‘জলধি’ পত্রিকা আর তার সম্পাদক নাহিদা আশরাফীর সঙ্গে আমার বহুস্তরীয় ভালোবাসার সম্পর্ক। আজ যখন ‘জলধি’ ভ্রমণ বিষয়ক লেখার সুযোগ এল, তখন আমি লিখব সারা পৃথিবী জুড়ে সূর্যের আলোর মতো, জ্যোৎস্নার মতো ছড়িয়ে থাকা মরমী কিছু ভালোবাসার সত্যি গল্প। যে গল্পগুলি আমার ঝুলিতে এসেছে পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণের হাত ধরে।
লকডাউনের কঠিন সময়টায় এই স্মৃতিগুলিকে বুকে নিয়ে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছি এবং আমার সাধ্য মতো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস। এই লেখাটাও সেই প্রক্রিয়াতেই লেখা হয়েছিল।
যে সীমাহীন ভালোবাসা সীমানাহীন তারই একটা ছোট্ট স্মৃতি
ভালোবাসার মণিমুক্তো... এক অজানা রহমতের গল্প
এই লেখাটা লিখতে পারছিলাম না বড় বেদনায়। কত স্মৃতি, কত ছবি আর কত কষ্ট যে ভিড় করে আসছিল মনের মধ্যে ! চোখের সামনে ভাসছিল দিল্লী বাস স্ট্যান্ডের কাছে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের মুখটা। এক কাঁধে একটা বড় ব্যাগ, যার মধ্যে ঠেলে আঁটিয়ে দিয়েছে তার বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকু আর অন্য কাঁধে এক বোধহীন মুখে এত বড় একটা ভিড় দেখতে থাকা একটা এত ছোট মানুষ ! ভিটে মাটি ছেড়ে দূর পরবাসে শুধু জীবনধারণের, জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন নিয়ে আসা এক ভয়ার্ত পালাতে চাওয়া মানুষ। এই মুখটা কি আমাদের গ্রামের রাজেশের, নাকি মুর্শিদাবাদের জাহাঙ্গীরের নাকি সেই সুদূর ইতালির খোকন বা বাসুর ?
বড্ড মনে পড়ছে ইতালির কথা। সেই ২০০৫ সালের কথা। সেই রোম, ফ্লোরেন্স আর পিসার কথা। আজ আর বেড়াতে যাওয়ার বিবরণ লিখব না। লিখব কিছু রহমতদের কথা। কোন রহমত ? সেই যে কাবুলিওয়ালা ! যার ছোট্ট মেয়েকে নিজের দেশে রেখে সে কলকাতায় এসেছিল সওদা বেচতে। বাকিটা আছে গল্পগুচ্ছ আর তপন সিংহের সিনেমায়, যাতে ছবি বিশ্বাস অভিনয় করেছিলেন নাম ভূমিকায়।
রোমের ট্রেভি ফাউন্টেন থেকে শুরু করে কলোসিয়াম হয়ে প্যানথিয়ন পরে ফ্লোরেন্স হয়ে পিসার হেলানো মিনার পর্যন্ত প্রতিটি দ্রষ্টব্য স্থানের আশেপাশে একটু দাঁড়ালেই কানে আসত বাংলা কথা। তখনো দলে দলে লোকজন ইউরোপ যেত না তাই চমকে ফিরে তাকাতাম স্বভাষীর খোঁজে। দেখতাম পরিচিত চেহারার, চেনা ভাষার মানুষরা নানা রকমের জিনিস বিক্রি করছে বিদেশী পর্যটকদের কাছে। ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ আর ইতালিয়ানে তারা দিব্যি কাজ চালানোর মতো কথা বলতে পারত। হয় আমাদের নিজেদের মধ্যে বাংলা বলা শুনতে পেয়ে ওরা এগিয়ে আসত নয় ওদের নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে শুনে আমরা এগিয়ে যেতাম। দু চারটে কথা হত। হয়তো টুকটাক স্যুভেনির কিনতাম। ওদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম ওরা সবাই বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে এসেছে ইতালিতে। কিছু লোক ওখানকার নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে (ওদের ভাষায়... কাগজ হয়ে গেছে) আর বাকিরা এখনো আইনত অনুপ্রবেশকারী। হয়তো কখনো কোথাও কাগজ বেরোলে (ইতালি, ফ্রান্স,স্পেন,পর্তুগাল) ওরা ছুটবে সেই কাগজ জোগাড় করে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করবে। তার আগে পর্যন্ত এই ভাবেই... ! আমার মেয়ে ঊর্মি তখন বেশ ছোট। বছর সাতেক বয়স। ওর কাছে ওই বিদেশে বাংলাভাষী মানুষগুলো সঙ্গে সঙ্গে কাকু হয়ে উঠত। আর ওরা বড় ভালোবাসায় ওর হাতে তুলে দিত ছোট ছোট উপহার। কলোসিয়ামের রেপ্লিকা, হাঙরের মতো দেখতে বেলুন, আলো জ্বলা শিং ইত্যাদি। কিছুতেই রাজি হত না দাম নিতে। অনেকেরই নাম ভুলে গেছি এখন কিন্তু তাদের দেওয়া উপহারগুলি সযত্নে রাখা আছে।
এই রকমই একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ফ্লোরেন্সে। রোম থেকে ট্রেনে ফ্লোরেন্স এসেছিলাম আমরা। স্টেশনের কাছেই আমাদের হোটেল। একটা পুরোনো ম্যানসন ধরনের বাড়ি হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। তার তিনতলায় আমাদের ঘর। মালপত্র নিজেদের টেনে তুলতে হয়। সকালে রোমের হোটেলে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছিলাম ট্রেন ধরতে। ফ্লোরেন্সে পৌঁছে ঠিক করলাম ফল সহযোগে লাঞ্চ করব আর তারপর বেরিয়ে যাব পায়ে হেঁটে ফ্লোরেন্স দেখতে।
স্টেশনের কাছেই অনেকগুলো ফলের দোকান। তার একটাতে গিয়ে হাজির হলাম। একজন বাংলাদেশী দোকানদার, চেহারাতেই মালুম হচ্ছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই ঊর্মিকে জিজ্ঞেস করল, ‘ফল নিবা ? কী ফল নিবা ?’ ঊর্মি চমৎকার লাল চেরিগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত দাম ?’ আমার কথাটা কানে না তুলেই বেছে বেছে সুপুষ্ট চেরি দিয়ে একটা বড় সড় ব্রাউন পেপারের ঠোঙা ভর্তি করে ফেলল দোকানদার। ইউরোপে গিয়ে প্রথমেই যেটা মাথায় ঘোরে সেটা হল এত ইউরো মানে টাকায় কত ? আমারো মনে হচ্ছিল। দোকানদার এবার প্রশ্ন করল, ‘পিস্ফল (পীচ) খাইবেন না ? এহানকার পিস্ফল মধুর লাহান। খাইয়া দ্যাহেন !’ কিছু বলার আগে গোটা পাঁচেক পিস্ফল ঠোঙায় ঢুকে পড়ল। তারপর আঙুর, কয়েকটা বেদানা আর কয়েকটা অচেনা ফল (ও যেন কী একটা বলেছিল ‘ফিগ’-এর কাছাকাছি)। সব মিলিয়ে তিনটে প্রমাণ সাইজের ঠোঙা। সেগুলোকে সযত্নে একটা কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেলল। আমি তো দাম নিয়ে প্রমাদ গুনছি। খুব রাগ হচ্ছে এ ভাবে এত গুলো ফল গছিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ফলগুলো দেখে লোভও সামলাতে পারছি না ! ওর কাজ সমাধা হলে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, ‘কত হল ?’
লোকটি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর একটা উদ্ভট প্রশ্ন করল, ‘খুকির বয়স কত ?’ ‘সাত বছর’, আমি একটু অবাক হয়েই উত্তর দিলাম। ‘কী নাম তোমার ?’ এবার প্রশ্নটা ঊর্মিকে। ‘আমার নাম অনুষা রায়’, গোটা বাক্যে ঊর্মি উত্তর দিল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘আমার আরেকটা নাম ঊর্মি।’ ‘ঊর্মি !’ লোকটি বলে, ‘বাঃ ! খুব মিঠা নাম তো!’ আমাদের তখন টাকা মিটিয়ে যাওয়ার তাড়া। ফ্লোরেন্সে একটা দিনই পাব ঘোরার জন্য। পরের দিন ট্রেনে করে যেতে হবে পিসা। এখন কি ফলওয়ালার সঙ্গে খেজুর করার সময় ?
‘দাদা ধরেন’, কল্যাণের দিকে ফল ভর্তি ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে লোকটা বলে। ‘কত দেব ?’ কল্যাণ জিজ্ঞেস করে। লোকটা বুড়ো আঙুল আর তর্জনী গোল করে ঘুরিয়ে যে মুদ্রাটা দেখায়, সেটাকে আমরা শূন্য বলেই জানি ! ইতালিতে কি ওই মুদ্রাটার অন্য কোনো মানে আছে নাকি ? আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে লোকটা হাসল একটু। তারপর বলল, ‘আমারও এক খান মাইয়া আছে দ্যাশে। ওই রকমই বয়স অইব অ্যাহন। কত দিন দেহি নাই তারে’, চকিতে মনে পড়ে গেল কাবুলিওয়ালার রহমতের কথা। ‘কী নাম আপনার মেয়ের ?’ ‘বিলকিস’, আমার প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বলে। ‘অর মায়ে তো অরে মিনু কইয়া ডাকে। ছবি আছে, দ্যাখবেন ?’ শত জীর্ণ মানিব্যাগের ভিতর থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে আনে লোকটা। মুখ চেনা যায় না এত রংচটা হয়ে গেছে কিন্তু ও পারে নিশ্চয়ই। ও তো চোখের আলোয় দেখে না, দেখে অন্তর উপচানো বাৎসল্যের আলোয়। ‘পাঁচ বচ্ছর অইয়া গেল, দ্যাশে যাইতে পারি নাই। ট্যাহা পয়সা পাঠাই। অরা ভালো আছে জাইন্যা ভালো লাগে। ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে (তখনো মোবাইল ফোন আসেনি হাতে হাতে)। খালি কয় “কবে ফিরবা বাজান ?” আরে, শখ কইরা কি এই বিদেশ বিভূঁইতে পইরা আছি রে ? কবে যে কাগজ আইব হাতে, কবে একবার যাইতে পারুম...’ লোকটার স্বগতোক্তি বয়ে চলে।
‘আপনি কিছু টাকা তো নিন’, আমি অনুরোধ করি। লোকটার কথার স্রোত বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘দ্যাহেন, এই দ্যাশে এত ফল। সারা দুনিয়ার লোক এ দেশের ফল চাখে। আর আমি তো ফলের কারবার করি। আমার মাইয়াটা এত মিঠা ফল চাখতে পারল না...তা দ্যাহেন না, আপনার মাইয়াও আমারই মাইয়ার মতোই। সে চাখুক। আমার মাইয়াটার জন্য দোয়া করেন আপনারা। আর কিছু চাই না...’ এবার লোকটার গলা ধরে আসে। মাথা নিচু করে চশমার কাচ মোছার ছলে ও চোখের জল লুকোবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
চোখের জল বেশ সংক্রামক সেটা মালুম পাওয়া গেল বেশ। ‘আপনার নাম কী ?’ জানতে চাইলাম। ‘আব্দুল’, লোকটা উত্তর দেয় কিন্তু সবাই আমারে খোকন ডাকে। আপনেরাও ডাকবেন।’ হঠাৎ মনে হল ডাকব আর কবে ? আর হয়তো কখনো দেখাই হবে না ! তবু বললাম, ‘কখনো কলকাতায় এলে আমাদের কাছে আসবেন। নিজের আত্মীয় মনে করে থাকবেন।’ তখনই মনে হল কী পরিহাস ! যে আকুল বাবা পাঁচ বছরে একবার নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পারে নি তার কাছে আর একটা অচেনা শহরের আমন্ত্রণ কি আদৌ কোনো অর্থ রাখে ?
দু দিন পর আমরা যখন ফ্লোরেন্স থেকে জুরিখ যাওয়ার ট্রেন ধরলাম, তখন খোকনের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়ে গেলাম। ওর দেওয়া ফলগুলি সত্যি বড্ড ভালো ছিল। চার পাঁচ দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে খেয়েছি ওর দেওয়া ফল। অত ভালো চেরি আর ডুমুর (আমাদের এখানকার মতো ডুমুর নয়, মিষ্টি সুস্বাদু লালচে রঙের ডুমুর) কোনো দিন খাইনি আজ পর্যন্ত।
জানিনা, এই বিশ্বব্যাপী অতিমারির দিনে কোথায় আছে খোকন ? এত দিনে নিশ্চয়ই ও অভিবাসীর কাগজ পেয়ে গেছে। ও কি ইতালিতেই আছে ? কী জানি ও কেমন আছে ? নাকি ও ইতালি থেকে বাংলাদেশে বয়ে এনেছে অসুখের জীবাণু আরো অনেক ইতালি অভিবাসী বাংলাদেশীর মতো ? শুধু এইটুকু কামনা করি, যেখানেই থাকুক খোকন যেন ভালো থাকে, খোকনরা যেন ভালো থাকে। আর মানুষের মনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যেন বেঁচে থাকে রহমতরা, খোকনরা।
এই লেখাটার প্রতিটা কথা আমার ২০০৫-এর ইউরোপ ডায়েরির পাতা থেকে নেওয়া। ওই রাতেই টাটকা স্মৃতি থেকে লিখেছিলাম। এটার উদ্দেশ্য বুঝবেন হৃদয় দিয়ে। অনুপ্রবেশ ভালো কি মন্দ এই আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
অলংকরণঃ জলধি