তিরিশের পর যে কয়েকজন কবি আশির দশকের পেছনের রোমন্থনপ্রবণতাকে ডিঙিয়ে বাংলা কবিতায় নিজস্বতার দস্তখত শুধু নয়, হাজির হয়েছেন ব্যক্তিগত বুড়া আঙুলের টিপসহি নিয়ে, বদরুজ্জামান আলমগীর তাঁদের একজন। কেননা, দস্তখতও অনেক সময় নকল করা যায়, কিন্তু কারো আঙুলের ছাপ তো আর নকল করা যায় না! কোথাও না কোথাও থেকেই যায় তার নিজস্বতার ছাপ; কবিতা ও কলমের মৌলিক মোলাকাত। নাম মুছে দিয়ে লেখা পড়েই তাঁকে আলাদা করা যায় সহজেই। তাঁর প্রতিটি লেখায় রয়েছে আত্মমুদ্রিত ভাষার আশ্চর্য অনুরণন। প্রতিনিয়তই তিনি নতুন ও অনন্য। প্রতিটি লেখাতে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যান। প্রতিটি লেখার ফাঁকে ও ফোঁকরে ছড়িয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিগত আঙুলের টিপসহি। একেবারে বাংলাদেশি ভাষা ও শব্দের সহজিয়া সরল বিন্যাসে আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে ফেলে তিনি লিখে ফেলেন মরমীয়া বাঙালির নিজস্ব সংবেদ –
‘আমি কোনভাবেই মোকাম করে উঠতে পারি না পূর্বজন্মের স্মৃতি আর আগামী জন্মের পিছুটানের মাঝখানে একটি লোকগীতির সুরের মধ্যে কে তুমি ফুটে থাকো এমন পদ্মফুল – লোটাস, লোটাস!’
(আনন্দধারা বহিছে । হৃদপেয়ারার সুবাস)
তারপর –
‘কাছিম ওড়ে – যদি শেখ ফরিদের দেখা পায়; ময়ূরপঙ্খী জলের নিচে মৌন পানিতে ডুবে থাকে – সে যখন রাই হয়; মৌলিকভাবে তৃষ্ণার্ত হলে আমাদের শরীরেও নদী এসে ভর করে। ঝড় যা – নীরবতাও তা-ই; রঙের হাটে লাগাতার বৃষ্টি আর হঠাৎ খরার তফাৎ কী? / প্রেমের হাটে কৃষ্ণ বলে কিছু নাই – খালি রাধার হাটবাজার: রাধা কৃষ্ণের জন্য রাধা, কৃষ্ণ রাধার জন্য রাধা!’
(মৌনতার রঙ । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
তিনি অবলীলায় কবিতার প্রকাশে নিজেকে পাশে রেখে একেবারে মুখের ভাষায় প্রকাশিত হন প্রতিটি লেখার মাঝে, ‘যে-জন অন্ধ সে-জন চক্ষুষ্মান; দিবালোকে শ্রেণি সংগ্রামীর ছোরা, রজনীর সংরাগে মর্মে কাঁপে সুন্দর ময়না এক – ময়না লো আমার; গন্তব্যহীন সড়কে ধীরে ধীরে হেঁটে যায় বায়েজিদ বোস্তামির কাছিম – তিন মাসের দুধভাতে ৩০০ বছর আয়ু; ও উলুধ্বনি, ও মায়া নগরীর চিত্রা হরিণ, এবং তন্বিষ্ট কস্তুরি নাভি; ঝড়েজলে সম্মিলিত নিঃসঙ্গতার আশানিরাশায় দিলকাঁপানিয়া তুমি, সুরে সংক্রামে পদ বাঁধে কোন জালালউদ্দিন রুমি !’ (ব্যাক কভার । হৃদপেয়ারার সুবাস)।
বাংলাদেশের কবিতার ভাষার সাথে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগের ভাষার দূরত্ব অনেক। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা ও ভাবের সাথে মিশিয়ে বাংলা কবিতা লেখেন এমন কবির সংখ্যা বাংলাদেশে হাতে গোনা। ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগে বরাবরই বাংলাদেশের কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে ইউরোপীয় আধুনিকতা ও পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষার ‘মান’ রূপ। কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে উক্ত দ্বিবিধ প্রবণতার সনদ নিয়ে কবি হয়ে ওঠার ইচ্ছা একটা দীর্ঘ দিনের রোগ। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতায় কিছুটা নতুনত্ব আসলেও তা পুরোপুরি বাংলাদেশি হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিনও। সেই কারণে জসীম উদ্দিন হয়েছেন অবজ্ঞাত, আর আল মাহমুদ সেই পথে এগুলেও বাংলাদেশের সহজিয়া ভাষারীতিকে দিয়েছেন শহুরে আধুনিকতা। এর পরে আছে অধ্যাপক শ্রেণির কিছু শিল্পসমালোচক, যারা ব্যাকরণের শাঁখের করাত হাতে নিয়ে করেন শিল্পের তাত্ত্বিক কাটা-ছেঁড়া। এসবের বাইরে এসে, হাতে গোনা কয়েকজন বাদে, বর্তমান বাংলাদেশের কবিতা আশির দশকের চর্বিত-চর্বণ ছাড়া আর কিছুই না।
বদরুজ্জামান আলমগীরের অনন্যতা হলো তাঁর নিজস্ব স্বর, বাচনভঙ্গি ও চয়িত শব্দের যোজনা। তিনি যেন শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে দেন বুননকৌশলের চমৎকারিত্বে; আর তা থেকে বের হয়ে আসে যাদুকরী জামদানি। বদরুজ্জামান আলমগীর কবিতা লেখেন না; বরং তিনি যা-ই লেখেন তা-ই কবিতা হয়ে যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতিদিনের অতি পরিচিত ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে তিনি দিয়েছেন কবিতার মহান অথচ ঘরোয়া শরীর। বাঙালি জীবনের অনিবার্য লোহাকে তিনি কাঁচা সোনায় রূপান্তরিত করেছেন। অনিবার্য অথচ অতি চেনা ঘটনার চরিত্রগুলো আবার কথাও বলে তাদেরই নিজস্ব ভাব, ভাষা, শব্দ ও আঙ্গিকের স্থানিক বিচারে। আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার সঙ্গে সুফিবাদী মরমিয়ার যোগসাধনে নতুন এক সম্পূর্ণ সাদাকালো বাংলাদেশি চিত্রকল্প ও ভাষাভঙ্গিমার উপস্থাপন বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখায় জ্বলন্ত আগুনের ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। মৃত্তিকাবতী বাঙালির মর্মের ভিতরে তিনি এক করে মিশিয়ে দেন কৃষ্ণ, কার্ল মার্ক্স ও মনসুর হাল্লাজের জীবন-দর্শন –
‘মেঘে মেঘে আগুন আছে হিয়ার ডলক
সবা মাঝে কৃষ্ণ থাকে আয়নাল হক’।
(জন্মাষ্টমী । সঙ্গে প্রাণের খেলা )
এবং –
‘মাটির ফাটার মধ্যে যেমন অপরূপ সুন্দর দু’টি ফিরোজা পাতা গজিয়ে ওঠে, আমিও তোমার সর্পিণী বিনাশের মধ্যেই দুঃখের ঝিনুকে গঠিত হই।
আমাকে আটকাবে কে?
যে মৃত- তাকে মরণের ভয় দেখিয়ে লাভ কী!
একজন পুজারীকে মন্দিরের একেকিত্ব থেকে কেউ রুখতে পারে না!
নিঃসঙ্গতা-ই তার কলরব’।
(মনসুর হাল্লাজ । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
বদরুজ্জামান আলমগীর অনুপম, কেননা তাঁর চিরায়ত চেতনার এক চির উজ্জ্বল যাপনের নাম – নিমজ্জন। যতই গভীরে নামি – অতল; যতই উপরে ভাসি – অসীম; কবিতাভাষ্যে যতটা নীরব ও সাবলীল –ততটাই জলঝর্ণার চঞ্চলতা ভেতরে ভেতরে। মনে ও মননে নিরেট ‘সাম্য-সুফী-বাউলিয়ানা’ আরাধ্য তাঁর। আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার সঙ্গে মার্কসবাদী সাম্য আর সুফিবাদী মরমিয়ার যোগসাধন এক নতুন চিত্রকল্প ও ভাষাভঙ্গিমার প্রকাশে ব্যাক্তিগত আগরবাতি হয়ে ওঠে তাঁর লেখার কুপিতে ও কার্নিশে –
‘আমার বুকের ভিতর গৌতম বুদ্ধের বাড়ি,
আমি যাই না – আসিও না কেবল অপেক্ষা করি’।
(আবের পাঙ্খা লৈয়া । আবের পাঙ্খা লৈয়া)
বোধ ও বোধির উৎসার থেকে উপলব্ধিজাত যাপন আপন করে নিয়ে মাটিমুখী দৃষ্টি লালন করে কবিতাকে চিনেছেন তিনি জীবনের সাবলীল তর্জমায়। আর স্বাক্ষরিত ভাষার প্রয়োগ যেন তাঁর নিয়ত নিরীক্ষার নিবিড় নির্বেদ; কেননা – ‘তুমি নিরন্তর প্রবাহ, যতিচিহ্নহীন বাক্য ও ভাষাবিন্যাস, তুমি ঈশ্বরের স্বভাবে অনন্ত বর্তমান। কিন্তু তোমার বর্তমান সদা চিত্রকল্পময় : দূর অতীতে তুমি উড়ে বেড়িয়েছো – তাঁর স্মৃতি তর্পন করা; আর ভবিষ্যতে কেমন করে পাখাবিহীন অনিঃশেষ দিগন্তের সংকেতময়তায় উড়েউড়ে যাবে – ওই হিসাব মিলাতে মাথা নুয়ে ভাবা – ভাবনার অতল প্রবাহে ব্যাকুল রাবেয়া বসরী – একটি কেদারায় নতশির মুহ্যমান লালন সাঁইজি – একফোঁটা কেমন পাখা’ (একফোঁটা কেমন পাখা না-পাখা । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)।
কবিতা বা গদ্য সবখানেই বদরুজ্জামান আলমগীরকে আলাদা করে চেনা যায়। গ্রন্থের নামকরণেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে যেমন তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম দেখেই আলাদা করা যায়, বদরুজ্জামান আলমগীরও তাই। প্রতিটি গ্রন্থের শিরোনামেই তিনি বলে দেন, ‘তাই আমি আসিয়াছি / আমার মতো আর কেউ নাই’ (জীবনানন্দ)। যেমন- ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’, ‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর’, ‘আবের পাঙ্খা লৈয়া’, ‘হৃদপেয়ারার সুবাস’, ‘নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো’, ‘ঢেউগুলো যমজ বোন’, ‘দূরত্বের সুফিয়ানা’, এবং ‘সঙ্গে প্রাণের খেলা’। আবার প্রতিটি গ্রন্থের ব্যাক কভারে রয়েছে আর এক অভিনব নন্দন ভাবনার জলজোছনা। রঙবেরঙের শব্দযোজনায় প্রতিটি লেখাই হয়ে উঠেছে ভাব ও ভাবনার এক অনুপম নির্ঝর। যেমন- ‘বইগুলি হাতে পথের মোড়ে উপুড়- ঢালুর মাথায় বসা নৌকার গলুই, গলুই বদলে কখন যে হয়ে যায় বাবার ভাঙা চাহনি, ট্রেনের চাকার নিচে কাটা পড়া সবুজসাথী বই, কোন ফাঁকে বিদ্যাপাতা হয়ে পড়ে ভবিষ্যবাদী পাক পাঞ্জাতন, হাতুড়ি ও ডেউয়াফলের মিলন বীক্ষায় তৃতীয় নয়ন, দোয়া আর আশিসে বালুভাত তথায় কেমন যাদু বলে শূন্যে মারে ওড়া, গুটিবসন্তের দাগে ছিটখই বাঁশবাগানের মাথার উপর ফুটে ওঠে তারাদের বেতফল জোড়া জোড়া। দুনিয়া দীঘলে ব্যথার কনফারেন্স বসে, সুরের কৃষিকাজ, আর কাঙ্ক্ষের কলস একা ও একসঙ্গে ডোবে ও ভাসে’ (সঙ্গে প্রাণের খেলা)।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের অধীন ১৯৯৬ সালে। এই গ্রন্থেই রয়েছে তাঁর নিজস্বতার সরব উপস্থিতি। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখি তাঁর শব্দের চয়ন ও চলন, বাক্যের গাঁথুনি ও গতিশীলতা এবং উপস্থাপনের নির্লিপ্তি; সব মিলিয়ে এখানেই তাঁর প্রকাশ একান্ত নিজের বলে চেনা যায়। শুরুতেই ঘোড়াউত্রা গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন ।
‘একটি গ্রাম কাকরগাছি টোনাটুনির বাস / একটি নদী ঘোড়াউত্রা লম্বা গলার হাঁস।
মুখ বাড়িয়ে থাকে নিতুই সঞ্চিবেরি গ্রাম / নাওয়ের গলুই নিয়ে আসে জলসরলার নাম’।
কেননা –
‘এই কাকরগাছি গ্রামের কোমরজড়ানো এক নদী, তাঁর নাম ঘোড়াউত্রা। ঘোড়াউত্রা নদীর ওপরে একদিন পাখিদের হাট বসে। পাখিরা চক্রাকারে ওড়ে। ওড়ে আর বলে, ওই যে ওই যে! আমাদের নিচে আরেকদল পাখি ওড়াওড়ি করে, আরে! আমরা উড়ি, ওরাও যে ওড়ে! দুই দল ওপরে ও নিচে পাল্লা দিয়ে হাওয়ায় ভাসে। হঠাৎ দুর্নিবার এক হাওয়া আসে। পাখায় ঝাপটা দেয়। নদীর জল ছল্কে ছল্কে ওঠে। সহসা নদীর বুকে ঘূর্ণি আসে। নদী ক্ষিপ্র এক পাগলের মতো লাফায়। ঘোড়াউত্রার বুক থেকে অতিকায় এক হাতি তাঁর দীর্ঘ শুঁড় আকাশপানে উত্থিত করে। প্রথমে কাকরগাছি গ্রামের লোকেরা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। যে কিশোর-কিশোরীর দল নদীর পাড়ে শুকনা পাতা কুড়াতে গিয়েছিল, তারা ভাবে, বাহ্ কী মজা! আকাশ যে হারিয়ে যায় ঘুড়ির মেলায়। ওই লাল ঘুড্ডি যাবে বহুদূর, ওই নীলটা গোত্তা খায়, ময়ূরকণ্ঠীটা আমার! দৌড়, দৌড়! কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বোঝে : ওরা দৌড়ায় না, মাঠের ওপর দিয়ে ঘুড্ডির মতোই ওড়ে! রাজহাঁস সমস্বরে চিৎকার করে : প্যাঁক প্যাঁক। গোরু বাছুর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে’।
তারপর –
‘ঘুমে ও জাগরণের ভিতরে আকাশে মেঘ করে। মেঘ থমথম করে। মেঘেদের এতো স্পর্ধা কোত্থেকে আসে? পাথর কী এক ধরণের মেঘ – না হয় পাথরের সঙ্গে পাথর ঘষে দিলে আগুন জ্বলে, মেঘের সঙ্গে মেঘ ঘষে দিলেও আগুন জ্বলে কীভাবে? মেঘ বুঝি দুঃখের দানা, কষ্টের কালো নুনপাথর! চাষীর লাঙলের ফলা থেকে দুঃখ ওঠে, শ্রমিকের হাতের আঙুলে কষ্ট জমে, নারীর ছিন্ন খোপার মধ্য থেকে জমে না–কী করবী ফুলের বীজ! এইসব কিছু জমে হয় মেঘ, মেঘের হানাহানি, মেঘ ডাকে গুরু গুর, আকাশেতে বিজুলি। মেঘেদের ভিতর রাত্রিদিনের ভেদাভেদ লুপ্ত করে মিছিলের ছায়া। কালো মিছিলের ছায়ায় দেখা যায় না, কিন্তু জ্বলে আগুনের শিখা! সে আগুনের উত্তাপে জাইদুল ও জয়ফুল বিবি ছটফট করে, ঢুকে পড়ে আরো লেলিহান অগ্নির ভিতরে’।
গদ্যকবিতা বা কবিতাগদ্য যাই বলি না কেন, এখানে সবার চেষ্টা কবিতা রচনা করা। এটাকে আমরা গদ্যে রচিত কবিতা কিংবা কবিতার গদ্য বলে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু বদরুজ্জামান আলমগীর কবিতা রচনা করেন না, কবিতা যেন তাঁর হাতে নিজেই রচিত হয়ে আছ। তিনি শুধু লিখে দেন গদ্যে কিংবা ছন্দে। তাঁর লেখাগুলো যেন কবিতায় রচিত গদ্য; অর্থাৎ তিনি গদ্যে কবিতা রচনা করেন না, কবিতায় গদ্য রচনা করেন। ভাব, ভাষা ও স্বর মিলিয়ে একটি অমল ঐকতানে এসে মিশে যায় তাঁর এষণা। ‘আবের পাঙ্খা লৈয়া’ অনন্য নাটকের এক স্বতোৎসারিত ‘কাব্যাখ্যান’। যেমন-
‘সেই সময়, যে সময়ের আদি নাই, অন্তও মেলে না, তখন, যা কিছু আছে তা কিছু নাই, যা কিছু নিরস্তিত্ব তা কিছু বিদ্যমান – কী লীলা, সেই ছলাকলায়, তখন শব্দ ছিল প্রথম নীরবতা, ছিল ধ্যানের বিষ্ময়, পৃথিবীতে স্বয়ম্ভূ মন্ত্রের নির্বাণ’।
(জুজুবুড়ি । আবের পাঙ্খা লৈয়া)
এবং
‘নিসর্গে যখন কিছু থাকে না, সকল দৃশ্যমানতা কালের কররেখায় রেখায় হারায়, বস্তু ও মৃতদেহের আকার থাকে রঙের চিহ্নে, তখন পৌষরাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া শনশন করে। যে কালের রাত্রি মর্মর এক ফোঁটা আলোর অভিলাষে পৃথিবীর পুবদিগন্তে ধাবমান তখন শূন্য বিলয় থেকে কাক ডাকে: কা । কা’।
(অহরকণ্ডল । আবের পাঙ্খা লৈয়া)
আবার,
‘মাটি তো তুললাম, কিন্তু মৈকুন তুমি যে বললা আমার লাগি আবের পাঙ্খা আনো! ওগো বাৎসল্য, ওগো বন্ধন, ওলো অমীমাংসা, হা সর্বংসহা মাটিকাদা, যোগসূত্র, বড় আশা, আহা মৈকুন, অন্ধ মৈকুন লো তোমার আবের পাঙ্খা কৈ!’
(আবের পাঙ্খা লৈয়া । আবের পাঙ্খা লৈয়া)
‘বায়েজিদ বোস্তামির কাছিম’ হয়ে বদরুজ্জামান আলমগীর বলে ওঠেন ‘মওলানা জালালউদ্দিন রুমির সঙ্গে বাঁচি/অন্ধকারে খোয়াবের ভিতর/আমি ও সৃষ্টিতত্ত্বের ময়ূর’ (ঈশ্বরের পৈথান । পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর)। তাঁর কাছে ‘কবিতা নোতুন বউ’, কেননা ‘দেউড়ির আড়ালে তার টুং টাং চুড়ির আওয়াজ’; কখনো ‘কবিতা বা স্টিফেন হকিঙ-এর/অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ (কবিতার নাম বলি । পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর)। বদরুজ্জামান আলমগীরের কাছে বেঁচে থাকা মানে ‘অপমানে, লাঞ্ছনায়, ভয়ে, তৃষ্ণায়, মাছের পেটে ইউনুস নবী’; কারণ ‘বেঁচে থাকা ডিজিটাল ক্লক নয় – টিকটিক কাঁটাওয়ালা ঘড়ি, কালিঝুলি, লেনদেন, পিছনে পড়ে থাকা – সিটি দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া’ (যে পিছনে পড়ে । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো); অবশেষে ‘যা কিছু সুন্দর, তাতে সবসময়ই কিছু না কিছু ব্যথার পোঁচ লেগে থাকে’ (সুন্দরের সুইসুতা দড়াদড়ি । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)। কোন এক অবচেতনের অচেনা স্তর থেকে ভাষাকে তিনি ছেড়ে দেন, আর তা আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় অতি চেনা বৃষ্টির রিমঝিম পতনের সাথে; এ যেন সেই মর্মরিত মরমিয়ার সাবলীল সিলসিলা –
‘নির্ভরতার করকমলে নীল আকাশ খোলা জেগেছিল আমার সম্মুখে। চোখের আগে দেখি ক্রমে খয়েরি মেঘের বারামখানা গড়ে ওঠে আসমানের সদর কোঠার সিথানে; সমান্তরালে আমার ভিতরও অঙ্কিত হতে থাকে তোমাকে পাবার এক অনির্বচনীয় আকুতি, স্তব্ধতা ও তৃষ্ণার কাসিদা, ডানাভাঙা পানকৌড়ির মাইজভাণ্ডারি আরশিয়ানা – অজন্তা গুহাচিত্রে ইশকের দিওয়ানা’।
(ইশকের দিওয়ানা । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
এবং –
‘এই যে ব্যাপকদীর্ঘ আপনার একটা জীবন, তাঁকে খুঁজতে যান – কোথাও পাবেন না। সবখানে আছে, তাই কোথাও নির্দিষ্টভাবে নেই।
আপনার সামান্য কিছুদিনের শৈশবটুকু খুঁজে পেতে যান – তার সবটুকু আছে, কিছুই হারিয়ে যায়নি!
ব্যাপারটা অনেকটা এ-রকম: আপনি এখন বিশাল সমুদ্রের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন – আপনার চোখের জলের ফোঁটা যে এই সাগরে পড়েছিল খুঁজতে গেলে কোথায় আপনি তার হদিশ পাবেন, কোথাও পাবেন না!
আপনার চোখের মধ্যে যে জল তিরতির করে তার মধ্যে সাগর খুঁজুন – পাবেন। একফোঁটা চোখের জলে কী অথৈ সাগর টলমল করে!’
(সীমার মাঝে অসীম । হৃদপেয়ারার সুবাস)
আবার –
‘তোমার হলুদ ফিতা নীরবতায় আমি ডাকঘর হয়ে গ্যাছি – শত হৃদয়ের পাহারাদার, সব চিঠি আমার মধ্যে ন্যাপথলিনের গন্ধ রেখে প্রাপকদের বাড়ি চলে যায়। আমার হাতে কেবল জমা থাকে কিছু মেঘ, কিছুটা স্মৃতি ইশকুলের গুঁড়া।
---
আহা, আমরা এতোটাই পরাজিত, দুনিয়া কী ভীষণ এক কুয়া! হাতের বালতি দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেলে জলের নিচে সে গৌতম বুদ্ধ – অমা, আভা জাগে’।
(কুয়া । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
আল মাহমুদের কাছে কবিতা তো ‘আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!’, তারপর ‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস / ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর / গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর / কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ (কবিতা এমন | আল মাহমুদ)। বদরুজ্জামান আলমগীরের কাছে ‘সাধক একজন গর্ভবতী নারী; কবি একজন জননী’ (কবি ও সাধক । হৃদপেয়ারার সুবাস); কেননা ‘একফোঁটা চোখের জলে কী অথৈ সাগর টলমল করে!’(সীমার মাঝে অসীম | হৃদপেয়ারার সুবাস)। এভাবেই বদরুজ্জামান আলমগীর নিবিড় পর্যবেক্ষণে নির্বাণের তুলিতে রাঙিয়ে তোলেন নিরেট বাংলাদেশি মানুষের চিরায়ত চাঞ্চল্য। নির্বিকারভাবে তিনি নির্ণয় করেন অতি পরিচিত জীবনের নির্বেদ ও অন্তর্নিহিত নিলয়। সহজাত সারল্যের কৌণিক আপতন অথবা সরল বিচ্ছুরণ তাঁর লেখার নদী হয়ে বয়ে চলে বাংলাদেশের অতি পরিচিত জীবন ও জলের এবাদতের সন্ধ্যাবাতির খোঁজে। বদরুজ্জামান আলমগীরের ‘ভাঙন আর সৃষ্টির মন্থনঘোরে চরিত্ররা বপন করে কবিতার মর্ম, উপন্যাসের মিথস্ক্রিয়া ও প্রবন্ধের যুক্তিনিষ্ঠ প্যারাডাইম; পথে বাজে দূরের শঙ্খধ্বনি, শূন্যে রচিত হয় বাবুই পাখির মোকাম, পিতলের সুই-এর আগায় সোনামুখি ফোঁড়’ (ব্যাক কভার | আবের পাঙ্খা লৈয়া)।
বাঙালির যাপিত জীবন আর সংস্কৃতি-যাপন মিলে-মিশে একাকার। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেমন একক ও অনন্য, তেমনি তাঁর নিজস্ব ভাষা-প্রকাশরীতিও। কিন্তু বাংলাদেশের কবিতা কোথায় যেন একটা ভদ্র-অভদ্র মিলমিশ নিয়ে মান আর আঞ্চলিকরীতির করাতকলে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত হাহাকারমুখর। কোথায় যেন একটা ভাষা প্রয়োগের লাজুক লতা বেড়ে ওঠে প্রকাশ্যেই। এখানে সাঁকো নয়, ডানা ভেঙে পড়ে যায় মানুষ আর কবিতার প্রাত্যহিক সম্পর্কের যুগল বালিহাঁস। ফুলেল আবেগে অবলীলায় বেজে ওঠে দূর থেকে ভেসে আসা সুর, ফুটে ওঠে জীবনের অপরিহার্য গন্দম। বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখায় বাংলাদেশি ঘটনার চরিত্রগুলোর স্থানিক আবহের মুগ্ধকথনে রচিত হয় পাতার বিস্তার। এমনি বিস্তারে নিজেকে আড়াল করে তাঁর লেখাগুলো যে আপনা-আপনি অর্থমুখর হয়ে বেজে ওঠে –
‘ওই যে ইকাত্তর – সংগ্রামের সন আইলো, মিলিটারি নামলো – উনিও ঘর থাইকা বাইর হয়!
বুড়া পাকুড় গাছের বাকল ফাইটা ফাইটা আমার কপালের লাহান হইয়া গেল – পাকুড় গাছের ভাঙা ডালে বারি দিয়ে কতোবার ঘুন্নিবাই আইলো – খালি তাইন আইয়ে না!’
(অপেক্ষাসংহিতা । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
কিংবা,
‘সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি জেগে থাকে,
একজন কবি এমন – / সবার পক্ষে ক্রুশবিদ্ধ হন যিশুখ্রিস্ট যেমন।
সমুদ্রের অসীম একোরিয়ামে / নুন থৈথৈ পানির আত্মায়
সেলাই করে চোখের জলে নকশিকাঁথা, / প্রাণের তারানা ক্ষণ –
ঢালুর দিকে হেঁটে যাওয়া কবিটি এমন’।
(কবি এমন । দূরত্বের সুফিয়ানা)
এবং,
হায় আল্লা তাইলে কোনাই যাইতাম – কেও কতা হুনে না; তুঁইও কতা রাখ না। ব্যাকে তো খালি হোগা মারে; মন্ত্রী, মিনিস্টার, সদাগর, ইমামসাব, বাউন, গিজ্জার ফাদার, বেজ্ঞুনে গোয়া মারে, তুঁইও দেখি ফাকাও – তাইলে আঁই কনোই যামু!
(দুনিয়াদারি । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
কোন কোন কবি অবশ্য একটি নিজ ভাষাশৈলী নির্মান করে নেন। নির্মানের কালিমা লেপন করে ভাষা কখনো কখনো হয়ে যায় কৃত্রিম অথবা সন্ধি-সমাসের ব্যাকরণিক বিগ্রহ। এখানে প্রমথ চৌধুরীকে স্মরণ করে নিতে চাই, “ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে। কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা করতে গেলেই মুখে শুধু কালি পড়ে।” এই কালিমুখ নিয়েই এতদিন বাংলাদেশের কবিতা ঘুরপাক খেয়েছে অর্থ-অনর্থের শোকের মিছিলে। নিজ ভাষা নির্মান করতে গিয়ে অনেকেই মুখের ভাষাকে কবিতার কলমে না তুলে এনে, কলমের কালিতে ভাষাকেই করেছেন কালিমালিপ্ত। বদরুজ্জামান আলমগীর নিজ ভাষাশৈলী নির্মান না করে বাংলাদেশি মানুষের মুখের ভাষাকে তুলে এনে তাকে দিয়েছেন কবিতার মহিমা। তিনি আসলে কবিতা লিখেন না, কবিতা বলেন, আর তা-ই কাগজের ডালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকে – আমরা তাকে কবিতা বলি। কবিতকাগুলো সংঘটিত হলেও এখানে কোথায় যেন একটি চিরন্তন বাংলাদেশের সহজিয়া মানুষের মাটি ও মুখের ভাষা হেলেঞ্চা শাকের ডগা হয়ে নেচে ওঠে। যে ভাষায় তিনি কথা বলেন, তা-ই তার কবিতার আরাধ্য। মনে হয় এই ভাষা এইমাত্র বাংলাদেশে কারো মুখ থেকে জন্মলাভ করলো, এবং এর আর কোন তুলনা হবে না অন্য কারো ভাষায়- ‘যেইমাত্র দেখি নিরাকারে নাই – আকারেও নাই – বিলিয়ে দেবার এক কানাকড়ি সম্পদও আমার হাতে নাই – তখনই কতো যে মণিমানিক্য ঝিকমিক করে! /অতঃপর যা নাই – তা বিলিয়ে দেবার নির্বিকারে বাদশার দুই হাত বাড়িয়ে দিই!’ (না থাকার বাদশাহি । হৃদপেয়ারার সুবাস)।
জীবনানন্দ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘ভালো কবিতার কেমন একটি আদিম অপূর্বতা আছে; মনে হয় এ যেন সদ্যোজাত অথচ চিরন্তন; এইমাত্র এই মুহূর্তে এর জন্ম হলো, এবং চিরকালের মধ্যে এর মতো আর কিছু হবে না’ (কালের পুতুল)। বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখাগুলো সেই ‘আদিম অপূর্বতা’ দিয়ে দিয়ে মন ভরিয়ে দেয়। তাঁর লেখাগুলো অতি ধীরে নেমে আসে বোধ ও বাৎসায়নের শব্দজল হয়ে। এই জল এক অপার ভাষাহীনতার স্রোতে নদী হয়ে বয়ে চলে ইঙ্গিতের আবহে। কথা ও কাহিনীর ঝাঁকে পাখিরা উড়ে আসে, অথচ কলরবের চিহ্নমাত্র নাই। এক অনুপ্রস্থ সন্ধ্যার অনুরণন খুঁড়ে জ্বলে ওঠে যেন অতি চেনা এক অমেয় পরিশিষ্ট, যার কোন অতীত নাই; এইমাত্র এক ফুলের স্বর এখানে বয়ান করে চলেছে জীবনের মর্মরিত সুর।
যেমন –
‘হাট ছিল- শোরগোল ছিল, মঙ্গলবার বাজারে / বুন্দিয়া বাতি ছিল।
হাট ভেঙে গ্যাছে- মানুষগুলো নেই- এতোগুলো মানুষ! /
শতসহস্র কথার হাড় পড়ে আছে, কথাদের নাকফুল / পড়ে আছে!’
(ভাঙা হাট । দূরত্বের সুফিয়ানা)
আবার–
‘কৃষ্ণ মাত্র ১৬বছর বয়সে বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেন। তিনি যখনই বোঝেন রাধার মন তমাল গাছের একটি পাতা বুঝি কেঁপে উঠেছে, তখনই বাঁশিটি রাধার হাতে তুলে দিয়ে একটি দূরত্বের রঙে লুকিয়ে যান। এভাবেই লীলাবান কৃষ্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে রূপান্তর লাভ করেন’।
(নির্বিকার বিন্দুটি । দূরত্বের সুফিয়ানা)
আলকেমিস্ট-এ পাওলো কোয়েলহো যেমন বলেছেন ‘অপরাপর সবার মতোই আমিও দুনিয়াটাকে দেখি – যেভাবে তাকে দেখতে চাই; বাস্তবে যা, তা থোড়াই পরোয়া করি’। বদরুজ্জামান আলমগীরও ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশি জীবিনের সংবেদ ও সংস্কারগুলোকে দেখেছেন একান্ত নিজের মতো করে; যেভাবে তিনি দেখতে চান, ঠিক সেভাবেই – থোরাই কেয়ার করেন বাস্তবে কে কীভাবে দেখছেন ও লিখছেন। ঘটনাগুলো যেন ঘটে না, তিনিই ঘটিয়ে দেন; একেবারে নিজের মতো করে। এর জন্য প্রয়োজন হলে তিনি খুলে ফেলেন ভাষা ও ব্যাকরণিক ফিতার জটিল গিট্টু। তিনি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজেকে দেখেন ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী লোকাল’ (ব্যাক কভার । আবের পাঙ্খা লৈয়া) হিসাবে। তিনি নিজেকে দূরে রেখে সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোকেই দাঁড় করিয়ে দেন ঘটনা ও ভাষার ব্যবহারিক ব্যাকরণে। এখানে তিনি সবার মধ্যে থেকেও হয়ে ওঠেন অনন্য, দশের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন এগারো। ধার করা শব্দের সমাহারে ভাষা নির্মাণের তরিকাকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর’র মতো তিনিও বলে ওঠেন, ‘না রবে প্রাসাদ গুণ না হবে রসাল/ অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল’ –
‘জোড়া শালিক আঁকলো দুপুর / সোনামুখী সুই
দুর্গাবাড়ির পুকুর ঘাটে / একলা ডোবের দুই।
কেউ নিতে চায় খোলা ঘরে / আমার দুধের বাটি
কে তুলে নেয় আমার পুত্র / শুদ্ধ নিমের মাটি!’
(সারা সুঃখ লৈ । পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর)
অথবা –
সমুদ্র নিঃসঙ্গতায় গিলে ফেলে নিজেরই বোয়াল মাছের পেট। রাত্রি কালো পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকায় – এ রাত্রি উন্মূল তুমুল মীনা কুমারী – নিজেরই রজনী নেকাব, পাহাড়ের খাড়া ঢালু বেয়ে গহ্বরে নূরান্ধকারে উল্লাসে, আর্তনাদে মাহফিলে নামে।
স্তব্ধতার দেয়ালে তানহা রাত্রির কবি পয়ারে, গীতে, রক্তজবার পরাগে ফোটেন। তাঁর আসরে, মহলে আলো ঝলমল – তমসার সিরিঞ্জে ফোঁটা ফোঁটা রঙিন বুদ্বুদ। মীনা কুমারী নাজ জীবনভর নিজেরই কান্না নাকের নোলকে পরেন, কানে ঝুমকায় বাঁধেন, তোলেন শিকলের ইশকে।
(তানহা রাত্রি । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
ঘটনার সংঘটিত পরম্পরা যে কবিতা হতে পারে, বদরুজ্জামান আলমগীরের আগে বাংলা কবিতায় দেখা যায়নি। সোজা কথায়, বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম নিয়ে এলেন প্যারাবলধর্মিতা। শুধু তাই নয়, সহজাত প্যারাবলের যে নীতিধর্মিতা, তাকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে মানুষের বদলে বরং অতি চেনা মানুষ ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গকেই তিনি দিলেন কবিতার মহিমা।শিবলি জামান বদরুজ্জামান আলমগীরের ‘হৃদপেয়ারার সুবাস’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই বইটির মাধ্যমে বাংলা কবিতায় প্রথম বারের মত আমদানি করলেন কবিতার এক নুতন ধারা ‘প্যারাবলধর্মিতা'। বইটি পড়তে শুরু করলেই পাঠক চমকিত হবেন, বিস্মিত হবেন আনন্দিত হবেন এবং মোহাবিষ্ট হবেন। মানব সমাজের গতি প্রকৃতি,মানুষের মন, আধ্যাত্মিকতা,ধর্ম,বাস্তবতা, কুসংস্কার,আচার, রীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বোপরি মানুষের যাপিত জীবনের সংস্কৃতিই এই বইয়ের পাতায় পাতায় আটকে আছে। জীবনের চলার পথের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো সমস্যা, সংগ্রাম আর অভিজ্ঞতাকে তিনি গেঁথে দিয়েছেন এক অনন্য গুচ্ছে। আর ফুলের মত নীরবে যতনে সকলের অগোচরে ফলিয়েছেন কবিতার সুপক্ক একটি রক্তিম ফল’।
তাই বিদেশ-বিভূঁই-এ একজন হকি ওয়েগনারের কাছে বদরুজ্জামান আলমগীরের নদীটি যেন পাশ ফিরে তাকানো রমণীর চেনা মুখ হয়ে উড়ে এসে বসে একেবারে মৃত্তিকার মর্মরে। ‘নদীও পাশ ফেরে’তে ‘সঙ্গে প্রাণের খেলা’য় দেখি এর শিহরিত রূপায়ণ –
‘এবেলায় ওয়েগনার একটু সিরিয়াস; হি সেইড, স্টপ জোকিং ম্যান। তুমি সেদিন আমারে একটা কবিতার বই দেখাইছিলা – তোমার লেখা বই। এবার আমার মনে পড়লো, সেদিন একফাঁকে আমার বই – ‘নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো’ দেখিয়েছিলাম। হকি তোতলাইয়া তোতলাইয়া বইয়ের নামটাও বলার চেষ্টা করে।
আমি এবার মনে করিয়ে দেই – এ রিভার টার্নস এরাউন্ড ইফ ইউ কল হার আ গুজ। অয়েগনার বিড়বিড় করে, আমি জানি না এটি কীভাবে সত্যি, তা-ও জানি না এটি কীভাবে মিথ্যা! নদীও পাশ ফেরে; বাহ, কী অসাধারণ!
আমি ভূতগ্রস্থের মতো বলি: আমাদের নারীরা নদীর কাজিন, আমাদের নদীও নারীর মতো ক্থা কয়, তাই এমন হয় – ঘুমে ঘটে, জাগরণে ঘটে।
হকি ওয়েগনার বলতে বলতে হাঁটে – এ রিভার টার্নস এরাউন্ড ইফ ইউ কল হার এ গুজ’।
কবিতার মেধা ও মনন সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল, কিন্তু অহঙ্কারী নন; বরং নতশির। এক অমৃত ফল্গুধারা তিরতির করে কুলুকুলু রবে পাখি হয়ে যায়, পাখি হয়ে যায়। ‘সঙ্গে প্রাণের খেলা’র ‘কবিতাগদ্য’ তারই প্রমাণ- ‘প্যারাবলে খ্রিস্টীয় সুসমাচার গ্রহণ করেন কোহলিল জিবরান, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপসংহারে অভ্রান্ত বাইবেলীয় পরিকল্পনা তুলে আনেন অক্টাভিয়া বাটলার; কিন্তু খ্রিস্টীয় নীতিশাস্ত্র পরিহার করেন ফ্রানজ কাফকা, প্যারাবল লেখায় শিল্পবোধই প্রধান ও শেষ বিবেচনা হোর্হে লুই বোর্হেস-এর বেলায়, কালের বিন্দুবিন্দু জরুল ইটালো কালভিনোর সিদ্ধি, পাওলো কোয়েলহো ইতিহাসের কেন্দ্রে গঠিত হওয়া শুভবোধে নিষ্ঠ – তাঁর মধ্যে গহীন ভিতরে হয়তো খ্রিষ্টীয় মনোনয়নের একটি দূরবর্তী পোঁচ দেখা যায়। হৃদপেয়ারার সুবাসে মায়াবী পর্দার আড়ালে আছেন বাঙলার এক বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষিজীবী দার্শনিক, অন্তঃসলিলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মধ্য আশির বৈকালিক আসনে মনন ও সাহসে স্থিরকৃত ডক্টর আহমদ শরীফ, স্ট্রিট ফিলসোফির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সক্রেটিস আছেন, লালন সাঁইজি না থাকলে এমন নির্ভীকচিত্ততা কোত্থেকে আসে!’
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যেমনটি বলেছিলেন আমহদ ছফাকে - ‘লেখার ব্যাপারটি অইল পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো ব্যাপার। যতো বড় ঢিল যত জোরে ছুঁড়বেন পাঠকের মনে, তরঙ্গটাও তত জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকব” (যদ্যপি আমার গুরু । আহমদ ছফা)। বদরুজ্জামান আলমগীরও যেনো লাঙলের ফলা থেকে বের হয়ে আসা বাংলাদেশি জমির বড় বড় ঢিল নিয়ে তা ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশি কবিতার পরিচিত পুকুরে। শুধু বাংলাদেশের ভাব ও ভাষা থেকে প্রাপ্ত অনুষঙ্গ নয়, বরং তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মিথ ও মদিরা মন্থন করে তাকে উপস্থাপিত করেন একেবারে খাঁটি বাংলাদেশীয় অনুষঙ্গে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত মিথ ও ঐতিহাসিক ঘটনার শৈল্পিক সুষমাগুলো তাই কখনোই ধৈর্যচ্যুতির কারন হয়ে ওঠে না। প্রথাগত স্থানিক অবস্থিতির ধারণা থেকে বের হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী লোকাল’। তাঁর মনমৃত্তিকার মর্মের ভিতর মিলান কুন্ডেরার ‘আইডেন্টিটি’ উপন্যাসের শেষে উচ্চারিত প্রশ্নের অনুরণন জেগে ওঠে – ‘অনুঘটক মুহূর্তটি আসলে ঠিক কোন ক্ষণটিকে বলা যাবে- যা বাস্তব থেকে অধিবাস্তবে রূপান্তরিত হয়, নিরেট বাস্তব আর বাস্তবের ধোঁয়াশা- কেমন করে বোঝা যাবে- এর সীমারেখা কোনটি?’ –
‘আমি আনন্দে কাবু হয়ে যাই – ভারত না, পাকিস্তান না, নেপাল-শ্রীলঙ্কার নাম বলেনি – একদম বাংলাদেশ! আমি বলি, ইউ আর জাস্ট ফেনোমেনাল জেনিফার! কিন্তু খাপেখাপ বুঝলা কেমনে? তোমার হাসি দেখে বুঝেছি তুমি বাংলাদেশের ছেলে।
আমি এক বাঙলার সন্তান – যেখানে পরিশ্রমী প্রান্তিক মানুষেরা সারাজীবন অন্যের জন্য বাঁচে – নিজের বেঁচে থাকার কথা, সুখ স্বাচ্ছন্দের অঙ্ক পরমানন্দে ভুলে থাকে, তাঁরা আমাদের মা লক্ষ্মীর সমান্তরালে এক ফলিত লক্ষ্মী গড়ে তুলেছেন, তাঁদের অভিধানে কাজই লক্ষ্মী, কর্মই উপাসনা! তাঁরা যা আয় করেন তার থেকে বেশি খরচ করে ফেলেন, ফলে তাঁদের অভাব দূর হয় না – কিন্তু তারপরও তাঁরা কোরাণের আয়াতের পবিত্রতায় হাসেন, বেদের মন্ত্রে ঝরিঝরি কাঁদেন!’
(বাঙলায় হাসি । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
আবার,
‘নানা ঘাটে ভিড়িয়ে ডিঙা পান খেতে খেতেই একজীবন হঠাৎ কোনদিক দিয়ে আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়; মেলার, হাটের কোন মোড়ে কোন সওদা – তা হিসাবের খাতায় আনতে আনতেই দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে আহা’!
(কাহার লাগি ফুরায় লেনদেন । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
স্টিফেন স্পেন্ডারের ‘দ্য মেকিং অব আ পোয়েম’ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলছেন, ‘কবির কাজ হচ্ছে প্রতীকটি যতই লোভনীয় হোক সেটি কবিতা থেকে একেবারে দূরে রাখা। প্রতীক নিয়ে আপ্লুত হওয়া কবির কাজ নয়। কবির কাজ হচ্ছে ছবিটিকে শব্দের শরীরে ধরা, উচ্চারণের মাধ্যমে ছবিটিকে তৈরি করা এবং যে কবিতাটি লেখা হবে তাকেই দায় তুলে দেয়া যে তুমি প্রকাশিত হয়ে পাঠকের কাছে কবির অভিপ্রেত অর্থসহ আবিষ্কৃত হবার অপেক্ষায় থাকো’। বদরুজ্জামান আলমগীর তাঁর লেখাগুলোকে নিজে প্রকাশ করেন না; বরং লিখেই যেনো বলে দেন, ‘যা রে যা চিঠি লেইখা দিলাম সোনা বন্ধুর নামে রে’। লেখাগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রকাশিত করে তোলে। উপমান ও উৎপ্রেক্ষার উসকানি, রূপকের রুলি, ছন্দের ছাউনি বা প্রতীকের আসকারা সবকিছু পাশে রেখে তিনি হেঁটে চলেন বাংলাদেশি কবিতা-মাটির আলপথে। এক অনাবিল নির্লিপ্তি নিয়ে তিনি যেন নিজেই নদী হয়ে দেখেন স্রোতের বয়ে যাওয়া। পড়তে পড়তে পাঠককে কোথায় তুলে যেনো তিনি বলেন, এবার নামো তো যাদু, কিন্তু নামার কোন পথ আর নাই – কেননা অতি চেনা অনুভবের মেঘবাড়ি থেকে নেমে আসতে কোন পথ লাগে না, লাগে দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর লেখার সাথে সাথে পাঠকও যেনো হয়ে উঠেন পানির গভীর থেকে তুলে মাছ মুখে ধরে বসে থাকা পরিতৃপ্ত পানকৌড়ি –
‘মর্মের বাগানে গুরু একা মুরশিদ হয় না; ভুবন অর্থে তাতে অদল-বদল লাগবে। গুরু যদি শিষ্য না হয় সেই গুরু সরকারি আমলার সামিল – তাতে ভরসার মধু মেলে না।
মানুষ সবচেয়ে বড় জ্ঞানী যখন সে অজ্ঞানী; একজন তখনই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক যখন তিনি সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র’।
(ভুবন গুরু । হৃদপেয়ারার সুবাস)
আরো –
সেই সময় রাবেয়া বসরীর নামে একটা গল্প চাউর ছিল : লোকে দেখে তাঁর এক হাতে আগুন আরেক হাতে পানি নিয়ে বেজান দৌড়ে যাচ্ছেন। এই আগুন আর জল দিয়ে রাবেয়া কী করবেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- পানি ঢেলে দোযখের আগুন নিভাবেন, আর আগুন দিয়ে বেহেস্ত জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবেন।
তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতাটিও তিনি তখনই লেখেন : জান্নাত মিসমার করে দেয়া হোক, যেন মনে না হয় আমি বেহেশতের লোভে তোমার পায়রোবি করি; জাহান্নাম তুলে দাও যাতে তুমি না ভাবো- দোযখের ভয়ে আমি তোমার ভজনা ইন্তেজামে নামি!
(রাবেয়া বসরীর পলাপলি খেলা । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
কবিতায় ছন্দ ও চিত্রকল্পের চেয়ে ভাষা অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। ছন্দকে পাশে রেখে, চিত্রকল্পকে ডিঙিয়ে কবিতায় ভাষা হয়ে ওঠে অর্থ-অনর্থের দোদুল্যমানতার তীর্যক প্রকাশের সারল্য নির্ঝর। আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘কালজ ও কালোত্তর’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘শিল্পের কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। কবিতারও নেই ওরকম কোনো যান্ত্রিক সংজ্ঞা। পৃথিবীতে নতুন কবিতা যতোদিন লেখা হবে ততোদিন তার জন্যে নতুন নিয়মও সৃষ্টি হবে’। আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও কিছু বেশি প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী তা বলাই শক্ত’। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ ওই যে বলেছেন বেশিটুকু – আমি বলি ওই বেশিটুকুই কবিতা’। বদরুজ্জামান আলমগীর নিজস্ব মনন ও মহিমা দিয়ে বাংলাদেশের কবিতাকে নিয়ে গেছেন আটপৌরে বাংলাদেশি যাপিত জীনবনের উনুনে ও উঠোনে; দিয়েছেন সেই বেশিটুকু, যা তাঁর প্রতিটি লেখাকে এনে দেয় কবিতার মহিমা। তিনি যেনো অতি পরিচিত কোন বাংলাদেশির জীবনবোধকেই অনূদিত করেন তাঁর কবিতায় – একান্ত তাঁরই মুখ থেকে বিচ্ছুরিত ভাষা ও ভাবের প্রবাহে অথচ অনিবার্য এক ‘তীর্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি’তে। তাঁর ব্যবহৃত বচন ও বাচনভঙ্গি যেনো বাংলাদেশের আলো-হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো পানকৌড়ির তুলে আনা উজ্জ্বল মাছ। প্রতিদিনের ব্যবহৃত যে কোন শব্দই তাঁর কাছে ফেলনা নয়। নিজ স্বর ও স্বরভঙ্গি দিয়ে প্রতিটি শব্দই হয়ে ওঠে অনিবার্য আড়ালের এক তীর্যক তীর। কবিতার শব্দ চয়ন বিষয়ে ‘যেভাবে কবিতা লিখতে হয় না’ প্রবন্ধে বিখ্যাত ক্যানাডিয়ান লেখক উইলিয়াম লিকক প্রাণীর সাথে প্রাণীর এবং শিশুর সাথে মানুষের প্রাথমিক কথোপকথনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন – ‘এখানে আমরা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসাবে কোনভাবেই শব্দ নয়, বিবেচনা করি স্বর ও বাচনভঙ্গি’। বদরুজ্জামান আলমগীরও ঠিক সেভাবেই কবিতার সাথে আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেন অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিমায় –
‘চোখের জল বুঝি কোরানের আয়াত / তাকে মাটিতে ফেলতে নেই
নদী বা সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের / গতির মুখে ফেলতে হয়,
না হয় তুলে রাখতে হয় হাতের রেহেলে।
--- --- ---
উপরে জলের ফোঁটা নিচে থাকে ফাটাফাটা ভূমি
মাঝখানে মাথা নুয়ে ধ্যান করে জালালউদ্দিন রুমি’।
(একদানা মহাকাব্য । দূরত্বের সুফিয়ানা)
আবার,
‘জীবন এমনই – কাঠঠোকরার ঠোঁটে নিজেরই খানিকটা
রক্ত, আমরা মনে করি পলাশ ফুটে আছে’!
(নিসর্গের নুন সিরিজ । দূরত্বের সুফিয়ানা)
কিংবা,
কোন যে ব্যথার সোয়াবে খোয়াবে / জল কাঁপে তিরতির
কার্পাস তুলা কেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে ডোবে / বলো তার তাফসির!
(প্রতিধ্বনি । দূরত্বের সুফিয়ানা)
বাংলাদেশের কবিতা এক ধরনের প্রথাগত আধুনিক। এই প্রথার গভীরে রয়েছে শিল্প সংক্রান্ত কুসংস্কারের ভাঙা কুলা। তাই নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা আর কোলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিকতার জগদ্দল পাথর। এর সাথে যোগ হয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানসর্বস্ব পত্রিকার লেখক বানানোর ও পুরস্কারপ্রাপ্তির রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। ফলে বাংলাদেশের কবিতা বারবার হয়েছে কলুষিত – ভাবে ও ভাষায়, করণে ও প্রকরণে; আধুনিকতার নামে হয়ে উঠেছে অনুকরণের বিষবৃক্ষ। কবিতার গায়ে কলুষ লাগিয়ে আমরা শিল্পের লাঠি লজেন্স মুখে দিয়ে নেচে উঠি তা তা থৈ থৈ। ‘কলুষিত কবিতা’ প্রসঙ্গে পাবলো নেরুদা বলেছেন – ‘কবিতায়ও কালিঝুলি থাকে; যেভাবে আমাদের পরিধেয় বস্ত্র অথবা শরীরে স্যুপের দাগ, লজ্জাকর ব্যবহারের নোংরামি, মুখের বলিরেখা, অনিদ্রা ও স্বপ্ন, পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎবাণী, ঘৃণা ও ভালোবাসার প্রকাশ, প্রত্যাখ্যান ও সন্দেহ, সম্মতি ও বোঝার কলুষ লেগে থাকে’। বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতাগুলো যেন হয়ে ওঠে আমাদের প্রতিদিনের সমন্বিত শুশ্রূষার আবহসঙ্গীত, কলুষ থেকে মুক্তির এক মহাসোপান – প্রকাশিত প্রায়শ্চিত্ত। কথাগুলোকে তিনি যেন বল সাবানে ধুয়ে রোদে শুকাতে দেন পাঠকের সামনে। একেবারে মচমচে টানটান। কোথাও কোন ভাঁজ নেই, খাঁজ নেই। যেমন –
‘সোফিস্টরা দাবি করতেন, তাঁরা জানেন। সক্রেটিস বলতেন, আমি জানি না। তাদের সঙ্গে আমার তফাৎ এখানেই। তারা যে জানে না – তা তারা জানে না; কিন্তু আমি যে জানি না – আমি তা জানি।
জাক লাঁকা বলেন, আমার অবস্থা আরো বেগতিক; আমি জানি – এই কথার অর্থ কী আমি তা-ই জানি না।
অজানার অতলে উন্নীত হবার এমন মেধা ও সংকল্পই মধু। মধু বুঝি?’
(উত্তরের প্রশ্ন । সঙ্গে প্রাণের খেলা)
হোর্হে লুই বোর্হেসে আমরা দেখি ‘সময়ের মর্মেই আমার অস্তিত্ব। সময়নদীই আমাকে বয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু আমিই নদী; আমিই সেই বাঘ, যে আমাকে ধ্বংস করে; আমিই সেই আগুন যে আমাকে গ্রাস করে’। বদরুজ্জামান আলমগীরও যেন সেই আগুনের প্রতীকে নিজেকেই রচনা করেন একান্তে। সময়ের স্মারকে প্রবাহিত নদীর পাশে তিনি হয়ে যান নদী, প্রজ্জ্বলিত আগুনের নিচে তিনিই আগুন হয়ে ফুটে উঠেন পাথরের ফুল –
‘ঢেউয়ের সমান নামনিশানা সুরের নামে চিন
হৃদকাঁপানি মৌন ডালিম রঙকানা দুই মীন’।
(মৌন ডালিম । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
এবং –
‘এই দুনিয়ার মিউজিয়ামে প্রত্যেকটি মানুষই একেকটা পেইন্টিং। প্রতিটি লোক পেইন্টিঙের দেখা ও অদেখা, সরবতা আর নীরব, বলা এবং অবলার নিরাশ্রয় ওঙ্কার।
---- ---- ----
প্রকৃতির বর্ষা কখনই নামতার মত মুখস্থ করে রাখে না তারই অন্দরমহলে অন্তরীণ গ্রীষ্মের দাবদাহ, শীত তার মুহ্যমানতায় একমুহূর্তের জন্যও মনে রাখে না বসন্তের উন্মন; এভাবেই প্রত্যেকটি মানুষ একেকজন লুকোচুরি খেলা – নিজে সে অমৃতা শেরগীল, নিজেই সুলতানের বড় ক্যানভাস; ধরে রাখে এল গ্রেকোর আর্তনাদ, একই সঙ্গে শাহাবুদ্দীনের অপ্রতিরোধ্য সমবায়।
সে কখনও তাফসির করতে পারে না – কীভাবে সে এক অসামান্য চিত্রকর, কেমন করেই বা এঁকে রাখে ভুবনডিঙানো চিত্রকর্ম এক’।
(পেইন্টিং । নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো)
প্রতিদিনের অতি সূক্ষ্ম ঘটনাবলী কথাচ্ছলে এঁকে দিয়ে তিনি অনুভব করেন পাতার নয়, পাথরের মর্মর; আর্তনাদের নয়, গন্তব্যের গমক; অভিজ্ঞতার নয়, অন্তর্লীন অভিজ্ঞান। তাই লেখার মাঝে তিনি ফুটিয়ে তুলেন প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য সঙ্গতি; যা পাঠকের অনুভবের উদ্দীপ্ত কল্পনাকে দান করে ইন্দ্রিয়জ সংবেদ। সুবীর কুমার নন্দী তাঁর ‘নন্দনতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘কবি এই যে পাঠকের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করেন তাঁর বিশিষ্ট শৈলীতে কাব্যের কথাগুলিকে সাজিয়ে, তাঁর ফলে পাঠক শিশুসুলভ কল্পনার আশ্রয়ে নতুন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেই অভিজ্ঞতা পুরোনো গতানুগতিকতাকে অস্বীকার করে বিচিত্রতর ইন্দ্রিয়জ সংবেদনকে আশ্রয় করে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি তাঁর কাব্যে অভিজ্ঞতায় পাওয়া সমস্ত খুঁটিনাটি শুদ্ধ এক একটা আস্ত সংবেদনকে চিত্রিত করেন’। বদরুজ্জামান আলমগীরও এভাবে অনুভব করেন পতনের গভীরতা, স্মৃতিময় দিগন্তরাশি, আনন্দের সান্ত্বনা, চকচক করে হেসে ওঠা ঘাসেদের হাসি –
‘আজো খানিকটা আউলা ঝাউলা আছে, থাক না;
হাটবাজারে শোরগোল থাকবে,
দূরত্বে থাকবে ইনসমনিয়া – এটাই কী স্বাভাবিক নয়?’
(ইথার । দূরত্বের সুফিয়ানা)
এবং-
‘আমি ঘরে যাই না – এক বৈশাখ থেকে আরেক বৈশাখ আম কুড়ানোর প্রতীক্ষায় থাকি; আম গাছটির সাথী – এক চৈত্র থেকে আরেক চৈত্র নাগাদ বোলের আশায়আশায় অপেক্ষা করে জাগি।
আমি সাধক রাবেয়া বসরীর জাত, এবং যে-মাত্র কবিতার বীজানু ধারণ করি তখনই জাতে আমি নারী। সামান্য তৃষ্ণায় এক ছটাক জল পান করা রাবেয়া বসরীর স্বভাব নয় – চৈত্রের ফাটাফাটা চৌচির মাটি আমি…’
(কবির সাক্ষাৎকার । হৃদপেয়ারার সুবাস)
মনে পড়ছে হাফিজের সেই ‘আনন্দভাইরাস’ কবিতার কথা, ‘তারাদের তলদেশে গান করার সময় গতরাতে আমি / এই আনন্দভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। / এটি বড়ই ছোঁয়াচে – / কাজেই আমাকে চুম্বন করো’। বদরুজ্জামান আলমগীর দেখেন, ‘প্রত্যেকটি ছেলে প্রতিদিন একজন ঘুমন্ত পরীকে জাগিয়ে তোলে; প্রত্যেকটি মেয়ের একজন রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোথাও পরী নেই, রাজকুমার কবেই কালের গর্ভে হারিয়ে বিলীন।--- জীবন আনন্দ আর বিষাদে এভাবেই ফলবান: যার সাথে দেখা হয় – তার সাথে দেখা হয় না’ (অন্য কেউ । হৃদপেয়ারার সুবাস)।
বদরুজ্জামান আলমগীরের অনুবাদের কথা সম্পূর্ণ একটি আলোচনার দাবি রাখে। অনুবাদও যে টিপসই দিয়ে নিজের করে নেওয়া যায়, বদরুজ্জামান আলমগীরের আগে আমি দেখিনি। এখানেও নাম মুছে দিয়ে পড়েই বলে দেয়া যায় এই অনুবাদটি কে করেছেন। অনুবাদ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের মত, ‘কবিতার অনুবাদ দুইজন কবির সন্ধিসনদ; দুজন পথচারী কবি এক জংশন বিন্দুতে এসে একটি চুক্তি সই করে – ওইটাই অনূদিত কবিতারূপে বুদ্ধ পুর্ণিমায় একাকী কন্যাকুমারীর মাধুরী লয়ে হাজির হয়। ---- অনুবাদে কিছু আটকেপড়া মুহূর্তকে খোলা হাওয়ায় মেলে ধরার বোঝাপড়া থাকে। একজন ইংরেজি ভাষাভাষী কবি যখন বলেন – এ গড হেয়ার গেট নারিশড ডিপ ইন্সাইড মাই হার্ট – আমি তাঁর বাংলা করি এরকম – আমার প্রাণের ভিতর হিয়ার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে মাবুদ’ (এসো প্রাঙ্গণে মোর । সঙ্গে প্রাণের খেলা)। অনাড়ষ্টতা, আত্মমুদ্রিত ভাষার সিল-ছাপ্পর আর শব্দের যোজনাই তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় –
‘এমনি ঘুমঘোর গতরজনীর আনন্দ ভুল-
আলোক উদ্গাতা সূর্যদেব ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’
রৌদ্র মদিরা ধ্বনি / আর আঁখিবন্ধনে জমে ওঠে জলবিন্দু স্ফটিক।
নিদ্রার গুমরে / বিগত নিশি খোয়াবের বিচ্ছুরণে ফুটতে থাকে,
আর / প্রাণের ভিতর হিয়ার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে মাবুদ!’
(ঘুমে খোয়াবের জাল । ঢেউগুলো যমজ বোন)
আবার–
‘আমি দম-দেয়া এক দাবারুকে খোঁজ করছি, তার মাথায় থাকবে লাল পাগড়ি। আমি শুনি ওখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন পিথাগোরাস এবং সুশোভন ভারী এক বুজুর্গ—যিনি ঈশ্বরের কর্ণকুহরে নীরবতার রেওয়াজ শুনতে পান।
অসীমতা আর সময় দুই দরকারি চাবি—প্রত্যেকেই তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশভাগ, কিন্তু এক ঝলক দেখামাত্র বোঝা যায়, ওই সমগ্রের যৌগ আসলে কিছু নয়।
ভাসমান, উজাগর মানুষের রাত, ঘড়ির চাবিআঁটা আত্মায় নিশিঘোর রজনী তাদের—সকলই হাজির যামিনীর কারখানায়—আয়নামহল যার।
এখানে পিতলের গিনি সোনায় অলংকৃত একটি হাত উত্থিত—হাতের পাঁচ আঙুল অঙ্গুলি নয়—বুঝি লকলকে কুকুরের পঞ্চমুখ- সবার আগে বিস্ফারিত ভয়াকুল দুটি চোখ!’
(রাতে পুরনো পোস্টকার্ড । চার্লস সিমিকের কবিতা)
এবং –
‘আর কতো শত গ্লানি, কতো যে মালিন্য আকার
স্বপ্ন ছিনতাই, ক্ষরণ, ক্ষরণ- ভেঙে পড়া হৃদকৌটা।
ক্ষীণজীবী ঊনাকার সামান্য পোকার নৃত্য বৈঠক,
পাখির একাকী বিরহ ডাক তোমাকে দেয় শান্তির দুইদণ্ড
বাতাসের প্রসন্ন পালক তোমাকে ছোঁয়ায় আনমনা সুমধুর।
আমাকে একটু একা থাকতে দাও- একা।
--- --- ---
থাক, কেবল সামান্য ক্ষণের অতলটুকু থাক-
এই গ্রীস্মের সুমধুর একফালি ঘন্টা।
আসুক বৈঁচি ফুলের একচিলতে সুবাস’।
(হেরমান হেস, ঘাসের বিছানায় । ঢেউগুলো যমজ বোন।)
প্রকৃতিই যে মৌলিক, তা আর একবার বদরুজ্জামান আলমগীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। নিগূঢ় বাংলাদেশি হিম ও হরিৎ, শোভা ও শূন্যতা, দাহ ও দ্রোহ, হল্লা ও হীনতা, বিশ্বাস ও বিভঙ্গ, আচার ও আকাম সবকিছু দুইহাতে সরিয়ে এক নিরলস আশ্রয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান কবিতার অলিগলি। ভাব ও ভাষার এক অনাবিল চাঞ্চল্যে পাঠক হারিয়ে ফেলে নিজেকে, কিন্তু সে হারায় না; আসলে হারিয়ে আবার ফিরে ফিরে আসে শেকড়ে-বাকরে। সমস্ত ঘটনা ও যোগাযোগ মনে হয় একটি সরল বাকপ্রতিমা, যেখানে নেই আয়াসসাধ্য কোন জটিল বাকনির্মিতি। সবকিছু পাশ কাটিয়ে কবি অনুভব করেন নিরাভরণ প্রকৃতির অনুরণন। কবিতার শব্দ ও শরীর যেন এক অবিচ্ছিন্ন অনুভব। জীবনানন্দ প্রসঙ্গে সমীরণ মজুমদার যেমন বলেছেন, ‘কবিতার শব্দ কিংবা বাকপ্রতিমাকে কবিতার শরীর থেকে পৃথক করা যায় না। কবিতার আবেদন তার সমগ্রতায়। কবিতার যে আবেদনটি আমাদের অনুভূতিতে সঞ্চারিত হয়, তা শব্দ, বাক-প্রতিমা কিংবা ছন্দ কোন কিছুতেই এককভাবে সংস্থিত নয়, সে আবেদন কবিতার সমগ্র মুখলাবণ্যে পরিব্যাপ্ত। কিন্তু কবিতার দেহে পরিব্যাপ্ত হয়েও সে লাবণ্য দেহাতীত। সে সৌন্দর্য যেন মোহন সঙ্গীতের রেশ হয়ে আমাদের অন্তরে নিরন্তর অনুরণিত হয়’। বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখাগুলো পাঠশেষে ‘যেন মোহন সঙ্গীতের রেশ হয়ে আমাদের অন্তরে নিরন্তর অনুরণিত হয়’।
মনসুর হাল্লাজের নিগূঢ় অন্তর্দর্শন, রাবেয়া বসরীর পরিশুদ্ধ আত্মার আকুতি, নূহ নবীর নৌকা, খনার কৃষিতত্ত্ব, বাউলের আত্মানুসন্ধান, রুমীর আত্ম অন্বেষণ, জাগতিক বিলয় ও বিনষ্টি, দৈনন্দিন বন্ধন ও বাৎসল্য, যাদবের পাটীগণিত, জীবনানন্দের চিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এক পা, ধর্মের গ্রহণ, হরিণের ডানা, বুড়ি মা ও অমর্ত্য সেনের অর্থনীতি, পরমাত্মার ময়ূরতত্ত্ব, ঈশ্বরমুহূর্তের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব, অন্তর্গত মৃগেল মাছের চোখ, রাধা-কৃষ্ণের নৃতত্ত্ব, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য-সংবেদ, সাম্য ও মৈত্রীর মেলবন্ধন, ফ্রয়েডের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, শ্রেণি ও শোষণের এজমালি, অন্ধকারের হীরন্ময় আলোকছটা – সব মিলিয়ে এক অনুপম অনুধ্যানের স্বরলিপি নিয়ে বিমূর্ত উপলব্ধিগুলোকে তিনি দিয়েছেন মূর্তিময় মর্ম।
অনু হোসেন তাঁর ‘বাংলাদেশের কবিতা : লোকসংস্কৃতির নন্দনতত্ত্ব’-গ্রন্থে বলেছেন, ‘কবির কাজ হল তাঁর কবিসত্তার মাধ্যমে মননপরিস্রুত আবেগ বা আবেগচালিত মননের দ্বারা নানা উপমানচিত্র সৃষ্টির সাহায্যে তাঁর উপলব্ধির বিমূর্ততাকে মূর্তায়ন করা’। বদরুজ্জামান আলমগীর সেই কাজটিই করছেন তাঁর অনন্য শিল্পমেধার সমন্বয়ে। তাঁর ‘হৃদপেয়ারার সুবাস'- এর ‘একজীবনে’ তাঁর দ্বিধাহীন উচ্চারণ - ‘আমার মুরশিদ গুণমণি গো, লোহারে বানাইলা কাঞ্চা সোনা!’ এখানে তিনি অনন্য, কেননা তিনি যা-ই লেখেন তা-ই হয়ে ওঠে সহজিয়া মাটি ও মানুষের মননের মর্মের মিথ ও মনীষার মূল। বদরুজ্জামান আলমগীর আমাদের মাটিলগ্ন কৃষিসম্প্রদায়ের মর্মের মূলে ফুটে উঠেন একজন আগুনের ঢেউ।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান