জলধি / প্রবন্ধ / মুর্শিদাবাদ : পথে প্রান্তরে ইতিহাস
Share:
মুর্শিদাবাদ : পথে প্রান্তরে ইতিহাস
মুর্শিদাবাদ নামকরণ ঘিরে নানা মত প্রচলিত আছে। জেলা হিসেবে মুর্শিদাবাদ-এর জন্ম ১৭৮৬ সাল। কিন্তু তার আগে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। মুর্শিদকুলী খাঁর আগে এই জেলার নাম ছিল মুখসুদাবাদ। তারও আগে ছিল মাসুমাবাজার। এই জেলার নামকরণের  ৩১৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান মুর্শিদাবাদ দেশ, উপমহাদেশ ও বিশ্বের পর্যটকদের হাতছানি দেয়। মুর্শিদাবাদ এক সময় প্রধান তিনটি শাসন ব্যবস্থার রাজধানী ছিল। বাংলার স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ,মহীপালের রাজধানী মহীপালে এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী  মুর্শিদাবাদ ঐতিহাসিক নগরীতে ছিল।১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে যেমন ঢাকার গৌরব ক্ষীণ হতে থাকে তেমনি মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরের চরম শিখরে পৌঁছায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর রণাভিনয়ের পরে বঙ্গের সৌভাগ্যলক্ষীর বিপর্যয় ঘটে।১৭৬৫ সালে ক্লাইভ নবাবদিগকে শাসন কার্য থেকে অপসৃত করেন। এবং পেনশন প্রদান করেন। এই সময়ে নবাবদের " নবাব " উপাধি মাত্র থাকে। এই উপাধিও ১৮৪৫ সালের পর উত্তরাধিকারী অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।নবাবরা কেউ স্বাধীনভাবে কেউ আবার পুতুল নবাব সেজে প্রায় ৫০/৬০ বছর বাংলা বিহার উড়িষ্যা শাসন করেছেন। সেই সময় থেকে মুর্শিদাবাদ তথা লালবাগ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক বাড়ি, অসংখ্য মসজিদ, মন্দির,মঠ, গির্জা, আখড়া ও প্রাসাদে পরিপূর্ণ ছিল। গুপ্ত-হত্যা,হাসি- কান্না,রাজা- প্রজা, এবং স্থাপত্য মুর্শিদাবাদের ভূমি। মুর্শিদাবাদ জেলার বুক জুড়ে রয়েছে মন- হরন পর্যটন কেন্দ্র।নবাবী আমল থেকে এখানকার ভূমি__ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ।পদে পদে ঐতিহাসিক স্থান, নিদর্শন ও চিহ্ন ছিল। তবে পরিতাপের বিষয় হল__ কিছু কিছু স্থাপত্য টিকে থাকলেও পূর্বের অনেক স্থাপত্য বর্তমানে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে।
                   ইতিহাস এমন একটি বিষয়__যা জাতীয় জীবন চেনার বা সংশোধনের একমাত্র উপায়। ইতিহাস প্রাণ কিছু ব্যক্তি জেলার ইতিহাস লিখে জেলার কল্যান সাধন করেছেন। কিন্তু আজও বোধহয় মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি। এই জেলার প্রতিটি ধুলিকণার সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু -সাধক,মসুলমান -পিরের করুন ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে।              
যে স্থান সুদীর্ঘ কাল ধরে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী পরিগণিত ছিল, তার বিস্মৃত বিবরণ জানার কার না ইচ্ছে হয় ? বিশেষতঃ মুর্শিদাবাদের তিনশো বছরের অধিক ইতিহাস নিয়ে চর্চার যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। পুরাকীর্তি, পুরানো পুঁথি, প্রাচীন মুদ্রা, দেবদেবীর মূর্তি, শিলালিপি থেকে আমরা আমাদের প্রাচীন জাতীয় জীবনের সন্ধান পেতে পারি।
                  ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদ জেলার আয়তন ৫৩২৪ বর্গ কি.মি.। আনুমানিক জনসংখ্যা ৫৮৬৬৫৬৬৯ জন।
                   বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনবহুল পর্যটন শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সমৃদ্ধ এই শহরের জনপ্রিয়তা কেবল তার প্রাচীন প্রকৃতির জন্য নয়। বরং বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষীর প্রাচীন স্থাপত্য  ও ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শন বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে এই শহরের ইমারতগুলি আজও মরে বেঁচে আছে। এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত। ভৌগোলিক দিক দিয়ে এজেলার অবস্থান বিচিত্রময়। পুর্বে অধুনা বাংলাদেশ, দক্ষিণে নদীয়া, উত্তরে মালদা এবং পশ্চিমে বীরভূম। ভাগীরথী নদী জেলাকে দু'ভাগে ভাগ করেছে।উভয়েরই সদর শহর বহরমপুর। বহরমপুর, লালবাগ, কান্দি, জঙ্গিপুর ও ডোমকল। একেবারেই কৃষি প্রধান জেলা। আরও একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতের যে ক'টি জেলা মাত্র সংখ্যা লঘু অধ্যুষিত তারমধ্যে মুর্শিদাবাদ একটি। জেলার কৃষকরা বেশির ভাগই সংখ্যালঘু মুসলমান। এই জেলার অসাম্প্রদায়িক জেলা বারে বারে সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছে।যেমন,১৯৮৫ সালে কাটরা মসজিদের ঘটনা কেন্দ্র করে একই সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ শহিদ হলেও জেলা জূড়ে শান্তির বার্তা দিয়েছে।১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনার পর মুর্শিদাবাদ ছিল ঘটনাবিহীন।১৭৫৭ সালের আগে ভাস্কর্য পণ্ডিতের নেতৃত্বে এই জেলা কয়েক বার লুণ্ঠিত হবার কথা সর্বজনবিদিত। ১৭৫৭ সলের পর প্রকৃত অর্থে চেহেলসেতুনের খাজাঞ্চিখানা লুণ্ঠন করে গেছে ইউরোপীয় দেশের বণিকের ছদ্মবেশে আসা দস্যু ও ইংরেজরা।১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধজয় থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েকশো বজরা ভর্তি সোনা, স্বর্ণমুদ্রা রুপোরমুদ্রা,অন্যান্য দামি সামগ্রী স্বদেশে পাচার করে।১৭৫৭ থেকে ১৭৬০__ এই তিন বছর কোম্পানি পুতুল নবাব মীরজাফরের নিকট থেকে উপোঢৌকন বাবদ আদায় করে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা মীরজাফর এছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীদের দিতে বাধ্য হয়েছিল__ নগদ ভাতা ও পুরস্কার দানের নাম করে ৫৯  লক্ষ টাকা। পরের পাঁচ বছরে আরও ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। এছাড়াও কোম্পানির বাড়তে লাভ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা,ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।
                  জনশ্রুতি আছে, মুর্শিদাবাদ শহরে ছোট বড় মিলে ৫৭০ টি মসজিদ ছিল। এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ছিল ২৯৬ টি। লালবাগ শহরে পাঁচটি বাউলির খবর পাওয়া গেলেও চারটি স্থান নির্নয় করা যায়, একটির স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। যেগুলোর স্থান নির্নয় করা যায় ।যথা বিডিও মোড়, বনমালীপুর, চকমসজিদ ও কাঠগোলা। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলায় সাতটি গোলার খবর পাওয়া যায়,যথা- ভগবানগোলা,লালগোলা,সুপরিগোলা,আজিমগঞ্জগোলা (ডোমকল), চরবলণগোলা, গোলাবাড়ি ও কারাগোলা।ইংরেজরা এই শহরকে লন্ডনের চেয়ে সুন্দর, জনবহুল এবং সমৃদ্ধ বলেছে।১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে শাহেন শাহ ফারুকশিয়রের নিকট থেকে রাজস্ব আদায়ের সনদ পেলে তারা কাশিমবাজার,ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কুঠি গড়ে এবং তখন থেকে একটু একটু করে লালবাগের গৌরব হারাতে বসে। তার পরও যেটুকু ছিল __ ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে ৮/১০ ঘণ্টার পুতুল খেলা হয় এবং সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর আরও শেষ হল।
                  সপ্তম শতাব্দীর শুরুতেই গৌড় রাজ্যকে এক প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম পরাক্রান্ত রাজ্য গৌড়ের অধিপতি মহারাজ শশাঙ্ক বাংলার ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম নরপতি ছিলেন। তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তাঁর সময়েই গৌরবের চরম সীমায় পৌঁছে ছিল।
                    কর্ণসুবর্ণ:  ৬০০-৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বলাবাহুল্য বাংলার প্রথম স্বাধীন মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ন। প্রাচীন রাজ্যের মধ্যে কর্ণসুবর্ন সুবিশাল বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি বা কর্ণসুবর্ন বিশেষ স্মরণীয় স্থান। এমন কি ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াদের বেশ বড়সড় রেশমের কুঠি ছিল। এই স্থানকে স্বাস্থ্যনিবাস মনে করা হত। কোম্পানির আমলের সাহেবরা এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতেন।১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে খনন করে প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পোড়া মাটির সীলমোহর।যার গায়ে উৎকীর্ণ ধর্মচক্র- প্রতীকের নিচে দু'লাইন লিপিতে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের উল্লেখ আছে।  রাঙামাটির বেশির ভাগ ভাগীরথী গ্রাস করছে।চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ এসেছিলেন। তিনি দু'হাজার বৌদ্ধ শ্রমিকের বসবাস ছিল বলে বর্ণনা করেছেন। কর্ণসুবর্নে গুপ্ত বংশীয় রাজারা বহুদিন রাজত্ব করেছিলেন। এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের স্তুপ থেকে বহু প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে।খননকার্য চালালে এখনও হয়তো বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
                মহীপাল: সাগর দিঘী থানার একটি ছোট গ্রাম__ মহীপাল। এই নগরে রাজধানী ছিল পাল রাজাদের। এখনও মহীপাল নগরীতে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দাক্ষিণাত্যের রাজা রাজেন্দ্র চোল আনুমানিক ১০২০-১০২৩ সমরাভিযান চালিয়ে মহীপালকে পরাজিত করে এবং রাজ্য লুণ্ঠন করেন।
                   কিরীটেশ্বরী : মুর্শিদাবাদ জেলায় হিন্দু দেবালয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম মন্দির।মূল মন্দির সংলগ্ন আরও ছোট ছোট অনেক মন্দির দৃশ্যমান। ঐতিহাসিকদের ধারণা এই মন্দিরের নির্মাণকাল_ ১৪৬৫ খ্রীষ্টাব্দ। বাহান্ন পীঠের একটি পীঠ বলে এই স্থানের নাম__ কিরীটেশ্বর বিজয় রায় সেন বিরচিত " তীর্থ- মঙ্গল " কাব্যে কিরীটেশ্বররীর বর্ণনা আছে।রিয়াজুস সালাতীন ও রেনেলের কাশিমবাজার দ্বীপের মানচিত্রে কিরীটকোনাকে ' তীরতকোনা ' বলে উল্লেখ করেছেন। ১৭০৪ সালে দর্পনারায়ণ রায় ডাহাপাড়ায় আসেন। এখানে এসে এই মন্দিরের সেবার যথেষ্ট বন্দোবস্ত করেন। অনেকদিন তাঁদের হাতে দায়িত্ব ছিল। দর্পনারায়ণ রায় মন্দিরটির পুনঃনির্মাণ ও কালী সাগর নামে পুকুর খনন করে দেন। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে আজও হাজামজা অবস্থায় পুকুরটি দৃশ্য মান। পৌষমাসের প্রতি মঙ্গলবার কীরীটেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ পুজো ও সারা মাসব্যাপী মেলা চলে।দেশ বিদেশের প্রচুর ভক্তদের সমাগম হয়। লালবাগ কোট স্টেশন থেকে তিন মাইল দূরত্ব।
                   খেরুর মসজিদ: সাগরদিঘী থানার অন্তর্গত খেরুর এক ছোট গ্রাম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন মসজিদ এটি। জনশ্রুতি আছে, এই মসজিদটির আশপাশ থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত যুগের বহু নিদর্শন। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের দেওয়ালে দৃষ্টি নন্দন টেরাকোটা কাজের শৈল্পিক ভাবনার বহির্প্রকাশ দেখতে পাবেন। মসজিদের প্রধান দরজা উপরে একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ৯০০ হিজরীতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্দেশে মোয়াজ্জেম রিফাত খাঁ নির্মাণ করেন।
                    কসবা বাহাদুরপুর: মোঘল শাসন শুরু থেকে গড়ে ওঠে কসবা। কসবার মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা থানার কসবা বাহাদুরপুর সর্বপ্রথম। ১৫৭৪-১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কসবা বাহাদুরপুর গড়ে উঠেছিল। প্রাদেশিক রাজধানী গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদে কিন্তু বড় বাজার গড়ে উঠেছিল কসবা বাহাদুরপুরে।ভগবানগোলা থানার ৫৬ নং গ্রাম।তৎকালে এখানে একটি নীল উৎপাদনের কারখানা ছিল। নীল চাষের কাজে ব্যবহৃত পুকুর আজও দৃশ্যমান। কিন্তু কারখানার নালা সবই লুপ্ত হয়ে গেছে।আখেরীগঞ্জ ভগবানগোলা রাস্তার মাঝামাঝি নহর সংলগ্ন এই গ্রামটি।একসময় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল এখানে। কসবা বাহাদুরপুর গ্রামের অদূরেই বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান  বুধুর তেলিয়াপাড়া। বাঙলার সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র বাহাদুর সিংহাসন অধিকার করেন। বাহাদুর অধুনা বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলার ঘিয়াসাপুরে ' ঘিয়াসাবাদ ' নামে একটি শহর ও বাজার গড়ে তুলেছিলেন। তার কারণ লক্ষ্ণৌতির সঙ্গে এই শহরের নিরাপদ এবং অদূরে। সহজে যাতায়াতের জন্য এই শহর গড়েছিলেন। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ লক্ষ্ণৌতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে আসছেন শুনে বাহাদুর শাহ সপরিবারে ঘিয়াসাবাদে আত্মগোপন করতে চেয়েছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের নির্দেশে কেন্দ্র বাহিনী লক্ষ্ণৌতির দখল নিলে বাহাদুর সেখানে থেকে ঘিয়াসাবাদ পালিয়ে যান।জলপথ পরিত্য্যাগ করে স্থলপথ ধরেন। এবং সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা, আলাইপুর, আখেরীগঞ্জ রাজশাহী সড়ক পথেই পালিয়ে যাবার পথ। কিন্তু শরীর বইতে পারছে না দেখে বিশ্রামের জন্য বাহাদুরপুরে ডেরা করেন। এই সুবাদে বাহাদুরের নামে গ্রামের নাম হয়েছে বাহাদুরপুর। ক্রমে কসবা বাহাদুরপুরে পরিণত হয়।
                  মোঘল টুলি ও আকবর নগর: বঙ্গপ্রদেশে মোঘল আধিপত্য বিস্তার করার পর থেকেই শাসন কার্য চালিয়েছে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে।যেমন গোয়াস, মোঘল টুলি প্রভৃতি।আকবরপুরের সাবেকি নাম আকবরশাহী। বর্তমান আকবর পুর। সম্রাট আকবরের আমলে তাঁর অগণিত টাকশাল ছিল।আকবরের যে টাঁকশাল গুলোর নাম জানা যায়, তার মধ্যে সব টাঁকশাল থেকে সব ধরনের মুদ্রা নির্মাণ হতে না।তামার মুদ্রা প্রস্তুতকারী টাঁকশাল গুলোর মধ্যে প্রথম নাম এসে যায় আকবরপুরের নাম। তাঁর শাসনকালে বাঙলা সুবেহে প্রথম টাঁকশাল গড়ে আকবরপুরে। দ্বিতীয় টাঁকশাল গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ জনপদের জাফরাগঞ্জে। মোঘল টুলি, আকবরপুর গ্রামদ্বয়ের নামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের নাম সংপৃক্ত। মোঘল সুবেদার ও সিপাহসালার মুনিম খাঁ,খান-ই-খানান ২৫ সেপ্টেম্বর ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দে আফগান সুলতান দাউদ কাররানির সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এবং যুদ্ধে মুনিম খাঁ জয়লাভ করেন। তখন থেকে বাঙলা দিল্লির অধিনে আসে। যুদ্ধ চলাকালীন সম্রাট আকবর নিজে যুদ্ধ সামগ্রী ও খাদ্য নিয়ে আসেন।মুকসুসাবাদ শহরকে নিরাপদ স্থান ভেবে এখানেই শিবির স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের সেনা বাহিনী যেখানে থাকত সেখানকার নামকরণ হয় আকবরপুর।আর সম্রাট যেখানে থাকতেন সেখানকার নামকরণ হয় মোঘল টুলি।
                  জাফরাবাদ: সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর স্থলাভিসিক্ত হোন তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ। বাঙলাদেশের সোনারগাঁও সরকারের পদ ও ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দিন মুবারক শাহর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সাতগাঁও ও সরকারের সুবেদার ইজজউদ্দিন ইয়াহিয়া এবং লক্ষ্ণৌতির সরকারের সুবেদার কদর খাঁ।এমন সময় সোনারগাঁওর সরকারের সামান্য আরমার-বিয়ারার ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল ও স্বাধীনতা ঘোষণা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে সমগ্র বাঙলার নিন্দা মনে করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও সমরাভিযান করলে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের পরাজয় হয় এবং পালিয়ে গিয়ে বাগড়ীর অজ গ্রামে আত্মগোপন করে।জাফর খাঁ ছিলেন রাজস্ব বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের রাজকর্মচারী। তাঁর সুপারিশে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের পুনর্বহাল হোন। ফখরুদ্দিন মুবারকের শাহের জামাতা ছিলেন জাফর খাঁ।জাফর খাঁ শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেন। এই কথা জানতে পেরে সিকন্দর শাহ ঘটনার সত্যাসত্য প্রশ্নে সেনা অভিযান করতে বলে। দিল্লির সেনা বাহিনী রাজমহল, সুতি, লালগোলা, আলাইপুর পথে এগিয়ে আসে। এমন সময় লক্ষ্ণৌতির সামরিক বাহিনী হাজির হয়। উভয় পক্ষ যুদ্ধ করে। সেই থেকে এই স্থানের নাম জাফরাবাদ। গ্রামটি বর্তমান অধুনা রানিতলা থানার অন্তর্গত।
                   রানিতলা: মুর্শিদাবাদ জেলার  অধুনা রানিতলা থানার অন্তর্গত একটি  গ্রাম। গ্রামটি প্রাচীনত্বের দাবি রাখে।১৮৫২-১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের রাজস্ব জরীপে যথাক্রমে ৬৮ ও ৬৯ নাম্বার গ্রাম দু'টোর সম্মিলিত রুপ রানিতলা। জেলা জরীপে একত্রিত করা হলে নামকরণ হয় 'রানীতলাশ' বর্তমান রানিতলা নামেই পরিচয় লাভ করেছে। অতীতে ইংরেজরা পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করে। পুলিশ ব্যবস্থা বলবৎ করতে " রানীতলাশ " নামে পুলিশের প্রশাসনিক বিভাগ চালু করে এবং পরে এখান থেকে থানা চলে যায় ভগবানগোলায়। দীর্ঘদিন পর রানিতলায় পুনরায় থানা গঠিত হয়েছে। রানী ভবানীর  এখনো অনেক স্মৃতি দৃশ্যমান।রানিতলা হাট প্রাচীনত্বের দাবিদার। এই হাটের জন্ম,১৮৮০ সাল। সপ্তাহে দু'দিন হাট বসে মঙ্গলবার ও শুক্রবার।
                   মরীচা: মুঘল শাসন আমলে নদী কেন্দ্রিক প্রাচীন নগর।সভ্যতার ও নাগরিক চেতনার বিকাশ গড়ে উঠেছিল।শিয়ালমারি, জলঙ্গি ও ভৈরব নদী কেন্দ্রিক বিকাশের অনেক প্রমান পাওয়া যায়। ভৈরব নদী নির্ভর যাতায়াত ছিল গৌড় থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত। ভৈরব শিয়ালমারি ও জলঙ্গি নদী__ এই নদীগুলোর উৎস মুখ পদ্মা এখনও।সুলতানি বা মুঘল শাসন আমলে সাতগাঁও শাসনের জন্য সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা,চুনাখালি স্থলপথে অথবা ভাগীরথী- ভৈরব জলপথে যোগাযোগ করত। সম্রাট আকবর পর্যন্ত সাতগাঁও যেতেন ভৈরব নদীর বুক বেয়ে। এছাড়া সুলতানী আমলেও এই নদীগুলোই যাতায়াতের একমাত্র প্রধান উপায় ছিল। প্রতি প্রতিক্ষার স্বার্থে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা ছাউনি গড়ে তুলেছিলেন।মরীচা সেনা ছাউনি তার মধ্যে অন্যন্য।শিয়ালমারি নদী ও পদ্মা নদীর কাছাকাছি ছিল মরীচা। প্রশাসনিক দপ্তর গড়ে ওঠার কারণেই মরীচা,মৃদাদপুর ও আমিরাবাদ বিভক্ত হয় এবং পৃথক জনপদ গড়ে ওঠে। সেনা প্রশাসকদের বসবাসে আমিরাবাদ এবং প্রাত্যহিক সেনা মহড়ার জন্য মৃদাদপুর গ্রাম দু'টোর নাম স্মরণ করিয়ে দেয়।মরীচা ও মৃদাদপুরের পূর্বে শিয়ালমারি নদী। উত্তরে আলাইপুর মরীচা জলঙ্গি প্রাচীন সড়কপথ। পরিখার ধারে মসজিদ সমর বিভাগে নিযুক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাজ পড়ার প্রমাণ। এই মসজিদটির নাম ছিল " চৌকী " মসজিদ।মরীচা সামরিক ছাউনির কারণে ও সামরিক লোকজনের প্রয়োজনে সংলগ্ন এলাকায় হাট বাজার এবং সুপরিগোলায় একটি বানিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল।জনরব,মরীচায় কড়িয়ালদের বসবাস ছিল। প্রসঙ্গত, প্রাচীন মরীচা জনপদেই ভাষা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আবদুল হাই জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন মরীচা পদ্মায় ভেঙে গেলে নতুন করে মোল্লাডাঙ্গা সেখপাড়া পাকা সড়কের দক্ষিণে মরীচা গ্রাম এখনও বিদ্যমান। প্রাচীন কালে নদী কেন্দ্রিক যাতায়াতের সুবিধার্থে মরীচা সেনা ছাউনি,সুপরিগোলায় শস্য ভান্ডার এবং টাঁকশাল গড়ে উঠেছিল।
                    মুর্শিদকুলী খাঁ: নবাব জাফর আলী খাঁর পূর্ব নাম ছিল__ করতলব খাঁ। ইতিহাস খ্যাত নাম মুর্শিদকুলী খাঁ। তিনি ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুর্শিদাবাদে। তাঁর অনেক কীর্তির মধ্যে কাটরা মসজিদ। শুধু তাই নয় তিনি ঢাকা(জাহাঙ্গীর নগর) নগরীতে আরও একটি মসজিদ ও বাজার নির্মাণ করে ছিলেন। উক্ত মসজিদটি ' জাফরী ' মসজিদ নামে খ্যাত।ইহা ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর উত্তরসূরি গুজনফার হুসেন খাঁর কন্যা হাজি বেগমের তত্ত্বাবধানে দেন। মসজিদটি আকারে বিশাল। এই মসজিদ নির্মাণ কৌশল অতি চমৎকার। মসজিদটি বেগম- বাজারের মসজিদ নামে পরিচিত।
                 মুর্শিদকুলী খাঁ ১৭০৪ সালে কাসিম বাজারে টাঁকশাল স্থাপন করেন। কাসিম বাজারে কোন স্থানে এই টাঁকশাল ছিল তা আজ চিহ্নিত করা যায় না। এক বছর পর কাসিম বাজার থেকে সরিয়ে মহিমাপুরে রাজকীয় টাঁকশাল স্থাপন করলেন। এবং এই টাঁকশালের পুরো দায়িত্বে রাখলেন মানিক চাঁদ তথা শেঠেদের উপর।এদেরই চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়।
                    সম্রাট ওরঙজেব প্রধান কানুনগোর ক্ষমতা হ্রাস করে এবং সুবাদার বা নাজিম থেকে দেওয়ানকে আলাদা করে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য হায়দ্রাবাদের দেওয়ানী দপ্তরের দক্ষ হিসাবরক্ষক মহম্মদ হাদীকে করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে মুখসুদাবাদ প্রদেশের ফৌজদার ও সুবা বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যাকে সুবা বাংলা বলা হত। তিনি প্রথমে আসেন তৎকালে সুবার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে।আজিম উসসানের বিদ্বেষ বাড়তে থাকলে  মহম্মদ হাদী মুখসুসাবাদের ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়াতে বসবাস এবং দেওয়ানখানা গড়ে তুলেন।ভারত সম্রাট ওরঙজেবের অনুমতিক্রমে তাঁর নামে রাজধানীর নাম করলেন মুর্শিদাবাদ।১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর মুর্শিদকুলী খাঁ হন বাংলা সুবার সুবেদার এবং তাঁর সুতামন-উল-মুলুক আলা উদ্ দৌলা, জাফর খাঁন বাহাদুর নাসির, নাসির। মহম্মদ হাদীর সঙ্গে এসেছিলেন মহিমা পুরে মানিক চাঁদ, দর্পনারায়ন ডাহাপাড়ায় এবং ভট্টবাটিতে জয় নারায়ন ‌তখন থেকে মুর্শিদাবাদ জাঁকজমক রূপ পেল। এই কুলোরিয়াতে নিজ প্রাসাদ,দরবার হল সবই ছিল।চেহেল সেতুন নাম দিয়েছিলেন।১৭০৪-১৭২৭ পর্যন্ত চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান।
                    চেহেল সেতুন: ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়া নামক স্থানে চল্লিশটা স্তম্ভের উপর নির্মিত দরবারখানা।১৭০১সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার প্রধান দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি রাজস্ব আদায়ে দক্ষ ছিলেন বলে রাজস্ব আশাতীত বেড়ে যায়। তাঁর নির্মিত চেহেল সেতুন আজ আর চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায়।এটি একটি নবাবদের বাসোপযোগী সুদৃশ্য প্রসাদ।১৭০৪-১৭২৭ প্রায় ২৫ বছর চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান। বাংলার রাজধানী ছিল জাহাঙ্গীরনগর।১৭০৪ সালে সেখান থেকে মুকসুসাবাদে রাজধানী তুলে এনেছিলেন। তাঁর নামানুসারে হয় মুর্শিদাবাদ। অবশ্য মুর্শিদাবাদ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতের প্রচলিত আছে। মুর্শিদকুলী খাঁ  এখানে আসার পর যে বিশাল বিশাল প্রাসাদ,ইমারত, কেল্লা, দরবার গৃহ প্রভৃতি নির্মাণ করলে মুখসুসাবাদ বা মুর্শিদাবাদ অজগাঁ থেকে শহর বা রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। নবাবও নেই আর সেই জৌলুসও নেই।চেহেল সেতুনের পাশেই মুর্শিদকুলী খাঁর মহিষী নৌসেরীবানু বেগমের একটি মসজিদ ও তার মধ্যে নৌসেরীবানু বেগমের সমাধি আছে। মসজিদটি নির্মাণ করেন ১৭১৮ সালে নৌসেরীবানু বেগম। মসজিদটির নাম কেউ বলে নৌসেরী বানুর মসজিদ আবার কেউ বলে বেগম মসজিদ। মসজিদটি বিলুপ্তের পথে।
                    কাটরা মসজিদ: মুর্শিদাবাদ শহরের অন্যতম আকর্ষণ কাটরা মসজিদ। নগরীর মধ্যে একটি প্রাচীন অন্যতম মসজিদ। মুর্শিদকুলী খাঁর আরও একটি অমর কীর্তি কাটরা মসজিদ।১৭২৩ সালে মক্কার সুপ্রসিদ্ধ মসজিদের আদলে নির্মিত কাটরা মসজিদ।মোরাদ ফরাস নামে তাঁর একজন স্থপতিকে ওই মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করে ছিলেন। স্থপতি মোরাদ ফরাস মাত্র ১৭২৩-১৭২৫ সালের মধ্যে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করেন।১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ মৃত্যু বরণ করলে তাঁর পূর্ব ইচ্ছে অনুযায়ী মসজিদের সিঁড়ির নিচে কবরস্থ করা হয়।১৭৮০ সালে হোজেস নামের পরিব্রাজকের মতে এখানে ৭০০ জন কারী এক সঙ্গে বসে কোরআন পাঠ করতেন। এবং তার ব্যয় ভার ছিল কাটরা বাজারের আয় থেকে।১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কাটরা মসজিদের গম্বুজ ও অন্য অংশের ক্ষতি হয়। এখানেএকটি সুবিশাল শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এবং যা দেখে সবাই অবাক হতেন।
                    মহিমা পুর ও টাঁকশাল:১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকার জাহাঙ্গীর নগর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সেই সময় জগৎ শেঠ বংশের পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদও মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। তিনি ছিলেন হীরা নন্দের পুত্র। হীরা নন্দের সাত ছেলে নানা স্থানে ব্যবসা করতেন। মানিক চাঁদের ব্যবসা ছিল বাংলায়। তাঁর ব্যবসা মূলত মহাজনী ও হুন্ডির। মহিমা পুর টাঁকশালের পরিচালনার দায়িত্ব পান মানিক চাঁদ।১৭১৫ সালে দিল্লির বাদশা ফারুকশিয়ার তাঁকে শেঠ উপাধি প্রদান করেন।সুবা বাংলার উত্থান ও পতনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে এই খল নায়ক জগৎ শেঠের নাম।
                   সপ্তদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় মাড়ওয়ার থেকে এই বংশের অন্যতম আদি পুরুষ হীরা নন্দ সাহু পাটনাতে আসেন এবং আর এক বেনিয়া ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কুঠি গড়ে তুলেন। তাঁর বড় ছেলে জাহাঙ্গীর নগরে একটি কুঠি স্থাপন করেন। জাহাঙ্গীর নগর তখন বাংলার রাজধানী মানিক চাঁদের উত্তরাধিকারী ফতে চাঁদ ১৭২২ সালে নবাবদের নিকট থেকে জগৎ শেঠ উপাধি লাভ করেন। মুর্শিদকুলী খাঁর দারোগা রঘু নন্দনের মৃত্যু হলে ফতে চাঁদ নবাবের ব্যাঙকার হন।জগৎ শেঠের আদি বাড়ি ছিল মহিমা পুরে।যা এখন ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। অতীতের গৌরব আজ ধূলিসাৎ। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে ইদ্রপুরীতুল্য রাজপ্রাসাদ।
                   খাজা খিজির: খোয়াজ খিজির বা খোয়াজ পরির কাহিনি আরবি লোক প্রবাদ থেকে শোনা যায়। খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে আরব দরবেশ ইব্রাহিম ইবন অহদম তাঁর সুফি সাধনায় এই অলৌকিক পুরুষের কথা প্রচার করেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী খোয়াজ হলেন জলের মালিক। সঞ্জীবন বারি পান করে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী ও সিদ্ধকাম মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি নদী- সমুদ্রে ঝঞ্ঝা আনেন আবার ভক্তকে উদ্ধারও করেন। অনেকের মতে নবী ইলিয়াস ইহুদীদের কাছে যিনি এলিজা নামে পরিচিত, তিনিই এই রূপক চরিত্রে পরিচিত হয়েছেন। এনিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়।নদ- নদী এবং সমুদ্র মধ্যে বিপন্ন নাবিকদের রক্ষা করে বলে জনসাধারণের বিশ্বাস, বিশেষ করে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে।ঢাকার নবাব মকরমখাঁর সময়ে বাংলার মুসলমান এই অনুষ্ঠানের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ জানতে পারে। পূর্বে এই পর্ব অতি সমারোহে পালিত হত।আজও লালবাগ কেল্লার সামনে ভাগীরথী তীরে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এই উপলক্ষে কলা গাছের প্রকাণ্ড আলোকজান প্রস্তুত হয়। তার উপর নানা বর্ণের রঞ্জিত এবং কাগজে ও অভ্রে সুশোভিত করে। এই উৎসব বেরা নামে পরিচিত। ধারণা করা যায় লালবাগ শহরে এই উৎসবের প্রচলন করেন মুর্শিদকুলী খাঁ।
                   তোপখানা ঘাট: বাংলার রাজধানী ও মুর্শিদাবাদ শহর রক্ষার জন্য কাটরার দক্ষিণপূর্বে গোবরানালা বা কাটরা ঝিল ঘেঁষে একটি অস্ত্রাগার তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খাঁ। এখনও জাহানকোষা কামান অতীতের নবাবী প্রতাপের নীরব সাক্ষীস্বরূপ একটি বেদীর উপর দৃশ্যমান।কামানটি অষ্টধাতুর নির্মিত। বাংলাদেশের কুলাউড়ার জনার্দন কর্মকারের খ্যাতি ছিল উপমহাদেশ ব্যাপী। মোঘল যুগে কুলাউড়ায় সমরাস্ত্র বন্ধক কামান তরবারি তৈরি হত।
                   প্রাচীন সমরাস্ত্রের এবং আধুনিক সমরাস্ত্রের গতি- শক্তি নিয়ে কথা উঠতেই পারে। কিন্তু এখন যেরূপ যুদ্ধের ব্যুহ সাজানো হয়ে থাকে, প্রাচীন কালেও সেরকম ব্যুহ সাজানোর নিয়ম চালু ছিল।যিনি ব্যুহ সাজান তাকে মহাব্যুহপতি বলা হত।
                  মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা কামান তৈরি করার সময় নিযুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগরের দারোগা শের মহম্মদের ও পরিদর্শক হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে প্রধান কর্মকার জনার্দন দ্বারা অক্টোবর মাসে ১৬৩৭ খ্রীষ্টব্দ নির্মিত হয়েছিল। এই তোপের ওজন ২১২ মন এবং অগ্নিসংযোগ করতে ২৮ সের বারুদের প্রয়োজন হতে।
                  বুধুরি গ্রাম: ভগবানগোলার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই ভগবানগোলার নিকটেই বুধুরি গ্রাম। এখানেই রামচন্দ্রে ও গোবিন্দ বসবাস করতেন। রামচন্দ্র ধর্ম প্রচারের জন্য দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। গোবিন্দ প্রথমে শক্তি- উপাসক ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো শাক্ত পদে কথা জানা যায়।পরে রামচন্দ্রের অনুরোধে শ্রী নিবাস আচার্য বুধুরিতে এসে গোবিন্দকে দীক্ষা দেন। তিনি চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। ছিলেন।বুধুরি- বিলাস মতে গোবিন্দ দাস ১৫৩৫ শকাব্দে পরলোকগমন করেন।
                  কুমোরপাড়ার রাধামাধব মন্দির: সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়াতেই মতিঝিলের পূর্ণ পাড়ে শ্রীজীব গোস্বামীর শিষ্যা হরিপ্রিয়া ঠাকুরানী রাধামাধব মন্দির স্থাপন করেন। এবং এই মন্দিরে রাধামাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠান করেন। সাবেকি আমলের মাধবীকুঞ্জ বৃক্ষটি এখনও কালের সাক্ষী বহনকারী হিসেবে দৃশ্যমান।কথিত আছে, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাকি নিষিদ্ধ খাবার (গোমাংস?) ভর্তি পরাত সেবাইতের নিকট পাঠান।পরাত বাহক সেবাইতকে জানায় নবাব দেবতার ভোগ পাঠিয়েছেন।পরাতের ঢাকনা তুলে দেখা গেল পরাত ভর্তি ফুল।বাহক এই ঘটনা নবাবকে জানান এবং নবাব নিজেই সেবাইতের নিকট আসেন। অলৌকিক ঘটনা দেখে মন্দিরের জন্য নিষ্কর জমি দান করেন। তবে এর সত্যতা কতদূর সত্য তা জানা যায় না।
                    গ্রামের নাম কুমোর পাড়া। মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ থানার অন্তর্গত প্রান্তিক একটি ছোট গ্রাম। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণে বহরমপুর যাবার পথে মাত্র দেড় -দুই কিমি দূরে। লালবাগ শহরের অদূরে অন্যতম আকর্ষণ রাধামাধব মন্দির। এই মন্দির মতিঝিলের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত।মন্দিরে গেলে একদণ্ড বসলেই শান্তি পাওয়া যায়।
                  নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁ: লালবাগ মুর্শিদাবাদের একটি জনপ্রিয় শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই শহরের জনপ্রিয়তা কেবল তার প্রাচীন প্রকৃতির জন্য নয়। বরং বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষী এর প্রাচীন স্থাপত্য শিল্প নিদর্শনগুলি। বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। লালবাগে নবাবী আমলে বিশেষ স্থাপত্য শিল্পের বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে এই শহরের ইমারতগুলি আজও মরে বর্তে টিকে আছে। আগেই বলা হয়েছে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন ধর্মপ্রাণ নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ। মুর্শিদকুলী খাঁর মৃত্যুর পর নবাব হন তাঁর জামাতা সৌখিন নবাব সুজাউদ্দিন। তিনি প্রকৃত নবাব ছিলেন। অতঃপর বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব হন তাঁর পুত্র নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁ। তিনি ১৭৪০ খ্রীষ্টব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে আলিবর্দী খাঁর অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রেই শহিদ হলে তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র মীর্জা আমানী খাঁ মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের সন্নিকটে নাটকাখালি (অধুনা নাগিনাবাগ) নিয়ে এসে রাতারাতি সমাধিস্থ করেন। এতদিন ধরে সমাধিটি জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ধ্বংসের প্রহর গুনছিল। উল্লেখ্য, নবাবের স্মৃতি বিজড়িত ফুটি মসজিদ তাঁর মৃত্যুর কারণে আজও অসমাপ্ত রয়েছে। মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ এন্ড কালচারাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি পুনঃসংস্কার করার জন্য ২০১২ সাল থেকে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলা শাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ এন্ড কালচারাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে দখল মুক্ত করে এবং সোসাইটির আর্থিক সহায়তায় পুনঃ সংস্কারের কাজ শেষ করে (০৫ অক্টোবর ২০২১ মঙ্গলবার) তার শুভ উদ্বোধন করে। এখন থেকে ভ্রমণ পিপাসু বন্ধুরা স্বচ্ছন্দে শহিদ নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁর সমাধি পরিভ্রমণ করতে পারবেন।
                   নাগিনাবাগ ইতিহাস প্রসিদ্ধ একটি জনপদ।নাগিনাবাগ মুর্শিদাবাদ থানার অন্তর্গত। এই জনপদের পূর্ব নাম ছিল নাকটাখালি বা নৃক্তাখালি।১৭৪০ খ্রীষ্টব্দের পর থেকে এই স্থানের নাম হয় নাগিনাবাগ।গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁ নিহত হলে, এই প্রাসাদ থেকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে( ১৭৪০-১৭৪৪ ) বন্দী করে রাখেন আলিবর্দী খাঁ। প্রত্যেকের মাসহারা ধায্য ছিল।নাগিনাবাগে ১৭১৭ খ্রীষ্টব্দে নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁর মাতা জিন্নাত- উ-ন্নিসা বেগম একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মতান্তরে সরফরাজ খাঁর সহধর্মিণী এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। গম্বুজ ছিল তিনটি। প্রবেশ পথ তিন এবং এই মসজিদটির নাম বেগম মসজিদ নামে পরিচিত ছিল।যা আজ জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ধ্বংসের প্রহর গুনছে।
                  ফুটি মসজিদ: কাটরা মসজিদের পশ্চিম দিকে কুমারপুর জনপদে একটি অসমাপ্ত মসজিদ আছে। গম্বুজ সংখ্যা পাঁচ। প্রবেশ পথ পাঁচ। আয়তন  দৈর্ঘ১৩০ প্রস্থ ৩৮ উচ্চতা ৪০ ফুট। জরাজীর্ণ অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি ফুটি মসজিদ নামে প্রসিদ্ধ। নবাব সুজা- উদ-দ্দৌলার জ্যেষ্ঠ্য পুত্র হতভাগ্য নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁ( সরফরাজ খাঁর পূর্ব নাম ছিল মির্জা আবদুল্লা) এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করিয়েছিলেন। কিন্তু মসজিদটির নির্মান শেষ করতে পারেন নি।গিরিয়ায় আলিবর্দী খাঁর অতর্কিত আক্রমণে পরাজিত বা নিহত হন।সমরাঙ্গনে যোদ্ধাবেশে মৃত্যু বরণ করেন একমাত্র নবাব নাজিম সরফরাজ খাঁ। তারপর শুধুই হাহাকার।ফুটি মসজিদদের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রইল। নবাব এসেছেন কিন্তু অসমাপ্ত কাজ কেউ- ই সমাপ্ত করেন নি। তার কারণ,হয় ব্যক্তিস্বার্থ বা অর্থাভাব। নবাব আলীবর্দী খাঁ এবং সিরাজ ছিলেন শত্রু বেষ্টিত। বিভিন্ন সময়ে অন্যায় যুদ্ধ মোকাবেলা করতে সময় অতিবাহিত করেছেন।সিরাজের পর বাকি নবাবরাতো ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল নবাব।আর সরফরাজ খাঁর বংশের কথা ভাবাই যায় না। তার বড় কারণ হলো, তাঁর বংশের সদস্যদের বন্দী জিঞ্জিরা প্রাসাদে অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে।ফলে,ফুটি মসজিদ বাংলার নাজিম নবাবদের থেকে শুরু করে পুতুল নবাব সকলেই মনোযোগী হতে পারেন নি। হতভাগ্য নবাব সরফরাজ খাঁর অসমাপ্ত মসজিদ আজও অবহেলার ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে।কেউ দেখার নেই। পুরাতত্ত্ব বিভাগ যদি অধিগ্রহণ করে  সংস্কার করত তাহলে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো,করতোই।
                    বাহাদুর আলি খাঁর চৌরাস্তা: লালবাগ সাব রেজিস্ট্রার অফিস ও সাব জেলখানার নিকটে চারদিক থেকে চারটি রাস্তা এসে মিলিত হয়েছে। এই চৌরাস্তার নামই বাহাদুর আলি খাঁর চৌরাস্তা। চৌরাস্তা থেকে রাজধানী বা ত্রিপুলিয়া গেটের দিকে যেতে চৌরাস্তার মোড় সংলগ্ন এলাকায় একটি প্রাচীন অন্যতম মসজিদ আজও বিদ্যমান। মসজিদের উৎকীর্ণ ফলকে লেখা আছে এই মসজিদের নির্মাণ কাল__ ১৭৬৬ খ্রীষ্টব্দ। জনৈক মহম্মদ আমীর এই মসজিদ সেখ কুলীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত।
                    ভট্টবাটির রত্নেশ্বর মন্দির: ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের অদূরেই নবগ্রাম থানার নারিকেল বাগান গ্রামের পার্শ্বস্থ ভট্টবাটি এক প্রাচীন জনপদ। সাবেকি ভট্টবাটি এখন ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে।এক সময় জনপদটি সব দিক থেকেই সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিল। ভট্টবাটির রত্নেশ্বর মন্দির প্রাচীন কালের অতি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। ইটের খাঁজে ধরা পড়ে টেরাকোটা কাজের শৈল্পিক কৌশল। লালবাগ কোট স্টেশন থেকে প্রায় তিন কিমি পশ্চিমে ভট্টবাটি জনপদেই মন্দিরটি আজও দণ্ডয়মান। এই মন্দিরের টেরাকোটা কাজ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।কেউ কেউ বলে থাকেন, মন্দিরটি ছোট হলেও টেরাকোটা কাজের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। মন্দিরের সামনে শান বাঁধানো কালী সাগর নামে একটি পুকুর আছে। পুকুরের উত্তর কোনে আরও একটি মন্দির আছে। মন্দিরটি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অধিগ্রহণ করে তার কাঁটার বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। তবে দর্শণার্থীদের প্রবেশ অবাধ। আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়াতেই নির্মিত হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের টেরাকোটার উল্লেখ মাত্রই যে মন্দিরটির নাম প্রথমে মনে পড়ে সেটা হল ভট্ট বাটির রত্নেশ্বর মন্দির। বস্তুত টেরাকোটা মন্দির হিসেবে জেলাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
                 নবাব সিরাজউদ্দৌলা নির্মিত হিরাঝিল প্রাসাদ: নবাবদের নানা কীর্তি লালবাগের বাতাসে কানাকানি করে বেড়ায়। সিরাজউদ্দৌলা নিজের জন্য ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে ডাহাপাড়ার নিকটে একটি সুরক্ষিত প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন হিরাঝিল। ভাগীরথীর পাড় ভাঙার ফলে সিরাজের সাধের হিরাঝিল অনেক আগেই নদী গর্ভে সলিল সমাধি হয়েছে। কিন্তু মুদ্রিত ইতিহাস ও লোক পরম্পরায় লোককথায় থেকে গেছে কিছু স্মৃতি।সিরাজ ওই প্রাসাদে নবাবী ও সাহেবীয়ানায় দিনযাপন করেছেন।ইরাক ও ইরান থেকে নানা ফুল নিয়ে এসে সাজিয়েছিলেন।যা আজ জঙ্গলাকীর্ণ বা ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে।
                   হিরাঝিল প্রাসাদকে মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ ও লালা কুঠিও বলা হয়ে থাকে। এই প্রাসাদের বাইরের রং লাল ছিল তাই লাল কুঠি বলা হত। মৌজার নাম মনসুরগঞ্জ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা শুধু হিরাঝিলই নির্মাণ করেননি। শত্রু সৈন্য বেষ্টনীর মধ্যে থেকেও অনেক কীর্তি রেখেছেন। তাঁর আমলে নির্মিত মদিনা মসজিদটি আকারে ছোট হলেও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত। হাজার দুয়ারি সংলগ্ন একটি মসজিদ ১৭৫৪ সালে নির্মাণ করেন সিরাজউদ্দৌলা। মসজিদের গম্বুজ তিন, প্রবেশ পথ তিন, আয়তন পঁচিশ ফুট লম্বা পনেরো ফুট উচ্চতা পঁচিশ ফুট চওড়া। রং হলুদ। নাম জরুদ মসজিদ। অটুট আছে।
                   সিরাজের নাম ছিল মনসুর- উল- মুলক। সেই জন্য এই প্রাসাদের নাম করণ করেন মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ। দাদু আলিবর্দী হিরাঝিলের কাছে গঞ্জ প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেন ও সেখান থেকে বছরে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা আয় হত। সেই অর্থে মনসুরগঞ্জ প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলত। সিরাজের জন্ম: ১৭৩৩ খ্রীষ্টব্দ মতান্তরে ১৭৩২ । মৃত্যু: ২ রা জুলাই ১৭৫৭ ।
                  মোরাদ বাগ প্রাসাদ: হিরাঝিল প্রাসাদের ঢিল ছুঁড়া দূরত্বে ছিল মোরাদ বাগ প্রাসাদ। এখানে ক্লাইভ এবং কোম্পানির কোন কোন রেসিডেন্টও বাস করেছেন। এই প্রাসাদও ছিল সৌন্দর্যে মোড়া।হিরাঝিলের মতোই এই প্রাসাদের কোন অস্তিত্ব নেই। ধ্বংসাবশেষের ছড়ানো ছিটানো উপাদান গুলোও আর দেখা যায় না।
                 আমানীগঞ্জের ঘাট: সরফরাজ খাঁর পূর্ব নাম ছিল মীর্জা আবদুল্লা। মীর্জা আবদুল্লা ওরফে সরফরাজ খাঁর পুত্র হাফিজ উল্লা খাঁ ওরফে মীর্জা আমানী খাঁ। মীর্জা আমানী খাঁর নামানুসারেই এই জায়গা বা ঘাটের নাম হয়েছে আমানীগঞ্জের ঘাট।নবাবী আমলে আমানী গঞ্জ ছিল হিন্দুদের শ্মশান ঘাট এবং মুসলমানদের গোরস্থান। তৎকালে এই নিয়ে একটা প্রবাদ ছিল__ এখানকার মহিলারা কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়ে বলতে, ' আমানীগঞ্জে যা' ।যার অর্থ দাঁড়ায় তোরা 'মর্' এবং আমানী গঞ্জের গোরস্থানে বা শ্মশানে যা। এই সময়ে আমানী গঞ্জ ঘাট ছিল উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক কেন্দ্র। প্রসঙ্গত,গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজখাঁকে আলিবর্দী খাঁ পরাজিত করে মসনদ দখল করেন। এবং ১৭৪৪ খ্রীষ্টব্দে সরফরাজ খাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যদের সঙ্গে হাফিজ উল্লাখাঁকেও ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। সেখানে আমানী মীর্জা বন্দী হয়ে দিন কাটিয়েছেন। বিচক্ষণ আমানী মীর্জা তাঁর অন্য ভাইদে এইর চেয়ে নির্ভিক প্রকৃতির ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহসিক নবাব পুত্র। মীরজাফর আলী খাঁ তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে উপবিষ্ট। মীরজাফরের দারুন অর্থাভাব,ঢাকার রাজকোষ একেবারে শূন্য। সৈন্যদের ভাতা দিতে পারছেন না। ওই সুযোগে বিশ্বস্ত বন্ধুদের সাহায্যে ১১৭৫৭ খ্রীষ্টব্দে তিনি নবাব জেসরৎখাঁকে নিহত করে ঢাকার নবাবীপদ দখল করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি ২২ অক্টোবর তারিখে অতি গোপনে জিঞ্জিরার বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে লালবাগের  ( ঢাকা) দুর্গ আক্রমণ করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনার খবর পৌঁছে যায় জেসরৎ খাঁর কানে। এবং জেসরৎ খাঁ তাঁর পরিকল্পনা ভেস্তে দেন। তারপর আমানীগঞ্জ শুধুই ইতিহাস।আগের মতো জৌলুস না থাকলেও আমানী গঞ্জ ঘাট সর্বজনবিদিত।
                   বালুচরের সিল্কের শাড়ি: ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত বালুচর একটি জনপদের নাম।। কথিত আছে,জিয়াগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল গম্ভীলা বা বালুচর। যাহোক, বালুচরের সিল্কের শাড়ি, রেশম ও তন্তুবায় শিল্পীদের গৌরবময় ঐতিহ্য,সুনাম জগৎ জোড়া।মারাঠা বর্গীরা বালুচর লুট করতে আসলে এখান থেকে প্রতাপ ও প্রভাবশালী নবাব আলীবর্দী খাঁ তাদের বিতাড়িত করেন। বালুচরে ধনী জৈনদের বাস ছিল।মারাঠা বর্গীদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় ছিল রেশম শিল্পজাত নানা রকমের বস্ত্র। এই তন্তুবায়দের বসতি ছিল বেলিয়া পুকুর,বাগডহর ও বাহাদুরপুর এবং রমনা পাড়া প্রভৃতি স্থানে। তন্তুবায় শিল্পীদের মধ্যে উচ্চ শিখরে ছিলেন দুবরাজদাস চামার।মীরপুর জনপদটি ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এই মীরপুর ছিল দুবরাজদাস চামারের আদি নিবাস। এই মীরপুর গ্রাম থেকে চলে এসে বাহাদুরপুরে বসবাস করতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই ছিলেন। এহেন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর বংশ পরিচয় পাওয়া যায়নি।
                  রেশম সুতোর এই শাড়ির আঁচলার বিন্যাস চারকোণা। চারদিকে খোপে খোপে সাজানো বিচিত্র নকশা থাকে।হাতি, ঘোড়া,শোয়র, পুরুষ, লতাপাতা, মন্দির, মসজিদ, মহিলা,জাহাজ ও রেল গাড়ি এবং গরুর গাড়ি ইত্যাদি। এছাড়াও দরবারী ছবিও শাড়ির আঁচলায় স্থান পেত। বালুচরেই  রেশমের শাড়ি বোনার  পর নানা নকশার কাজ বসিয়ে যে শাড়ি তৈরি করা হত তাই- ই বালুচরী শাড়ি। শাড়ির উপর যে নকশা করা হত তারও নাম দেওয়া হতো।যেমন: আশারুপী নকশা,গুনবাহার নকশা ও কল্কা বুটিদার নকশা। চরকায় কাটা সুতো সাধারণ তাঁতে মাকুর সাহায্যে বালুচরী শাড়ি বোনা হত।তাঁত যন্ত্রটিও খুব জটিল ছিল। যেমন তেমন কারিগরের দ্বারা যন্ত্রটি তৈরি করা সম্ভব ছিল না। যন্ত্রটি তৈরি করতে পাকা কারিগরের ডাক পড়ত।
                     মহারাজা রাজবল্লভ: রাজনগর অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ- পশ্চিমে প্রায় ২৭ মাইল দূরত্বে অবস্থিত ছিল।যা এখন কীর্তিনাশা পদ্মার গর্ভে পতিত হয়েছে। এই রাজনগরে পূর্ব নাম ছিল বিলদাওনীয়া। রাজবল্লভ ছিলেন সিরাজুদ্দৌলার কয়েক জন সেনার মধ্যে একজন। ইতিহাসের পাতায় খল নায়ক হিসেবে তাঁর নাম স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে আছে। রাজবল্লভ এই জায়গায় রাজপ্রসাদ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদের কক্ষ গুলোর নাম ছিল নিম্নরূপ: রঙ্গমহল, নবরত্ন, পঞ্চরত্ন, সপ্তদশরত্ন ও একুশরত্ন। তখন এই স্থান ধনে,জনে,বিদ্যায় সম্ভ্রমে সমৃদ্ধ ছিল। এই খলনায়ক সিরাজুদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পুতুল নবাব ও ইংরেজদের কাছে থেকে মোহরের পদ এবং তাঁদের দয়ায় ঢাকার ও পাটনার সুবাদারী পদও লাভ করেছিলেন। একসময় নবাব মীরকাসেমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়ালে রাজবল্লভের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।পলাসী যুদ্ধের কয়েক জন খলনায়কদের মধ্যে রাজবল্লভ একজন। তবুও তাঁর নাম খুব একটা প্রকাশ্যে আসেনি।
                   কদমশরীফ: ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ জেলার সেবাত্বের সাক্ষী কলম শরীফ। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের এক কিমি পূর্বে খোজা বসন্ত আলীর তৈরি কয়েক একর জমির ওপর সেবা কেন্দ্রটি অবস্থিত। মীরজাফর আলী খাঁর রাজত্বকালে ১৭৮১ খ্রীষ্টব্দে এই মসজিদ, কদমরসুল,ও নঙ্গরখানাটি নির্মাণ করেছিলেন বসন্ত আলী খাঁ। এখানে পড়াশোনা এবং এতিম দুঃখিদের খাওয়ানোর সুবন্দোবস্ত ছিল। আকারে ছোট হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এর জৌলুস কম ছিল না।এর খিলান ও গম্বুজ গুলো অতি চমৎকার ছিল। সাবেকি মসজিদের সামনে সংযোজন করে মূল মসজিদের লোপ পেয়েছে। মহরমের সময় এখানে বহু লোকের আগমন ঘটত। এবং খিলানের ওপর নহবত বাজত।জনশ্রুতি আছে, এখানে বিশ্বনবী হজরত মহম্মদের পায়ের ছাপ অঙ্কিত পাথর রয়েছে। কথিত আছে,খোজা নির্মাতা গৌড় থেকে এখানে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত করেন। একসময় সিয়াদের অধিকারে থাকলেও এখন সুন্নীদের তত্ত্বাবধানে আছে। এখানে বেশ কিছু সংখ্যক কবর দৃশ্যমান। কবরগুলোর অবস্থা এতই শোচনীয় যে- কেউ দেখলেই দু'ফোটা চোখের পানি পড়বে। অন্তত কবরগুলোর সরকারি বা বেসরকারি ভাবে সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুন। কবর চত্বরে একটি কুয়োর ভগ্ন দশা পরিলক্ষিত হয়। কবরের দক্ষিণ পাশে তালাবদ্ধ ছোট কক্ষ আছে।পাথর ফলকে খোদাই করা আরবি- ফার্সী বর্ণমালায় উৎকীর্ণ আছে। প্রবেশ করার চেষ্টা করেও লেখক ব্যর্থ হয়েছে। চাবির জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে, ' চাবি কোথায় আছে জানি না।' এই রকম অজুহাত দেখানোর জন্য রসুলের পায়ের ছাপ অঙ্কিত পাথর যে ঘরে আছে তাও দেখা হয়নি। একসময় এটি একটি পূণ্যস্থান ছিল মুসলমানদের কাছে। কদমশরীফ সংলগ্ন উত্তর দিকে একটি সুরম্য সিঁড়িযুক্ত পুষ্করিনী মরে বর্তে আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। আনুমানিক এই স্থাপত্যগুলো ২০০ বছরের প্রাচীন। বসন্ত আলী খাঁ সারা জীবনের যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন সেই অর্থ ব্যয়ে এই স্থাপত্যগুলো নির্মাণ করেন।
                 কাসিম বাজার: যব চার্ণক প্রথমে কাসিম বাজারে এসে ইংরেজ কুঠিতে জন কেন্ সাহেবের অধীনে বাৎসরিক ২০ পাউন্ড বেতনে কাউন্সিলের চতুর্থ সভ্যপদে নিযুক্ত হন। সেসব কথা ঢাকার জাহাঙ্গীর নগর থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী গড়ে ওঠার কয়েক শতক বছর পূর্বের।
                   ইংরেজকুঠির জন্য কাসিম বাজার বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৬৫৮ সালের মাঝামাঝি ইংরেজরা এখানে কুঠি স্থাপন করে। ইংরেজরা এখানকার রেশম শিল্প সম্বন্ধে বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠেছিল। কাসিম বাজার সংলগ্ন  ফরাসডাঙ্গা বা সৈয়দা বাদ এলাকায় ফরাসিদের আস্তানা ছিল। এবং এখানে ফরাসি আর্মেনিয়ানদেরও কুঠি ছিল।কালিকাপুরে ডাচদের। এদের বানিজ্যের প্রধান বস্তু ছিল রেশম।
                   কাসিম বাজারে ইংরেজদের একটি নীল কুঠি ছিল। জায়গাটির নাম ছিল নীল কুঠির মাঠ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরিকল্পনার আঁতুর ঘর নামে সুপ্রসিদ্ধ। কাসিম বাজারে ছোট ও বড় দু'টি রাজবাড়ি এখনও বিদ্যমান।ততসংলগ্ন প্রচুর কবর, গির্জা, মন্দির, মসজিদ দেখা যায়। কথিত আছে,এত অট্টালিকা ও প্রাসাদ ছিল যে কাসিম বাজার থেকে আকাশ দেখা যেত না।যা আজ কালের গর্ভে মুখ লুকিয়েছে। পলাশীর যুদ্ধের পরিকল্পনার আঁতুর ঘর যে স্থানকে বলা হয় তাও ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। কেবল একটি সাইনবোর্ডে উৎকীর্ণ আছে নীল কুঠির মাঠ।এ-ও কথিত আছে, এই কুঠি থেকে সিরাজের তাড়া খেয়ে ওয়াটস সাহেব ও ওয়ারেন হেস্টিংস কান্ত মুদির দোকানে গিয়ে পান্তাভাত এবং কুচোচিংড়ি দিয়ে দুপুরের খাবার খান। কান্তমুদির দ্বারা রক্ষা পেয়ে ওঁরা কান্তমুদিকে পুরস্কৃত করেন।
                   কাসিম বাজার সংলগ্ন বানজেটিয়াতে জেটি বা বন্দর ছিল। ঘাঁটগুলো শিবপুর ভাটপাড়া, শ্রীপুর,ব্যাসপুর, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। এই বন্দরের জন্য (১৬৩০-১৬৩২ ) কাসিম বাজার বানিজ্যের দিক থেকে আরও এগিয়ে যায়। বাবুল বোনা রোডে ইংরেজদের বহু কবর আছে। কাসিম বাজার বহরমপুর থানার ১০২ নাম্বার গ্রাম। গ্রামের আয়তন ৬৮৬.৬১ একর। রাজস্ব জরিপ মতে ৮ নাম্বার গ্রাম। রাজস্ব জরিপের পর৮ ও ৪৭ নাম্বার গ্রাম একত্রিত ভাবে বর্তমান কাসিম বাজার।
                   কাসিম বাজার সংলগ্ন কাটিগঙ্গার পশ্চিম তীরে পাতালেশ্বর মন্দির। এবং এই ঘাটকেই সতীঘাটও বলে। কথিত আছে, এই ঘাটে স্বামীর চিতায় কত জীবন্ত নারীদের দাহ করা হয়েছে। মন্দিরের পরিবেশ খুব মনোরঞ্জক। একদণ্ড বসলেই শান্তিতে মন ভরে উঠে।শান বাঁধানো ঘাট। বসার জন্য সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বেঞ্চ আছে। এই মন্দিরে এখনও পূজা অর্চনা হয়।
                  ফরাসডাঙ্গা: সাবেকি ফরাস ডাঙ্গার এখন আর কিছুই নেই।থাকা বলতে প্রাচীন ফরাস ডাঙ্গা নামক গ্রাম ও ঘেরি ঘাটটি। এই দু'টোই ফরাস ডাঙ্গার স্মৃতি বহন করছে।১৭৪০ খ্রীষ্টব্দের গোড়ার দিকে ফরাসডাঙ্গায় ,ফরাসীরা কুঠি স্থাপন গড়ে তোলার জন্য সনদ প্রাপ্ত হন । মুর্শিদাবাদের দক্ষিণ- পশ্চিমে প্রায় তিন মাইল দূরত্বে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে ফরাসীদের কুঠি ছিল। সম্ভবত ফরাসীদের কুঠি স্থাপনের পর থেকে এই স্থানের নাম ফরাসডাঙ্গা হয়েছে। কুঠির অধ্যক্ষ যোসেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লের হাত দিয়ে ফরাসীদের ফরাসী ব্যবসার উন্নতি সাধন হয়েছিল। বানিজ্যিক জিনিস পত্র হিসেবে তাঁরা চিনি,আফিং, লঙ্কা, সুতি কাপড়,তুলো, রেশম,রেশম বস্ত্র নিয়ে কারবার করত।  ভাগীরথীর গতি পথ ছিল ফরাসডাঙ্গা, কাসিম বাজার, বানজেটিয়া ,চালতিয়া বিল ,হয়ে ভাগীরথীতে পড়ত।পরে ইংরেজরা ওই পথ বন্ধ করে দিয়ে ফরাসডাঙ্গা থেকে এখনকার সোজা পথে ভাগীরথীকে বইয়ে দেয়।
                 মতিঝিল: শুধু ভারতের নয়,জল বিশ্ব সংস্কৃতির অঙ্গ।জলে জন্ম,জলেই লয়।মানব সভ্যতার ও সংস্কৃতি যে ধারা অবলম্বন করে এগিয়েছে তাকে ধারণ করেছে, নির্ধারণ করেছে জল।অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষায় জলাধার এবং জলাভূমির উপযোগিতা বিশাল। মতিঝিল এমনই একটি অশ্বখুরাকৃতি জলাশয়। অবশ্য এই জলাশয়ে মুক্ত চাষ করে অর্থ উপার্জন করত এবং বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাত। এখানে সাংহী দালান নামের প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন নবাব মহম্মদ নওয়াজেস খাঁ। নবাব আলীবর্দী খাঁনের জামাতা। অর্থাৎ নবাব কন্যা মেহেরুন্নেসা বেগমের স্বামী। মেহেরুন্নেসা বেগম ঘসেটি বেগম নামে পরিচিত সর্বজনবিদিত। মতিঝিলের সৌন্দর্য দেখে বিদেশি ভ্রমণকারি টিফেনথ্যালার তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করতে বিস্মৃত হননি। ভাগীরথীর একটা প্রাচীন বাঁক বা খাত থেকে মতিঝিলের উৎপত্তি। সিরাজের আপন চাচা নবাব মহম্মদ নওয়াজেস ১৭৪৩( মতান্তরে ১৭৫০) সালে যে সাংহী দালান নির্মাণ করেন তা আজ তার ধ্বংসাবশেষের স্তুপ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তাঁর নির্মিত মসজিদটি অটুট আছে। এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। এবং ঘসেটি বেগমের পোষ্যপুত্র ( বোনপো) একরামউদ্দৌলার ( সিরাজের ভ্রাতা) কবর দৃশ্যমান। ঘসেটি বেগম এই প্রাসাদে বসবাস করতেন। তাঁর গুপ্তধনাগারটি পরিলক্ষিত হয়। সিরাজ ও ঘসেটি বেগমের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হলে এই প্রাসাদ থেকে ঘসেটি বেগমকে চেহেল সেতুনে বন্দী করে রাখেন সিরাজউদ্দৌলা। নবাব মহম্মদ নওজেস খাঁ ঢাকার সুবেদার ছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই মতিঝিলে পাকাপাকিভাবে বসবাস করেন। মতিঝিল প্রাঙ্গণের মসজিদটির সৌন্দর্য নজর কাড়ে। মসজিদে তিনটি গম্বুজ, চারদিকে চারটি লম্বা লম্বা মিনার ও তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে।পেছনেও রয়েছে দু'টি মিনার। মসজিদের জন্য ছোট ইট ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। কথিত আছে, সিমেন্টের পরিবর্তে কলাইয়ের আটা,খড়িমাটি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে। দৈর্ঘ ১৬ মিটার ও প্রস্থ ১০ মিটার এবং উচ্চতায় ১০ মিটার। সারিবদ্ধভাবে পাপড়ি আকারের পঙ্খ শিল্পের কাজ বা অলঙ্কারে সুসজ্জিত। মসজিদটি কালা মসজিদ নামে পরিচিত। মতিঝিল,জে এল নাম্বার ৪২ । মুর্শিদাবাদ থানা।
                     মীর মদন খাঁর সমাধি: অভিশপ্ত পলাশীর লক্কাবাগে যুদ্ধের সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলা পক্ষের বীর ও বিশ্বস্ত সৈনিক মীর মদন খাঁ। পলাশীর যুদ্ধ চলাকালীন বেলা বারোটার সময় সৈন্য চালনার সময় মীরমদনের পায়ের উপর ইংরেজ কামানের একটি গোলা এসে পড়ে। এবং বীর মীরমদনের পা ভেঙে যায়। অতঃপর আহত বীর সেনাপতিকে তুলে সিরাজুদ্দৌলার শিবিরে আনা হয়। বিশ্বস্ত সেনাপতি তাঁর নবাবকে যুদ্ধের বিবরণ দিতে দিতে শাহাদাত বরণ করেন। এবং বীর যোদ্ধা সেনাপতির মৃত্যুতে সিরাজ ভেঙে পড়েন। সেদিন পলাশীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে কয়েকজন নবাবী ফৌজের সেনানায়ক মারা যান। তাঁদের মধ্যে বিচক্ষণ সেনাপতি মীরমদনের জামাই বদর আলী খাঁ-ও ছিলেন।
                 মীরমদন পলাশীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারা গেলে তাঁকে রেজিনগরের দাদপুরের কাছে ফরিদাতলা গ্রামে কবর দেওয়া হয় ফরিদাতলায় শাহ্- ফরিদের কবরের কাছে।
                বড়নগর: মুর্শিদাবাদ জেলার  জিয়াগঞ্জ থানার ৪০ নাম্বার গ্রাম। গ্রামের আয়তন ৫৬৯.৭১ একর। এই জনপদটি মন্দিরে মন্দিরে ছয়লাপ। বাংলার দ্বিতীয় বারানসি। নাটোরের রানী ভবানীর স্মৃতি ও কীর্তি বিজড়িত বড়নগর। জনপদটি আজও ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে আজিমগঞ্জ শহরের এক মাইল উত্তরে অবস্থিত। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের দেবালয়ের মধ্যে গড়নের আকারে ও প্রাচীনত্বের দিক থেকে স্মরণীয়। এখানে রাজশাহী জেলার নাটোরের রাজ বংশের গঙ্গাবাস ছিল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল এখানকার চারটি একচালা বাংলা-মন্দির যা ' চার-বাংলা ' মন্দির নামে পরিচিত। বিগ্রহ বলতে শিবের মূর্তি।ভবানীশ্বর মন্দির স্থাপত্যের দিক থেকে বাংলার অন্যতম মন্দির। এখানে রানী ভবানীর নির্মিত বহু আছে।যার মধ্যে অনেক মন্দির ধ্বংস মুখে পতিত হয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন দ্বিতীয় বারানসি বানাতে। অধিকাংশ মন্দির ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও চার বাংলা মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। টেরাকোটা কাজের জন্য বিদেশ বিদেশের দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে।
                চক মসজিদ: ১৭৩৩ খ্রীষ্টব্দেমীর চকমসজিদ নির্মাণ করেন নবাব মীর জাফর আলী খাঁর পত্নি মুন্নি বেগম। মসজিদটি চকবাজারে এখন অটুট। নাম চকমসজিদ। এই গম্বুজ ৭, প্রবেশ পথ ৭ টি। আয়তন ২৫×২০×৪৫।
                   মুর্শিদাবাদ শহরের প্রাচীন একটি অন্যতম ঐতিহাসিক মসজিদ। চকমসজিদ সংলগ্ন চেহেল সেতুনে মীরজাফর আলী খাঁর দরবার কক্ষ ছিল। এই চকবাজারে এক সময় চাঁদনি চক বাজার বলা হত। এখানে হীরা জহরত চাঁদি এবং দাসদাসী বেচাকেনা চলত। কথিত আছে, নবাব আলীবর্দী খাঁনের মহীয়সী পত্নি সরফুন্নেসা নাকি এই চাঁদনি চক বাজার থেকে লুৎফুন্নেসাকে ক্রয় করেছিলেন। চকমসজিদ প্রাঙ্গণে একটি বাউলি থাকার ইতিহাস পাওয়া যায় ( বড় কুয়ো যা থেকে এক সঙ্গে অনেক লোক জল উত্তোলন করতে পারত) ।সে বাউলি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মসজিদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চকমসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন মুন্নি বেগম। এবং তৈরি করেন নিজামত তহবিল। নবাব প্রসাদ নিজামত কলেজ ছাড়াও শহরের অনেক রাস্তা, বাঁধ তৈরি করেছিলেন এই নিজামত তহবিলের অর্থ দিয়েই। মুন্নি বেগম অনেক ধনসম্পদের মালিক ছিলেন। এই সম্পদের অনেকটাই পড়েছিলেন তাঁর স্বামী নবাব মীর জাফর আলী খাঁর কাছ থেকে।
                 উল্লেখ, মীরজাফর আলী খাঁ তখন বাংলার নবাব। সিরাজুদ্দৌলার ভাই এক্রামউদ্দৌলার বিয়ে উপলক্ষে দশ হাজার টাকার চুক্তিতে বাইজি বিশুর দল আসেন মুর্শিদাবাদে। এই দলের সঙ্গে আসে মণি বাই।মণিবাইয়ের রুপ এবং নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান নবাব মীর জাফর আলী খাঁ। বিয়ের কাজ শেষ হয় যাওয়ার পর বাইজি বিশুর দলবল যখন মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন, তখন নবাব মীর জাফর আলী খাঁ অনুরোধ করলে মণিকে রেখে চলে যান। কিছুদিন যেতে না যেতেই মণির জায়গা হয় নবাবী হারেমে। অতঃপর মণি হয়ে যান মুন্নি বেগম।১০ জানুয়ারি ১৮১৩ সালে মুন্নি বেগমের মৃত্যু হলে জাফরাগঞ্জ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
                 রোশনী বাগ: মুর্শিদকুলী খার জামাতা সুজাউদ্দিন প্রকৃত বিলাসী নবাব ছিলেন। মুর্শিদাবাদে তাঁর বহু নির্মিত দ্রষ্টব্যস্থান আজও পরিলক্ষিত হয়।যেমন, ত্রিপোলিয়া গেট,দেওয়ানখানা প্রভৃতি। তিনি হাজার দুয়ারী প্রাসাদের সোজাসুজি ভাগীরথীর অপর পাড়ে রোশনী বাগে ফর্হাবাগ নামে একটি ফুল ও ফলের বাগিচা, ঝর্না তৈরি করেন। তাঁর আমলে মুর্শিদাবাদে গান - বাজনা এবং কলম আমের চাষ শুরু হয়েছিল। ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ নবাব সুজাউদ্দিন একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এখানে। মতান্তরে সিপাহসালার আলিবর্দী খাঁ তাঁর মনিব নবাব সুজাউদ্দিনের জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির আয়তন ৩০ বাই ২০ বাই ২০। গম্বুজ ৩টি।নাম রোশনী বাগ মসজিদ। প্রবেশ পথ ৩ টি। মসজিদটি এখন অটুট। এখনকার সুশোভিত উদ্যানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন বিলাসী নবাব সুজাউদ্দিন।
                 হুসনী দালান: মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক লালবাগ শহরে নবাবী আমলের অনেক প্রাচীন কীর্তি বা স্থাপত্যের মধ্যে হুসনী দালান সুপ্রসিদ্ধ। এই স্থানে প্রতি বৃহস্পতিবার বহুলোকের সমাগম হয়।হুসনী দালান কঠোর নিয়মাবলীতে আবদ্ধ।মানত হিসেবে এখানে মাটির ঘোড়া,ধূপকাঠি ও সিন্নি দিয়ে থাকে মানতকারীগণ। এখানে জানা অজানা ক'টি কবর আছে। প্রধান গেট পেরিয়ে ডানে ও বামে দু'টি গৃহ পরিলক্ষিত হয়।ডানের ঘরে আছে মা ফতেমার পাঞ্জা এই ঘরে মহিলা ছাড়া পুরুষের ঢোকা নিষিদ্ধ। বামের ঘরে মানতের সামগ্রী নিয়ে মহিলা, পুরুষ, ছোট-বড় হিন্দু মুসলিম সবার প্রবেশাধিকার রয়েছে। এছাড়াও হোসেন হাসেনের বিষাদ-স্মৃতি শোক চিহ্ন কৃষ্ণবস্ত্রের আবৃত করে সিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানগণ জারি গান সমবেত কণ্ঠে গেয়ে থাকেন। ইমাম বাড়ার মত এখানেও হোসেন হাসেনের প্রতীকী কবর রয়েছে। প্রতীকী কবরের পাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করে। উল্লেখ, আমি ওখানে যেদিন গিয়েছিলাম__ সেদিন শিক্ষিতা যুবতী মেয়েরা ও গায়ক সম্প্রদায়ক হোসেন হাসেনের সদ্গুনাবলী বিষাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে জারি গান গাইছিলেন।হাজার দুয়ারী থেকে কাঠগোলা বাগানের দিকে যেতে ডান দিকে একটি ছোট শিব মন্দির তার পাশ দিয়ে  সরু রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই হুসনী দালান দেখতে পাওয়া যাবে।
                   হুমায়ূন মঞ্জিল: ১৮৩০-১৮৩২ সালে নবাব হুমায়ূন জাঁ নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদ বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কদমশরীফ মসজিদ থেকে দক্ষিণ দিকে গেলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ছাউনির পিছনে হুমায়ূন মঞ্জিল। এখানে একদিন ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত ছিল। নবাব হুমায়ূন জাঁ সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করে তিনি বসবাস করতেন।একতলা হলেও দেখতে ছিল মনোরম। নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাংলো, পুকুর ও গেট ছিল।যা এখন কালের গহ্বরে ঢাকা পড়েছে। সেদিনের সাক্ষ্য হিসেবে এই জনপদের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে সিপাহিদের পাহারা দেবার জন্য গুমটি ঘরের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভগ্নস্তুপের তার সাক্ষ্য দেয়।পলু পোকার চাষ হত। কয়েক বছর আগেও । এই সিংহাস হুমায়ূন জাঁর তৈরি বাংলোর দাওয়ায় পাথরের সিংহাসন অনাদরে পড়েছিল। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত গোলাকার কালো পাথরেরএই কুর্শিটি এখন কেউ বলে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে আছে।পাশপাশের ভূসম্পত্তি দখলদারদের দখলে এখন।
                 হাজার দুয়ারী: মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় প্রাসাদ। অবশ্য এখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলত এই মিউজিয়ামকে ঘিরে দেশ বিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা। এই প্রাসাদটি ইয়োরোপীয় স্টাইলে নির্মিত। তাইতো সর্বপ্রধান স্থাপত্য নিদর্শন। সামরিক বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার জেনারেল ডানক্যান ম্যাকলয়েড এই প্রাসাদের স্থাপত্যরীতি ইটালিয়ান রীতে নকশা করেন।১৮২৯ সালে হাজার দুয়ারী প্রাসাদের ভিত স্থাপিত হয়। এবং ১৮৩৭ সালে নির্মাণ কাজ শেষ করে। তিনতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা। মধ্যে সভা কক্ষ।হল ঘরের উপরে ৬৩ ফুট উঁচু একটি গম্বুজ আছে। বিভিন্ন কক্ষে অনেক মুল্যবান জিনিসপত্র__ অলঙ্কার দুষ্প্রাপ্য চিত্রাবলী অস্তশস্ত্র ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ ছিল যা এখন হ্রাস পেয়েছে। হলঘরের উপরে চারটি প্রকষ্ট আছে। সেখানে বসে বেগমরা নবাবদের বিচার সভা প্রদর্শন করতেন।জরুদ মদিনা মসজিদ এবং নবাবের কুর্শি সোজাসুজি ছিল। মসজিদের দিকে নজর রেখে বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। কখনো কখনো সূক্ষ্ম বিচার করতে গিয়ে ভুল হলে আল্লাহকে স্মরণ করতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বে ভুল হলে আল্লাহ যেন ক্ষমা করেন এইভেবে। ভাগীরথীর পূর্ব তীরে হুমায়ূন জাঁ হাজার দুয়ারী প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। এই প্রসাদে আটটি গ্যালারিসহ একশো চৌদ্দটি ঘরের হাজারটি দরজা থেকে নাম করন হয়েছে হাজার দুয়ারী। প্রকৃত দরজা আর কৃত্রিম দরজা মিলে একহাজারটি দরজার কথা কথিত আছে। এই প্রাসাদের দ্বিতলে দেখা যায় রূপোর সিংহাসন।যা নাকি বৃটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার।১৬১ টি ঝাড়যুক্ত বিলাস বহুল ঝাড়বাতির নীচে কুর্শিতে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করত। বর্তমানে প্রাসাদটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রক্ষানাবেক্ষন করা হচ্ছে।
                  ইমাম বাড়ার: কারবালার পটভূমিকায় নির্মিত এক সুরম্য অট্টালিকা। ১৮৪৭ খ্রীষ্টব্দ সাদেক আলী খাঁর তত্ত্বাবধানে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়।শোক গাথা এই প্রাসাদ নবাব ফেরাদুন জাঁ প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদটি লম্বায় ২০৭ মিটার তবে চওড়া বা লম্বা কোনদিকই সমান নয়। ইমাম বাড়ার ভিতরে অনেক গুলো ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। সপ্তাহে একদিন বৃহস্পতিবার খোলা থাকে। এবং মহরমের সময় ১০ দিন খোলা থাকে। বছরের বাকি দিনগুলো বন্ধ থাকে। এখানে মহররম মাসে মহরম পালিত হয়। বর্তমান এই প্রাসাদের জৌলুস কমে আসছে। অবিলম্বে ইমাম বাড়ার সংস্কারের ভীষণ দরকার।তা না হলে যে কোন সময়ই ঘটতে পারে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। কথিত আছে, এশিয়া মহাদেশে এত বড়ো ইমাম বাড়া আর দ্বিতীয়টি নেই।
                  সূর্য ঘড়ি: হাজার দুয়ারী এবং ইমাম বাডা মিউজিয়ামের ঠিক মধ্যস্থলে আজও দণ্ডায়মান। এই clock tower দেখতে পর্যটকদের ভীষণভাবে নজর কাড়ে। সূর্য ঘড়িটির নক্সা করেন সাগর মিস্ত্রী। এটির উচ্চতা 50 ফুট।
                  আস্তাবল: মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ শহরের পাঁচরাহা মোড়ে অধুনা নেতাজি মার্কেটের উত্তরে অন্যতম আকর্ষণ নবাব হুমায়ূন জাঁ নির্মিত আস্তাবল। এখানে প্রায় ২০০০  ঘোড়া,৮০০ খচ্চর,৬৫০ উট,৩৩০ গাধা ও ১৭০ হাতি থাকার সুব্যবস্থা ছিল।ঘোড়াশালাটির দুতলায় কুচুয়ান,মাহুত প্রমুখ বাস করতেন। এঁরা পশুগুলোকে প্রশিক্ষণ দিত ও পরিচর্যা করত।ঘোড়াশালার পিছনে পশুগুলোর গা ধোয়ানোর জন্য বেশ বড়সড় পুকুর এবং  পশুগুলোকে প্রশিক্ষণের জন্যে বিশাল মাঠ আজও দৃশ্যমান।পিলগুলির নাম ছিল__ সৃজন পিয়ারী,রুপমতি,লোল সুন্দর ও লালকসুর ইত্যাদি। আস্তাবলের জৌলুস কালের গহ্বরে মুখ লুকিয়েছে। শুধু কি তাই, ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের নজর নেই। প্রাসাদের তির- বর্গা চুরি হচ্ছে। এখানে যাদের থাকার কথা অনেকদিন তারা নেই।ঘোড়শালার আসল বাসিন্দাদের দেখা মেলে না।ওই ঠিকানায় এখন সকাল -সন্ধ্যা সবজির বাজার বসে, পাটের আড়ত, মাংসের দোকান,রড ও সিমেন্ট ইত্যাদি। দেওয়ালের প্লাস্টার খসে,ইট খুলে পড়ে ছাদ ভেঙে যাই যাই অবস্থায়।এখনই আস্তাবলের হৃত গৌরব ফিরিয়ে না দিলে একদিন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। ১৮২৯-১৮৩৭ খ্রীষ্টব্দে হাজার দুয়ারী এবং আস্তাবল নির্মিত হয়েছিল। নকশা করেন বেঙ্গল কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স- এর জেনারেল ডানকান ম্যাকলিয়ড।
                  সাধকবাগ আখড়া: জিয়াগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল গাম্ভীলা। গাম্ভীলা ছিল বৈষ্ণবদের একটি প্রসিদ্ধ পীঠস্থান। নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্য পণ্ডিত গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী এখানে বসবাস করতেন। এছাড়াও দেবীপুরে এখনও প্রাচীন আখড়ার কথা সর্বজনবিদিত।
                  দাদা স্থান:  জৈনদের তীর্থস্থান। মন্দির ও সুন্দর পূকুর আজও বিদ্যমান।
                 বড় গোবিন্দ বাড়ি ও ছোট গোবিন্দ বাড়ি: জিয়াগঞ্জে বড় গোবিন্দ বাড়ি ও ছোট গোবিন্দ বাড়ি নামে দুটি প্রাচীন মন্দির আছে। প্রধানতঃ এই দুটি বাড়ি বৈষ্ণবদের অন্যতম ধর্মকেন্দ্র।
                   পিলখানা: লালবাগ থেকে বহরমপুর যেতে এম জি ব্লকের ঢিল ছুড়া দূরত্বে অবস্থিত ছিল পিলখানা ।নাম ছাড়া সেদিনের আর কিছু দেখতে পাবেন না। বর্তমান বিএসএফ ছাউনি গড়ে উঠেছে।এখানে নবাব নাজিমদের হাতীশালা ছিল।হাতীগুলোর পরিচর্যা করার জন্য মাহুতদের বাসস্থান গড়ে উঠেছিল। এখন কিছুই নেই।
                   ওয়াসিম মঞ্জিল: নিউ প্যালেস নামেও পরিচিত। এখানে একসময় পাওয়ার হাউস ছিল। ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে ওয়াসিম আলি মির্জা এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদের রং সাদা। কথিত আছে ওয়াসিম মঞ্জিল প্রাসাদ সংলগ্ন তেরটি মহল ছিল।যেমন- চাঁদি মহল, সোনা মহল, হাওয়া মহল ,নাচ মহল,রঙ মহল,মতি মহল, বাঈজী মহল প্রভৃতি।যা এখন ধ্বংসোন্মুখ।
                   বাচ্চাওয়ালী কামান: প্রসিদ্ধ ইমাম বাডা ও হাজার দুয়ারী প্রাসাদের মাঝ বরাবর বাচ্চাওয়ালী কামান অবস্থিত।কামানটি লম্বায় ১৮ ফুট এবং ওজন ৭২৫০ কেজি। নির্মাণ কাল ১৩/১৪ শতক।
                   মদিনা মসজিদ: ঐতিহাসিক হাজার দুয়ারী এবং ইমাম বাডা অট্টালিকার মাঝামাঝি অবস্থিত। ১৭৫৫ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মক্কা থেকে মাটি নিয়ে এসে এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশ্য সেটা ছিল কাঠের তৈরি মসজিদ। আগুনে ভস্মীভূত হলে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির রং সাদা।
                    আদিনাথ মন্দির: নশিপুর রাজবাড়ির পূর্বদিকে (দাউদ পুর?) কাঠগোলায় দুগর পরিবার কতৃর্ক নির্মিত মনমুগ্ধকর নন্দন কাননে মহারাজ একটি চারতলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ ও আদিনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। প্রাসাদ এবং মন্দিরটি অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত।১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি করা হয়েছিল। মন্দির ও প্রাসাদটি দুটোই শিল্প ও সৌন্দর্য দর্শককুলকে অভিভূত করে।
                   এক আনা চাঁদপুরের মসজিদ: ১৫৬০ সালে এক আনা চাঁদ পুরে একটি মসজিদ নির্মিত হয়।এক আনার পরিবর্তে পাওয়া এই এক আনা চাঁদ পুরে সৈয়দ শরীফমুখী কর্তৃক এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল বলে কথিত আছে। প্রসঙ্গত, তিনিই পরবর্তীতে হোসেন শাহ বাদশাহ বলে সর্বজনবিদিত। এবং ১৪৯৮ থেকে ১৫২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন।
                   ঘণ্টা ঘর: নবাব ওয়ালা জাঁ নির্মিত দক্ষিণ দরজা সংলগ্ন এই ঘন্টা ঘর অবস্থিত। এই ঘন্টাটি ১৮৩৬ সালে নবাব হুমায়ূন জাঁ লন্ডন থেকে নিয়ে এসে ঘন্টা ঘরে প্রতিষ্ঠিত করেন।এর ওজন ১০০ কেজি।১৫ কি মি দূর থেকে শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। ঘন্টায় ঘন্টায় বাজত। এখন শব্দ হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় দিন গুজরান করছে।
                    বর্গী নেতা ভাষ্কর পন্ডিতের মন্দির: সৌখিন নবাব সুজাউদ্দিন নির্মিত রোশনী বাগের  উত্তর দিকে এই প্রাচীন মন্দিরটি বিরাজমান। মন্দিরে কোন বিগ্রহ না থাকলেও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের আনাগোনা আছে।
                নশিপুর রাজবাড়ি ও মন্দির: কাঠগোলা বাগানের পশ্চিমে রাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুরের তৈরি হাজার দুয়ারী প্রাসাদের আদলে তৈরি করেছিলেন নশিপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির অন্দর মহলে একটি জীর্ণ মন্দির পরিলক্ষিত হয়। প্রাসাদ ও মন্দিরটি জীর্ণ হলেও পৌরাণিক দেবদেবীর উপস্থাপনার জন্য দর্শকদের নজর পড়ে। কথিত আছে খাজনা দিতে অপারগ প্রজাকে হত্যা করে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হতো।
                       লালগোলা রাজবাড়ি: লালগোলার তেমন কোন পরিচিত ছিল না। যতখানি ছিল আলাতলির। বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল এই আলাতলির। পদ্মাগর্ভে আলাতলি বিলীন হয়ে গেলে লালগোলার গুরুত্ব বাড়ে।মোগল আমলে শাসনব্যবস্থা ও ব্যবসা বাণিজ্যে পরিচিত ছিল আলাতলির। মুর্শিদাবাদ জেলায় সাতটি গোলার সন্ধান পাওয়া যায়।যথা ভগবানগোলা,আজিমগঞ্জ গোলা,সুপরিগোলা,কারাগোলা,নালাগোলা,বামনগোলা ও লালগোলা। মোগল ও সুলতানি আমলে গোলাগুলি খাদ্য ভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত। সৈন্যদের জন্য সারা বছরের খাবার মজুত থাকত। মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার গ্রাম নাম লালগোলা। লালগোলা থানা এলাকার ৮০ নং গ্রাম লালগোলা। এই লালগোলা নাম নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে।চরের উৎকৃষ্ট জমিতে প্রচুর শষ্য উৎপাদনে প্রাচুর্য জনিত লালগোলা নাম হয়েছে। আবার, মোগল যুগে বিস্তার কালের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী লাল খাঁর ছাউনি থেকে লালগোলা নাম হয়েছে।লালগোলার রাজপরিবারের সদস্যদের তৈরি অনেক স্থাপত্য নিদর্শন আজও গৌরব বহন করে। যেমন রঘুনাথ জিউ মন্দির, সত্য নারায়ণ মন্দির, চক্রধর মন্দির এবং কালী ও শিবমন্দির।লালগলার রাজাদের রথের মেলা সর্বজনবিদিত। এখানে ব্রিটিশ আমল থেকে কাছারি ও থানা ছিল। কাছারি না থাকলেও থানা আছে। রাজবাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে কলকলি নদী বয়ে যেত।যা আজ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।লালগোলার দ্রষ্টব্যস্থান ও স্থাপত্য এখনও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এবং কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির এখনও বহালতবিয়তে দৃশ্যমান। এশিয়া মহাদেশের সাতটি মুক্ত সংশোধনাগার আছে। পাঁচটি ভারতে আছে।তার মধ্যে লালগোলা মুক্ত সংশোধনাগার একটি। এই রাজবাড়ি সরকার বাহাদুর অধিগ্রহণ করে সাজা প্রাপ্ত আসামীদের গুণ বিচার করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে এবং মেয়াদ শেষে তারা এখান থেকে জেল মুক্ত হয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যান।
                  জাফরাগঞ্জ দেউড়ি: এই প্রাসাদের গোপন কক্ষে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজদের চক্রান্তে হত্যা করা হয় বলে নেমক হারাম দেউড়িও বলে। আলিবর্দী খাঁ তাঁর সৎ বোন শাহ খানমের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদে মীরজাফর আলী খান স্ত্রী শাহ খানম ও মীরনকে নিয়ে বসবাস করতেন। ঔদাসীন্যে জাফরাগঞ্জ দেউড়ির প্রধান তোরণ দ্বারের জৌলুস নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মরেবর্তে টিকে আছে এখনও।জাফরাগঞ্জ কবর স্থানে মীরজাফরের বংশধরদের কবর বিদ্যমান।মীরণ বাদে প্রায় ১১০০জনের কবর আছে এখানে।
                     সুতি থানার জাগ্রত দেবতা: সুতি থানার বংশবাটি গ্রামে বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো অত্যন্ত সুপ্রাচীন। প্রস্তর মূর্তি _ পক্ষী রূপা। দ্বাপরে কংস কতৃর্ক নিধন হওয়ার ভয়ে যশোদা পক্ষী রূপ ধারণ গ্রাম হোসেন শাহ অধিকারেরকরে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল।তাই কল্পনা করে এই দেবী মূর্তির প্রতিষ্ঠা।
                 জীয়ৎ কুণ্ড: জীয়ৎ কুণ্ড গ্রামে একটি বৃক্ষের তলায় জীয়ৎকুণ্ডেশ্বরী দেবীর মূর্তি বিদ্যমান। লোক বিশ্বাস মতে, হোসেন শাহ জীয়ৎ কুণ্ড দখল করতে আসে কিন্তু অধিকার করতে পারে না তার কারণ গ্রামে একটি কুণ্ড আছে তার জন্য। মৃত সৈনিকের গায়ে সেই কুণ্ডের জল ছিটিয়ে দিলে প্রাণ ফিরে পেত। এই কুণ্ডের জলে গ্রামের এক বিশ্বাসঘাতক গোমাংস নিক্ষেপ করে এবং ওই গ্রাম হোসেন শাহ অধিকারে আনে।
                    বিষ্ণুপুরের কালী মন্দির: বহরমপুর থানার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরে প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী কালী মন্দির। এখানকার বিশেষ জাগ্রতা দেবী বলে লোকের বিশ্বাস। এখানে পাঁঠা বলির প্রচলন আছে। পৌষ মাসে মেলা বসে। এই মন্দিরটি লালগোলার রাজপরিবার কতৃর্ক নির্মিত।
                 জজান: মুর্শিদাবাদ জেলার একটি সুপ্রাচীন জনপদ। অতীতে নাম ছিল জয়যান। জনপদের চারপাশের বহুসংখ্যক জনপদ নিয়ে একটি সামন্ত রাজ্য গঠিত ও ও মহারাজ আদিত্য শূর বার্ষিক ১৫০০ টাকা কর ধার্য করে সোমেশ্বর ঘোষকে রাজা রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। সোমেশ্বর ঘোষ জজানে সোমেশ্বর শিবমন্দির ও সর্বমঙ্গলা মন্দির নির্মাণ করেন। সুনিপুণ কারুকাজে নির্মিত বিশাল অট্টালিকা,শান বাঁধানো পুকুর ঘাট,সবই ছিল।যা এখন ধ্বংসোন্মুখ।জজান জনফদটির মন্দিরের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। কথিত আছে, বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সন্ন্যাসী কালিকানন্দ অবধূত এই জনপদে বসবাস করেছেন।
                    আস্তাবল; এখানে নবাব হুমায়ূন জাঁ নির্মিত একটি সুবিশাল ঘোড়াশালা ছিল। বর্তমান ঘোড়াশালাটি জরাজীর্ণ অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।ঘোড়াশালাটির পূর্বে ঐতিহাসিক আস্তাবল ময়দান ও উত্তরে বিশাল পুকুর রয়েছে।ঘোড়াশালাটি দ্বিতল বিশিষ্ট ছিল। নীচে থাকত ঘোড়া, উট প্রভৃতি। ঐতিহাসিক আস্তাবল ময়দানে ঘোড়াগুলিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত আর প্রশিক্ষিত উট ও ঘোড়াগুলীকে পুকুরে স্নান করাত কোচওয়ান ।উট-ঘোড়াগুলিকে যারা ট্রেনিং করাত তাদের কোচম্যান বলা হত।১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ূন জাঁ নির্মাণ করে ছিলেন।
                   আজিম- উন্নিসা বেগমের কবর: আজিম - উন্নিসা বেগম ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলী খার একমাত্র কন্যা। স্বামী নবাব সুজাউদ্দিন। নবাব সরফরাজ খানের জননী।১৭৩৮-৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মহিমা পুর পুলিশ ফাঁড়ির নিকটে সুজাউদ্দিন নির্মাণ করেন। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ছিল। বর্তমান ধ্বংসের মুখে। খবরটি অক্ষত অবস্থায় থাকলেও মসজিদটির ভগ্নদশা। সারা বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে।
                   খোশবাগ: এখানে একটি মসজিদ ও নবাব আলীবর্দী খানের উত্তরসূরীদের কবর আছে।১৭৫৬-১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুযোগ্য নবাব আলীবর্দী নির্মাণ করেন। লালবাগ সদর ফেরি ঘাটের পশ্চিমে ভাগিরথী নদীর পাড়ে খোশবাগ। দেশি বিদেশি ফুলের সমাহার ছিল। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ।খোশবাগ হল আনন্দ বাগিচা।এখানে চির শায়িত আছেন নবাব আলিবর্দী খাঁর মাতা, নবাব আলিবর্দী খাঁ, তার সহধর্মিনী শরফুউন্নিসা বেগম, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তাঁর স্ত্রী লুৎফাউন্নিসা বেগম,কন্যা উম্মেদুউন্নিসা সহ নবাব পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
                   বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় মুর্শিদাবাদ জেলায় ২৯৬ টি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। আমার পক্ষে সবগুলো তুলে ধরা সম্ভব হয়নি বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
                   পলাশী চক্রান্তের মূল হোতা ছিল ইংরেজ বেনিয়ারা তার সঙ্গে দোসর হয়ে যোগদান করেছিল জগৎ শেঠ, প্রভাবশালী আর্মনী বণিক খোজা ওয়াজিদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও অন্যান্যরা।এরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপ বা প্রতাপশালী
ব্যক্তি। এদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন কৃষ্ণনগরে, উমিচাঁদ ছিলেন কলকাতায় , আর্মনী বণিক খোজা ওয়াজিদ ছিলেন হুগলিতে ও জগৎ শেঠ ছিলেন মুর্শিদাবাদে।
                 পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটলে পরবর্তী নবাবরা ইংরেজদের হাতের পুতুল নবাব হয়ে পড়ল। এবং ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ থেকে নিজামত আদালত কলকাতায় স্থানান্তরিত করে। নবাবদের রাজকীয় ক্ষমতা বিলুপ্ত করল।১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস পাকাপাকিভাবে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় উঠিয়ে নিয়ে গেল।ফলে, দেখতে দেখতে মুর্শিদাবাদের জৌলুস ও খ্যাতি ম্লান হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকার বাহাদুরকে উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে।
                     
তথ্যসূত্র:
১। ক্ষেত্র সমীক্ষা __ লেখক
২ । গণশক্তি,২৭ জানুয়ারি ২০০৪
৩ । মুর্শিদাবাদ ইতিহাস চর্চা__ ২ , ১ মে ২০১৭
৪ ।কলম__ ২৩ জুন ২০১২
৫ ।কলম__ ৮ নভেম্বর ২০১৮
৬ । আনন্দবাজার__ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৭
৭ । আজকাল__ ২০০৪
৮ । ফিরে দেখা মুর্শিদাবাদ__ সংকলন: কল্যাণকুমার দাস
৯ । ইতিহাসের আলোকে মুর্শিদাবাদ__ রবীন্দ্রনাথ দাস
১০ । নবাব উজির বেগম__ প্রতিভা রঞ্জন মৈত্র
১১ । মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক মসজিদ__ মো: সামসুদ্দিন
১২ । সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী সমিতির স্মারক পত্রিকা__ ২০১২
১৩ ।ঢাকার ইতিহাস__ যতীন্দ্র মোহন রায়
১৪ । মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি__ কমল বন্দোপাধ্যায়
১৫ । মুর্শিদাবাদ জেলা গেজিটিয়ার__২০০৩
১৬ । মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গ্রাম ও গড়ন__ তাজউদ্দিন বিশ্বাস
১৭ । পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি__ বিনয় ঘোষ


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন