জলধি / ভ্রমণ / ভূগোলকের সুদূর দক্ষিণে রবি ঠাকুরের বিজয়ার দেহলিতে
Share:
ভূগোলকের সুদূর দক্ষিণে রবি ঠাকুরের বিজয়ার দেহলিতে

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সুদূরে আর্জেন্টিনা। ২০১৫ সালে আমরা বহু বছরের অর্থ সঞ্চয়ের বিনিময়ে গিয়েছিলাম অ্যান্টার্কটিকা আর সেই সময়ে আমাদের কয়েকটা দিন কেটেছিল আর্জেন্টিনায়। আজকের গল্প সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত বলেই আমার ধারণা। ১৯২৪ সালে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু এবং আরো কয়েকটি দেশে যাওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু পথেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার ফলে তাঁর যাত্রা সংক্ষিপ্ত করে নামতে হয় আর্জেন্টিনায় এবং তিনি আতিথ্য গ্রহণ করেন সেই সময়ে আর্জেন্টিনার সাহিত্য জগতের সুপরিচিত বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। বেশ কিছুটা সময় উনি অতিবাহিত করেন প্লাতা নদীর তীরে অবস্থিত আর্জেন্টিনার অভিজাত ওকাম্পো পরিবারের সান ইসিদ্রোর ভিলাতে। সেখানে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে গড়ে ওঠে কবির এক নামহীন সখ্য যার ব্যাখ্যায় আমি এই লেখায় যাব না। এই বিষয়টা নিয়ে বাংলায় এবং ইংরেজিতে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা অনেক বই আছে। এ কথা সকলেরই জানা যে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর বিদেশের পরবাস পরিপূর্ণ করে দেওয়া সেই নারীকে যাঁকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘বিজয়া’ নামে।

আর্জেন্টিনায় যাওয়ার এবং কয়েক দিন থাকার পরিকল্পনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিল সান ইসিদ্রো যাওয়ার। আমি শুনেছিলাম যে ওকাম্পো পরিবারের ওই ভিলাটি এখন একটি সংগ্রহশালা। আমাদের সময় খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল তাই ফেরার দিনটিই আমরা ধার্য করেছিলাম সান ইসিদ্রো যাওয়ার জন্য। প্রায় মধ্য রাতে আমাদের নির্ধারিত উড়ান ফলে সকালটা বুয়েনোস আইরেস থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সান ইসিদ্রো যাওয়া যেতেই পারে। আমাদের হোটেলের কেউই ভালো ভাবে আমাদের পথ নির্দেশ দিতে পারল না। শেষ পর্যন্ত একজন বলল যে সান ইসিদ্রো যাওয়ার ট্রেন আছে কিন্তু সেখানে গিয়ে কী ভাবে ওকাম্পো ভিলায় পৌঁছনো যাবে সে কথা তারা কেউ জানে না। আসলে আমরা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে যে ভাবে চিনি বা মনে রেখেছি আর্জেন্টিনার মানুষ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সংযোগকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখেনি ভিক্টোরিয়াকে। শিক্ষিত আর্জেন্টিনীয়দের কাছে তিনি সুপরিচিত একটি সংস্কৃতিমনস্ক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা সাহিত্য জগতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। ভিক্টোরিয়া ছিলেন এক অসাধারণ প্রাবন্ধিক, পত্রিকা সম্পাদক এবং আর্জেন্টিনার নারী মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা। তাঁর সম্পাদিত ‘সুর’ (দক্ষিণ) পত্রিকাটিতে সেই সময়ের প্রতিটি লাতিন আমেরিকান লেখকের কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি ভিক্টোরিয়ার বোন সিলবিনা ওকাম্পোও কিন্তু একজন বিশিষ্ট গল্পকার ছিলেন সেই সময়ে।

যাই হোক, আমরা অবশেষে অনেক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে (স্প্যানিশ ভাষাটা জানি বলে খুবই সুবিধা হয়েছিল) আমরা বুয়েনোস আইরেস স্টেশন থেকে সান ইসিদ্রো যাওয়ার ট্রেন ধরলাম। তিরিশ কিলোমিটার মতো দূরত্ব পেরোতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো সময় লাগল। প্রথমে শহর, তারপর ছবির মতো সুন্দর শহরতলি; সান ইসিদ্রোও তারই মধ্যে একটি। স্টেশনে নেমে ওকাম্পো ভিলার খোঁজ করতেই লোকজন ভালো করে পথ বলে দিল কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষ আমাদের হতাশ করে স্প্যানিশে যা বললেন তার মর্মার্থ হল, ‘আপনারা আজ এলেন কেন? আজ তো বুধবার। ওকাম্পো ভিলার মিউজিয়াম তো বন্ধ থাকে আজ। আপনাদের শুধু বাইরেটা দেখেই ফিরে আসতে হবে। কাল কি একবার আসা যায় না ?’ আমাদের হাতে কোনো কাল আর ছিল না। আমরা জানতাম যে অত দূরের দেশে আর কোনো দিনই যাওয়া হবে না আমাদের। মন খারাপ নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম ওকাম্পো ভিলার দিকে।

দক্ষিণ গোলার্ধের শরৎকাল তখন। আমাদের দেশের মতোই রোদটা চড়চড়ে ছায়াটা বড় আরামের। পাথর বিছোনো ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে প্রতিটা মোড়ে মানুষ জনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে বেশ খানিকটা গিয়ে অবশেষে হাজির হলাম ওকাম্পো ভিলার সামনে। উঁচু দেওয়াল আর গাছগাছালির ভিতর দিয়ে বাড়িটাও ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। মনটা ভারি হয়ে উঠল। পাঁচিলের গায়ের দরজাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ। কোনো জনমনিষ্যির দেখা নেই অভিজাত পল্লীর রাস্তায়। তাহলে ? এত দূর এসে কি ফিরেই যেতে হবে শেষ পর্যন্ত ?

সকলে বলে যে খুব আকুল ভাবে কিছু চাইলে অনেক সময় ভাগ্য একটা সুযোগ দেয়। অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদের ভাগ্যও তেমন একটা সুযোগ দিল আমাদের। একটা বড় গেট খুলে গেল হঠাৎ। তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ময়লা নেওয়ার গাড়ি। সে কারণেই গেটটা খুলল আর দু হাতে ময়লার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলেন কেয়ারটেকার গোছের এক ভদ্রলোক। তাঁকে দেখে আমি তো ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে তাঁর পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওঁকে বললাম আমাদের আসার উদ্দেশ্য। ভদ্রলোক তো কোনো কথা শুনতে চান না। ‘এস্তা সেররাদো... এস্তা সেররাদো...’ (বন্ধ আছে, বন্ধ আছে) বলেই চলেন। আর আমি তো গেটের মুখে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছি যে আমাকে ঠেলে না সরালে উনি ঢুকতে পারবেন না। আমার বর আমাদের বিজাতীয় ভাষার আলাপনের মাঝখান থেকে সরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে রাস্তায় লাফিয়ে বেড়ানো স্টার্লিং পাখিদের ছবি তোলায় মন দিলেন। আর আমি তো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যাই হোক না কেন, দরজা যখন একবার খুলেছে তখন আমাকে ঢুকতে দিতেই হবে। আমি ততক্ষণে রবীন্দ্রনাথ কে, তাঁকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কত শ্রদ্ধা করতেন এবং আমি সেই রবীন্দ্রনাথের দেশের লোক, আমাদের কাছে এই বাড়িটা তীর্থক্ষেত্রের মতো ইত্যাদি প্রভৃতি বলেই চলেছি। অবশেষে অত অত স্প্যানিশ বকার ফল মিলল। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক আমাদের ঢুকতে দিতে রাজি হলেন। সঙ্গে এটাও বললেন যে ভিজিটার্স বুক-এ আমাদের সই করতে দেওয়া যাবে না আর মিউজিয়ামটা আমরা দেখতে পাব না। আমরা বাগান ঘেরা বাড়িটার চারপাশে ঘুরে যেতে পারি।

তাই সই ! অন্তত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্মৃতিধন্য পরিসরে তো ঢোকা যাবে। ঢুকলাম। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটা হল ফুলে ফুলে সেজে থাকা একটা রক্তকরবীর গাছ। অবশ্যই এই গাছ রবীন্দ্রনাথের সময়ের নয় কিন্তু গোটা বাগান জুড়ে অজস্র ক্রান্তীয় অঞ্চলের গাছ যা এমনিতে আর্জেন্টিনার মতো সমশীতোষ্ণ অঞ্চলে থাকার কথা নয়। আমরা বুয়েনোস আইরেস বা আর্জেন্টিনার অন্য কোথাও এই ধরনের গাছ দেখিও নি। সত্যি মিথ্যা জানি না, আমার মনে হয়েছিল ভারতবর্ষের গাছ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য এই বাগানটিকে সাজিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া এবং সেই ঐতিহ্য ওকাম্পো ভিলার পরবর্তী দিনের উত্তরাধিকারীরা বজায় রেখেছেন।

আমরা পুরো বাগানটা ঘুরলাম পায়ে পায়ে। গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলাম। কতটা সুরে কতটা বেসুরে তা অবশ্য জানিনা। তবে রবি ঠাকুরের অজস্র গানের বাণী আমার আপনা থেকেই স্মৃতিতে থাকে কাজেই গেয়ে গেলাম মনের আনন্দে। ইতিমধ্যে ওই কেয়ারটেকার ভদ্রলোক নাম মিগেল (মাইকেল) আমাদের জন্য একটু কফি আর বিস্কুট নিয়ে এলেন। ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। আমরা একটা সুন্দর ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে কফি খেলাম আর গল্প করলাম। মিগেল বললেন যে ওঁর বাবা ওঁকে অনেক বার বলেছেন যে এশিয়ার সব চেয়ে বড় কবি এবং এক মহান দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে ওকাম্পো পরিবারের অতিথি হয়ে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন যদিও সে সময়ে উনি নিজেও খুব ছোট ছিলেন। তবে ওঁর বাবা মানে মিগেলের দাদু সেই সময়ে ওকাম্পো পরিবারের মালিদের একজন ছিলেন এবং এই বাগানটার যত্ন উনিই করতেন। সারা গায়ে যেন কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছিল কল্পনা করে।

মিগেল বললেন যে উনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েননি কখনো। আমার মাথায় কী রকম ভুত চাপল যেন। স্মৃতি থেকে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতার অংশ অনুবাদ করে দিয়ে এলাম ওঁর হাতে। কবিতাটির নাম ‘বিদেশী ফুল’। কবি কবিতাটি কার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় পড়লে। মিগেল সম্ভবত কাব্যরসিক নন। কিন্তু একজন সুদূর পুবের দেশ থেকে আসা একটা মানুষ নিজের স্মৃতি থেকে তাদের প্রিয় কবির একটা কবিতা স্প্যানিশে অনুবাদ করে দিচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা তাঁকে বেশ চমৎকৃতই করেছিল বলে মনে হয়।

ফেরার পথে যেন মন ভেসে ছিল রুপো রঙের প্লাতা নদীর ধারায়, যে নদীর স্রোতে মিশে আসে এক বর্ষীয়ান কবি ও তাঁর ভিন ভাষার বিদেশী অনুরাগিনীর এক অনন্য বন্ধুত্বের কাহিনী যা বইতে থাকবে যুগ থেকে অন্য যুগে।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান