সংস্কৃত ভাষায় পুরো বাক্যটি এমন- যদ্দৃষ্টং, তল্লিখিতং। এর মানে হলো- যা দেখেছি, তাই লিখেছি।
যদ্দৃষ্টং শব্দটির অভিধানিক অর্থ- ‘এরূপ’। সাধারণত এ শব্দটি কোনো উদ্ধৃতির পাশে বন্ধনীর মধ্যে লেখা হয়। এতে বোঝানো হয় উদ্ধৃত শব্দ বা বক্তব্য আপাতভাবে অসম্ভব বা অশুদ্ধ মনে হলেও ঠিকভাবেই উদ্ধৃত হয়েছে। এই 'আপাতভাবে অসম্ভব' কথাটি মনে করিয়ে দিল মার্ক টোয়েনের বলা আপ্তবাক্যটি- ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান... সত্য কল্পনার চেয়ে বিস্ময়কর। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন ফিকশানকে সম্ভাব্যতার সাথে যোগ রাখতে হয়। সত্যের সে দায় নেই। আমাদের কাছে অসম্ভব মনে হলেও বাস্তব সত্য নিজের মতো করেই ঘটতে থাকে। এক সময় পুরাঘটিত হয়। তারপর অতীত হয়ে যায়। এই ঘটনা দেখাটাই লেখা হয়ে ওঠে। তাই দর্শনধারী না হলে ভাষ্যকার হয়ে ওঠা অসম্ভব।
অর্থাৎ কিনা যা দেখেছি, তাই লিখেছি। প্রতিনিয়ত দেখছে বলেই মানুষ সদা উৎসুক। অদেখাকে দেখতে চায় বলেই মানুষ জিজ্ঞাসু। আড়াল থেকে সত্যটাকে বের করে দেখার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষ বিনির্মাণপ্রবণ। ‘Veil’ বইটিতে হেলেন সিখো (Helene Cixous) তাঁর উপলব্ধি জানিয়েছিলেন- ‘সেই গোপন না-দেখাকে দেখার নস্টালজিয়া ক্রমশ জাগছিল। এবং এখনো, অনেক কিছুই তো দেখতে চাই, চাই না? দেখা! আমরা দেখতেই চাই! হয়তো দেখতে চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো ইচ্ছেই ছিল না।’ আমরা দেখি। দেখতে দেখতে সমৃদ্ধ হই। ধারন করি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর। একই বইতে জাক দেরিদা দার্শনিক বোধ থেকে উচ্চারণ করেছিলেন- যেভাবেই হোক আড়াল সরে যায়। যদি আড়াল থেকেও থাকে, সেটা সরে যাবার জন্যই। ভেতরের সত্য আবিষ্কারে মানুষ উন্মুখ। সে মানুষের সামনেই সত্য উন্মোচিত হয় যার আছে সত্যকে দেখার দৃষ্টি এবং সত্যকে জানার যোগ্যতা আর আকাঙ্ক্ষা।
তাহলে দেখাটা, দেখার ভঙ্গিটা লেখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। জ্বালানি শক্তি আসছে লেখকের অভিজ্ঞতার উপলব্ধি থেকে। এতেই লেখা হয়ে উঠবে তা নয়। দেখছে তো সকলেই, যারা চক্ষুষ্মান। তারা জীবন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞও বটে। লিখতে হলে কল্পনায় সেই দেখাটা স্থাপন করতে হয়। যেটাকে সহজ ভাষায় বলে 'ভাব'। জীবন আর জগত থেকে ভাববীজ কুড়িয়ে নেয়ার দৈবশক্তি থাকতে হয়। লিখনশৈলী আর ভাষার দক্ষতায় সেই ‘ভাব’ এর প্রকাশসম্ভাবনা তৈরি হয়। ব্যক্তির-অস্তিত্ব ও সামাজিক-অস্তিত্বের সেই মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিয়ত বিনির্মিত হয় রচনা (টেক্সট)। লেখার শেষে তখন বন্ধনীর ভেতর যদ্দৃষ্টং লিখে না দিলেও চলে।
আপাতদৃষ্টিতে চারবেলা চারদিকে যা দেখি, তাই লিখি। তল্লিখিতং। জীবনের আনাচে কানাচে কখন কি দেখি লিপিবদ্ধ হয়ে যায় কলমের আঁচড়ে। হাসান আজিজুল হক ‘সাহিত্যের বাস্তব’ প্রবন্ধে প্রশ্ন করেছেন- যা কিছু যেমন আছে অবিকল সেটি তুলে ধরাই কি সাহিত্যে বাস্তবতা? বাস্তবতা মানে বস্তু বা জীবনের বাইরের চেহারাটাই নয়। বাস্তবেরও আড়ালস্বভাব আছে। বাস্তবের আড়াল আর বাহিরকে লেখাই লেখকের কাজ। বাস্তবকে দেখাটা শুধু লেখা অর্থেই নয়, একজন মানুষ যা দেখছেন প্রতিরূপ গড়ছেন তুলিতে বা ক্যামেরায়। বাস্তব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আঁকিয়ের রঙ রেখা আর ভাস্করের মাটিপাথর ব্যবহারের সুযোগ আছে। লেখকের আছে মানুষের কথার লিপিচিহ্ন। বাস্তবের বহু/সমষ্টিকে একক ব্যক্তি যখন অক্ষরে ধারণ করেন, সেই বিশালতাকে ধারণ করা খুব সহজ কাজ নয়। ধোঁয়াশায় বা অনিশ্চয়তায় বাস্তবতার চেহারাটি হারিয়ে ফেলে। লেখক বাস্তব থেকে বহুদূরে সরে যান। লেখককে ভাবতে হবে- যা দেখছেন তেমনি অবিকল বাস্তবকে লিখবেন? নাকি বাস্তবের সাদৃশ্য এড়িয়ে বাস্তবতর প্রতিরূপ তৈরি করবেন? ‘অফ গ্রামাটোলোজি’তে দেরিদা সেই অন্তর্গুঢ় ইঙ্গিত দিয়েছেন- লেখা (Writing) শব্দটির মানে শুধু ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়। লেখা শব্দটিকে তিনি সম্প্রসারিত করেছেন অন্তর্লেখ (Inscription) দিয়ে। লেখা শুধু অক্ষরে/কথনে সীমাবদ্ধ নেই। ‘লেখা’টা আক্ষরিক হোক কিংবা না হোক, সার্বিকভাবে অন্তর্লেখর দিকেই গেছে। লেখা যা কিছু দিচ্ছে সেটা শুধু পরিচিত ‘কন্ঠস্বর’ এর লিখিত প্রকাশ নয়। সিনেমেটোগ্রাফি, কোরিওগ্রাফিসহ আছে চিত্রকলা, সঙ্গীত আর ভাস্কর্যের ‘লেখা’। হতে পারে শরীরচর্চা, সামরিক বা রাজনৈতিক ‘লেখা’ যা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আমরা যেটার কর্তৃত্তাধীন। ‘লেখা’ বলতে শুধু কাজকর্মের স্বরলিপি (Notation) বর্ণনার প্রক্রিয়া বোঝায় না। কাজকর্মের ভেতরের নির্যাসটুকুও (Essence) লেখা বর্ণনা করে।
জীবন ও সময় যা দেখায় সেটা টুকে টুকে সাহিত্য রচিত হয়। এই জায়মান বিনির্মাণ ভাষা ছাড়িয়ে ভাষাকে ভাষার বাইরে নিয়ে যায়। গল্প জীবনের অনিঃশেষ ধারা। জীবন বয়ে চলে। জীবনের সমান্তরালে গল্পও। প্রায়ই শুনি ‘নিটোল’ গল্প। নিটোল/টোলহীন গল্প কাকে বলে? আপাতত যা বুঝেছি, জীবনের খণ্ডিত অংশকে সেই ‘আদি-মধ্য-অন্ত’ কাঠামোয় ভারসাম্য রেখে যে আখ্যান নির্মাণ সেটাই নিটোল গল্প। অন্তে কিছুটা চমক। বিশেষ করে শেষ বাক্যে ঝাঁকি। বাস্তবকে লেখা যদি হয় সরল বিবরণ তখন আর শিল্প হয় না। হাসান আজিজুল হকের ভাষায়- ‘কলম চালানো কিন্তু সহজ হয়ে আসে, কাজ হয়ে দাঁড়ায় শুধু জাবর কাটার মালপত্র জুগিয়ে যাওয়া।’ উল্লিখিত প্রবন্ধে প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি- ‘যেসব লেখক বাস্তবের শুধু কাজচলা গোছের প্রতিরূপ নির্মাণে ব্যস্ত, সন্দেহ নেই জনচিত্তে তাঁদের জায়গা অনেক বেশি সুরক্ষিত, তাঁদের গ্রন্থের কাটতিও বেশি, বাজার ফাটিয়ে দেয় তাঁদের বই, কিন্তু বাস্তববাদী লেখক কি তাঁদের সত্যিই বলা চলে? ঐ সরল কাহিনীর লেখকদের, ঐ নিছক বর্ণনাকারীদের? নাকি হিসেব করে দেখতে হয় একবার তাঁদের কথা, যাঁরা বাস্তবের সাদৃশ্য রচনায় মনোনিবেশ করেছেন কি করেননি, চলেছেন বহিরঙ্গ-সাদৃশ্য ভেদ করে ভিতরে, শুধু এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে, বাস্তবের তীব্রতর তীক্ষ্মতর চেহারা তাঁরা ফুটিয়ে তুলবেন বাস্তবের সচরাচর প্রাপ্য আকার ভেঙে দিয়ে, তাকে দলে-মুচড়ে তছনছ করে। সাহিত্যে একমাত্র তখনই সাদামাটা বাস্তবের পাশাপাশি দেখা যায় আন্তর্বাস্তবতা- যা নিছক বর্ণনা নয়, শুধু অবলোকন নয়। শতপথে সূচীতীক্ষ্ম আলো এসে পড়ছে, লেখকের মন মেধা প্রজ্ঞা মিশে যাচ্ছে তার সঙ্গে।’
যা দেখছি সেই বাস্তব যদি ‘লেখা’ হয় তাহলে আর যাই হোক ‘নিটোলত্ব’কে সেই ‘লেখা’য় নেয়া যায় না। জীবন যখন বহুকৌণিক টোলে ভরা, সময় যখন বেঁকেচুরে ভেঙে পড়ে গল্পগুলোও তদ্রুপ হয়। প্রশ্ন হলো টোলপড়া গল্পই বা কী? শুধুই ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট? শিল্প নয়? রবিশংকর বল ‘প্লট ভাঙো, গল্প লেখো’ নিবন্ধে বলেছিলেন- ‘আমার জীবনের কোথাও তো কোনো নিটোল গল্প নেই। সব ভাঙাচোরা। এক কাহিনীর মধ্যে অন্য কাহিনী, এক চরিত্রের কথার মধ্যে অন্য চরিত্রের কথা ঢুকে পড়ে। যে ঘটনার সাথে আমার রক্তমাংসের সম্পর্ক নেই, তা নিয়ে তো লিখতে পারি না। তাই কিছুতেই শিল্প করা হয় না আমার। অর্থাৎ ওই নিটোল গল্প লিখতে পারি না।’ আমরা জানি ‘শিল্প’ গঠন/ছাঁচ (Form) আর বিষয়বস্তকে (Content) মান্যতা দেয়। পশ্চিম ইউরোপীয় ধারণায় নিটোল, নিখুঁত, নিয়ন্ত্রিত যা কিছু সেটাই শিল্প। অথচ শিল্প অটল বা স্থিতিশীল কিছু না। শিল্পের ধারণা বদলে যায় সময়ের সাথে। জীবন যেখানে কাঠামোর প্রতি আনুগত্যকে অস্বীকার করে সেখানে বোধের নির্যাস ছকের বাইরে গেলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না।
‘এভাবে গল্প লেখে না’ কিংবা ‘ওভাবে গল্প হয় না’ এই কথাগুলো ছুঁড়ে দেয়া হয় টোলপড়া গল্পের জন্য। কারণ ডায়োনেসিয়াস বাতিল। অর্থাৎ ‘ভেঙে ফেলা’ ব্যাপার হলেই সেটা শিল্পের বাইরের বিষয়। অথচ কাঠামোর ভাঙন মানে কাঠামোর সার্বিক বিনাশ নয়। একটি গল্প কাঠামোর ভেতরে ঢুকে সেই কাঠামোর গঠনকে সংশয়ের দিকে ঠেলে দেয়। কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। দেরিদা বিনির্মাণের ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেছেন- ‘Deconstruction doesn’t take place after the fact, from outside. It is always already at work.’ কোনো বিষয়ের বিনির্মাণ কাঠামোর বাইরে থেকে হয় না। কাঠামোর ভেতরেই বিনির্মাণের কাজ চলতে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে গল্পও একটা কাঠামোকে বদলে দিতে পারে। গল্পের ভেতর পরিচিত বহুজনবোধ্য গঠন (Form) নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রতিসাম্য (Symmetry) থাকে। এই প্রতিসাম্যই গল্পের শিল্পগুণ হয়ে ওঠে।
যা দেখছি নতুন করে সেই দেখতে পাওয়ার লেখাটাও নতুন হতে থাকে ভেতরে ভেতরে। ফলে আখ্যানবয়ানের ভাষাও বদলে যায়। গল্পের ভাষার ভেতরের নির্যাসটুকু আসলে ভাষার ভেতরে এক না-ভাষা। ভাষা ভরকেন্দ্র থেকে পরিধিহীনতার দিকে যায়। ভাষা ‘দুই যোগ দুই’ বললে আমরা না-ভাষায় বুঝে নিই ‘চার’। এই আঙ্কিক ভাষা ছাড়াও বলা যায় না-ভাষায় ব্যক্ত হয়ে যাওয়া অনুভূতির কথা। সেই অনুভব হতে পারে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। ভাষার মুক্তি ঘটার পাশাপাশি লেখার আঙ্গিকও বদলে যায়। ‘নষ্টনীড়’ আকারে উপন্যাসের মতো হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকার বিবেচনা করে গল্পটিকে ছোটগল্প হিসেবেই গল্পগুচ্ছে রেখেছেন। স্যামুয়েল বেকেটের সর্বশেষ গদ্য/উপন্যাস ছিল ‘স্টিরিংস স্টিল’। ১৯৮৭-৮৮ সালে লিখিত গদ্য/উপন্যাসটি মাত্র দু’হাজার শব্দের। হোর্হে লুইস বোর্হেস সম্পর্কে অক্টাভিও পাজ যেমন বলেছেন- ‘বোর্হেসের প্রবন্ধ পড়লে মনে হয় গল্পের মতো। আর গল্পগুলো মনে হয় কবিতার মতো আর কবিতাগুলো আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায়। যদিও সেগুলো হলো প্রবন্ধ।’ আধুনিক সাহিত্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস এই জঁরগুলোর নির্দিষ্ট সীমা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
আর্থসামাজিক অবকাঠামো যত বদলে যাচ্ছে, পৃথিবী জটিলতর হয়ে উঠছে। জটিল হচ্ছে বিবিধ বিষয়বস্তু, সম্পর্ক আর পরিপ্রেক্ষিত। এই জটিলতাকে নিটোল ছকে ফেলে নয় জটিলতা সমেতই ধারণ করতে হয়। আধুনিক গল্প সেই নিত্য নতুন জটিলতাকে ধরতে পারে। এতে গল্পের উপকরণও (Particulars) বৈশ্বিক মাত্রা পায়। গল্পের মধ্যে জীবনপ্রবাহ প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়।
গল্পের কাছে আর কী চাইব?
অলংকরণঃ তাইফ আদনান