দু’জন আলাপ করছেন, ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে একটি বই- ‘সঙ্গীত নিয়ে অবিরাম আলাপ : সেইজি ওজাওয়ার সঙ্গে হারুকি মুরাকামি’ (অ্যাবসলিউটলি অন মিউজিক : কনভারসেশন্স); বইটি আমার অসম্ভব প্রিয়; বইটিতে সঙ্গীত আছে, খ্যাতিমান সুর স্রষ্টাদের কথা আছে। এ-বইয়ের একটি অন্তর্বর্তী অধ্যায় ‘সঙ্গীতের সঙ্গে লেখাজোখার সম্পর্ক’, এখানে কথা বলেছেন মুরাকামি, ওজাওয়া শুনেছেন, প্রশ্ন করেছেন। পুরো বইতে- দু’জনই দু-জনকে প্রশ্ন করেছেন, কখনও দু’জনই উত্তর দিয়েছেন নানা কথার নানা রঙে।
সেইজি ওজাওয়া কে, মুরাকামি যার সঙ্গে এতো কথা বলবেন? ওজাওয়া বিগত তিন দশক ধরে বোস্টন সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’র সঙ্গীত পরিচালক, বিশ্বখ্যাত জর্মন সুরস্রষ্টা য়োহান সেবাস্টিয়ান বাখের ওপর পড়াশোনা দিয়েই সঙ্গীতভুবনে যার পদচারণার শুরু; মুরাকামি তার কাজ কাছ থেকে দেখেছেন, আধুনিক সঙ্গীত ওজাওয়ার কাছে অনেকটাই ঋণি। মূল জাপানি থেকে বইটির ইংরেজির অনুবাদ করেছেন জয় রুবিন। বইটি পড়তে পড়তে, কতো কতো রাত, এই অবিরাম লকডাউনের সময়ে, প্যারিসে, সঙ্গীতের গভীর ঘোরে আমি আচ্ছন্ন হয়েছি! চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থেকেছি রাতের গভীর আলোর দিকে…
মুরাকামি : আমি সেই ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত শুনছি, তবে- বহু বছর পর, আমার উপলব্ধি হয় যে- আগের চেয়ে এখন আমি সঙ্গীত ভাল বুঝতে পারছি, আত্মায় অনুভব করতে পারছি; সম্ভবত সঙ্গীতের ভেতরকার সূক্ষ্ম কারুকাজগুলোকে আমি যেন দিনে দিনে আরও বেশি করে ধরতে পারছি, লেখালেখিতে যাকে ডিটেইলস বলে, ঠিক সেরকম; এবং, আমার এটাও মনে হয় যে- কথাসাহিত্য লেখাই আমাকে এমন এক শ্রুতি দিয়েছে, যার মাধ্যমে সঙ্গীত এখন আমার আত্মায় পৌঁছে যায়, অনবরত বাজতে থাকে। আমি বলব- আপনি কিছুতেই লিখতে পারবেন না যদি না আপনার সঙ্গীতের কান থাকে। এ-দুজন পরস্পরের পরিপূরক- প্রাণভ্রমরা প্রেমিক! সঙ্গীত আপনার লেখার শৈলীকে (স্টাইলকে) ভিন্নতা দেবে, আপনি অসম্ভব ভাল লিখতে পারবেন; আর আপনার স্টাইল যতো ভিন্ন হবে, যতো উন্নত হবে, ততোই সঙ্গীতের প্রতি আপনার টান তৈরি হবে, সঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ধরতে আপনি সক্ষম হয়ে উঠবেন।
ওজাওয়া : ইন্টারেস্টিং...
মুরাকামি : কেউ কোনওদিন আমাকে কীভাবে লিখতে হয় তা যেমন শেখায়নি, তেমনি- লেখার টেকনিক নিয়ে আমি গবেষণাও করি নি। তাহলে, কীভাবে আমি লিখতে শিখলাম? উত্তর একটাই- সঙ্গীতে ডুবে থেকে। এখন দেখুন- লেখালেখির ভেতরের সবচে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি কী? উত্তর- তাল, ছন্দ ইত্যাদি; লেখায় ছন্দ না পেলে আপনি যা লিখছেন, কেউ তা পড়বে না। লেখার ভেতরেই একটি ছন্দোবদ্ধ অনুভব থাকতে হয়, যা পাঠককে পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠায়, পাতায় পাতায় এগিয়ে নিয়ে যাবে। আপনি ভালো করেই জানেন- যেকোনও যান্ত্রিক নির্দেশিকা-ম্যানুয়াল পড়া কতোটা বেদনাদায়ক হতে পারে! সমসসাময়িক সমস্যা নিয়ে লিখিত প্যাম্ফ্লেট পুস্তিকাগুলো তালহীন লেখার সবচে ক্ল্যাসিক উদাহরণ।
নতুন লেখকের বইটি কতোটুকু পাঠযোগ্য তা আপনি খুব সহজেই তার লেখার ভেতরকার ছন্দের মেজাজ দিয়েই বিচার করে ফেলতে পারবেন। ব্যাপারটিকে আমি যেভাবে দেখি, বেশিরভাগ ক্রিটিকের চোখই তা এড়িয়ে যায়। ক্রিটিকরা প্রধানত লেখকের শৈলীর সূক্ষ্মতা, লেখকের শব্দভাণ্ডারের নতুনত্ব, আখ্যানের গতি- এসব নিয়ে কথা বলেন, থিম নিয়ে কথা বলেন, লেখক কেমন ঈর্ষণীয় টেকনিক ব্যবহার করেছেন, এবং আরও কতোকিছু যে তারা বলেন! আমি মনে করি- ছন্দ ছাড়াই যিনি লিখেন, লেখক হওয়ার প্রতিভা তার নেই। তবে অবশ্যই- এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত, আর কিছু না।
ওজাওয়া : আপনার কি মনে হয়- আমরা যখন পড়ি তখন আমরা সেই ছন্দটিকে অনুভব করতে পারি?
মুরাকামি : অবশ্যই। লেখার তাল কিংবা ছন্দ আসে- শব্দ, বাক্য এবং অনুচ্ছেদের সংমিশ্রণ থেকে, অর্থাৎ তাদের মিলন থেকে; শক্ত ও কোমল, নরম, হালকা ও ভারী, ভারসাম্য এবং ভারসাম্যহীনতা, বিরাম, অবিরাম, ছেদ এবং বিভিন্ন সুর ও স্বরের সঙ্গম থেকে, এ এমন এক ‘বহুস্বর’ সঙ্গীতে যাকে ‘পলিরিদম’ বলা হয়। লেখায় তাকে ধরতে হলে- লেখকের তীক্ষ্ণ কান থাকতে হবে, না হলে তিনি কিছুতেই পারবেন না। হয় তাকে লিখতে পারতে হবে, না হলে তাকে লেখা ছেড়ে পালাতে হবে। হয় তাকে এই ক্ষমতা আয়ত্ব করতে হবে, নয় চরমভাবে ব্যর্থ হতে হবে। হ্যাঁ, এজন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কাঠখড় পোড়াতে হবে; লেগে থাকলে তিনি কেন পারবেন না?
আমি জ্যাজ সঙ্গীতের ভক্ত, তীব্র প্রেমিক একজন; আমি করি কী- প্রথমেই ভেতরে ছন্দের ঢেউ জাগিয়ে তুলি, তার পর কর্ড ঠিক করি, তারপরেই শুরু হয় অবিচ্ছিন্ন যাত্রা, যাকে ইম্প্রোভাইজেশন বলা যায়; সব কিন্তু লেখক হিসেবে আমার ভেতরে ক্রিয়া করছে, আমি তখন সুরস্রষ্টা- শিল্পী। বাজাতে বাজাতে আমি এগিয়ে চলেছি অন্ধকার পথ ধরে, মানে আমি লেখায় ধ্যানমগ্ন, তখন আমার সঙ্গে সুর ছাড়া আর কেউ নেই। কিছু নেই। আমি এমনভাবে লিখি যেন সুর সৃষ্টি করছি।
ওজাওয়া : আমি কখনই জানতাম না যে লেখার মধ্যেও ছন্দ থাকতে পারে। আপনি এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, তা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
মুরাকামি : তাহলে, এ সম্পর্কে আরও কিছু বলা যাক… তাল বা ছন্দ পাঠক এবং লেখক উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন উপন্যাস লিখছেন, লেখটি চলছে, কিন্তু লেখায় যদি প্রাণ দিতে না পারেন, মানে- তখনও ছন্দ প্রতিষ্ঠা করেননি, তাহলে আপনার ভেতর থেকে পরবর্তী বাক্যটি বের হবে না; যার মানে দাঁড়ায়- গল্পটি কোনওক্রমেই আর এগোবে না। লেখার ছন্দ আর গল্পের ছন্দ : এই তালটি যদি একবার আপনি ধরে ফেলতে পারেন, যদি একবার তালটি পেয়ে যান, পরবর্তী বাক্যটি তখন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসবে। আমার বেলায়- আমি যখন লিখি, তখন কী হয় জানেন… ধরুন, একটিমাত্র বাক্য লিখেছি, খেলাটা শুরু হবে তার পর থেকে; বাক্যটিকে তখন আমি শুনতে থাকি, যেন মাথার ভেতর একটা গান স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজতে শুরু করেছে; এই কাজটা আমি নিজেই করি, তাতে কিছুক্ষণের মধ্যে তালটা পেয়ে যাই, যেন লেখা নয়, গান; একদম জ্যাজ সঙ্গীতের মতো : আপনি মগ্ন সুরসাধক, ধীরে ধীরে কোরাস-দলে গানটিকে ছন্দোবদ্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছেন, পরবর্তী কোরাসে যা আরও ঘনবদ্ধ হয়ে ওঠবে।
ওজাওয়া : আমি টোকিওর যে বাড়িতে মাঝেমধ্যে থাকি, কয়েকদিন আগে সেখানে আমাকে একটি প্যাম্ফ্লেট দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল সেখানকার কোনও এক দফতরের নির্বাচনের প্রার্থীর পক্ষের প্রচারণা সম্পর্কিত, প্যাম্ফ্লেটে দেখলাম কিছু প্রতিশ্রুতি লেখা, কিংবা ইশতেহার; তখন তেমন ব্যস্ত ছিলাম না বলে পড়তে শুরু করলাম, মনে করলাম- ইশতেহার পড়েই সময় কাটাই কিন্তু পড়তে গিয়ে মনে হলো- লোকটি যা বলতে চেয়েছিল, তা বলতে পারেনি, কারণ- আমি কোনওভাবেই তিন বাক্যের বেশি পড়তে পারিনি, চেষ্টা করেও পারিনি। মনে হচ্ছিল- লোকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখেছে, কিন্তু আমি তার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো পড়তে শোচনীয়ভাবেই ব্যর্থ হলাম!
মুরাকামি : হ্যাঁ, এই এতক্ষণ আমি যা বললাম- তার লেখায় ছন্দ ছিল না।
ওজাওয়া : আপনি কি তাই মনে করেন? ছন্দ না থাকায় এমন হলো? আপনি নাৎসুমি সুজেকি সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?
মুরাকামি : আমার মনে হয় সুজেকির স্টাইলটি দুর্দান্তরকমের সাংগীতিক; আপনার মনে হবে- লেখা হচ্ছে খুব আলতো করে পড়ার মতো একটা ব্যাপার, লেখায় যেন শব্দ নয়, কুয়াশা ঝরছে, আর আপনি পাঠের গভীর নৈঃশব্দ্যেও সেই শব্দ শুনছেন, মৃত্যুর এক শতাব্দী পরেও তার লেখা এমনই দুর্দান্ত। আমি নিশ্চিত যে- পশ্চিমা সঙ্গীত দ্বারা তিনি খুব কমই প্রভাবিত ছিলেন যতোটা প্রভাবিত ছিলেন এদো যুগের (১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত চলা তকুগাওয়ার শাসনকাল, যা ছিল ঐতিহ্যবাহী জাপানের সবচে সমৃদ্ধ সময়) স্তোত্রগানের দীর্ঘ ন্যারেটিভের দ্বারা কিন্তু তার শোনবার কান অর্থাৎ শ্রুতিশক্তি ছিল একদম খাঁটি । তিনি পশ্চিমা সঙ্গীতে কতোটা পণ্ডিত ছিলেন- এ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই কিন্তু তিনি বেশ ক’বছর লন্ডনে পড়াশোনা করে কাটিয়েছিলেন, তাতে মনে যে সেখানকার জলহাওয়ায় কিছুটা হলেও একাত্ম হয়েছিলেন।
ওজাওয়া : নাৎসুমি তো ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, তাই না?
মুরাকামি : তাঁর উত্তম শ্রুতিশক্তি থাকার কথাটি বলছি এই অর্থে যে- তার মধ্যে নিখাদ জাপানি এবং পাশ্চাত্য উপাদানের চমৎকার মিশ্রণ ছিল। সঙ্গীতের শৈলীকে লেখায়-ধরতে-পারা আরেক লেখক হলেন হিদেকাজু ইয়োশিদা, যার হাতে জাপানি ভাষা উচ্ছ্বল হয়, তরঙ্গায়িত হয় অসামান্য দোলায়, এবং তার লেখায় যে-সুর বাহিত হয় সে-সুর আসলে জীবনকে যাপনের ব্যক্তিগত উদযাপন মনে হয় আমার কাছে।
ওজাওয়া : আপনি ঠিকই বলছেন...
মুরাকামি : সাহিত্যের অধ্যাপকদের কথা যখন উঠলোই, আমি মনে করতে চাই তোহো গকুয়েন স্কুল অভ মিউজিকের ইংরেজির অধ্যাপক সাইয়াচি মারুইয়া’র কথা; তিনিও অসামান্য ছিলেন।
ওজাওয়া : একদম সত্যি। তিনিই তো আমাদেরকে জয়েসের ‘ডাবলিনার্স’ পড়তে শিখিয়েছিলেন। তার মতো আর কেউ ছিলেন না যার মাধ্যমে আমার মতো লোক এই বই বুঝতে পারবে! সেদিন আমি একটি মেয়ের পাশে বসেছিলাম যে খুব ভাল ইংরেজি বুঝতো, মেয়েটি আমাকে ‘ডাবলিনার্স’ ভেঙে ভেঙে বুঝিয়েছিল, আমি তো নিজে থেকে কিছু ধরতেই পারছিলাম না, পড়াশোনা তো একদমই করতাম না; যার অর্থ- যখন আমেরিকা যাচ্ছি, তখনও আমি ইংরেজি না-জানা লোক!
মুরাকামি : কিন্তু শিক্ষক হিসেবে মারুইয়া দুর্দান্ত ছিলেন, আর আপনি ছিলেন পড়াশোনায় উদাসীন ছাত্র।
ওজাওয়া : একদম…
অলংকরণঃ তাইফ আদনান