গল্পের আখ্যান কেমন হবে তা নিয়ে নানা মুণির নানা মত। নানা ফোঁস ফোঁস, নানা ছোবল। নানা মতকে সম্মান জানিয়ে সম্মান জানাতে চাই তারাশঙ্করের নাগিনীদের৷ ১২৫ তম জন্মদিনে তার নাগিনীদের কথা দিয়ে স্মরণ করছি মহান এই লেখককে কারণ এতটা পথ পেরিয়ে এসেও তারাশঙ্করের নাগিনীদের নীল বিষের ভাণ্ডার অফুরন্ত। আমরা দেখেছি তার লেখায় বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তার লেখার সবচেয়ে বড় গুন। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা।
আমি তারাশঙ্করকে প্রথম চিনি তার বেদেনী গল্প দিয়ে তারপর তার উপন্যাসের ভেতর ঢুকে পড়ি গল্পের লোভে সিঁদকাটা চোরের মতো। ভাগ্য সবসময় প্রসন্ন না থাকলেও তারাশঙ্করে প্রবেশ করে প্রশান্তি পেয়েছিলাম। এটি কোন ধরাবাঁধা লেখা নয়৷ শুধু একান্ত আমার চোখে তার নাগিনীদের ফিরে দেখা৷
তাহলে একটা গল্প বলি। কিভাবে তারাশঙ্কর গল্পের জগতে এলেন। যারা তার আত্মজীবনী পড়বেন বা তার কাছের লোকদের কাছে লেখক সম্পর্কে জানতে চাইবেন তখনই এই কথা গুলো শুনতে পাবেন। আমার শোনার কাহিনি কিন্তু এসব সুত্র ধরেই। একদিন তারাশঙ্কর কমলিনী বোষ্টমীকে দেখলেন বীরভূমের রুক্ষপ্রকৃতির মধ্যে - মাথায় রাখালচূড়া, নাকে রসকলি, গলায় তুলসী কাঠের মালা দিয়ে আত্ম ভঙিতে হেঁটে যেতে। বৈষ্ণবীর মিষ্টি হাসির প্রশংসা করলে সে বলত বৈষ্ণবীর ঐ-টিতো সম্বল প্রভু। সাধন সঙ্গীহীন একাকী এই বৈষ্ণবীটিকেই নিয়ে তারাশঙ্কর রচনা করলেন তার রসকলি কাহিনিটি। এবং এই কাহিনি দিয়েই তারাশঙ্কর সাহিত্য মহলে প্রবেশের পাকাপোক্ত সুত্রপাত ঘটালেন।
এই ফাঁকে আরেকটি গল্প বলি, গল্পে গল্পে গল্প বাড়ে গল্পপ্রসংগে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন এসে পড়লেন। হুমায়ূন আহমেদকে যখনই পড়ি নতুন মনে হয়, মজার অদ্ভুত মানুষ ছিলেন, প্রভাবিত হয়েছিলেন ক্লাসিক সাহিত্য দ্বারা । তারই উদাহরণ নিজের মেয়েদের নামকরণ, যা তিনি তার লীলাবতীর মৃত্যু বইতে উল্লেখ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন নোভা। নামটি এসেছিল আমেরিকার টিভিতে ' কসমস ' নামক একটি অনুষ্ঠানের আলাপ থেকে, যেখানে প্রায় নোভা এবং সুপার নোভা নিয়ে নানান কথা থাকত। অনুষ্ঠানটি করতেন কার্ল সেগান। দ্বিতীয় মেয়ে শীলার নাম নিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ' শৈলজ শীলা ' থেকে এবং সবচেয়ে ছোট মেয়ের বিপাশা নাম নিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' বিপাশা ' উপন্যাস থেকে। একটা গল্পের নাম একজন মানুষকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তারই একটা উদাহরণ টানলাম।
তারাশঙ্কর কবিতা, নাটক দিয়ে শুরু করলেও গল্প তাকে খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছে দেয়। যেন তিনি দুধ কলা দিয়ে পুষছেন তার নাগিনীদের। তাদের গমন ৫৩ টি গল্পের বইয়ের ভেতর। শুরুতে প্রত্যাখ্যান হয়েছে তার লেখা কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চালিয়ে গেছেন সাহিত্য চর্চা৷ তারাশঙ্কর তার বই প্রকাশ হলেই রবীন্দ্রনাথকে পাঠাতেন। রবীন্দ্রনাথ বই পড়ে তার ভালো লাগা মন্দ লাগা জানাতেন। একদিন তারাশঙ্কর রবীন্দ্রনাথের সাথে শান্তিনিকেতনের পুনশ্চের বাড়িতে বসে আছেন। এমন সময় আকাশে চিলের ডাকে আনমনা হয়ে গুরুদেব তারাশঙ্করকে বললেন তোমার ডাইনীর বাশিঁ গল্পটি মনে পড়ে গেল দারুণ লিখেছ।
নীতিবাদী ধ্যান ধারণা সরিয়ে লেখায় মানুষের বৃহৎ জীবন ধরার জন্য কোন কোন সাহিত্য সমালোচক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে টলস্তয়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে অথবা বাংলার টলস্তয় ও বলা যেতে পারে বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন রজনীকান্ত দাস ও বুদ্ধদেব বসুর মতো লেখকদের কাছ থেকে। তবে তিনি দমে যাননি। জানতেন তার লেখা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে৷ তারাশঙ্করের লেখা শুধু তাকে নয় আমাদেরও নিয়ে যাচ্ছে তার গল্পের ভেতর দিয়ে অজানা মানুষের জগতে।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন