জলধি / সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য / হান ক্যাং এর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার
Share:
হান ক্যাং এর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার

'মানুষ কি প্রকৃত অর্থেই নৃশংস?' নিরন্তর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা হান ক্যাং হলেন সবচেয়ে কমবয়সি 'আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার' প্রাপ্ত লেখক, যার জন্ম ১৯৭০ সালে দক্ষিন কোরিয়ার গুয়াংজুতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরীয় সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে, তারপর গল্প লিখতে শুরু করেন। গল্পগ্রন্থ 'লাভ অব ইয়েওসু' প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৮-য় যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। এখন তিনি সিউলের ইন্সটিটিউট অব আর্টসে ক্রিয়েটিভ রাইটিংসের শিক্ষক।

'দ্য ভেজিটারিয়ান' উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালের 'আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার' পেয়েছেন তিনি। তার অন্যান্য উপন্যাস- ব্ল্যাক ডিয়ার, ইয়োর কোল্ড হ্যান্ড, ব্রিদ ফাইটিং, গ্রিক লেসনস ইত্যাদি।

'দ্য ভেজিটারিয়ান' সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নিজের লেখা একটি গল্পকে ঘষামাজা করতে করতে মাথায় উপন্যাসটির আইডিয়া আসে। লেখা শেষ করার পর বুঝতে পারি নিজের ভেতরে ব্যাখ্যাতীত কিছু অনুভূতির জন্ম হচ্ছে!' হান ক্যাং আরো বলেন, 'উপন্যাসের মূল চরিত্রটি এমন এক নারীর যে মানব চরিত্রের অন্ধকার দিক থেকে নিষ্কৃতি পেতে উদ্ভিদে রূপান্তরিত হতে চায়। এ উপন্যাসের মাধ্যমে আমি জীবনের কিছু জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি'। 'দ্য ভেজিটারিয়ান' উপন্যাসটি দুঃস্বপ্ন দেখা এক নারীকে নিয়ে রচিত হয়েছে। তার নাম ইয়ং হি। ইয়ং হি একজন আবেগপ্রবণ নারী। স্বপ্ন দেখার এক পর্যায়ে মানুষের নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মাংস খাওয়া ত্যাগ করে। নিজেকে বৃক্ষ হিসেবে ভাবতে শুরু করে সে। মাংস খাওয়া ত্যাগের যুক্তি হিসেবে স্বপ্নের কথা বলে।

অনূদিত  সাক্ষাৎকারটি মূলত, ২০১৬ সালের মে মাসে 'ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে' এবং 'কোরিয়ান লিটারেচার'-এ প্রকাশিত দুটি সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের সমন্বয়।

 

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: এখন আপনি কোন বইটি পড়ছেন?

হান ক্যাং: ভিক্তর স্তইকিতার 'অ্যা শর্ট হিস্ট্রি অব শ্যাডো'।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: পাঠের তালিকায় থাকা আপনার পরবর্তী বইটির নাম কী?

হান ক্যাং: এখন 'দ্য লাইভস অব প্যারোটস' বইটি পড়ব কারণ এই প্রাণিদের ব্যাপারে পড়তে আমি আগ্রহী।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কোন সে জায়গা যেখানে আপনি এখনো যাননি কিন্তু যেতে চান?

হান ক্যাং: যদিও আমার এই আকাঙ্ক্ষা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না! কিছুদিন আমি হিমশৈল (আইসবার্গ) দেখতে চাই। কখনো কখনো কল্পনাও শক্তিশালী হয়।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়ার জন্য সিউলের সেরা জায়গা কোনটি?

হান ক্যাং: 'দ্য বুক সোসাইটি', যার অবস্থান পুরানো সিউলের কাছে কিউইয়েং-বুক প্যালেসে; চারু ও কারুকলার বইয়ের জন্য দোকানটি প্রসিদ্ধ। দোকানটি এমন একটি ঢঙে সাজানো হয়েছে যার কোণাগুলোয় ঠাসা বইগুলো এমন দেখায় যেন তারা পুরাতন বইয়ের ধ্বংসাবশেষ। আপনি সারাদিনই সেখানে কাটিয়ে দিতে পারবেন।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে যখন থাকতেন, সেখানকার কোনোকিছু আপনাকে বিস্মিত করেছিল?

হান ক্যাং: সেখানে দিগন্তবিস্তৃত শস্যখেত আর প্রবাহিত ঝোড়ো হাওয়া, প্রাণপণে চাইছে সবকিছুকে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। একদিন, বাসে করে শিকাগো যেতে যেতে আমি এক চমৎকার মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম; কথায় কথায় বললেন আমিই একমাত্র বিদেশি যার মাধ্যমে বাইরের দেশের কোনো মানুষের সঙ্গে এই তার প্রথম সাক্ষাৎ হলো! সেখানে অবারিত শান্তিতে থেকেছিলাম কিছুদিন, যেখানে নিজের লেখাটি লিখবার জন্য হাতে অফুরন্ত সময় থাকে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: সিউলে সৃষ্টিশীল কাজের অনুপ্রেরণার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা কোনটি?

হান ক্যাং: সিউলের ছোট ছোট বইয়ের দোকান আর গ্যালারি আর আর্ট মিউজিয়ামগুলো। বইয়ের দোকানগুলোয় কয়েকবছর ধরেই ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে!

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: সাহিত্যকর্মের মধ্যে পড়ে না এমন প্রিয় কাজ আপনার কাছে কোনটি?

হান ক্যাং: দীর্ঘসময় ধরে হাঁটা।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: ছোটবেলার প্রিয় বই কোনটি?

হান ক্যাং: বাড়িতে আসা সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যাগুলো। পত্রিকাগুলোর ছবি, কবিতা, প্রবন্ধ আর গল্প (কোরিয়ার সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুসারে উপন্যাসের চেয়ে কবিতা ও ছোটগল্প অনেক বেশি শক্তিশালী) পড়তে পড়তে আমাদের বিকেলগুলো কেটে যেত; যদিও লেখাগুলোর অনেক কিছুই বুঝতাম না!

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: বাড়ির লাইব্রেরিকে গোছাতেন কীভাবে?

হান ক্যাং: আমাদের বাড়ির লাইব্রেরিকে কখনোই খুব মনের মতো করে গোছাতে পারিনি কিন্তু দৈবক্রমে কোন বইটি কোথায়, কোন বইয়ের পাশে রাখতে হবে সে ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ছাত্রদের দেওয়া আপনার সেরা উপদেশ কোনটি?

হান ক্যাং: আমি মনে করি না ছাত্রদের কোনো শিক্ষা আমি দিতে পেরেছি। যেসব বই আমার প্রিয়, মনেপ্রাণে পছন্দ করি, ছাত্রদের সঙ্গে সেসব বই নিয়ে আমার কিছু ভাবনা বিনিময় হয়। একমাত্র যে উপদেশটি তাদের আমি দেই, তা হলো- পড়ো। এতটুকুই।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কীভাবে আপনি লেখক হয়ে উঠলেন?

হান ক্যাং: পাঠের অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল সেই ছোটবেলায়, সবসময় তখন পড়তাম। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো নিয়মিত, পুরোনো বাড়ি ছেড়ে কয়দিন পর পর নতুন বাড়িতে উঠতাম, তাই স্কুলও বদলাতে হয়েছিল বেশ কয়েকটি; নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে কাউকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার আগে পর্যন্ত একা একা বই পড়ার কথা আমার এখনো মনে আছে। সেই বয়সে নির্ভেজাল আনন্দের জন্যে পড়তাম। কৈশোরে পা দিয়ে সেসব বই-ই আবার পড়েছিলাম, তখন আমার ভেতরে এই সাধারণ প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছিল- মানুষ হওয়া বলতে কী বোঝায়? মানুষ কেন মরে যায়? জীবনের মানে কী? আমি কে? বইগুলো যখন আবারও পড়তে শুরু করলাম, পড়ে বিস্মিত হলাম কোথাও আমার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে। শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন, উত্তর কোথায়! তখন বুঝতে পারলাম, বইয়ের লেখকরাও ঠিক আমার মতোই প্রশ্নের উত্তর যেমন জানেন না ঠিক তেমনি উত্তরগুলো কোথায় আছে তাও তাদের জানা নেই। আমার মতো তারাও খুঁজে চলেছেন প্রশ্নগুলোর উত্তর। সুতরাং লেখকদের সঙ্গে আমি এক ধরনের আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করলাম। যদিও আমি তাদের চাইতে বয়স ও অভিজ্ঞতায় ছোট এবং খুব সামান্য এক কিশোরী। আমার মাথায় এলো, লেখালেখির মানে যদি শুধু প্রশ্ন করে যাওয়া হয় আর উত্তর খুঁজে বের করাটা জরুরি না হয়, তা হলে আমিও তাদের মতো লিখতে পারব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিন-চার বছর আমি ম্যাগাজিন ও বই প্রকাশনার কাজ করেছি, বইপত্র বাঁধাই করেছি, ইনটারভিউ নিয়েছি, নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছি; বিভিন্ন জায়গায় অ্যাসাইনমেন্ট করতে গেছি। পরে যখন নিজেই লেখালেখিটা শুরু করলাম, তখন কিন্তু লেখায় নিজেকে একেবারে নিবেদিত করে দিলাম, একেবারে; লেখালেখিতে পূর্ণ সময় দিতে লাগলাম, সঙ্গে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের শিক্ষকতার কাজটাও চলল পুরোদমে আর এভাবে সময়ও চলে যেতে লাগল।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: লেখক হিসেবে নিজেকে কি কখনো পরিপূর্ণ মনে করেন?

হান ক্যাং: আমার কাছে, লেখা হলো- 'জীবন কী', 'মৃত্যু কী', 'আমি কে' অবিরাম এসব প্রশ্ন করে যাওয়া। আমি যখন লিখি, বিশেষ করে উপন্যাস লিখি যখন, তখন জীবনের একটি, দুইটি, তিনটি, কখনো চারটি বছরও সেই উপন্যাসটির জন্য উজাড় করে দেই, যেন উপন্যাসের সঙ্গে বিনিময় করছি নিজের জীবন। যখনই আমি অনুভবটি করতে পারি যে, লেখক হিসেবে আমি এগিয়ে যাচ্ছি, যখন দেখতে পাই 'মানুষ বলতে কী বোঝায়?' প্রশ্নটি আমি নানাভাবে খুঁজে চলেছি, উপন্যাসের পর উপন্যাসে, নিরন্তর সেই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজছি, ঠিক তখনই আমি আনন্দিত হই এটি ভেবে যে, লেখক হয়েছি!

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: 'দ্য ভেজিটারিয়ান' উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু বলুন।

হান ক্যাং: মুখ্য চরিত্রটি একজন নারী- "ইয়ং হি", যাকে নিরামিষাশী হতে হবে কিন্তু সেটি হতে হবে এমন এক পদ্ধতিতে যাতে কাউকে কোনোরকমের ক্ষতির শিকার না হতে হয়। মাংস খাওয়াটা হলো- মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং এই বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগঠিত নিষ্ঠুরতার প্রতীক। 'ইয়ং হি' হতে চায় সচেতন নিরামিষাশী, সভ্যতায় চালু থাকা সহিংসতার বিরুদ্ধে নিজেকে বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি হিসেবে। সুতরাং মানুষ পরিচয়ের বদলে ইয়ং হি নিজেকে চারাগাছে রূপান্তরিত করে আর খাওয়াদাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেয়, দিনে দিনে নিজেকে সে নিঃশেষ করে ফেলে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: উপন্যাসটির ভাবনা কীভাবে এসেছিল?

হান ক্যাং: 'দ্য ফ্রু টস অব মাই উইমেন' নামে দশ বছর আগে, আমার একটি গল্পে এক নারী চারাগাছে রূপান্তরিত হয়; স্বামী তাকে ফুলদানিতে লাগিয়ে রাখে, পানি দেয় আর খুব যত্ন করে প্রতিদিন। আমি সবসময়ই এই গল্পটির একটি ফলো-আপ মানে, পরবর্তী পর্বটি লিখতে চেয়েছিলাম। সেই গল্পই ছিল উপন্যাসের প্রথম প্রেরণা। দ্বিতীয়ত আমি সবসময়ই মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ এবং সহিংসতার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী ছিলাম। দেখতে চেয়েছিলাম, যদি মানুষের অপাপবিদ্ধতা সম্ভব হয়, তা হলে সহিংসতা পরিহার করে যে কেউ-ই একটি সম্পূর্ণ নির্দোষ জীবনকে যাপন করতে পারবে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: লেখক হিসেবে মানবজীবনের কোন দিকটি আপনার ভাবনায় সার্বক্ষণিক বিরাজ করে?

হান ক্যাং: 'মানুষ হতে হবে' কথাটি দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়? এটিই আমার মৌলিক জিজ্ঞাসা, সবসময়ই আমি এই কথাটি ভাবি। নিজেকে লেখক ভাবতে গেলেই দেখি জিজ্ঞাসাটির ধরন উপন্যাসগুলো লিখতে গেলেই বদলে যায়। আমি বলতে চাইছি, জিজ্ঞাসার ধরন বদলে যায়। 'দ্য ভেজিটারিয়ান' উপন্যাসেও আমি অবিরাম খোঁজ করেছি, খুঁজে ফিরেছি প্রশ্নটির একটি যথার্থ উত্তর, কাকে বলে মানুষ? মানুষ কি নির্দোষ হতে পারে? নিষ্পাপ? আমরা কি হিংস্রতা, সহিংসতাকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে পারব? 'লিভ নাও, দ্য উইন্ড ইজ ব্লোইং' উপন্যাসেও খুঁজে ফিরেছি একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তর- পৃথিবীতে সৌন্দর্য আর হিংস্রতার মধ্যে যে বিশাল বৈপরীত্য তার কি কোনো শেষ আছে? পরের উপন্যাস 'হিয়ার কামস দ্য বয়'-এ 'প্রকৃত মানুষ হতে হবে' কথাটি দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয় এটি ছিল আমার জিজ্ঞাসা; যদি মানুষ হতে না পারি, পারা না যায়, তা হলে আমাদের করণীয় কী থাকে? জিজ্ঞাসাগুলোর ধরনটা হয়তো বদলায়; মৌলিক প্রশ্নটি কিন্তু একই থাকে- 'প্রকৃত মানুষ হতে হবে' দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়?ক



অলংকরণঃ তাইফ আদনান