জলধি / প্রবন্ধ / বিজয় দিবস : চেতনায় সদা জাগ্রত
Share:
বিজয় দিবস : চেতনায় সদা জাগ্রত
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনেই পাকিস্তানের শাসকদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাদ পায় বাংলার মানুষ। ইতিহাসের কালো পৃষ্ঠায় চোখ মেললে আমরা দেখতে পাই, ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি পরাধীন হয়ে পড়ে। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে তাঁদের জীবনে নেমে আসে বিষাদের কালো ছায়া। শুরু হয় নানারকম নির্যাতনের অধ্যায়।  নির্যাতিত হওয়ার এই ইতিহাস যেমন অত্যন্ত বেদনার তেমনি চরম ভয়ানক ও অমানবিকতার। তবে বাঙালি  জাতি কখনোই সেই নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে নাই। যতবার তাঁদের অত্যাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই ফুঁসে উঠেছে তাঁরা। অর্থাৎ জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর গৌরবময় ইতিহাস বাঙালির দীর্ঘদিনের। তার মানে যুগে যুগে বাঙালি জাতি যেমন অত্যাচারিত হয়েছে তেমনি এর প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে বাঙালি জাতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেমন দানা বেঁধেছে তেমনি তা পরিবর্তন হয়ে দেখা দিয়েছে সূর্যের আলোকরশ্মি। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাই সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শ্রেণি সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে। একসময় আবার তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জাতির মধ্যে। এভাবে বাঙালি জাতি নানা আন্দোলন আর সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেছে। কৈবর্ত বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, তাঁতি বিদ্রোহ, নীলকর বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ফরায়েজী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে এদেশের মানুষের। 
 
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সঙ্গত কারণেই আমরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হই। কিন্তু এর পরে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে আরও কঠিন দুর্দশা। কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা পূর্বপাকিস্তান তথা বাঙালির উপর অত্যাচার শুরু হয়। প্রথমেই আঘাত আসে ভাষার উপর। বাংলাভাষার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করে তারা। কিন্তু এটা মেনে নেয়নি এদেশের সংগ্রামী মানুষ। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই যেমন বাঙালিকে চরমভাবে সচেতন করে তুলেছে ঠিক তেমনি পুরো জাতি একই পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকল প্রতিকূলতা রুখে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানমুখর মিছিল এবং সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার, অহিউল্লাহর আত্মদান শুধু মাতৃভাষার অধিকারই রক্ষা করে নাই, সুদৃঢ়ভাবে স্বাধীনতার বীজ রোপন করেছে। আর সেই বীর শহিদদের স্মরণে নির্মিত শহিদ মিনার হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। তাই যতবার একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে ততবারই তাঁরা দাঁড়িয়েছে একই পতাকাতলে। আর সেখান থেকে অন্যায়, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে প্রতিবাদের স্লোগান। এভাবে যখনই প্রয়োজন হয়েছে বাঙালি একত্রিত হতে পেরেছে। একুশের সুমহান চেতনা সবসময় জাগিয়ে রেখেছে তাঁদের। এই জাগরণ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিকে জয়লাভ করিয়েছে। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবিকে জোরালো করেছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি সৃষ্টি করেছে। এই শক্তির কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ বিজয় হয়েছে বাঙালির। আর বাঙালি এভাবেই এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতার দিকে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে একের পর এক। তাতে বাঙালি জাতি কখনোই দমে যায়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।" তাতে দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বীর বাঙালি। উপায়ান্তর না-দেখে পাকশাসকেরা ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বর্বর হামলা চালায় ঘুমন্ত বাঙালির উপর। পক্ষান্তরে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিও অবতীর্ণ হয় সশস্ত্র যুদ্ধে। একটি বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য তখন মহামূল্যবান জীবন বাজি রাখতেও কুন্ঠিত হননি তাঁরা। দীর্ঘ তেইশ বছর পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি আর বৈষম্যের শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে একাত্তরের এই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে তাঁদের। পঁচিশে মার্চের  কালরাতে আক্রমণের মধ্য দিয়ে পাকবাহিনীর যে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়েছিল তা শুধু বাংলাদেশের নয় পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনা। এই বর্বর হামলার বিরুদ্ধে বীর বাঙালি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশমাতৃকার মুক্তির আশায় বুক পেতে দিয়েছে হানাদারদের বুলেটের সামনে। অকুতোভয় সৈনিকের মতো লড়াই করেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এর মধ্যে অকাতরে ঝরে গেছে কতো প্রাণ। বাবা-মায়ের বুক খালি করে চলে গেছে কতো সন্তান। কতো অবুঝ শিশু হয়েছে এতিম। ভাই বোনকে হারিয়েছে, বোন ভাইকে আর খুঁজে পায়নি কোনোদিন। স্বামীহারা হয়েছে অসহায় গৃহবধূ অথবা স্বামীর সামনেই চরম লাঞ্ছিত করা হয়েছে বহু কুলবধূকে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে অসংখ্য মা-বোন। সেই নির্মম অপমান সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যার পথে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন আরও কতো অবলা নারী। কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চিরদিনের জন্য পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। হানাদারদের ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে অসংখ্য মা-বোনকে।  সেই দুঃসহ স্মৃতি বহন করে সারাজীবন সমাজের কাছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেছে তারা। এরকম বেশিরভাগ নারীই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। যাঁরা পেরেছে, তাঁদের বাকি জীবনটাও পুরোপুরি সুস্থ ও সুন্দরভাবে কাটাতে পারেনি। যুদ্ধকালীন নয়মাসে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে অসংখ্য বাড়ি-ঘর।  অফিস-আদালত। দোকানপাট। এমনকি মসজিদ, মন্দির, গির্জাও বাদ যায়নি বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে। বাস্তুহারা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আশ্রয়হীন হয়ে, প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে অসংখ্য মানুষ। সেখানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করেছে।  এভাবে একটা দেশ, দেশের মানুষ কঠিন বিভৎসময় দিন অতিবাহিত করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য পাকিস্তানিদের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার সাথে বিদেশি চক্রান্ত যেমন ছিল, তেমনি ছিল দেশীয় কিছু মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ । তবে সব ষড়যন্ত্র ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শুধু দেশকে ভালোবেসে আমাদের মুক্তিকামী বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছে দৃঢ় মনোবল নিয়ে। তাঁদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়েছে এই সবুজ ভূখণ্ড। এই বীর বাঙালির এতো আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি শেষ পর্যন্ত। 
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এসেছে সেই কাঙ্খিত বিজয়। পতপত করে উড়েছে লাল-সবুজের প্রিয় পতাকা। মাতৃভূমি বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে আলাদা একটি দেশ হিসেবে। সেই থেকে ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আমাদের গৌরবের মাস। পৃথিবীর বুকে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, এদেশ কারো দানে পাওয়া নয়, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ। ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আমাদের অহংকারের দিন। ১৪ই ডিসেম্বর আমাদের শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি শহিদ বুদ্ধিজীবীদের। আর ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের চূড়ান্ত বিজয়কে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাই। এ বিজয় অর্জিত হয়েছিল বলেই আমরা আজ একটি স্বাধীন জাতি। আমাদের আছে আলাদা একটি দেশ। একটি পতাকা আছে। লাল-সবুজের সেই পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নির্ভয়ে গেয়ে উঠি, "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি/ চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।"  কখনো কখনো আবেগ ভরা কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। নয়নের জলে ভেসে যাই আমরা। এই দেশ আমাদের। এই বিজয়ও আমাদের। ডিসেম্বর তাই আমাদের গৌরবের মাস। এই গৌরবের মান অক্ষুন্ন রাখতে হবে আমাদেরই। অর্থাৎ যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা একটি বর্বর রাষ্ট্রের অপশক্তির হাত থেকে নিজেদের দেশকে রক্ষা করেছি, সেই চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে নিতে হবে প্রিয় বাংলাদেশকে।


অলংকরণঃ তাইফ আদনান