জলধি / প্রবন্ধ / শেখ মুজিবর রহমান : এক অপরাজেয় রাষ্ট্রনৈতিক ব্যক্তিত্ব
Share:
শেখ মুজিবর রহমান : এক অপরাজেয় রাষ্ট্রনৈতিক ব্যক্তিত্ব

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত তাঁর আত্মজীবনী আট দশক বইটিতে শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন,  "( এই ) বাংলাভাষী দলের নেতা ছিল একটি কৃশকায় ছেলে - নাম  শেখ মুজিবর রহমান l তার নীতি শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতই ছিল l বঙ্গবন্ধু মুজিবর বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে সফল হয়েছিলেন l" এই ভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধির যথার্থ অধিকারী তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেনl তিনি বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের মতোই বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতিসংঘে ( ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজেশন ) বাংলায় ভাষণ দিয়ে l বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা।                                    

1971 সালের 25 মার্চ রাতে (26 মার্চ ) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেনl সেই রাতেই এদেশের মাটিতে শুরু হয় ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি  হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের এক সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম l  পাকিস্তানি সৈন্যরা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে আর সেই সঙ্গে ধ্বংস করে ঘর বাড়ি গ্রাম শহর নগর এবং জনপদ l  দিনের পর দিন তারা অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে এদেশের উপর তাদের শাসন ও শোষণ কায়েম রাখার চেষ্টা চালিয়েছিল l কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয় নি l বাংলার মানুষ সেদিন হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র আর শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধ l অবশেষে 1971সালের 16 ডিসেম্বর সশস্ত্র সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে 'বাংলাদেশ ' এর অভ্যুদয় ঘটে l বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দেন।                                        

বঙ্গবন্ধু শুধু একজন অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সার্থক রাষ্ট্রনায়ক,  যিনি এই উপমহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে তাঁর সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত নেতৃবৃন্দের সাথে এক আসনে জায়গা করে নিয়েছিলেন l সেই সময় বিশ্বব্যাপী আলোচিত রাষ্ট্রনায়কগণ যেমন প্রেসিডেন্ট টিটো (যুগোস্লাভিয়া ),  প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ ( ইন্দোনেশিয়া ),  প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো ( কিউবা ),  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ( ভারত ) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কদের সাথে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নামও সারা বিশ্বে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতো ।

মাও -জে -দং এর চিন্তাধারায় From Masses to the Masses - এর সাথে মুজিবের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল l  From Masses to the Masses - এর অর্থ ছিল জনগণের নিকট থেকে জনগণের নিকট l অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের সাথে ব্যাপক আলোচনা ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন এবং কর্মসূচি সঠিক হয়েছে কি না তা জনগণের নিকট উপস্থিত করবেন l জনগণ এই কর্মসূচিকে সমর্থন জানালে তা হবে জনগণের কর্মসূচি l এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত হয় নির্ভুল l এই প্রক্রিয়াতেই বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি দিয়েছিলেন বলেই ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালি জাতির  মুক্তি সনদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল এবং এই ছয় দফাই ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিলl বঙ্গবন্ধুর সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্তের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় l 1952  সালের ভাষা আন্দোলন,  যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে নির্বাচন,  1965 সালের পাক - ভারত যুদ্ধের পর 1966 সালে ছয় দফা কর্মসূচি,  1970 সালে L. F. O. র অধীনে নির্বাচন, 7 মার্চের ভাষণ এবং 26 মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা  --- বঙ্গবন্ধুর  এই সঠিক সিদ্ধান্তের ফলেই নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ।                                     

বঙ্গবন্ধু কোনো সময় জনগণের উপরে তাঁর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন না l জনগণের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করে রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে মত বিনিময় করে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন l যে নেতা সুদীর্ঘ তেইশ বছর পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন,  বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন আত্মপরিচয়,  সেই জাতির জনককে 1975 সালের 15 আগস্ট নৃশংসভাবে সপরিবারে খুন করা হয়। 

অভ্যন্তরীণ নীতি                          

পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে 10 জানুয়ারি, 1972,   স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই শেখ মুজিবর রহমান অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, তার ভঙ্গুর অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে এমন একটি রাষ্ট্র এবং সরকার এর ভিত্তি স্থাপন করতে যেখানে ও যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্র তথা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে l স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ভারতে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান এবং দৃঢ়চেতা জাতীয়তাবাদী ভূমিকা,  তা সারা পৃথিবীতে বিরল lজাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহতকরণের সঙ্গে রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক কাঠামোগুলিকে নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু l মাত্র এক বছরের মধ্যে সুলিখিত সংবিধান প্রণয়ন, রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারণ,  জাতীয় প্রতীক প্রণয়ন,  রাষ্ট্রপরিচালনার কর্মপদ্ধতি ও কার্যবন্টন তৈরি করা থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠা,  দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন,  পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের সদস্যপদ অর্জন, প্রাচ্য ও পাশ্চত্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন সহ অসংখ্য মৌলিক কাজ তিনি করে গেছেন তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক এবং কূটনৈতিক প্রজ্ঞার দ্বারা,  তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্বের গুণাবলী দিয়ে।

সরকার গঠনে বঙ্গবন্ধুর দক্ষতার দু একটি উদাহরণ দেওয়া যায় l একটি আধুনিক সরকার এর যে ধরণের পেশাগত দক্ষতার দরকার সেটি নিশ্চিত করেছিলেন তিনি l শুধু প্রশাসনিক ক্যাডার বা আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর না করে তিনি দেশের প্রখ্যাত পেশাজীবী এবং চিন্তাবিদদের সরকারে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদের মেধাকে দেশের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন l প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের পরে ইতিপূর্বে তাঁর পরিচিত যে সব কর্মকর্তা এবং পেশাজীবি যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন তাঁদেরকেও সরকারে নিয়ে এসেছেন l যেমন --- শিক্ষায় ড. এ. আর. মল্লিক এবং ড. আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন,  প্রকৌশলীদের মধ্যে মঈনুল ইসলাম, শফিকুর রহমান, আল হুসেইনী প্রমুখ l কুখ্যাত ইয়াহিয়া সরকার বাঙালি এবং স্পষ্টবাদী বলে যে সমস্ত  দেশপ্রেমী সরকারি কর্মকর্তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল তাঁদেরকে পুনর্নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধু সরকারি কাজকর্মে গতিশীলতা আনেন l এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন আবুল এহসান,  মতিউল ইসলাম শামসুর রহমান খান প্রমুখ।

নবগঠিত পরিকল্পনা কমিশনে একই রকম ভাবে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ,  প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু l মুক্ত বাংলাদেশে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় প্রফেসর নুরুল ইসলামকে l প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চেয়ারম্যান l প্রফেসর ইসলাম মন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পান l কমিশনের অন্যান্য সদস্য ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদগণ --- ড. মোশররফ হোসেন,  প্রফেসর রেহমান সোবহান,  ড. আনিসুর রহমান --- এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন l এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে প্রথম পরিকল্পনা সেল গঠন করেন l প্রথমে পরিকল্পনা সেল নামে গঠিত হলেও প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে বোর্ডে রূপান্তরিত করা হয় l তারপর আবার একে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশনে উন্নীত করা হয়েছিল l এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মুজফফর আহমেদ চৌধুরী।                                

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় 17 এবং 18 ফেব্রুয়ারী 1972 এ l সরকারের দায়িত্বে থাকায় স্পষ্টতই তখন আওয়ামী লীগ সরকারি দল l ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় ঐ সভায় রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি যেমন (1)বাঙালি জাতীয়তাবাদ (2)গণতন্ত্র (3)ধর্মনিরপেক্ষতা ও (4) সমাজতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে l শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও ঐ সভায় আওয়ামী লীগ কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।                                  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এর প্রধান হয়ে জাতীয়করণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন l তিনি তাঁর এই সংকল্প এর কথা 1972 সালের 26 মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন l শুধু জাতীয়করণ নীতি ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন করতে প্রয়াসী হয়েই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হন নি l এসব কাজের মধ্যে গ্রামীণ ও নগরজীবনে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতেও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন l তাঁর এই প্রচেষ্টায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পাঁচ শত ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেন l বঙ্গবন্ধু মনে করতেন যে ডাক্তার - ইঞ্জিনিয়াররা কৃষক - শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যা অর্জন করেন l কাজেই তাঁদের সেই সব কৃষক - শ্রমিক দের ঋণ শোধ করতে হবে ।

ক্ষুদ্রায়তন ও কুটিরশিল্পকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করতেন বঙ্গবন্ধু l  তিনি বলতেন, "গ্রামে গ্রামে সব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় l "

তিনি মনে করতেন যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন l

বৈদেশিক নীতি

বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি ভূখণ্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই সে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায় না। তার র্সার্বভৌমত্বকে কার্যকরী করার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রকাশ্য স্বীকৃতি অবশ্য প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই শর্তপালন আবশ্যক ছিল এবং সে সম্পর্কে মজিবর রহমান পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিলেন। 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানায় । ভারত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে সাহায্য করলেও স্বীকৃতি দেয়  ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। পরের দিন ভুটান স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দুটি  দেশই  স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে পৌঁছে বাংলাদেশ ও নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের প্রতি আবেদন রাখেন।বঙ্গবন্ধুর  শাসনকালে মোট ১২৮ টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সৌদি আরব ,চীন ও সুদান স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে।এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের উপর আমরা আলোকপাত করতে পারি ।

বাংলাদেশ- চীন সম্পর্ক

মুক্তিযুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করে। ১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ঐদিন চীন বাংলাদেশকে  'রুশ- ভারতের সৃষ্টি' বলে মন্তব্য করে। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি থেকে অবশ্য বাংলাদেশ ও চীন সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করে। যদিও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর, ১৯৭৫ সালের ৩১আগস্ট ।

বাংলাদেশ - জাপান সম্পর্ক 

বাংলাদেশ- জাপান সম্পর্ক গড়ে  উঠেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি  জাপান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য জাপান থেকে প্রচুর ত্রাণ সাহায্য আসে। ১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রীয় সফরে যান। তার প্রচেষ্টায় জাপান ওভারসিজ  কোঅপারেশন ভলান্টিয়ার্স  চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  এর মাধ্যমে জাপান সহজ শর্তে ২৪ কোটি টাকা ঋণ দেয় - যেটি নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্য ছিল বিরাট পাওয়া।

অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে জাপান - বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি শেষ সাফল্য আসে ১৯৭৫ সালে যখন তাঁর আমন্ত্রণে জাপানের তৎকালীন যুবরাজ আকিহিতো সপরিবারে বাংলাদেশ সফরে আসেন। এই সফর বাংলাদেশ - জাপান সম্পর্কের গভীরতা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।

বাংলাদেশ - পাকিস্তান সম্পর্ক

বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশ - পাকিস্তান সম্পর্কের সূচনা হলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। মুজিবরের আমলে দু দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বাধা ছিল - (১) বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদান ; (২) পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ; (৩) পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী মুক্তি ;(৪) বাংলাদেশে আটকে পড়া অবাঙালিদের প্রত্যাবাসন ; (৫) বৈদেশিক ঋনের দায় ও সম্পদ বন্টন।

বাংলাদেশ - ভারত মৈত্রী চুক্তি , ১৯৭২

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ সরকার প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করে ভারতের সঙ্গে। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।  ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিটি   স্বাক্ষরের দিন থেকেই কার্যকরী হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্বের যাত্রা শুরু। এর সঙ্গে আদর্শগত মিল যুক্ত হওয়ায় আরো গভীর আস্থা , বিশ্বাস ও নির্ভরতার সৃষ্টি হয়। তাই চুক্তির ক্ষেত্রেও শান্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উভয় দেশের সীমান্তকে  চিরন্তন শান্তি ও বন্ধুত্বের সীমান্তে পরিণত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। ১৯৯৭  সালে এই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। বাংলাদেশ বা ভারত চুক্তি নবীকরণে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি।

বাংলাদেশ - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি প্রদান করে।  ১৯৭২ সালের এপ্রিলের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় দাতা দেশ এবং ভারত প্রথম। জুন ১৯৭৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দাতা দেশে উন্নীত হয়। শুধু অৰ্থনৈতিক সহযোগিতা নয় , পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়েও জাতিসংঘ (UNO ) এবং অন্যান্য সংস্থায় সদস্য হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে।  বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে মার্কিন সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প গৃহীত হয়।

বাংলাদেশ - যুক্তরাজ্য  সম্পর্ক

মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে যুক্তরাজ্য পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারী যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে।  যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ।

বাংলাদেশ - সোভিয়েত সম্পর্ক

মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কারণে স্বাধীনতার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বঙ্গবন্ধু সরকার অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম ভাষণে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার কথা ঘোষণা করলে সোভিয়েত নেতারা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সোভিয়েত  ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী। ১-৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান এবং দুটি সাহায্যচুক্তি ও একটি বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২০,৬৮৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও সাহায্য দেয়।  এই সময় আদর্শের কারণে বাংলাদেশ-সোভিয়েত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল।

কমনওয়েলথ ও বঙ্গবন্ধু

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বে বাংলাদেশও ভারত উপমহাদেশের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য পদ লাভ করে।অবশ্য বাংলাদেশকে সদস্যপদ প্রদানের প্রতিবাদে পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগ করে।   

এখানে উল্লেখ করা যায় যে ব্রিটেন সহ কমনওয়েলথের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল। কমনওয়েলথ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন যে এই রাষ্ট্রসংস্থার সংঘে উন্নত ও উন্নয়নকামী দেশসমূহের প্রতিনিধিত্ব আছে। তিনি বলেন যে উন্নয়নকামী দেশগুলি তাদের নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান ও পারমাণবিক পরীক্ষার দ্বারা আবহাওয়া দূষিত করার বিরুদ্ধে কমনওয়েলথের জনমত গড়ে তোলা উচিত।

বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্ব

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পরে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানপন্থী নীতি গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে।  বঙ্গবন্ধুর  শাসন আমলে বাংলাদেশের প্রতি ভূমিকার দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা

(১) প্রতিক্রিয়াশীল - সৌদি আরব , লিবিয়া, তুরস্ক , জর্ডান , সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরান।

(২) মধ্যপন্থি  - ইন্দোনেশিয়া , মালয়েশিয়া , সিরিয়া , মিশর , দক্ষিণ ইয়েমেন , আফগানিস্তান।

শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অব্যাহত রেখে ৩৫ টি মুসলিম দেশের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির  বড়ো সাফল্য। 

শেষের কথা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আরোপিত ভাষা ও সংস্কৃতিগত  আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।  স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে সেই সমাজতন্ত্রকে আমরা মার্কসীয় সমাজতন্ত্র না বলে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের রূপায়ণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কারণ বঙ্গবন্ধু শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে না পৌঁছে বিবর্তনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন যদিও তাঁর নির্ধারিত পদক্ষেপে সোভিয়েত রাশিয়ার অনুসৃত কিছু কিছু নীতির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।

 

তথ্যসূত্র :

১।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান , শিশু গ্রন্থমেলা - ৫ , ঢাকা , প্রকাশক - ফাল্গুনী হামিদ , ২০১২

২।  এইচ.টি.ইমাম - বাংলাদেশ সরকার - ১৯৭১ - ৭৫ , ঢাকা , হাক্কানী পাবলিশার্স , ২০১৩

৩। গোলাম আকবর চৌধুরী - বাংলাদেশের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা , ঢাকা ,মুক্তধারা , ১৯৯৭

৪। নুহ - উল  -আলম  লেনিন (সম্পাদিত ) - ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু , ২০১১

৫। মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত) বঙ্গবন্ধু কোষ , ঢাকা , বাংলাদেশ শিশু একাডেমি , ২০   

            



অলংকরণঃ তাইফ আদনান