এক শনিবারে কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশকের কাছে গিয়েছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক বিমল মিত্র। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে কাজ শেষ হলে ট্যাক্সি ধরে চেতলার বাড়িতে ফিরবেন তিনি, তো সেই প্রকাশক তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তিনিই গাড়িতে করে পৌঁছে দেবেন বিমল মিত্রকে। শুধু যাওয়ার আগে পাঁচ মিনিটের জন্য পাইকপাড়ায় যাবেন। রাজি হলেন বিমল মিত্র। হঠাৎ দেখা গেল টালাপার্কের দিকে গাড়ি ঢুকছে। পাইকপাড়ার পাশেই টালাপার্ক। বিমল মিত্র সেই প্রকাশককে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কার কাছে যাচ্ছেন?’
প্রকাশক বিমলবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘দাদা, আজ তারাশঙ্করের জন্মদিন। একটু মিষ্টি দিয়ে প্রণাম করে আসি।’
গাড়ি থেকে নামলেন না বিমল মিত্র। তারাশঙ্করের সঙ্গে বিমল মিত্রের সম্পর্কটা ভালো ছিল না। তিনি দেখতে পেলেন ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। গেট হয়েছে। দেখে পিত্তি জ্বলে গেল বিমল মিত্রের! এই বয়েসে বাড়ি সাজিয়ে জন্মদিন করছে? প্রকাশকের মুখে খবর পেয়ে হৈ হৈ করে খালি গায়ে ধুতি পরে ছুটে এলেন তারাশঙ্কর। বারংবার গাড়ি থেকে নামতে বললেন বিমল মিত্রকে।
বিমল মিত্র বললেন- ‘না ভায়া, সময় নেই। বাড়ি গিয়ে লিখতে বসব।’ তারাশঙ্কর বক্রহাসি হেসে বললেন- আরে মশাই আপনি তো লিখবেন সেই পুরাণদিনের কথা। জানেন তো চলে যাওয়া দিন নিয়ে লিখতে বেশি ভাবতে হয় না। আজকের মানুষজন নিয়ে লিখলে ভাবতে হত। সেসব পুরাতন বিষয় তো আর চলে যাচ্ছে না।
তারাশঙ্করের কথায় ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন বিমল মিত্র। ঠিক করলেন উচিত জবাব দেবেন। বাড়িতে ফিরেই লিখতে বসলেন সমকালীন মানুষের জীবন নিয়ে। লেখা হলো- “কড়ি দিয়ে কিনলাম” উপন্যাস। “কড়ি দিয়ে কিনলাম” উৎকৃষ্ট উপন্যাস সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে জনপ্রিয়ও বটে কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস পাঠকের ভালোলাগা, মন্দলাগা হিসেবে ও জনপ্রিয়তার বিচারে পুরোনো দিনের কাসুন্দি ঘেটে লেখা “সাহেব বিবি গোলাম” আজও উৎকৃষ্টতার বিচারে শ্রেষ্ঠ। “সাহেব বিবি গোলাম” সেকালে এতোটাই জনপ্রিয় ও পাঠকের মনে ধরেছিল যে, বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে যেখানে উপহার সামগ্রি রাখা থাকে সেখানে নোটিশ টানিয়ে রাখা হতো “আর “সাহেব বিবি গোলাম” লওয়া হইবে না”। এ প্রসঙ্গে আমার নরওয়েজিয়ান নাট্যকার ইবসনের লেখা “ডলস হাউজ” নাটকটির কথা মনে পড়ে গেল। সেকালে “ডলস হাউজ” নাটকটিও এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আমন্ত্রণপত্রে লিখে দিতে হতো- “উক্ত অনুষ্ঠানে নোরা নিয়ে আলোচনা নিষেধ”। উক্ত নাটকে নোরা একটি প্রগতিকামী চরিত্র। কোন অনুষ্ঠানে দু’চারজন লোক একত্রিত হলেই নোরার কথা উঠত। বাগবিতণ্ডা থেকে শুরু হতো হাতাহাতি। তাই সেসময় বেশ কয়েক বছর পার্টির নিমন্ত্রণপত্রে গৃহকর্তা লিখে দিতেন- “নোরা সম্বন্ধে পার্টিতে আলোচনা নিষিদ্ধ”।
কবি সাহিত্যিকগণ সাধারণত সমকালীন বিষয় নিয়েই লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর প্রধান কারণ আমার দৃষ্টিতে মূলত দুটি- প্রথমত, যে কোন সমকালীন বিষয় বেশীরভাগ সাহিত্যিককেই দারুন ভাবে আলোড়িত করে। দ্বিতীয়ত, কবি সাহিত্যিকগণ সাধারণত সমাজ ও মানুষের প্রতি তাদের যে দায়বদ্ধতা অনুভব করেন সে কারণেও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তারা লিখতে প্রবুদ্ধ হন। শওকত ওসমানের উপন্যাস “ক্রীতদাসের হাসি”, কবি শামসুর রাহমানের কবিতা “উদ্ভব উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ” কিংবা এসময়ের তরুন জনপ্রিয় কবি জুননু রাইনের “এয়া” কাব্যগ্রন্থের “অনীহাকে অদৃশ্য হুমকি” কবিতার দুটো পংক্তি আমি আজরাইল দেখিনি প্রভু/ক্রসফায়ার দেখেছি।
লুইজ গ্লিকের প্রথম জীবনের কবিতা গুলোতে মিথ ও পৌরাণিক কাহিনী এসেছে বানের স্রােতের মতো। যেমন তিঁনি “অ্যাকিলিসের বিজয়” কবিতায় লিখেছেন- গ্রিসের অগ্নিদগ্ধ কোনো জাহাজের সঙ্গে/এ ক্ষতির তুলনা করবে তুমি?/ তার তাঁবুতে, অ্যাকিলিসের/শোক ছিল সমস্ত সত্তাজুড়ে/ এবং দেবতারা দেখেছেন/ ইতিমধ্যেই সে এক মৃত লোক, একজন শিকার/ সেই অংশের যা ভালোবেসেছে,/ সেই অংশ যা নশ্বর। (অনুবাদ: রায়হান রাইন)।
হারপার কলিন্স থেকে প্রকাশিত (১৯৬২ থেকে ২০১২) ‘পোয়েমস’ নামক কাব্যসংকলনটির শিরোনাম গুলোর দিকে তাকালেই কিন্তু সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েকটি শিরোনাম- ‘জেমেনি’, ‘আফ্রেদিতি’, ‘অ্যাকিলিসের বিজয়’, ‘কিংবদন্তী’ ‘একটি কল্পনা’, ‘একটি উপকথা’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে এই কাব্যসংকলনটি লস এঞ্জেলেস টাইমস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। এ ধরণের আরো বহু কবিতা লিখেছেন গ্লিক।
এজন্যই বোধকরি বিখ্যাত ইংরেজ কবি ফিলিপ লার্কিন তাঁকে একবার “পৌরাণিক বেড়ালছানা” বলে সম্বোধন করেছেন। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত লেখক ও অধ্যাপক ডেভিড ওর, নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন- কবিতা সবক্ষেত্রেই পুরাণ ও কিংবদন্তীর পরিচারিকা হিসেবে কাজ করে এবং একই সঙ্গে এর উল্টোটাও ঘটে। অর্থাৎ পুরাণ ও কিংবদন্তী ভৃত্য হিসেবে কাজ করে কবিতার। কবি কখনো কখনো বিদ্যমান পুরাণ ও কিংবদন্তী নিয়ে আসেন তাঁর কবিতায়। যেমন অভিদ লিখেছিলেন- “মেটামরফসিসি”। কিংবা কখনো কখনো কবি পৌরাণিক ও কিংবদন্তীর আকর্ষণীয়তাকে কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেন আরেকটি চরিত্র। হোমারের ‘ইলিয়াড’ থেকে উদ্ভুত ভার্জিলের আয়োনেড চরিত্রটি এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তীগুলো কেন উপজিব্য হয়ে উঠতো গ্লিকের কবিতায়? ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা’র কাছ থেকে গ্রীক পুরাণ এবং জোয়ান অফ আর্কের কিংবদন্তীর মতো চিরায়ত গল্প কিংবা কাহিনীগুলো শুনতেন লুইজ গ্লিক।
বিশেষ করে তাঁর মা শৈশবে তাকে নানাবিধ পৌরাণিক কাহিনী শোনাতেন। আমরা যেমন দেখি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মা জাহ্নবী দেবী ছোটবেলায় ছোট্ট মধুকে পাশে শুইয়ে তাকে শুনাতেন রামায়ণ, মহাভারতের মতো পৌরাণিক কাহিনী। পরবর্তীকালে সেটারই প্রতিফলন ঘটে মধুসূদনের লেখায়। এ কারণেই তাঁর হাত দিয়ে বেরুতে দেখি পৌরাণিক কাহিনীকে অবলম্বন করে লেখা- ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’, ‘বীরঙ্গনা’, ‘ব্রজঙ্গনার’ কাব্য কিংবা মহাকাব্য। বাংলার অন্য আরেক প্রধানতম কবি জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দেবীও শৈশবে জীবনানন্দকে শোনাতেন নানা গল্প কাহিনী। যে সকল পাঠকবৃন্দ দার্শনিক নিৎসের লেখার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানেন গ্রীক ও রোমান পৌরাণিক কাহিনীগুলো নিৎসকে কি দারুনভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং পরবর্তীকালে নিৎসের লেখাতেও সেটা দারুন এক নতুনত্বে প্রতিফলিত হয়েছে।
লুইজ এলিজাবেথ গ্লিকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্ক শহরে কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠা নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে। তাঁর পিতৃপুরুষ ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি। গ্লিকের বাবা ড্যনিয়েল গ্লিক যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া প্রথম সন্তান। গ্লিকের বাবা একটু আধটু সাহিত্যচর্চা করতেন বটে কিন্তু টিকে থাকার জন্য সাহিত্যনির্ভর হওয়ার মতো ক্ষমতা ছিলনা তার। এই জন্য নিজ শ্যালকের সঙ্গে একসময় ছুরির ব্যবসায় নেমেছিলেন। ১৯৩০ সালে এক্স অ্যাক্টো নামক এক ধরণের চাকু আবিস্কার করেন তারা।
একদিনেই কবি হয়ে ওঠেননি লুইজ গ্লিক। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। হাইস্কুলে পড়ার সময়ই তিনি আক্রান্ত হন অ্যানারেক্সিয়া নার্ভালসা (ক্ষুধামন্দা) নামক একটি রোগে। দীর্ঘদিন তার মনো ও দৈহিক চিকিৎসা চলে। এক পর্যায়ে পড়াশোনা মুলতবি রেখে তাকে ভর্তি করা হয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে। একটা সময় তার নাকি এমন মনে হয়েছিল যে- তিনি মারা যাচ্ছেন। কিন্তু আরও তীব্রভাবে তিনি অনুভব করেছেন বেঁচে থাকার আকাঙ্খা। আর এই তীব্র বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই তাকে সম্ভবত কবি হওয়ার বাসনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি একজন সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা তাঁর সৃষ্টিতে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। ইংরেজি সাহিত্যের প্রথমদিককার লেখক জেফ্ররি চসার ভীষণভাবে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে লিখেছিলেন “দ্য ক্যন্টারবারি টেলস্”। কিংবা জন মিল্টন অন্ধত্ব নিয়ে লিখেছিলেন “প্যারাডাইসলষ্ট” ইংরেজ সাহিত্যে আরেক অত্যুঙ্গ লেখক জেমস্ জয়েস সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন ক্ষিণদৃষ্টি নিয়ে। বিখ্যাত ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলীও ভয়ানক শ্বাসকষ্ট ও শরীরে কৃত্রিক শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র লাগিয়ে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “ফ্রাঙ্কেষ্টাইন”। অন্যদিকে যখন সমস্ত দুনিয়া পলিও রোগে আচ্ছন্ন ঠিক তখন প্রখ্যাত ইংরেজ লেখিকা সিলভিয়া প্লাথ লিখেছিলেন “দ্য বেল জার” ও উইলিয়াম কেনেডি লিখেছিলেন- “আয়রণউইড”।
১৯৬১ সালে নিউইয়র্কের জর্জ হিউলেট স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে গ্লিক কবিতার কোর্সে ভর্তি হলেন সারাহ লরেন্স কলেজে। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চারদিকে যতগুলো কবিতা বিষয়ক কর্মশালা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন গ্লিক। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেখানকার পাঠ না চুকাতেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন শিক্ষার্থীদের জন্য স্নাতক কোর্স পরিচালনা করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন চার্লস হার্জ জুনিয়রের সঙ্গে। নবদম্পতির ঘর আলো করে যেখানে নতুন অতিথির আগমনের কথা সেখানে তাঁদের মধ্যে বনিবনা না হওয়াতে শিঘ্রই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। কিন্তু ১৯৬৮ সালে জন্ম নেয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফাষ্টবর্ণ’। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “হাউজ অন মাশল্যান্ড” এই বইটি তাকে এক শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ১৯৯২ সালে গ্লিকের বিখ্যাত কবিতার বই “দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ” সাহিত্য দুনিয়ায় দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই কাব্যগ্রন্থের জন্য পুলিৎজার পেয়েছিলেন তিনি। এই কাব্যগ্রন্থের ‘স্নোডপস’ কবিতায় শীতের পরে জীবনের অলৌকিক প্রত্যাবর্তন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এছাড়াও ২০০৬ সালে লেখা ‘অ্যাডের্নো’ তে মৃত্যুর দেবতা হেডেসের বন্দিদশাকে ভীষণ সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ “ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াল নাইট”।
এর বাইরে গ্লিকের কবিতা সংক্রান্ত দুটো প্রবন্ধের বই- “প্রুফস অ্যান্ড থিওরিজ” ও “আমেরিকান অরিজিনালিটি” অন্যতম। লুইজ গ্লিকের মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। যদিও শৈশবে গ্লিক উইলিয়াম ব্লেইকের কবিতা দ্বারা দারুনভাবে উদ্বেলিত হয়েছিলেন বটে কিন্তু তার কাব্যগ্রন্থগুলো একে একে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই তাকে কবি এমিলি ডিকেন্সন, রাইনের মারিয়া রিলকে এবং সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে তুলনা করতে থাকেন। সেদিক থেকে বিচার করলে গ্লিক পশ্চিমা বিশ্বের মুল ধারার কবিতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি বলা চলে।
শুধুমাত্র মিথ কিংবা পৌরাণিক অনুষঙ্গ নয়। গ্লিকের কবিতায় উঠে এসেছে মানব জীবনের বিভিন্ন সংকট, আত্মবিলাপ ও প্রকৃতি। নিঃসঙ্গতা ও বিষন্নতা তাঁর কবিতার অন্যতম লক্ষণ। গ্লিকের কবিতায় আত্মজীবনের সঙ্গে এসে মিশেছে মিথ। লেখক মাত্রেই জীবনকে দেখেন বিশেষ একটা দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সেই লেখকের লেখা বা শিল্পকর্মের মধ্যে সেই কারণেই একটা বিশেষ স্বাতন্ত্র্য লক্ষণ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। রবার্ট ব্রিজেস্ হয়তো এই কারণেই বলেছেন যে, কাব্য বা সাহিত্য হচ্ছে লেখকের নিজের জীবনেরই প্রতিধ্বনি।
লেখক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ঠিকই বলেছেন- লুইজ গ্লিকের কবিতা যেন অবিরল আত্মসংলাপ ও নিজের সঙ্গে নিজে বোঝাপড়া, আত্মনিরীক্ষার অবিরত প্রচেষ্টা। ‘দ্য মিথ অব ইনোসেন্স’ কবিতার শুরু এইভাবে: এক গ্রীষ্মে সে মাঠে গিয়েছিল যেমন সে যায়/পথে দাঁড়িয়ে ছিল একখ- জলাশয়ের পাশে/যেখানে সে প্রায়শ:/নিজ প্রতিবিম্বে দেখে নেয়/কোনো পরিবর্তন এসেছে কি-না/সে দেখে অপরিবর্তিত কায়া/জঘন্য কন্যাসুলভ আদিখ্যেতা এখনো/লেপ্টে আছে শরীরে।
তিনি আরো লিখেছেন- এটা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে লুইজ গ্লিকের কবিতা অনুসরণ করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রচনাশৈলী যা আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। তাঁর গদ্যকবিতা নিছকই গদ্য, আমাদের বহু পরিচিত রূপবন্ধ থেকে পৃথক। ছন্দ, অন্ত্যমিল, উপমা ও চিত্ররূপময়তার সঙ্গে ধ্বনি মাধুর্যের সম্মিলনে যে রসসিক্ত কবিতা পড়তে আমরা অভ্যস্ত, লুইজ গ্লিকের কবিতার ধাঁচ তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর রচনা অনাড়ম্বর, সম্পূর্ণ অংশে নিরাভরণ; এমনকি শব্দ নির্বাচনেও এমন কোনো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না যা আমাদের চঞ্চল করে তুলতে পারে।
নোবেল ঘোষণার পর সুইডিশ একাডেমির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, গ্লিককে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁর নিরাভরণ সৌন্দর্যের ভ্রন্তিহীন কাব্যকণ্ঠের জন্যে যা ব্যক্তিসত্তাকে সার্বজনীন করে তোলে। সুইডিশ একাডেমি আরো বলেছে- লুইজ গ্লিকের ২০০৬ সালের সংকল “অ্যাডার্নো” ছিল সুনিপুণ এক সৃষ্টিকর্ম। তাঁর সব কাজেই স্পষ্টবাদিতার প্রয়াস লক্ষণীয়। গ্লিকের কবিতায় পাওয়া যায় আত্মজৈবনিকতার সঙ্গে ধ্রুপদী মিথের দৃঢ় আত্মসম্পর্ক। পৌরাণিক চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে মানবপ্রকৃতির এক দূরদর্শী ব্যাখা দিয়েছেন কবি। নোবেল পুরস্কারের বিচারকমন্ডলী বলেছেন- কবি হিসেবে লুইজ নিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছেন। বারবার নতুন নতুন রূপবদল ঘটেছে তাঁর কবিতার।
কেউ কেউ বলেন লুইজ গ্লিকের কবিতা সমসাময়ীক অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছে অপ্রত্যাশিত ভাবে। বছর দুয়েক আগে আমি একবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেখানে আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম- আপনি জীবনীভিত্তিক কোন উপন্যাস লিখলেন না কেন? তখন কিংবদন্তীতুল্য এই লেখক আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- “আমি আমার বাগানে একরকম ফুলই ফোঁটাই, ইচ্ছে হলে নাও, না হলে না নাও।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালিন সময় ফরাসী ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন রেনে শার নামে। নিজে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন কিন্তু কখনো দেশাত্মবোধক কবিতা বা উত্তেজক কবিতা লেখেননি। তিনি মনে করতেন, কবিতা অতি বিশুদ্ধ শিল্প, তার মধ্যে যুদ্ধ-টুদ্ধ মেশানো উচিত নয়। কবিতা দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না, সে চেষ্টা করতে গেলে, সেগুলো কবিতাও হয় না, অস্ত্রও হয় না। রেনে শারের মতো আরেক রুশ কবি ও লেখক ছিলেন রোরিস পাস্তেরনাক। যাকে আমরা চিনি ‘ডক্টর জিভাগো’ উপন্যাসখানার জন্য। কিন্তু তিনি কবিতাও লিখেছেন বিস্তর।
তিনি বারো-তেরোটি মৌলিক গ্রন্থের জনক। এদের মধ্যে অধিকাংশই কবিতার বই। তাঁর প্রায় দু’লক্ষ শব্দ সংবলিত সুদীর্ঘ উপন্যাস ‘ডক্টর জিভাগো’ প্রকাশিত হবার পর ইউরোপ আমেরিকায় যে প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তার তুলনা বিরল। সুইডিশ একাডেমি পাস্তেরনাককে পুরস্কার দিতে গিয়ে তাঁর কবিপ্রতিভার কথা বিশেষরূপে উল্লেখ করেছেন। অথচ আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা পাস্তেরনাককে বিশেষরূপে আকৃষ্ট করতে পারেনি। পাস্তেরনাক ছিলেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক কবি। জনতার সঙ্গে মিলে যাবার মনোবৃত্তি তাঁর কবিতায় তেমন একটা নেই।
এ মুহুর্তে আমার আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল- আলজেরিয়ায় ফরাসি সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে কামু কোনও লেখা লিখেননি কিংবা কোন বিবৃতি দেননি বলে বোভোয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। নোবেল পুরস্কার আনতে গিয়ে স্টকহোমে কামু বলেছেন: ‘আই লাভ জাস্টিস; বাট আই উইল ফাইট ফর মাই মাদার বিফোর জাস্টিস।’ মাতৃভূমি বলেই কামু ফ্রান্সের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে নয়। ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করলে ফ্রান্সের বিপক্ষে যেতে হত।
সাহিত্যে সমকালীনতা ও আধুনিকতা সম্পর্কে চমৎকার একটি সংজ্ঞা আমার চোখে পড়ে নির্ঝর আহমেদ প্লাবন নামে প্রান্তিক এক লেখকের লেখায়। প্রান্তিক বললাম এই কারণে যে, তিনি বসবাস করেন মফস্বলে এবং তথাকথিত জনপ্রিয় লেখকের যে সংজ্ঞা ও তকমা সেটা তাঁর নেই। তাঁর মতে আধুনিকতা হচ্ছে অন্তর্বয়ন অর্থাৎ মানবের মনোধারা বিকাশের পদ্ধতি। সমকালীনতায় প্রকাশ মূখ্য, আধুনিকতায় বিকাশ মূখ্য।
সমকালীনতা আর আধুনিকতা এক নয়। উভয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। একটা সাময়িক অপরটা চিরন্তন। সমকালীনতা মানে সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে যাওয়া প্রবহমান জীবনের ভাষ্য। সমকালীনতা অনেকটা সাম্প্রতিকতা। আর সাম্প্রতিকতা মনেই ক্ষণিকতা। ক্ষণিক জীবন কখনোই আধুনিক নয়। আধুনিকতা মননজাত বিষয়। আধুনিক শব্দটির মধ্যে সমকালীনতা মিশে থাকতে পারে কিংবা সমকালের আভাস থাকতে পারে। আপন হৃদয়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার স্বীকারোক্তির সাহস এবং চৈতন্যের নিরঙ্কুশ বিবৃতি রচনা অধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য তথা আধুনিকের বৈশিষ্ট্য। সমকাল মানে বর্তমান আর আধুনিক মানে বর্তমানের হৃদয়ে ঘটে যাওয়া চিরঞ্জিব ঘটনার নান্দনিক সৌকর্য। সর্বাঙ্গীন জীবনের জন্য মানবের যে চিরন্তন অন্বেষণ তাই আধুনিকতা। অন্তরের নিগূঢ় রহস্যের দিকে আধুনিকতার অভিসার বলে অনেক সময় আধুনিক কবিতা বোঝা দূরুহ হয়ে পড়ে। আধুনিকতা হলো জীবনের অপার উৎসারণ আর সমকালীনতা হলো জীবনে ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। সমকালীনতা মানে চলমানতা আর আধুনিকতা হলো ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিচার্য ঘটনার বিবৃতি। সমাজ সভ্যতা ভব্যতা ও ইতিহাসের ক্রমবিকশিত অধ্যায়ের যে বর্ণিল বিভূতি তার সঙ্গে মানব মননের যে অন্তর্গূঢ় সম্পর্ক তার প্রকাশই সাহিত্যে আধুনিকতা হিসেবে বিবেচ্য।
সমকালীন বিষয় প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি পূর্ণেন্দুপত্রীর ভাষ্যটিও বেশ প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- যে কবি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত। আর যে কবি শুধুই বাস্তববাদী, তিনিও ততোধিক মৃত। যে কবি অযৌক্তিকতায় আচ্ছন্ন, তাঁর কবিতা বুঝবেন কেবল তিনি আর তাকে যারা ভালবাসে। এটা খুবই দুঃখের। যে কবি তত্ত্ববাগীশ, তাঁকেও বুঝবে কেবল তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা। এটাও খুব দুঃখের। কবিতার জন্যে কোথাও কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। ঈশ্বর অথবা শয়তান, কেউই তৈরি করে দেন নি কোনো ফরমুলা। অথচ এই দুই মহামান্য ভদ্রলোক, ঈশ্বর এবং শয়তান, কবিতার জগতে হাঁকিয়ে চলেছেন এক লাগাতার যুদ্ধ। যুদ্ধে কখনো জিতছেন ইনি, কখনো উনি। কিন্তু কবিতা রয়ে যাচ্ছে অপরাজেয়।
কবিতার পংক্তি ছোট হবে কি বড়, সরু হবে কি মোটা, হলুদ হবে কি লাল, তার কোনো নিয়ম-কানুন কি কেউ তৈরি করেছে নাকি? যিনি কবিতা লেখেন, শুধুমাত্র তিনিই এসব নির্বাচন-নির্ধারণের মালিক। তিনিই নির্ধারণ করেন নিজের রক্ত এবং শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে, জ্ঞান এবং অজ্ঞান দিয়ে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন লুইজ গ্লিক কি আদৌ নোবেল পাওয়ার যোগ্য? যদিও এবার লুইজ গ্লিক জাপানিজ সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি ও কানাডিয়ান সাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড কে পেছনে ফেলে জিতে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কার কিন্তু বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে- এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দৌঁড়ে লুইজ গ্লিকের নাম শুরুতে তেমন আলোচনায় আসেনি। আরেকটি বিষয় এবার বেশ লক্ষ্য করার মতো। বাংলাদেশে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কিছু আঁতেল আছেন যারা বলতে শুরু করেন- “আমি পূর্বেই ধারণা করেছিলাম যে ইনিই পারেন নোবেল কিংবা বলতে থাকেন রাজ্যের সব গুলবাজি ও উদ্ভট কথা।” এবার কিন্তু সেটা পরিলক্ষিত হয়নি। এবার যেন সবকিছুই ঘটেছে তাদের সিলেবাসের একেবারে বাইরে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে গ্লিকের দুটি কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন আমেরিকা প্রবাসী লেখক শামস আল মমীন, যা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায়। সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্যক্তি যে লুইজ গ্লিকের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সে যা হোক, সুইডিশ একাডেমির নোবেল কমিটির প্রধান অ্যান্ডার্স ওলসন বলেছেন- লুইজ যে খুব পরিচিত তা নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তার পরিচিতি খুবই সল্প। তাঁর লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও কম হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওলসন। তারপরও গ্লিক কিভাবে ভূষিত হলেন নোবেল পুরস্কারে!
সাহিত্যে এপর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১১৭ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৬। গ্লিকের পূর্বে ২০১৬ সালে আমেরিকার রক সংগীতের কিংবদন্তি ববডিলান এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রয়াত টনি মরিসন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। বিগত কয়েক বছর সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বেশ কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে শুরু করে রয়েল সুইডিশ একাডেমি। পাল্টে যায় নোবেল কমিটির কাঠামোও। এ বছর ২০১৯ সালের বিজয়ীর পাশাপাশি ঘোষণা করা হয় ২০১৮ সালের স্থগিতকৃত বিজয়ীয় নামও। ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় পোলিশ লেখক ওলগা তোকারজুক কে।
২০১৮ সালে নোবেল কমিটির এক সদস্যের স্বামী ও জনপ্রিয় আলোকচিত্রী জ্যঁ ক্লদ আর্নোর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনা হয়। পরে ওই ঘটনায় তাকে দুই বছরের কারাদ- প্রদান করে আদালত। যৌন কেলেঙ্কারির পাশাপাশি বিজয়ীর নাম ফাঁস করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিতর্কের মুখে স্থগিত করা হয় ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল প্রদান।
২০১৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হান্ডকে। তার বিরুদ্ধে সার্বিয়ার নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের বলকান যুদ্ধ সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে। পিটার গণহত্যার সমর্থক, এই ছিল সমালোচকদের বক্তব্য। ১৯৯০ এর দশকের যুগোস্লাভ যুদ্ধে হান্ডকে সার্বদের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এমনকি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য কুখ্যাত সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গন। নোবেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছিল, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং শুধুই সাহিত্যিক মানদণ্ডে হান্ডকে পুরস্কৃত হয়েছেন। এছাড়াও ২০১৬ সালে রক তারকা ববডিলানকে যখন এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল তখন তিনি পুরস্কার প্রাপ্তিতে এতোটাই নির্লিপ্ত ছিলেন যে সুইডিশ নোবেল কমিটিকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত জ্ঞাপন করেননি তিনি। তারপরও তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ২১ হাজার ডলার সমপরিমাণ ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার।
উপরোক্ত কারণগুলোর জন্যই নোবেল কমিটি এবার সম্ভবত পা ফেলেছেন সন্তর্পনে। কিন্তু একটা কথা ভুলে গেলে চলবেনা। লুইজ গ্লিক কবিতা লিখছেন পঞ্চাশ বছর ধরে। তাঁর কবিতার শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্য ইতোমধ্যে আমেরিকার প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারই পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক ডোয়াইট গার্নার এ বিষয়ে বলেছেন- লুইজ গ্লিককে নির্বাচন করে একাডেমি এবার একদম সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
লুইজ গ্লিকের কবিতা ভবিষ্যতে থাকবে কি থাকবে না এ বিষয়ে ছোট দুটি গল্প বলে শেষ করবো আজকের লেখা। প্রথম গল্পটি আমি বহু আগে পড়েছিলাম সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা ‘কলেজ ষ্ট্রিটে সত্তর বছর’ বইটির প্রথম খণ্ডে এবং প্রাসঙ্গিক ভাবেই বলতে হয় প্রথম গল্পটির উত্তর আমি পেয়েছিলাম দেশ পত্রিকার এক সময়ের বিখ্যাত সম্পাদক সাগরময় ঘোষের “হিরের নাকছাবি” গ্রন্থে।
তারাশঙ্করকে তখন সবাই সাহিত্যসম্রাট বলেন। এমনকি সে সময়ের বিখ্যাত কবি কবিশেখরও তাকে সাহিত্যসম্রাট বলেই সম্বোধন করেন। কলেজ ষ্ট্রিটের সাহিত্য আড্ডায় একদিন দেখা হলে তিনি তারাশঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বললেন- কী ব্যাপার, সম্রাটের কী খবর?
তারাশঙ্করবাবু বললেন, আর সম্রাট! মনটা এমনই খারাপ করে দিল, সরোজ রায়চৌধুরী, ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম। ট্রামে করে আসতে আসতে সরোজ এমন একটা কথা বলল, মেজাজটা খিচড়ে গেল। বলল, তারাশঙ্কর তোমার যাই নাম হোক না কেন, তোমার সাহিত্য টিকবে না। কারণ তোমার লেখায় সেই একঘেয়ে বীরভূমী কাহার সাঁওতাল চাষীদের জীবন আর সবথেকে বড় কথা হল তোমার লেখায় কোনো স্টাইল নেই। স্টাইল না থাকলে কোনো লেখক বা তার লেখা বাঁচে না।
কবিশেখর বলল, ওঃ এই কথা! আমি ভাবলাম না জানি কী তত্ত্বকথা শোনাল। আসলে কী জানো- তারাশঙ্কর সরোজ রায়চৌধুরী আর তোমার লীলাক্ষেত্র একই, সেই রাঢ়বঙ্গ। ও একটা ঈর্ষার প্রতিযোগিতা থাকবেই। দ্যাখো তারাশঙ্কর, তোমাকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। মানুষ সবসময়ে মানুষের বুকের কথা হৃদয়ের কথা শুনতে চায়। থ্যাকারে অর্থাৎ উইলিয়াম মেকপীস থ্যাকারে আর চালর্স ডিকেন্স প্রায় সমসাময়িক কালের লেখক। আমাদের পড়ানো হত থ্যাকারের রচনাশৈলী আর ডিকেন্সের সাহিত্য। বলতো কে বেঁচে আছে এখন? থ্যাকারে না ডিকেন্স?।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো- একদিন মধ্যাহ্নভোজে বিভূতিভূষণ খেতে বসেছেন তারাশঙ্করের বাড়িতে। বেগুনভাজা ও পটলভাজার সঙ্গে গাওয়া ঘি, লাউ দিয়ে সোনামুগের ডাল, বড়ি-চালকুমড়োর তরকারি আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি। দই সন্দেশ তো ছিলই।
খাওয়া-দাওয়ার পর এবারে বিভূতিবাবুর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু তারাশঙ্করবাবু বিভূতিবাবুকে তাঁর একতলার বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে গিয়ে সাহিত্যের আলোচনা শুরু করে দিলেন। বিভূতিবাবুর লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার পর বললেন- দেখো বিভূতি, তুমি কিন্তু একটা ভুল করছ। তুমি তোমার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছ না। দেখছ না আমাদের সমাজে কত পরিবর্তন ঘটে গেল। দাঙ্গা, মন্বন্তর, অতবড় এক যুদ্ধের আঁচ তো আমাদের গায়েও কম লাগেনি, যার ফলে রাতারাতি সমাজের চেহারাটাই যাচ্ছে পাল্টে, জীবনের মূল্যবোধ কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা কি তুমি বুঝতে পারছ না? যে-বিশ্বাস নিয়ে আমরা বড় হয়েছি, সে-বিশ্বাস আজ কীভাবে ভেঙে পড়ছে সে তো তুমি তোমার চারপাশে দেখতেই পাচ্ছ। তোমার কি উচিত নয় তোমার সাহিত্যে এসব সমকালীন বিষয় তুলে ধরা।
অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তারাশঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে বিভূতিবাবু বললেন- তুমি কী বলতে চাইছ তারাশঙ্কর? আমি যা লিখেছি তা হলে সেগুলি কি কিছুই হচ্ছে না?
তারাশঙ্কর বললেন- আমি তা বলতে চাইছি না বিভূতি। আমি বলতে চাইছি তোমার সাহিত্যে তুমি এখনও সেই গ্রাম আর নদী, সাঁই-বাবলার জঙ্গল আর অরণ্য, এই নিয়েই পড়ে আছ। সেসব থেকে তো তোমায় বৃহত্তর পটভূমিকায় বেরিয়ে আসতে হবে।
তারাশঙ্করবাবুর অবশ্য এ কথা বলবার অধিকার আছে। উনি তখন খ্যাতির তুঙ্গে। হাঁসুলীবাঁকের উপকথা, মন্বন্তর, গণদেবতা বই তখন অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, ওঁর বইয়ের কাটতি তখন যে-কোনও সাহিত্যিকের কাছে ঈর্ষার কারণ।
বিভূতিবাবু কিন্তু তারাশঙ্করবাবুর যুক্তি মেনে নিতে পারলেন না। বললেন- আমি কোনও বড় ঘটনায় বিশ্বাসী নই, দৈনন্দিন ছোটখাটো সুখদুঃখের মধ্য দিয়ে যে জীবনধারা ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদীর মতো মন্থর বেগে পরিপূর্ণ বিশ্বাসের ও আনন্দের সঙ্গে বয়ে চলেছে- আসল জিনিসটা সেখানেই। আমি আমার গ্রামের চারপাশের প্রকৃতি আর মানুষদের মধ্যে এই জীবনটাই দেখি-বুঝি। আমার লেখা তাদের নিয়েই। কোনও কৃত্রিম প্লট সাজানো, প্যাঁচ কষা, কৃত্রিম সিচুয়েশন তৈরি করা-আমি জানি না। বিভূতিভূষণ আফসোসের দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন- সেই জন্যেই বোধহয় আমার কিছু হল না।
তারাশঙ্করবাবু সান্ত¡না দেবার সুরে বললেন- না বিভূতিভূষণ, তোমার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা আছে। শুধু যুগের সঙ্গে, কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে হবে। তা যদি না পারো পিছিয়ে পড়বে তুমি।
আলোচনা যখন এই খাতে অনেকদূর গড়িয়েছে হঠাৎ বিভূতিবাবুর মনে সংশয় দেখা দিল। তা হলে আমি যা লিখছি তা কি সবই ভুল? সবই মুছে যাবে?
এই বিরাট প্রশ্নটা মনে নিয়ে তারাশঙ্করবাবুর বাড়ি থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন বিভূতিবাবু। টালাপার্ক থেকে সোজা চলে গেলেন টালিগঞ্জে। চারু অ্যাভেনিউতে থাকেন সে সময়ের বিখ্যাত কবি, কবি কালিদাস রায়। যাঁর সাহিত্যিক বিচারবোধের উপর বিভূতিবাবুর অসীম শ্রদ্ধা।
সৌভাগ্যের বিষয় কালিদাসদা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। উত্তেজিত বিভূতিবাবুকে দেখেই কালিদাসবাবু বললেন- কী হে বিভূতি, আবার কী হল? হঠাৎ এ-সময়ে আমার কাছে?
তারাশঙ্করবাবুর সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়েছে তা সবিস্তারে কালিদাসদার কাছে পেশ করার পর বললেন- আচ্ছা দাদা, আপনিই বলুন, আমি কি ভুল পথে চলেছি? আমার লেখা কি সত্যিই মুছে যাবে?
কালিদাসদা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চিন্তান্বিত বিভূতিভূষণের অসহায় মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। পরে ধীরকণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন শোনো বিভূতিভূষণ, দেবী সরস্বতীকে তারাশঙ্কর গা-ভরা সোনার গয়না দিয়ে যতই সাজাক, তুমি দেবীর নাকের নাকছাবিতে যে হিরে বসিয়েছ তা দেবীর সারা অঙ্গের গয়নার জলুসকে ছাপিয়ে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তুমি যে-পথে চলেছ সেইটিই ঠিক পথ- সেইটিই তোমার ধর্ম। কখনও ধর্মচ্যুত হয়ো না।
যে প্রশ্ন এতক্ষণ বিভূতিবাবুর মনকে আলোড়িত করে চলেছিল, কালিদাসদার এই কথায় তার উত্তর পেয়ে প্রশান্তিতে মন ভরে উঠল বিভূতিভূষণের। সহসা চেয়ার থেকে উঠে কালিদাসদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললেন- চলি দাদা, আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।
তবে আমার ধারণা এরপরও বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সংশয় সম্পূর্ণরূপে কাটেনি। তার মনের ভেতর খুতখুত ভাবটা সম্ভবত থেকেই গিয়েছিল আর এজন্যই তিনি সম্ভবত সে সময়ের সামাজিক অবস্থা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি নিয়ে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস “অশনিসংকেত”। সে যাই হোক আমি কিছু না বললেও বর্তমান পাঠকসমাজ খুব ভালো করেই জানেন তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের মধ্যে কে এখন দীপ্যমান ও নিজ আসনে প্রতিষ্ঠিত।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান