জলধি / প্রবন্ধ / মাজরুল ইসলাম
Share:
মাজরুল ইসলাম
মুর্শিদাবাদ: কুটিরশিল্পের বিবর্তন ও অনুসন্ধান
                     

              আমরা অনেকেই জানি মুর্শিদাবাদ এক সময় শুধু বহুল প্রচারিত জেলাই ছিল না,সব থেকে বেশি গৌরব সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিগণিত ছিল। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি বিভাগের একটি জেলা এই মুর্শিদাবাদ।এই জেলার মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদ জেলাকে  দুভাগে ভাগ করেছে। পূর্ব তীরের অংশ বাগড়ি ও পশ্চিম তীরের অংশ রাঢ় নামে পরিচিত। জেলার সদর দপ্তর বহরমপুর। মুর্শিদাবাদ বরাবরই কৃষিপ্রধান অঞ্চল হিসেবে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। এই জেলায় উষ্ণ আদ্র ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়।এটি একটি জনবহুল জেলা। মুর্শিদাবাদ নবাবি আমলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল।
                কুটিরজাত শিল্পসামগ্রীই কুটির শিল্প নামে আখ্যায়িত করা যায়। ঘরে বসে মোটা মূলধন ও ভারি যন্ত্রপাতি ছাড়া হাতের সাহায্যে ঘর গেরস্থালির ব্যবহারী জিনিস পত্র উৎপাদন করা যায় বলে, এটা কুটির শিল্প নামে পরিচিত।
                 অতি প্রাচীনকাল থেকেই মুর্শিদাবাদের কুটির শিল্প পেয়েছিল বিশ্ববিশ্রুত শিল্পের মর্যাদা। মুর্শিদাবাদের কুটির শিল্পের সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো আজ আর নেই। এই জেলায় অনেক ধরনের কুটির শিল্প ছিল।যেমন -পাটের দ্রব্যসামগ্রী,বিড়ি, তাঁত, শাঁখা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল এবং বাঁশ ও বেতের ধামা -কুলো। এই কুটির শিল্পগুলো গ্রামজীবনে ঐতিহ্যের অংশ ছিল।যা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
               কাগজ: কাগজ আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে এক অপরিহার্য বস্তু। প্রাচীনকালে চুনাখালিতে কাগজ তৈরির কারখানা ছিল। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজনেরা 'কাগজী' নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে এখানে কয়েকশো ঘর 'কাগজী' বাস করত। এরা বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত।ততকালীন এখানকার কাগজ বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। মুর্শিদাবাদে কাগজ তৈরির জন্য কাঁচা মালের ছিল না। কোন এক সময় এই এলাকার জনবসতি লোপ পেলে তার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার কাগজ শিল্পও কালের গহ্বরে তলিয়ে যায়। প্রসঙ্গত,চুনাখালি সংলগ্ন বালির ঘাট -- পালপাড়ায় পুনরায় নতুন করে কাগজ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।
                কাঁথা: লোকশিল্পের অন্যতম নিদর্শন কাঁথা শিল্প। গ্রাম্য মহিলারা নিজস্ব চেতনায় সামাজিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনে এই শিল্পকর্মটি করে থাকে। কাঁথা তৈরিতে অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার দরকার। বহুদিনের পুরনো পরিত্যক্ত ছেঁড়া লুঙ্গি ও শাড়ি প্রধান উপকরণ। স্বামী - পুত্র - কন্যার জন্য তারা এই কাঁথা তৈরি করে।টোপ বা ফোঁড়গুলোর বিশেষ বিশেষ নাম আছে।যেমন - সোজা টোপ, বাঁকা টোপ, ভাঙ্গা টোপ এবং মাছি টোপ ইত্যাদি। আবার কাঁথাগুলোর নির্দিষ্ট নাম থাকে।যথা: ব্যাথন কাঁথা,আনারস কাঁথা,মই কাঁথা,কনক চাঁপা কাঁথা, গোলকধাঁধা কাঁথা,সুজনি কাঁথা, নক্সী কাঁথা, বিস্কুট খোপ ও লিহলি কাঁথা প্রভৃতি। নক্সী কাঁথার বুনন হরেকরকম হয়,ছয়পাতা ফুল,আটপাতার ফুল প্রভৃতি। জীবজন্তুর ছবি লতাপাতার ছবি নক্সাকারে ফুটিয়ে তোলে। কাঁথা বুননে যে সব রঙের সুতো ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে সাদা ,লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ও বিশেষ করে কালো রঙের। কাঁথা তৈরির ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।যেমন মুসলিম শিল্পীরা সূর্য, চন্দ্র, তারা, ফুল ও লতাপাতার ছবি সূচ সুতোর সাহায্যে ফুটিয়ে তোলে। তেমনি হিন্দু শিল্পীরা মাছ, ফুল,  জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গ সব কিছুরই ছবি সূচ সুতোর সাহায্যে ফুটিয়ে তোলে। প্রকার ভেদে কাঁথাগুলোর নাম - সুজনি কাঁথা, নক্সী কাঁথা,লেপ কাঁথা,বেথন কাঁথা,ওয়াড় কাঁথা ও রুমাল কাঁথা ইত্যাদি। এই নক্সী কাঁথা নিয়ে পল্লি কবি জসীমউদ্দিন ' নক্সী কাঁথার মাঠ ' নামে এক মহাকাব্য রচনা করেছেন।যা আজও অমর হয়ে আছে। গ্রামের মহিলারা অবসর সময়ে উসরা বা উঠোনে এক সঙ্গে মিলিতভাবে বসে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। সচারাচর এই দৃশ্য আজ আর দেখা যায় না।এখন এই শিল্প বিলুপ্তির পথে। যা আজ অভিজাত শ্রেণীর লোকেদের শোকেসে স্থান পেয়েছে।
                   শঙ্খ: মুর্শিদাবাদ জেলার ভগীরথপুরের ও বাজিতপুরের 'শাঁখারী'রা বিশেষভাবে এই শিল্পের জন্য পারদর্শী। শাঁখা শিল্প মুর্শিদাবাদ তথা ভারতের একটি প্রাচীন শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা  'শাঁখারী' নামে পরিচিত। বিবাহিতা বা সধবা হিন্দু রমণীরা প্রাচীনকাল থেকে ডান ও বাম উভয় হাতে শাঁখা পরে থাকে।
                মুর্শিদাবাদের ভগীরথপুর, বাজিতপুর প্রভৃতি স্থানে বহু পূর্ব থেকে এই শঙ্খশিল্প গড়ে উঠেছে। শঙ্খশিল্পীরা নবশাখ শ্রেণী গোত্রীয়। শাঁখা তৈরির করাত আবিষ্কারক নাকি অগস্ত্যমুনি। তাই এদের আরাধ্য দেবতা অগস্ত্যমুনি। শঙ্খশিল্পীরা বা শঙ্খবণিকরা ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রানীর গর্ভজাত। এই শাঁখা পরা নিয়ে কিংবদন্তি কম নেই।ভগীরথপুর ও বাজিতপুরের 'শাঁখারী'রা উৎকৃষ্ট মানের শাঁখা তৈরিতে ওস্তাদ। এখানকার প্রায় সকল পরিবারের লোকজন শাঁখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এবং এই শিল্প থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। সাধারণত একজোড়া শাঁখার মূল্য ৫০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। শঙ্খের সব কাজই হস্তদ্বারা সম্পন্ন করে।করাত দিয়ে শঙ্খ ছেদন করতে হবে এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। শঙ্খ কাটা হলে পর ধৈর্যসহকারে ঘষার কাজ করে। শঙ্খ থেকে তৈরি হয়- শাঁখা,চুড়ি, অঙ্গুরী,বালা প্রভৃতি। 'শাঁখারী'রা এই সব দ্রব্যেগুলোকে নানা প্রকার ভাবে কারুকার্য মন্ডিত করে তোলে। এবং শঙ্খের তৈরি দ্রব্যাদি  ভারতের নানান জায়গায় রপ্তানি করে ।শঙ্খগুলো সমুদ্রের উপকূল থেকে মুর্শিদাবাদের ভগীরথপুরে ও বাজিতপুরে আমদানি করা হয়। সামুদ্রিক এক প্রকার প্রাণীর খোলস থেকে শঙ্খের উৎপত্তি।
                উল্লেখ্য, বাংলা তথা ভারতের বহু প্রাচীন শুষির শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র হল শঙ্খ। এছাড়াও প্রাচীনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে শঙ্খ ছিল বিশেষ নির্দেশক। যুদ্ধারম্ভ, যুদ্ধ সমাপ্তি ইত্যাদি ঘোষনায় এর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সন্ধ্যায় হিন্দু পরিবারের মহিলারা ঠোঁটের সাহায্যে মঙ্গল ধ্বনি হিসেবে বাজায়। আকৃতি ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শঙ্খকে নানা ভাগে ভাগ করা যায়।যেমন - গোলমুখ শঙ্খ,ধবল শঙ্খ,পানি শঙ্খ ,পঞ্চমুখী শঙ্খ প্রভৃতি।
                আসন: উপবেশনের কাজে আসনের ব্যবহার মুর্শিদাবাদ তথা ভারতের লোকসংস্কৃতিতে অনন্য। বৈদিক যুগে কুশের তৈরি আসনের কথা জানা যায়। বর্তমান উল,চট,কাপড়, খেজুর পাতা,তালপাতা প্রভৃতির আসন দেখা যায়। সাধারণত গ্রাম্য বালিকা কিশোরী ও যুবতী শিল্পীরা এই কাজ করত বা করে। এতে নান্দনিক নক্সা দেখা যায়।অবশ্য পবিত্র আসন হিসেবে বা পুজোতে ব্যবহৃত হয় কুশ ও কম্বলের। বর্তমানে নাইলন, প্ল্যাস্টিক,ফাইবারের আসন বাজার দখল করায় এই শিল্প অচল।
                গালা: মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতের নয়, গালা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লাক্ষা থেকে গালা উৎপন্ন হয়। লাক্ষা উৎপাদন করে গালা তৈরি করে তা দিয়ে অপূর্ব শিল্পকার্য সম্পন্ন করা হয়। এই গালা বিভিন্ন কাজে লাগে। বিশেষ করে গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরিতে লাগে।গালা তৈরি হয় লাক্ষা নামক ক্ষুদ্রাকৃতি পোকা থেকে। স্ত্রী লাক্ষা একসঙ্গে কয়েক লক্ষ ডিম প্রসব করে।ডিম ফুটে বেরোন পোকা গুলো গাছের কচি ডালে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের দেহনিঃসৃত লালা দিয়ে নিজেকে আবৃত করে। এই লালা শুকিয়ে গিয়ে লাক্ষাতে পরিণত হয়।গালা চাষিরা গাছের ডাল ভেঙে পরিশোধন করে চাকি গালা বা বাটন গালা প্রস্তুত ক'রে গুদামজাত করে।পরে বাজারে বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জনশ্রুতি আছে, মুর্শিদাবাদের মরিচা ও দাঁড়াকাটি এলাকায় এক সময় গালাশিল্প রমরমিয়ে চলত।যার এখন কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার বলাবাহুল্য।
               হস্তিদন্তের ও দারুর কাজ: মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্গত এনাতলিবাগে একসময় হস্তিদন্ত শিল্পীদের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। এবং এই শিল্পীদের হাতির দাঁতের কারুকার্য অপূর্ব দর্শনীয়। হাতির দাঁতের তৈরি দ্রব্যাদির সমাদর করত নবাব বাহাদুর, আমীর ওমরাহ্ , প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ। এই সব কারণে এখানে হস্তিদন্ত শিল্পীদের ভিড় জমেছিল এবং এই শিল্প গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছেছিল।  উল্লেখ্য, হস্তিদন্তের নামজাদা শিল্পীর  এককথায় নাম উঠে আসে শ্রী রবিশঙ্কর ভাস্করের। কিংবদন্তি এই শিল্পীর বাবা ছিলেন- সতীশচন্দ্র ভাস্কর।তারা তিন ভাই,এক বোন। রবিশঙ্করের তিন ছেলে,চার মেয়ে।মীরা ভাস্কর ছিলেন স্ত্রী। তিনি  লাইসেন্স প্রাপ্ত হস্তিদন্ত শিল্পী ছিলেন। বাবার কাছে হাতেখড়ি।বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন বলবৎ হলে হাতি শিকার বন্ধ হয়েছে বলে এখন আর হাতির দাঁত বা হাঁড় পাওয়া দুষ্কর।ফলে, এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা পেশাচ্যুত হয়ে অন্য পেশায় ভিড়ে গেলেও রবিশঙ্কর ভাস্কর এখনও কাঠ বা দারু শিল্পের সঙ্গে সংপৃক্ত। তিনি এই কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। মুর্শিদাবাদ সফরে আসা দেশী বিদেশী পর্যটকেরা স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করেন। কাঁচা মালের ঘাটতিতে এবং ফাইবারের তৈরি দ্রব্যাদি সহজে পাওয়ায় কেউ আর কেনেনা বলে, এই শিল্প কালের গহ্বরে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
               কাঁসা-পিতল : মুর্শিদাবাদ জেলার খাগড়া ও বহরমপুর কাঁসা পিতলের বাসন শিল্পে আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, জগৎজোড়া নাম ছিল।'কাঁসারী'রা প্রাচীনকাল থেকে কাঁসার থালা, গামলা প্রভৃতি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত বা করে। এখনকার কাঁসার বাসন উৎকৃষ্ট মানের। বহরমপুর, খাগড়া, আজিমগঞ্জ ও বড়নগরে বহু সংখ্যক 'কাঁসারী'র বাস ছিল। এরা বংশ পরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ।এখন খাগড়া ছাড়া অন্য কোথাও এদের দেখা মেলে না বলাই বাহুল্য। 'কাঁসারী'দের কারুকার্য খচিত বাসনপত্র নবাব বাহাদুর, লালগোলাধিপতি রাজা যোগেন্দ্র নারায়ণ রায়,মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রমুখদের কাছে প্রশংসিত ছিল। লোকমুখে শোনা যায় আগের দিনে কাঠের আগুনে কাঁসা পিতল গলানো হত।এখন আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কাঁসা পিতল গলানো হয়।তামা ও দস্তার মিশ্রণে  পিতল হয়। তামা ও রাং-এর সংমিশ্রণে কাঁসা। কাঁসা পিতলের তৈরি জিনিসপত্রগুলো -- যেমন ঘড়া,কলসি,গাড়ু,পিলসুজ, গামলা,ঘটি,বাটি ডাবর,হাতা- খুন্তি,তসলা,রেকাবি,বদনা, পিকদান,জগ ইত্যাদি ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ছোট বেলায় দেখেছি জঙ্গিপুরের বাসন ব্যবসায়ীরা ঘোড়ার পিঠে বাসনপত্রের পসরা সাজিয়ে নিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে ফেরি করত। চাহিদামতো তারা হয়তো খাগড়া ও বহরমপুর থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসত। জঙ্গিপুরে কাঁসা পিতলের বাসনপত্র তৈরি হত কিনা জানা যায় না। কিন্তু খাগড়ার এই প্রাচীন শিল্প এখনও মরে বর্তে টিকে আছে।যে শিল্প একদিন নবাবি দরবারে কদর পেত সে শিল্প আজ প্রায় অতীত হতে চলেছে। তাছাড়া বাজারে এখন ফাইবারের, প্ল্যাস্টিকের ও অ্যলুমিনিয়ামের জিনিস পত্রে ছেয়ে গেছে। কাঁসা পিতল অপেক্ষা সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বল কেউ কাঁসা পিতলের বাসনপত্র কেনা কাটা করতে চাইছে না। এই প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে।
                কাঁচের চুড়ি ও চুড়িপট্টি: মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্গত চুড়িপট্টি স্থানটি জিয়াগঞ্জ সহরের অংশ বিশেষ। মুসলমান শাসন কাল থেকেই চুড়িপট্টিতে কাঁচের চুড়ির আড়ং ছিল বলে জানা গেছে। জিয়াগঞ্জ প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সহর। অনেক জনগোষ্ঠীর বসবাস এখানে এখনও বিদ্যমান। অবশ্য কাঁচের চুড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল মুসলিম পরিবারের লোকজন। বলাবাহুল্য অজ্ঞাত কারণে চুড়িপট্টির কাঁচের চুড়ির ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। চুড়ির আড়ং থেকেই হয়তো চুড়িপট্টি নামের উৎপত্তি। তবে এখানে কোনো কালে কাঁচের চুড়ির কারখানা ছিল কিনা জানা যায় না।
                শোলাশিল্প: শোলা জলে জন্মায়।শোলা উৎপাদনের জন্য কোনো চাষযোগ্য জমির প্রয়োজন হয় না। বর্ষা কালে জলাভূমিতে আপনা আপনিই জন্মায়। বহরমপুর শোলা শিল্পের নাম করা কেন্দ্র ছিল বা এখনও আছে। কারুকার্য করা শোলার যে- কোন জিনিস যে- কোন মানুষের কাছে এক আকর্ষণীয় দ্রব্য।শোলা শিল্পী সৈয়দাবাদের সমীর সাহা শোলার কারুকার্য দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি পুরুস্কার লাভ করেন। এই শিল্পটিও যে অতি প্রাচীন শিল্প তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।শোলার তৈরি জিনিসপত্র -- শোলার সাজ,ডাকের সাজ, টুপি, খেলনা হয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে না হয় ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।ছিটে ফোটা হলেও এখনও এই শিল্প টিকে আছে।যখন এই জেলায় এখনও জলাভূমি আছে।অতএব শোলা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। শুধু সরকারের সদিচ্ছার ভীষণভাবে দরকার।বেকার যুবক যুবতীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অর্থ অনুদানের ব্যবস্থা করলেই চলবে।
                বিড়ি: পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার অরাঙ্গাবাদ,সূতী ও ধুলিয়ান অঞ্চলে সর্বাধিক বিড়ির কারখানা , বিড়ি শ্রমিক, দেখা যায়। শুধু তাই নয় এই এলাকায় বেশ বড়সড কারখানাগুলো বিদ্যমান।যেমন 'পতাকা' বিড়ি কোম্পানি প্রভৃতি। এই শিল্পের কারিগরেরা সঠিকভাবে মজুরি ও চিকিৎসা পায় না।অথচ বিড়ির দাম বাড়াতে কম কিছু করে না মালিকগণ। বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে কর্কট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। অরাঙ্গাবাদ,ধুলিয়ান,সূতী,সামশেরগঞ্জ, ফারাক্কা অঞ্চলে সব চাইতে বিড়ি শ্রমিক বা কারিগরের বসবাস বেশি। মুর্শিদাবাদের  বিড়ি শিল্পই একমাত্র জাঁকজমকপূর্ণ। এখানে এর চেয়ে বড় কোন শিল্প আছে কি না  আমার জানা নেই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে এই জেলার প্রায় ১৪ লাখ কারিগর ।বহু সংসার নির্ভরশীল এই শিল্পের উপর।
               বাঁশ ও বেত: মুর্শিদাবাদ জেলার হুড়সী, ছয়ঘরি,পাহাড় গোবিন্দ পুর,সরলপুর, দিয়ারা, ইন্দ্রানী এবং মল্লিকপুর প্রভৃতি গ্রামের লোকজন বাঁশ ও বেতের নান্দনিক ধামা,কুলো, মোড়া,ইত্যাদি তৈরি করে। আধুনিক কলকারখানা রবার, ফাইবারের তৈরি জিনিসপত্র বাজার দখল করায় এই শিল্পজাত দ্রব্যাদি কিংবা শিল্পীরা হারিয়ে গেল।
               শিকে: মাছ, মাংস,ঘি,দুধ,দই,গুড় বা অন্যান্য দ্রব্যাদি খাবার রাখার জন্য দড়ির তৈরি ঝুলন্ত আধার বিশেষ। প্রাচীন কালে গ্রাম্য বাড়ি- ঘরের চালের বাতায় ঝুলিয়ে রাখা হত এই শিকেয় নানাবিধ খাবার দ্রব্যাদি সুরক্ষিত রাখার জন্য ঝুলিয়ে রাখা হত।যেন শিশু, কুকুর, বিড়াল ও পিঁপড়েরা নষ্ট করতে না পারে।এখন চালের ঘর- বাড়ি সচারাচর দেখা যায় না বলে শিকেও দেখা যায় না।
                তাঁত ও তাঁতী: মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রেশম শিল্পের কথা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মুর্শিদাবাদ রেশমের জন্য বিখ্যাত। এখানকার রেশমের মত মোলায়েম নয় অন্য এলাকার রেশম। শুধু তাই নয় জরির কাজের জন্যও বিখ্যাত এই অঞ্চল।
         উল্লেখ্য, দিল্লিশ্বর আকবর বারভূঁঞাদের দমন করার জন্য ইসলাম খাঁকে পূর্ববঙ্গে প্রেরণ করেন। ইসলাম খাঁ রাজমহল থেকে গৌড় হয়ে ভগবানগোলার নিম্নাংশ পদ্মা পেরিয়ে ভৈরব নদীর বুক বেয়ে সমরাভিযান করেন। যুদ্ধের কৌশল মতো কিছু সংখ্যক সৈন্য ইসলামপুরে ও ভগীরথপুরে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মোতায়েন রেখে বাকি সৈন্য নিয়ে পূর্ববঙ্গের বারভূঁঞাদের দমনের জন্য এগিয়ে যান। ইসলামপুর ও ভগীরথপুরের সৈন্যের দরকার না হওয়ায় তারা সেখানেই বসবাস করতে থাকে। ইসলামপুর ও ভগীরথপুর জনপদ গড়ে ওঠে। ইসলাম খাঁর নামানুসারে আজকের ইসলামপুরে জন্ম বলে অনুমতি। এই ইসলামপুরে তন্তুবায়রা আজও তাঁত বুনে। এছাড়াও জিয়াগঞ্জের তাঁতীপাড়া, বাগডহর ও বেলিয়াপুকুর এলাকায় তন্তুবায়দের বসবাস ছিল। বর্তমান ইসলামপুরে তাঁত শিল্পের ভূমিকা থাকলেও বাগডহর ও বেলিয়াপুকুরে এর কোন অস্তিত্ব নেই।শাড়ি নয় তন্তুবায়দের তৈরি গামছা, মশারীর সুনাম আজও বহন করে।
              বালুচরী: সুক্ষ্ম কারুকার্য খচিত জমকালো সিল্কের শাড়ি বিশেষ। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জিয়াগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল বালুচর।আর এখানেই তৈরি হত বালুচরি শাড়ি। বালুচর নাম থেকেই বালুচরির উৎপত্তি। এই শাড়ির হাকডাক ছিল জগৎজোড়া। নবাব বাহাদুর থেকে রাজা,জমিদার, দেশ ব্যাপী এমন কি বিদেশেও এই শাড়ির সমাদর ছিল। এই বালুচরি শাড়ি বিলুপ্তির পথে। এই শাড়ি তৈরি করতে সুদক্ষ তাঁতী ডাক পড়ত। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের  মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির  তৈরি শাড়িতে বাজার ছয়লাপ। সেই জন্য আজ এই তাঁত শিল্পীরাও কোথায় হারিয়ে গেল।কাজ না পেয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত তারা। সরকার বাহাদুর পৃষ্ঠপোষকতা করলে হয়তো এই বালুচরি শাড়িকে বাঁচাতে পারে।
                     যাহোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার সস্তায় ঠুনকো দ্রব্যাদি বাজারে প্রচুর পরিমাণে আমদানি হওয়ায় মানুষ সেদিকে ঝুঁকে পড়ায় সাবেকি দ্রব্যাদি প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। এই সাবেকি কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছার ও অনুপ্রেরণা। শিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ভর্তুকিতে অর্থ অনুদানের। যেটুকু ধুকধুক করছে সেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা। না হলে যেটুকুও আছে কখন সেটুকুও কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
                                 ______

তথ্য সূত্র:
********
১ । লোককথা ও জনশ্রুতি
২ । বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ
৩ । মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার --২০০৩
৪ । নাসিমা বেগম -- ছাতাই
৫ । মুর্শিদাবাদের কুটির শিল্প - লক্ষী নারায়ণ চক্রবর্তী
৫ । ক্ষেত্র সমীক্ষা -লেখক


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন