জলধি / পাঠ-পর্যালোচনা / মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনে শব্দের বর্শা আর চিত্রের তিক্ষ্ণতা আবিষ্ট হওয়
Share:
মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনে শব্দের বর্শা আর চিত্রের তিক্ষ্ণতা আবিষ্ট হওয়

একজন ক্ষেত্র সমীক্ষকের কাজ হলো বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ঐতিহাসিক সামাজিক ভৌগলিক বা সাহিত্যের বা ভাষার বৈচিত্র সমূহের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নতুন তথ্য খুঁজে বার করা সাধারণত ক্ষেত্র সমীক্ষএকটি নতুন দিশা খুঁজে দেখার চেষ্টায় ক্রমশ ঘুরতে থাকেন বিভিন্ন অঞ্চলে।একজন কবি এবং একজন ক্ষেত্রসমীক্ষকের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই ইংরেজিতে যাকে বলে এক্সপ্লোর করা একজন কবিও প্রতিনিয়ত এক্সপ্লোর করে চলেন। ক্ষেত্রসমীক্ষকের মতই কবিও  ভাষার শব্দ অর্থ রুপ ও যতি চিহ্নের ভিতর দিয়ে দিনযাপনকে সমীক্ষা করতে থাকেন এক একটি লেখা হয়ে ওঠে আবিষ্কার 'পাখিতীর্থদিনে'  কবিতা সংকলনে কবি মাসুদ খান লিখছেন 'আমি বগুড়ায় থাকি ছোট ও নিরিবিলি একটি শহর বেশ কয়েক বছর ছিলাম সেখানে। এই কয়েক বছরে কত সখ্য, কত মাখামাখি...  কত বয়ে যাওয়া, প্রাণপাত্র উপচে কত ছলকে-ছলকে পড়া প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে সারাদিন নিংড়ে  নিচ্ছি প্রভূত প্রাণশক্তি আর তা উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছি আমাদের সান্ধ্য আড্ডাগুলিতে । আমাদের দিনযাপন তখন কবিতাযাপনের নামান্তর।' কবি যখন ঠিক এই ভাষায় নিজেকে ধরা দিতে চান যখন কবি নিজেই বলে দেন যে তার সারাদিনের যাপন চিত্র ক্রমশ কবিতা যাপন হয়ে ওঠে কবিতাকে সাক্ষী রেখে সূর্য ওঠে এবং সূর্য অস্ত যায়। কবিতার  আবহেই নিরন্তর ডুবে থাকেন কবিকবিতা থেকেই তাঁর অক্সিজেন গ্রহণ আবার কবিতাতেই আক্ষেপ অভিমান ক্রোধ ও কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করা এই কবিকে তাই সহজেই মনে হয় তিনি যেন একজন ক্ষেত্র সমীক্ষক।

কবি লিখছেন ভিন্ন রকম নিরীক্ষার পাশাপাশি কবিতার ভাষা কবিতার শরীর কেমন হবে তা অনুভব করতে কবি ছুটে গেছেন বিভিন্ন এলাকায় কবি লিখছেন পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর রংপুর লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম নওগাঁ নাটোর রাজশাহী রাজগঞ্জের পল্লীতে পল্লীতে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন তাও তিনি স্পষ্ট করেছেন কবি লিখছেন 'একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে' এ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কবিতাও যেমন তিনি লিখেছেন তেমনি পাশাপাশি ভেবেছেন জটিল স্রোতে সাঁতার না কেটে সাধারণ বিষয় নিয়ে অনুভূতি ও কল্পনার বিকাশ ঘটিয়ে কবিতা  চর্চা করা যায় কিনাকীভাবে তা করা যায় তা ভেবে চলেছেন নিয়ত। পরক্ষনেই তিনি বলছেন এই যে বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সেখানে দেখেছেন কোথাকার কোন মাটি ঝুরঝুরে কোন মাটি বেলে দোঁয়াশ বা  আলমাটি সবুজ মাঠ ঘর ভেঙে যাওয়া হাট মেঠো পথ পথের পাশে চায়ের দোকান শীতের শুষ্ক আবহাওয়া রুক্ষ ভূপ্রকৃতি এসবের মাঝেই হঠাৎ পুষ্করিণী বা দিঘী এই আদিগন্ত ভূ-আয়তন এর এক কোণে ভরা নদীর বাঁকে অবস্থিত  ধরলা নদী কবিকে ভাষা যোগায় কবি দেখেছেন কেমন করে নদী সাড়া দেয়, গ্রহ-উপগ্রহের টানে আকুল হয়ে ওঠে খেলে যায় ঝড়ো হাওয়ার উস্কানিতে ঢেউ উঠে আবার শান্ত হয় মাছরাঙা আর পানকৌরি দুই বৈমাত্রেয় ভাই বাসা বাঁধে নদীর বুকে।স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ কলহ করেবাবুই পাখিরা ও ভুলে যায় তাদের বয়নসূত্র বিবিধ বেড়া ও প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় গৃহনারী। বইটির প্রচ্ছদে স্পষ্ট দেখি একটি চোখ ঠোঁট আর জলের মধ্যে নিমজ্জিত পাখির পা। কবি খুঁজে ফেরেন নতুন ভাষা নতুন শরীর নতুন নিরীক্ষা আপাত কঠিন ভাষার আড়ালে  কবি বাবুই পাখির মতো বুনে চলেন  অদ্ভুত এক সুন্দর বাসা

ধরলা নদীর বাঁকে ছোট্ট একটি শহর কুড়িগ্রাম 'পাখিতীর্থদিনে' সংকলনের প্রথম কবিতা কুড়িগ্রাম। মোট পঁয়ষট্টিটি কবিতায় সাজানো এক বিচিত্রমুখী কোলাজ। সবার আগে আলোচনায় বেছে নেব 'একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে' কবিতাটি। কবি নিজেই বলেছেন এটি একটি নিরীক্ষাধর্মী কবিতা। কবিতার নির্মাণ শরীর দেখলে চমকে উঠবেন পাঠক কবি লিখছেন:

 বালি লালা

 আচমকা নায়িকাচূর্ণের দিগ্বিদিক ঘ্রাণ।

 ধ ওর্ম বীর্যবাসনা প্রবল হলে জাগে টান

..........................................

আন্ডারক্যারেজ গিয়ার............ গতিবর্ণ -পপি ফুল

                                         গতিগন্ধ -পপিফুল, মদপিচ্ছিল মৎস্যকন্যা

কবিতাটির শেষ হচ্ছে এইভাবে

তিরতির-কাঁপা উচ্চাভিলাষী কাঁটা

কবি প্রথমেই বলেছিলেন 'ছন্দ অলংকার শব্দচয়ন কয়েনেজ ভাব ভাষা এসব নিয়ে নানারকম নিরীক্ষা ও ভাঙচুরে আমরা তখন অকাতর' এই কবিতায় কবি তেমনি শব্দচয়ন করেছেন 'তাম্রডিজেল', 'চিত্রবাঘ', 'পোড়া মবিল', 'মৃগইঞ্জিন' এবং 'ট্র্যাজেক্টরি''অসিলোস্কোপ'।  কবিতার  এই ভাষা সহজেই মনে পড়িয়ে দেয় যেন একটি ধাবমান পুরুষ বা বাঘকে। খুব সহজেই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় উইলিয়াম ব্লেকের দ্য ল্যাম্প এবং দ্য টাইগার কবিতা দুটি একজন নিরীহ একজন হিংস্র চিত্রিত হরিণের পিছনে চিত্রিত বাঘ,  তীব্র ক্ষুধার্ত পুরুষের  লালা যেন এক উজ্জ্বল উল্কা অথচ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ক্রমশঃ। গন্ধ আসছে পটাশিয়াম সায়ানাইডের কবি দেখতে পাচ্ছেন  এই উচ্চাভিলাষের মধ্যেই রয়েছে যুগ্ম ট্র্যাজেক্টরি। একটা চোরা গোঁত্তা খাওয়া পথ,  যেন এক উপাসনা অথচ ও যৌনতায়  ও ধর্ম লালায় মিশে আছে 

শব্দের ব্যবহার ও তাৎপর্যে যে সাবলাইম গল্প আছে তাতে পাণ্ডিত্য দেখানোর কোনও চেষ্টা নেই অথচ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন মাসুদ খান। এই রূপ ও চিত্র  কবির কাছে অবিরল। এই শব্দের মায়াবন্ধন কবিকে বেঁধে ফেলে আবহ নির্মাণের সহজিয়া পথে। প্রথম কবিতায় ফিরে আসি কবি স্পষ্ট বলছেন, 'কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম'। কবির মধ্যে কোন ভনিতা নেই অথচ কবি অনুভব করেন 'রাত গভীর হলে  আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।' কবি স্পষ্ট অনুভব করতে পারেন:

নদী শান্ত হয়ে এলে

শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা যত গৃহনারী

পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে নদীকূলে করে ভিড়

প্রকান্ড স্ফটিকের  মতো তারা সপ্রতিভ হয়।

কবিতার মধ্যে কবির আকুতি ফুটে ওঠে এই যে এত সুন্দর কুড়িগ্রাম সেখানে কবি কখনো যাননি সেখানে কি কখনো যাওয়া হবে? দ্য লং চেরিশড ডিজায়ার অব দ্য পোয়েট মে অর মে নট বি ফুলফিলড... কবির এই আকুতি নিজের ভাবনার মধ্যে মিশে যায় ক্রমশ কবি দেখতে চেয়েছিলেন সাধারণ আটপৌরে ভাষায় কবিতা নতুন শরীর তৈরি করা যায় কিনা বা করলে তা কতখানি রূপ ধারণ করে। নিরীক্ষার বাইরে দাঁড়িয়ে ও অন্যরকম নিরীক্ষা 'পিঠাপুরান' কবিতাটি। কবি লিখছেন 'যে উত্তাপ, শৈত্য আর জাদুর প্রভাবে/ পোড়া পিঠাতেই  ঘটে অঙ্কুরের উদ্গ, শুধুই/ রূপচিত্র বলে আটকে রেখেছ সে-উপাখ্যান,/ শ্যাওলা-পড়া মলিন ব্রোঞ্জ-মেহগিনি কৌটার গহ্বরে।'  আমরা পাঠ করি অন্যরকম চিত্ররূপময় কবিতা। জীবনানন্দের কবিতা থেকে দূরে হলেও কোথাও যেন শব্দের মধ্য দিয়ে যে ছবি ফুটে ওঠে তাকে মনে করিয়ে দেয়। আমাদের দিনযাপনের আখ্যান ফুটে ওঠে সহজ কথায়। পাঠক মুগ্ধ হন। অথচ এত  সব কিছুর ভিতরেও কবি তাঁমত করে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন সাধারণ কথাবার্তার মাধ্যমে মুছে দেন বিভেদ। এখানে শুধু সাধারণ দিনযাপনের কথা নয় নতুন দিন আনার কথাও কবি ঘোষণা করেন যেন তিনি একজন ম্যাজিশিয়ান আর হাতে রয়েছে জাদুদণ্ড কবি লিখছেন 'তার সব আফিম- কামাখ্যা দশা নিজেই খারিজ করে দিয়ে/ দুমড়ে মুচড়ে উঠে আসা সারা দেহে চূর্ণ-চূর্ণ অক্ষরসমেত, প্রবাদপৃষ্ঠার।' পরক্ষণেই লেখেন  'এতকাল পরে,/ আজ এই পরম জঙ্গম দিনে/ পুনর্বিবেচনা জোর দাবি হেঁকে হেলেদুলে আসে/ ওই নাঙ্গা  কালো কমলিলা।' কবি দেখতে পান একটি নতুন দিন। ' পেতে রাখা কম্বলের পর দু-চারটি টুপটাপ পিঠাফল' গাছ থেকে ঝরে পড়ে কবি ছন্দ চর্চায় নিজেকে কেমন করে বেঁধেছেন দেখুন পাঠক। এমন বাঁধনে মন সুন্দর হয়ে ওঠে। কবিতা এমন  শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে  যাকে  সামলানো যায় না  জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়তে  পারেন পাঠক:

 ঠায় ঝোলানো মুখটা যেন

খেজুরগাছে ভান্ড

ছাতিমগাছে দোদুল্যমান

কলাগাছের কান্ড

ক্রাউন আমরা সবাই দেখেছি অথচ কেমন স্থির চিত্রের সামনে আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেন কবি। এমন ভাবনার জগতে আমরাও যে  ক্লাউন, আমরাও যে ক্রমশ জড় বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েও আমাদের ভিতর আগুনকে আমরা ধরে রাখতে পারি কিন্তু তার প্রকাশ করতে পারিনা তা কবি দেখিয়ে দিয়েছেন

আগুন-কাঁখে আটটি দিকে/ উলঙ্গ জিপসি/ নগ্ন নর-নারী দেখে/ কাটল কি জিভ, ছিঃ! ক্লাউন কবিতার শেষ দুই লাইন কবি লিখছেন 'দেহভর্তি মাখামাখি রাত্রি এবং আগুন/ জড়বুদ্ধ সিদ্ধপুরুষ স্থিরচিত্রে ক্লাউন।'  যেন একই সঙ্গে শয়তান এবং ভগবান মাখামাখি হয়ে রয়েছে। ক্লাউন কবিতার আগের কবিতাটিই  'পাখিতীর্থদিনে' এমন কবিতা লিখতে পারলে যে কোন কবি নিজেকে ভাবতেই পারেন  তিনি একজন ভাষা ক্ষেত্রসমীক্ষক। প্রথম তিন লাইন পাঠককে অবশ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট 'আজ এই পাখিতীর্থদিনে, খোলা জানালাদিবসে/ নিদারুণ এ অশনবসনের ক্লেশ।/দাদা দুর্ভিক্ষের সামনে হা-দাঁড়ানো হতভম্ব মিকাইল।/ হাতে কাঁপতে-থাকা ভিক্ষামাপনযন্ত্র/ র্চেপড়া, অ্যানালগ; বুড়ি খসড়া, ক্যালিব্রেশনহীন।

প্রতিটি কবিতার ভাষা শব্দ তার ব্যবহারের পরিমিতিবোধ পুরো সংকলনটিকে অবশ্য পাঠ্য করে তুলেছে 'স্রোত' কবিতায় কবি সাধারণ দিনযাপনের চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি নিরীক্ষাধর্মী ভাবনাচিন্তা একই সঙ্গে ব্যবহার করেছেন

'মূর্ধা থেকে মূর্ধন্য-ণ লিখেই  তারপরেই কবি 'ণ' কে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার একটি ভঙ্গিমা এঁকেছেন যা তিনি আত্রাই পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তিনি জানেন 'আত্রাইয়ের পরেই লৌহ। লৌহ মানে লোহা।/ লোহা আর গঙ্গাফড়িঙের এর মিলিত গর্জনসমবায়/ কেউ-কেউ বলছে, গর্জনকাঠ নিরেট।দেখাই যাচ্ছে লেজ নেই।/মেধা আর মহিষের মধ্যে তৃতীয় কোন ধারণা নেই...' কবি সজোরে ধাক্কা দিলেন আমাদের ভাবনার গোড়ায়। লৌহ মানে লোহা আমরা সবাই জানি। অথচ কবি এত জোরের সঙ্গে আমাদের একবার নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন কবির উদ্দেশ্য। লৌহ মানে লোহা শুধু নয় একটা জায়মান ভাবনা। এই ভাবনা নিয়ে বসে থাকি আমরা।  বিচার বিশ্লেষণ করতে বসে ভাবি আসলে  আমাদের মেধা আর মহিষের মত কি অবস্থা হচ্ছে? আমরা নিরেট অথবা শুধু পেশী শক্তি আমাদের সামর্থ্য কবি দেখেছেন একমাত্র শক্তি উৎস হল স্রোত যেহেতু মাসুদ খান বাংলাদেশের কবি তাই তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের চিত্র  ফুটে উঠেছে। মাঠ ঘাট এসবের বর্ণনা এসেছে  স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু এই স্থির চিত্রগুলি গতানুগতিকভাবে আসেনি প্রতিটি চিত্রের ভিতর এমন এক একটি স্ট্রোক দিয়েছেন এমন কিছু শব্দের সমষ্টি তৈরি করেছেন এমন কিছু ফেডেড ছাপ রাখার চেষ্টা করেছেন যা আপনাকে কবিতার আপাত নিরীহ ভাব থেকে টেনে বের করে এনে মুক্তিযুদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে 'ধর্ম' কবিতায় কবি লিখছেন, 'রে গড্ডল, চকচকে কুকুর কৃকলাস,/ চারদিক থেকে ঝড় করে ছুটে এস সংখ্যহীন/ হুলুস্থুল পাহাড়ি বাদ্যকুহেলির মতো।' কবি সাধারণ ভাবনার গায়ে এমন এক একটি ভাবনাকে বসিয়ে দিচ্ছেন যা এতদিনকার প্রচলিত ভাবনা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে 'দেহের জটিল গ্রন্থি থেকে সব প্রলম্ব শিকড়, অস্থানিক।/ কাপ্তান হঠাৎ গুলি ছোড়ে আর হাঙরের মাথা গুঁড়া হয়ে যায়/...... পশ্চিমের নদী থেকে উড়ে আসে ভাঙাঝাঁক/ হর্ষবর্ধন যৌনকবুতর।'

আমরা কিংবদন্তি ভালোবাসি উপকথা ভালোবাসি, রূপকথা ভালোবাসি, ভালোবাসি ইতিহাস অথচ এইসব এর ভিতরেই আমাদের ভ্রান্ত ভাবনা আমাদের অনুসন্ধান পর্বের  মিথ্যে কৌশল ধরা পড়ে যায় 'কবরের উপকথা' কবিতায় স্পষ্ট  লিখছেন, 'মূর্খ মানুষ প্রত্নের লোভে কবরের দেশে যায়/ বাঁকা বসবাস, অনুসন্ধান, বক্র সমান্তর;/ ক্যালেন্ডারের ভস্ম ফলক ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যায়/ মূর্খ মানুষ, ওই নির্মাণ ভ্রান্তপ্রকৌশলে।'  ৬৮ পাতার এই কবিতার সংকলনে প্রকাশক লিখছেন, 'স্বাধীনতা-উত্তর সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারায়  অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের রূপবদল ঘটেছে। আশি থেকে নব্বইয়ের শেষ পর্যন্ত কবিতা ও কথা সাহিত্যে যে সব কাজ হয়েছে  সেই সমস্ত দুষ্প্রাপ্য লেখাগুলি কে নিয়ে পুনরায় প্রকাশ করার উদ্দেশ্য ছিল  বইগুলি যাতে পাঠকের কাছে পুনরায় পৌঁছে যায়। এই বইগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে যা যুদ্ধপরবর্তী উত্তাল বাংলাদেশের লেখালেখির মূলধারা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে কি থেকে নতুন পাঠ সংস্করণে মাসুদ খানের 'পাখিতীর্থদিনে' বইটি পুনঃ প্রকাশিত হয়েছে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিশির ভট্টাচার্য। ড়কির এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আশির দশক থেকে  থেকে নব্বই-এর এর প্রথম ভাগ জুড়ে টগবগে তারুণ্যের পাশাপাশি ধীর স্থির স্থিতধী গদ্যের বা নতুন কাব্যভাষার সন্ধান ও  চর্চা চলেছিল একদিকে প্রেমের ঝংকার অথবা শব্দের তীব্রতা আমাদের সামনে একটি চিত্র রূপ তুলে ধরছিল মাসুদ খানের কবিতায় সেই সময়ের উত্তেজনার ছোঁয়া রয়েছে। আছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ। অথচ ক্লান্তি বা একঘেয়েমির ছাপ পড়েনি কোথাও। কবির কবিতা আরো পরিণত হয়েছে 'সার্কারামা' কবিতায় কবি উত্তেজনার ছবি আঁকতে গিয়ে লিখছেন, 'আজ এক রুগ্ অগ্নিকুন্ডের কিনারে বসে আছি জবুথবু/ চারদিকে চলমান সার্কারামা/ ছবিগুলি খুব দ্রুত নাচতে নাচতে আসে আর যায়।' সেই কবি 'মানুষ' কবিতায় লিখছেন, 'তোমাদের ও বংশের কেউ নই আমি,/ না তস্কর কুলের কেউ/ শরীরে জেগেছে ঢেউ, নেউলগন্ধের।' 'পাখিতীর্থদিনে' কবিতা সংকলনটি পাঠক হিসেবে একটি পরম পাওয়া পশ্চিমবাংলায় কবিতার ভাব ও ভাষা নিরন্তর ইজম-এর বাঁধনে বাঁধা পড়েছে  অথচ বাংলাদেশে সেই একই কবিতার ভাষায় কোনও তথাকথিত বিপ্লববাদ বা ইজমের ছোঁয়া নেই, শুধু আছে একজন  ক্ষেত্রসমীক্ষকের চোখে শব্দের ও ভাষার ও ভাবের কমেন্টারি। এক একটি কবিতা যেন এক একটি বর্শা। ৬৮ পাতার পেপারব্যাক বাঁধাই-এর ৩০০টাকা মূল্যের এই কবিতার বইখানি একইসঙ্গে বারুদ এবং ফুল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবি লিখছেন, 'অরেঞ্জ নদীর তীরে নামল রাঙা প্রমিথিউস/ মৃত্তিকাস্তর কাঁপল মৃদু-মৃদু/ অরেঞ্জ নদীর তীরে/ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত রঞ্জিত সব মানুষ।' উত্তাল সময়কে পেরিয়ে নিজের ভিতরের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে প্রকৃত ক্ষেত্রসমীক্ষকের মত কবি শব্দকে খুঁজে খুঁজে বের করে তাকে নতুন রূপ দিয়ে পাতার পর পাতা ছবি এঁকেরেখেছেন পাখিতীর্থদিনে কবিতা সংকলনে।

পাখিতীর্থদিনে

মাসুদ খান

উড়কি নতুনপাঠ

মূল্য ৩০০ টাকা

প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য

উড়কি সংস্করণ প্রচ্ছদ-মোস্তাফিজ কারিগর

   


অলংকরণঃ তাইফ আদনান