জলধি / প্রবন্ধ / আহসান হাবীব: কবিতায় আধুনিকতা ও জীবনবোধ
Share:
আহসান হাবীব: কবিতায় আধুনিকতা ও জীবনবোধ
বাংলা কবিতার ক্রমবিকাশের পথ ধরে তিরিশোত্তরকালের কবিতার ধারায় কবি আহসান হাীব এক অনিবার্য নাম। প্রথম প্রকৃত আধুনিক কবি হিসেবে তিরিশের কবিদের আধুনিক চিন্তাশৈলী, স্বতন্ত্র ভাষার অধিকারী কবিদের পথ ধরে কবিতায় নিজস্ব দর্শন ও কাব্যের আধুনিক মননশৈলী নিমার্নে আহসান হাবীব নতুন পথ নিমার্ন করেছেন। পঞ্চাশের কাব্য আন্দোলনের উত্তর সাধক হিসাবে আধুনিক কবিতার উত্তরাধিকারের পথকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন আহসান হাবীব। কবিতায় জীবন দর্শনের শিল্পরীতি, চৈতন্য জুড়ে তীব্র দহন, অস্তিত্বের সংকট, মধ্যবিত্ত জীবনের আকাংখার স্বরূপ নিমার্নে নিজস্ব শক্তিমত্তায় ঋদ্ধ করেছেন আহসান হাবীব। কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ এক মূল্যায়নে আহসান হাবীবের কবিতা নিয়ে বলেছেন- “আহসান হাবীবের কবিতাই আমাদের আধুনিকতা চর্চার প্রকৃত সোপান তৈরী করেছেন। তিরিশের কবিরা কবিতায় যে রবীন্দ্রত্তোর ধারা প্রবাহিত করেছেন আহসান হাবীব তাতেই অবগাহন করেছেন। প্রকৃতপে আহসান হাবীব তার রচনাকর্মে আশাবাদ, সচেতনতা, পুনঃমানবিকীকরণের উদ্ধোধন ঘটিয়ে আধুনিকতার সংজ্ঞাকে মুক্ত ও সম্প্রসারিত করেছেন। এ সত্য প্রথম  উপলদ্ধি করেছেন আহসান হাবীব। কবি হিসেবে আমাদের কাছে বরেণ্য কেবল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণেই নয় ত্রিশোত্তরকালে আর্বিভূত তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন।”
 
কবিতায় আহসান হাবীব নির্মাণ করেছেন স্বদেশলগ্নতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা, মানবিকবেদনাবোধ থেকে উৎসারিত আতœজৈবনিক কাব্য শৈলী। তিরিশ কাব্য শৈলীর আধুনিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র- নজরুল যুগের কাব্য কলার সংমিশ্রণে দেশ ও জীবনবোধের ঘনিষ্টতায় নতুন আধুনিক কাব্য আন্দোলনের সুচনাক্রমে উদ্ভাসিত হয়েছে আহসান হাবীবের রচনাকর্মে। তাইতো আহসান হাবীব শুধু আমাদের প্রকৃত কবি নন, তিনি উত্তরাধুনিকতার পথের পথিকও। উভয় বাংলার কাব্য পটভূূমিতে আহসান হাবীবের কাব্য চিন্তা ও রচনাকর্ম পথিকৃৎ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
 
১৯৪৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রি শেষ’ প্রকাশিত হয়েছিলো কলকাতা থেকে। বাংলাদেশের বরেণ্য আধুনিক ধারার উপন্যাসিক, গল্পকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রকাশনা সংস্থা কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থে আহসান হাবীব সমকালীন সমাজের জীবন যাপনের নানান অনুভূূতির চিত্র গভীর অর্ন্তর্দূষ্টি সহকারে চিত্রিত করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন, আশা, সমাজ জীবনের ভাঙ্গা গড়ার বিবর্তন আধুনিক জীবন শৈলী কবি আহসান হাবীব কবিতা নির্মানের শুরু থেকেই উপলদ্ধি করেছেন। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা সংকলন ‘নতুন কবিতা’র মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিদের যে নতুন পথ উন্মোচিত হয় সেই সময়ের সংকলনের সকল কবিই নতুন আধুনিকতার প্রতিনিধি। তাদের রচনাতেই ভাষার দতা, রুচিবোধ, বিষয় বৈচিত্রতা নতুন আঙ্গিকে উঠে আসে। পরবর্তীতে নতুন কাব্যর নিজস্বতার পথ ধরে কাব্য সংকলনের দিক নির্দেশনায় এগিয়ে গেছে কবিদের কাব্য আন্দোলন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় মধ্যবিত্ত সমাজের প্রগতিশীল নতুন রাজনৈতিক ধারার সাথে কাব্য আন্দোলনে স্বতন্ত্র ধারায় সৃষ্টি নিয়ে আবির্ভূত হন আহসান হাবীব।
 
প্রথম কাব্য গ্রন্থের দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ “ ছায়াহরিণ” (১৯৬২) ছাড়াও একে একে নতুন কাব্য শৈলীতে প্রকাশিত হতে থাকে নতুন চেতনায় সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাব, (১৯৭৬), দুই হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা (১৯৮১) এবং সর্বশেষ কাব্য বির্দীণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫), প্রভৃতি কবিতা গ্রন্থে স্বদেশ, সমাজ, মানবিকতা, জীবন বোধের সংগ্রামী চেতনা, মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়েন সংকটের বোধ। আধুনিকতার জটিল মাত্রা খুঁজতে গিয়ে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন আহসান হাবীব। প্রত্য করেছেন কাল ও সংকটের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘুণার্য়মাণ মানুষের জীবনযাত্রা। কালের ধ্বনি প্রতিনিয়ত তাকে বিচলিত করেছে। তাইতো সকল সংকটের তীব্রতায় দু’চোখে দেখে তিনি অকান্ত আকাংখা ও অস্থির চিত্তে উচ্চারণ করেছেন।
 
“ আমারতো কোথাও যেতে হবে।
পথ না পেলে ছেড়ে দেব?
এই দাপাদাপি
এই অস্থিরতা সার হবে?
আমি কি কোথাও পৌঁছার মত আলো 
পাবো না জীবনে?
আমি এই পথ থেকে ফিরবোনা। কেন না 
মানুষকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়
স্বকাল সমৃদ্ধ এক সুস্থির আবাস তাকে
অবশ্যই গড়ে নিতে হয়
কোনখানে।
          (আমারতো কোথাও না কোথাও যেতে হবে- মেঘ বলে চৈত্রে যাবো)
 
কবিতায় জীবনবোধ, বিষণœতা, নৈরাশ্য চেতনা অতিক্রম করে সমাজে চলমান জীবন যাত্রার সাথে কবি নিজেকে জড়িয়েছেন গভীরতর অনুভবে। গভীর প্রত্যয়ে জীবনকে গড়ে নিতে চেয়েছেন নতুন সমাজ জীবনে মানুষের জীবনবোধে। ইতিহাস, সমাজ চেতনা বাঙালি জীবনের সঙ্গে মগ্নতায় কবি সমকালীন জীবনকে অবলম্বন করে শ্বাশতের দিকে ধাবিত হয়েছেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা- এ মন-এ মৃওিকা  কবিতায়। অনিশ্চিত জীবনের পথে জীবনের পথ চলায় দীর্ঘ জীবনের গতিশীল চিত্র কবিতার চিত্রকল্পে ভাষায় ব্যাঞ্জনায় কবি তুলে এনেছেন একটি দীর্ঘ নিটোল স্বপ্নময় কবিতায়। তবুও জীবনের পথ চলার গতি সামনের দিকে ধাবিত হয়েছে বারবার। যেমন-
 
‘ঝরা পালকের ভস্মস্তুুপে তবু বাঁধলাম নীড়,
তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়।
তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা,
মনের গহনে আনে বারবার রঙের প্রবঞ্চনা।
অশেষ আশার দিন পলাতক, আজো মিলায়নি ছায়া,
আজো দিগন্তে স্বপ্নের মতো অপরপ কায়া
স্মরণের ভীরে র্তীযক হয়ে কান্ত নয়নে কাঁপে,
আজো এ হৃদয় দিনের আশাতে দু:সহ দিন যাপে’। 
-এ মন-এ মৃওিকা / রাত্রিশেষ
 
কবিতা জীবনের সম্ভাবনার একটা ইতিবাচক প্রান্তর। কবিতায় পংক্তির পর পংক্তিতে আবেদন তৈরিতে নতুন আবহের বিস্তার করেছেন আহসান হাবীব। নিজের আতœ চরিত্রকে উন্মুক্ত করে কবি চৈতন্য নতুন পথ সঞ্চারের নির্দেশে শিকড় স্পর্শী চেতনায় জানান দিয়েছেন নিজেই পংক্তিমালায়।-
 
“ আসমানের তারা স্বাক্ষী
 স্বাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই 
এই নিশিরাইত বাঁশ বাগানের বিস্তর জোনাকি স্বাক্ষী
স্বাক্ষী এই জারুল জামরুল, স্বাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি 
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোন অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভীনদেশী পথিক নই।
আমি কোন আগন্তুুক নই।
আমি কোন আগন্তুুক নই,আমি 
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা-
সারা দেশে। 
                                             
(আমি কোন আগন্তুুক নই-( দুই হাতে দুই আদিম পাথর)
 
জীবনযাপনে তীব্র বেদনাবোধ, মৃত্যু চিন্তা, মানুষের মৃত্যু নিয়ে শ্বাশত চিন্তার অভিঘাত মানুষকে যেভাবে বিচলিত করে তেমনি কবিকে করে তোলে বেদনাবোধে আক্রান্ত। জীবনের মাঝে কবি হাঁতড়ে খোঁজেন মৃত্যুর অমোঘ প্রকাশকে। মৃত্যুর কল্লোলিত ধারা কবিকে আঘাত করে মুহ্যমান করে তোলে অনুভবে। কবি বলে উঠেনÑ
 
“ কোন কোন মৃত্যু এসে রেখে যায় নতুন স্বার 
এই মৃত্যু রেখে যায় জীবনের মুক্ত পরিসর।
ীণ জীবনের এই মৃত্যু করে কুণ্ঠাহীন।
এই মৃত্যু নিয়ে আসে অকুতোভয়ের সেই দিন
ভীরু চিত্তে।
 ভালবেসে এই মৃত্যু খড়গাঘাত করে
স্বপ্ন আর পলায়নে জীবনের নিলর্জ্জ প্রহরে।
                                                
সমগ্র কাব্য জীবনের শেষের দিকের একটি কবিতায় কবি জীবন যাপনের সঙ্গে মৃত্যুর অমোঘ সত্যকে উচ্চারণ করেছেন নিজস্ব চিন্তার প্রকাশভঙ্গিতে। কবি শক্তি চট্রোপাধ্যয়ের শেষ দিকের কবিতা “যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো? কবিতার মতো আহসান হাবীব লিখেছিলেন সর্বশেষ কবিতা “যাবো না”। কবি প্রকৃতিকে স্বাী করে নিজের কান্তিকালের জীবন বৃত্তের মায়াবী হাতছানিতে প্রতীকী ভাবনায় জীবনের নির্যাস দান করেছেন। জীবনের প্রান্তে এসে  নিজের কবিতার কাছে, দেশের কাছে এমন সর্মপন এক মহ্য কবির সংবেদন প্রকাশ পেয়েছে। 
নিজের আতœপরে গ্লানি থেকে তিনি কাব্য চৈতন্য হয়ে উঠেন আধুনিক পূর্ণতায় ঋদ্ধ কবি। সর্বশেষ কাব্য ‘বিদীর্ণ দর্পনে মুখ’ কাব্যের সর্বশেষ লেখা কবিতায় আতœ জিজ্ঞাসার পদধ্বনি শুনতে পাই 
“ শৈশবে এই পাথর খণ্ডে বসে
আমি সূর্যাস্ত দেখতাম
রাখাল এই পথে ফিরতো
আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসতো
এই বিকেল আমার সঙ্গে যাবে না
তবে কেন যাবো?
কেন যাবো স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ বিভূঁয়ে
অন্ধকারে?
প্রস্তুতি বড় কষ্টের।
আমার কোন প্রস্তুুতি নেই।”
                                 
 
(যাবোনা-  আহসান হাবীব)
 
মানুষের মাঝে প্রেম ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক প্রকৃতির মাঝে মানুষের মনে ভালোবাসার কল্পনার নতুন সৌধ নির্মাণ করে। ভালোবাসার চরম পরিণতিতে হৃদয়ের প্রত্যাখানে প্রেমিক মনে বাসা বাঁধতে পারে পংকিলতায়। নারীর ভালোবাসায় নতজানু নারীর প্রেমে জাগে বিরহ কাতরতা, পূর্ণতা পায় প্রেম দৃপ্ত শপথে। কিন্তু কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রেম অনায়াসেই দু’জনার আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার চিন্তায় রূপ লাভ করে নতুন শপথে। তাইতো কবি বলে উঠেনÑ
 
“ তুমি ভালো না বাসলে বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায়না কখনো।”
                      (যে পায় সে পায়- প্রেমের কবিতা)
 
বাঙালি মানসের অর্ন্তলীন ভালোবাসায় জীবন আহসান হাবীবের কবিতায় একটি বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে। তার প্রেমের কবিতা সমকালীন অন্যান্য কবিদের থেকে স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্ন স্বাদ এনে দেয় পাঠককে। তাইতো সার্থক রূপ লাভ করে তার কবিতা পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। কবি হিসেবে তিনি যোগ করেছেন আধুনিক কবিতায় নতুন মাত্রা। নতুন যুগ সঞ্চারী আধুনিক মননের কবি আহসান হাবীব তাইতো ক্রমে ক্রমে কবিতার মধ্য দিয়ে আধুনিকতার অনিবার্য আসনে পথ করে নেন অনায়াসেই, উত্তর প্রজন্মের কবিদের কাছে সমগ্র  রচনা কর্মের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সবোর্চ্চ পদক একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরষ্কার সহ অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত কবি আহসান হাবীব ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।
 
তথ্য সূত্রঃ
শ্রেষ্ঠ কবিতা: আহসান হাবীব অনন্য প্রকাশনী, ১৯৯৯, ঢাকা,
উত্তর আধুনিকতা ও আহসান হাবীবের শেষ পর্বের কবিতা মাসুদুজ্জামান, ইত্তেফাক সাময়িকী, ২৭ জানুয়ারী ২০১২


অলংকরণঃ তাইফ আদনান