চলে গেলেন না ফেরার দেশে সাহিত্যক, সম্পাদক আবুল হাসনাত। ৭৫ বছর বয়সেও এই লেখকের কলম চালু ছিল; নিয়োজিত ছিলেন দেশের খ্যাতনামা সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ সম্পাদনার গুরু দায়িত্বে। ’মৃত্যু’ এই কর্মবীরের কর্মযজ্ঞ থামিয়ে দেয় ১ নভেম্বর, ২০২০। আবুল হাসনাত ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। যতদূর জানা যায়, আবুল হাসনাত ছাত্রাবস্থায়ই লেখা ও সম্পদনার সাথে যুক্ত হন। স্বাধীনতার পূর্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের ছায়া সংগঠন সংস্কৃতি সংসদেরও সম্পাদক ছিলেন। এ-সময়ে আবুল হাসনাত সংস্কৃতি সংসদের বেশ কটি ‘একুশে সংকলন’ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে তিনি ‘গণসাহিত্য’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন, যা ছিল বাংলাদেশের কমিউনিটি পার্টির সাহিত্যপত্রিকা। স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভবত সেটিই ছিল প্রথম মানসম্পন্ন নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন। প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকত শিল্পমানসম্পন্ন লেখা। এর মুদ্রণ ও অঙ্গসজ্জাও ছিল শৈল্পিক ও নান্দনিক।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে বিপুল-বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। সে-সময়ে আবুল হাসান ঢাকার সাহিত্যপাড়ায় কেতাদুরস্ত সম্পাদক হিসেবে পরিচিত। তিনি সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করায় তদানীন্তন মেধাবী লেখকবৃন্দও তাঁদের লেখা সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে লেখা প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ব্যক্তি-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সাহিত্য মানসম্পন্ন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ সাময়িকীর জন্য বেছে নিতেন। একই সাথে সাহিত্যপাতার গেটআপ ও মেকআপে আমূল পরিবর্তন এনে একে শিল্পোমানসম্পন্ন করে তোলেন। সাহিত্য সাময়িকীর অঙ্গসজ্জায় বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম ব্যবহার করে পাতাটিকে দৃষ্টিনন্দন ও নান্দনিক করে তোলেন । ফলে বোদ্ধা লেখক ও পাঠকবৃন্দের কাছে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী স্বল্প সময়ের মধ্যেই আকর্ষণীয় এক সাময়িকী হিসেবে বিবেচিত হয়ে ওঠে। সংবাদের সাহিত্য-সাময়িকীতে লেখা প্রকাশ লেখকদের জন্য একটি মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। জানা যায়, সংবাদের সাহিত্য-সাময়িকী যেদিন প্রকাশিত হতো, সেদিন অতিরিক্ত পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হতো। সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে সংখ্যাটি ছিল অন্যান্য দৈনিকের জন্য ঈর্ষর্ণীয়। সংবাদে থাকাকালেই তিনি ‘প্রণোদনা’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন।
আবুল হাসান শুধু যে সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার কাজ করতেন তা-ই নয়, সাহিত্যের নানা শাখায়ও ছিল তাঁর সাবলীল বিচরণ। তিনি একাধারে কবিতা, প্রবন্ধ ও শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প লিখতেন। সম্পাদক আবুল হাসান পরিচয়ের বাইরে গিয়ে তিনি ছদ্মনাম মাহমুদ আল জামান নামে লেখালিখি করতেন। ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, 'কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ‘ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল’ আবুল হাসনাতের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তার দুটি প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য’, ও ‘জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য’। তাঁর লেখা শিশু ও কিশোরদের নিয়ে রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’, ‘টুকু ও সমুদ্রের গল্প’, ‘যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে’, ‘রানুর দুঃখ-ভালোবাসা’। ১৯৮২ সালে টুকু ও সমুদ্রের গল্পের জন্য তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার পান।
নব্বয়ের পরে দেশে সংবাদপত্র জগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সংবাদপত্র জগতে কর্পোরেট পূঁজির ঢল নামে। অপেক্ষাকৃত তরুণ সম্পাদকের সম্পাদনায় উন্নত প্রযুক্তিতে বহুসংখ্যক দৈনিক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। দৈনিক সংবাদ ছিল বাম রাজনীতি-প্রভাবিত পত্রিকা। কিন্তু ’৯০ এর গণঅভ্যুত্থান ও প্রায় একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গোটা পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির পতনের পরে এদেশেও তার প্রভাব পড়ে। সে ধাক্কা সামলে দৈনিক সংবাদ তার গতিধারা অব্যাহত রাখতে অসমর্থ্য হয়। পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। বোদ্ধা লেখকবৃন্দ নতুন প্রকাশিত দৈনিকের সাহিত্য-সাময়িকীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে দৈনিক সংবাদের জৌলুশও হ্রাস পায়।
আবুল হাসানও বিপরীতমুখী স্রোতের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ২৪ বছরের সৃজনশীলতা ত্যাগ করে তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের বিপরীতমুখী রাজনীতি-প্রভাবিত কর্পোরেট পূঁজির স্রোতে অবগাহন করেন। তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন কর্পোরেট জগতের সঙ্গে।
আবুল হাসান বেঙ্গল গ্রুপের অর্থায়নে ‘কালি ও কলম’ নামের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হন। বেঙ্গলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের দায়িত্বও নেন তিনি। ‘কালি ও কলম’ সাহিত্য-সাময়িকীতে তিনি সম্পাদক হিসেবে মানসম্পন্ন লেখা ছাপানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতির সাক্ষর রাখেন। এখানেও তাঁর আঁচড়ে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই পত্রিকাটি দেশের সাহিত্যকদের কাছে লেখা ছাপাবার উৎকৃস্ট সাময়িকীতে রূপান্তরিত হয়। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসান ছিলেন সৃজনশীল ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী। তিনি যখন যেখানে সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তখন সেখানেই তাঁর সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতার সাক্ষর রেখেছেন। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদকের সাথে ‘ব্যক্তিগত যোগাযোগ’ লেখা নির্বাচনের ব্যাপারে মুখ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। আবুল হাসানের ব্যাপারে কোনো লেখক আজ অবধি এই অভিযোগ করতে পারেননি। বরং শিল্পমানসম্পন্ন লেখা নির্বাচন এবং সৃজনশীল ও নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় যে কোনো সাময়িকীকে তিনি বোদ্ধা পাঠকের কাছে করে তুলেছেন শিল্পমানসম্পন্ন সাময়িকী।
লেখক হিসেবে তিনি সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন। তাঁকে বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৪ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ পান। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না। গোটা কর্মজীবনে তিনি আলোর শিখা বয়ে চললেও আলোচনার পাদপ্রদীপে আসেননি। এটা কি তাঁর আত্মকেন্দ্রীক জীবনাচরণ, সাহিত্যপাড়ায় বলদর্পী অনুপস্থিতি, প্রচারবিমুখক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে? তাঁর মৃত্যুর পরে এ-ধরনের বিশ্লেষণ কতটা যুক্তিসঙ্গত? আমি মনে করি এটা দোষের কিছু নয়। কেননা, ব্যাপক জনপ্রিয় লেখক কিংবা কবি হয়ে না ওঠার পেছনে যে সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করা হলো সেগুলো দোষের কিছু নয়, বরং একজন একনিষ্ঠ সাহিত্যসাধকের গুণ। লেখক ফারুক মাঈনউদ্দিন এ-প্রসঙ্গে এভাবেই ফেসবুকে তাঁর নিজ টাইমলাইনে (১ নভেম্বর) স্মৃতিচারণ করেছেন, “আমি তখন কর্মসূত্রে সিলেটবাসী। ঢাকায় এলে লেখাটা নিয়ে পুরানা পল্টনের সংবাদ অফিসে সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের হাতে তুলে দিই। তাঁর সামনে কোনো চেয়ার না থাকায় বসারও সুযোগ ছিল না। তিনি লেখাটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কেবল বললেন, রেখে যান। ব্যাস, এটুকুই মাত্র কথা। কোনো আলাপ পরিচয় কিংবা বাড়তি একটি কথা বলার সুযোগও হয়নি। আগে থেকে তাঁর এই স্বভাব জানা ছিল বলে খুব হতাশ হইনি। কয়েক সপ্তাহ পর লেখাটা সাময়িকীর প্রথম পাতার নিচের অর্ধাংশে ছাপা হলে বুঝতে পারি তাঁর কাছে পরিচয়টা কোনো বিষয় ছিল না।”
মৃদুভাষী, নিরহংকারী ও বিনয়ী মানুষটি জীবন অতিবাহিত করেছেন ঋষির মগ্নতা নিয়ে। তাঁর যাপিত জীবন ছিল অনাড়ম্বর, সাধারণ ও নির্বিরোধী। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক শুন্যতা তৈরি হলো- যা সহজে পূরণ পূরণ হবার নয় বলেই মনে করি।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান