জলধি / সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য / স্পর্শ ও অনুভূতির ভাষা
Share:
স্পর্শ ও অনুভূতির ভাষা

এখন কি সেই প্রেমের দিন ফুরিয়ে গেল? আর কি কোনো কবি লিখবে না, Send me the words 'Good Night' to put under my pillow? মৃত্যুর আগে এইটুকু প্রার্থনাও পূরণ হয়নি যুবক কিটসের। তিনি শরীর চাননি, চুম্বনও চাননি, ঘরকন্নাও নয়। এক টুকরো কাগজ মাত্র। হায় প্রেম! কী দীর্ঘশ্বাস! কী যন্ত্রণা তোমার! পৃথিবীতে প্রকৃত প্রেম কি আজ পর্যন্ত সুখের হয়েছে? কে যেন বলেছিল, প্রেমে কেউ সুখ চেয়ো না, প্রেম তো দুঃখের, গানও দুঃখের, বেঁচে থাকাও দুঃখের। আমরা এইসব দুঃখের সুখ উপভোগ করতে করতে চলে যাই। পুরানো পৃথিবী তেমনই পড়ে থাকে। দলে দলে শিশুরা আসে, খেলাও পাতে, তারপর খেলাও ভেঙে যায়।

তাহলে প্রেম কি শুধু উপলব্ধি? ইন্দ্রিয়ের নয়? ইন্দ্রিয় না থাকলে তো মন আসে না, আর মন না থাকলে তো ইন্দ্রিয়ও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। সুতরাং মনই চালক, মনই বলে দেয় সবকিছু। কবিরা যুগে যুগে এই মনেরই দাসত্ব করে আসছে। ফ্রয়েড ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সব সৃষ্টির মূলে তিনি মূলশক্তি হিসাবে যৌনতাকেই দেখেছেন। যৌনতাই মনকে ভাবায়, কথা বলায়, ছবি আঁকায়, কল্পনা ও স্বপ্ন, আনন্দ ও দুঃখ পেতে সাহায্য করে। রোমান্টিক আবহ থেকে 'বায়রন', 'কিটস', 'শেলি' সকলেই প্রেমের উপলব্ধিকে কবিতা করে তুলেছেন। তাঁদের সেই প্রেম অধিকন্তুই Platonic Love যার অবস্থিতি বৈষ্ণব দর্শনে, নিষ্কাম ভালোবাসায় এবং Mystical Feelings অথবা Infatuation-এ। এক মরমি সত্যসন্ধানী কবিকে অতীন্দ্রিয় জগতে তা নিয়ে যেতে পারত। আর এই পথেই 'জীবনানন্দ দাশ' হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসেছেন পরম এক নিজস্ব অন্ধকারে।

রক্তমাংসের নারীকে কেন্দ্র করে যে প্রেমের অনুভূতি জাগালেন তা প্রখর হয়ে উঠল কবি' বোদলেয়ারের লেখায়। বান্ধবী জান দ্যুভালকে প্রেমের তীব্র প্রতিমূর্তি অথবা উত্তেজনার জারক হিসাবেই তিনি দেখেছেন। পরে আরও বহুনারী ম্যারি দোত্রে, মাদাম সাবাডিয়ে সবাই তার বৃত্তকে পূর্ণ করেছে। আদি রসাত্মক ইন্দ্রিয়ভোগ্য কামকলার অভিনব শিহরনে তাঁর কাব্য কুসুম আজও রোমাঞ্চিত। সেই কাব্য অনুভূতির দরজায় দাঁড়িয়ে বাংলা কাব্য জগতে কবিরা দেহবাদী পঞ্চবাণের শিকার হয়েছেন। আবার এই দেহকেও অতিক্রম করে গিয়েছেন। সুতরাং দেহ ও দেহহীন, সহজিয়া-মরমিয়া মিশে একাকার হয়ে গেছে। এযুগের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একই সঙ্গে দেহবাদী হয়েও দেহকে অতিক্রম করেছেন:

“মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে 

 ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনি

                     তুমি কথা দিয়েছিলে…

এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু।”

(হিমযুগ, আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি)

যে কথার কথা কবি বলেছেন তা হলো উদাসীন সঙ্গম শেখানোর কথা। শরীরী মায়া বা ইন্দ্রিয়জ আকর্ষণ যে 'ভুল স্বপ্ন' এবং শেষ পর্যন্ত নতজানু হয়েও 'উদাসীন সঙ্গম' শেখার আকুলতা কবিকে দেহবাদের ভিতর থেকে মরমিয়া জগতে উত্তরণ ঘটানোর ডাক দিয়েছে। মানুষ কামচেতনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে আবার কামচেতনা নিয়েই মরে যায়। আদি প্রবৃত্তির কি আদৌ কখনও কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? তাই সুনীল গঙ্গোপাধায় ঋষি পরাশর-সত্যবতীর কাহিনিও কবিতায় উত্থাপন করেন। আবার কুমারী যোনির পাশে ঘুমোবার ইচ্ছার কথাও ব্যক্ত করেন। এক অদ্ভুত রহস্যচারী জীবন। টি. এস. এলিয়টের জে. আলফ্রেড প্রুফকের প্রেমের গানে দেখতে পাই, আলফ্রেন্ড যখন বলে আবার সময় আসবে, সুসময় আসবে, তখন সে ভালোবাসবে। এত ভালোবাসার তৃষ্ণা তার বুকে, তবু সে ভালোবাসা থেকে দূরে সরে গেছে। বড়ো প্রেম শুধু কাছে টানে না দূরেও ঠেলে দেয়। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত যখন একথা ভাবে তখন আমাদের মনে হয় প্রেম চিরদিনই অধরা, শরীরে যেমন তাকে ধরা যায় না মনেও সম্পূর্ণ রূপে উপলব্ধি করা যায় না। আঁধার বা আলো, বিরহ বা পাওয়া কোনো কিছুতেই সে নেই। শুধু এক ভাববিলাস বা মোহপাশের বাঁধন স্মৃতির ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখে। নিষিদ্ধ ফল খেয়ে আদম ও ইব পৃথিবীতে এসেছিল। তারা পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্যে কিন্তু কোনো ফল খায়নি। ফল যখন নিষিদ্ধ তখন তার স্বাদ কেমন সেটিই পরখ করতে চেয়েছিল। মানুষও শরীর দেখে, শরীর মুকুলিত হতেও দেখে, আর এই দেখার মধ্যে দিয়েই তার শরীরে প্রবেশ ইচ্ছা জাগে। কেউ কেউ একে প্রেম বলতে পারে, কারণ এই শরীর শক্তি। এরূপ বন্দনা তাকে কর্মে প্রবৃত্তিদান করে। সে যদি বাউলও হতে চায় কিংবা গৃহস্থ হতে চায় হতে পারে।বিজ্ঞানী কিংবা কবি হতেও তার বাধা নেই:

“কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে যেতে আমরা দেখেছিলাম

দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে জলের উপর দিয়ে।—কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে,

আর আমার কী ভালো লেগেছিল।”

প্রেমের কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'নতুন পাতা' কাব্যগ্রন্থের 'চিল্কায় সকাল' কবিতায় যখন একথা বললেন তখন এক নিমেষে ছবি ফুটে উঠল, নারীর হাসির। এই হাসিই হয়ে গেল চিরন্তন ভালোলাগার আবেদন। হাসিও শরীর, কান্নাও শরীর, কিন্তু ভালো লাগার মুহূর্তটি সময়ের অনুবাদমাত্র। সবাই এই মুহূর্তটি উপলব্ধি করতে পারে না। শরীরে এই উপলব্ধি যখন ফসফরাসের মতো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয় তখনই পুলক জেগে ওঠে। গোবিন্দদাস বৈষ্ণবপদেও একথাই বলেছেন:

“যাঁহা যাঁহা হেরিয়ে মধুরিম হাস।

তাঁহা তাঁহা কুন্দ-কুমুদ-পরকাশ।।”

শ্রীকৃষ্ণ যখন বুদ্ধদেব বসুর হৃদয়ে বসে নারী দেখেন, তখন যেকোনো নারীই শ্রীরাধা হয়ে যান। আবার নারীরা যখন শ্রীরাধাকে আশ্রয় করে যেকোনো পুরুষ দর্শন করে, তখন সবপুরুষই শ্রীকৃষ্ণ হয়ে যান। তা সে নিষিদ্ধ সম্পর্কের হলেও:

“ধূসর পাঞ্জাবি, মেঘলা পাঞ্জাবি, তোমার পাঞ্জাবি

                                  মেঘ নামায় 

এখনই রোদ ছিল, লজ্জাবোধ ছিল, হঠাৎ ঝড় এল

                                    আকাঙ্ক্ষায়”

(ধূসর পাঞ্জাবি, হৃদয়ে অবাধ্য মেয়ে, মন্দাক্রান্তা সেন)

আকাঙ্গার ঝড় হঠাৎই আসে আর তখন 'শরীরে শরীর ঘষটে' আগুন চায় সবাই। এ এক আদিম দাহ, দহনেও সুখ। এই আগুন চাওয়া তো আজ নয়, ইংরেজ কবি 'রবার্ট ব্রাউনিং'-এর স্ত্রী 'এলিজাবেথ ব্রাউনিং'-ও প্রেমিক ব্রাউনিংকে নিয়ে সেদিন যেন একথাই বলতে চেয়েছিলেন:

“How do I love thee 

Let me count the ways.”

আর 'তসলিমা নাসরিন'-ও লিখলেন:

“শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা 

আমার পৃথিবী এত জল পোষে, এত মাটি আমি তবু তৃষ্ণার্তই থেকে যাই অধিক জীবন।”       (শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা) 

শিকড়ে যখন ক্ষুধা তখন মেঘলা পাঞ্জাবি যতই মেঘ নামাক কিছুতেই তৃষ্ণা মিটবে না। আকাঙ্ক্ষার ঝড়ে সব এলোমেলো, মেঘও উড়ে যাবে। তখন তো বলতেই হবে, 'Let me count the ways'। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, 'আমি সোনার একটি মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে'। অর্থাৎ সেই মাছি (প্রেমিকা যখন স্ত্রী হলেন) খুন করেই নীল ভালোবাসার-জীবনে প্রবেশ করলেন। 'সোনার মাছি খুন করেছি' কাব্যেই লিখেছেন সে কথা। কিন্তু সেই মাছি যে দুঃখদায়ক, কবির চোখে নেশা লেগেছে, 'বাঁচব বলেই একা একা' চমকপ্রদ ভাবে যে জড়িয়ে গিয়েছেন তা অকপটে স্বীকারও করেছেন।

প্রেমকে আশ্রয়ের পথ হিসাবেই গ্রহণ করা হয়েছে তখন। আসলে অবলম্বনের ব্যাপারটি সকলেরই জানা। আসঙ্গলিপ্সা মানুষের আদিম প্রবৃত্তিরই অঙ্গ। একে কি প্রেম বলা যায়? নারী পুরুষ কি প্রেমিক-প্রেমিকা হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন বিবাহেই প্রেমের মৃত্যু হয়, বিরহেই প্রেম জীবিত থাকে। তাহলে প্রেম তো না-পাওয়া, অচরিতার্থতাকেই বোঝায়। ভাবসম্মেলনে আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যগুলি বিরহেও মিলনের সুখ উজ্জীবিত করেছে, মিস্টিক চেতনারই সাধনা হিসাবে। রবীন্দ্রনাথও এই পথেই হেঁটেছেন। জন্মান্তর বা বহুরূপের ভিতর প্রেম সত্তাটি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। বিরাট প্রতিভার বলে বোধের বিস্তৃতিকে অনন্তের পথে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাই 'মহুয়া' কাব্যের 'সাগরিকা' নামে কবিতায় বলেছেন তাঁর প্রেমিকা যেন পুনরায় প্রদীপখানি তুলে ধরে দেখে, এবার তাঁর আর মকরচূড় মুকুট মাথায় নেই। ধনুক বাণও হাতে নেই, বাতাসে ডালি সাজিয়েও আসেননি। স্পষ্ট করে জানতে চাইলেন,

           “এনেছি শুধু বীণা—

দেখো তো চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পারো কিনা।।”

প্রেমের আইডেন্টিটি সকলেই রক্ষা করতে চান, নিজেকে তুলে ধরতে চান জগতের কাছে। আদি পৃথিবীর উৎস থেকেই প্রাণ প্রবৃত্তির অনুধাবন চলে আসছে। যত

কবিতা বা সাহিত্য রচিত হচ্ছে সবই এই আইডেন্টিটির অন্বেষণ। আত্মস্বরূপ উন্মোচন করাই প্রতিটি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর এই পথে হাঁটিতে গিয়েই রহস্যও ঘণীভূত হয়ে ওঠে। সেইসব রহস্য অনুভূতিকে ভাষা দিচ্ছেন স্রষ্টারা, রঙ্ দিচ্ছেন শিল্পীরা, সুর দিচ্ছেন গায়কেরা।

আমরা প্রেমের কাছে অর্থাৎ তাঁদেরই অনুভূতির বিনির্মাণের কাছে বিনীতভাবে দাঁড়াচ্ছি। আমাদের সমীহ বিছিয়ে দিচ্ছি, সৃষ্টিতে সৃষ্টি যোগ করছি। পুরানো সৃষ্টিই হোক অথবা বাঁক্ বদলের সৃষ্টিই হোক, সব সৃষ্টিতেই যে একই লক্ষ্য, একই অন্বেষণ তা বলাই বাহুল্য। মানুষই মানব হয়, মানবের মাঝেই মানুষকে পাওয়া যায়। তেমনই শরীর থেকেই শরীরহীন কোনো আধ্যাত্মলোকে পাড়ি দেওয়া সম্ভব। কাব্য কবিতায় যতই যৌন আবেদন থাকুক, দৈহিক উষ্ণতার রগরগে উল্লাস থাকুক তা কখনওই বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। প্রেম শুধু স্পর্শ ও অনুভূতির আলোকেই জেগে থাকে।

   


অলংকরণঃ তাইফ আদনান