ভালোবাসাকেন্দ্রিক এমন বেপরোয়া মুভি অনেক দিন দেখা হয় নাই, তবে কেন্দ্রে ভালোবাসা থাকলেও এ ছবিতে এসেছে কালচারাল ক্ল্যাশ জেনারেশনাল গ্যাপ ইত্যাদি বিষয়-আশয়। তার্কিশ বাবা-মার ঘরে জন্ম নেয়া জার্মান পরিচালক 'ফাতিহ আকিন' বেশ ভাবনাসঞ্চারী ছবি বানান। তিনি প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন এই 'হেড অন'- এর মাধ্যমে, যেটা তাকে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টের মোস্ট প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড 'গোল্ডেন বিয়ার' এনে দিয়েছিল, সালটা ২০০৪।
ছবির শুরুটা কী মনোমুগ্ধকর! ইস্তানবুলকে পেছনে রেখে বসফরাসের তীরে বসেছে এক বাদক দল, অনেকটা লোকগানের ভঙ্গিতে এক গায়িকা যেন বর্ণনা করে যাচ্ছে অম্লমধুর প্রেমকাব্য, থেকে থেকে আমাদেরকে পরিচালক এই ব্যান্ডদলের কাছে ফিরিয়ে আনবেন একটু জিরিয়ে নিতে, কেননা যে প্রণয়কাহানি আপনি পর্দায় দেখতে যাচ্ছেন তা আপনাকে যথেষ্ট ভোগাবে! মদের দোকানের শিশি বোতল কুড়িয়ে বেড়ানো এক তার্কিশ জার্মান জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তীব্র বেগে গাড়ি নিয়ে আঘাত করেন দেয়ালে, উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যেই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সেখানে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ এক নারীও হাজির, জাতিতে তার্কিশ, সেও আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে ফিরেছে, কিন্তু ভাবভঙ্গি খুব একটা সুবিধার না, তাকে যখন তার ভাই ও মা বাবা মিলে জীবনের মূল্য বোঝানোর সবক দিচ্ছিলেন সেটা দূর থেকে খেয়াল করেন 'চাহিত' নামের ঐ হতাশাগ্রস্ত ভদ্রলোক। সবচেয়ে আচানক হলো 'সিবেল' নামের চটপটে মাইয়াটা হুট করেই চাহিতকে প্রস্তাব দিয়ে বসে বিয়ে করার জন্য, যেহেতু চাহিত তার্কিশ, তার বাবা মা মেনে নিবে, তবে এটাই একমাত্র কারণ না, মূল কারণ যেহেতু মেয়েটা অস্থিরতার স্টেজে আছে, অতএব তারা তার মতের বিরোধিতা করে আরো অস্থির করে তুলবে না! কিন্তু চাহিত কেন রাজি হবে, চাহিত আসলে এক প্রকার বাধ্য হয়, মেয়েটা যখন একটা বারে পুনরায় বিয়ের কথা তোলে আর চাহিত তাতে নারাজের ইঙ্গিত দেয় সাথে সাথে সিবেল বিয়ারের একটা বোতল ভেঙে হাত কেটে ফেলে! যাই হোক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তাদের বিয়ে হয়, সে সময় আমরা অবগত হই, চাহিত অপেক্ষা সিবেল ২৩ বছরের ছোট! বিয়েটা আসলে একটা ফর্মালিটিজ হিশেবেই তারা করে, তাদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি থাকে যে বিয়ের পরও তারা তাদের জীবন আগের মতোই কাটাবে, কারণ সিবেল এক বেহিশেবী জীবন কাটাইতে চায়, তার অবাধ স্বাধীনতায় পারিবারিক হস্তক্ষেপের যাতনা থেকে মুক্তি পেতেই সে বিয়ের অভিনয়টুকু করলো। চাহিতের এতে কোনো আপত্তি নাই, শরীরের চাহিদা সে অন্য নারীতে মেটায়।
কিন্তু একটা সময় তারা টের পায় তাদেরকে (চাহিত ও সিবেল) তাদেরই বেশি প্রয়োজন, আস্তে আস্তে যখন পরস্পরের প্রতি আসক্তি জন্মাতে শুরু করে তখনই ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা, সিবেলের এক প্রাক্তন প্রেমিক সিবেলের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জনসম্মুখে সিবেলের চরিত্র নিয়ে গালমন্দ করতে থাকে, এক পর্যায়ে চাহিত তাকে অ্যাশট্রে দিয়ে আঘাত করলে তার মৃত্যু হয়, চাহিত সাজা সিবেলের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, কারণ সিবেলের পরিবারই এই ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করবে, ফলে হামবুর্গ থেকে পালিয়ে সিবেল ইস্তানবুলে গিয়ে আশ্রয় নেয় তার এক কাজিনের কাছে। চাহিতকে সে জানিয়ে আসে তার জন্য সে অপেক্ষা করবে, পত্র মারফতে সে চাহিতকে এও জানায় ইস্তানবুল শহরের সতেজতা তার মনের মলিনতা দূর করতে পারছে না, চাহিতের মতোই সে যেন এক প্রকার কারাগারেই অবস্থান করছে! সিবেল যেন এক আমৃত্যু শরণার্থী, এখানে সেখানে ভেসে বেড়ানোই যেন তার নিয়তি, ফলে ড্রাগ-সঙ্গীর আহ্বানে ছেড়ে আসে কাজিনকে, কিন্তু এই পিশাচ তাকে সুযোগ বুঝে রেইপ করে বের করে দেয় গভীর রাতে। তল্পিতল্পা সহযোগে বেরিয়ে পড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে, পথিমধ্যে বিবাদে জড়ায় ৩ ধর্ষকামী পুরুষের সাথে, যারা তাকে ছুরি মেরে মৃত্যুমুখে ফেলে যায়, এই সহিংসতার দৃশ্য বেশ ভীতিকর, সিবেল যেন চাহিতের অনুপস্থিতি সইতে না পেরে মৃত্যুই কামনা করছিল, কারণ বিবাদ সে এড়িয়ে না যাওয়ার রাস্তায় হেঁটে জড়িয়ে পড়ার রাস্তাই বেছে নিচ্ছিল, আর তাই আমার এই সন্দেহ! একটা দীর্ঘ বিরতির পর আমরা দেখি চাহিতের কারামুক্তি, সিবেলের সন্ধানে ইস্তানবুল আগমন। সিবেলের সেই কাজিনের কাছে এসে যখন তার সন্ধান চায় তখনই আমরা জানি সিবেল অন্য পুরুষের সাথে ঘর বেঁধেছে, সেখানে এক কন্যারও আবির্ভাব হয়েছে। চাহিত অপেক্ষা করে, কিসের জোরে যদি জানতে চান, তবে বলব ভালোবাসার জোরে, একদিন হোটেলে সিবেলের ফোন আসে, এরপর তাদের সাক্ষাৎ হয়, এবার তাদের মিলনটা শরীর অব্দি গড়ায়, চাহিত সিবেলকে প্রস্তাব করে তার কন্যাসহযোগে ভেগে যাবে চাহিতের জন্মস্থানে, সিবেল রাজি হয়, কিন্তু বাসায় এসে ব্যাগ গোছানোর সময় কন্যার সাথে বাবার ফোনালাপের মায়ায় থেকে যায়, ফলে শেষমেশ আমরা চাহিতের পাশের সিটটা খালিই দেখব, যে বাসে সে রওনা করেছে তার গ্রামের বাড়ি!
এ যেন এক ভালোবাসার কাছে আরেক ভালোবাসার পরাজয়, পরাজয় না বলে আমরা এও তো বলতে পারি, এক ভালোবাসা আরেক ভালোবাসায় সমর্পিত হইল। সিনেমার কালার টোন এত রিয়ালিস্টিক যেন প্রতিদিনের জীবন দেখছি, সাউন্ডের কথা তো আগেই ইঙ্গিত করেছি, শরীর সাড়া দেয় এমন এক আবহসঙ্গীত, তাছাড়া এক সাক্ষাতকারে পরিচালক জানাচ্ছেন লাইট কস্টিউম নয়, মিউজিকের জন্যই এই ছবির বাজেট সবচেয়ে বেশি রেখেছেন, প্রায় ১ লাখ ইউরো, সালটা কিন্তু ২০০৪! আর অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততার কথা না বললে অবিচার করা হবে প্রধান দুই চরিত্রর প্রতি, কী জান্তব উপস্থিতি এই দু'জনের, আবেগ অনুভূতি ও নির্মোহ ভঙ্গি প্রকাশে কোনো ভণিতা নেই, যেন গল্পই তাদের রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে! এমন ছবি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার দেখলেও ক্লান্তি আসবে না বোধ করি।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন