ঢাকায় এক শীতের রাত। ফ্রাঁসোয়াজ ল্যইঁ নামের গৃহপরিচারিকার বিপন্ন অস্তিত্বকে যখন নিজের মধ্যে ধারণ করছি, বরফঢাকা কিউবেক শহরে বহিরাগত ফরাসীরা আসছে বসতি গড়ার জন্য। তখন আঠারো শতকের শুরু। ফরাসি অধিবাসীরা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করছে। ফরাসী সংখ্যাধিক্যের কারণেই কিউবেকের ডাকনাম হলো ‘নয়া ফ্রান্স’।
সেই সময়ে কিউবেকে প্রচলিত ছিল ঔপনিবেশিক আইন। তেমন একটি আইনকে ঘিরে মার্গারেট অ্যাটউড ‘ম্যারিং দ্যা হ্যাংম্যান’ শিরোনামে আশ্চর্য এক কবিতা লেখেন। এই কবিতা তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে একজন নারীর পরিণতি এবং সমাজের ভাষ্য। নিজেকে নারীবাদী লেখক তিনি বলেন না। যদিও অ্যাটউডের লেখাপত্রে নারীজীবনের সঙ্কট আর দুর্যোগ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য সমালোচনা আর প্রবন্ধের জন্য অ্যাটউড সম্যক পরিচিত। বলা যায় উপন্যাস ‘দ্যা হ্যান্ডমেইড’স টেল’ এর জন্যই বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক কাজুও ইশিগুরু নোবেল পুরস্কার পাবার পর গ্লোব অ্যান্ড মেইলকে বলেছিলেন- I apologize to Margaret Atwood that it’s not her getting this prize. I genuinely thought she would win it very soon. I never for a moment thought I would. I always thought it would be Margaret Atwood very soon; and I still think that, I still hope that. ইশিগুরুর মনে হয়েছে নিজের নোবেল প্রাপ্তির জন্য মার্গারেট অ্যাটউডের কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত কারণ অ্যাটউডই এ মুহূর্তে নোবল পুরস্কার পাবার যোগ্যতম সাহিত্যিক। এ কথা জেনে ইশিগুরুকে সহসা মহানুভবতায় অনন্য একজন মহৎ লেখক মনে হয় । সাথে এই ভাবনাটুকুও জাগে, নোবেল না পেয়েও অ্যাটউড তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের জন্য বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
একালে-সেকালে সময়ের ফেরে নারীদের অবস্থা আর অবস্থান কতটা আলাদা সেই উত্তর খুঁজতে গেলে মার্গারেট অ্যাটউডের কথাসাহিত্যের মতো কবিতার কাছেও ফিরে যেতে হয়। তাঁর বিশাল সৃষ্টিশীল ভুবন থেকে ‘ফাঁসুড়েকে বিয়ের পয়গাম’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি পড়া জরুরী হয়ে ওঠে। তাই শীতের রাতে উষ্ণতার হাতছানি ফেলে আমি কেনাডার ঔপনিবেশিক অতীতের শৈত্যপ্রবাহের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। কবিতা পরিভ্রমণ করি। এর চলন গদ্যের মতো হলেও গদ্যের অধিক কবিতা হয়ে উঠছে ইঙ্গিতে, অবয়বে, অনুভবে। অ্যাটউড এর কবিদৃষ্টি নারীকে কতদূর অব্দি দেখতে পায় সেটা উপলব্ধি করা যায় চিত্রকল্প আর রূপকে। পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারে একটি ভাবনা ক্রমশ কবিতা হয়ে উঠছে। দেখে নিই এ কবিতা কী বলে-
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নারীটির মৃত্যুর আদেশ হলো। একজন পুরুষ
ফাঁসুড়ে হয়ে ফাঁসি থেকে রেহাই পেয়ে যায়,
নারী রক্ষা পেতে পারে ফাঁসুড়েকে বিয়ে করে। কিন্তু সেখানে
এখন কোনো ফাঁসুড়ে নেই; তাই বাঁচার পথও নেই।
সেখানে শুধুই মৃত্যু, যা অনিশ্চিতভাবে থেমে আছে।
এটা কোনো কল্পনা নয়, এটা ইতিহাস।
*
কারাগারে আয়না ছাড়াই বেঁচে থাকা। আয়নাহীন
মানে নিজেকে ভুলে থাকা। নারীটিও
আত্মবিস্মৃত হয়েই বাঁচে, পাথরের দেয়ালে ছিদ্র খুঁজে পায় আর
ওপাশে একটা কণ্ঠস্বর।
স্বরটি আঁধারে ভেসে আসে এবং এর কোনো মুখাবয়ব নেই।
এই স্বরই নারীটির আয়না হয়ে ওঠে।
*
মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে হলে, যে মৃত্যু তার জন্য নির্ধারিত,
মোচড়ানো ঘাড় আর ফুলে ওঠে জিভ,
নারীটিকে বিয়ে করতে হবে ফাঁসুড়েকে।
কিন্তু সেখানে ফাঁসুড়ে নেই, প্রথমে তাকে
ফাঁসুড়ে বানাতে হবে, রাজি করাতে হবে পুরুষটিকে
কন্ঠস্বরের ওপারে যে, সেই স্বর যাকে সে কখনো দ্যাখেনি এবং সেও
তাকে দ্যাখেনি, এই অন্ধকারে প্রলুব্ধ করতে হবে
পুরুষটির মুখ এড়িয়ে, মুখ বদলে নিতে হবে ব্যক্তিসত্তাহীন
মৃত্যুর মুখোশের সাথে, যে আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর চোখ আছে কিন্তু
মুখগহ্বর নেই, যা এক বিষণ্ণ কুষ্ঠরোগীর মুখোশ। নারীটি
পুরুষের হাত দুটোর রূপান্তর ঘটাবে যেন দড়ি হয়ে পেঁচিয়ে ধরে
গলার চারপাশ, যাদের গলা চিহ্নিত হয়েছে নারীটির মতোই,
শুধু নারীটির গলা বাদে। বিয়ে করতেই হবে ফাঁসুড়েকে,
আর কাউকে না, এটা তেমন খারাপ কিছুও নয়।
বিয়ের জন্য আর কে আছে?
*
হয়তো ভাবছ নারীটির অপরাধ। তার মৃত্যুর আদেশ হয়েছিল
মনিবের পোশাক চুরির জন্য, মনিবের স্ত্রীর পোশাক চুরির অপরাধে।
নিজেকে সে আরো সুন্দর দেখতে চেয়েছিল।
পরিচারিকার এমন ইচ্ছে আইনসম্মত না।
*
নারীটি কণ্ঠস্বরকে হাতের মতো ব্যবহার করে, সেই স্বর
আকর্ষণীয় এবং হৃদয়স্পর্শী হয়ে পৌঁছে যায়
দেয়াল ভেদ করে। সে আর কীই বা
বলবে পুরুষটিকে রাজি করাতে?
লোকটির ফাঁসির সাজা ছিল না, মুক্তি তার জন্য
অপেক্ষায়। কী সেই প্রলোভন, যা কাজে লেগেছিল?
হয়তো লোকটি এমন এক নারীর সাথে থাকতে চেয়েছে
যার জীবন রক্ষাকারী সে, যে নারী গভীরভাবে সব দেখবে কিন্তু
সহায়তা পাবার জন্য স্বামীর দ্বারস্থ হবে না।
পুরুষটির নায়ক হবার এই এক সুযোগ, অন্তত একজনের কাছে,
ফাঁসুড়ে হয়ে গেলে অন্যরা তাকে ঘৃণা করবে। সে কারারুদ্ধ হয়েছিল
তরবারি দিয়ে জখম করার অপরাধে, ডানহাতের একটা আঙুল।
এটাও ইতিহাস।
*
আমার বন্ধুরা, যারা দুজনই নারী, ওদের গল্পগুলো বলে,
বিশ্বাস করা যায় না কিন্তু সেগুলো সত্য।
এসব ভয়ের গল্প, আমার জীবনে ঘটেনি,
এখনো পর্যন্ত ঘটেনি, ঘটলেও আমি নিস্পৃহ, যা আমরা
অবিশ্বাস করি ভয়ানক ভেবেই নজরে রাখি।
এমন ঘটতেই পারে না জীবনে,
এখন বিকেল এবং বিকেলে ঘটনাগুলো ঘটে না।
সমস্যা এই, সে বলেছিল, চশমা পরার
সময় ছিল না আর চশমা ছাড়া আমি
বাদুরের মতোই অন্ধ, এমনকি দেখতেই পাইনি কে ছিল।
এমন হয় এবং আমরা টেবিল ঘিরে বসি এবং গল্প করি
যেন শেষ পর্যন্ত গল্পগুলো বিশ্বাস করা যায়।
বানানো কাহিনী নয়, ইতিহাস, এখানে অনেক ফাঁসুড়ে আছে
ফলে এদের অনেকেই জীবিকাহীন।
*
পুরুষ: দেয়ালের শেষভাগ, দড়ির শেষটুকু, দরজা খুলে যাওয়া, একটা মাঠ, একটা বাড়ি, একটা সূর্য, একটা টেবিল, একটা আপেল।
নারী: স্তনবৃন্ত, বাহুডোর, অধর, মদ, পেট, চুল, রুটি, উরু, চোখ, চোখগুলো।
তারা দুজনই প্রতিশ্রুতি রেখেছিল।
*
ফাঁসুড়ে তেমন খারাপ লোক না। পরে সে
ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যায় এবং বাকি জিনিসগুলো পরিষ্কার করে,
যদিও অসতর্কতায় হাত থেকে পড়ে যাওয়া কিছু মোছে না।
সে কেবল সাধারণ জিনিসগুলো চায়: একটা চেয়ার,
কেউ তার জুতা খুলে দেবে, কথা বলার সময়
তাকিয়ে শুনবে, প্রশংসায় আর ভয়ে, সম্ভব হলে কৃতজ্ঞতায়,
বিশ্রাম ও নতুন উদ্দীপনায় জেগে ওঠার জন্য সে যার ভেতর ডুবে যাবে।
এই সবই হতে পারে এমন নারীকে বিয়ে করে
সুন্দর হতে চাওয়ার অপরাধে যাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল এক পুরুষ।
এখানে নির্বাচনের সুযোগ আছে।
*
সবাই বলেছিল লোকটা বোকা।
সবাই বলেছিল নারীটি চতুর।
তারা যে শব্দটি ব্যবহার করে ছিল- ফাঁদে আটকানো।
*
তারা কী বলেছিল প্রথমবার একসঙ্গে
যখন একই ঘরে? পুরুষ কী বলেছিল
যখন নারী ঘোমটা খুলেছিল আর লোকটি শুধু
গলার স্বর শুনছিল না একটা শরীর দেখছিল, পরিমাপ করেছিল?
নারী কী বলেছিল যখন বুঝতে পারল
একটি বদ্ধ ঘর ছেড়ে সে আরেকটা বদ্ধ ঘরে? স্বাভাবিকভাবেই
প্রেমের কথা বলেছিল, যদিও সেটা সারা জীবনের জন্য না।
*
বন্ধুদের বলার মতো আমার তেমন গল্প নেই
যা বললে ওদের ভালো লাগত। ইতিহাস মোছা যায় না,
যদিও সেটা অনুধ্যান করে নিজেরা প্রশমিত হই
সেই সময় নারী ফাঁসুড়ে ছিল না। হয়তো কোনো কালেই না,
তাই বিয়ে করে কোনো পুরুষকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে হতো না।
নারীকে সেটা করতে হতো, আইন অনুযায়ী।
*
পুরুষ: পা, বুটজুতা, আদেশ, শহর, মুষ্টি, সড়ক, সময়, ছুরি।
নারী: পানি, রাত, উইলো, চুলের দড়ি, ভূমিগর্ভ, গুহা, মাংস, কাফন, উন্মুক্ত, রক্ত।
তারা দুজনই প্রতিশ্রুতি রেখেছিল।
টিকে থাকাটা অনেক সময় স্বাধীনতাকে অতিক্রম করে যায়। স্বাধীনতা তখন মুখ থুবড়ে পড়ে অস্তিত্বের প্রশ্নে। ‘ফাঁসুড়েকে বিয়ের পয়গাম’ কবিতায় মার্গারেট অ্যাটউড এই সত্যটি বলেছেন। দুর্ভাগ্য এটাই, স্বাধীনতার বিনিময়ে যে জীবন, সেটা কোনো জীবন নয়।
কবিতার শুরুতেই আঠারো শতকের ঔপনিবেশিক এক আইনের কথা আছে। সেই আইন অনুযায়ী কারারুদ্ধ পুরুষ মানুষ ফাঁসুড়ে হয়ে গিয়ে সাজা থেকে মুক্তি পেতে পারে। নারীরা যেহেতু ফাঁসুড়ে হতে পারে না তাই ফাঁসুড়েকে বিয়ে করে তাদের সাজামুক্ত হতে হয়। কিন্তু ফাঁসুড়ে না থাকলে নারীর আর বাঁচার পথ নেই। এই কারাগারে যেহেতু ফাঁসুড়ে নেই, নারীর অস্তিত্বও তাই বিপন্নতায়। কবিতা যতটা এগোতে থাকে পাঠক অনুভব করে ফাঁসির আদেশ পাওয়া একজন ‘অপরাধী’ নারীর জন্য একজন ফাঁসুড়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখনও আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন পুরুষ নারীর জন্য অপরিহার্য। একটা ‘ফাঁসুড়ে’ স্বামী পেলেই নারীর প্রাণরক্ষা হয়। বিয়ের মাধ্যমে নারীর নিজের জীবনই শুধু নয় পরিবারের সম্মান ও সমাজের সম্ভ্রম সুরক্ষিত থাকে।
দ্বিতীয় স্তবকে দুটো উপাদান রূপক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর একটি ‘আয়না’ এবং আরেকটি ‘কণ্ঠস্বর’। আয়না এখানে ‘আত্মপরিচয়’ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কারাগারে আয়না থাকে না তাই নিজেকে দেখা যায় না। আয়নায় প্রতিফলিত মুখশ্রীতে মানুষ আসলে মুখের রেখাটুকু ছাপিয়ে ভেতরটাকে দেখার সুযোগ পায় অন্যথায় তাকে ভুলে যেতে হয় স্বীয় আদল আর অন্তরাত্মা। কারাগারে বন্দী হয়ে নারীর ব্যক্তিপরিচয় হুমকির মুখে পড়েছে।
এই আত্মবিস্তৃত নারী হঠাৎ শোনে এক কণ্ঠস্বর। পাথরের দেয়ালের সামান্য ছিদ্র দিয়ে অন্ধকার কুঠুরীতে ভেসে আসে এক পুরুষস্বর। তার মুখাবয়ব দেখা যায় না। কন্ঠস্বরটি নারীর কাছে আয়না হয়ে যায়। ওই কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দগুলোতে নারী আপন অস্তিত্বকে প্রতিফলিত হতে দ্যাখে এবং জেনে যায় কেমন করে নির্ধারিত শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তাকে ‘ফাঁসুড়ে’ সৃষ্টি করতে হবে। সেটা তখনই সম্ভব যখন পুরুষটিকে সে ফাঁসুড়ে হতে রাজি করাতে পারবে। একটা শুধুই কন্ঠস্বর। পুরুষটিকে সে কখনো দ্যাখেনি এবং পুরুষটিও তাকে দ্যাখেনি। তবু এই অন্ধকারে অচেনা অদেখা পুরুষটির মন জয় করতে হবে। সে যেন ফাঁসুড়ে হয় এবং নারীটিকে বিয়ে করে। তখন আমার মনে পড়ে পৃথিবীর নানারকম প্রসাধন আর রূপচর্চার সামগ্রী দিয়ে পুরুষের ভোগের জন্য নারীর নিজেকে তৈরি করার প্রক্রিয়া। মনে পড়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নিরুপায় নারীর নিজস্বতাকে বিসর্জন দিয়ে পুরুষের সেবায় দক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা। গৃহকর্মে সুনিপুণ হবার জন্য মননশীলতা আর সৃষ্টিশীলতাকে বলি দিয়ে ক্রমশ নিজেকে পুরুষের পছন্দের ছাঁচে ফেলে গড়ে তোলার প্রয়াস। অ্যাটউড সেই সত্যের আভাস দিয়েছেন কবিতায়- ‘...নারীটি/ পুরুষের হাত দুটোর রূপান্তর ঘটাবে যেন দড়ি হয়ে পেঁচিয়ে ধরে/ গলার চারপাশ, যাদের গলা চিহ্নিত হয়েছে নারীটির মতোই,/ শুধু নারীটির গলা বাদে। বিয়ে করতেই হবে ফাঁসুড়েকে,/ আর কাউকে না...’
কী ছিল সেই নারীর অপরাধ? যার জন্য তাকে শাস্তিস্বরূপ ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো? চতুর্থ স্তবকে কবিতার পাঠককে সরাসরি উদ্দেশ্য করে সেই অপরাধের কারণ বলেন অ্যাটউড আর পাঠকের মন সমবেদনায় আর্দ্র হয়ে যায়। বিশেষ করে এই স্তবকের শেষ দুটি বাক্যে ‘নিজেকে সে আরো সুন্দর করে তুলতে চেয়েছিল/ পরিচারিকার এমন ইচ্ছে আইনসম্মত না’ সামাজ কাঠামোর গভীর বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই সুন্দর হতে চাওয়া মানে ‘জীবন’কে চাওয়া। একজন নারীর এই চাওয়াকে তার সামাজিক অবস্থান আর প্রচলিত আইনের পাশাপাশি স্থাপন করে অ্যাটউড দেখিয়ে দিয়েছেন একজন পরিচারিকার সামাজিক অবস্থান নিচু বলেই তার অতি ক্ষুদ্র ইচ্ছেটুকুও আইনের অনুমোদন পায় না। জীবন আর জীবনের আবেগ-ইচ্ছে শুধু উচ্চশ্রেণির মানুষের পক্ষে ধারণ ও প্রকাশযোগ্য। এই পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বলা যায়- ‘নিজেকে সুন্দর দেখাবে’ এই ইচ্ছেটা পারিচারিকার ক্রয়যোগ্য ছিল না। ফলত ‘সুন্দর দেখাবে’ এটা তার চাহিদা (অভিপ্রায়) হতে পারে না। এই চাওয়ার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
কবিতা পড়তে গিয়ে একটু ইতিহাসও জানা হলো। শীতের রাতে পরিচিত হওয়া গেলো কিউবেক প্রদেশের ফ্রাঁসোয়াজ ল্যইঁ এর সাথে। চুরির দায়ে এই পরিচারিকার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। কারাগারে তার পাশের কুঠুরিতে ছিল আসামী জঁ কহলরঁ। ঔপনিবেশিক সৈন্যদলের এক ‘ড্রামার’। যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ডারদের সঙ্কেতবার্তা পদাতিক বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া ছিল তার কাজ। ১৭৫১ সালে ডুয়েল (দ্বন্দ্বযুদ্ধ) লড়ার জন্য সে কারাবন্দী হয়। কহলরঁকে ল্যইঁ অনুরোধ করেছিল ফাঁসুড়ের শূন্যপদে যোগ দিয়ে তাকে বিয়ে করতে। কবিতায় ফ্রাঁসোয়াজ ল্যইঁ কিংবা জঁ কহলরঁ এর নাম উল্লেখ করা হয়নি। এর প্রয়োজনও নেই। কবিতার নাম থেকেই উপলব্ধি করা যায় বিয়ে একটা ‘বিবেচনা’র বিষয়। পাত্র-পাত্রী হতে পারে সর্বার্থেই পশ্চাদপদ যে কোনো সমাজের।
ইতিহাসের পথরেখা থেকে কবিতায় আসি। লোকটির ফাঁসির সাজা ছিল না। সে মুক্তির দিন গুনছিল আর ভাবছিল পাশের কুঠুরীর নারীর কথা। যে নারীর কন্ঠস্বর সে শুনতে পায়। কণ্ঠস্বরই মায়াভরা হাতের মতো তাকে স্পর্শ করে। তার মনে হয় এই নারীর কাছে সে পরিত্রাতা হয়ে উঠতে পারে।
কবিতার প্রথম স্তবকে ‘কল্পনা নয়, এটা ইতিহাস’ বলা হলেও ষষ্ঠ স্তবকে সমসাময়িক কালে চলে আসেন অ্যাটটুড। সেখানে বন্ধুদের বলা অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য গল্পের ভাষ্য অতীত ‘ইতিহাস’ থেকে বর্তমান সময়ের হয়ে যায়। গল্পগুলো কোনো কল্পকাহিনী নয়, ইতিহাসের সত্য। এই সময়ে কতই না ‘ফাঁসুড়ে’ পুরুষ আছে এবং সংখ্যাধিক্যের জন্য কেউ কেউ জীবিকাহীন। ফলে সহসা তারা সাজামুক্ত হতে পারে না।
সপ্তম স্তবকে ফের সেই সময়ে ফিরে যাওয়া। যেখানে নারী-পুরুষের কথোপকথন হয়েছে। অ্যাটউডের কাব্যিক কাঠামোয় সেই আলাপচারিতা বাক্য নয় এসেছে কিছু শব্দের মাধ্যমে। পুরুষ বলে- দেয়ালের শেষভাগ, দড়ির শেষটুকু, দরজা খুলে যাওয়া, একটা বাড়ি, একটা আপেল... নারীটি বলে- স্তনবৃন্ত, বাহুডোর, মদ, পেট, চুল, রুটি, চোখ... শব্দগুলো পড়েই বলে দেয়া যায় কোন শব্দগুলো পুরুষটি উচ্চারণ করেছিল আর কোনগুলো নারী। কবিতা এগিয়ে যায়। অ্যাটউড পুরুষের মনস্তত্ত্বের গভীরে সাঁতরে জেনেছেন নারীর কাছে কী চায় এই পুরুষ? ‘একটা চেয়ার’ যেটায় আরাম করে বসা যাবে। আরও যা দেখা গেলো- ‘কেউ তার জুতা খুলে দেবে, কথা বলার সময়/ তাকিয়ে শুনবে, প্রশংসায় আর ভয়ে, সম্ভব হলে কৃতজ্ঞতায়,/ বিশ্রাম ও নতুন উদ্দীপনায় জেগে ওঠার জন্য সে যার ভেতর ডুবে যাবে।’ এই কাঙ্ক্ষিত চাওয়াগুলো বাস্তব হতে পারে একজন নারীকে বিয়ে করে। সেই নারীকে হতে হবে দুর্বল এবং ক্ষমতাহীন। সুন্দর হতে চাওয়ার অপরাধে যাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া যায়। এই ফাঁসির দড়ি আদপে নারীর কণ্ঠস্বরকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই। কবিতা পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে আইনপ্রণেতা এবং বিচারক ছিলেন একজন পুরুষ। আমি ভুলে যাই না- বিয়ে করা বা না করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ এবং অধিকার পুরুষের আছে। নারীর মতো পুরুষ উপায়হীন নয়।
তবুও পুরুষ বোকা এবং নারী চতুর রূপে চিহ্নিত হয়। তথাকথিত সভ্য সমাজের আঙুল উত্থিত হয় নারীর দিকেই। খালেদ হুসেইনি’র ‘A Thousands Splendid Suns’ উপন্যাসেও বলা হয়েছে আঙুলের কথা। ‘Like a compass needle that points north, a man’s accusing finger always finds a woman. Always. You remember that, Mariam.’ হেরাত উপত্যকায় তাজিক ছোট্ট মেয়ে মারিয়ামকে তার মা কথাগুলো বলেছিলেন- মনে রেখো মারিয়াম, কম্পাসের কাঁটা যেমন সব সময় উত্তর দিক নির্দেশ করে, একজন পুরুষের তিরস্কারের আঙুল সব সময় একজন নারীকে খুঁজে নেয়। ‘ফাঁসুড়েকে বিয়ের পয়গাম’ কবিতার নারীটি যেন বা মারিয়াম। কারণ বলা হয়েছিল- নারীটি পুরুষকে ফাঁদে ফেলেছে। অথচ এই নারীর স্বামী হবার সিদ্ধান্তটি মূলত পুরুষই নিয়েছিল পরিত্রাতা হবার বাসনায় এবং বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে যার ‘নির্বাচন’ এর সুযোগ ছিল। ফাঁসুড়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া ছাড়া নারীর আর বিকল্প কিছু ছিল না।
অ্যাটউড পাঠককে নয় যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করেন- নারীটি কী বলেছিল? ‘যখন বুঝতে পারল একটি বদ্ধ ঘর ছেড়ে সে আরেকটা বদ্ধ ঘরে?’ একজন নারী ফাঁসির দড়ি থেকে গলা বাঁচাতে চাইলে, ঔপনিবেশিক আইন অনুয়ায়ী, ফাঁসুড়েকে বিয়ে করতেই হবে। সেই সময় নারী যদি ‘ফাঁসুড়ে’ হতে পারত তাহলে ফাঁসুড়ে হয়ে, বিয়ে করে, কোনো পুরুষের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজের কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছেগুলো সার্থক করবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারত। এবং অবশ্যই সেটা হতো আইন অনুযায়ী! নারীর সেই স্বাধীনতা ছিল না। আজও নেই।
কবিতার শেষাংশে কবি ইঙ্গিত দেন কারাগার থেকে বের হয়ে নারী এবং পুরুষটি একসাথে থাকা শুরু করে। আবারও দেখা যায় নারী-নরের আচরণগত ভিন্নতা। মূর্ত-বিমূর্তের দ্বন্দ্ব এবং পুরুষ বলে- ‘পা’। নারী বলে- ‘ভূমিগর্ভ’। পুরুষ বলে- ‘সড়ক’। নারী বলে- ‘গুহা’।
মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা ‘ফাঁসুড়েকে বিয়ের পয়গাম’ আপাত বাহ্যদৃষ্টিকে পরম অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যায়। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যুগেও নারীর এই যে নিয়ত লড়াই, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বেঁচে থাকার অবিরাম সংগ্রাম, সেটাই যেন প্রকাশিত হয় নারীটির উচ্চারিত শেষ শব্দে। ‘রক্ত’।
ভাবছি ক্ষরণ বোঝাতে এর চেয়ে বেশি সত্য আর কোনো শব্দ হতে পারে না।
...
অলংকরণঃ তাইফ আদনান