাটি নিজেও তার সমানে দিয়ে সড়ে গেলো, যেনো সে কিছুই দেখেনি । ওদিকে মেডিক্যাল স্টুডেন্টটি সত্যি হাতের উপর ভর দিয়ে একক ভাবে নেচে যাচ্ছিলেন । প্রচন্ড উল্লাশ শুরু হয়ে গেলো, সঙ্গে সশব্দে পা ঠুকে যাওয়া ও হাততালির বাহবা । মোটের উপর একটা মুক্তির স্বাদ চারদিকে । ইভানের নেশা ধরেছিলো, তিনি হেসে উঠতে চাইলেন, কিন্তু হঠাৎ তীব্র দহনজ্বালার মতো একটা সন্দেহ মাথা চারা দিয়ে উঠলো । অবশ্য, তিনি চাইছিলেন যে ওরা সবাই স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দে থাকুক, অন্তরঙ্গ পরিবেশ বজায় রাখতে চাইছিলেন তিনি । অবশ্যই তিনি সেই সুরটিই চেয়েছিলেন, হ্যাঁ সত্যিই চেয়েছেন সেই সময় যখন তারা সবাই তার থেকে দূরত্বে চলে যাচ্ছিলো, কিন্তু সে অন্তরঙ্গতা এখন সীমা ছাড়াতে শুরু করেছে । যেমন, চার হাত ফেরতা একটা জীর্ণ ভেলভেটের গাউন পরা মহিলা নিজের গাউনের ষষ্ঠ ফিগারের সময় এমন ভাবে পিণ এঁটে মাপ নিলো যেনো সে ব্রা’র মাপ নিচ্ছে । সেই ক্লিওপেত্রা সেমিওনভনা, সেই ম্যাডিক্যা্ল স্টুডেন্টের সাথী নর্তকীটি সম্পর্কে যার মন্তব্য ছিলো, ইচ্ছা হলে যা খুশি করা যায় । ছেলেটি তো একেবারে দ্বিতীয় ‘ফোকিন’, ঊনবিংশ শতকের পিটার্সবুর্গের সেই বিখ্যাত নর্তক পুরুষ । কিন্তু এসবের মানে বুঝতে পারছিলো না ইভান ইলিয়িচি, একসময় সবাই দূরে দূরে থেকে এড়িয়ে যাচ্ছিলো, এখন আবার অবাধ ভাবে কাছাকাছি আসছে । এটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিলো এই পরিবর্তনটা খুব দ্রুত হয়ে গেলো । একটা দুশ্চিন্তা তাঁর মাথায় খেলে গেলো । ইভান ইলিয়িচ যে এখানে হাজির আছেন সেটা তারা বেমালুম ভুলে গেলো ! সমবেতদের নৃত্যের প্রশংসা করে অবশ্য তিনিই নিরবতা ভেঙ্গে হেসে উঠলেন । সম্ভ্রমে আকিম পেত্রভিচও খুশিতে হো হো করে হেসে উঠলেন । আকিমের মনে একবারের জন্যেও সন্দেহ হয়নি যে তার স্যার মনে মনে আবারো বিষাক্ত বৃশ্চিকের কমড়ের মতো যন্ত্রণা পাচ্ছেন ।
কোয়াড্রিল শেষ হলে ডাক্তারির সেই ছাত্রটি ইভান ইলিয়িচের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো । ইভান স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় সেই ডাক্তারির ছাত্রটিকে বললেন, ‘বেশ ভালো নাচো তো তুমি’ । তারিফ শুনে মুখে হাসি এনে ছাত্রটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখটা ইভান ইলিয়েচের মুখের কাছে নিয়ে এসে আচমকাই মোরগের ডাক ডেকে উঠলো । এটা খুবই বারাবাড়ি হয়ে গেলো । ইভান ইলিয়িচ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । এরপরেও অপ্রত্যাশিত ভাবে অশোভন একটা হাসির লহর উঠলো, কারন মোড়োগের ডাকটা ছিলো হুবহু মোড়্গের মতো । এই মজা করাটা ছিলো একাবারেই অপ্রত্যাশিত । জেনারেল ইভান ইলিয়িচ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, এমন সময় স্বয়ং গৃহস্বামী পসেলদনিমভ এসে মাথানিচু করে তাঁকে নৈশ ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানালো, তার পিছু পিছু মা’ও এলো । মাথা নুইয়ে পসেলদনিমভের মা বললে, ‘আমরা ধন্য হব হুজুর, আমাদের এই আয়োজনে আপনি অংশ নেবেন, আপত্তি করবেন না’ ।
‘আমি... আমি সত্যিই, এর কোনো মানে খুজে পাচ্ছি না যে কি বলবো...’ বললেন ইভান ইলিয়িচ, ‘আমি এই জন্য আসিনি... ভাবছিলাম এবার ফিরে যাবো...’ ।
সত্যি সত্যি টুপিটা হাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন; মনে মনে স্থির সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন যে যাই হোক তিনি আর থাকবেন না এখানে । তবুও থেকে গেলেন । এক মিনিট পরেই খাবার টেবিলের দিকে সবাই সারিবদ্ধ ভাবে এগোতে শুরু করলো, সেই সাড়ির সামনে দাঁড়ালেন তিনি । পসেলদনিমভ ও তার মা সামনে সামনে তাঁর রাস্তা করে দিতে লাগলেন । সবচেয়ে সম্মানের আসনটি তাঁর জন্য রাখা ছিলো সেখানে এবং পুরো একবোতল শ্যাম্পেন রাখা ছিলো ইলিয়িচের জন্য তাঁর প্লেটের পাসে । খাবার টেবিলে হেরিং মাছ ও ভদকা রাখা ছিলো । উনি একটি গ্লাসে ভদকা ঢেলে নিয়ে দ্রুত পান করলেন । ভদকা পানে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না । এক গ্লাসেই মাথায় লেগে গেলো তাঁর, মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের উপর থেকে তিনি গড়িয়ে পড়ছেন, দ্রুত থেকে দ্রুততর এই পতন হচ্ছিলো তাঁর । বুঝতে পারছিলেন এই পতন থেকে উঠে দাঁড়ানো দরকার তাঁর, থামা দরকার । কিছু একটা আঁকড়ে ধরা উচিৎ, কিন্তু কী করে তা ধরবেন বুঝতেই পারছিলেন না ।
সত্যিই পরিবাশটা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছিলো তাঁর কাছে । গোটা অবস্থাটা তাঁর কাছে ভাগ্যের বিরম্বনা মনে হচ্ছিলো । ঘন্টাখানেক ধরে তাঁর উপর দিয়ে যে কি সব হয়ে গেলো তা একমাত্র ভগবানই জানেন । প্রথম যখন তিনি ঘরে ঢুকলেন তখন তাঁর সমানের সমস্থ মানুষের প্রতি, তাঁর অধস্তনদের প্রতি তিনি ভালোবাসার দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু এক ঘন্টাও কাটেনি, তারমধ্যেই বিরক্তি ও ক্ষোভের সঙ্গে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে তিনি তাঁর অধস্তন পসেলদনিমভকে ঘৃণা করতে শুরু করেছেন । মনে মনে শাপ দিচ্ছেন তাকে ও তার পরিবারের সবাইকে, এই বিয়েটাকেও । শুধু সেই নয়, পসেলদনিমভের চোখমুখেও ইভানের প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ ফুটে বেরুচ্ছিলো । সে যেনো মনে মনে বলছে, ‘মালটা কখন যে ঘার থেকে নামবে!’ পসেলদমিনভের চোখ মুখের এই ভাষাটা নেক আগেই টের পেয়েছিলেন ইভান ইলিয়িচ ।
তবে অবস্থাটা যে এই পর্যায়ে গিয়ে পৌছবে তা ইভানের কল্পনার বাইরে ছিলো, এমনকি টেবিলে গিয়ে বসার সময়েও এমন ভাবার থেকে নিজের হাত কেটে ফেলাটাও সহজ ছিলো । সে স্বীকৃতির মুহূর্ত এখনো আসেনি, খানিকটা নৈতিক জয় তখনো তাঁর ছিলো । কিন্তু ক্রমশ তাঁর বুকের ভিতড়টাতে ব্যাথা অনুভব করতে থাকেন । খোলা মাঠের বাতাস ও স্বাধীনতায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম চাইছিলো সে । আসলেই ইভান ইলিয়িচ একজন সজ্জ্বন ব্যাক্তি ছিলেন ।
অনেক আগেই তাঁর এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো । এখন চলে যাওয়া শুধু নয়, তার অনুভব বলছে এখান থেকে পালানো দরকার । এখানে আসার পথে রাস্তায় যা যা ভেবে এসেছিলেন এখানে তেমন কিছু ঘটলো না ।
‘কি করতে যে এলাম, শুধুই মদ খেতে?’ প্লেট থেকে হেরিং মাছে কামড় দিতে দিতে ভাবলেন তিনি । ইতিমধ্যে তাঁর মনটা বিষিয়ে উঠেছে । নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করতে ইচ্ছা করছে তাঁর । নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করছেন, কেনো এলেন এখানে?
‘কিন্তু এখন যাওয়াটা সমম্ভ নয় মনে হচ্ছে তার, শেষ রক্ষা না করে যাওয়াটার কোনো মানে হয় না । সবাই কি বলবে তবে? সবাই বলাবলি করবে যে আমি যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই । শেষ রক্ষা না করে গেলে সেটাই আলোচনায় থাকবে । খবর বাতাসে ভাসে, সেক্ষেত্রে স্তেপান নিকিফরভিচ, সেমিওন ইভানভিচ, অফিসের সহকর্মীরা, যত সব শেম্বেল শুবিনেরা কী বলবে তবে? না না, তা চলবে না, এমন ভাবে বিদায় নিতে হবে যাতে সকলেই বোঝে কেন এসেছিলুম, নৈতিক উদ্দ্যেশ্যটাকে পরিষ্কার করে তুলবার জন্য এটা করতেই হবে... । কিন্তু সেই সুযোগটাই আসছিলো না । মনে মনে ভবছিলেন যে এখানে তাঁর সম্মানটাও আর থাকছিলো না । ‘আরে বাবা, এতো হাসাহাসির কি আছে? মনেমনে আবার ভাবছিলেন, ‘আজকালকার ছেলেপুলেদের দেখছি এরা কেমন লাজলজ্জ্বাহীন... বেপরোয়া । না, আমাকে আর কিছুক্ষণ থাকতে হবে ... নাচ তো শেষ হয়ে এলো, টেবিলের চারপাশে জমা হচ্ছে সবাই । এই সময় আমি দেশের কথা, এই সময়ের সমস্যার কথা আলোচনা করতে পারি মনে হচ্ছে... এদের মনঃসংযোগ টানতেই হবে । হয়তো এখনো সেই সুযোগ আছে । বাস্তবিকভাবেই এমন ঘটার ছিলো হয়তো । কিন্তু কিভাবে শুরু করবে সেটা নিয়ে মনের দ্বিধা কাটাতে পারছিলো না ঈভান ইলিয়িচ । আবার নিজেকে অসহায় লাগছিলো তাঁর । ভাবছেন তিনি, ‘ওদের কী ইচ্ছা, কী চায় এঁরা ? ওদিকে দেখছি কয়েকজন হাসছে ! আমাকে নিয়ে হয়তো? আমি ওদের দিকে যাচ্ছি না কেনো ? কী চায় এঁরা ?’ এসব কথা চিন্তা করতে করতেই একটা দ্বিধা ও লজ্জ্বাবোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করতে লাগলো ।
ক্রমশ সবকিছুই এগিয়ে চলতে শুরু করলো । খাওয়ার টেবিলে একটা মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার আশঙ্কা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেললো । হঠাৎ টের পেলেন, তিনি মদের নেশায় চূড় হয়ে উঠছেন । আগে যেমন হয়েছিলেন তেমন নয়, এবার একেবারে বেহেড মাতাল । শ্যাম্পেনের পর ভদকা পান করার প্রতিক্রিয়া ঘটেছে দ্রুত । পুর্ণ চেতনা দিয়েই তিনি উপলব্ধি করলেন যে মাতলামির অন্তিম ধাপে তিনি পৌঁছে গেছেন । তবুও তার হামবরা ভাবটা কমে নি, কিন্তু মন শান্ত হচ্ছিলো না । বারে বারে মনে হচ্ছিলো যে এটা তাঁর করা ঠিক হয় নি, নিতান্ত অন্যায় হয়েছে, লজ্জার ঘটনা । মাতাল চেতনার ভাবনাগুল স্থির থাকছিলো বেশিক্ষণ । দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছিলো ভাবনাগুলো । একদিকে বেপরোয়া ভাব, যা খুশি হয় হোক, চিন্তা নাই, এদেরকে পরাজিত করতেই হবে, যাই হোক তাকে অতিক্রম করে যেতেই হবে । জেদ মাথাচাড়া দিয়েছে, উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতেই হবে । এর পরপরেই মনটা খারাপ লাগতে লাগলো, মনে হলো কি যেনো একটা তার বুকের রক্ত চুষে খাচ্ছে । পাগলের মত মনে হতে লাগল। ‘ কাল কি হবে? লোকজন কি বলবে তাকে নিয়ে! শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গরায় কে জানে!!’
আগেই তিনি ভেবে রেখেছিলেন যে এই আমন্ত্রিতদের মধ্যে তার শত্রুও আছে অনেকে । সন্দেহ বশত ভাবছিলেন, ‘যখন এসেছিলাম তখন নেশা ছিলো বলেই এমন মনে হয়েছিলো তার’ । কিন্তু তার পরের ঘটনাবলীতে তিনি এখন নিশ্চিত যে সামনের টেবিলে সত্যি তার অনেক শত্রু রয়ে গেছে, এবিষয়ে নিঃসন্দেহ সে ।
জেনারেল নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আমার অপরাধটা কি?’
টেবিল ঘিরে থাকা প্রায় তিরিশ জন আমন্ত্রিত অতিথি, এদের বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যেই বেসামাল । আর যারা ছিলো তারা মধ্যে প্রবল হুল্লোড়ে মাতোয়ারা । গলা খুলে চেঁচাচ্ছে, সবাইমিলে এক সঙ্গে চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা । রুটি সেঁকে ওঠার আগেই তাদের তা চাই । কাচা রুটির টুকড়ো বানিয়ে মেয়েদের দিকে ছুড়ে মারছে, মেয়েদের দিক থেকেও তেমনই জবাব আসছে । একটা তিলা পড়া জামা পড়ে আসা লোক এতটাই মদ খেয়েছে যে চেয়ারে বসতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো এবং সেভাবে মাটিতেই পড়ে রইলো । এর মধ্যে এক মাতাল টেবিলে উঠতে চাইছিলো আর সেখানে উঠে রুটির জন্য চেঁচাতে চাইছিলো, তাকে আটকাতে সেই অফিসারটি তার জামার কলার ধরে টেনে রইলো । খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও খুবই আলোমেলো, একদম জগাখিচুড়ি। রান্নার জন্য কোনো এক জেনারেলের ভূমিদাস বাবুর্চিকে আনা হয়েছিলো । খাদ্যের তালিকায় ছিলো মাংসের কিমা, আলু ও জিহ্বার ঝোল , কাটলেটের সঙ্গে মটরশুঁটি এবং এরপর রাজহাসের মাংস ও সবশেষে ব্লামাঞ্জো । পাণিয়ের মধ্যে ছিলো বিয়ার, ভোদকা, শেরী । জেনারেলের প্লেটের পাশে একটা শ্যাম্পেনের বোতল রাখা হয়েছিলো, সেখান থেকে আকিম পেত্রভিচের গ্লাসেও ঢালা হচ্ছিলো, এর কারন নৈশ ভোজের টেবিলে একা সামলানোর সাহস ছিলো না তাঁর । রুটির সঙ্গে পাণীয় হিসাবে সস্তা সুরার বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো অন্যান্য অতিথিদের জন্য । একটা তাস খেলার টেবিলের সঙ্গে আরো কয়েকটি টেবিল জুড়ে খাওয়ার টেবিলের বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো । নানা রকমের টেবিল ক্লথ জুড়ে সেটি ঢাকা হয়েছিলো, একটা রঙ্গিন ইয়ারোস্লাভল ছিলো তার মধ্যে । একজন মেয়ে ও একজন ছেলে এভাবে পরপর বসেছিলো । পসেলদনিমভের মা যদিও কিছুতেই বসলো না, ঘুরে ঘুরে দেখাশোনা করছিল ও নানা জনকে নির্দেশ দিচ্ছিল । এমন সময় একজন কুশ্রী চেহারার মেয়ে, এতক্ষণ তাকে দেখা যায় নি । লাল রঙ্গের একটা সিল্ক পোষাক তার গায়ে, গোলগাল গালের মুখ, একটা রুমাল বাঁধা, মাথায় একটা বেঢপ উঁচু টুপি । শোনা গেলো এই মহিলাই কনের মা । রাতের খাওয়ারের জন্যই সে ভেতরের ঘর থেকে এখন বাইরে এলো, পসেলদনিমভের মায়ের সঙ্গে এই মহিলার তুমুল ঝগড়া রয়েছে । কিন্তু এসব পরের কথা । বিদ্রুপাত্মক একটা নজর নিয়ে সে জেনারেলের দিকে তাকালো, জেনারেলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তার মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না । এই মহিলাটিকে জেনারেলের সুবধা জনক মনে হয় না । এছারাও আরো কয়েকজনের মধ্যে এমন আচরণ দেখতে পাচ্ছিলেন জেনারেল, এদের দেখে মনের মধ্যে একটা স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা জন্মাচ্ছিলো । তার মনে হচ্ছিলো যে এরা সবাই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে । এদের আক্রমণের উদ্দ্যেশ্য নির্ঘাত ইভান ইলিয়িয়েচ । খাওয়াদাওয়া যত এগোচ্ছিলো ততই তার এই দুর্ভাবনা বাস্তবিক মনে হতে লাগলো । দেড়েল একটা লোক, দেখে শিল্পীটিল্পী মনে হয়, তাকেই সবচেয়ে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে । দেড়েলটা মাঝেমাঝেই ইভান ইলিয়িচের দিকে তাকাচ্ছে আর তারপর পাশে থাকা মানুষটার কানে কানে কিছু বলছে । এর একজন আমন্ত্রিতের আচরণও তার সন্দেহজক লাগছিলো । দেখে তাকে ছাত্র মনে হয় আর মদ খেয়ে একবারে চূর । ডাক্তারির ছাত্রটির মধ্যেও কিছু সন্দেহজনক আচরণ দেখা যাচ্ছিলো । এমন কি এই অফিসারটির উপরও আর আস্থা রাখতে পারছিলো না সে । কিন্তু এর থেকেও পরিস্কার একটা বিদ্বেশভাব চোখমুখে ফুটে উঠছিলো সেই ‘অঙ্গার’ পত্রকার সাংবাদিকের মধ্যে । উদ্ধত ও বেপরোয়া মেজাজ নিয়ে সে চেয়ারে বসেছিল আর দাম্ভিক চাহুনি নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিলো । অন্যান্য অতিথিরা যদিও লেখকটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলো না । ‘অঙ্গার’এ তার মাত্র চারটি কবিতা ছাপা হয়েছিলো আর এতেই তার মাটিতে আর পা পড়ছে না । আসলে প্রত্যকেই এই লোকটার প্রতি বিরক্ত । তবুও হঠাৎ একটা আটার দলা ইভান ইলিইয়িচের সামনে এসে পড়লো, তিনি নিশ্চিত যে এই কাজটি ওই ‘অঙ্গার’এর লেখকটিরই ।
এমন নানা কারনে ইভান ইলিয়িচের খুব খারাপ লাগছিলো । এর একটা বিষয়ও নিয়েও তিনি চিন্তাগ্রস্থ হচ্ছিলেন, সেটি হল নেশার প্রকোপ তাঁকে আচ্ছন্ন করছে, তার জ্বিহ্বা জিড়িয়ে আসছে । উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছিলো, জ্বিহ্বা তাঁর নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য করছিলো । এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চেতনা হারাতে লাগলেন । হাসির কোনও কারন না থাকলেও হা হা করে হেসে উঠছিলেন । এই পর্বটাও এক গ্লাস শ্যাম্পেন পানের পর কেটে গেলো । নিজে নিজেই শ্যম্পেন ঢাললেও সেটি পান করার ইচ্ছা ইভানের প্রাথম দিকে ছিলো না, তবুও গ্লাস থেকে পান করে ফেলছিলেন । বুঝতে পারছিলেন যে কেমন একটা অতিরিক্ত ইমোশন কাজ করছিলো তাঁর মনের ভেতর । অনেক বছর পরে তাঁর হৃদয়ে একটা প্রেম প্রেম আলোড়ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, এই ভালোবাসা সবার জন্য । পসেলদনিমভের জন্যেও, এমন কি ‘অঙ্গার’এর লেখটির জন্যেও । হঠাতই সবাইকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাঁর । সমস্ত মনোমালিন্য ভুলে সবাইকে আবার আপন করে নিতে চাইলেন তিনি ।
মনের ভেতর থাকা সব কথা মেলে ধরতে চাইলেন । যেনো বলতে চাইলেন যে তিনি কত ভালো মানুষ, দেশের জন্য কত অবদান তার, মেয়েদের কিভাবে হাসাতে পারেন । তিনি তাঁর প্রগতিশীল মননকে তুলে ধরতে চাইলেন সবার সামনে, এমন কি অধস্তন বা নিম্নস্থরের মানুষদেরও তিনি কিভাবে আপন করে নেন তা দেখাতে চাইলেন । এভাবেই তিনি সবাইকে জানা দিতে চান যে কিভাবে অধস্থন কর্মী পসেলদনিমভের বাসায় এই অনুষ্ঠানে বিনা অমন্ত্রেণেই তিনি এসেছেন, দু-দু বোতল শ্যাম্পেন পান করেছেন , তাঁর উপস্থিতি দিয়ে আনন্দিত করেছেন তাদের ।
‘সবচেয়ে প্রধান বিষয় হলো সত্য ও পবিত্রতা, অকপট থাকা । আমি আমার ভনিতাহীন আচরণে অন্যদের মনে যায়গা করে নেবো । আমি বিশ্বাস করি ওরাও আমাকে আপন করে নেবে । এই মূহুর্তে আমার প্রতি এদের অনে্কেই বিরূপ, কিন্তু সবশেষে তাদের মনে আমি যায়গা করে নেবো এই বিশ্বাস আছে । পেয়ালা পুর্ণ সুরা নিয়ে তারা আমার সুস্বাস্থ কমনা করবে । অবেগে ওই অফিসারটি তার বুকে পানপাত্র ঠুকে দেবে এমন ভাবে যে তা ভেঙ্গে যাবে, চিয়ার্স – হুররেরে-এ-এ বলে চেঁচিয়ে উঠবে আনন্দে । হুসারির কায়দায় তারা সবাই মিলে আমাকে নিয়ে লোফালোফি করতে শুরু করলেও অবাক হবো না । নতুন বোউয়ের কপালে চুম্বন এঁকে দেবো, খুব সুন্দর মেয়েটি । আকিম পেত্রোভিচও খুব ভালো মানুষ । পসেলদনিমভ আরো ভালো হয়ে উঠবে । সমাজের উচ্চস্থরের আভিজাত্য নেই তার মধ্যে । এটা শুধু তার নয়, এই সময়ের সমস্থ তরুণেরই সমস্যা এটা, হৃদয়ে সেই সূক্ষ্ণতা বোধ নেই । আমার দায়িত্ব ওদেরকে আমাদের রাশিয়ার দিশা, অন্যান্য ইউরোপিয় দেশ গুলোর সামনে কি মিশন আমাদের তা বোঝানো । কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কেও আলোচনা করবো । এর ফলে এদের সবার সামনে আমি বেশ আপন হয়ে উঠবো । এখান থেকে স-সম্মানে ফেরা যাবে’ ।
কথাগুলো ভালো লাগছিলো তাঁর, কিন্তু এমন মনোরম কল্পনার উপর থুথু ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যে জেগে ওঠাটাকে আটকাতে পারলেন না ইভান ইলিয়িচ । অনিচ্ছা থাকলেও মুখ থেকে থুঃ থুঃ বেড়িয়ে এলো তাঁর । নিজের এই অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন তৎক্ষণাৎ যখন দেখলেন আকিম পেত্রোভিচের গালে সেই থুথু ছিটে লেগেছে ও শ্রদ্ধাবশত আকিম তা মুছে ফেলতেও পারছেন না । হঠৎ রুমাল নিয়ে তিনিই সেই গালে লেগে থাকা থুথু মুছিয়ে দিলেন । কিন্তু এই ঘটনাটা তার কাছে এতটাই বিরক্তিকর লাগছিলো যে হতবম্ভ হয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন । আকিম পেত্রোভিচও মদ্যপান করেছেন, কিন্তু কেমন লাল মুখ নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলেন । এতক্ষণে ইভান ইলিয়িচ টের পেলেন যে প্রায় পনের মিনিট ধরে তিনি আকিমের সঙ্গে একনাগারে কথা বলে চলছেন । এবং যে বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলছেন তা খুবই মনোহরণকারী, কিন্তু সেই কথাতে আকিম পেত্রভিচ কেমন যেনো ভয় পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে । তার পাশে বসে থাকা পসেলদনিমভও একদিকে মাথা ঝুকিয়ে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক বিস্ময়ে, মুখ ভার তার । মনে হচ্ছে যেনো তার পাহারাদার । অনুষ্ঠানের সমাগত অতিথিদের দিকে তাকেয়ে দেখলেন ইভান, তার সবাই তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন আর হাসছেন । তবে এখন এসব আর তাঁকে অপ্রস্তুত করছে না, বরং অন্যটাই লাগছে । গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়েই আবার তিনি কথা বলা শুরু করলেন ।
কন্ঠস্বর যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে তিনি বললেন, ‘আগেই বলেছি আমি। এই কিছুক্ষণ আগে আকিম পেত্রোভিচকে বলছিলাম যে রাশিয়া, হ্যা রাশিয়া... মানে যা বলতে চাইছি তা নিশ্চই আপনারা বুঝছেন... আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের পিতৃভূমি রাশিয়া এখন মনবিকতার ভিত্তিভূমের মধ্য দিয়ে চলছে’ ।
টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মা-ন-ব-তা!!’
‘মা-ন- - - !’
‘তা-তা...’
হঠাত এই চেঁচানিতে ইভান ইলিয়িচ ঘাবড়ে গেলেন । গৃহকর্ত্তা পসেলদনিমভ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকটা তাকিয়ে দেখলো – কে চেঁচিয়েছে? আকিম পেত্রভিচ মাথা নেড়ে অতথিদের ইশারা করতে চাইলেন । ইভানের তা চোখ এড়ালো না, মনের মধ্যে সেই ব্যাথাটা আগলে রাখলেন তিনি । এরপর একটা জেদ চলে এলো তার মধ্যে । জেদ করেই বলতে লাগলেন, ‘মানবতা ! এই কিছুক্ষণ আগেই... হ্যা, এই কিছুক্ষণ আগেই আমি স্তেপান নিকিফরভিচকে বলছিলাম... হ্যা... বলছিলাম যে ... সবকিছুর মূল দিশাই নতুনত্বের পথে চলা...’ ।
টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে কেউ একজন জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘হুজুর !’
‘কি বলছেন?’ কথা থামিয়ে ইভান ইলিয়েচ জিজ্ঞাসা করলও তাকে । মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করছিলেন তাকে দেখার ।
‘কিছু না হুজুর, হঠাৎ একটু উত্তেজনা এসে গিয়েছিলো । বলুন, আপনি আপনার মত বলে যান স্যার ।’
ইভান ইলিয়িচ একটু থমকে গেলেন । ‘ঠিক, এ সমস্ত বিষয়কে নতুনত্বের আখ্যা দেওয়া যায়’ ।
‘হুজুর !’ আবার সেই লোকটার স্বর । ‘হ্যা, বলুন !’ ‘বলছিলাম আপনাকে প্রণাম !’
এবার ইলিয়িচ আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে । কথার মাঝে থেমে গেলেন আবার, একবার তাকালেন সেই লোকটার দিকে যে বারংবার বাধা দিচ্ছিলো । একটি অল্প বয়সী ছাত্র, নেশায় টলছে সে, দেখে তাকে সন্দেহজনক মনে হয় তাঁর । কিছুক্ষণ আগে এই ছোকরাটিই চেচামেচি করেছে, গ্লাস ও প্লেট ভেঙ্গে চেঁচিয়ে বলছিলো যে বিয়েবাড়িতে এভাবেই ভাঙতে হয়, ইভান ইলিয়িচ যখন তার দিকে তাকালেন তখন গণ্ডগোল পাকানো এই ছোকরাটিকে করা ধমক দিচ্ছেন অফিসারটি, “চেঁচাচ্ছ কেনো? বের করে দেওয়া উচিৎ তোমায় !’
‘আপনাকে বলি নি কিছু স্যার । আপনাকে নয় । আপনি বলুন !’ চেয়ারে টলে পড়তে পড়তে ছোকরাটি চেঁচাতে লাগলো, ‘আপনি বলে যান । আমি শুনছি; ভারি, ভারি ভালো লাগছে আপনার কথাগুলো । সাধু, সাধু ...’
‘মাতাল !’ ফিসফিস করে বললো পসেলদনিমভ ।
‘মাতাল ! তা তো আমরা দেখতেই পারছি...’
‘আমি ওকে একটা মজাদার কাহিনী বলছিলাম স্যার’, অফিসারটি বললো, ‘আমাদের পল্টনের একজন এন্সাইন অফিসারের সঙ্গে ঐ রকম করে কথা বলতো । ও তারই নকল করতে শুরু করেছে । অফিসার যাই বলুন, সে কেবলই চেঁচাত – ‘সাধু, সাধু’ বলে । বছর দশেক আগে এই কারণে তার চাকরিটাই চলে গিয়েছিলো ।’
‘কে এই এনসাইন?’
‘আমাদের পল্টনের একজন’ । কথাটা নিয়ে ও প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো । প্রথমদিকে অল্পস্বল্প ডোজ দেয়া হতো সংশোধনের জন্য, কিন্তু এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া পথ ছিলো না । উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কেউ তাকে বাপের মতো বললে সে বলতো ‘সাধু’ সাধু’ ! কি পাগলামো ! ছ ফুটের উপর লম্বা সেনা অফিসারটি ঠিক করেছিলো একে কোর্ট মার্শাল করবেন । তারপর দেখা গেলো লোকটার মাথায় গোলমাল আছে ।’
‘স্কুল স্টুডেন্ট... তাই এর মজা করাটাকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে ... আমার দিক থেকে একে ক্ষমা করে দিচ্ছি ।‘
‘স্যার, লোকটার মেডিক্যাল টেস্ট করা হয়েছিল !’
‘সে কি! অপারেশান বা পোস্টমর্টেম করে দেখা হয়েছিলো নাকি !’
‘আরে, এতো জ্যান্ত মানুষ একটা !’ এই কথায় সমবেত লোকজনের মধ্যে একটা হাসির হুল্লোড় উঠলো, এতক্ষন তারা সবাই চুপ করে বসে ছিলো । ইভান ইলিয়িচ এতে ক্ষেপে উঠলেন ।
‘আরে শুনুন শুনুন, জ্যান্ত মানুষকে যে পোস্টমর্টেম করে দেখা যায় না সে কথা বোঝার ক্ষমতা আমারও আছে । আমি ভেবেছিলাম পাগল হলে আর জ্যান্ত থাকে না মানুষ !’ প্রথমে স্পষ্ট ভাবে কথাগুলো বললেও ক্রমশ তা জড়িয়ে যাচ্ছিলো । ‘ মারা গেছে ভেবেছিলাম । মানে সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম ! ... মানে বলতে চাইছি... আপনারা আমাকে পছন্দ করছেন না... আপনারা আমায় ভালোবাসেন না... কিন্তু আমি আপনাদের সবাইকেই ভালোবাসি... হ্যা, হ্যা... এমনকি এই পরফিরিকেও ... এভাবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলে আসলে আমি নিজেকেই ছোট করে ফেলেছি ...’
কথা বলার সময় ইভান ইলিয়েচের মুখ থেকে ক্রমাগত থুথুর দলা ছিটকে আসছিলো । সেই ছিটে আসা থুথু টেবিল ক্লথের একাংশকে ভিজিয়ে তুললো । পসেলদনিমভ ছুটে এলো সেই ভেজা অংশটা মুছে দিতে । এই অবস্থায় পৌঁছে ইভান ইলিয়িচ একদম ভেঙ্গে পড়লেন । নিজের প্রতি প্রবল হতাশায় চেঁচিয়ে উঠলেন, বড্ডো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু !’
‘নেশা তো সবারই হয় স্যার,...’ আবার বললো পসেলদনিমভ ।
‘পরফিরি ! দেখতে পাচ্ছি আপনারা... আপনারা প্রত্যেকেই... আপনাদের সবাইকেই বলছি... আপনাদের প্রত্যেকের কাছেই আমি ছোট হয়ে গেলাম,...’ বলতে বলতে ইভান প্রায় কেঁদে ফেললেন । ‘কী বলছেন স্যার!’ ‘পরফিরি, আমি তোমায় জিজ্ঞাস করছি, আমি এভাবে তোমার বিয়েতে এসেছি, সেটা কি উদ্দ্যেশ্য ছাড়া? আমি মন থেকে চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কগুলোর নৈতিক ভিত্তিটা আরো উঁচু হোক ... চেয়েছিলাম আপনাদের সবাইকে নিয়ে খুশির আলোতে জড়িয়ে রাখবো । আপনাদের প্রত্যেকের কাছে তাই আমার জিজ্ঞাসা, আপনাদের চোখে কি আমি কি নিজেকে খুব নিচু স্তরে নিয়ে গিয়েছি?’
উৎসব মুখর ঘরটিতে মর্গের নিরবতা এসে গ্রাস করলো । ‘এবার অনুভব করুন বিষয়টা, আমার জিজ্ঞাসার সামনে নেমে আসা এই মৃত্যুহীম নিরবতা ! এখন কেনো ওরা চেঁচিয়ে বলছে না !’ ইভানের মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো জ্বলে উঠলো কথাগুলো, আগত অতিথিরা একে অন্যের মুখ দেখাদেখি করতে লাগলো । আকিম পেত্রোভিচ মরার মতো ঠান্ডা হয়ে বসেই রইলেন, আর ভয়ে চুপ করে থাকলো পসেলদনিমভ, তার মথায় একটাই প্রশ্ন ঘু্রপাক খাচ্ছিলো, ‘এ সবের পর আগামী কাল কি যে ঘটবে আমার কপালে !’
সেই লেখকটি এইমধ্যেই মদের নেশায় চূর, মুখ গোমড়া করে সে এতক্ষণ বসে ছিলো । হঠাৎ তিনি চকচকে দৃষ্টি নিয়ে ইভান ইলিয়িচের দিকে তাকালেন এবং বেশ জোরের সঙ্গে উঁচু স্বরে বললেন, ‘হ্যা, আপনি নিচু হয়ে গেছেন আমাদের সামনে । আপনি একজন প্রতিক্রিয়াশীল মানুষই’, কেটে কেটে বললেন ‘প্র – তি –ক্রি –ইয়া –শীল’ ।
‘নিজের অবস্থান ভুলে গেছো ছোকড়া! জানো না কার সঙ্গে কথা বলছো!’ প্রচন্ড রাগে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বললেন ইভান ইলিয়িচ ।
‘আমি জানি আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি এবং এটা মনে রাখবেন আমি ছোকরা নই... আপনি এসেছিলেন সস্তায় নাম কামাতে!’
‘পসেলদনিমভ, এসবের মানে কী?’ ইভান ইলিয়িচ তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন । পসেলদনিমভ লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো, কিন্তু ভয়ে তখন তার পা হীম হয়ে গেছে, বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে । অতিথিরা সবাই এমন ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় । সেই শিল্পী ও ছাত্রটি সোল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠলো । ‘সাবাস, সাবাস !’
“হ্যা, আপনিই এসেছিলেন আপনার মানবতার বড়াই করতে ।” চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলো ‘অঙ্গার’এর লেখকটি । ‘সবাই মিলে মেতে থাকা আনন্দ-ফুর্তিতে আপনি এসে ব্যঘাত ঘটিয়েছেন । শ্যাম্পেন গিলে গেছেন, অথচ ভাবেননি মাসে দুশ রুবল বেতনের অধঃস্থন কর্মীর পক্ষে সেই শ্যাম্পেনের খরচ যোগার করা কতো কঠিন । আমার তো মনে হয় আপনি সেই সব উর্ধতন কর্তাদের মতো যারা অধঃস্থনের সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি কুনজর দেন । শুধু এটাই নয়, আমার স্থির বিশ্বাস আপনি ঠিকা প্রথার পক্ষে থাকা মানুষ... এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই ।”
ইভান ইলিয়িচ এমন অপমানের ধাক্কা সামলাতে পারছিলেন না, প্রতিটি কথা তাঁর বুকে গিয়ে বিঁধছিলো । তিনি দুই হাত ছড়িয়ে পসেলদনিমভের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন ।
‘স্যার, এক্ষুনি দেখছি ! আপনি কিছু ভাববেন না’ । বেশ জোড়ের সঙ্গে বললেন পসেলদনিমভ । এরপর লেখকের দিকে ছুটে গেলেন, কোটের কলার ধরে তাকে এক ধাক্কায় টেনে তুললো সে। তাকে টেনে নিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে । মার্কুটে ভঙ্গিতে পসেলদনিমভ যে এতোটা শক্তি ধরবেন তা আগে ভাবা যায় নি । যদিও লেখকটি তখন মদে মাতাল আর গৃহকর্তা পসেলদনিমভ সম্পূর্ণ প্রকৃতস্থ । পিঠে কয়েকটি ঘুসি চালিয়ে এক ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘর থেকে বের করে দিলো সে ।
‘হামজাদা ! সবকয়টা বদমাইশ !’ লেখকটি সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছিলো, ‘কাল অঙ্গার পত্রিকায় আমি তোদের মুখোশ খুলে দেবো, দেখে নিস !’ সকলেই ততক্ষণে উঠে দাড়িয়েছিলো ।
পসলদনিমভ, তার মা, আর কয়েকজন অতিথি তখন ইভান ইলিয়েচকে অনুরোধ করে যাচ্ছিলো, ‘স্যার, স্যার, কিছু মনে করবেন না । স্যার !’
‘ওহ! ওহ!’ বললেন জেনারেল, ‘আমার সম্মান চলে গেছে... এসেছিলাম... এসেছিলাম কিছু ভালো আদব কায়দায় দীক্ষিত করতে ... নব বঁধুকে আশির্বাদ করতে ... আর এই সব তো এই জন্যেই !’
নেশার চোটে জ্ঞান হারিয়ে টলে পড়লেন চেয়ারের উপরই । মাথাটা ঝুকে পড়ছিলো আর হাতটা গিয়ে পড়লো এক প্লেট ব্লামাঞ্জের মধ্যে । এর ফলে উপস্থিত প্রত্যেকের মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হলো। মিনিট খানেক পরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি । বোঝা যাচ্ছে যে তিনি চলে যেতে চাইছেন । কিন্তু নেশায় এতটাই মত্ত যে টলতে টলতে চেয়ারের সঙ্গে পা আটকে সোজা উলটে পড়লেন মেঝের উপর । তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ইভান ইলিয়েনিচ নাক ডাকতে লাগলেন ।
ঘটনার আকস্মিকতায় পসেলদনিমভকে যতটা বিদ্ধস্ত লাগছিলো তার অবস্থা আসলে তার চেয়েও খারাপ ছিলো । তখনো ইভান ইলিয়িচ জ্ঞান হারিয়ে মেঝের উপর পড়ে রয়েছেন আর তার সামনে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পাসলদনিমভ মাথার চুল ছিঁড়ছিল । এই সময় ঘটনা পরম্পরা থেকে সরে গিয়ে পরফিরি পেত্রোভিচ পসেলদনিমভের সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা হতে পারে ।
বিয়ের মাসখানেক আগেও আর্থিক অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছিলো সে । গুবের্নিয়ায় তার গ্রামের বাড়ি, সেখানে ওর বাবা কিছু একটা কাজ করতেন । কোনো এক ঘটনায় তার বিচার হয় এবং সেই অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে । বছর খানেক ধরে পিটার্সবুর্গে দারিদ্রের মধ্যে ক্ষুধার্ত জীবন অতিবাহিত করার পর বিয়ের ঠিক পাঁচ মাস আগে যখন মাসে দুশ রুবল মাইনের চাকরি জুটল পসেলদনিমভের, তখন সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ঘটনাক্রমের তার আবার মানসিক অস্থিরতার কারণ ঘটে । পসেলদনিমভের আত্মিয়স্বজন বলতে ছিলো মাত্র দুজন – সে ও তার মা, স্বামীর মৃত্যুর পর মা গুবেনির্য়া চলে আসে পিটার্সবুর্গে । এরপর হাড়কাপানো ঠান্ডায় মা ও ছেলের খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টের সঙ্গে দিন কাটে । এমন দিন গেছে তাদের যে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য জাগ হাতে ফন্তানকা নদীতে যেতে হয়েছে ! শেষ পর্যন্ত চাকরি পাবার পর মা ও ছেলে মাথা গোঁজার মতো একটা আস্তানা জোগার করে নিতে পারে । মা ধোবার কাজ নেয় আর একজোড়া জুতো ও একটি ওভারকোট কেনার জন্য চার মাস ধরে পসেলদনিমভ টাকা জমাতে থাকে । অফিসেও খুব কষ্টের মধ্য থাকতে হয়েছে তাকে; বস এসে জিজ্ঞাসা করতেন যে কতদিন ধরে সে স্নান করে নি । সহকর্মীরা হাসিঠাট্টা করতো যে তার কোটের কলারে এতো নোংরা যে সেখানে ছাড়পোকা বাসা বেঁধেছে । কিন্তু প্রবল ইচ্ছা শক্তিতে পসলদনিমভ সমস্তটা সহ্য করে গিয়েছে । সে চেহারা ছিলো শান্ত ও নিরীহ, পড়াশোনাও খুব একটা জানতো না, খুব একটা কথাবার্তা বলতো না সে, বোঝা যেতো না যে মনের মধ্যে তার কি ঘটছে, কোনো মতলব আছে কি না ! কোনো উচ্চাশা পোষণ করছে কি না সেটা বাইরে থেকে বুঝাবার উপায় ছিলো না । তার মনের মধ্য একটা অদম্য ইচ্ছা শক্তি দানা বেঁধে উঠছিলো এই করুণ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য । পিঁপড়ের মতো অসম্ভবকে বহন করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে চাইছিলো সে । পিঁপড়েরা যেমন যতবার বাসা ভাঙ্গা হবে সে আবার পূর্ণউদ্যমে সেই বাসা গড়ে নেবে, তেমনি সেও ভেঙ্গে পড়ার মানুষ ছিলো না । নিজের বাসার জন্য একটা পজিটিভ স্বপ্ন ছিলো তার । তাকে দেখেই বলে দেওয়া যেতো যে এই লোকটা ঠিক এগোবে, বাসা গুছিয়ে নেবে বা কিছু সম্পদ জমিয়েও যাবে সে । পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কাউ ছিলো না তার যে তাকে ভালোবাসতো, মায়ের এই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলো না । গুবের্নিয়া মেয়েটি ছিলো দৃঢ়চেতা ও পরিশ্রমী, তেমনি ভালোমানুষ । অবস্থা না ফেরা পর্যন্ত সেই মাথা গুজবার ঠাইতেই হয়তো আরো বছর পাঁচেক কেটে যেতো, যদি না দেখা হতো অবসরপ্রাপ্ত টিতুলার কাউন্সিলার ম্লেকোপিতায়েভের সঙ্গে । তিনি ছিলেন সরকারি ট্রেজারির এক অবসরপ্রাপ্ত কেরানি, মফস্বলে চাকরি করত, সম্প্রতি পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন পিটার্সবুর্গে । পসেলদমিনভকে চিনবার কারণ কোনো একসময় তার বাবা এই করনিকের কিছু উপকার করে দিয়েছিল । অল্প কিছু অর্থ নিয়ে এসেছিলেন তিনি, খুব একটা বেশি টাকা নয় সেটা । তবে এই টাকার পরিমান কেউ জানতো না , না তার বৌ, না তার বড় মেয়ে, না তার আত্মীয়স্বজন । দুই মেয়ে তার, এই বৃদ্ধটি অদ্ভূত খেয়ালি ছিল, সে ছিল মাতাল, সংসারের সবাই তার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকতো । এর উপর সে ছিলো অসুস্থ – এই সময় তার মাথায় ঢুকে যে সে তার মেয়ের বিয়ে পসেলদনিমভের সঙ্গে দেবে । সে ভেবেছিলো যে পসেলদমনিভের বাবাকে সে চিনতো, বড় ভালো মানুষ ছিলো সে, ছেলেটাও নিশ্চই ভালোই হবে । কোনো খেয়াল চাপলে সেটা করেই থামে ম্পেকোপিতায়েভ, খামখেয়ালি ও বদমেজাজি ছিলো সে । সারা সময় সে আলস্যে চেয়ারে বসে বসে কাটাতো, অসুস্থতার জন্য পা দুটো তার অচল হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু সেই জন্য মদ খাওয়ার খামতি হতো না। সারাদিন মদ খেতো আর সবাইকে গালাগালি করে অস্থির করে ছাড়ত । গালাগালি করার জন্য তার কাউকে না কাউকে চাইই । এই উদ্দেশ্যেই কয়েকজন আত্মিয়কে সে তার বাসায় এনে রেখেছিলো – তার বোন, অসুস্থ গজগজ করতে থাকা একটি মেয়ে, তার বৌয়ের দুই বদমেজাজি ও মুখরা বোন এবং একজন বুড়ি মাসী, দুর্ঘটনায় যার পাঁজরের একটি হাড় বাদ গেছে । এছাড়াও তার একজন পোষ্য ছিলো, জার্মানি এক বৃদ্ধা । এই বৃদ্ধার গুণ ছিলো যে সে গৃহকর্তাকে ‘আরব্য রজনী’র মতো রূপকথার গল্প শোনাতো । এইসব লোকেদের, যারা তার আশ্রয়ে এসেছিলো তাদের সারাদিন ধরে উত্যক্ত করে ছাড়তো এই মানুষটা, এদের সাধ্যমতো গালাগাল দেওয়াতেই তার আনন্দ ছিলো । কিন্তু যতোই গালাগাল খাক তারা কেউ টু শব্দটিও করতো না, এমনকি তার বৌও না, ‘দাঁতের ব্যাথায় কাহিল হয়ে থাকার মতো থাকতো সে’ । এইসব লোকেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিতো ম্পেকোপিতায়েভ, কুৎসা খুঁজে বেড় করতেন, এর কথা তাকে - তার কথা একে লাগিয়ে মজা দেখতো সে । বাসার মানুষেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করলে আনন্দে হাসতো সে । বড় মেয়ে তার অফিসার স্বামীর সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে দশ বছর কাটিয়ে যখন আবার বাপের বাড়ি ফিরে এলো তখন তার সঙ্গে তিনটি রোগা রোগা সন্তান । কিন্তু ম্পেকোপিতায়েভ এতে খুশিই হলো , ওই সন্তানগুলোকে দেখতে পারতো না, কিন্তু তার আনন্দের হলো কারণ ঝগড়া লাগিয়ে মজা দেখার উপকরণ বেড়ে গেলো তার । রুগ্ন সন্তানদের নিয়ে এই বদমেজাজি মেয়েটি পিটার্সবুর্গের এই কাঠের বাড়িটায় গাদাগাদি করে থাকতো তাদের অত্যাচারী বাবার সঙ্গে । অধিকাংশ সময় খাওয়া জুটতো কি জুটতো না, বুড়ো ম্পেকোপিতায়েভ ছিলো অসম্ভব কৃপণ, একসঙ্গে যতটা কম পারাযায় ততটাই অর্থ বা কোপেক বের হতো তার হাত থেকে, যদিও মদের পরসায় খামতি হতো না কখনো । এই বাড়ির কেউ এই মানুষটার জন্যে ভালো করে ঘুমোতে পারতো না । বুড়োর অনিদ্রা রোগ ছিলো, অন্যদের সেই জন্য রাত জেগে তাকে ফুর্তি যোগান দিতে হতো । এরা সবাই খুবই নিরানন্দে জীবন কাটাতো আর নিজেদের ভাগ্যকে দোষ দিতো । ঠিক এই সময় ম্পেকোপিতায়েভের নজর পরে পসেলদনিমভের উপর । তার লম্বা নাক আর নম্র স্বভাব ভালো লেগেছিলো তার । তার রোগাটে আর সাদাসিদে ছোট মেয়েটির তখন বয়স সতের, সদ্য জন্মদিন পার হয়েছে । জার্মানির এক স্কুলে ভর্তি করা হলেও প্রাথমিকেই থামতে হয়েছে তাকে । এরপর তাকে মাতাল ও খোঁড়া বাবার ক্র্যাচের শাষনেই থাকতে হয়েছে, ক্রমশ আরো রুগ্ন হয়ে পড়েছে সে । পারস্পরিক নিন্দা, কুৎসা ও গোয়েন্দাগিরির এই নরকেই দিন কাটতো তার । মেয়েটির কোনো বন্ধু ছিলো না, বুদ্ধিও ছিলো না । বাইরের মানুষের সামনে সে গোবাচারি, কিন্তু বাসার ভেতরে, বিশেষ করে মায়ের সামনে ও বাড়ির অন্যান্যদের সামনে সে দুদিক কাটা তরোবারি । দিদির রুগ্ন ছেলেগুলোকে আড়ালে চিমটি কাটতো আর ঝগড়া বাঁধাত, তারা রুটি বা মিস্টি চুরি করলেই তা যথাস্থানে বলে দিতো, ফলে দিদির সঙ্গে তার সাড়াদিন ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত । বুড়ো নিজে থেকেই পসেলদনিমভের কাছে মেয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো । পসেলদনিমভ গরিব হলেও এই সম্বন্ধ ভেবে দেখার জন্য সময় চাইলো । বাড়িটা মেয়ের নামে রেস্ট্রি করা ছিল । একতলা একটা জীর্ণ কাঠের বাড়ি, কিন্তু বেশ বড় । তাছাড়া হবু বরের মাসে চারশ রুবল আয়, এই পরিমাণ টাকা জমাতে তার অনেক বছর সময় লেগে যেতো । বুড়ো ম্পেকোপিতায়েভ চেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলছিলো, ‘বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষকে আনছি কি জন্যে জানো তোমারা? এর প্রথম কারণ বাসাটা মেয়েতে ভর্তি, আর মেয়েমানুষে আমার অরুচি ধরে গেছে । আমি চাই পসেলদনিমভও আমার কথাতেই চলবে কারণ আমি তার উপকার করছি । দ্বিতীয়ত, ওকে নিচ্ছি কারণ তোমরা সকলেই ওর বিরুদ্ধে, তোমারা সবাই খেপে আছো । ওকে নিচ্ছি তোমাদের আরো জ্বালানোর জন্যই । আমি যা বলি তাই করি । আর পরফিরি, মেয়েটা তোমার বৌ হলেই ওকে পিটাতে শুরু করবে, বুঝেছ? জন্মানোর পর থেকেই মেয়েটা একদম ঝানু গোয়েন্দা হয়েছে, মেরে ঠান্ডা করে দিও, আমার এই ক্রাচটাও দরকারে তোমাকে দেবো পেটানোর জন্য...’ ।
পসেলদনিমভ এই কথার উত্তরে সেদিন কিছু বলে নি । কিন্তু মন ঠিক করে ফেলেছিলো । বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো । ওকে আর ওর মাকে সেই পরিবারের সদস্য হিসাবে যুক্ত করা হলো সবার আগে । পোষাক-আশাক ধোপদস্ত করা হল । হাতে কিছু অর্থও দেওয়া হল, বিয়ের প্রস্তুতির জন্য । ম্পেকোপিতায়েভের দয়া তাদের উপর বর্ষিত হচ্ছিলো একটু বেশি পরিমানেই, কারণ গোটা পরিবারের কাছেই তারা ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হচ্ছিলো । পসেলদনিমভ মায়ের প্রতি এই বৃদ্ধ একটু বেশি সদয় হয়ে উঠলো, তাকে অন্যদের মতো অত্যাচার করার কথা ভাবেনি সে । বিয়ের এক সপ্তাহ আগে পসেলদনিমভকে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই সে কাজাচক নাচের ব্যবস্থা করলো । নাচের অনুষ্ঠানের শেষ দিকে সে পসেলদনিমভকে বললো, ‘অনেক হয়েছে, আর না হলেও চলবে । আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমি সবকিছু মনে রেখেছ কি না !’
বিয়ের জন্য যতোটা কৃপণতা করা যায় সে তাই করলো । কিন্তু নেমন্তন্যে কার্পন্য করলো না, তার সমস্ত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে বিয়ের নেমন্তন্য জানালো । পাত্রের দিক থেকে একমাত্র সেই ‘অঙ্গার’এর লেখকে ও মাননীয় ব্যক্তি হিসাবে আকিম পেত্রোভিচকে নেমন্তন্য করা হয়েছিলো । পসেলদনিমভ ভালোই জানতো যে পাত্রী তাকে একদম সহ্য করতে পারছে না, অফিসারটিকেই সে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । কিন্তু সে সমস্তকিছু মুখবুজে সহ্য করে গেলো, মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলো সে । বিয়ের দিন ও গোটা সন্ধ্যেটা বৃদ্ধ ম্পেকোপিতায়েভ গালাগাল করে গেলো আর মদ গিলে গেলো । বিয়ের জন্য আত্মীয়স্বজন সহ সবাই একটা ঘরেই গাদাগাদি হয়ে ছিলো, এতটাই চাপাচাপি সেখানে যে প্রত্যেকের দমবন্ধ হবার অবস্থা হচ্ছিলো । বাসার সামনের দিকের ঘরগুলো নাচাগানার জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছিলো । যথারীতি বর ও বৌয়ের দুই মায়ের মধ্যে মনমালিন্য ঘটেছিলো, কিন্তু রাতে আবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে যখন দুজনেই নাচের আসরে ও খাওয়ার আয়োজনে যোগ দিলো । কিন্তু এই সময়েই ঘটে ইভান ইলিয়েচের উপস্থিতি । গোটা আবহটাই পাল্টে করে দিলো তাঁর উপস্থিতি । ম্পেকোপিতায়েভের বৌ চমকে যায়, এবং সবাইকে বকাবকি করতে থেকে যে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার বা জেনারেলকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে এই কথাটা তাকে জানানো হয় নি ! তাকে জানানো হলো যে জেনারেল বিনা আমন্ত্রণে এসেছেন । কিন্তু সে কথা তাকে বিশ্বাস করানো কঠিন ছিলো । জেনারেলের জন্য শ্যাম্পেন আনানো দরকার । কিন্তু পসেলদমিনভের মায়ের কাছে তখন আর মাত্র ২ রুবল টিকে আছে, ছেলের কাছে এক কোপেকও নেই । ম্পেকোপিতায়েভের বৌকে তোয়াজ করে প্রথমে একটি এবং পরে আরো একটি শ্যাম্পেনের বোতলের টাকা জোগার করতে হল তাদের । তাকে বলা হল যে বরের উপরওয়ালা এসেছেন, ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেখার জন্য তার বিবেকের কাছে আবেদন রাখা হচ্ছে । শেষ পর্যন্ত শ্বাশুরির থেকে টাকা পায় বটেও কিন্তু এর জন্য তাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয় । এতোটাই অপমানিত হয় শ্বশুরবাড়ির লোকদের থেকে যে কয়েকবার সে তার সাজানো ছোট্টো বাসর ঘরটিতে গিয়ে মাথার চুল ছিড়ে । অসহ্য অপমানের জ্বালায় সেই ফুলে সাজানো বাসরসজ্জ্বার বিছানার উপর উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদছিল, যে শয্যাটি তার অসীম আনন্দের জন্য রচিত হয়েছিলো । ইভান ইলিয়েচের চিন্তার বাইরে ছিলো সেদিন যে দু’বোতল শ্যাম্পেন সে তিনি পান করলেন তার প্রকৃত মূল্য কতোটা ! এরফলে গোটা ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত যেখানে উপস্থিত হল তার ফলে পসেলদমিনভের মনের অবস্থা কি হয়েছিলো তার ধরনা করা যাবে না, যে রাগ, যে ভয় তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করছিলো । আবার গোদের উপর বীষফোড়ের মতো একটা বিপদ এসে হাজির হলো, হয়তো সারারাত ধরেই তার কলহপ্রিয়া স্ত্রী চেঁচিয়ে যাবে, কেঁদে যাবে এবং নির্বোধ আত্মীয়দের শাপশাপান্ত করতে থাকবে । ইতিমধ্যে তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে, যন্ত্রণায় তার চোখের মণির উপর একটা অন্ধকার নেমে আসছে । এদিকে কর্তা ইভান ইলিয়েচের এমন অবস্থা যে তাকে শুশ্রূষা করা দরকার । রাত তিনটের সময় ডাক্তার ডেকে আনতে হবে অথবা তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে । তাঁকে যদি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আনতে হবে একটা গাড়ি, সেটাকে অবশ্যই কোচোয়ান গাড়ি হতে হবে । এমন একজন অভিজাত ও উচ্চপদস্থ মানুষকে যেমন তেমন করে পাঠানো যাবে না । কিন্তু কণের মা এতে ক্ষেপে গেলো, এই টাকাটা আসবে কি ভাবে? জেনেরেল তার সাথে কথা না বলাটাও তার ক্ষেপে ওঠার একটা কারন ছিলো । এমনকি জেনারেল খাওয়ার সময় তার দিকে সৌজন্যমূলকভাবে তাকাননি পর্যন্ত । এর ফলে সে জানিয়ে দিলো যে তার কাছে আর একটি কোপেকও নেই । হয়তো সত্যিই তার কাছে আর অর্থ ছিলো না । এখন কোথা থেকে টাকা আসবে? এই দুশ্চিন্তায় নিজের মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কি বা করতে পারে পসেলদনিমভ ?
ওদিকে কজনে মিলে ধরাধরি করে ইভান ইলিয়েচকে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে গেলো, একটা চামড়ার সোফার উপর তাকে শুইয়ে দিলো । এদিকে টেবিলপত্তর সরানো শুরু হল আর ওদিকে পসেলদনিমভ ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগলো কিছু টাকা জোগাড়ের জন্য, এমন কি চাকরবাকরদের কাছেও টাকা চাইলো । কিন্তু তাদের কারো কাছে এক পয়সাও পাওয়া গেলো না । আকিম পেত্রোভিচ তখনো ছিলেন সেখানে । পসেলদনিমভ তার কাছেও হাত পাতার ঝুঁকি নিলো । লোকটা এমনিতে মন্দ নয়, কিন্তু টাকার কথা শুনেই ভয় পেয়ে থতমত খেয়ে গেলো । জড়িয়ে পেঁচিয়ে কোনোভাবে সে বলল, ‘অন্য সময় হলে আনন্দের সঙ্গে তোমাকে টাকা দিতে পারতাম... কিন্তু এখন... খুব দুঃখিত ... আমাকে ক্ষমা করো... ’ । এরপর হ্যাট টি নিয়ে সে চলে গেলো সেখান থেকে। একমাত্র সেই স্বপ্নবেদের উল্লেখ করা লেখক ছেলেটির কাছ থেকে কিছুটা উপকার পাওয়া গেলো । তার কাছে টাকা পাওয়া না গেলেও পসেলদনিমভের অবস্থা দেখে সে পাশে দাঁড়ালো । সে, তার মা ও ছেলেটি মিলে বসে ঠিক করলো ডাক্তার ডাকার থেকে একটা গাড়ি ডেকে জেনারেলকে বাসায় পাঠানোই শ্রেয় । যতক্ষণ গাড়ি না আসে ততক্ষণ তার মাথায় ঘারে ঠান্ডা জল ও বরফ দিয়ে ঘরেলু চিকিৎসা চলুক । পসেলদনিমভের মা এই দায়িত্বটা নিলো । ছেলেটা গাড়ি ডাকতে গেলো । এতো রাতে পিটার্সবুর্গে একটা ছ্যাকরা গাড়ি পর্যন্ত পাওয়া গেলো না । অবশেষে ছেলেটি শহরতলির দিকে রওনা হলো, তাদের ঘুম ভাঙালো । সেই গাড়িচালকেরা প্রচুর টাকা দাবি করে বসলো । বলল যে এ সময় একটা গাড়ির জন্য ছয় রুবলও খুব কম । শেষ পর্যন্ত তিন রুবলে রাজী হলো । কিন্তু চারটের ঠিক আগে সেই চালক যখন গাড়ি নিয়ে পসেলদনিমভের বাসায় হাজির হলো ততক্ষণে পরিস্থিতি পাল্টেছে । জেনারেল, ইভান ইলিয়িচ তখনো অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন । সহ্যাতিরিক্ত মদ্য পানের কারনে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ছটফট করছেন, মিহিস্বরে মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে, তিনি এতটাই অসুস্থ যে তাঁকে একা অন্যত্র পাঠানো বিপজ্জ্বনক, এবং সম্ভব নয় । হতাশ ও চিন্তিত পসেলদনিমভ বিরবির করে বললো, ‘ কি যে হবে কে জানে!’ কী আর করা যাবে? এর মধ্যে আরও একটা সমস্যা দেখা দিলো, অসুস্থ মানুষটাকে যদি এখানেই রাখতে হয় তবে রাখবে কোথায়? শোবে কোথায়? গোটা বাসায় মাত্র দুটি, এরমধ্যে একটা মস্তবড় খাট যেখানে ম্লেকোপিতায়েভ তার স্ত্রীকে নিয়ে শোয় । আন্যটি নব বিবাহিত দম্পতির জন্য নকল ওয়ালনট থেকে কেনা । বাড়ির অন্যান্য সদস্য, বলা ভালো সদস্যারা মেঝেতে ঘুমায়, গাদাগাদি করে একটি মাত্র তোষকে কোনো ক্রমে রাত কাটে তাদের । পুড়নো ও নোংরা সেই তোষকগুলো থেকে দুর্গন্ধ বেরোয় । সেই নোংরা তোষকে কুকুরের মতো রাত কাটে তাদের । কিন্তু এই অসুস্থ মানুষটাকে রাখা যায় কোথায়? একটা ফেদারের তোষক জোগাড় করা যায় বটে, ঘুমন্ত কারো পীঠের নিচ থেকে টেনে আনলেই হলো, কিন্তু কোথায় তা পাতা হবে সেটাই তো সমস্যা । সবচেয়ে ভালো হয় যদি বসার ঘরে ব্যবস্থা করা যায়, এই ঘরটি সাংসারিক কাইকিচির থেকে দূরবর্তী যায়গায়, যাতয়েতের দড়জাও ভিন্ন । কিন্তু এঘরে তোষক পাতার যায়গা কোথায় ? চেয়ারের উপর তো আর তোষক পাতা যায়না ! স্কুল ফেরত ছাত্রদের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হলেও ইভান ইলিয়েচের ক্ষেত্রে তা হবে সম্মানহানিকর । আগামীকাল জেগে উঠে যখন দেখবেন একটা চেয়ারে তাঁকে শোয়ানও হয়েছে তখন তিনি বিষয়টি কি ভাবে নেবেন? পসেলদমভ তাই এই প্রস্তাব কানেই নিলো না । শুধু একটাই রাস্তা ছিলো আর, সেটি বাসর ঘর । আগেই বলা হয়েছে যে একটা ছোট্ট ঘরে বাসর ঘর পাতা হয়েছিলো, সেটি খাওয়ার ঘরের লাগোয়া ছিলো । খাটটা নতুন ও ডাবল তোষক পাতা, সেখানে এক্ষণ পর্যন্ত কেউ শোয় নি । বাসর খাটের উপর গোলাপী চাদর পাতা, চারটে গোলাপী মসলিনের ঝালর দেওয়া ঢাকনা পড়ানো ক্যালিকো বালিশ । নরম লেপটা গোলাপী সাটিংয়ে জড়ানো ও সুন্দর সূচী কর্মের চিহ্ন আঁকা । মাথার উপর একটা সোনালী আংটা সেখান থেকে মসলিনের স্বচ্ছ একটা মশারি টানানো । মোটামোটি যেমন একটা বিয়ে বাড়ীর বাসর ঘর হয় তেমনি । অতিথিরা দেখে প্রশংসা করে গিয়েছেন । পসেলদনিমভকে সহ্য করতে না পারলেও কনেও কয়েকবার এই বাসর ঘর ঘুরে গেছে । সুতরাং যখন তার কানে এলো যে এই বাসর ঘরটাই এই মাতাল ও অসুস্থ লোকটার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে সে খেপে লাল । চেঁচামেচি করে হুলুস্থল শুরু করে দিলো, তার মাকে সঙ্গে পেলো সে । চিৎকার করে সে জানালো যে পরদিন সকালে স্বামীর কাছে নালিশ করবে সে । কিন্তু পসেলদনিমভ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো । ইভান ইলিয়িচকে বাসর ঘরেই আনা হোল । সেই বাসর ঘরেই চেয়ারের উপর নবদম্পতির জন্য বিছানা পাতা হলো । কনে কান্নাকাটি করলেও শেষ পর্যন্ত মেনেই নিলো, কারণ বাবার ক্রাচের প্রহারগুণ সে জানে । সে জানে যে আগামীকাল তার বাবা সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানবে । তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সেই গোলাপী সাটিনের লেপটা তার জন্য নিয়ে আসা হলো বসার ঘরে । এই সময় গাড়ির সেই ছোকরাটি এলো । গাড়ির আর দরকার নেই শুনে তার হম্বিতম্বি শুরু হলো, ভাড়াটা তাকে মিটিয়ে দিতেই হবে । পসেলদনিমভের কাছে দশ কোপেকও নেই, সে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দিলো । গাড়ির চালককে শান্ত করার চেষ্ঠা করা হলো, কিন্তু ক্রুদ্ধ ড্রাইভার চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো, জানলার খড়খড়ির উপর দমাদম বাড়ি দিতে শুরু করলো । এরপর কি হয়েছিলো আমার জানা নেই, কিন্তু সেই ছেলেটি জামিন হিসাবে গাড়িতে করে গিয়েছিলো পেসকির ৪র্থ ক্রিসমাস স্ট্রিটে । সেখানে সে পরিচিত কোনো ছাত্রকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জানাবে যে এক পরিচিতের বাসায় ছিলো এবং তার থেকে টাকা ধার নেবে । এদিকে নতুন বড় কনে যখন ঘরের দড়জা আটকে একলা হয়ে কাছে এলো তখন ভোর চারটে । পসেলদনিমভের মা সারা রাত অসুস্থ মানুষটার বিছানার পাশে রয়ে গেলো । মেঝের উপর একটা সতরঞ্চি পেতে শুলো, গায়ের উপর টেনে নিলো তার পাতলা কোটটা । কিন্তু ঘুম আসছিলো না, কেনোনা বারংবার উঠতে হচ্ছিলো তাকে – ইভান ইলিয়িচের ভয়ানক বমি শুরু হয়েছিলো । এই বয়স্কা মহিলার যেমন সাহস তেমনি উদার মন তার । নিজের হাতে ইভান ইলিয়িচের পোষাক খুলে নিজের ছেলের মতো শুশ্রূষা করলো সে । বমি ভর্তি পাত্রটা হাতে নিয়ে বারংবার তাকে ঘর বাহির করতে হলো ।
কিন্তু রাতের এই দুর্দশা তখনো শেষ হয়নি । নবদম্পতি তাদের ঘরে দড়জা বন্ধ করার মিনিট দশেক পরেই ঘটলো এক মহা বিপত্তি । হঠাত একতা তীব্র ও ভয়ানক আর্তনাদে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো । এরপরেই একটা ধপাস করে আওয়াজ, এরই সঙ্গে একটা হুড়মুড় এবং চেয়ার পড়ার আওয়াজ । এর সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো মহিলা সেই অন্ধকার ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল ঘটনাটি কি বুঝবার জন্য । এরমধ্যে মেয়ের মা ও দিদিও ছিলো – রোগা ছেলেপেলেদের রেখেই সে চলে এসেছে, আর তিন মাসি, পাঁজর ভাঙ্গা পিসিটিও বাদ যায় নি । কি ঘটেছে তা দেখার জন্য রাঁধুনিও এসেছে, যে জার্মানটি গল্প শোনাতো সেও এসেছে । এই বাড়ির সবার মধ্যে তার তোশকটিই ছিলো সেরা ও সেটি তার একমাত্র সম্পত্তি ছিলো, তার পিঠের নিচের থেকে একপ্রকার জোর করেই ছিনিয়ে আনা হয়েছিলো সেই তোষকটি । সেই তোশকটিকে নতুন বিবাহিত বর-কনের বিছানায় দেওয়া হয়েছিলো । এইসব গণ্যমান্য মহিলারা চুপিসারে গুটিগুটি পায়ে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে গেলো । বাড়ান্দায় গিয়ে দেওয়ালে কান পাতলো তারা । কেউ একজন দ্রুত একটা মোমবাতি জ্বালালো এবং সেই মোমের আলোয় সেই অভাবনীয় ঘটনাটি আলোর সামনে এলো । চেয়ারগুলো মুখোমুখি রেখে বিছানা পাতা হয়েছিলো বরকনের । তার উপর দুজনে চেপে বসতেই চেয়ারগুলো সড়ে যায় একে অন্যের থেকে এবং চেয়ারের ফাক দিয়ে দুজনেই তোশক সহ মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে । প্রচন্ড রাগে কনে তখন ফুঁসছে, আর তার পাশে বিপর্যস্ত অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পসেলদমিনভ । এটা সত্যি সে মানসিক ভাবে আহত ও বিপর্যস্ত । কোনো কৈফয়ত দেওয়ার জায়গা ছিলো না তার । চারদিকে আর্তনাদ আর চেঁচামেচি চলছে তখন । গোলমাল শুনে পসেলদনিমভের মাও এসে পরলো, কিন্তু পরিস্থিতি কনের মায়ের পক্ষে ছিলো । শুরু থেকে সে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন সব বাছাবাছা গালি বর্ষণ করতে শুরু করলো, এরপর বললো, ‘তুমি কি ধরনের স্বামি হে ? এমন জঘন্য কান্ড ঘোটনোর পরেও তোমাকে আর কী কাজে লাগবে এখানে? এরপর মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে সে নিয়ে গেলো । পরদিন ম্লেকোপিতায়েভ রেগে গিয়ে যাবতীয় ঘটনার বিবরন শুনতে চাইলে তাকে জানানো যাবে সবটা । তার পিছু পিছু সবাই চলে গেলো ঘটনাস্থল থেকে । যাওয়ার পথে সবাই নানা কুটুক্তি করছিলো । পসেলদনিমভ ও তার মা এই দুজন মাত্র পড়ে রইলেন সেই ঘরে । ম কিছু একটা বলে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তাকে খেকিয়ে উঠলো পসেলদমিনভ ।
তার কাছে কিছুই তার পক্ষের ছিলো না । কোনক্রমে ঘষটে ঘষটে সোফার ওপর গিয়ে নিজেকে ফেললো সে । পড়নে তার তখন শুধু অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছু নেই । মাথায় তার নানা দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধছিল । যন্ত্রের মতো তার চাহুনি, সে সেই প্রাণহীন দৃষ্টিতে ঘরের দিকে তাকালো, কিচ্ছুক্ষণ আগেও সেখানে নাচের ছেলে মেয়েরা কি উদ্দাম আনন্দে মশগুল ছিলো ! ঘরের ভেতরটা তখন সিগারেটের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে ছিলো । মেঝেটা নোংড়া হয়ে আছে, তার নানা যায়গা জলে ভেজা এখনো, এখানে সেখানে সিগারেটের টুকড়ো ও লজেন্সের মোড়ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । বিপর্যস্ত বাসর ঘরটি একটি পর্যদুস্ত দাম্পত্যের স্মারক হয়ে পড়ে আছে । শ্রেষ্টতম ও প্রকৃত সত্য সাংসারিক চাহিদার করুন দৃশ্য হয়ে উল্টে থাকা চেয়ার ও বিপর্যস্ত বাসরের খাট পড়ে রয়েছে ! এই মর্মান্তিক আবহের মধ্যে ঘন্টা খানেক বসে রইলো সে ।
পসেলদমিনভের মাথায় তখন হাজার দুশ্চিন্তা । মাথার মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো, অফিসে কি হবে তার? বুঝতে পারছে যে এই রাতে যা ঘটেছে তাতে এই চাকরীটা টিকে থাকা কঠিন, তাকে আবার অন্য একটা চাকরির খোঁজ করতে হবে । ম্লেকোপিতায়েভের কথাও ভাবছিলো সে, হয়তো কাল সে আবার তাকে সেই অসহ্য কাজাকাচ নাচ নাচিয়ে ছাড়বে যে সে কতটা অনুগত সেটা যাচাই করে নেওয়ার জন্য । মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছিল সে, বিয়েতে খরচ করার জন্য পঞ্চাশ রুবল দিয়েছিল বটে কিন্তু আরো চারশ রুবল এখনো দেয়নি, যে টাকাটা যৌতুক হিসাবে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলো সেটা নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করে নি কাল । এমনকি এই বাড়িটি তাদের লিখে দেওয়ার কথা থাকলেও আইনত এর রেজিস্ট্রেশান হয়নি । এরপর তার মাথায় এলো তার বৌয়ের কথা । যৌথ জীবনযাপনের প্রথম দিনেই তার সংকটকালে সে তাকে ফেলে দিয়ে চলে গেলো । সেই লম্বা অফিসারটির কথাও মনে পড়ছিলো তার । লোকটা এক পা মুড়ে নতজানু হয়ে বসে ছিলো তার নতুন বোউয়ের সামনে । এটা তার নজরে এসেছিলো । বাবা ম্লেকোপিতায়েভের কথা মতো সাত রকমের শয়তান তার বৌয়ের মাথায় খেলে বেড়ায়, সেই শয়তানদের শায়েস্তা করার জন্য তার হাতে ক্র্যাচটা কাজ করে । অসহ্য সহ্যশক্তি তার, কিন্তু দুর্বিপাকে পড়ে নিজের সেই শক্তির উপরও আস্থা রাখতে পারছিলো না পসেলদনিমভ ।
এমন নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় নিজেকেই দোষারোপ করছিলো পসেলদনিমভ । ওদিকে জ্বলতে থাকা মোমবাইটি প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো । সেই মোমবাতিটির মৃদু আলো সোজা পড়ছিলো পসেলদনিমভের মুখের উপর । ফলে দেওয়ালে সেই ছায়া বিশাল আঁকারে গিয়ে পড়ছিলো, একটা গলা লম্বা, টিকলো নাক ও সনের মত এক গাছি চুল সোজা উঠে গেছে, আর এক গোছা মাথার পেছনে, এই দুগাছি চুল । ধিরে ধিরে সকালের আলো ফুটছিলো । যখন সেই আলো তার মুখের উপর এসে পড়লো তখন সে জ্ঞান হারানোর মতো টলতে টলতে চেয়ারগুলোর ফাঁকে আটকে থাকা সেই গদীর উপর গিয়ে পড়ল । এরপর কোনো গুছগাছ না করেই, মোমবাতি না নিভিয়ে বা বালিশগুলো না গুছিয়ে, সেই যায়গাটাকে তেমন রেখেই সেই বিছানার উপর গা এলিয়ে দিলো পসেলদনিমভ । অজ্ঞানের মতো ঘুমে ডুবে গেলো সে। এই ঘুম এমন ছিল যে ঘুম কেবল সেই দিতে পারে যার পরদিন হাটে শাস্তি হবে ।
অভিজাত জেনারেল ইভান ইলিয়িচ পসেলদনিমভের বাসর শয্যার উপর যে মর্মান্তিক একটি রাত কাটালেন তার তুলনা কোনো দুর্বিষহ রাতের সঙ্গেই চলে না। মাথা ধরা, বমিভাব এক মুহুর্তের জন্যেও কমছিলো না তাঁর । নরক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন তিনি । মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এসেছে বটে কিন্তু সেই চেতন অবস্থায় থাকছিলো এক অতল অন্ধকার । সবকিছুই গোলমাল লাগছিলো ইভানের । চোখের সামনে ভেসে আসছিলো এমন সমস্ত ঘটনার স্মৃতি যে তার মনে হচ্ছিলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকাটাই শ্রেয় ছিলো তার । অবশ্য তখনো সবকিছুই গোলমেলে লাগছিলো তার কাছে । পসেলদমিনভের মাকে তিনি চিনতে পারলেন । শুনতে পাচ্ছিলেন একটি কণ্ঠ অনুনয় বিনয় করছে। ‘আর একটু কষ্ট করতে হবে বাছা । একটু সহ্য করলেই সবকিছু স্বাবাভিক হয়ে আসবে ।’ পসেলদমিনভের মাকে চিলতে পারলেও তিনি কেনো তার কাছে রয়েছেন তা বুঝতে পারছিলেন না । খুব খারাপ খারাপ দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো । সবচেয়ে বেশি মনে পরছিলো ইভানোভিচের চেহারাটা, কিন্তু একটু ভালো করে নজর করে সে দেখতে পেলো যে সে সেমিওন ইভানোভিচ নন, পসেলদমিনভের নাক ওটি । তার চোখের সামনে দ্রুতলয়ে ভেসে উঠছিলো শিল্পীটি, অফিসারটি, সেই গালফোলা বৃদ্ধাটি – এরা সবাই চোখের সামনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছিলো । তার চিন্তাটা সবচেয়ে বেশী উদ্বেল হয়ে উঠলো যখন তিনি তার মাথার উপর পর্দা টানাবার সেই সোনালী আংটাটা দেখলেন । নিভন্ত মোমবাতির মৃদু আলোয় তিনি জিনিষটা দেখছিলেন পরিষ্কার, আর ভাবছিলেন যে এই আংটাটি কিসের? এটি এখানেই বা কেনো? বৃদ্ধাকে এই বিষয়টি জানার জন্য কয়েকবার জিজ্ঞাসাও করেছেন, কিন্তু ঠিকিঠাক কথাবার্তা না হওয়ায় পসেলদনিমভের মা সেই কথার এক বর্ণও বুঝতে পারেন নি । অবশেষে ভোর বেলায় মাথাব্যাথাটা একটু কমলো, ইভান ইলিয়িচ ঘুমানোর চেষ্ঠা করলেন, গভীর ঘুমে ডুবে গেলেন । ঘন্টা খানেক স্বপ্নহীন ঘুমোলেন, অঘোরে । যখন ঘুম ভাঙলো তখন তার পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এসেছে । মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে, জিহ্বাটা সংবেদনহীন একটুকরো কাপড়ের লাগছিলো । বিছানায় উঠে বসলেন, চারদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন । উপরের চালের ওখানের একটা ফাঁকা দিয়ে সকালের ম্লান আলো আসছিলো, দেওয়ালের উপর তার ছায়াটা কাঁপছিল । ঘড়িতে সকাল তখন সাতটা । ধীরে ধীরে ইভান ইলিয়িচ টের পাচ্ছিলেন তিনি কোথায় ও কেন? রাতের ঘটনাগুলো ক্রমশ তার মনে পড়ছিলো । মনে পড়লো ডাইনিং টেবিলের ঘটনাগুলো, তাঁর লোক দেখানো বীরত্ব, জ্ঞান ফলানো বক্তৃতার কথা । এসবের পর যে পরণতি হয়েছিলো বা হবে সে সমস্তটাই তার মনে হানা দিচ্ছিলো । গোটা ঘটনাটা মানুষজন কিভাবে নিয়েছে বা নেবে সেটা ভেবেও একটা আশঙ্কা তাকে চিন্তাগ্রস্ত করছিলো । কি ঘটবে তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো তার সামনে । যখন সে দেখলো যে তার অধস্তনটির সুসজ্জ্বিত বাসর শয্যার কি ভয়ানক পরিণতি করেছেন তিনি । সেই দৃশ্য দেখে তার মনে একটা গ্লানি জেগে উঠলো যে লজ্জ্বায় দুহাতে মুখটা ঢেকে আবার বিছানায় মুখ গুঁজে উপুর হয়ে পড়লেন । নজরে পড়লো একটা সোফার উপর জামা কাপড় পরিপাটি ভাবে ভাজ করে রাখা হয়েছে । সেই জামাকাপড় টেনে নিয়ে দ্রুত পড়ে ফেলতে শুরু করলেন । একটা আশঙ্কা থেকে চারদিকে তাকাচ্ছিলেন । একটা চেয়ারে কোট আর টুপি রাখা ছিলো, টুপির গর্তে হলুদ দস্তানাটা রাখা। চুপি চুপি চলে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু দড়জা খুলে তখনই বৃদ্ধা পসেলদমিনভা সেই ঘরে ঢুকলেন । হাতে একটা মাটির গামলা ও কলসী, কাঁধে একটা তোয়ালা । গামলাটা নামিয়ে রেখে দৃঢ় স্বরে সে বলল যে ইভান ইলিয়েচকে হাত মুখ ধুয়ে নিতে হবে ।
‘হাত মুখ ধুয়ে নিতে হয় মহাশয় । হাত মুখ না ধুলে চলে না...’
সেই মুহুর্তে ইভান ইলিয়িচ অনুভব করলেন, এই গোটা পৃথিবীতে যদি এমন কেউ থাকে যার কাছে তার কোনো আশঙ্কা নেই , যার কাছে তিনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন, তিনি অবশ্যই এই বৃদ্ধা মহিলাটি । নিরবে হাত মুখ ধুয়ে নিলেন । এরপর যখনই বিষন্নতার মূহুর্ত এসেছে মনখারাপের সেই সময়গুলোয় তার মনে পড়তো এই ঘুমভাংগানীয়া ঘটনাগুলো – মাটির গামলা, কলস, তাতে ছোট ছোট বরফ-কুচি ও ঠান্ডা জল । গোলাপি মোড়কে মোড়া একটা ডিম্বাকৃতি গোলাপী সাবান, সাবানের উপরে কিছু খোদাঁই করা – এর দাম পনেরো কোপেকের বেশী নয় মনে হয়, এবং নবদম্পত্তীর জন্যই নির্ঘাৎ কেনা হয়েছিলো । কিন্তু এই সাবানটির প্রথম ব্যবহারের ভাগ্য ইভানের জন্যই নির্ধারিত ছিলো... আর বা কাঁধের উপর তোয়ালে রাখা এই বৃদ্ধা মহিলাটি... ঠান্ডা জলে তাজা বোধ করলেন ইভান ইলিয়িচ । এরপর হাত মুখ মুছে একটাও কথা না বলে, যে মহিলাটি তাকে একটু আগেই সেবা করলো তাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত না দিয়ে মাথায় টুপিটি পড়ে নিলেন, গায়ে কোটটি চাপিয়ে চলে গেলেন বাড়ান্দার দিকে, এবং রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে । একটা বেড়াল সেখানে মিউ মিউ করলো, তোশকের ভেতর থেকেই আগ্রহী হয়ে তাকে তাকিয়ে দেখলো রাঁধুনিটি । সেখান থেকে উঠোনের দিকে ছুটে এলেন, সেখান থেকে রাস্তায়, তারপর একটা চলন্ত গাড়ি ধরে তাতে উঠে বসলেন । তুষারপাতে ঠান্ডা সকালটা, ঠান্ডা একটা হলদেটে কুয়াশা চারদিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে । ইভান ইলিয়িচ তার কোটের কলারটা তুলে দিলেন । তার মনে হচ্ছিলো সকলেই বুঝি তাকে লক্ষ করছে, প্রত্যেকেই জেনে গেছে তিনি কে, সব্বাই চিনে ফেলছে তাকে... ।
এক সপ্তাহের বেশি নিজেকে ঘরে আটকে রাখলেন তিনি, অফিসে গেলেন না । নিজেকে অসুস্থ লাগছিলো তার, ভয়ানক অসুস্থ, এবং সেটা যতটা না দৈহিক, তার চেয়ে অনেক বেশী মানসিক । এই দিনিগুলো তাক নড়ক যন্ত্রণা দিচ্ছিলো । এই যন্ত্রণা আগামী জন্মেও টোকা থাকবে তার বলে ভাবছিলো সে। মাঝে মাঝে সবকিছু ছেড়ে সন্ন্যাস নেওয়ার কথাও ভাবছিলেন । চিন্তাভাবনা তার সেই দিকেই যাচ্ছিলো । নরকের অন্তিম সেই সঙ্গীত সুর শুনতে পারছিলেন তিনি । একটা উন্মুক্ত কফিন ভেসে উঠছিলো তার চোখে, নির্জন গীর্জা, জঙ্গলে না পাহাড়ের গুহায় জীবনযাপনের কথা তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করছিলো । যখন তার সম্বিৎ ফিরে আসলো তখন তিনি ভাবলেন যে এগুলো নিশ্চয়ই আজগুবি চিন্তাজাত, খুব বাড়াবাড়ি রকমের দুশ্চিনা এসমস্ত, নিজের আবারও লজ্জ্বা লাগলো এজন্য । তারপর তার এই অধপিতত অবস্থার কথা ভাবনা থেকেই শুরু হল নৈতিক বিবেকগ্লানি । অতঃপর পুনরাই একটা লজ্জ্বাবোধ জেগে উঠে বুকটা একদম ভরিয়ে দিলো, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিলো, স্মৃতি এসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লাগালো । চোখের সামনে যেসব ছবি ভেসে উঠছিল তাতে শিউরে উঠছিলেন তিনি । এরপর একদিন তো অফিসেও যেতে হবে, তখন লোকে কি বলবে ? তাকে নিয়ে কানাঘুসা চলবে গোটা বছর ধরেই । তার এই গল্পটা বংশানুক্রমে চলতে থাকবে ! এই সব ভাবতে ভাবতে একটা আতঙ্ক গ্রাস করছিলো, একবার মনে হল ছুটে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বন্ধুত্ব পাতাবে সেমিওন ইভানভিচের সঙ্গে । নিজের পক্ষে কিছু বলার ইচ্ছাটাও আর ছিলো না তার । নিজের সেদিনের কর্মকান্ডের, তার ব্যবহারের পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেই যুক্তি খুঁজতেও তার নিজের মনে একটা গ্লানি তৈরি হচ্ছিলো ।
একবার ভাবছিলেন সোজা তিনি তার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন এবং নিরবে মানুষের জন্য কাজ করার সংকল্প নিয়ে পথে নামেন । অন্ততপক্ষে তার বন্ধুবান্ধবদের সাহচার্য তাকে ত্যাগ করতেই হবে, স্মৃতি থেকে গোটা অতীত যাতে মুছে যায় । এরপর তার ধারণা হলো এটা একটা অসম্ভব ভাবনা, অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে আগের চেয়ে করা ভাবে চললেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে । এমন ভাবনা তাকে আশাম্বিত করছিলো, মনের দিক থেকে ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠছিলেন । এইসমস্ত সংশয় যন্ত্রণা আটদিন তাকে একটা ভাসমান অবস্থায় রেখেছিল, অসহ্য লাগছিলো তার । একদিন এক সুন্দর প্রভাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে অফিসে যাবেন ।
মন খারাপ করে বাসায় নিজেকে আটকে রাখার সময় অজস্রবার ভেবেছেন অফিসের ব্যপারটা কিভাবে সামলাবেন । একটা দুর্ভাবনা তার ছিল যে অফিসে ঢুকে চলার পথে নানা রকম কটূক্তি শুনবেন, কানাঘুষা কানে আসবে, দেখবেন কুটিল হাসাহাসি । কিন্তু বাস্তবে এসব কিছুই যখন হলো না তখন খুব অবাক হলেন ইভান ইলিয়িচ । যে সম্মান তিনি আগে পেয়েছেন সেই সম্মান তাকে দেখানো হল, অধস্তনেরা মাথা নোয়ালো তাকে দেখে । প্রত্যেকেই ছিলো ব্যাস্ত ও গম্ভীর । মনটা খুশিতে ভরে উঠলো তার ।
অফিসে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন তিনি। কতগুলো রিপোর্ট নিলেন, তার ব্যাখ্যা শুনলেন। যেখানে দরকার সেখানে নির্দেশ দিলেন। তার নিজের মনে হলো এদিনের মত বিচক্ষণতার সঙ্গে আগে নির্দেশ দিতে পারেন নি । নিজেকে একজন ভালো কাজের মানুষ মনে হলো তার। দেখলেন তার কাজে লোকে খুশি হচ্ছে, তার তারিফ করছে, সম্মান করছে তাকে । নিখুঁত ভাবে সব কাজ সমাধা করছিলেন তিনি । সবটা নিয়ে বেশ ভালো কাটলো তার ।
অবশেষে আকিম পেত্রভিচ এল কিছু কাগজপত্র নিয়ে। তাকে দেখেই ইভান ইলিয়িচের মনে তৎক্ষণাৎ একটা আশঙ্কা জেগে উঠল । আকিমের সঙ্গেও কাজ করলেন তিনি, বেশ কৃতিত্ব নিয়েই। এরপর তাকে কি করতে হবে সেই নির্দেশও দিলেন । যদিও তিনি বুঝতে পারছিলেন যে আকিম পেত্রভিচের দিকে তিনি চোখেচোখ রেখে তাকাতে পারছেন না, অথবা এটাও হয়তো ঠিক যে আকিমই তার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। কাজ শেষ হলে আকিম পেত্রভিচ উঠেও চলে গেলো ।
‘আর একটা আবেদন আছে স্যার,’ নিজেকে যথাসম্ভব নির্বিকার রেখে বললেন তিনি, ‘রেজিস্টার পসেলদনিমভ... ডিপার্টমেন্টে বদলি হতে চায়... স্যার সেমিওন ইভানভিচ শিপুলেংকো ওকে একটা কাজ দেবেন বলেছেন । আপনার কাছে মানবিক আবেদন রেখেছেন যে আপনি যেন সহায়তা করবেন ।”
‘ও! সে তাহলে বদলি হয়ে যেতে চাচ্ছে ?’ বললেন ইভান ইলিয়িচ এবং অনুভব করলেন যে বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেলো । আকিম পেত্রভিচের দিকে তাকালেন, চোখাচোখি ।
“বেশ, আমার দিক থেকে আপত্তি নেই... আমি চেষ্টা করবো... আমি রাজী ...”
আকিম পেত্রভিচ চাইছিলেন দ্রুত সড়ে যেতে । কিন্তু ইভান ইলিয়িচের উদার মনের কাছে সবটা বলেই যাবেন ঠিক করলেন । ‘তাকে বলে দেবেন যে আমার কোনো রাগ নেই তার উপরে । হ্যা, সত্যি কোনো ক্ষোভ নেই । বরং পুরোনো কথা আমি ভুলে যেতে চাই... সব কিছু ভুলে যেতে চাই’, বলবেন ভেবেও নিজেকে সংবরণ করলেন ইভান ইলিয়িচ । অবাক হয়ে লক্ষ করলেন আকিম পেত্রভিচের বিচিত্র ব্যবহার; বিবেচনা বোধ হারিয়ে মানুষটা হঠাৎ অবিবেচক হয়ে উঠলেন । তার কথাটা সম্পূর্ণ না শুনেই তার মুখটা লালাভ হয়ে গেল, দ্রুত উঠে সেলাম করতে করতে পিছিয়ে গেলো সে দড়জার দিকে । মনে হচ্ছিলো যেনো মাটিতে মিশে যেতে চাচ্ছে সে, নিজের আসনে গিয়ে বলতে পারলে যেনো বেঁচে যায় সে । একা একা বোকার মতো ইভান ইলিয়িচ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন । আয়নায় নিজের তাকালেও সেদিকে নিজেকে দেখলেন না ।
‘উহু... খুব কড়া ব্যবহার করা দরকার !’ নিজের মনেই বলতে লাগলেন তিনি, এমন ভাবতে ভাবতেই তার গোটা মুখটা রক্তজমে লাল হয়ে উঠলো । সেই মহুর্তে প্রচন্ড গ্লানি বোধ হতে লাগলো, খুব কিঞ্চিৎকর লাগছিলো নিজেকে তার, এমনটা গত আট দিনের গৃহবন্ধী থাকাকালীন দুঃসহ সময়েও মনে হয়নি ।
‘চালিয়ে যেতে পারলাম না !’
অসহায় ভাবে কথাগুলো মনে মনে উচ্চারণ করে চেয়ারেই আবার বসে পড়লেন ।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন