কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীও চলে গেলেন । বয়েস তিয়াত্তরও হল না। তার আগেই...। এত কী তাড়া ছিল যাওয়ার ? কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী যতটা বাংলাদেশের কবি, তটটাই কলকাতার। ঢাকায় তিনি সিরাজী ভাই। কলকাতার সিরাজীদা। সিরাজীদা কলকাতায় এলে কবিদের মহাসম্মেলন বসত তার ডেরায়। আজ স্মৃতি ও অশ্রু একীভূত হয়ে গেছে ঢাকা ও কলকাতার। আমার ও পিয়াসের, তপন ও নোমানের, শিবাশিস ও শ্রীজাতর। হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমার মেন্টর। আলোকবর্তিকা যদি সুনীল’দা হন তাহলে হাতে ধরে রাস্তা পার করেছেন সিরাজী’দা। কী ভাবে? সিরাজীদার সাথে কলকাতায় এক বিশেষ আসরে আলাপ হয়েছিল। সে আসরে সুনীল বা কৃত্তিবাস শিবিরের গুরুসহ সবাই উপস্থিত। কবিতা পাঠ শুরু হতেই আমার অসম্ভব পছন্দ হয়ে গেল তার কবিতা। ডাই হার্ড ফ্যান হয়ে গেলাম তার লেখার। সেবারে তার আনা কাব্যসংকলনের এক একটি কপি প্রায় ছিনতাই করে নিয়ে এলাম। পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। সুনীল’দা চলে গেলেন ২০১২ সালে। সিরাজীদা ২০১৩ তে এলেন কলকাতা বইমেলায়। তার আগে আমার প্রথম কবিতা সংকলন ‘রূপসারি’ প্রকাশ হয়েছে এবং তা পৌঁছে গিয়েছে ঢাকায় সিরাজীদার হাতে। সিরাজীদা এসেই বললেন ‘তোমার রূপসারি পড়লাম। ভাল লেগেছে। তবে...’ । এই ‘তবে’ বর্ণনা করার আগে সিরাজীদা আমার হাতে তার বই ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’ তুলে দিলেন। পৃষ্ঠা উলটে দেখি তাতে লেখা – অমিত গোস্বামী, যেজন কবিতায় অন্ধকারকেও দিবস করে, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ৯/০২/২০১৩। তার ‘তবে’ অর্থাৎ দিকনির্দেশিকা শুনলাম। কোথায় কোথায় কী হলে আরো ভাল হত বললেন এক এক করে। সব শুনে বললাম, সিরাজীদা একটা ঘোরতর অন্যায় হয়ে গেছে। কী অন্যায়? দাদা, এই কবিতা সংকলনে ‘সংশয়’ কবিতাটায় আপনার লেখা কবিতার দেড় লাইন ‘সূর্যকিরনে অভিমানে মাছরাঙা/ গাছে বসেছিল...’ এটুকু অজান্তে নিয়ে ফেলেছি। তাতে কী? এটা হতেই পারে। এটা প্রভাব। তবে আমারটা অন্ত্যোমিলহীন, তোমারটা ছন্দে লেখা। না না সিরাজীদা, আমার এত খারাপ লাগছে...। দূর পাগল, পরে পুণর্মুদ্রণ হলে ঋণস্বীকার লিখে দিও। কিন্তু সিরাজী’দা, এত ঋণ শুধব কি করে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা পরিষদের সম্পাদক। ২০১৪ সাল। হঠাৎ ই-মেইলে তার আমন্ত্রণ। জাতীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পড়ার। আমি নেহাত এলেবেলে। আমাকে এই সম্মান? সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা আরও অনেক মহানক্ষত্রদের সাথে এক মঞ্চে কবিতা পড়ার ডাক। আপ্লুত আমি এসেই দেখা করলাম সিরাজীদার সাথে। পরিবারের খুব প্রিয় এক সদস্যের অসুস্থতায় পাগলপারা সিরাজীদা একটাই কথা বললেন – আমি থাকতে পারব না। কিন্তু তুমি এমন কবিতা পড়বে যাতে সকলে বলেন যে আমি যথার্থ কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ইউ টিউবে আপ লোড করা সেই কবিতাপাঠ আজও গুরুর শিষ্যের থেকে সেরা পারফরম্যান্স বার করে আনার অন্যতম স্বাক্ষর হিসেবে বেঁচে আছে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী। হাজির আছেন ২০১৪’র ৮ মে’র দুপুরে। রাইটার্স ক্লাবে। উপলক্ষ কবি রাজু আলাউদ্দিনের জন্মদিন পালন, আমাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, কবিতা পাঠ ও আলোচনা। মুহাম্মদ নুরুল হুদা আয়োজক। প্রায় সকল নামী কবি হাজির। এ ধরনের অনুষ্ঠান যে ভাবে এগোয় সেভাবে চলছিল। আমার কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা, রাজু আলাউদ্দিন ও মানিক মহম্মদ রাজ্জাক। এবারে উঠলেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বললেন, অমিত, তোমার কবিতা লেখার ক্ষমতার বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তুমি বাংলাদেশে বাংলাদেশের কবিতা লিখতে চাইছ। এটা সহজ নয়। গঙ্গার পলির স্বাদ মিষ্টি। ওখানে কোন সংগ্রামের ইতিহাস নেই। কিন্তু পদ্মার পলি নোনতা। এখানে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত মিশে আছে, ২ লক্ষ মা’বোনের সম্ভ্রম। এ মাটিকে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হবে। এর যন্ত্রণা প্রাপ্তি তোমাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। এদেশকে তোমায় হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তবেই তুমি এদেশে এদেশ নিয়ে লিখতে পারবে। এ কাজ খুব কঠিন। ওপারে বসে হয় না। উপস্থিত সকলে একটু ব্যোমকে গেলেন। বেশ কড়া কথা বলে ফেলেছেন সিরাজীদা। আমি বললাম, আপনার এই কথাগুলি আমাকে নতুন পথের সন্ধান দিল। আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ী চলে প্রমাণ করব আমি বাংলাদেশের লেখক।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫। হাজির আছেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আমার ‘যখন বৃষ্টি নামল’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সিরাজীদার হাতে মোড়ক উন্মোচন হল আমার প্রথম উপন্যাসের। উন্মোচন করেই বইটা সোজা ঢুকিয়ে দিলেন ঝোলায়। বললেন, পড়ে বলব, গদ্যের হাত কেমন। তারপরে ক্রমাগত দেখা, আড্ডা, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতা ক্রমশই আমার সামনে উন্মোচিত করল এক প্রকৃত কবির মুখ। আমি আমার ভাবনা প্রকাশ করলাম। আমি লিখলাম বর্তমানকালের কবিদের মধ্যে কলকাতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও কামাল চৌধুরী। তাতে কিছুদিন আগে আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া এক কবির কি ভীষণ উষ্মা। আমাকে ‘ল্যাদা কবি’ বলে ফেসবুকে পোস্ট দিলেন। সিরাজীদাকে কথা প্রসঙ্গে বললাম। হাসতে হাসতে বললেন, তবু তো তোমাকে ‘কবি’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ল্যাদাই বলুক আর আধাই বলুক।
২০২০ র ফেব্রুয়ারি, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও জাতীয় কবিতা উৎসব উপলক্ষ্যে ঢাকায় পৌঁছলাম। প্রাণ হাঁসফাঁস, সিরাজীদার সাথে দেখা করব কখন! তখন তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক। এই প্রথম একজন পেশায় প্রকৌশলী কবি সম্ভবত এই পদে বসেছেন। একটি ঝগড়াও বাকী আছে। সেই ঝগড়া পকেটে করে যেতে হবে। ঝগড়াটা ছিল এই যে বাংলাদেশ বাংলা অ্যাকাডেমির এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা ও উন্নাসিকতা আছে যা ভাল সাহিত্যের প্রতিবন্ধক যেমন বেশ কিছু স্বীকৃতির জন্যে বাংলাদেশি হতেই হবে। তাদের পত্রিকায় এপারের কেউ লিখতে পারবেন না। ভারতে এই গন্ডীবদ্ধতা নেই। সেকারণেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার ভারতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ খেতাবের অধিকারী। কাঁটাতারের এ বেড়া সিরাজীদা একদিন ভাঙবেন আমি নিশ্চিত। গেলাম তার অফিসে। সেই অফিসের তপন, স্বকৃত, পিয়াস আমার বন্ধু। সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকটি আনবিক বোমা। সকলের সাথে দেখা করে সিরাজীদার ঘরে পৌঁছতেই বললেন, এসেছ, খবর পেয়েছি। কী একটা ঝগড়া নিয়ে এসেছ শুনলাম ? আচ্ছা, চলো পাশের ছাদে যাই। সিকিউরিটিকে বলে দিলেন, চল্লিশ মিনিট কাউকে অ্যালাও করবে না। চল্লিশ মিনিট ? এত সময় আমায় দেবেন? পাশের ছাদে গিয়ে বললেন, দাও, সুনীলদার একটা সিগারেট দাও। সুনীলদাকে নকল করে আমরা সুনীলদার ব্র্যান্ডই খাই, জানতেন। সুনীলদার বুকের এক টুকরো ছিলেন সিরাজীদা, আমরা দেখেছি। তিনিও আত্মমগ্ন হতে চাইতেন সুনীলে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেদিন নিতান্ত বদমাসি করে, ‘আচ্ছা, সিরাজীদা আপনি এত সুনীল প্রভাবিত বলেই কি আপনার কবিতা অপার বাংলা ? ধর্মের কোন ছোঁয়া নেই? সিরাজীদা নিজের চেয়ারে বসলেন। কিছুটা স্বগোতোক্তির মত বলতে শুরু করলেন, ফরিদপুর শহর থেকে বার মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি অজপাড়া গাঁ রসুলপুরে আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা। আমি আশরাফ শ্রেণির মুসলমান। সেসময় আশরাফ ও আতরাফের ব্যাপারটি প্রকট ছিল। আবার আমার হাতেখড়ি স্বর্গীয় শ্রী সুধন্যচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের কাছে। শীতের সকাল, পূর্ব দিকে সূর্যের আলো, পিঠ দিয়ে আমি বসতাম এবং তিনি আমার সম্মুখে বসতেন। আমার যে ছায়াটি সামনে পড়ত, তখন তিনি বলতেন, দেখ ছায়াটা কতদূর এগোচ্ছে? দেখতে দেখতে ছায়াটা যখন ঘাসের ওপরে পড়ত, তখন তিনি বলতেন, দেখ ছায়ার রঙ কী? যখন খালি মাটিতে পড়ত, তখন বলতেন, ছায়ার রঙ কী? এভাবে তিনি আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। আর প্রকৃতি তো মানুষকে কবি করে। আমি প্রথমে গদ্য লেখা দিয়ে শুরু করি। প্রথম লেখা ১৯৬২ সালে। কালিদাস রায়ের (১৮৮৯-১৯৭৫) একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে। তবে প্রকাশ পায় নি। আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা ১৯৬৬ সালে ‘অন্ধকারের পথ ধরে’। এই লেখাটি একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা। তারপরে আমি হাত দিলাম অনুবাদে। ১৯৬৬ সাল থেকে আমি ঢাকায় এসে ১৯৬৬ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট) ভর্তি হলাম। ছাত্র রাজনীতিতে কিছুটা জড়িত হই। এই রাজনীতি ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রশ্নের রাজনীতি। এই সময়েই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব আবুল হাসানের, অন্যদিকে হেলাল হাফিজ থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু গুণসহ সবার সঙ্গে। তবে বন্ধুত্বের পর্যায়ে শহীদ কাদরী ছিলেন আমার কাছে অগ্রগণ্য। আমি প্রচুর লিখেছি; ১৯৬৬ থেকে শুরু করে; তবে আমার প্রথম বই ১৯৭৫-এ, ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’। কাজেই বুঝতে পারছ যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাকে অন্য কবি বানিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যদি না হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আমাদের ভিতরে না আসত, তাহলে আমাদের সাহিত্যের ভাষা অন্য রকম হয়ে যেত। সাহিত্যের বিষয়বস্তু অন্য রকম হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে ভাবতে শেখাল—আমি বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে ভাবতে শেখাল—আমার বাংলাদেশ। সুনীলদার সাথে যোগাযোগ অনেক পরে। তিনিও হৃদয়ে ধারন করতেন বাংলাদেশকে। একবার ভেবেওছিলেন যে শেষ জীবন তিনি ঢাকায় থাকবেন। এমন মানুষ আমায় ভালবাসতেন। সুনীলদার জন্যে নয়, আমার বাল্যের প্রেক্ষিত, আমার শিক্ষক, আমার বন্ধুরা আর মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অপার করেছে। আমার কখনও মনে হয় না লেখার সময় তোমরা আলাদা।
দীর্ঘ কথোপকথনের পরে তিনি বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তোমায় কি দেই বলো তো? প্রতিবার কিছু না কিছু দিয়েছেন। বেশিটা নিজের বই, একবার রাস্তায় দেখা, একটা কফি মাগ কিনে তার ওপরে লিখে দিয়েছিলেন, হাতে কিছু নাই, তাই... হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমি দুম করে বললাম – আপনার একটা কবিতা দিন। তিনি কম্পিউটারে কী সব ঘাঁটলেন। তারপরে বললেন, তোমার মেইল চেক করো। খুলে দেখি সেখানে সিরাজীদার মেইল, লেখা –
একটি লেখা - গায়ে-গতরে কেমন পৌঁছুলো জানিও।
নিত্য শুভার্থী-
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
একটি অপরিণামদর্শী বর্ণনা
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
বুক খুলে দাঁড়িয়েছিলো অস্ত্রাগার
আর কান পেতে শুনছিলো পানশালা
হৃদয়ের কম্পন ও শ্রবণের মাত্রা
যৌথভাবে একটি কলহ উপভোগ করলে
প্লাটফর্মে উপচে পড়ে ভিড়
তূর্ণনিশীথ বাড়ি যাবে
পথে এলেম দিচ্ছে কারিগর
আর রুমালের ভেতর থেকে জাদুকর বের করছে সাপ
‘বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে …’
যাবার জন্য ভূগোলের পাতা খোলা দরকার
পঁচিশ বছর আগের একগুচ্ছ চুম্বন
সামাজিক বিজ্ঞান নিয়ে চাকায় মেতেছে
অস্ত্রাগার ও পানশালা
মধ্যরাতে একটি রাজনৈতিক অধিবেশনের প্রস্তুতি নিলে
কুকুরটি সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্টির স্বর্গে আরোহণ করবে।
কবিতাটি পড়তে পড়তে এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। উত্তরণ ঘটল অন্য এক জগতে। কথায় ভেসে গেল পকেটে আনা ঝগড়া। আমি শুধু বলতে পারলাম – আমি উঠি সিরাজীদা। আবার আসব। নাহ, আর হল না করোনার করালাঘাতে। মধ্যরাতে কলকাতার কবিতার প্রান্তরে সংবাদ আছড়ে পড়লা – সিরাজীদা নেই। ফোন বাজল। স্মৃতিচারণে তর্পণ। কিন্তু কবিতা কী হারালো, তা কবিতাই উত্তর দেবে ভাবীকালে। কিন্তু আমার কবিতার দীপশিখাটি নিভে গেল।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন