জলধি / ভ্রমণ / মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়
Share:
মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়
সপ্তাহের পাঁচটা দিন কেটে যায় নানা রকম কাজের চাপে। বাকি দুটো দিন চেষ্টা করি আনন্দ করে কাটাতে। এ রকমই একটা সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঠিক করলাম, বাড়িতে থাকব না; কোথাও একটা যাব। শনিবার গিয়ে রবিবার ফিরে আসবো। সেইমতো জায়গা বাছাই চলতে লাগলো । কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগের এই জায়গা বাছাই পর্বটাও খুব মজার হয়। আমরা এই উইকেন্ড ট্রিপ গুলোতে সাধারণত  চার জনই যাই। আমরা স্বামী-স্ত্রী আর আমাদের এক বন্ধু পরিবার; তারাও স্বামী-স্ত্রী । আমাদের ছেলেরা যায় না। হয়তো আমাদের সুযোগ করে দেয় নিজেদের মতো সময় কাটাতে। এবার আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে আরেক সেট  couple।
         
ফিরে আসছি জায়গা বাছাই পর্বে। সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমাদের ঘরে মিটিং বসেছে, মিটিং উইথ ইটিং --- যাকে আড্ডাই বলা ভালো। কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায় ----অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করতে হবে যে। প্রথমত এক রাতের জন্য যেতে হবে , দ্বিতীয়ত  বেশি দূরে যাওয়া যাবে না তৃতীয়ত বেশি টাকা খরচ করা যাবে না চতুর্থতঃ খাওয়া-দাওয়া ভালো হতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একেকটা করে জায়গার নাম উঠে আসে, google করে ফোন নাম্বার জোগাড় করা হয়, কথা বলার চেষ্টা করা হয় আবার সেটা ক্যানসেল হয়ে যায়।এভাবে দু-চারটে স্পট ক্যানসেল হবার পর আলটিমেটলি ঠিক হলো আমরা 'টাকি' যাব। ছেলে শুনে বলল সারা সন্ধ্যে আলোচনা করে শেষে টাকি?!! আমি কপট গম্ভীর মুখে জবাব দিলাম "ওটাই  বেস্ট স্পট"!!
       
প্ল্যান মাফিক শনিবার সকাল সকাল পাড়ার মোড়ে একত্র হলাম ছয়জনে। স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলাম। লোকাল ট্রেন; এটা ওটা খাবার উঠতেই থাকে। বাদাম ভাজা, ঝাল মুড়ি, শসা, আপেল খেতে খেতে আর বকর বকর করতে করতে চলেছি আমরা। বারাসাত পর্যন্ত সবই চেনা স্টেশন। তারপর থেকে শুরু হল সব অদ্ভুত অদ্ভুত নামের জায়গা। 'কড়েয়া কদম্ব গাছি', 'ঘোড়ার রস ঘানা' 'কাঁকড়া মির্জা নগর' ----কোথা থেকে যে এইসব নামের উৎপত্তি কে জানে!! সবচেয়ে হাস্যকর নাম ছিল 'ভ্যাবলা'। হেসেই মরি আমরা। এমনও জায়গার নাম হয়! বারাসাত জংশনের পর থেকেই ট্রেন চলেছে গ্রাম বাংলার বুক চিরে। ট্রেনের দুদিকে সবুজ আর সবুজ। মাইলের পর মাইল জমিতে ফসল ফলে আছে। কোথাও ধান, কোথাও পাট, কপি, পটল, কলা , নানা রকম শাকসবজি, সবুজের সমাহার। তাকিয়ে থাকলে চোখের শান্তি হয়, মনেরও শান্তি হয়। আমাদের শহরকেন্দ্রিক জীবনে সবুজের, সজীবতার বড় অভাব। চারিদিকে ইট কাঠ পাথরের ধূসর রং বড় কর্কশ; সেখান থেকে দুদিনের জন্য পালিয়ে এসে ভুল করিনি। মনে হচ্ছিল ছেলেকে এনে দেখাই। "দেখ্ রে-- দুচোখ ভরে দেখ্। এই আমাদের গ্রাম বাংলা।"
           
ঘন্টা দেড়েক বাদে ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিল 'টাকি রোড' স্টেশনে। সিঙ্গেল লাইন; মানে একটাই প্ল্যাটফর্ম। বেশ লম্বা। স্টেশনে দু'চারটে ছোট ছোট খাবারের দোকান। platform এর গা ঘেঁষে ই  রাস্তা চলে গেছে। স্টেশন থেকে বেরোতেই টোটো পর পর দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েক বছর আগে যখন এসেছিলাম এখানে তখন টোটো ছিল না, ছিল 'ভ্যান'। এই আরেকটা অদ্ভুত গাড়ি, যানবাহনের মধ্যে যে ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে এটা পড়ে তখনও বুঝতে পারিনি, আজও বুঝিনা। একটা মাঝারি মাপের চৌকো পাটাতন আর তার সামনে রিক্সার মত চালক বসার জায়গা। পেছনে দুটো চাকা লাগানো আর সামনে একটা। পাটাতনে যাত্রী বসবে আর চালক সাইকেল এর মতো প্যাডেল ঘুরিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা মজা করে বলতাম 'মারুতি ভ্যান।'। এই ভ্যানে বসার আবার কায়দা আছে। সামনে-পেছনে দুজন করে পা ঝুলিয়ে বসবে আর মালপত্র থাকবে মাঝখানে। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তাদেরও স্থান হবে ওই মালপত্রের সাথে। রোদে কষ্ট হলে ছাতা খুলে মাথায় দিয়ে নিতে হবে। সে এক মজার অভিজ্ঞতা ছিল। 
     
স্টেশন থেকে রাস্তায় নেমে টোটো দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম, যাক ছাতা মাথায় পা ঝুলিয়ে বসে যেতে হবে না। এবারও আরেক মজা। আমরা ছয় জন। টোটো চালক কিছুতেই ছাড়বেনা দুজনকে, জোর করে চেপে চুপে একই টোটো তে ছয় জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে আঁটিয়ে দিল। গোঁ গোঁ করতে করতে টোটো চলেছে আর আমরা হেসেই যাচ্ছি নিজেদের অবস্থা দেখে। ভাবছি যেভাবে সেট হয়ে গেছি টোটো  থামলে আমাদের হাত পা কেটে বের না করতে হয় ! 
           
জায়গা মতো পৌছালাম প্রায় আধঘন্টা টোটো যাত্রার পরে। গেস্ট হাউস আগে থেকেই বুক করে গেছিলাম, তাই ঘর খুঁজতে আর সময় নষ্ট হলো না। টোটো থেকে নামতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। রাস্তার ডান দিক দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী আর বামদিকে সারি সারি গেস্ট হাউস। মাঝখান দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে রাস্তা। নদীর পাড় ঘে়ঁসে বানানো হয়েছে  সাজানো-গোছানো পার্ক। বসেছে অনেক দোকান পসার। সব মিলিয়ে জমজমাট ট্যুরিস্ট স্পট। এর আগে কিন্তু এরকমটা ছিল না।ছিল ইট পাতা মেঠো রাস্তা আর নদী। টাকি মিউনিসিপ্যালিটি ভালো কাজ করেছে। এখন টুরিস্ট আকর্ষণ করার জন্য ফুল প্যাকেজ এর ব্যবস্থা করেছে। সৌন্দর্যায়ন হয়েছে, থাকার হোটেল অনেক হয়েছে, নৌকো করে নদী ভ্রমণের ব্যবস্থা হয়েছে, টোটো করে গ্রাম ঘোরানোর ব্যবস্থা আছে, খুব ভালো খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত ও আছে। এমনকি 'সোনার বাংলা'ও ওখানে গিয়ে থাবা বসিয়েছে। 
 
কিন্তু নেই।-- নেই নদীর পাড়ের গাছ-গাছালি, নেই পুরনো স্মৃতি বিজড়িত যেটা ছিল টাকির ঐতিহ্য, সেই জমিদার বাড়ি গুলি। টাকিতে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ চারদিকে চারটে জমিদার বাড়ি ছিল। বড় বড় উঁচু দরজা, খিলান দেওয়া জানলা, লাল ইটের প্রাসাদপমো বাড়ি, সেই সব কালের গতিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিছুটা নদীগর্ভে বিসর্জিত হয়েছে। যেটুকু থাকতে পারতো আধুনিকতার প্রকোপে সেটুকুও নেই। টোটো করে গ্রামটা পুরো ঘুরে বেড়িয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেলাম যেগুলি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এখনো কিছুটা হলেও পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, প্রাক্তন চিফ অফ আর্মি, জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি।
         
গেস্ট হাউসের সামনে থেকেই টোটো পাওয়া  যায়। চালকরা ই গাইড এর কাজ করে, গ্রামের অনেক জায়গায় ওরা ঘুরিয়ে দেখায় ।অবশ্য আমার ইচ্ছে বা চালকের ইচ্ছেয় নয়, ধরা বাঁধা নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট রূটে ওরা ঘোরায়। ভালোই লাগছিল।  বর্ধিষ্ণু গ্রাম টাকি। সরকারি স্কুল, সরকারি কলেজ, সরকারি হাসপাতাল, এমন কি সরকারি লাইব্রেরিও আছে টাকিতে। টাকি পৌরসভা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো পৌরসভা গুলির মধ্যে একটি। গ্রামের বেশিরভাগ লোক ই শিক্ষিত এবং তাদের বর্তমান প্রজন্ম শহরমুখী। ইছামতি নদী এই গ্রামের প্রাণস্বরূপ। বর্তমানে এই নদীকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের প্রসার হচ্ছে । স্থানীয় লোকেদের বিকল্প জীবিকা তৈরি হয়েছে । 
         
ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছালাম মিনি সুন্দরবন অঞ্চলে। টোটো থেকে নেমে পরিচয় পত্র জমা রেখে অন্য টোটো তে করে যেতে হবে সেখানে। বেশ খানিকটা হেঁটে যেতে হবে। ভারি সুন্দর এই জায়গাটা। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য এখানে মনুষ্য সৃষ্ট। নানা রকম গাছে ঘেরা এই অঞ্চলটি নদীর একদম কোল ঘেঁষে। পর্যটক আকর্ষণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলেও অঞ্চলটি দৃষ্টিনন্দন তো বটেই সবুজের সমারোহ থাকার জন্য ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম ও বজায় রাখতে পারছে। টাকির মূলত তিনটি খাদ্যবস্তু বিখ্যাত। মালপোয়া, সাদা পাটালি, আর ট্যাংরা মাছ। এই মিনি সুন্দরবন অঞ্চলে দেখলাম বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী সাদা-পাটালি বিক্রি করছে মাটিতে বসে, যেমন তার সুন্দর গন্ধ তেমনি কম দাম। কিনে নিলাম বেশ কিছুটা। এবার হেঁটে ফিরতে হবে টোটোর রাস্তা পর্যন্ত। দোকানী বৌদিদের হাতের আমড়া মাখা, কদবেল মাখা খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম টোটো করে গেস্ট হাউস। লাঞ্চ করতে হবে এবার। পেটে যে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।
         
রান্নাবান্না বেশ ভালোই। মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে খানিকটা গড়িয়ে নিলাম বিছানায়। শীতের শেষ দিক। ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে যাবে, তাই বেশি দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। সামনে নদীঘাটে নৌকা বাঁধা আছে। আলো থাকতে থাকতে নৌকাযাত্রা সেরে ফেলাই ভালো। দর দস্তুর করার বিশেষ সুযোগ নেই। মাঝিদের অর্থ মূল্য ও পৌরসভা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম নৌকায়।
           
নৌকা যাত্রা তো আগে বহুবার হয়েছে। কখনো নদী পারাবারের উদ্দেশ্যে, কখনো আবার নিছকই নদীতে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ নেওয়ার জন্য। এবারে ইছামতির বুকে নৌকা যাত্রা একটা আলাদা মর্যাদা পেল। আমরা চললাম জলপথে দুই দেশের সীমানা বরাবর। প্রাকৃতিক নিয়মে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী। নদীর প্রস্থ এই অঞ্চলে অনেকটাই বেশি আর এই চওড়া নদীর এক দিকে ভারত বর্ষ আর অপরদিকে বাংলাদেশ। প্রকৃতি কখনো ভৌগোলিক সীমানা মেনে চলেনা। সে তার নিজের খেয়ালে বিদ্যমান থাকে, আমরা আমাদের সুবিধা মত তাকে 'আমরা- ওরা' য় ভাগ করে নিই। এখানেও তাই ঘটেছে। বহতা নদীর মাঝ বরাবর সীমানা টেনে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নৌকো দৈর্ঘ্য বরাবর অনেকদূর যেতে পারবে কিন্তু প্রস্থ বরাবর সীমানা লঙ্ঘন করতে পারবে না ।
     
এই সীমানা বছরে একদিনই লঙ্ঘন করা যায়। বিজয়া দশমীর দিন। টাকি- হাসনাবাদ অঞ্চলে যত দুর্গাপুজো হয়, সব মূর্তির বিসর্জন হয় একটি নির্দিষ্ট রীতি মেনে। দুটো নৌকোর মাঝখান বরাবর মায়ের মূর্তিটি রাখা হয়, মাঝ নদীতে গিয়ে দুটো নৌকো দুদিকে সরে যায়, মাতৃ মূর্তি বিসর্জিত হয় নদী বক্ষে। এ এক চমৎকার দৃশ্য। বহু লোক সমবেত হয় এই দৃশ্য দেখার জন্য। এই একটি মাত্র দিনে নদীর ''একুল - ওকুল দুকুল ভেসে যায়"। ভারত বাংলাদেশের ভাই বোনেরা একে অপরের সাথে মিশে যেতে পারে নদী কুলে। (স্থলভাগে যাওয়া যাবে না)। এরপরে যদি কখনো টাকিতে আসি অবশ্যই এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার উদ্দেশ্যে আসবো। আপাতত ঘরে ফেরার সময় হলো।
     
         
কিভাবে যাবেন---
 শিয়ালদা থেকে হাসনাবাদ লোকাল ধরে 'টাকি রোড' স্টেশনে নামতে হবে। তারপর টোটো ধরে নদীর ধারে।
       
কোথায় থাকবেন--
 নদীর ধারে যথেষ্ট সংখ্যায় হোটেল বা গেস্ট হাউস রয়েছে। দরদাম করে নেওয়া যায়। আগে থেকে বুক করেও যাওয়া যায়। 
কি কি দেখবেন--
টোটো করে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখতে পারেন। নদীতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাও আছে।
     
কি কি খাবেন--
 শীতকালে গেলে অবশ্যই সাদা পাটালি চোখে দেখবেন। এছাড়া মাখা সন্দেশ আর মালপোয়া বিখ্যাত। আর আছে নদীর বড় বড় ট্যাংরা মাছ।
 
 সময় সুযোগ করে সবাই একবার অন্তত ঘুরে আসবেন টাকি থেকে।


অলংকরণঃ তাইফ আদনান