জলধি / প্রবন্ধ / ‘সৃষ্টি’ না ‘বিবর্তন’?
Share:
‘সৃষ্টি’ না ‘বিবর্তন’?

সুইডিশ  বিবর্তনীয় জীবন-বিজ্ঞানী স্ফান্তে পাবো (Svante Pääbo) ‘দেহতত্ব ও রোগ-নিরাময়’ (physiology or medicine) জ্ঞানাঙ্গনে এবার ২০২২ নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন ।                       
পাবো’র আবিষ্কৃত সুত্র , আজকের আধুনিক মানুষের ( Homo sapiens) জৈবিক / শারীরিকভাবে সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের আত্মীয়তার  ধারাবাহিকতা জানতে অত্যন্ত বেশী সহায়ক ও সহজ হতে পারে। প্রায় ৪০ হাজার বছরেরও আগের বিলুপ্ত প্রজাতির (Neanderthals) হাড় থেকে অনু-প্রবিষ্ট ডিএনএ , তুলনামূলক  বিশ্লেষণ–সংশ্লেষণ করে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।  এটা তার প্রায় ৩০ বছরের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ।
দণ্ডায়মান দ্বিপদী গরিলা ( বন মানুষ) – নিন্দারথালদের (Neanderthals) জিন (gene, genome , ডিএনএ ) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি মৌলিক আবিস্কার করেন যে , বিলুপ্ত নিন্দারথাল প্রজাতিদের থেকেই দৈহিক , মানসিক ও চারিত্রিক ভাবে বিবর্তিত হয়ে আজকের মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। তারাই আজকের মানব প্রজাতির অতি নিকট পূর্বসুরী / আত্মীয় ছিল ।
নোবেল কমিটি বলেছে , Svante Pääbo established an entirely new scientific discipline, paleogenomics. (প্যালিওজেনোমিক্স হল,  জীব-বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্র - যা বিলুপ্ত প্রজাতির জিনোমিক তথ্যের উৎসগুলো ( জৈব , প্রত্ন তাত্বিক প্রাচীন নিদর্শন ইত্যাদি) আনবিক- বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন জীব ও জীবনের আদ্যপান্ত সম্পর্ক ধারা অনসন্ধান করে। )
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , নোবেল পুরস্কারের সম্প্রতিক ইতিহাসে এটা প্রায় বিরল যে , একক ভাবে কেহ এ  পুরস্কার পেয়েছে।  এ আবিস্কারে পাবো’র নেতৃত্ব এতই মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ যে , দল নিয়ে কাজ করেও , তিনি একাই পুরস্কৃত হন। এই বিভাগে ২০১৪এর পর এবারই প্রথম কাউকে পুরস্কার দেয়া হল। তখন জাপানের  বিজ্ঞানী ইওশুনরি ওসুমি ( Yoshinori Ohsumi ) এটি  পেয়েছিলেন ।  
তার আবিস্কারের একটা বড় পর্যবেক্ষণ ছিল যে ,  বর্তমান কোভিড মহামারীর অন্যতম একটা কারন ছিল যে , নিন্দারথালদের এক বিশেষ জিন (gene) বা জীবানু আজকের মানব সমাজে সংক্রামক হওয়া। এই জীবাণুর আচরণ  ও তার বৈরী প্রভাব বিস্তারে অতীতে বিলুপ্ত এ প্রজাতির জিন হয়ত দায়ী । এটা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে ।  
আমি পাবোকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম বেশ আগে থেকেই। ২০০৯য়ে  Jim   Mullikinর  সহযোগিতায় পাবো সর্বপ্রথম কোন ডিএনএ -কে ক্লোন করে নিন্দারথালদের বিলুপ্ত প্রজাতির মানুষের জেনোম পরীক্ষা সফল ভাবে সম্পন্ন করেন। তখনই তিনি ভেবেছিলেন ,  হোমো-স্যাপিয়েনদের শরীরে বিলুপ্ত নিন্দারথাল প্রজাতিদের (extinct hominins) থেকে তাদের জিন প্রবাহ ( বিস্তার) করে বর্তমান মানব জাতিতে এসেছে ।

বিবর্তন ধারাঃ
অসীম মহাকালের গহ্বর থেকে এ বিশ্বের শুরু । হোমো-সাপিয়েন্স  প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে উত্তর-হিমযুগের (Post ice-age) কোন এক সময়ে। মধ্যবর্তী পর্যায়ে বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় মনুষ্য সমগোত্রীয় বহু প্রজাতি বিবর্তনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র প্রজাতি সৃষ্টি করেছে। একশো বছরের কিছু আগে উ.-পশ্চিম ভারতের শিবালিক পাহাড়ে একটি মহা-বানর-এর প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম পাওয়া যায়। এটির নাম রামা-পিথেকাস। প্রাথমিক ভাবে এটিকে মানব বিবর্তনের মধ্যবর্তী-স্তরের প্রতিনিধি হিসেবে মনে করা হয়েছিল।  
১৫০-৬০ কোটি বছর আগে গড়ে ওঠা প্রোটেরোজয়িক স্তরে সর্বপ্রথম ফ্যাঙ্গাস, ব্যাকট্রিয়া জাতীয় নিম্নতম স্তরের বহু-কোষ প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ৬০ থেকে ২২ কোটি বছর আগে ছিল প্যালিয়জয়িক স্তর যখন সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী, মাছ, সরীসৃপ ইত্যাদির উদ্ভব হয়। তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধির ফলে ,  এই সময় থেকে ভূ-পৃষ্ঠের আয়তন বেড়ে যায় এবং আবহাওয়া উন্নতর হতে থাকে। পরবর্তী 'মেসোজয়িক' স্তরে- ২২ থেকে ৭ কোটি বছর আগে - ডাইনোসোর জাতীয় বৃহদাকার জন্তুর আবির্ভাব ঘটে। ৭ কোটি থেকে ৩০ হাজার বছর আগে আসে 'সেনোজয়িক' কালপর্ব যখন পাখি ও স্তন্যপায়ী জীবের সৃষ্টি হয়। এই যুগের শেষদিকে প্লেইস্টোসিন মানবের সৃষ্টি হয়। অতঃপর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক 'হোমো-স্যাপিয়েন্স' মানবের উদ্ভব ঘটেছে বলে ভূ-তাত্ত্বিকরা মনে করেন।
১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর পূর্ব থেকেই প্রাক-প্রাথমিক স্তরের সদ্য-জন্মা অরণ্যে মানুষ প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল বলে কেউ কেউ সনাক্ত করেছেন। আফ্রিকা, ইউরোপ সাইবেরিয়ায় , দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব  এশিয়ায় । উত্তর-পশ্চিম ভারতে – হিমালয়ের পশ্চিমে ও শিবালিক পর্বত অঞ্চলে , মায়োসিন যুগের আদিম মানুষের  জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে। ড্রায়োপিথেকাস প্রজাতির  মানুষ।  শিম্পাঞ্জী , গরিলা , অরাং-অটাং ও গিবন । বিভিন্ন ধরনের নর-বানর বিলুপ্ত হলেও বর্তমানে ৪ ধরনের এপ আছে।   
সনাতন ধর্মের মহা-পুথি ‘রামায়নে’ নাকি এর কিছু উল্লেখ ছিল।  রামাপিথেকাস , ব্রাহ্মাপিথেকাস , শিবাপিথেকাস প্রভৃতি রামায়নীয় চরিত্র গুলোও হতে ‘ রামাপিথেকাস পাঞ্চবিকাশ’ চালু হয়েছিল। এ প্রজাতির আদিম মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর পৃথিবীতে জীবিত টিকে ছিল।
মানুষ প্রজাতি-বৃন্দের বিবর্তনের মাধ্যমে বিকাশ ঘটে চারটি পর্যায়। কোটি কোটি বছর ব্যাপী ।  ১- হোমো হাবিলিস ( দক্ষ মানব প্রজাতি) , ২- হোমো ইরেক্তাস ( দণ্ডায়মান মানব) । এরা আজকের মানুষের প্রত্যক্ষ পূর্বসুরী। প্রায় ১০ লাখ বছর পূর্বে এদের উদ্ভব। প্রায় ১ লাখ বছর পূর্ব পর্যন্তও এদের অস্তিত্ব ছিল। ৩- নিন্দারথেলাস ( বুদ্ধিদীপ্ত মানব প্রজাতি) ও  ৪- হোমো স্যাপিয়েন ( আধুনিক মানুষ)। আমাদের মত , এরা সোজা হয়ে দাড়াতে , দৌড়াতে , গাছে লতা-পাতা ফল-মূল , পাথর দিয়ে , গাছের ডাল দিয়ে শিকার করতে পারত । জীবিকার জন্য। একেকটা স্তর অতিক্রমণে এ সব প্রজাতিদের লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায় ।  
গরিলা হচ্ছে প্রাইমেটদের ( আদি বন মানুষ) মধ্যে আকৃতিতে বৃহত্তম। এরা প্রাইমেট ( আদিম) পরিবারের এক ধরণের তৃণভোজী মাটিতে বসবাসরত প্রাণী। এদের বাস ছিল আফ্রিকা মহাদেশের জঙ্গলে। গরিলাদেরকে দুইটি প্রজাতিতে ভাগ করা হয়। মানুষের সাথে গরিলার ডিএনএ-এর প্রায় ৯৭-৯৮% মিল রয়েছে।  শিম্পাঞ্জিদের পরে এরাই মানুষের নিকটতম সমগোত্রীয় প্রাণী। গরিলারা নিরক্ষীয় বা উপ-নিরক্ষীয় বনাঞ্চলে বাস করে। আজও আফ্রিকার বাইরে অনেক মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে ১-৪% ‘নিয়েণ্ডারথাল’ জিন।

জৈব ‘বিবর্তন’ হচ্ছে একটি জৈব-বৈজ্ঞানিক দীর্ঘ কালের নানা জটিল প্রক্রিয়ার ধারণা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের শারীরিক , মানসিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রম-পরির্তন হয় নানা বৈচিত্রময় এ প্রক্রিয়ায় । কোন জীবের বিভিন্ন প্রজাতির অবরোহী-আরোহী বংশধরদের আবাধ মেলামাশার ফলে তাদের শরীরের জিন-গুচ্ছ কি ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে তাদেরই অধস্তন বংশ-প্রবাহে , এবং তা নব-জাতকের দৈহিক গঠনে ও বৈশিষ্টে মৌলিক পরিবর্তন করতে পারে , - জীব বিজ্ঞান এটাও অনুধাবন ও অধ্যয়ন করে।       
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এ বিবর্তনের ধারার আধুনিক গবেষণা শুরু । প্রধানতঃ ফসিল রেকর্ড আর প্রাণী বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে । ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও , অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে , হিম-যুগের পর  কালের ধারায় প্রকৃতির সাথে সংঘাত ও সহযোগীতার মাধ্যমে অসংখ্য ফাঙ্গাশ , ব্যাক্তারিয়া , কীট-পতঙ্গ সহ নানা জৈব প্রজাতিগুলোও জন্ম-মৃত্যু ও  শারীরিক , মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমিক পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়েছে। তবে এর প্রক্রিয়াটি অস্পষ্ট বা অজানাই রয়ে যায় ।  
সর্বপ্রথম , বিজ্ঞানী  চার্লস ডারউইন এবং পরে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস পৃথক পৃথকভাবে তাদের সুশৃঙ্খল ও দিক-নির্দেশনা সুচক জৈব তথা প্রাকৃতিক  বিবর্তন-ধারার উপর তত্ত্ব ( Theory of Evolution)  উপস্থাপন করলেন। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের প্রকাশিত বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই “ On The Origin Of Species “ এর মাধ্যমে। ঐতিহাসিক ‘বিবর্তনবাদ’ ।
পরে ১৯৩০ সালের দিকে , ডারউইনীয় প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের সাথে মেন্ডেলীয় বংশগতি-বিদ্যার ( জেনেটলোজী) মেলবন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্ব । এটি প্রকৃতির  ( ভু-তত্ব , নৃ-তত্ব, পরিবেশ  ও মহা-জাগতিক  ইত্যাদি) পরিবর্তনশীল বিরূপ আচরণ এবং মেন্ডেলীয় জেনেটিক্সের সাহায্যে সমন্বিতভাবে বিবর্তনবাদকে ব্যাখ্যা করে। আধুনিক জীব-বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় তত্ত্বে পরিণত হয়।  
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে টমাস হাক্সলিও 'বিবর্তন-তত্ত্ব' সমর্থন করে মানব-প্রজাতির  অস্তিত্ব রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রাম ও বর্তমান মানবজাতির আবির্ভাবের কাহিনী তুলে ধরেছেন। অতঃপর শুরু হয় নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা ও অনুসন্ধান। মানব-প্রজাতির সেই বিবর্তনের  রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে দু'টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলি হল, অতীতের প্রজাতির সাথে বর্তমান মানব জাতির  'হারানো যোগসূত্র' (Missing link) ।  অর্থাৎ লেজহীন বানর , বা বন-মানুষের মত প্রাণী থেকে আজকের শারীরিক গঠন সম্পন্ন মানুষের উদ্ভব কিভাবে হল , সেই রহস্যের সন্ধান। অপরটি হল , 'জীবাশ্ম' পর্যালোচনা । অর্থাৎ প্রাচীন জৈব বস্তুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা গঠন , যা শিলা বা প্রস্তরখণ্ডের আকারে এখনো পড়ে আছে, তাদের বিশ্লেষণ। চার্লস ডারউইন তত্বকে এ যায়গাটায় পাবো দীর্ঘ গবেষণা করে বস্তুনিষ্ঠ প্রমানাদি দিয়ে সুত্রায়ন করেন , ধারাবাহিক বিবর্তন-প্রক্রিয়ার।
 

দ্বন্ধ – বিতর্কঃ
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশের এক পর্যায়ে ,অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়  ‘বিবর্তন’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। আজও মহাজগৎ , বিশ্ব , মানব জাতি ও অন্যান্য জীবের উৎপত্তি ও বিকাশ / বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী দার্শনিক ও অন্যান্যদের সাংস্কৃতিক ও ধর্ম-তাত্ত্বিক বিতর্ক শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত চলছে। ‘বিবর্তন’ (Theory of Evolution)  শব্দটা এতই স্পর্শকাতর যে , শব্দটা   শুনলেই যেন ‘নাস্তিকতা’র একটা গন্ধ পাওয়া যায় !
চার্লস ডারউইনের বই “ On The Origin Of Species “ বের হবার পর,   শুরুতে খ্রিষ্টীয় মৌলবাদীগণ আধুনিক জীবাষ্ম-বিদ্যা, বংশগতি-বিদ্যা, টিস্যু-তত্ত্ব, ক্ল্যাডিস্টিক্স এবং অন্যান্য শাখায় আলোচিত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর পূর্ব-পুরুষদের সাথে রক্তের বন্ধনের  সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে বাদানুবাদ করেছিলেন।  ধার্মিক রক্ষণশীলরা সৃষ্টির ইব্রাহিমীয় ( Abrahamic) ধারণা থেকে নিজের মত করে যুক্তি দেন। পাশাপাশি, বিজ্ঞানের নিরীক্ষণকে সমূলে সরাসরি খারিজ করতে পারেন নি।  নিজেদের প্রভাব রক্ষার মূল উদ্দেশ্যে , বিজ্ঞানের জগতে ধর্মের একটি স্থান অর্জনের জন্য ,  তারা বিবর্তনীয় জীব-বিজ্ঞানের পাশাপাশি "সৃষ্টি-বিজ্ঞান" ( Science of  Creation) নামক একটি বাগাড়ম্বর-পূর্ণ ‘ধারনা’ দাঁড় করাতে চান ।   
অর্থাৎ, এ ব্রহ্মাণ্ড সব কিছু ‘এক অতি-প্রাকৃতিক শক্তি’ সৃষ্টি করেছেন। একমাত্র তার নিজের মহা-শক্তিতেই । মানুষকেও তিনিই সৃষ্টি করে জল  ও মাটি থেকে , অন্য কোন জীব-প্রজাতি থেকে নয়।  অর্থাৎ বিবর্তন নয়। সরাসরি ও প্রত্যক্ষ ভাবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি জীবের ‘বিবর্তন’টা করিয়েছেন নব-জাতকের মায়ের গর্ভে ।  
তখন ভূ-তাত্ত্বিক প্রমাণ গুলো প্রাচীন পৃথিবী সংক্রান্ত বিভিন্ন নতুন ব্যাখ্যা , বিভিন্ন ফসিল জিওলজিকাল সিকোয়েন্সের সাহায্যে প্রাপ্ত বিলুপ্ত প্রজাতি সমূহের বিবর্তনের প্রাথমিক ধারণা জনপ্রীয়তা লাভ করতে থাকে।  এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের ধারণা গুলোকে যুক্তরাজ্যে প্রথমে সনাতন "কায়েমী" সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি বলে ধরা হয়।  চার্চ ও রাষ্ট্র উভয়ই এগুলোকে অবদমিত করার চেষ্টা করে।   এই অবস্থাটি ধীরে ধীরে সহজ হয় , এবং ১৮৪৪ সালে রবার্ট চ্যাম্বারস’র বিতর্কিত ভেস্টিজেস অফ দ্য ন্যাচারাল হিস্টোরি অফ ক্রিয়েশন  ( Vestiges of the Natural History of Creation ) নামক গ্রন্থটি প্রজাতি সমূহের ক্রমশ রূপান্তরের ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে। প্রথমে চার্চ অফ ইংল্যান্ড ঘৃণা ও রাগের সাথে  পরিত্যাগ করে।  উল্লেখ্য যে, ডারউইনের বইতে কোন রকম ধর্মীয় ব্যাপারে কথা ছিল না।  
এরপরও (Essays and Reviews, edited by John William Parker, published in March 1860)  এসেস এন্ড রিভিউজ  (১৮৬০)  জার্নালে বিবর্তন-তত্ব নিয়ে যে ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক ও সমালোচনার সূচনা হয় ,  তা খুব ভালভাবেই ‘চার্চ অফ ইংল্যান্ডে’র মনোযোগ কাড়ে।

খৃষ্টানীটির উপর ৭টি গবেষণা ধর্মী রচনা নিয়ে জার্নালের সেই ইস্যুটি বের হয় । যাতে বাইবেলের উপর জার্মান সমালোচকদের , ইংল্যান্ডের ধর্ম-চিন্তায় গোঁড়ামি , মহাআকাশ রহস্য নিয়ে সমৃদ্ধ চিন্তা লিখিত ছিল ।  
সে রচনা গুলোয় কোন কোন উদারপন্থী লেখক ডারউইনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।  অনেক নন-কনফরমিস্টও ইনিয়ে-বিনিয়ে  ডারউইনকে সমর্থন করেন।  যেমন- রেভারেন্ড চার্লস কিংসলে এই ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন যে, ঈশ্বর বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টির সব জীবকে তৈরি করেছেন। অন্যান্য খ্রিস্টানগণ এই ধারণাটির বিরুদ্ধে যান।  এভাবে , ক্রমান্বয়য়ে রক্ষণশীল ধর্ম ও দার্শনিক মহলে বিজ্ঞানের প্রতি আপোষমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে  মহাজগতের  ‘সৃষ্টিকর্তা’র অস্তিত্ব এর পক্ষে প্রথাগত ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তির একটি আত্মরক্ষা মূলক  “আধুনিক রূপ”। যুগের সাথে টাল মেলানোর খাতিরে।

অন্যদিকে , ১৯৮৭ সালে প্রতিপালকের  ‘সৃষ্টি-তত্ত্ব’কে পাঠ্য বইয়ের অংশ হিসেবে বিজ্ঞানের সাথে পড়ানোর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি রায় দেয়া হয়েছিল। এক সময়  যুক্তরাষ্ট্রের  আদালতে “কিটজমিলার বনাম ডোভার বিতর্কে” এই ‘সৃষ্টি-বিজ্ঞান’ ( সৃষ্টি তত্ব) পূর্ণাঙ্গভাবে ধর্মীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হিসেবে রায় প্রকাশিত হয়। এও প্রকাশিত হয় যে ,  ওটার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।    

এ বছরের (২০২২) মাঝামাঝি , ভারতের মোদী সরকারের  সংস্কৃতি মন্ত্রানালয় এক ‘প্রত্ন-তাত্ত্বিক জরিপে’র উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে ভারতের জাতি সমুহের ডিএনএ  সিকোয়েন্স পরীক্ষা করবে স্থানীয় ভারতীদের  জাতিগত মৌলিকত্ব যাচাইয়ের জন্য । বঝতে চাইবে , কীভাবে ও কতটুকু স্থানীয় ভারতীয়দের রক্তে বিগত ১০ হাজার বছরে বিদেশী রক্ত মিশ্রিত হয়েছে। এ  মৌলবাদী সরকারের ‘ বিশেষ উদ্দেশ্য’ প্রণোদিত এ প্রোজেক্ট নিয়ে বিতর্ক সমালোচনা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দেশটির ১০০ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী , নৃতত্ত্ববিদ, ভু-তত্ব বিদ, ইতিহাসবিদ সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন।        

উদারপন্থি মুসলমান বিশ্বাস করেন যে , "সময়ের সাথে সাথে মানুষ ও প্রানীদের দৈহিক সমূহ বিবর্তিত হয়েছে ।  আবার কোন রক্ষণশীলরা  বিশ্বাস করেন যে,  "মানুষ চিরকালই বর্তমান রূপেই বিদ্যমান ছিল। মানুষ অন্য জীব হতে রুপান্তর হয় নি। মধ্যপন্থী   মুসলিম চিন্তাবিদগণ বিবর্তন-তত্ত্বের  উপাদান সমূহের  ইনিয়ে-বিনিয়ে পরোক্ষ স্বীকৃতিও দিয়েছেন। তবে মুসলমানদের সকল পন্থীদেরই শেষ কথা হয় , এ বিবর্তন প্রক্রিয়ার ওপর “ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক  ঈশ্বরে”র আধিপত্য রয়েছে।   

ইসলামের ইতিহাসে আরেকটা উল্লেখ করা হয় যে,  শত শত বছর আগেই মুসলমান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা , যেমন- ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, ইবনে কাসির, ইবনে আরাবি ইত্যাদি ‘ইখওয়ান’ মতবাদের অনুসারী বিজ্ঞানীরা চার্লস ডারউইনের মতোই বিবর্তনবাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।

শেষ কথাঃ

আলফ্রেড নোবেল ছিলেনএকজন বিজ্ঞানী , প্রকৌশলী, অস্ত্র ব্যবসায়ী। মৃত্যুর আগে করা উইলে তার ‘নোবেল ইন্সটিটিউট’ ফান্ড রেখে যান এই উদ্দেশ্যে যে , নোবেল কমিটি বিশ্ব মানব-সভ্যতার ক্রম-অগ্রগতি , মানব জাতির বৃহত্তর সমঝোতা ও শান্তি প্রসারে   অবদান রাখবে।  । এ ক্ষেত্রে অন্য কোন ‘বিশেষ’ ব্যাক্তি ,  বিষয় বা মতবাদকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন নি।  

সভ্যতা সৃষ্টির ঊষা লগ্ন ( ধাতু ও কৃষি বিকাশের যুগ ) হতেই ‘অজ্ঞেয় প্রাকৃতিক মহাশক্তি’র উপাসনা (ধর্ম) মানব চিন্তা জগতে দ্রুত প্রভাব বিস্তার শুরু করে। কালের যাত্রা পথে , পরবর্তী কালে যুক্তি বিদ্যা , এর পরে দর্শন-বিদ্যার প্রভাব বাড়ে । পরবর্তীতে , অর্থাৎ, ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে,  বিজ্ঞান , ভাববাদী ও উদারবাদী চিন্তাধারার  বিস্তার হয়। যা আজও বলিষ্ঠ। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি , বস্তুবাদ সহ অন্যান্য দর্শনও দ্রুত প্রসার ঘটে ছিল। সামাজিক স্তরে আজও তা আরও পুষ্ট হচ্ছে । তবে , কমিউনিস্ট ব্যবস্থার পতনের পর আবারও ধর্মের নানা স্বৈরতান্ত্রিক প্রভাব  অনুভূত  হয় , যা আজও চলামান। এ প্রেক্ষিতে স্ফান্তে পাবো’কে ভূষিত এ নোবেল পুরস্কারের এ বিষয়বস্তু  নিশ্চয়ই ‘বিবর্তন বাদ’ বস্তুবাদী চিন্তার জগতের ঢেউ তুলেছে। স্ফান্তে পাবো’র  এ আবিস্কার মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে আধ্যাত্মবাদী ধারনার মূল ভিত্তির উপর মারাত্মক ঝাকুনি দিয়েছে ।    

 নিঃসন্দেহে , সভ্যতার ঊষা লগ্নে ধর্ম ছিল প্রগতিশীল ও আধুনিক জীবন দর্শন। তবে , সময় , সভ্যতা ও মানুষের জীবনাচার বদলের তালে ধর্ম আর নিজের ভারসাম্যপূর্ণ প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারে নি।

ধর্ম সর্বপ্রথম সংগঠিত সমন্বিত পরিপূর্ণ এক জীবন দর্শন হিসাবে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে উদ্ভব হয়।  সর্বশেষ ,  অন্যতম কনিষ্ঠ মৌলিক ধর্ম – ইসলামের উদয় মাত্র / প্রায়  ১৪৫০ বছর আগে। আজতক আরও বহু ধর্ম  উপ-ধর্মের উদ্ভবও অব্যহত আছে। এবং,  সকল ধর্মই নৈতিক নীতির জীবনাচার নিয়ে এক পর্যায়ে মানুষ দ্বারা লিখিত মহা-পুথি আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অদৃশ্য বা গায়েবী শক্তি দ্বারা এসব গ্রন্থ  লিখিত  নয়। মনুষ্য রচিত । তাই, প্রশ্ন আসছে , এ সবের লিখক মানুষগুলো কারা ? এর পেছনে  তখন তাদের চিন্তা-উদ্দেশ্য- লক্ষ্য গুলি কি কি ছিল? হাজার হাজার বছর পর আজও কি তা কি তেমনই আছে বা থাকবে? কেন আজ ‘ধর্ম’ গুলো সম-সাময়িক মানব চাহিদা ও সমস্যা গুলো সমাধানের ‘নয়া বার্তা’ নিয়ে হাজির হতে পারে না ? নানা প্রশ্ন আসছে।

ফলে , মানব চিন্তায় ধর্মের খুঁটি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়েছে , হচ্ছে । বিশেষত লক্ষণীয় ভাবে , সাম্প্রতিক বছর গুলোয় করোনা মহামারী লক্ষ-লক্ষ মানুষের মৃত্যু , বিজ্ঞানীদের টীকা আবিস্কার ও গন-মৃত্যু হতে মনুষ্য জাতিকে রক্ষা করা , আক্রান্ত মানুষদের মুনি-ঋষি , পীর- ফকির উপাসনালয় বাদ দিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া-আসার প্রবনতা ,  পাশাপাশি- মহাকাশে যুগান্তকারী একাধিক সফল  অভিযান , চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানুষের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রতিস্তাপনের যুগান্তকারী ঘটনাবলী ইত্যাদি সাধারন মানুষের চিন্তা জগতে বিশাল ঝড় তুলেছে। আধ্যাত্মবাদ , অদৃষ্টবাদ , নিয়তিবাদের নিয়ে নানা সংশয় ও অনাস্থা বেড়েছে । তবে অতি দুর্বল গোষ্ঠীর মানুষ বিপরীত দিকেও হেলেছে ।   

মানুষ চিন্তা করতে সাহসী হচ্ছে , ‘অজ্ঞেয়’ বিষয়-বস্তু কি চিরকালই সাবার কাছে  অজ্ঞেয় থাকবে ? এ জগত কি ‘অতি-প্রাকৃতিক শক্তি ’ নিজের মর্জি মাফিক পরিচালনা করেন ? নাকি- এর পেছনে অন্য কোন কারন, বা প্রাকৃতিক শক্তি কাজ করছে ? আজকের মানুষকে কি কেহ সরাসরি ‘একধাপে’ই জল ও মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছে ? নাকি অন্য কিছু ?      

বিজ্ঞানীরা বলছে , মহাজগত  ত প্রায় ৫০০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয় । তারও প্রায় কয়েক শ কোটি বছর পর , মনুষ্য প্রজাতির আদি রূপে প্রথম বিকাশ । আর ধর্মের প্রথম আবির্ভাব মাত্র পাঁচ হাজার বছরের মত। ধর্ম ও ‘বিশ্ব প্রতিপালক’ আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই মানুষ প্রজাতি সমুহের উদ্ভব বা সৃষ্টি হয়েছিল। তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল ? ~৫ হাজার বছর আগে “ ইশ্বর”র আগমনের আগে ,   কে বা কীভাবে মানব প্রজাতি সৃষ্টি বা বিকাশ হল ? তখন কি কোন “প্রতিপালক” শক্তির ধারনা বিরাজ করত ?

সুইডিশ বিজ্ঞানী স্ফান্তে পাবো ‘র যুগান্তকারী অবিস্কারের  বিষয়টি বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মবাদী , কার্যকরণ বাদী ও নিয়তী বাদী , প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল  চিন্তার  লড়াই , চর্চার বিরোধে নয়া মাত্রা যোগ করবে নিশ্চয়ই ।    

গণতন্ত্র , অভিজাত-তন্ত্র , স্বৈরতন্ত্র , উদারবাদ , উন্নয়নবাদী ইত্যাদির খোলসে দেশ-কাল-অবস্তা ভেদে রাষ্ট্র ও সরকার এসব সামাজিক শিবিরগুলোকে নিজেদের পছন্দের আইন মাফিক নিয়ন্ত্রণ করে , ব্যবহার করে, পরিচালনা করে। রাষ্ট্র যে  বিশেষ  সামাজিক শ্রেনীর ( যেমন ব্যবসায়ী ... ) প্রতিনিধিত্ব করে তাদের মুনাফা লাগাতর বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। 



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন