জলধি / প্রবন্ধ / আবুল হাসনাত- ইছামতীর দিকে যার অদৃশ্য যাত্রার আয়োজন
Share:
আবুল হাসনাত- ইছামতীর দিকে যার অদৃশ্য যাত্রার আয়োজন

স্কুল বয়স থেকে ঘর পলায়ন করতে করতে শুধু মা'কে এড়িয়ে যেতে পারিনি সুতরাং, পালানো আর হলোই না।
এমনকি স্কুল পালিয়ে মা থেকে সপ্তাহ শেষে জমা ৩০টাকা বা একটু বেশি এসব নিয়ে ছুটে যেতাম শহরে। কর্ণফুলী ব্রিজটা পার হলেই আমার হাঁটা শুরু বাস থেকে নেমে,কী গতিতে ছুটতাম যেন ফড়িং দৌড়; দৌড়েরও অধিক। চাক্তাইয়ের অলিগলিতে শুটকি মাছ, জালের বিভিন্ন জিনিস বিশেষ করে ডুবো জালের ঐ প্লাস্টিকের নানান রঙের বলগুলো চোখে নতুন নতুন স্বপ্ন দিতো; নদীর পাশ দিয়ে হাঁটার এমন স্বর্গীয় অলিগলিতে বিচিত্র পেশাজীবির হাঁকডাক আর যানবাহনের সমানতালের গর্জনে এগিয়ে যেতাম নারকেল, পেঁয়াজ-রসুনের আড়তের  স্যাঁতস্যাঁতে পথটার ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওড়ে;  ট্র্যাকের দাঁড়ানো অগ্রভাগ যেন ঘোড়ার শরীরের মতো দোল দিয়ে এক অদ্ভুত গর্জনে, কোনোটা রাতে এসে থেমে আছে।ঠেলাগাড়ী দিয়ে মাল খালাস কিংবা শ্রমিকের মাথায় গামছার ওপরে বস্তা নিয়ে দৌড়ের মধ্যে,  রিকশার ভীড়ে পথিকের হাঁটাও মুশকিল; এরমধ্যে আমার সাথে রিকশাও গন্তব্যে আগে কখনো পৌঁছাতে পারতো না। অদ্ভুত টার্নিং করে করে এঁকেবেঁকে এক দমে হাঁটতাম। আন্দরকিল্লায় এসে এই গতি একেবারে থেমে থেমে,আলাভোলা। বইয়ের রাজ্যে আমি যেন আমি নই। পৃথিবীর বইগুলোর মাঝে শুয়ে পড়তে পড়তে হাঁটি। কোনোকালে সামর্থ্য ছিলো না কেনার,আমার বংশের কারো ঘরে একটা বুকস শেল্ফ পর্যন্ত দেখিনি; খুব অসহায়বোধ লাগতো এসব বইয়ের পাহাড় দেখে আবার ভেতরে কীরকম জোর আসতো হাঁটতে হাঁটতে। মোমিন রোড পেরুলে পুরনো বাতিঘরের সামনে এসে বাইরে থেকে খুঁজতাম শুধু একটা পত্রিকা ঝুলিয়ে দিলো কিনা, কেনার টাকা নেই,ব্যথা মনে দেখতাম....
কখনো কভারটাতে হাত বুলিয়ে দিতাম,তাতে কখনো অতদূর শহরে যাওয়ার শ্রমটুকু সার্থক যেন; সংকোচ লাগতো দোকানিওয়ালা কিছু বললে,এরপরে কয়েক সপ্তাহের টাকা জমিয়ে বেশ হলে মানে ৭০-৮০ টাকার কাছাকাছি, তখনি পত্রিকাটি কিনতাম আর সেটি হলো 'কালি ও কলম'....
হ্যাঁ, ঠিক আমার প্রথম প্রেম,প্রথম কোনো সাহিত্য পত্রিকা বুকে নিয়ে ঘুমানো ক্রিকেট বলের পাশাপাশি .....
আমি স্কুল বয়স থেকে ডাকযোগে,কুরিয়ারে,মেইলে যেসব পত্রিকায় এখনি অবধি লেখা পাঠিয়ে আসছি অথচ কখনো লেখা ছাপায়নি( দৈনিক বলতে প্রথম আলো, সমকাল, কালের কণ্ঠ) সেসবের মধ্যে একমাত্র সাহিত্য পত্রিকা 'কালি ও কলম'...
তবুও আমার বুকজুড়ে,এই একটি সাহিত্য পত্রিকা, আমার অনুভূতির সবটুকু নিয়ে.... ২০০৬ -২০০৭ এর পত্রিকাগুলো এখনো দেখলে অন্যরকম ঘোর লাগে,প্রতিটা পত্রিকায় অসম্ভব রকম আমার হাতের লেখা তখনকার,প্রতিটা কবিতার পাশাপাশি আমারও অগোছালো কবিতা...
ঘরে বর্ষা মৌসুমে ফুটো চাল দিয়ে কিংবা মাটি উপচিয়ে জলে সয়লাব হলে আমি শুধু 'কালি ও কলম' আর 'কালের খেয়া' পত্রিকাগুলো পলিথিনে মোড়াই,ভাদ্র আশ্বিনে রোদে শুকাই....
কেননা এই পত্রিকাটি হাতে যতবার নিতাম,নতুন করে লেখার জেদটুকু পেতাম,এমনকি এই পত্রিকাকে ভালোবাসার ফসল 'দেয়াঙ' পত্রিকাটি সম্পাদনা করা....
এসব কথা কেন বলছি,এবার বলি...
'কালি ও কলম' আমার লেখা কখনো ছাপেনি অথচ আমার প্রিয় সম্পাদক আবুল হাসনাত... প্রায় লেখক উনাদের স্মৃতিচারণে নিজেদের লেখা প্রকাশের জন্য বিবিধ সুখ উগরে দিয়েছেন আর লেখা না ছাপালে প্রিয় হয়না এটার স্বভাব অনেকের কাছ থেকে আমিও টের পাই একটি পত্রিকা করি বলে....সম্পাদক আবুল হাসনাতের মৃত্যু পরে আমি আরো আশ্চর্য হয়েছি যে,উনার নানান মাত্রিক পরিচিতি পেয়ে। তিনি মাহমুদ আল জামান,অনেক পত্রিকায় মাহমুদ দেখেই বুকের কাঁপুনি হয়েছে নামের শেষটা পড়ে চুপসে গেছি বহুবারই। উনার কবিতা আমার ভালো লাগতো,তবে তিনিই যে আবুল হাসনাত এটা জানার জন্য উনার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে; এখানে আমার কাছে একটা শিক্ষা এলো যে,আপনি অমুক পত্রিকার সম্পাদক অমুক কিছু সেসবের মূল্য কাঁচাবাজার দরের মতো; এখন অনেক সম্পাদকের পোস্টে উপর্যুপরি তেল দিয়ে কমেন্ট করলেই নিয়মিত লেখা ছাপে। এমনকি অনেককে ভুল ধরিয়ে দিতেই তাঁদের সাহিত্য পাতায় আমার লেখা ছাপেন না... দিনশেষে উনি কী লিখলেন আর আমি কী লিখলাম তফাৎ ততটুকু হবে আবুল হাসনাতের মৃত্যু আর মাহমুদ আল জামানের কবিতার শরীরে উত্থান বেশ শিক্ষণীয়....
সরাসরি বলতে পারি  'কালি ও কলম' নতুন লেখক সৃষ্টি করেনাই,তেলের ওপর তেল দিলেন এটা আমারও বিশ্বাস; এমনকি এই পত্রিকার ভাব গতি ব্রাহ্মণ ধাঁচের,বেশ জাত পাত দেখে। কবিদের কাজ কবিতা লেখা আর উনারা দেখে কবি কী করে এমনসব... 
    তবে 'কালি ও কলম' পড়েই যে উন্মাদনা পেতাম এটা কি সৃজনে প্রভাবিত করা নয়? ঐ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পেলেই কী সৃষ্টি করা হবে শুধু ? এই মত পোষণ আমি করিনাই কখনো...কেননা আগেই বললাম দিনশেষে কে কী লিখলো এটাই যাচনা....

পত্রিকাটি হাতে পাবার জন্য কত টিপিন খাইনি দুপুরে, কত পথ হেঁটেছি সে আমি জানি...
একই রকম আমি দৈনিক প্রথম আলো, সমকাল ও কালের কণ্ঠের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ... এসব পত্রিকা আমার কখনো লেখা ছাপায়নি অথচ এসব পড়েই আমি আজ এতো পথ এসেছি, সব ছেড়ে লেখালেখি করার এই ভাবনা এসবের সাহিত্য পাতা উজাড় করে দিয়েছে... 

তাই সম্পাদক আবুল হাসনাতের মৃত্যুতে আমার মতো কষ্ট কেউ অনুভব করছেন বলে মনে করিনা লেখকদের মধ্যে; কেননা আমার প্রেম ছিলো একতরফা তবুও গায়েবী,একেবারে স্বার্থহীন....
আবুল হাসনাত মারা গেলেন, 'কালি ও কলম' নিয়ে কবিতার শরীরে মাহমুদ আল জামান আমার সাথে সৌজন্যে সাক্ষাৎ করতে ইছামতীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন যেন, এইমাত্র ....



অলংকরণঃ তাইফ আদনান