জলধি / প্রবন্ধ / আবছায়া সিল্যুয়েট অথবা বোর্হেসীয় বিস্ময়
Share:
আবছায়া সিল্যুয়েট অথবা বোর্হেসীয় বিস্ময়

অনেকটা দূরের ছায়া ছায়া, আলো আলোয় সব তেমন বোঝা যায় না। জ্যামিতিক নকশার তর্জমা নাকি ঈশ্বরের লিখনচিহ্নের ব্যাখ্যা, যেটুকু নির্বাচিত হয়ে অনুভবে আসে, এর সাথে বিশেষ স্মৃতি আর কল্পনা মিশে উপলব্ধি জন্মায়। উপলব্ধির লেন্সে গল্পগুলো দেখি। সবই ধোঁয়াশা। এর কতখানি ধোঁয়া, কতটুকুই বা কুয়াশা  বোঝা যায় না আর আমার মনে হয় চোখ দুটোর হয়তো উন্মীলিত হবার এখনও কিছু বাকি। লেন্স আর সেন্সের সমন্বয়ে একটু একটু করে ধোঁয়াশা কেটে ফুটে ওঠে দৃষ্টিভঙ্গি। দেখি, দেখতেই থাকি। আলোকচিত্রীর মতো একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে থাকি বোর্হেসের গল্পের দিকে।          

তাঁর গল্পে ছায়া আর রঙের সবটুকু ধরা দেয় না জেনেই হোর্হে লুইস বোর্হেস পড়ি। মৌলিক গল্প পড়ার আগেই সাক্ষাৎকার পড়া হয়ে যায়। কয়েক বছরের দীর্ঘ বিরতির পর সেই প্রতীক্ষিত মূহূর্তের আগমন। বোর্হেসের গল্পকে তখন কিছুটা ধারণ করা যায়। গদ্য সাহিত্যের অভিনবত্বে গোলকধাঁধার ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এ কি বিস্ময়! হোর্হে লুইস বোর্হেস একজন ‘ধ্রুপদী লেখক’ অথবা ‘লেখকদের লেখক’ পরিধি ভেঙে এক প্রকাণ্ড জ্ঞানস্তম্ভ হয়ে যান। যার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি দি রাইটিং অফ দ্যা গড, দি ডেড ম্যান, দি লাইব্রেরি অব ব্যাবেল, দি আলেফ, ব্লু টাইগার্স, ইনফার্নো ওয়ান, থার্টি টু... গল্পের উপরিভাগ যতটুকু, সহজে বুঝে ফেলা যায়। গল্পের গহীনে যে বোর্হেস তাঁকে চিনতে পৃষ্ঠ তলদেশে ডুব দিই। অপরিমাপযোগ্য গভীরে কোথাও যদি গল্পের রূপকে, ইঙ্গিতে আসল বোর্হেসের দেখা পাই! সে কাজ বড় দুঃসাধ্য। শুনেছি কাফকার পর এমন অভিনবত্বে অনন্য গল্পকার আসেনি।   

একবার বোর্হেসের লেখায় মগ্ন হতে পারলে দ্বিধাহীনভাবে গল্পগুলো সুপাঠ্য হয়ে ওঠে। শোপেনহাওয়ার, স্পিনোজা, কিয়ের্কেগার্দের দর্শন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে জানা থাকলে বোর্হেসের গল্পের সম্যক ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু বোর্হেস পড়তে গেলে এসব জানতেই হবে এমনও না। সময়, নদী, জীবন, স্বপ্ন, ঈশ্বর, আয়না, গোলকধাঁধাঁ, লাইব্রেরি, বাঘের হেঁয়ালি আর বিভ্রান্তিকর অবস্থায় হাবুডুবু খেয়ে এক গভীর অনুভবে আছন্ন হয়ে থাকার জন্য বোর্হেসের গল্পই যথেষ্ট। ১৯৩৫ সালে ‘আ ইউনিভার্সাল থিওরি অফ ইনিক্যুইটি’ বইয়ের মাধ্যমে বোর্হেসীয় সাহিত্য শুরু হয়। ১৯৩৮ সালে সেপ্টিসেমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি। ভেবেছিলেন আর লিখতেই পারবেন না। কিন্তু লিখলেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লিখলেন- ‘পিয়ের মেনার্ড, অথর অফ দ্যা কিহোতে’ এবং ‘ট্‌লন, উকবার, অরবিস টেরশাস’। ‘ট্‌লন, উকবার, অরবিস টেরশাস’ গল্পে জ্যামিতিক প্রক্রিয়ায় দর্শনের (Geometrical method of philosophical Exposition) প্রকাশ ঘটেছে। গল্প দুটো পছন্দ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তাঁর ‘সুর’ পত্রিকায় প্রকাশ  করেছিলেন। বোর্হেস তখন রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলো লিখছেন। সে কারণে তিনি পরিবারসহ বেশ সমস্যার মধ্যে পড়েন। বোন নোরাকে জেলে যেতে হয়। মা গৃহবন্দি, বোর্হেস নজরবন্দি। অনেকের ধারণা বহুবার নোবেল কমিটিতে তাঁর নাম আলোচিত হলেও রাজনৈতিক কারণে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। এত অসুবিধার মধ্যেও লেখা থামাননি। সাহিত্য জগত তাই দেখল অধিবিদ্যা (মেটাফিজিকস) ও প্রহেলিকার নতুন ঘরানার প্রথম গল্পকার। সঙ্গত কারণেই বোর্হেসের গল্প প্যারাডক্সিকাল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধাঁধাঁকে তিনি যেন ভাষায় প্রকাশ করতে চাইছেন। অলৌকিকতার সাথে বিশ্বজগতের সমন্বয় ঘটাতে চাইছেন। ব্যক্তিগত ঈশ্বরে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। ছিলেন পৃথিবীর রহস্যে বিশ্বাসী। ‘অতিপ্রাকৃত’ ব্যাপারে বিশ্বাস করতেন। উইলিস বার্নস্টোনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘লোকে যখন ঈশ্বর শব্দটা ব্যবহার করে, জর্জ বার্নার্ড শ’র কথা মনে পড়ে যায় আমার। যদ্দুর খেয়াল করতে পারছি, কথাটা এই- ‘ঈশ্বর এখনো নির্মীয়মান’। আর আমরাই হলাম এর নির্মাতা, আমরা জন্ম দিচ্ছি ঈশ্বরকে। যতবার সৌন্দর্য অর্জন করি ততবারই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করি আমরা।’ বোর্হেস গদ্যের চেয়ে কবিতা বেশি পছন্দ করতেন কারণ কবিতার কোনো কার্যকারণ দাবী নেই। ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কল্পনার অভিমুখেই কবিতার যাত্রা। হয়তো সে কারণেই তাঁর গল্পে আছে জটিল ধরণের এবং উঁচু স্তরের রূপকী (Allegory) প্রবণতা আর কবিতার ইঙ্গিতময় (Allusion) অনির্দিষ্টতা।  

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিভিন্ন গল্পে তিনি ‘শেক্সপিয়ার’ এর নাম উল্লেখ করেছেন। এমন কি ‘শেক্সপিয়ার’স মেমোরী’ নামে একটা গল্পই আছে। কবি এবং নাট্যকার শেক্সপিয়ারকে বোর্হেস তাঁর গল্পগুলোয় বিভিন্ন রূপকে প্রয়োগ করেছেন। উইলিস বার্নস্টোনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বোর্হেস বলেছিলেন- ‘যখন বলি শেক্সপিয়ার, তখন আমি মানুষ উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কথা ভাবি না। ভাবি ম্যাকব্যাথের কথা, উইয়ার্ড সিস্টার্স এর কথা, হ্যামলেট এর কথা আর সনেটগুলোর নেপথ্যের রহস্যময় লোকটার কথা।’ কথাসাহিত্যের  একটি আঙ্গিক রূপক (Allegory)। যার মাধ্যমে চরিত্রের বা ঘটনার আপাত অর্থকে অতিক্রম করে অন্য চরিত্র  বা ঘটনাকে প্রকাশ করা যায়। ভাবাদর্শের অ্যালিগরিতে বোর্হেস বিমূর্ত ভাবকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আরেকটি গল্পের উদাহরণ দেয়া  যায়। ‘দ্যা শেপ অফ দ্যা সোর্ড’ গল্পে শেক্সপিয়ারকে ঈশ্বর এবং মানবতার রূপকে প্রকাশ করেছেন। ভিনসেন্ট মুন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মুন সম্পর্কে গল্পকথক তাঁর উপলব্ধিকে এভাবে প্রকাশ করেছেন- ‘Whatsoever one man does, it is as though all men did it. That is why it is not unfair that a single act of disobedience in a garden should contaminate all humanity; that is why it is not unfair that a single Jew’s crucifixion should be enough to save it. Schopenhauer may have been right—I am other men, any man is all men, Shakespeare is somehow the wretched John Vincent Moon.’ (একজন মানুষ যা করে, সেটা যেন সব মানুষই কখনও করেছিল। তাই এটা বলা অন্যায় হবে না, একজন মানুষ একটা বাগানে কোনো অমান্যতার কাজ করলে সেটা পুরো মানবজাতিকেই কলুষিত করে। এটা বলাও ভুল হবে না, একজন ইহুদিকে ক্রুশবিদ্ধ করাটা ছিল পুরো মানবজাতিকেই রক্ষা করা। হয়তো শোপেনহাওয়ার ঠিকই বলেছেন- আমি হচ্ছি অন্যসব মানুষ, যে কোনো মানুষই সব মানুষ। শেক্সপিয়ার তাই কোনো না কোনোভাবে হয়তো এই হতভাগা ভিনসেন্ট মুনই।)          

‘দ্যা শেইপ অফ দ্যা সোর্ড’ গল্প আমাকে ‘শেক্সপিয়ার’ এর রূপকার্থে স্রষ্টা বিষয়ক একটি ‘ধারণা’কে মনে করিয়ে দেয়। সেই ধারণা অনুযায়ী স্রষ্টা সমস্ত সৃষ্টিতে মিশে আছেন। সে অর্থে ঈশ্বর আমরা সবাই। একই অর্থবাচকতায় শেক্সপিয়ারই ভিনসেন্ট মুন। শেক্সপিয়ারকে অবলম্বন করে বোর্হেস ঈশ্বর সম্পর্কিত এই বিমূর্ত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।   

আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরিসে যে শহরতলীতে বোর্হেস বেড়ে ওঠেন, পালার্মো, সেখানে ইতালীয় সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। জলদস্যু, দুর্বৃত্ত এবং যৌনকর্মীতে ভরা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ক্যাবারে নাচ, ট্যাঙো। ছিল গাউচো। এদের হাতে ছোরা-বন্দুক থাকত। এরা গিটার বাজিয়ে নিজেদের লেখা গান গাইতো। পরে তিনি ‘গাউচো’দের নিয়ে লিখেছেন। গল্পের নাম ‘দ্যা ডেডম্যান’। গল্পটিতে জীবনের এক গভীর সত্য ইঙ্গিতে (Allusion) প্রকাশিত হয়েছে। গল্পে বুয়েনেস আইরিসের এক দুর্বৃত্ত ওতালোরা ভাগ্যান্বেষনে উরুগুয়ে যায়। বৃদ্ধ বানদেইরার সাথে দেখা করে। তার অধীনেই কাজ শুরু করে। পশু চরায়। পরে সিদ্ধান্ত নেয় পশু চরানোর কাজ আর না। বানদেইরার আসল কাজ চোরাকারবারি। সে চোরাকারবারি শুরু করে। কাহিনী এগিয়ে যায়। ওতালোরা এক পর্যায়ে বানদেইরার জায়গা দখল করে। এরপর  ঘটনাচক্রে খুন হয়ে যায়। মরে যাবার আগে সে বুঝতে পারে একটু একটু করে নিজের যে অবস্থান সে তৈরি করেছে সেটা আসলে তার অর্জন নয়। তাকে দেয়া হয়েছিল। দিয়েছিল বানদেইরা। ওতালোরা ভেবেছিল বানদেইরাকে সে নেতার অবস্থান থেকে সরিয়ে দিয়েছে অথচ দেখা গেল বানদেইরা তার বিরুদ্ধে ওতালোরার সমস্ত ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আগে থেকেই জ্ঞাত। এই গল্পের ভেতরে যদি তাকাই তাহলে দেখব মৃত ওতালোরা সমস্ত জীবিত মানুষের রূপক। মৃত ওতালোরার মতোই জীবনে আমরা অনেক কিছু পাই। আবার সহসাই হারিয়ে ফেলি। গল্পে ওতালোরা কৌশলে হারিয়ে দিচ্ছে বানদেইরাকে। বিজয় অনুভব করছে অথচ সে ভাবতেও পারেনি এভাবে খুন হয়ে যাবে। বানদেইরা তাকে নিজের ঘোড়া   এবং নারী পর্যন্ত নিয়ে নিতে দেয়। তারপর গুলি করিয়ে মৃত্যুও দেয়। আমি দেখলাম ওতালোরা এবং তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দিয়ে বোর্হেস জীবনের এক গভীরতম তাৎপর্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সেটা  হলো- একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছুই মানুষের নিজের না।   

শৈশবে বোর্হেস ছুটি কাটাতেন সামার হাউজে। সেখানকার পরিবেশে ইংরেজ আবহ ছিল। বাগানে ছিল ইউক্যালিপটাস গাছ। সেখানে সময় কাটাতেন। কখনও বা চিড়িয়াখানায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঘের গায়ের দাগের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। জাগুয়ারের গায়ের দাগগুলোকে লেখা মনে করতেন। পরে তাঁর গল্পে জাগুয়ারের গায়ের দাগগুলো গোপন ভাষার লিপিচিহ্ন হিসেবে এসেছে। বাঘ, চিতাবাঘের রূপক ঘুরে ফিরেই তাঁর লেখায় এসেছে। ব্লু টাইগার্স, দ্যা ডেডম্যান, দি রাইটিং অফ দ্যা গড, ইনফার্নো 1, 32 এসব গল্পের কথা বলা যায়। ‘দি রাইটিং অফ দ্যা গড’ গল্পে প্যাগান যাদুকর বুঝতে পারেন যে, তিনি সমগ্র বস্ত্রের একটা সূতা মাত্র এবং তাকে নির্যাতনকারী পেদ্রো আরেকটা সূতা। সন্ন্যাসী অনুভব করেন ভাষার সূত্র খুঁজতে গেলে জেলখানা  কোনো বাধা নয়। ভাষার সূত্র আছে জাগুয়ারের গায়ে দাগগুলোয়। গোপন ভাষায় লেখা সেই দাগগুলোর মধ্যে কোনো কোনো দাগ মিলে যায় একটা বিন্দুতে। বাকিগুলো জাগুয়ারের পায়ে ছেদরেখার আকৃতি নেয়। উপলব্ধির ফ্রেমে আমিও চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি রেখা-বিন্দু আর বোর্হেসের কাব্যময়তায়, ব্যাঞ্জনায়, ইশারায় বোর্হেসের সাথেই পৃথিবীকে ছাড়িয়ে অনন্ত মহাশূন্যে ঈশ্বরের লেখা অনুসন্ধান করি। স্বপ্নের ক্লান্তিহীন গোলকধাঁধায় জেগে উঠি। এই জেগে ওঠা জাগরণের দিকে নয়। এ যেন স্বপ্নের ভেতর আরেক স্বপ্নের মধ্যে জেগে ওঠা। অন্ধকারের ভেতর আলোর বৃত্ত জন্মায়। দেখছি যা কিছু সব ঘটছে, সুন্দর-অসুন্দর, বিনাশ-বিন্যাস সবই যেন আলো অন্ধকার নিয়ে কেন্দ্রের দিকেই যাচ্ছে।         

বোর্হেসের গল্পের অন্যতম প্রবণতা যুক্তি এবং কল্পনা। আবেগ কিংবা সম্পর্কজনিত অনুভব তার রচনায় তেমন আসে না। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে অঢেল বই তিনি পড়েছেন। গল্পের উপাদান নিয়েছেন। পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রে আবহমান কাল থেকে ঘটমান সমুদয় অন্যায়,  অবিচার, নৈরাজ্য, বৈষম্য, যুদ্ধ, হত্যার ক্লান্তি আর বিষাদগ্রস্ততাকে মূর্ত করেছেন। কল্পনায় বাস্তবকে স্থাপন করেছেন আর বাস্তবের মধ্যে কল্পনাকে। যুক্তি ও কল্পনা দিয়ে অসম্ভব দক্ষতায় মিশ্রণ ঘটিয়েছেন ফিকশান এবং ননফিকশানের। বোর্হেসের অনেক গল্পকে তাই গদ্য মনে করার সুযোগ আছে। তাঁর সেরিব্রাল গল্পগুলোকে ‘সিউডো এসে’ বা ‘ছদ্ম প্রবন্ধ’ বলা যায়। অক্টোভিও পাজের ‘ইন টাইম’স ল্যাবিরিন্থ’ এর একটা মন্তব্য এখানে বলাই যায়- ‘বোর্হেসের প্রবন্ধ পড়লে মনে হয় গল্প পড়ছি। গল্পগুলো মনে হয় কবিতা আর কবিতাগুলো আমাদের ভাবনা জাগায়। যদিও সেগুলো হলো প্রবন্ধ।’ পাজের এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় সাহিত্যের জঁরগুলোর সীমারেখা তিনি কত বছর আগে ভেঙে দিয়েছেন। ১৯৩৫ সাল থেকে হিসেব করলে প্রায় ৮৫ বছর আগে বিশ্বসাহিত্যে এসব কাজ হয়ে গেছে। ফিকশান-ননফিকশান ভারসাম্যের এই দক্ষতা তাঁর গল্পের আঙ্গিক বদলে দিয়েছে। বোর্হেসের গল্পকাঠামোর এই স্বতন্ত্রতা নিবিষ্ট পাঠকদের মনযোগ আকর্ষণ করেছে। যখন বোর্হেস পড়ছি, জাক দেরিদার কথা মনে পড়ছে। ১৯৬০ সালে জাক দেরিদা তখন বিনির্মাণ (Deconstruction) ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। কোনো বিষয়ের বিনির্মাণ কাঠামোর বাইরে থেকে হয় না। কাঠামোর ভেতরেই বিনির্মাণের কাজ চলতে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে গল্পও একটা কাঠামোকে বদলে দিতে পারে। গল্পের ভেতর পরিচিত বহুজনবোধ্য গঠন (Form) নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রতিসাম্য (Symmetry) থাকে। এই প্রতিসাম্যই গল্পের শিল্পগুণ হয়ে ওঠে। ফিকশান-ননফিকশানের এই মিশে যাওয়াটা এক অনুভব জাগায়। এঁকে আমি বলি বোর্হেসীয় বিস্ময়। বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ করে গল্পে এ ধরণের কাজ হচ্ছে। আট দশকের গল্পেই আমরা দেখেছি পাঁচ/ছয় দশকের ন্যারেশানের গতানুগতিক কাঠামো ভেঙে গেছে। নিটোল গল্প বা ঘটনাপ্রধান গল্পের বাইরে ব্যতিক্রমী গল্প লেখা হচ্ছে।    

‘দি রাইটিং অফ দ্যা গড’ এর পটভুমি মেক্সিকো। গল্পে অনায়াসে আর্জেন্টিনা থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রূপকথায় চলে গেছেন। ভারতে-পারস্যে তাঁর গল্পের অবাধ যাতায়াত। বোর্হেসের লেখায় আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় থিম এসেছে। ‘দি অ্যাপ্রোচ টু আল-মু’তাসিম’ ভারতবর্ষ এবং ইসলাম ধর্মের থিম নির্ভর। ‘দি ইনিগমা অফ এডওয়ার্ড ফিটযজারল্ড’ গল্পে এসেছে পারস্য এবং ওমার খৈয়াম। গল্পে আছে ভাষার ভারসাম্য। অতিসংক্ষিপ্ত বা অতিদীর্ঘ বাক্য নেই। বাক্যের গঠন জটিল বা ঢিলেঢালা নয়। যদিও স্প্যানিশ ভাষায় তাঁর ফ্যান্টাসির যে সার্থক সুখময় প্রকাশ ঘটেছে অনুবাদে সেটা পাওয়া কঠিন। অনুবাদের আরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ‘ফুনেস দ্যা মেমোরিয়াস’ গল্পের কথা বলা যায়। গল্পের একটা চরিত্রের নাম ফুনেস। ফুনেস শব্দটি স্প্যানিশ। এর অর্থ দুর্ভাগা, পোড়াকপালে, অন্ধকার। চরিত্রের নামের অনুবাদ হয় না। তাই ‘ফুনেস’ চরিত্রটি গড়ে তুলতে পোড়াকপালে বা অন্ধকার শব্দের যে আবহ নির্মাণ করা হলো, অনুবাদে সেটা এলো না।     

স্থানের মতো সময় জুড়েও বোর্হেসের অবাধ যাতায়াত। প্রাচীনতার মধ্যে আধুনিকতাকে তিনি মিশিয়ে দেন গল্পে। প্রচলিত সময় ধারণার বাইরে গিয়ে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ভেদরেখা আলাদা করা যায় না। একটা স্বপ্ন যেন বা! স্বপ্ন ও জীবন তাঁর লেখায় অচ্ছেদ্য হয়ে যায়। একটি স্বপ্নদর্শী মন থাকলে স্থান কালের বিভেদরেখা মুছে যায়। তাঁর বহুল আলোচিত বই ‘দি আলেফ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ‘দি আলেফ’ গল্পটিকে বলা হয় বোর্হেসের সৃষ্টির মূল নির্যাস। গোপন কিছু অনুসন্ধানের ধারণাটি এই গল্পেও আছে। এই গল্পে ফিকশানের অংশই বেশি। বাস্তব সমস্ত পরিপার্শ্বকে নিয়ে কেন্দ্রের দিকে ধাবমান। বোর্হেস চারপাশের সবকিছুকে গ্রহণ করে সেই কেন্দ্রের দিকে তাকান। সেখানে বিশ্বজগতের সমগ্র ইতিহাসে প্রতিটি ঘটনা একাকার হয়ে যায়। চরিত্রের ছদ্মবেশে বোর্হেস নিজেকেই এঁকে যেন একটি শব্দের বা বস্তুর মধ্যে সমস্ত বিশ্বকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। আলেফ হলো উজ্জ্বল গোলক। সে গোলকের ভেতর ঘূর্ণায়মান দৃশ্যে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থান। সেখানে সাগর পাহাড়, দিন-রাত, পিরামিড, আঙুর, তুষার, মরুভূমির প্রতিটি বালুকণা, জন্ম-মৃত্যু। আলেফকে সব জায়গা থেকে একই মুহূর্তে দেখা যায়। আলেফের মধ্যে পৃথিবীকে, পৃথিবীর মধ্যে আলেফকে দেখা যায়। আলেফের মধ্যে জাগতিক সমস্ত কিছু্র প্রতিফলন সম্ভব হয়ে ওঠে বোর্হেসের লিখনশৈলীর অতুলনীয় দক্ষতায়। আমি একনিষ্ঠভাবে আলেফের ইঙ্গিতময়তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শুধু জ্ঞানের গভীরতা আর ব্যাপকতা দিয়ে ‘দি আলেফ’ লেখা যায় না। আধ্যাত্মিক স্তরের একটি নির্দিষ্ট স্তরে বা মাত্রায় পৌঁছতে পারলে হয়তো এমন উচ্চমানের শিল্পনির্মাণ সম্ভব।       

বোর্হেসের ছোটবেলাটা লাইব্রেরিতেই কেটেছে। গল্পেও সেই লাইব্রেরিআচ্ছন্নতার ছায়াছাপ অনুভব করা যায়। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘দি লাইব্রেরি অফ ব্যাবল’। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘ফিকশান’ এ সংকলিত এই গল্পে মিশে যাচ্ছে দর্শন, কল্পনা, ঘটনা, রহস্য। বোর্হেসের সাহিত্যে পোস্ট মডার্নিজম ‘দি লাইব্রেরি অফ ব্যাবল’। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে ভারসাম্য রেখে একটি লাইব্রেরী ঘোরে আর আয়তনে বাড়ে। বই নিয়ে এই লাইব্রেরী অনন্ত সময় ধরে মহাশূন্যে ঘুরপাক খায়। লাইব্রেরিতে আছে এ পৃথিবীতে লেখা হয়েছে বা লেখা হবে এমন সব বই। লাইব্রেরীর গলিতে আয়না বসানো। যাতে লাইব্রেরীর দৃশ্যপট ফুটে ওঠে। লাইব্রেরীকে বলা যায় সসীম। যদি অসীম হতো তাহলে প্রতিচ্ছিবি দেখার জন্য আয়নার দরকার পড়ত না। আবার লাইব্রেরী একই সাথে অসীম। অন্তহী্ন একটা গোলক যার কেন্দ্রে আছে ষড়ভূজ। অথচ এর পরিধি নেই। পরিধি নাগালের বাইরে। একটা বইয়ের খোঁজে লাইব্রেরি পরিক্রম করে গল্পকথক অথচ সমস্ত বই অভিন্ন উপাদানে তৈরি। বইগুলো লেখা ২২ অক্ষরের বর্ণমালার সবগুলো অক্ষর নিয়ে। সম্ভাব্য সব রকম বিন্যাস নিয়ে। অনুসন্ধানকারীরা সেই আলোকপ্রাপ্ত, নিঃসঙ্গ, সীমাহীন, পুরোদস্তুর বইগুলো থেকে একটি খুঁজছেন। ‘লাইব্রেরী অফ ব্যাবল’ গল্পটি প্যারাডক্সিকাল। ‘মেটাফিজিক্যাল’ লেখার যা একটি কেন্দ্রীয় কৌশল। আপাতদৃষ্টিতে, একই সাথে অসীম-সসীম কিংবা একই সব বইয়ের মধ্যে বিশেষ বই খোঁজা, কথাগুলো পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এর মাঝে আছে যুক্তিগ্রাহ্য অর্থ। পাঠককে সেটি আবিষ্কার করতে হয়। দেখতে দেখতে পার্থিব কিংবা অপার্থিব এই লাইব্রেরির ভেতর আমিও ঘুরপাক খাই। পাঠযোগ্য বইয়ের খোঁজে মহাজীবনের একজন অনুসন্ধানকারী হয়ে উঠি।              

১৯৫৫ সালে অন্ধ হয়ে যাবার পরও তিনি ইংরেজি ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ করেন। ১৯৬০ সালে ড্রিমটাইগার্স বেরোয়। সেখানে প্যারাবোল, গদ্য, এবং কবিতা প্রকাশ করেন। সেরা কাজের একটা মনে করেন। ‘ইনফার্নো ওয়ান, থার্টি টু’ একটা প্যারাবল। এখানে ঘুমন্ত একটি চিতাবাঘকে স্বপ্নের মধ্যে আদেশ  করা হয়- তাকে দান্তের চোখে পড়তে হবে। দান্তে যেন তাকে কবিতায় প্রয়োগ করতে পারে। সেজন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জেগে উঠে চিতাবাঘ কী বুঝবে? একজন মানুষ কবিতা লিখবে এবং তাকে সেই কবিতায় প্রয়োগ করা হবে সেজন্যই সে বেঁচে আছে। চিতাবাঘের পক্ষে এটা বোঝা প্রায় অসম্ভব। ঈশ্বর স্বপ্নে দান্তেকে জীবনের উদ্দেশ্য আর দান্তের কৃতকর্মের গোপন কথা বিশ্লেষণ করে দিলেন। লেপার্ডের  মতো দান্তেও স্বপ্নের মধ্যেই ‘ডিভাইন কমেডি’ বুঝলেন। আমি দেখি, দেখতেই থাকি- Tradition relates that, upon waking, he felt that he had received and lost an infinite thing, something that he would not be able to recuperate or even glimpse, for the machinery of the world is much too complex for the simplicity of men. (জনশ্রুতি আছে, জেগে উঠে দান্তে অনুভব করেছিলেন সে অসীম কিছু পেয়েছে এবং হারিয়ে ফেলেছে। এটা এমন কিছু যা যা কোনোদিন আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এক পলকের জন্যও না। স্বপ্নে যা বোঝা যায় বাস্তবে বোঝা যায় না। দান্তে এবং চিতাবাঘ এই দু’জনের সরল্যের পক্ষে জাগতিক কলাকৌশল বোঝার ব্যাপারটা খুবই জটিল।) বোর্হেসের বেশিরভাগ গল্পেই আছে জটিল এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ইঙ্গিত। টীকাভাষ্য ছাড়া সাধারণ পাঠকের পক্ষে এসব ইঙ্গিতময়তার মর্মোদ্ধার কঠিন।       

পোস্ট-বোর্হেস সাহিত্য কেমন হতে পারে বিশ্ব সেটা পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাসাহিত্যে বোর্হেসকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। বোর্হেসীয় বিস্ময়ের আঙ্গিক, ভাষাস্বর এবং সম্যক শিল্পগুণের সাথে পরিচিত হবার জন্য আরও নিবিড়ভাবে বোর্হেস পাঠ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বোর্হেসের গল্প খোলামেলায় আলোয় উদ্ভাসিত ল্যান্ডস্কেপ নয়। সূর্যকে বিষয়বস্তুর পেছনে রেখে লিখিত গল্প। আমি দেখি, দেখতেই থাকি। গল্পের অধিক সে এক আবছায়া সিল্যুয়েট।  



অলংকরণঃ তাইফ আদনান