বাঙালি জাতিসত্ত্বার মূলে প্রোথিত মরমীবাদী চিন্তা,ধ্যান থেকে হৃদকমলে জেগে ওঠা এক আপ্তধ্বনির নাম বাংলাকবিতা। সেই বাংলাকবিতার শেকড়সন্ধানী চিন্তার বেদীতে যে কবিতাগ্রন্থগুলো নতুন অবয়বে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে জাকির জাফরানের ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’ তার অন্যতম।বাংলা লৌকিক কবিতার এক বিশাল আর্তি এই কবিতাগ্রন্থে সূচিবদ্ধ কবিতাবলীর মাধ্যমে আরেকবার জেগে উঠেছে,সে আর্তি মাটিবর্তী কাব্যঘরানার আড়ালে সাবলীল বোধিজ্ঞানের। সে আর্তি রোদ-বৃষ্টি আর অনির্বাণ জ্যোৎস্নায় সিক্ত অথচ দারুণ তৃষ্ণার্ত প্রাণের। জাকির তার এই কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় উপস্থিত করেছেন এমন সব দ্যোতনাদূত্যি যা বাংলা কবিতার বিলুপ্তপ্রায় তৃষ্ণাকে, বিলুপ্তপ্রায় মোহাচ্ছন্নতাকে জাগিয়ে তোলে।শুধু কবিতার প্রয়োজনেই নয়, বাঙালি মাটিবর্তী সত্ত্বাকেই ভাষিক এবং ভাবনাগত দৈনতার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে,পুনরুদ্ধার করেছে জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়-
তুমি ছিলে ময়ূরাক্ষী নদীর কিনারে, সেই থেকে
নদীতীরে জগৎ গড়েছি।একদিন আমাদের
প্রত্ন-প্রশাসন দেখে যারা হেসেছিল,আজ দেখ
সমাধীতে কালের কলঙ্ক হয়ে তারা শব্দহীন।
নিঝুম প্লাবন থেকে রাঢ় দেশে গড়ে উঠেছিল
তোমার আনকা মন নীল স্ফটিকের মতো চোখ,
ফসিল কাঠের মায়া ছিল মনে, আর মৃৎপাত্রে
অহোরাত্র রাখা ছিল তৃষ্ণার কাজল।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়-১২)
আধুনিক বাংলা কবিতার ঘর-গৃহস্থালিতে লোকজ ধারা বহমান এ কথা স্বীকার্য।এদিক থেকে বাংলা কবিতা মুখ ফিরিয়ে নেয়নি কখনো। কবিতা আমাদের লৌকিক বাংলার আজীবন লালন করা বাঙালিয়ানাকে পুঁজি করেই তৈরি করেছে তার অমৃত অমিয় ভাণ্ড। জাকির তার কবিতায় সে বিষযটিকে তুলে এনেছেন পরম নৈপুণ্যতায় জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় এ মন্তব্যের স্বার্থকতা বহন করে। মূলত সিরিজ কবিতা মনে হলেও এ কবিতাগ্রন্থের প্রতি পর্বে তিনি তুলে এনেছেন নতুন নতুন ভাবনার বহুমাত্রিক ধ্যান।প্রয়োজনে তিনি চিন্তার গভীরে গিয়ে হঠাৎ ফিরে আসেন নিজের ভেতরে। যেখানে নিজের সাথেই নিজের বিরোধিতা,নিজের ভেতরেই সব দ্বন্দ্ব। আলাপচারীতায় তিনি নিশ্চুপ হয়ে আসেন শব্দের ভিতরে। যে কারণেই তার কবিতা সাবলীলতায় বদলেছে ধীর লয়ে,একা। কবিতার জন্য আত্মমগ্নতা সত্যিই জরুরি,তার চেয়েও জরুরি নিজের পরিবেশ আর প্রতিবেশ সর্ম্পকে অবগত থাকা।এ দু’টি বিষয়ের একটি অপরটির সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত। অপ্রিয় সত্য এই যে, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কবিই উপর্যুক্ত দু’টি বিষয় সম্পর্কে সচেতন নন। জাকির জাফরান তার কবিতায় সচেতন ভাবেই এই নির্জনতার কাজটি করেছেন।
গত শতকের শেষে বাংলাদেশের কবিতা বাঁক নিতে শুরু করেছিলো নতুন এক সম্ভাবনার দিকে। সার্থক কবিতা কখনো একাডেমিক নয় বরং একাডেমিক চিনÍাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে চিরসুন্দর এক মূর্যাল হয়ে ওঠা আশ্চর্য চেতনার প্রকাশ।এ পথেই হেঁটেছেন জাকির জাফরান। তার কবিতার বেশ কিছু পর্বে এরকম শৈল্পিকতা ধরা পড়ে-
অদ্ভুত এ সমাপ্তির পর,প্রিয় কবুতর,রাতে,
অনন্ত নখের দাগে এই দেহহাঁড়ি ভরে গেছে।
অনাদি প্রেমের পুঁথি ছিঁড়ে নিয়ে নৈশভ্রমরেরা
নিধুয়া সংকেতে ডাকে,এসো চাষা ও বারুই এসো,
পতিত জমির স্তনে করো আজ শস্যের আবাদ,
দিগন্ত হালটে জাগো ধিকিধিকি ধানগাছতলে।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়-০৯)
একজন কবিই জানেন তার অর্নÍনিহিত চিন্তাসত্ত্বার আদি এবং অনন্ত অন্তিম পরিচয়। কেবল তার পক্ষেই জানা সম্ভব হয়ে ওঠে তার সামগ্রিক চিন্তা আর দর্শনের আদ্য্যেপানÍ।কবিতা সৃষ্টির প্রাক্কালে যাবতীয় দর্শনকে কবি আশ্রয় করেন কেবলি কি তার চিনÍার আয়োজন সম্পন্ন করতে নাকি আরো গভীরতর কোন বোধের বিনির্মাানিক তাগিদে? এ রকম প্রশ্ন জাকির জাফরানের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় । তার কবিতায় আদিগন্ত সত্যেও সৌন্ধর্য উন্মোচিত হয়েছে। আসলে কবি তার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন-যাপনের ক্রিয়াকর্মই তুলে ধরেন অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও সবটাতেই এই প্রক্রিয়া সমানভাবে কাজ করে না।কবিতার ভেতরে কবি তার নিজস্ব ভাবনা বুননের পাশাপাশি তুলে আনেন সময় আর আনুষঙ্গিকতার বিরল চিত্রকল্প। জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় এমনই কবিতাগ্রন্থ যার ভেতরে কবি টেনে হিঁচড়ে নয় বরং পরম ভালোবাসায় বের করে এনেছেন সেই সব বিলুপ্তপ্রায় লোকজশব্দ, মিথ, বিষয় যা হারিয়ে যেতে বসেছিলো বিংশ শতাব্দী শেষের সাথে সাথে। এ বিষয়টি কিন্তু সহজেই স্বীকার্য যে,বাংলাদেশের কবিতা সৃষ্টির মোহক্ষণে কবি তার মনোজাগতিক তদ্রাচ্ছন্নতা ভেদ করে পৌঁছে যান অলৌকিক সা¤্রাজ্যে যেখানে অযুত প্রশ্ন ধরা পড়ে তার দিব্যজ্ঞানে।জাকির জাফরানের এই কবিতাগ্রন্থেও কবিতাগুলোতে এরকম ছায়া উঠে এসেছে।তার কবিতার প্রকাশভঙ্গিমা অসাধারণ রকমের চিন্তনবোধজ্ঞানে উজ্জ্বল।
গত শতকের পঞ্চাশদশকের পরে আল মাহমুদের কবিতায় যে গ্রামীণআবহ চলে এসেছিল সেটি বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় হয়ে উঠেছিল এক অভিনব সংযোজন।এই কথা স্বীকার্য যে,আলমাহমুদ ছাড়াও তৎকালীন অনেক কবির কবিতায় গ্রামীণ আবহ সুচাররুপে ফুটে উঠেছিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাকবিতা তথা বাংলাদেশের কবিতা তীব্রভাবে বাঁকবদল করে উত্তরাধুনিকতা এবং বিপরীতকবিতাধর্মী ভাবনার দিকে। আমরা ভুলে যেতে থাকি আমাদের গ্রামীণ শিকড়ের অবিচ্ছেদ্য টান,আমাদের মগজে- মননে বারবার আশ্রয় নিতে থাকে পশ্চিমা ঘরানার সাহিত্যের আবহাওয়া। এর থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশের কবিতাও।একটি বিষয় চরম আক্ষেপের সাথেই মেনে নিতে হয় যে,নতুন শতাব্দীর শুরু হওয়ার বিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের কবিতায় এখনো পশ্চিমা কবিতার প্রভাব সাংঘাতিকভাবে বিদ্যমান। এইসব ঘোর থেকেই একেবারেই আলাদা করে তৈরি হয়েছে জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়।জাকির জাফরান তার চেতন-অবচেতন মনেই নির্মাণ করেছেন এই কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা। অলংকারশৈলী এবং ছান্দসিক বিচার-বিবেচনায় সনেটঘরানার এই কবিতাগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামীণ আবহ থেকেই জন্ম নিয়েছে।আল মাহমুদের পর আধুনিক বাংলাকবিতার এই সৃষ্টি বাংলাকবিতায় চিরায়ত লোকজ জীবনের পুনরুদ্ধার। কবি তার নিজস্ব চিন্তা এবংনিজস্ব ঢঙেই সাজিয়েছেন এই কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা। এই কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়ই প্রাঞ্জলতার ছাপ সুস্পষ্ট। জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় আগামীদিনের বাংলাকবিতার অনিবার্য মাইলফলক-
মাটির বাটিতে আজ নাচে দেখ স্বর্ণশিলা-মন।
কৈ মাছের নৃত্য দিয়ে পথে পথে রচিত দুপুর।
নলখাগড়ার দেহ দিয়ে রচনা করেছ শয্যা
সুরম্য চাঁচর দিয়ে বানিয়েছ অন্ত্যজ আকাশ।
এখন দেয়াল বেয়ে নামে নীল-নির্জন পুকুর।
পটচিত্রে আঁকা কারো মুখ,আর পটুয়াগীতির
কয়েক চরণ পড়ে আছে মাছুয়া নারীর পেটে,
ধীবরী চোখের তারায় যেন দুলে ওঠে চন্দ্রদ্বীপ।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়-১৩)
অদ্ভুত সুন্দর আদিবিমূর্ত প্রকাশ এই অংশে। জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়ে এরকম চিন্তার রেশ পুরো সিরিজেই রয়েছে।বাংলা কবিতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় জাকির তার এই গ্রন্থের কবিতাগুলোয় বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন আবহমান কালের আর্তি আর এ ভূখণ্ডের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস।মানবিক মূল্যবোধ আর জাগতিক চিন্তার রেশ জাকির জাফরান তুলে এনেছেন এই সনেটে। কবিতার ভেতরে স্বাভাবিক ধ্যান আর সাহসী উচ্চারণের পথকে আড়াল করে জাকির পৌঁছে গেছেন আক্ষরিকতাকে ছাপিয়ে অতলান্তিক বোধের পথে যেখানে পৌঁছে তিনি উপলব্ধি করেছেন নগর যন্ত্রনা থেকে বহুদূরের এক মূর্যাল।
বাংলাদেশের কবিতার প্রেক্ষাপট বিচারে নগরায়নের ভিতরে আরেক মুর্ছনার প্রকাশ তো অনেকেই করেছেন কবিতার কাব্যময়তায়। আল মাহমুদ,শামসুর রাহমান পরস্পর বিপরীত মেরুতে বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেলেও সাবলীল ভঙ্গিমায় তারা গ্রামীণ আর নগরায়নিক চেতনা,যাপিত মৌনতাকে প্রধান করে তুলেছিলেন।জাকির সে পথই অনুসরণ করেছেন বারবার জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়ের প্রতিটি কবিতায়।কবিতার ভেতরে তিনি তুলে এনেছেন রাজনীতি আর প্রেমের যৌথ ইশারাভাষিক উন্মাদনা।বাংলাদেশের কবিতায় এ এক নতুন সংযোজন। ছন্দের নয়,বরং তার কবিতায় উঠে এসেছে নিবিড় বোধের বুদ্বুদ! এ মন্তব্যের অর্থ এই নয় যে,তিনি ছন্দকে মুখ্য করেননি। হয়তো তিনি ছন্দকে আশ্রয় করেই লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তার কবিতা কেবল ছন্দেই মত্ত থাকেনি, সেই সাথে আরো কিছু বেদনা,আরো কিছু গোপন শুন্যতার লিরিক্যাল টিউন তিনি তৈরি করেছেন দক্ষ হাতে।সনেটিক ঘরানায় এই লিরিক্যাল টিউন বাংলা কবিতায় তৈরি করেছিলেন মাইকেল মধূসুদন দত্ত। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, হাজার বছরের বাংলা কবিতায় এই টিউন জড়িয়ে ছিলো যুগে যুগে তার প্রমাণ চর্যাপদ,মঙ্গলকাব্য সমূহ,পরবর্তী সময়ের যুগসন্ধির কবিতাবলীতে।
আল মাহমুদ,সৈয়দ শামসুল হক পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতার যে বোধ-চিন্তা এবং প্রকৃত স্বাপ্নিক সারমেয়তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন জাকির জাফরান তার কবিতায়, তাতে বাংলা কবিতার অধুনালুপ্ত আবহমানতার পুণরুদ্ধার ঘটেছে কেবল তা-ই নয়,সেই সাথে সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের কবিতার নতুন একটি দিক উন্মোচনের। সেটি হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ভেতর দিয়ে এক অযাচিত অথচ অনস্বীকার্য উপমার প্রকাশ ঘটে যেবষয়টি চিরায়ত এক বোধের দিকে মানুষকে টেনে নিয়ে যায় প্রাঞ্জলভাবেই। এই চেতনার গভীরে গিয়ে বোধের নিভু নিভু আলো কে আরেকবার প্রজ্জ্বলিত করার দুঃসাহস দেখানোর নজির বাংলা কবিতায় বিরল। এই জরুরি কাজটিই জাকির জাফরান দেখাতে পেরেছেন তার এই কবিতাগ্রন্থে। চিরায়ত বাংলা কবিতার গতিপথ পুণরূদ্ধার হয়েছে তার এই কবিতাগ্রন্থের মাধ্যমে।এই বিরল অথচ অনিবার্য কাজটি সম্পাদনের জন্যই নমস্য তিনি জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় এর কবি জাকির জাফরান।
এ গ্রন্থের কবিতাগুলোয় আত্মপরিচয়ের বয়ানের পাশাপাশি রয়েছে আত্মবোধের বয়ান। আবহমান কালের সুবিনির্মিত কবিতার বেশকিছু উপস্থাপনা রয়েছে এ কবিতাগ্রন্থে যেগুলো একজন অনুসন্ধিচ্ছুক কাব্যবোদ্ধা কে সহজেই টেনে নেবে বোধের পরমাশ্রয়ে।বাংলা কবিতার কেবল পরম্পরা বিচারেই নয়, অনাগত প্রজন্মের চেতনাকে লৌকিক বাংলা কবিতার সাথে সহজেই পরিচয় করাতে সক্ষম হবে ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’। চিরায়ত সংস্কৃতিচিন্তক প্রজন্মের হাতে এক অলৌকিক মৃত্তিকা-প্রদীপ,আধুনিক বাংলা কবিতার মঙ্গলালোক ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান