বর্ণালী সাহার গল্পগ্রন্থ এই প্রথম পড়া। যখন ফেসবুকে নিয়মিত ছিলাম, তখন বর্ণালীর শেয়ার করা গল্প এবং গল্পের অংশবিশেষ বিচ্ছিন্নভাবে পড়া হয়েছে। সেই অর্থে, বই পড়ার আগেই তার লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিলো। বর্ণালী সাহা নিঃসন্দেহে অনুসন্ধিৎসুপ্রবণ এবং স্বতন্ত্রধারার লেখক। অগ্রজ-অনুজের লেখা ব্যাতীত সমসাময়িক শক্তিশালী লেখকের লেখা নিয়ে কিছু বলার সংস্কৃতি এদেশে তৈরি হয়নি- এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও। কিছু যদিও-বা লেখা হয়, সেটা বন্ধুকৃত্যই। বড়ো কাগজ, বড়ো প্রকাশনা এবং বড়ো-বড়ো পুরস্কার অর্থাৎ প্রথাগত ধাক্কাধাক্কিগুলোর বাইরে থাকি বলেই হয়তো সেই নিবিড় মৌনতা ভেঙে, আমার একদমই সমসাময়িক, বলা ভালো একই দশকের কথাসাহিত্যিক বর্ণালী সাহার ‘জবরখাকি’ গল্পগ্রন্থের দুটো গল্প ‘জবরখাকি’ ও ‘লিম্বো’ নিয়ে একান্ত পাঠ-অনুভব প্রকাশে আমি দ্বিধাহীন। দুটো গল্পের সৃজনশীল গদ্যই- নিঃসন্দেহে বিরল পাঠ-অভিজ্ঞতা। একটু ভেবেচিন্তে লিখতে গিয়ে, তাই, বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেলো।
জবরখাকি
নামগল্প বলে শুধু নয়, ওই নামটা দেখেই, মাথায় ঘুরছিলো ল্যুইস ক্যারলের জনপ্রিয় ছড়া ‘জ্যাবরোকি’র সত্যজিৎ রায় অনুদিত ‘জবরখাকি’র সেই কবেকার কোন ছোটোবেলার কয়েকটি লাইন- বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে/ গালুমগিরি করছে ভেউ-এর ধারে... প্রায়ই বিড়বিড় করছিলাম আর ভাবছিলাম এমন ‘ননসেন্স’ পোয়েম গল্পে প্রাসঙ্গিক হয়ে এলো কী করে? এই জিজ্ঞাসা থেকেই ‘জবরখাকি’ গল্পটা পড়া শুরু করলাম। কৈশোরে তিন বান্ধবীর বন্ধুত্ব থেকে যৌবনে মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা পর্যন্ত এই গল্পের ব্যাপ্তি। বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখক আর তার দুই বান্ধবী; রূপা আর শারমিন, এই তিনজনের জীবন অভিজ্ঞতা গল্পে সমন্বিত ও চিত্রিত করেছেন।
জীবনের ফুলঝুরি থেকে তিন বান্ধবীর পারস্পরিক সহযোগিতা, নির্ভরতা, নির্মমতা, প্রতিহিংসা, প্রবঞ্চনা স্ফুলিঙ্গের মতোই নির্গত হতে থাকে, আর সূক্ষ্ম সংকট হয়ে সংবেদনশীলভাবে আখ্যানের অংশ হয়ে যায়। এই গল্পে দেখতে পাই, মেয়েরা ক্লাসের অফ-পিরিয়ডে, স্কুলের মাঠে ব’সে বান্ধবীদের সাথে ক্রিকেটের বাংলা ধারাভাষ্য শুনছে- লুকিয়ে নিয়ে আসা রেডিওতে। পুরো স্কুলে মেয়েদের প্রেমঘটিত বৈকল্য ছড়িয়ে পড়েছে ম্যাস হিস্টিরিয়ার মতোই। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপ’ খেলতে আসা পাকিস্তানি লম্বা-ফর্শা ক্রিকেটারদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে তারা। কারো আকিব জাভেদ, কারো ওয়াকার ইউনিস আর কারো-কারো বা আমির সোহেল। সেই সময়ের তুমুল আলোচিত একটি ঘটনার উল্লেখ আছে গল্পটিতে, যে প্ল্যাকার্ডটি টিভি স্ক্রীনে আমিও দেখেছিলাম। সেই ‘ম্যারি মি, আফ্রিদি’ অবসেশানে স্কুলের মেয়েরা আক্রান্ত হয়- স্বাধীনতার রজত-জয়ন্তীর বছরেই। এই হৃদয়ঘটিত ঘটনার প্রতিক্রিয়াটি স্পষ্টভাবেই ছিলো রাজনৈতিক।
স্কুলে ‘সমকামী’ হিসেবে অভিযুক্ত, গল্পের ন্যারেটার-বান্ধবীকে প্রিন্সিপাল আপার রুম থেকে উদ্ধার করে রূপা। শৈশবের সেই সাইকো কিড, শারমিনের ‘পোলাওগন্ধী’ চুলে যার গা শিরশির করে, ফারজানার সাথে না-করেও ‘লেসবিয়ান’ গালি খাওয়া এই মেয়েটাই গল্পে এক ডাক্তার ‘ব্যাটাছেলে’র সংসার করে। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে, তেরো ঘণ্টা লেবার-পেইন সহ্য করে জন্ম দেয়া ফুটফুটে মেয়ে সারাক্ষণ তার বুকের সাথে লেপ্টে থাকে। গল্পে ঘুরে ফিরে এই চরিত্রটির অনুদ্ঘাটিত প্রবণতার আভাস পাওয়া যায় আর ‘চরিত্র’টির প্রতি এক ধরনের বেদনা জাগায়। কারণ, এই ভিন্ন যৌন অভিমুখিতা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলেও, দেখা গেলো, এই সমাজ-বাস্তবতায় সেটি প্রকাশ করা যায় না। গল্পে ‘ইনভিজিবল মাইনরিটি’র এই নারী আমাকে দ্বান্দ্বিকতার মুখোমুখি করে। সমপ্রেম; সমলিঙ্গে ভালোবাসার মতো মানুষের অন্তর্নিহিত প্রাকৃতিক এই প্রবৃত্তি– এই দেশে যা এখনো ধর্মীয়, সামাজিক এমন কি আইনগতভাবে ‘অপরাধ’ হিসেবেই চিহ্নিত— সেটি অনুদ্ঘাটিত থাকাই কি কাম্য? আবার, শরীরী অনুভূতির এই অনুরণনে অভিপ্রায়ী হতে না-পারাটা কি মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করে না?
গল্প এগিয়ে যায়। ইংলিশ গ্রামারের ম্যাডাম, শত্রুপক্ষ-সহপাঠীদের বিচারনালিশ, কখনো বা সোনু নিগাম, ক্লাস টেনের নতুন ফিজিক্স স্যার, আফ্রিদীর সাথে হোটেলে শারমিনের সবান্ধব (শুধু ন্যারেটার ছাড়া) জন্মদিন উদযাপনসহ অ্যাডভেঞ্চার-মিসঅ্যাডভেঞ্চার পেরিয়ে তিন বান্ধবী বড়ো হয়ে যায়। রূপার সুপারিশেই স্বামী-সেপারেটেড শারমিনের চাকরি হয়। তারপর অফিসের বসের সাথে প্রেম। অতঃপর রূপার বরের সাথে পরকীয়া করতে গিয়ে নৌকায় ধর্ষিত হয়ে আসা আর এর কিছুদিন পর গর্ভপাত- পেট থেকে স্টিলবর্ন বেবিটার খালাস হয়ে যাওয়া। শারমিন বিষয়গুলো ‘স্বাভাবিক’ভাবেই নেয়। যদিও বান্ধবীর নবজাত বাচ্চা দেখতে গিয়ে, এই ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোর ‘স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকতার’ প্রশ্নে শারমিন ঠিকই ন্যারেটার-চরিত্রকে অন্তঃপীড়নে জর্জরিত করে। এখানে বর্ণালী সাহার দৃশ্যকল্পের একটুকরো তুলে দিলাম—
‘শারমিন প্রত্যেকটা বাক্য শেষ করছিল এমনভাবে, যেন ওর মাথার উপরই একটা ফলের গাছ বাতাসে দুলছে আর গাছের ডালে ধরে থাকা পাকা-পাকা ফলগুলি একটুর জন্য ওর নাগালের বাইরে আর ও আশা করছে বাতাসের তোড়ে একটা ফল ডাল থেকে ছিন্ন হয়ে ওর হাতে আসবে—তাই ও ক্ষণে-ক্ষণে করুণ দৃষ্টিতে ফলটার দিকে, মানে আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আমি তো ধরা দেবো না, আহারে, আমায় পাবে না, পাবে না, আহারে!’ গল্পে শারমিন চরিত্রটি পার্শ্বচরিত্র হিসেবে সার্থক, তুলনায় রূপা চরিত্রটি স্ফূটণ্মোমুখ।
মিউট করে রাখা গ্রুপ চ্যাট, কর্পোরেট সংস্কৃতি, সেলস-প্রমোশন-করাপশান, দাম্পত্য-প্রেম, পরকীয়া-ধর্ষণ-গর্ভপাত গল্পকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বর্ণালী সাহার ঠাস বুনটের গদ্যভাষায় লেখা গল্পের স্তরে স্তরে পাঠককে মনোযোগী হতেই হয়। যখন বর্ণালী লেখেন- ‘শীতকালে মালীরা ছুটিতে গেলে পরে স্কুলের মাঠের শুকনা পাতাগুলি ঝাড়ুবাহিনী ডাইনির দ্রুত নিঃশ্বাসে একধার থেকে আরেক ধারে গড়িয়ে যেত—চোখের পলকে—অতটুকু আমি দেখেছিলাম। জীবনে ওই রকম ফাস্ট টেম্পো থাকা চাই; কোনো ভাবনা, দেয়ালে-ক্লাসঘরে-স্টাফরুমের আলমারিতে ঝুলে থাকা কোনো তীব্র গম্ভীর সংলাপের কোনো কণা, সেই পলকে-পলকে যাপিত জীবনে বেশি সময় পেতে পারবে না, এমনই নিয়ম। লাইফ হলো ননী; সেটা ঘুঁটতে ঘুঁটতে অল্প টাইম থেকে আরো অল্প টাইম বের করে দিচ্ছিল কেউ আমাদেরকে, তার উপর আমাদের শত্রুপক্ষ তো সারাক্ষণ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল যে আমাদের টাইম আসলে আমাদের নিজেদের নয়, আমাদের টাইম আসলে ওদের কাছ থেকেই ধারকর্জ করে নেওয়া।...’ কমলকুমার মজুমদার বলেছিলেন বটে-- ‘লিখতে লিখতে ঘটে।’ ‘জবরখাকি’ গল্পে এমন দীর্ঘ-দীর্ঘ বাক্য, বাক্যে-বাক্যে শব্দের অমোঘ ব্যবহার, শব্দে-শব্দে আনকোরা লাগসই দৃশ্যকল্প মিলে ভিন্ন আঙ্গিকের অভিনব রচনাশৈলী ‘ঘটে’ গেছে—যা বর্ণালী সাহার যোগ্যতা ও প্রতিভাকে চিহ্নিত করেছে।
‘জবরখাকি’ গল্প শেষে অজান্তেই হাতের উল্টো পিঠে গাল মুছতে গিয়ে টের পাই ‘হরমোনতাড়িত- ব্যাকবেঞ্চার-নিম্ফো’ এই শারমিনের জন্যই আমার চোখ তরল হয়ে গেছে। বাচ্চা কোলে নিয়ে কান্না থামাতে গিয়ে শারমিন মুখস্থ ‘জবরখাকি’ ছড়াটা বলতে থাকে, কবিতার এক পর্যায়ে—‘তোর হাতেতেই জবরখাকি গেল?/ শুধায় ‘মায়ে’ চামুক হাসি হেসে/ আয় বাছাধন, আয় রে আমার ‘কোলে’’... তখন অনুক্তভাবে অজাত অপত্য স্নেহের অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটে যায় পাঠকের সাথে আর একটা ‘ননসেন্স’ পোয়েম কী প্রবলভাবে ‘সেন্সুয়াস’ হয়ে যায়! দুটো শব্দ- ‘বাপে’র বদলে ‘মায়ে’ আর ‘কেলো’র বদলে ‘কোলে’- গল্পটাকে অনন্য মাত্রা দেয়। কোনো রকম কাব্যপনা কিংবা ভাবালুতা ছাড়াই নির্মোহ নির্লিপ্ততায় সাবলিমিনাল ইফেক্ট তৈরি করতে পেরেছেন বর্ণালী। এখানেই গল্পটি সার্থক ও শিল্পোত্তীর্ণ। পড়তে পড়তে আমার চোখ ভিজে গেছে... লিখতে লিখতে হয়তো বর্ণালীরও। কথিত নারীবাদীদের ভ্রু কুঁচকে উঠবে নিশ্চিত। কিন্তু লেখক সবসময়ই যে কোনো ‘বাদ’-এর এজেন্ডার ঊর্ধ্বে মৌলিক মানব প্রবৃত্তিকেই লিখবে। শূন্যতার এই শাশ্বত অনুভবের সামনে আমি শারমিনের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি নিঃস্ব-বিবশ। সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড- সেখানে জবরখাকি ভাসছে।
লিম্বো
‘লিম্বো’ গল্পের চিন্তা-বৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়ে যাওয়া বিভ্রান্ত যুবক আবরার সংক্রান্ত বেদনাহত মা-বাবার লজ্জা আর উৎকণ্ঠা। গল্পের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে বিয়ের অ্যানিভার্সারি উপলক্ষ্যে এক আমেরিকান-বাঙালি দম্পতির মালদ্বীপের রিজর্টে সপুত্রক বেড়াতে আসার ঘটনা দিয়ে। গল্পের শুরু আর শেষের দুটো বিন্দু হলো- সেই রিজর্ট থেকে আসমা-মনসুর দম্পতির ছেলে আবরারের পালিয়ে যাওয়া এবং শেষতক লোকাল জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আবরারের সহিংস নাশকতায় লিপ্ত হওয়া। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ গল্পের এই দুটো বিন্দুকে যুক্ত করেছে। গল্প এগিয়ে গেছে চরিত্রগুলোর বর্তমান ও বিগত জীবনের একেকটি স্তরের উপলব্ধিজনিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।
আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য করা কবি ও বুদ্ধিজীবী, পাওয়ার-বলয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা মনসুর ইলিচ দাদু’র জীবনী পড়ে কিশোরবেলায় তাকে চিঠি লিখেছিল— ‘আমিও যুদ্ধ করতে চাই।... রেড আর্মিতে জয়েন করতে চাই।’ অথচ এটাই সত্য যে, মনসুরের বিপ্লব হার মেনেছে। মনসুর তার ছেলেকে বোঝাতে পারেনি ‘বিল্পব মৃত্যু ছাড়া আর কিছু আনে না।’ ছেলে আবরার নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ‘আরো ছোটো, ক্ষীণকায় আর কুঁজো’ হয়ে যাওয়া মনসুর ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা ভাবে- ‘ছেলের একার কী দোষ? জরুরি নক্ষত্ররাজি এক সরলরেখায় এসে থামে নাই দেখে মনসুরদের বিপ্লব হয় নাই আর শুধু সেইজন্য মনসুরের মতো উদ্যোমী মানুষেরা দারা-পুত্র-পরিবারসমত এমন একটা রাজ্যের পত্তন করেছে, যেইখানে মানুষের জীবনের চরম মানগুলি ছাড়া আর কোনো বস্তু, বোধ কিম্বা স্মৃতির জায়গা নাই। মনসুর নিজের হাতের পাতার দিকে তাকায়। মাথার ভিতর ও যেই রিপাবলিকের বাসিন্দা, সেই রিপাবলিকের পতাকা হাতের রেখার ভিতর বসে গেছে। ঘেন্নায় ওর উলটি আসে।’ একদা বিপ্লবী, অধুনা কাপুরুষ, পুঁজিবাদী দেশের সুবিধাভোগী নাগরিক মনসুরের গ্লানিবোধ পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়।
আবরারের মা আসমার ফুসফুস ‘নিঃশেষ করে কাঁদে’ আদরের মনচিনির জন্য। ‘এমন লাগে আসমার কান্না, যেন বিশ বছর ধরে সন্তানসম্ভবা হয়ে বাঁচার পর আজ তার গর্ভপাত হয়ে গেছে।’ টেররিস্টের মায়ের মনজাগতিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে এভাবে- ‘সর্বনাশের সুতা ঝুলছে আসমার নাকের সামনে আর ক্রমাগত প্রভোক করছে সুতা বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে তারপর মাকড়সার দৃষ্টি দিয়ে ছেলেকে আঁতিপাতি খুঁজতে।’ ভাবপ্রবণতা ছাড়াই মাতৃহৃদয়ের বিপর্যস্ততা আর নিরুপায়তার দৃশ্যকল্পের এমন নৈপুন্যে বিস্মিত হই। সর্বনাশের সুতা এতোটাই সূক্ষ্ম— আসমার খালি চোখে সেটা ধরা পড়েনি। কটেজের চারদিকের নৈঃশব্দ্যে পরাজিত মা-বাবার মনোগত জগত চিত্রিত হতে থাকে। এই শব্দহীনতা তাদের মনে করিয়ে দেয়- ‘সবাই জেনে গেছে, সবাই জেনে গেছে।’
রিজর্টে বেড়াতে আসা রকমারি মানুষ, রিজর্টকর্মী গিয়াস, আলমুতাল্লাব, শেফ গোপাল, ক্যাপ্টেন মামুন, আজমদের মানবেতর জীবনযাপন, মেরিন পুলিশদের টহল, বালুতটে মরা পটকা মাছের স্তূপ, ধর্ষণের পর শারীরিকভাবে নির্যাতিত রাশিয়ান পর্যটক নারী, সুনামির জলোচ্ছ্বাস, লেসবিয়ানিজম, মানবাত্মার বিশ্বাস-বেদনা, অসন্তোষ-অসহিষ্ণুতা দ্বীপের মরা মাছের গন্ধের মতো গল্পের অবয়বে লেগে থাকে। পড়তে পড়তে মনে হয় মানুষের জীবন হয়তো এক ‘লিম্বো’ই; ঘোরে-বেঘোরে স্বর্গ-নরক প্রান্তবর্তী এক অবরোধস্থান।
‘লিম্বো’ গল্পে বর্ণালী সাহার গদ্যভাষা প্রচলিত সাহিত্য-ভাষার বাইরে হলেও জট-পাকানো কিংবা গোলমেলে মনে হয় না। গল্প থেকে একটু তুলে দিচ্ছি— ‘এই যে আসমা চেক আউট করে যাচ্ছে, রিসেপশনের বর্গাকার চোয়ালের লোকটাকে যে বলছে বিল রেডি করে রাখতে, এই যে আবরারের কটেজ নম্বর নিয়ে জেনেশুনেও কেউ কোনো কথা বলবে না, এই যে আসমাকে দেখমাত্র রিসেপশনের অর্ধবৃত্তাকার টেবিলের খাঁজ মতো জায়গাটায় কারণে-অকারণে রিজর্ট-স্টাফরা হঠাৎই উবু হয়ে আসা-যাওয়া শুরু করেছে- এইসব পাবলিক পরিনতির সামনে আসমার নিজেকে মনে হচ্ছিল স্টেজ-পার্ফরমার।’ বাক্যটি দীর্ঘ হলেও এর প্রবাহ পরস্পরবিরোধী নয়। তাই পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে যায় না। বরং বলা যায় যে, নিজস্ব ভাষার এই দ্যুতি গল্পকে শিল্পের অমোঘতা দিয়েছে।
আরবী-ফার্সী-উর্দু শব্দের আধিক্য ‘লিম্বো’ গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও সমন্বয়পূর্ণ। রিজর্টের হাউজকীপার গিয়াস যখন বলে ‘... সেই ছেলে নাকি খেলাফত আনবে, মানে এইকূল-ওইকূল সকল কূলের মুখে কালি দিয়ে, মায়ের-বাপের-কওমের সব্বার বদদোয়া নিয়ে জান্নাতে দাখিল হওয়ার জন্য দস্তখত করবে।’ শব্দগুলোর মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না। মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে যাপিত জীবনে এমন শব্দ পরিচিত এবং বহুল উচ্চারিত।
স্বীকার করছি, বাংলা সাহিত্যের দুই মজুমদার— কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ এবং সেলিম মোরশেদীয় ধ্রুপদী সাহিত্যের পাঠ-অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমার সহায়ক হয়েছে। ‘লিম্বো’ গল্পের দীর্ঘ বাক্য, শব্দের অমোঘ প্রয়োগ আর গতানুগতিকের বাইরে অপ্রত্যাশিত দৃশ্যকল্পের ব্যবহারে গদ্যভাষাটি প্রাতিস্বিক হয়ে উঠেছে। গল্পে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর সন্নিবেশ আপাত উদ্দেশ্যহীন মনে হলেও আদপে সেটা একের পর এক ‘ইনসারশান রিঅ্যাকশান’ এর মতোই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে সন্নিবিষ্ট বস্তুর গঠন ক্রমশ বদলে দিয়েছে। গল্পের কথিত কাঠামোও তদ্রূপ বদলে গেছে। নিবিষ্টভাবে নির্মিত ‘আপাত-অগোছালো’ কাঠামো ও বিন্যাসের ঘনত্ব—এই দুই উপস্থাপন কৌশল ‘লিম্বো’ গল্পের রচনাশৈলীকে উদাহরণযোগ্য করেছে।
রচনাশৈলীর স্বকীয়তা মাথায় রেখেই বলছি- বর্ণালী সাহা বাংলাসাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী সাহিত্যগুলো ভালো করে পড়েছেন এবং আত্মস্থ করেছেন। ফরাসী লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যালা রব-গ্রিয়েসহ সমসাময়িক কবি ও লেখকদের সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের মতোই বর্ণালী সাহা গল্পের কাহিনী বিস্তৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে, কল্পনা আর বাস্তবতার প্রতিবিম্বে বিষয়বস্তুকে সর্বব্যাপী করে তুলেছেন। গল্পে ‘আদি-মধ্য-অন্ত’র কাঠামো এড়িয়ে এবং প্রকাশভঙ্গীতে অবজেক্টিভিটি ও সাবজেক্টিভিটির সমন্বয় রক্ষা করে, পরিপক্কতার সাথে আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর সঙ্গতি রক্ষা করেছেন।
পশ্চিম বাংলায় বিশ শতকের ৬ দশক আর বাংলাদেশের ৮ দশক ছিলো সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাহিত্যের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার কাল। বাংলাদেশে আশির কথাসাহিত্যে কয়েকজন লেখক, তাদের সাহিত্যকর্মে নিরীক্ষণপ্রয়াসী ছিলেন এবং বাক্যে যতিচিহ্ন, নামপদ, ক্রিয়াপদ, বিশেষ্য ও সর্বনাম ভিন্নভাবে প্রয়োগ করে কথাসাহিত্যে নবতর মাত্রা দিয়েছিলেন। পরবর্তী দুই দশক সেই ঝুঁকি তেমনভাবে নেয়নি ফলে বর্ণনাপ্রবণ রীতির মধ্যেই গল্প ঘুরপাক খেয়েছে। একুশ শতকের প্রথম দশকের অল্প কয়েকজন লেখকের লেখায় গৎবাঁধা কাঠামো কিংবা সর্বজনবোধ্য ভাষার বাইরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বর্ণালী সাহা তাদের মধ্যে অন্যতম।
আজকের গল্প বলতে আমি যা বুঝি- ‘লিম্বো’ সেটাই। আমার এই পাঠ-অনুভব তেমন কিছু না। তবু মনে হলো, একটু হলেও, বর্ণালী’র লেখকসত্তা যদি উদ্দীপ্ত হয়, এতে বাংলা সাহিত্যেরই উপকার। একজন লেখকের- মানে আমাদের বর্ণালী সাহার— লেখার পাঠ-অনুভব প্রকাশ করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি?
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন