উনিশ শতকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলে যে নবজাগরণের প্রভাতসূর্য ক্রমশ: দেদীপ্যমান হয়ে উঠছিল, সেই সময় বা তারও আগে কলকাতায় ঐতিহ্যে, ধনসম্পদে উল্লেখযোগ্য পরিবার বর্তমান ছিল বটে। তবে একটি জায়গায় টেক্কা দিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি। চিত্তানন্দের নানা বৈভববিচ্ছুরণে। সাহিত্য সংস্কৃতির কষ্টিপাথরে নিরিখ করলে ঠাকুরবাড়ির বহু বর্ণিল উদ্ভাস অন্যান্য ধনাঢ্য বনেদি পরিবারের নারীরা কোনোক্রমেই অতিক্রম করতে পারেন নাই। যে বাড়ির আলো হাওয়ায় জোছনায় খরায় বর্ষায়, শাসনে আদরে রবিঠাকুর বেড়ে উঠেছিলেন, সেই প্রদীপটিকে ঘিরে নানা বর্ণের সলতে পাকিয়েছিলেন তাঁর অন্দরের নারীরা। তাঁদের ভুলে যাবার কোন জো নেই।
সেই সময়ের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের কয়েকজনের কিছু কথা লিখতে আগ্রহী হলাম। শুরু করা যাক রামলোচন ও তাঁর দৃঢ়চেতা স্ত্রীর প্রসঙ্গ নিয়ে। দ্বারকানাথের পিতা রামলোচন তাঁর মাত্র বারো বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় থেকেই অলকাসুন্দরী সংসারের হাল ধরেন দীপ্ত মনোবল নিয়ে। ধর্মকর্মে ছিলেন নিষ্ঠাবতী। সেই সময়ে মৃত্যু আসন্ন মনে হলে মৃত্যুপথযাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হতো গঙ্গাযাত্রায়। কিন্তু অলকাসুন্দরী মৃত্যুর আগমুহূর্তেও ছিলেন তেজদীপ্ত। তিনি গঙ্গায় অর্ন্তজলি যাত্রায় অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে তাঁর ইচ্ছায় কেউ কর্ণপাত করেনি। এমনকি আঠারো বছর বয়সের পৌত্র দেবেন্দ্রনাথও নিশ্চুপ ছিলেন। অলকাসুন্দরী বলেছিলেন, ‘যদি দ্বারকানাথ বাড়ি থাকিত, তবে তোরা কখনই আমাকে লইয়া যাইতে পারতিস না।’ আরো কিছুদিন পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে থাকার তীব্র সন্তাপ নিয়ে তাঁকে ‘যুগধর্ম’ মেনে নিতে হয়েছিল! দ্বারকানাথের দিদি রাসবিলাসীও ভক্তিমতী ছিলেন। একপর্যায়ে রাসবিলাসীর কঠিন সিদ্ধান্তে বাড়িতে রক্তপাতের বদলে কালীপূজায় ফল বলি হতো। কেননা রাসবিলাসী দৃঢ় পণ ব্যক্ত করেছিলেন, ‘যে ভিটেয় রক্তপাত হবে সেখানে তিনি থাকবেন না।’ তিনিও গঙ্গাযাত্রা করেছিলেন এবং চার পাঁচদিন গঙ্গাতীরে বাস করে ইহলীলা সাঙ্গ করেন।
প্রিন্স দ্বারকানাথের বিয়ে হয় ছয় বছর বয়সের দিগম্বরীর সাথে। ধর্মপত্নী ঠাকুরবাড়িতে পদার্পণ করতেই যেন এই পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগলো। দিগম্বরী রূপের খ্যাতি প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় নাকি তাঁর পদযুগল থেকে অপূর্ব জ্যোতি দেখা যাচ্ছিল। দিগম্বরী কেবল রূপসী ছিলেন না, ছিলেন তেজস্বিনীও। শাশুড়ি অলকাসুন্দরীও এই অসামান্য বধূটিকে খানিক সমীহই করতেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই মূলত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিল্পরুচি বিকশিত হতে থাকে।
এর আগে গঙ্গাযাত্রা ছিল। ছিল মনুর বিধান মেনে চলার নানাবিধ গোঁড়ামি। অন্দরমহলে পরপুরুষের অবাধ যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরা বাইরে বেরুতেন ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে চেপে। বেহারার দলের বাহার ছিল মন্দ নয়। তাদের হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লাল রঙের হাত-কাটা মেরজাই। সঙ্গে সঙ্গে ছুটত দারোয়ান, তাদের হাতে লাঠি। ভেতরে গরমে ঘামে সেদ্ধ ঠাকুরবাড়ির সুন্দরী! কখনও গঙ্গাস্নানে যেতে হলেও সেই পালকি। পালকি সমেত জলে চুবিয়ে আনা হতো তাঁদের। এটাই ছিল সেকালের রেওয়াজ। আত্মীয় কুটুম্বের কোনো উৎসবে যেতে হলেও পালকিতে চেপে একেবারে উঠানে। ক্রমে এই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা জাগ্রত হতে থাকলেন, মনে প্রাণে। সমাজের জলন্ত চক্ষুর পরোয়া না করে।
প্রিন্স দ্বারাকানাথে ধর্মপত্নীর কথা হচ্ছিল। দিগম্বরী ডুবে থাকতেন জপতপ ঠাকুরসেবা ইত্যাদি কর্মসম্পাদনে। এরমধ্যে ব্যবসায়িক সাফল্যে দ্বারকানাথ ঝুঁকে পড়লেন নানারকম বিলাসিতায়। সেকালের বিলাসী বাবুয়ানা গ্রাস করলো তাঁকে। তাঁর বেলগাছিয়ার বাড়িটিতে ছিল নানাবিধ প্রমোদের আয়োজন। ১৮২৩ সালে বেলগাছিয়ার বাড়িটি তৈরি হয়, তাঁর বিশেষ শিল্পরুচির আদলে। তিনি তখন গবর্ণমেন্টের দেওয়ান, পরে আরো উন্নতির শিখরে অবস্থান করেন।
তখন বড় পুত্র দেবেন্দ্রনাথের সদ্য বিয়ে হয়েছে। দিগম্বরী ভরা সংসারে জপতপ নিয়ে সদা ব্যস্ত।
শাকম্ভরী ছয় বছর বয়সে বধূ হয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। নাম পাল্টানো হলো। হয়ে গেলেন সারদাসুন্দরী। সে যাই হোক, ওদিকে ঘটে চলেছে বিপর্যয়। দিগম্বরীর কানে এলো, তাঁর স্বামীর ভোজসভায় মদের জোয়ার। সাহেব মেমদের সাথে নানা আমোদে মেতে থাকেন তিনি। শোকাহত কর্ণকুহরে লোকের মুখের ছড়ার গান শুনতে পান, ‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরিকাঁটার ঝনঝনি, খানা খাওয়ার কত মজা আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানি।’ মন ভেঙে চুরমার। তেজদীপ্ত দিগম্বরী স্বয়ং স্বচক্ষে সত্য সন্ধানে উপস্থিত হলেন অতর্কিতে ম্লেচ্ছ ভোজসভায়। পতিব্রতা দিগম্বরী মোহাচ্ছন্ন স্বামীকে ফেরাবার জন্যে অনেক চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সকলি গরলি ভেল! অতঃপর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, স্বামীকে ত্যাগ করে কুল ধর্ম বজায় রাখবেন, না স্বামীর সহধর্মিনী হয়ে কুলধর্ম ত্যাগ করবেন? পণ্ডিতেরা মতামত জানালেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাহার সেবা করা অবশ্য কর্তব্য। তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি অকর্তব্য।’ কী অভিনব রায়! দিগম্বরী দেবী অতঃপর স্বামীর শয্যার কাছে গিয়ে মাটিতে প্রণাম রেখে আসতেন। কোনো বৈষয়িক বিষয়ে প্রয়োজন পড়লে কথা বলতে বাধ্য হতেন। তিনি তারপরই সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করে নিজেকে শুদ্ধ করতেন। কিছুদিন পর প্রবল জ্বরে ভুগে পরলোক গমন করেন। দ্বারকানাথ একসময় হাহাকার করেন বটে ‘লক্ষ্মী চলিয়া গেলে অলক্ষ্মীকে আটকাইবে কে? ’
এরপরে পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। ঋষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সরলাদেবী ছিলেন স্নিগ্ধশ্রী সহজ সরল গৃহিনী। স্বামীকে ঘিরেই ছিলো তাঁর ভাবনা আর কর্মকাণ্ড। জ্ঞানন্দানন্দিনীর ‘পুরাতনী কথা’য় পাওয়া যায় কিছু তথ্য যে সারদাদেবী বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না। একখানি তক্তপোশের ওপর বসে থাকতেন। দাসীরা ছেলের বৌদের রূপটান মাখাতেন। সেখানে বসেই অন্দরের কলহ বিবাদের বিচার আচার করতেন। তিনি হয়তো মধ্যবয়সে ঈষৎ পৃথুলা হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ের বাবুদের মতো ধনাঢ্য পরিবারের বিবিরাও মোটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আয়েস করে বসতেন। শুধু দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি এলে তিনি রান্নায় মনোযোগী হয়ে উঠতেন। স্বামীর সঙ্গে দেখা হতো রাত বাড়লে। একটা ধোয়া সুতি শাড়ি আর একটু আতর মাখানো এই ছিল তাঁর সাজসজ্জা। অথচ ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বধূরা রূপসজ্জায় নিপুণ ছিলেন। আলতা রাঙা দুখানি পা, আতর মাখানো বসন, সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর, ফুলের গোড়ে মালাটি গলায় পরে তবে ঘরে ঢুকতেন। অবনঠাকুরের লেখা থেকে এরকম বর্ণনা পাওয়া যায়। সারদাসুন্দরীর বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় না। চৌদ্দটি সন্তানের জননী তিনি। প্রতিটি সন্তানই এক একটি নক্ষত্র। সন্তানদের জ্ঞানগরিমার কথা অনেকেই তাঁকে বলতেন, প্রশংসায় ভরিয়ে তুলতেন। তিনি নতমুখে শুধু শুনতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’য় উল্লেখ আছে সারদাসুন্দরী ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তাস খেলতেন অবসরে। হয়তো সেই সময়ের বনেদি ঘরের বিবিরা দাস দাসী, দুধমায়ের তদারকিতে শিশুদের লালন পালনের ভার অনেকটাই ন্যস্ত করতেন। রবীন্দ্রনাথ ব্রজেশ্বরের খবরদারিতে প্রাতঃরাশ খাবারের বর্ণনা ‘আমার ছেলেবেলায়’- উল্লেখ করেছেন।
গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগামায়ার প্রসঙ্গে অনেক গুণপনার কথা জানা যায়। তাঁর মধ্যে প্রবল সনাতন ধর্মনিষ্ঠা ছিল। মাইনে করা বৈষ্ণবী বাড়িতে এসে পড়াতেন ‘শিশুবোধক’, ‘চানক্যশ্লোক’, রামায়ণ মহাভারত। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য নারীরাও লেখাপড়া জানতেন। প্রচলিত কুসংস্কার ছিল নারীরা বিদ্যাশিক্ষা করলে অকাল বৈধব্য নিশ্চিত। ঠাকুরবাড়িতে এ ছিল ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। বই ফেরি করতো মালিনীরা। তারা আসত বটতলার ছাপা বইয়ের ডালি নিয়ে। নরনারী, লাইলী মজনু, হাতেমতাই, আরব্যরজনী ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে। আরো থাকত অন্নদামঙ্গল, গোলেবকাওলি মানভঞ্জন, বস্ত্রহরণ, গীতাগোবিন্দ ইত্যাদি পুস্তক। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি ছিলেন, ‘একপ্রকার আমাদের শিক্ষয়িত্রী।’ যোগমায়ার যে চিত্রটি আমরা পাই, সে চিত্রটিও সুন্দর। ‘পুরাতনী কথা’য় পাওয়া যায় যোগমায়া দেবীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে পদ্মফুলের সুবাস ছড়াত। তাঁর ঘরে জমজমাট আসর বসতো। সত্যেন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায়, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বধূরা বাংলা ভালোই জানতেন। কিছুদিন পর বৈষ্ণবীর জায়গায় এলো ইংরেজ শিক্ষয়িত্রী। মিস গোমেস্ এঁদের একজন।
রবীন্দ্রনাথের বোন-সৌদামিনীর মূল দায়িত্ব ছিল অন্দরের সব দায়-দায়িত্ব পালনের। বোনেরা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় নিখুঁত করে সযত্নে কেশবিন্যাস তিনিই করতেন। উৎসবে আনন্দে সুশোভন আলপনা আঁকতেন সৌদামিনী। মহর্ষির জন্য যত্ন করে রান্না করা এবং পরিবেশন করতে তাঁর জুড়ি ছিল না কেউ। তিনি কয়েকটি ব্রহ্ম সংগীত এবং ‘পিতৃ-স্মৃতি’র রচয়িতা। তিনি বেথুন স্কুলে পড়তে যান। ঈশ্বরগুপ্ত লিখলেন, ‘যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। তখন এ.বি শিখে বিবি সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে।’ সেই সময় নিন্দুকেরা নানা কটূক্তিও করত। ‘স্বাধীন জেনানা’, ‘বৌবাবু’, ‘পাশকরা মাগ’, ‘শ্রীযুক্ত বৌ বিবি’, ‘হুড়কো বৌয়ের বিষমজ্বালা’, ‘কলির বৌ হাড়-জ্বালানী’, প্রায় পঞ্চাশ বছর লাগাতার এইসব নিন্দামন্দ লেখা হয়েছে।
বাড়ির খোলা ছাদে মেয়েদের বেড়ানোর বেলায়ও আপত্তি ছিল। অবশ্য তাঁরা কেবল দুর্গোৎসবে প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্যে তেতলার ছাদে উঠতেন, বছরে একটি দিন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হয়েও নিষ্ঠার সঙ্গে সনাতন হিন্দু ধর্মের বহু সংস্কার মেনে চলতেন। বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা তাঁর বিশেষ সম্মতি পায়নি।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় দেবেন্দ্রনাথ চার আনার বেশি দামের খাদ্য আহার করতেন না। যেখানে তাঁর পিতা ডিনার করতেন তিনশ টাকার। মহর্ষি সামান্যতম ঋণকেও অপছন্দ করতেন। অতিরিক্ত গাড়ি, ঘোড়া বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কেবল মেয়েদের জন্যে একটি পালকি ছিল। তবে তিনি আগাগোড়াই মেয়েদের সম্মানের চোখে দেখতেন।
সৌদামিনীর বোন স্বর্ণকুমারী ছিলেন দীপ্তিমান নারী। দৃষ্টান্তস্বরূপ! বাংলা সাহিত্যের সার্থক লেখিকা। তিনি লিখলেন ‘দীপনির্বাণ’, ১৮৭৬ সালে একটি উপন্যাস। যা বোদ্ধা পাঠকের প্রশংসা লাভ করে। শৈশবেই তিনি পেয়েছিলেন মহর্ষির পরম আশীর্বাদ, ‘স্বর্ণ তোমার লেখনীতে পুষ্পবৃষ্টি হউক।’ তখন বাড়ির অন্য মেয়েরা-সৌদামিনী, শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী, প্রফুল্লময়ী, সর্বসুন্দরী, কাদম্বরী মেয়েলি আড্ডায় মেতে থাকতেন। শরৎকুমারী রূপটান মেখে চৌবাচ্চার জলে মহানন্দে সময় কাটাতেন। কৌতূহলী বাইরের লোকজন তাঁর স্বামী সুরসিক যদুনাথকে জিজ্ঞেস করতো, ‘ঠাকুরবাড়ির মানুষগুলো এতো রূপ লাবণ্য পায় কিভাবে? ’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দুধে আর মদে’। লোকমুখে রটনা ছিল, ঠাকুরবাড়ির সদ্যোজাত শিশুকে জন্মের পরেই দুধ আর মদ দিয়ে স্নান করানো হতো। শরৎকুমারী ছিলেন রন্ধন শিল্পের রানি। স্বর্ণকুমারীর সাহিত্যকীর্তিতে ফিরে আসা যাক। তিনি রচনা করেন ‘বসন্ত উৎসব’ অপেরাধর্মী গীতিনাট্য। ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া আসরে গীতিনাট্যটি অভিনীত হতো। এরপর স্রোতের মতো প্রবহমান ছিল তাঁর লেখার ধারা। তাঁর ঐতিহাসিক রচনা দীপনির্বাণ, মিবাররাজ, বিদ্রোহ, ফুলের মালা, হুগলির ইমামবাড়া ইত্যাদি। স্বর্ণকুমারী বিধবা ও নারী কল্যাণমূলক কাজ করবার মানসে ‘সখিসমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্ঞানদানন্দিনীর স্বামী প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস অফিসার। স্ত্রীর প্রগতিশীল কাজের নেপথ্যে তাঁর ছিল অকুণ্ঠ সহযোগিতা। মেজো বৌ মাত্র ৭ বছর বয়সে ঠাকুরবাড়িতে আসেন। তাঁর পিতা কন্যাকে গৌরীদান করেন। পায়ে গুজরি পঞ্চম, মাথায় বড় করে টানা ঘোমটা। তবে অচিরেই এসব বালাই দূর করে তিনি প্রগতিশীল মুক্তমনের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে মহর্ষি-পত্নী এক পর্যায়ে কথা বন্ধ করে দেন। জ্ঞানদা দেবরের কাছে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য পর্যন্ত পাঠ করেছিলেন। তিনিই প্রথম পালকি চেপে বোম্বাইগামী জাহাজে উঠেছিলেন। বাড়ির পুরানো চাকরদের চোখে চিরায়ত নিয়ম ভাঙার দুরূহ কষ্টে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। দুই বছর বোম্বাই কাটিয়ে নতুন বেশবাসে ফিরে আসেন। জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত যাত্রাও করেন একাকী, সন্তানদের সাথে নিয়ে! একসময় স্বামীর কর্মস্তলেও যান তিনি। এটিও তখনকার প্রথা বিরুদ্ধ। বোম্বাই থেকে আনা শাড়ি পরার ধরনকে বলা হতো বোম্বাই দস্তুর। কিন্তু বাংলাদেশ এর নাম ঠাকুরবাড়ির শাড়ি। তবে এর নেপথ্যে একটু কাহিনি আছে। বর্তমান আধুনিকারা যে ঢঙটি সানন্দে গ্রহণ করেছেন, সেটি সরাসরি জ্ঞানদার আবিষ্কার বলা যায় না। বোম্বাই দস্তুরে যেসব অসুবিধা ছিল, সেগুলো দূর করেন কুচবিহারের মহারানি কেশব কন্যা সুনীতি দেবী। তিনি আঁচলে ব্রোচ আটকাবার কায়দাটি রপ্ত করেন। তাঁরই বোন ময়ূরভঞ্জের মহারানি সূচারু দেবী দিল্লির দরবারে প্রায় আধুনিক শাড়ি পরার ঢঙটি চালু করেন। শাড়ির সঙ্গে এলো লেস দেওয়া জ্যাকেট ও ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যমতে, ‘নেটের টুকরো আর খেলো লেস বসিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হতো।’ জ্ঞানদা আরও দুইটি প্রথা চালু করলেন। সান্ধ্যভ্রমণ ও জন্মদিন পালন। বিলেত থেকে এই দুটি কেতা এনেছিলেন ঠাকুরাবড়িতে। জ্ঞানদার উৎসাহেই প্রথম রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত হয়। তিনি সেবা শুশ্রƒষায় ছিলেন পয়লা নম্বরে। একপর্যায়ের আলাদা বাড়িতে উঠে গেলেও জোড়াসাঁকোর সঙ্গে বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। মৃনালিনীর পাঁচটি সন্তানের জন্মের সময় জ্ঞানদাই দেখভাল করেছেন। প্রফুল্লময়ী এমনকি অবনঠাকুরকে ছবি আঁকার উৎসাহ তিনি দিতেন। আরো বহু গুণের কারণে ও নিরলস কর্মকাণ্ডের জন্যে বধূ জ্ঞানদা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনিই ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে শাশুড়ি, জা, ননদ ও বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের ফটো তুলিয়েছিলেন। তাঁর বদৌলতে আজ আমরা তাঁদের মুখাবয়ব সাজসজ্জা দেখে ধন্য হই। কালের সাক্ষী, সেইসব বনেদিবাড়ির গুণী নারীসকল।
পিছনের দিকে আর একবার একটু ফিরতে হয় স্বর্ণকুমারী প্রসঙ্গে। উপন্যাস অনুবাদের কাজে তিনি উৎসাহী ছিলেন। তাঁর দুটি উপন্যাস, ১৪টি গল্প, একটি নাটক অনূদিত হয় ইংরেজিতে। তবে এই কাজে রবীন্দ্রনাথের সায় ছিল না। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দমবার পাত্র নন। একসময় ‘ভারতী’ পত্রিকার দায়ভার তাঁর উপর বর্তায়। শিশুসাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে তাঁর রচনা প্রশংসিত হয়। স্বামীর সঙ্গে তিনি কংগ্রেসের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘জগত্তারিনী’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।
হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীর বিষয়ে কিছু কথা লিখতেই হবে। এগারো সন্তানের জননী স্বামীর উৎসাহে গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন, নানা ভাষার নানা রকম অনূদিত গ্রন্থ পাঠ করতেন। দেশি-বিদেশি রান্নাও করতেন। এমনকি ঠাকুরবাড়ির নববধূদের আদর কেতা ইত্যাদি হাতে ধরে শেখাতেন। অদম্য শিল্পস্পৃহায় তিনি বাঁয়া-তবলা ও করতাল বাজাতেও শিখিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রের স্মৃতিকথায় জানা যায় নীপময়ী প্যারাডাইস লস্ট (মিল্টন), সংস্কৃত অভিজ্ঞান শকুন্তলম পড়তেন। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তিনি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন।
নীপময়ীর বোন প্রফুল্লময়ী বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রীরূপে ঠাকুর বাড়িতে আবির্ভূত হলেন। বনেদিআনার এক ঝলক চিত্র দেওয়া যেতে পারে। ফাগুনের অপরূপ অপরাহ্নে প্রফুল্লময়ী এলেন। যৌতুক পেলেন গা-ভরা গহনা। চিক, ঝিলদানা মরাল গ্রীবায়। হাতভরা চুড়ি, বালা, বাজুবন্দের রিনিঝিনি। কানজুড়ে মুক্তার গোচ্ছা, বীরবৌলি, কানবালা। জড়োয়া সিঁথি পাটি। পায়ে গোড়ে, পায়জোড়, মল, চালনা, চুটকি। সুডৌল কোমরজুড়ে দশ ভরির গোট। বালিকা বধূ গহনার ভারে কুপোকাত? দুই পল্লবঘন চোখে নতুন স্বপ্ন। প্রফুল্ল সংগীতচর্চায় নিবেদিত হলেন। দিন যায়। কিন্তু তাঁর মন জুড়ে বিষণ্ণতা। স্বামী বীরেন্দ্রনাথ উন্মাদ হয়ে গেলেন। ঘরের চার দেয়ালে বড় বড় অঙ্ক কষতেন, কাঠকয়লা দিয়ে। তাঁকে এক চামচ ভাত বা একটি পোড়া পটল খাওয়ানো যেত না। নাজেহাল হয়ে যেতেন প্রফুল্ল। শুশ্রুষা চলছিল। এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে আরেক অশনি সংকেত। মেধাবী পুত্র বলেন্দ্র জ্বরবিকারে এবং পুত্রবধূ সুশীতলা পরপারে চলে গেলে প্রফুল্ল ডুবে যান এক বিষাদ সাগরে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভুত হলেন জয় করলেন এবং অসময়ে চারদিকে ঝড় তুলে চলে গেলেন পরপারে। তাঁকে ঘিরে আজও এন্তার গবেষণা লেখালেখি চলছে। রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কলকাতায় বাস করতেন। তাঁর পিতা শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়। জগন্মোহনের পৌত্রী কাদম্বরী। ঠাকুরদাদা তাঁর দুই পুত্রসহ দ্বারকানাথের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। তাঁর কর্মটি ছিল বনেদি এই বাড়ির সন্দেশ পরীক্ষকের দায়ভার। কোনটি বাসি সন্দেশ কোনটি টাটকা তা তিনি চোখে দেখেই বলতে পারতেন। ঠাকুরবাড়ির বধূরা আসতেন কুলরক্ষার নিরিখে। সেই বিচারে কাদম্বরী এলেন। আট বছরের বালিকা মাতঙ্গিনী। নামটি বদলে হয়ে কাদম্বরী। বিস্ময়কর ব্যাপারটি হলো নিতান্ত বালিকা অনামী ঘরের বালিকারা ঠাকুরবাড়ির ধ্যানধারণার পরশস্পর্শে ক্রমে বিকশিত হয়ে উঠতেন। নারী জাগরণের, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণরসে জারিত হয়ে ক্রমে তাঁরাও হয়ে উঠেছিলেন স্মরণীয় বরণীয়। মাতৃহারা বালক রবি নতুন বৌঠানের সান্নিধ্যে মমতাময়ীর দর্শন পেলেন। ক্রমে শিল্প সাহিত্য সৌন্দর্য ভাবনার দোসর হয়ে উঠলেন নতুন বৌঠান। মানসিক নৈকট্য, প্রগাঢ় বন্ধুত্বে সমৃদ্ধ হলেন দুজনেই। একথা অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথের মর্মসহচরী নতুন বৌঠান কবির মনোলোকে এক পোক্ত আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শেষ বয়সে কৌতুক করে কবি বলেছেন, ‘ভাগ্যিস নতুন বৌঠান মারা গিয়েছিলেন-তাই আজও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখছি বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা হতো।’
কাদম্বরী প্রতিদিন প্রায় স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠের হাওয়া খেতেন। কাদম্বরী সেই সময়ে মেয়েদের মনে জাগ্রত করেছিলেন দুঃসাহসের মঙ্গলবারতা। অন্যদিকে গৃহস্থালি কাজেও ছিল নিপুণ দক্ষতা ও প্রবণতা। সুপুরি কাটতেন খুব মিহি করে প্রতিদিন। এমনকি প্রতিদিনের তরকারি বানানোর জমজমাট আসরে তাঁর ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। বাড়ির শিশুদের অসুস্থতায় শুশ্রুষায় তিনিই ছিলেন আশ্রয়। রবির সান্নিধ্যে তিনি পড়তেন দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’। কোনো কোনো দুপুরে রবিও তাঁকে পাঠ করে শোনাতেন। হাতপাখা নেড়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। ‘ভারতী’ পত্রিকার পৃ‘পোষকতায়ও তাঁর অবদান ছিল।
নন্দন কানন গড়ে উঠেছিল তেতলার ছাদে। নেপথ্যে সহযোগিতা করেছিলেন নতুন বৌঠান। পত্রপুষ্পে শোভিত শিল্পের এক মনোরম উদ্যান। নিয়মিত সাহিত্য আসর বসতো। গুণীজন অনেকেই আসতেন। নিয়মিত ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী। কাদম্বরী বিহারীলালের কবিতার ভক্ত ছিলেন। কবিকে মাঝে মধ্যে নিমন্ত্রণ করে সযত্নে আপ্যায়ন করতেন। কাদম্বরী একটি সুদৃশ্য আসন বুনে কবিকে উপহার দিয়েছিলেন। আসনে লেখা ছিল সারদা মঙ্গলের কয়েকটি লাইন। ছাদ বাগানে বসতো গানের আসরও। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রুপার রেকাবিতে ভিজে রুমালের ওপর বেলফুলের গোড়ে মালা। গ্লাসে বরফ জল। বাটা ভর্তি সাঁচি পান সাজানো থাকত। কাদম্বরী স্নান সেরে চুল বেঁধে আসতেন। জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবি দরাজ গলায় গাইতেন। সূর্যের শেষ লালিমাটুকু মুছে গেলে এই অসামান্য আসর শেষ হতো। কাদম্বরী রবিকে খেপিয়ে তুলতেন ‘কোনো কালে বিহারীলালের মতো লিখতে পারবে না।’ এসবই ছিল ছল! রবিকে উত্তরণের শিখরে পৌঁছে দেবার বাসনা। কাদম্বরী সুঅভিনেত্রী ছিলেন, তিনি সুকণ্ঠীও ছিলেন। স্বামী উজ্জীবিত হয়েছিলেন স্ত্রীর নাট্যাভিনয়ের কুশলতায়। এঁরা সমবয়সী। বৌঠান রবির এক বছরের বড় মাত্র!
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। এর আগেও একবার আত্মহননের চেষ্টা করেছিলেন। বাড়িতে আসত তাঁতিনী বিশ্বেশ্বরী। তাকে দিয়ে গোপনে আফিম আনিয়ে খেয়ে জীবনের সব বন্ধন ছিন্ন করে অজানা অভিমানে তিনি পরলোকে চলে যান। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন, ‘জ্যেতিকাকা মশাই প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তাঁর প্রধান আড্ডা ছিল বির্জিতলাওয়ে আমাদের বাড়িতে। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে ওঁর খুব ভাব ছিল।’ আবার বর্ণকুমারী বলেছিলেন অমল হোমকে জ্যোতিদাদার জোব্বার পকেট থেকে কাদম্বরী পেয়েছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী মতান্তরে নটী বিনোদিনীর কয়েকটি চিঠি। মৃত্যুর আগে কাদম্বরী লিখে গিয়েছিলেন যে, ঐ চিঠিগুলোই তাঁর আত্মহননের কারণ। মহর্ষির নির্দেশে সেইসব আলামত দ্রুত বিনষ্ট করে ফেলা হয়। সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলির মুখ বন্ধ করা হয় বিশেষ কৌশলে। সুতরাং জল্পনা কল্পনা গবেষণা ভেসে বেড়ায় বাতাসে।
মূলত নিঃসন্তান কাদম্বরী ছিলেন নিঃসঙ্গ। তারপর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞাননানন্দিনীর আধুনিক পরিবেশের আনন্দ আয়োজনে বিমুগ্ধ। সেখানেই চুম্বক আকর্ষণে প্রায়শ যেতেন। অনেক সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরতেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য বিবাহিত। সব মিলিয়ে নিঃসঙ্গ কাদম্বরী। যদিও এরই মধ্যে স্বামীসেবা গৃহ পরিচর্যা, সাহিত্যচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত করে রাখতে চেষ্টা করেছেন। অভিমান, মনস্তাপ অবচেতন মনেও বাসা বাঁধে। এ ছাড়াও স্বর্ণকুমারীর কন্যা ঊর্মিলাকে নিজের কাছে রেখে সযত্নে মানুষ করছিলেন। দৈব দুর্ঘটনায় সিঁড়ি থেকে পড়ে ঊর্মিলা মারা যায়। এই বেদনা তাঁর মনে অপরিসীম চাপ তৈরি করে।
অতঃপর যশোর থেকে এলেন এগারো বছর বয়সের কন্যা। নাম তাঁর ভবতারিনী। নাম শুদ্ধিকরণ হয়ে হলো মৃণালিনী। মিশে গেলেন বনেদি বাড়ির সহস্র কেতা দস্তুর মধ্যে। ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের প্রথমা কন্যা। বালিকা একেবারেই সহজ সরল, কথায় স্পষ্ট যশুরে টান। তিনি বধূ হলেন বাইশ বছরের সুদর্শন তুখোড় কবি আভিজাত্যের রাজপুত্রের সাথে। নিয়তির বাণ। নীপময়ী তাঁকে মানে কাঁচা নরম মাটির ঢেলাটিকে ছাঁচে ঢেলে রবির উপযুক্ত করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। ক্রমে তিনি মৃণালিনী হয়ে উঠতে লাগলেন। একসময় নীপময়ীর মেয়েদের সঙ্গে পড়তে গেলেন লোরেটো হাউসে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা, পিয়ানো শিক্ষা, সংগীত শিক্ষা, সংস্কৃতি শিক্ষা কোনো সৃজনশীল কাজে লাগেনি। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য উদ্ভাসিত নারীর সাথে এককাতারে সামিল হন নাই। অথচ তিনিও অভিনয় করেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন। আনন্দে বেদনায় সবার সাথে একান্ত হবার জন্য সচেষ্টও ছিলেন। ‘রাজা ও রানী’র নারায়নীর ভূমিকায় তিনি স্বচ্ছন্দ অভিনয় করেছিলেন। তিনি আদতে ছিলেন অর্ন্তমুখী এক স্নিগ্ধ চরিত্র। নিজেকে বহুল বর্ণিল রঙে উন্মোচনে ছিল তাঁর অনাগ্রহ। নিজে কখনো সাজতে চাইতেন না। একবার সবার অনুরোধে কানে দুটি ঝোলানো বীরবৌলি পরেছিলেন। হঠাৎ কবির আগমন ঘটায় হাতচাপা দিয়ে কর্ণভূষণ লুকিয়ে ফেলেছিলেন। পাকা রন্ধনশিল্পী ছিলেন। পান-সাজা, বড়ি দেওয়া, কাসুন্দি, হরেক কিসিমের আচার তৈরিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মৃণালিনীর মানকচুর জিলাপী, দইয়ের মালপো, চিঁড়ের পুলি ছিল অসাধারণ। রবিবাবু নিত্যনতুন রেসিপি দিতেন, মৃণালিনী তা সুচারুরূপে তৈরি করতেন। অবনীন্দ্রনাথ বিখ্যাত ক্ষীরের পুতুল রূপকথার গল্পটি তাঁর জবানীতে শুনে লিখেছিলেন। কৃতজ্ঞ অবনঠাকুর লিখেছেন, ‘এই আমার রূপকথার আদিকথা।’ শিলাইদহে থাকাকালীন তাঁর স্নেহাছায়ায় ছুটে যেতেন ভাশুরপো ও ভাশুরঝিরা।
মৃণালিনী রূপসী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর কোমল মুখাবয়বে অপরূপ মাতৃত্বের আভা ছিল সমুজ্জ্বল। পাঁচ সন্তানের জননী মৃণালিনী সম্পর্কে স্বর্ণকুমারী লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের বাড়ির জ্যোতির্ময় বউ। স্বভাব তাঁর এত সুন্দর ছিল যে চেহারার কোন ত্রুটি আমাদের চোখেই পড়ত না।’ ....... বাইরের সৌন্দর্যের অপেক্ষা ভিতরের সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালিনী, মহিমাময়ী।’ খ্যাতিমান স্বামী লিখেছেন, ‘আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশি কোন চেষ্টা কোরো না-আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্ট।’
শান্তিনিকেতন ‘আদর্শ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছায় কবি সস্ত্রীক সেখানে যান। বিষয় বিবেচনায় কবির ঘাটতি ছিল বৈকি। ঘরে তিন কন্যা, অথচ তিনি যথাসর্বস্ব ব্যয় করছেন আদর্শ বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্যে। মৃণালিনী যৌতুকের গহনা ও শাশুড়ির আমলের ওজনদার গহনা তুলে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের কাজে। কবির আদর্শ বিদ্যালয় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে মৃণালিনীর অকাল মৃত্যুর পর। সংসারে নেমে এসেছে বিশৃঙ্খলা। কবি লিখেছেন, ‘আমি তাদের সব দিতে পারি, মাতৃস্নেহ তো দিতে পারি না।’
এরপর সৌদামিনীর প্রসঙ্গ আসে। সেই যশোরের ফুলতলি থেকে এলেন আট বছরের বালিকা। গুণেন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়ে। পাঁচটি সন্তান নিয়ে সৌদামিনী বিধবা হলেন অকালে। সংসারের হাল ধরলেন শক্ত হাতে। পুত্র গগনেন্দ্র, সমরেন্দ্র, অবনীন্দ্র মায়ের বুদ্ধিমত্তা সুদৃঢ় পরিচালনায় নানা গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠলেন। মাত্র চব্বিশ বছরের বিধবা শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর গানের গলা ছিল মধুর। কিন্তু নিজের প্রতিভার বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মনোযোগ ছিল না। তিনি নিজে হাতে সুতা কেটে কাপড় বুনতেন। যা দেখতে ছিল খুবই মসৃণ। শান্তিপুরী কাপড়ের মতো মিহি। নাতনিদের প্রত্যেককে একটা করে চরকা কিনে দিয়েছিলেন। রোজ সুতো কেটে তাদের দেখাতে হতো। স্বদেশি কুটিরশিল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল খুব। গ্রামের মেয়েদের হাতের তৈরি খেলনা, পুতুল সৌদামিনী সব কিনে নিতেন, উৎসাহ দেবার জন্যে। ঠাকুরবাড়ির কাদম্বিনী ও কুমুদিনী ছিলেন গুণবতী। হেমেন্দ্রনাথ কন্যা প্রতিভা চর্চা করেছিলেন দেশি বিদেশি সংগীত। মাঘোৎসবে ভাইদের সাথে গাইলেন প্রকাশ্য জনসভায় ব্রাহ্ম সংগীত। ওস্তাদের কাছে পিয়ানো বাজানো শিখতেন। নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতেও শিখেছিলেন। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ অভিনয় করে মুগ্ধ করেছিলেন দর্শকদের। প্রজ্ঞাসুন্দরী তাঁরই বোন। শিক্ষিত গুণবতী প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য রন্ধনশিল্পের দিকে। নিজেদের আবিষ্কৃত পিঠা, পুলি, পোলাও ও নানা ব্যঞ্জনে আপ্যায়িত করেছেন সকলকে। তরকারিতে মিষ্টি দেওয়ার রেওয়াজ ঠাকুরবাড়ি থেকেই প্রচলিত হয়। মহর্ষি নিজে মিষ্টি ব্যঞ্জন পছন্দ করতেন। রন্ধনশিল্প নিয়ে প্রজ্ঞা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। তাঁর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ গ্রন্থটি রন্ধন-তত্ত্ব ও গার্হস্থ্যবিদ্যার আকর গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়। তিন খ- ছিল বইটি। রবিঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মদিনে ফুলকপি, খোয়া ক্ষীর, বাদাম, কিশমিশ, জাফরান, সোনা রুপোর তবক দিয়ে বরফি তৈরি করে নাম দিয়েছিলেন, ‘কবি সম্বর্ধনা’ বরফি। খেজুরের পোলাও, লঙ্কাপাতার চচ্চড়ি, রসগোল্লার অম্বল, বিটের হিঙ্গি, পানিফলের ডালনা, ঝিঙাপাতার পোড়া, মিঠা-দই-মাছ, ঘণ্ট ভোগ, কচি পুঁইপাতা ভাজা, কাঁচা তেঁতুলের সরস্বতী অম্বল, আমলকী ভাতে, পেঁয়াজের পরমান্ন, কই মাছের পাততোলা, কাঁকড়ার খোলা চিঠি, মাংসের বোম্বাইকারী ইত্যাদি।
সতেন্দ্রজ্ঞানদার একমাত্র কন্যা ইন্দ্রিরা। ঠাকুর পরিবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অসামান্য রূপসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ইন্দিরা সবার আপন বিবিদি হয়ে উঠেছিলেন। কৈশোর থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের ছিন্ন পত্রাবলির প্রাপক। ১৮৭৩ সালে তাঁর জন্ম। ইন্দিরাই প্রথম বি.এ পাস করেন। চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনী কিছুদিন আগেই প্রায় লড়াই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা উন্মুক্ত করেছিলেন। অবশ্য ইন্দিরার আগে স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা ঘোষাল প্রাজুয়েট হয়েছিলেন। ইন্দিরা লোরেটো থেকে এন্ট্রান্স পাস করে বাড়িতেই বি.এ পড়েছিলেন ফরাসি ও ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। ১৮৯২ সালে বি.এ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ইন্দিরা অর্জন করেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। ইন্দিরা এবং তাঁর স্বামী প্রমথ চৌধুরী ফরাসি জানতেন বেশ ভালোভাবেই। ইন্দিরা প্রবন্ধ, সংগীতচিন্তা, স্মৃতিকথা ও অনুবাদে ছিলেন স্বচ্ছন্দ। অনুবাদের কাজটি মেধা, পরিশ্রম, অতি মনোযোগের করেছিলেন। কবির ভাষায়, ‘তর্জমা মরা বাছুরের মূর্তি’। সেই মরা বাছুরটিকেই প্রাণ দিতেন ইন্দিরা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেন তিনি। কবি লিখেছেন, ‘তোর সব তর্জমাগুলোই ভালো হয়েছে।’ প্রমথ চৌধুরীর ‘চার ইয়ারের কথা’ অনূদিত করেন ইন্দিরা। অনুবাদ করেন ইন্দিরা ‘টেলস্ অব ফোর ফ্রেন্ডস’। সতেন্দ্রনাথের সাথে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেন মহর্ষির আত্মজীবনী ‘দি অটোবায়োগ্রাফি অফ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ টেগোর’।
ইন্দিরা ফরাসি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে অসামান্য দক্ষতা পরিচয় দিয়েছেন। ফরাসি সাহিত্যের অনুবাদ হলো রেনে গ্রুসের ‘ভারতবর্ষ’। পিয়ের লোতির ‘কমল কুমারিকাশ্রম।’ মাদাম লেভির ‘ভারত ভ্রমণ কাহিনী’, আঁদ্রেজিদের ফরাসি গীতাঞ্জলির ভূমিকা। ইন্দিরা নারীর অন্তরাত্মার পূর্ণ বিকাশ উদ্ভাসিত করার ক্ষেত্রটি অনেকাংশে সুগম করেছিলেন। ইন্দিরা রক্ষণশীলতা এবং এ যুগের উগ্র আধুনিকতার মাঝামাঝি অবস্থানটিকে পছন্দ করতেন। ইন্দিরার ‘জীবনকথা’ যেন রূপকথার অলীক ঝাঁপি। তাঁর ব্যক্তিত্বে যে কমল হিরের আভা ফুটে উঠেছিল, সেটাই কালচার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার আলোকে আলোকিত তিনি ধারণ করেছিলেন ঠাকুর বাড়ির অনন্য সাহিত্য সংস্কৃতির স্বচ্ছ পরিচয়।
হেমেন্দ্রনাথের কন্যারা ছিল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এঁদের মধ্যে অভিজ্ঞসুন্দরী ছিলেন রবিঠাকুরের সবচেয়ে আদরের ভাইঝি। মিছরির মতো মধুর ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। অভিনয়েও সুদক্ষ ছিলেন। অকালে তাঁর মৃত্যু হলে ছোট বোন মনীষার সঙ্গে হেমেন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। মনীষা স্বামীর সঙ্গে বিদেশে গিয়েছিলেন। পিয়ানোর নিখুঁত নোটেশন শুনিয়ে ইউরোপীয়দের বিস্মিত করেন। পঞ্চম কন্যা শোভনসুন্দরীও জয়পুরে যান স্বামীর সঙ্গে। সেখানে তিনি সংগ্রহ করেন কহাবৎ বা জয়পুরি প্রবাদ। জয়পুরি শিল্প ও শোভনাকে আকৃষ্ট করেছিল। এরপর লিখতে শুরু করেন ভারতের বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, লোককথার গল্প। এই জাতীয় ভান্ডার থেকে সংগ্রহ করে শোভনা লিখেছেন ‘নেচার মীনস্’। শোভনার বোন- সুষমা ১৯২৭ সালে সাতটি সন্তানের জননী গৃহবধূ হয়েও নারী প্রগতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের অভিলাষে পরিভ্রমণ করেন আমেরিকা। তিনি গিয়েছিলেন বক্তৃতা দেবার জন্যে। আট বোনের সর্বকনিষ্ঠ পূর্ণিমা। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ জমিদার আই সি এস অফিসার পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ পান্ডের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ঠাকুরবাড়ির এক টুকরো স্ফুলিঙ্গ গিয়ে পড়ল উত্তর প্রদেশে। স্বামী পূর্ণিমার ওপর জমিদারী দেখাশোনার ভার দেন। পূর্ণিমা ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক ছোড়া, খই ফোটার মতো ইংরেজি বলতে পারতেন। বিধবা হবার পর ঘোড়া হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে জমিদারী তত্ত্বাবধানে যেতেন। তিন তিনবার ‘মহারানি’ খেতাব প্রত্যাখান করেন। ইংরেজ কর্মচারীদেরও প্রয়োজনে প্রতাপ দেখাতে পিছপা হতেন না। তাঁর এলাকায় ডাকাতি বন্ধের লক্ষ্যে তিনি দুর্ধর্ষ ডাকাতদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী রক্ষীবাহিনী। নিঃসন্তান-পূর্ণিমার (সুদক্ষিণা) সংগীত ও জনকল্যাণে ছিল গভীর মনোযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
স্বর্ণকুমারীর সুকন্যা সরলার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও প্রগাঢ় দেশপ্রেমের পূর্ণমাত্রায় ছিল। সরলার একটুখানিক অভিমান ছিল, লেখাপড়ায় মগ্ন মা তাঁকে ভালোবাসেন না-সময় দেন না! মা অবশ্য সন্তানকে ভালোবাসতেন। বহিঃপ্রকাশ ছিল কম ব্যস্ত সাহিত্যিক মায়ের। মহর্ষি সরলার গানে মুগ্ধ হয়ে হিরে, চুনা বসানো জড়োয়া নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন। সরলা অসংখ্য বাউল গান, দক্ষিণ ভারতীয় সংগীত উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কবি সেইসব কুড়ানো মনি-মুক্তা ভেঙে ভেঙে অনেক নতুন গান সৃষ্টি করেন। ‘বন্দে মাতরম’ গানের প্রথম সুর কবির অনুরোধে সরলাই দিয়েছিলেন। কবির সান্নিধ্যে ম্যাথু আর্নন্ত, ব্রাউনিং, কীটস, শেলি প্রভৃতির নির্যাস সরলা গ্রহণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। রবিঠাকুর প্রহসন ‘চিরকুমার সভা’ লেখেন সরলার তাগিদে। ‘ভারতী’র দায়ভারও সরলার ওপর বর্তায় একসময়। লেখক সম্মানী দেবার প্রথাটি তিনি চালু করে। ছত্রিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় পাঞ্জাবের বিপ্লবী নেতা তেজস্বী রামভজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। শেষ জীবনে তিনি লেখেন ‘জীবনের ঝরাপাতা’। তিনি স্থাপন করেন ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’। সরলা মহত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। চরকা-খদ্দর ইত্যাদি প্রবর্তনে সরলা গান্ধীজীর ডানহাত ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্রের বিয়ে হয় গান্ধীজীর নাতনি রাধার সঙ্গে।
গুণেন্দ্রনাথের দুই কন্যা বিনয়নী ও সুনয়নী। সুনয়নী কবি ও গায়িকা ছিলেন। তিনি উচ্চমানের চিত্রশিল্পী ছিলেন। বাংলার ঐতিহ্য, অপরূপ প্রকৃতির রূপটি তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তুলির আঁচড়ে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায় তাঁকে সম্মান করতেন।
এবার আসা যাক রবীন্দ্রনাথের তিনকন্যা মাধুরীতলা (বেলা), রেণুকা, অতসীলতার (মীরা) প্রসঙ্গে। দুর্ভাগ্য কোনো কন্যাই দীর্ঘ সুখি জীবনযাপন করতে পারেন নাই। মীরা অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন।
মাধুরীলতার বিয়ে হয় ১৪ বছর ৮ মাস বয়সে। (১৮৮৬-১৯১৯) মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে যক্ষারোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন। রেনুকা (রানী)র জীবনকাল (১৮৯১-১৯০৩) এবং অতসীলতা (মীরা) (১৮৯৪-১৯৬১) জীবনকাল। রেণুকার বিয়ে হয় ১০ বছর ৬ মাস বয়সে। অতসীলতা মীরার বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। কন্যাদের বিয়েতে বরপক্ষের যৌতুক, পণ ও নানা দাবি দাওয়া মেনে নিতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। জামাইদের বিদেশে পাঠাবার দাবি মেনে নিতে হয়েছিল বিশ্বকবিকে?
কবি বিহারীলালের ‘সুপুত্র’ শরৎকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে হয় মাধুরীলতার। এই বিয়েতে ২০ হাজার টাকার পণের দাবি ছিল, কবি অত্যন্ত মনোক্ষুন্ন হয়ে ১০ হাজার মিটিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল গভীর মনোকষ্টের! কবি লিখেছিলেন যা তার মর্মার্থ সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দোকানদারি দিয়ে আরম্ভ করা, নির্মমভাবে নির্লজ্জভাবে দরদাম করার প্রথা যে সমাজে আছে সেই সমাজ নষ্ট হবার পথে। অথচ ঠাকুরবাড়িতে এই ঘৃণিত প্রথার চল ছিল না।
সৌন্দর্যের এক স্নিগ্ধ প্রতিমা বেলা বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে মজঃফরপুর চলে যান। মাধুরীলতার সতেরো বছরের দাম্পত্য মোটামুটি ভালোই চলছিল। তবে জামাতার কিছু অসম্মানজনক ব্যবহারের চিত্রও আমাদের ব্যথিত করে। বিশ্ববরেণ্য শ্বশুর, তার গুণী-দেবকন্যার মতো অপরূপা স্ত্রী এবং পণের টাকা ইত্যাদি সত্ত্বেও বিদ্বান, মেধাবী শরৎকুমারের কেন যে সৌজন্যবোধ ছিল না?
বিহারের মেয়েরা ছিল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। পর্দাপ্রথায় জীবনযাপন অবরুদ্ধ। মাধুরী গড়ে তুলেছিলেন, ‘লেডিজ কমিটি’। এরপর প্রতিষ্ঠা করলেন একটি গার্লস স্কুল ‘চ্যাপমান বালিকা বিদ্যালয়’।
মাধুরীলতা বড় হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র ধরনে। ধরাবাঁধা বিলিতি স্কুল লোরেটোতে পড়েননি। এমনকি দেশি বেথুন স্কুলেও পড়েননি। পাঠ নিয়েছেন স্বগৃহে। তিনজন শিক্ষয়িত্রী ছিলেন মিস পার্সন্ন মিস এলজি ও মিস লিটেন। এছাড়াও লরেন্স সাহেব, শিবধন বিদ্যার্নব প্রমুখের কাছে লেখাপড়া করেছেন। আর পড়েছেন বিশ্বখ্যাত বাবার কাছে। মাধুরী দেশি বিদেশি গান, সাহিত্য, নার্সিংও শিখেছিলেন। শকুন্তলা, মনুসংহিতা, বিষ্ণুপুরাণ সবই পাঠ্য ছিল। বাবার উৎসাহে মাধুরী লিখে ফেলেছিলেন সুরো, মাতাশক্র, সৎপাত্র, অনাদৃতা, চোর প্রভৃতি গল্প। ছাপা হয়েছিল, ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’ ও ‘সবুজপত্রে’। মাধুরীর লেখার হাত ভালো ছিল। কিন্তু তিনি সাহিত্যচর্চায় ততোটা নিমগ্ন হননি। শেষ পর্যন্ত রাজরোগ যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করেন। কবি পুত্রকে লিখেছিলেন, ‘জানি বেলার যাবার সময় হয়েছে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই।’
ছোট বোন রেণুকাও যক্ষারোগে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। কবি হাওয়া বদলের জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন হিমালয়ে, আলমোড়ায়। পাইনের হাওয়া নাকি যক্ষারোগীর জন্যে উপকারী। শেষসময়ে রেণুকা পিতার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘কিছু যে দেখতে পাচ্ছি না। বাবা, তুমি পিতা নোহসি মন্ত্র পড়ে শোনাও।’
মীরা (অতসীলতা)র শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতে। লরেন্স সহেব ইংরেজি শেখাতেন। কার্তিকচন্দ্র শেখাতেন ছবি আঁকা। তাঁর বিবাহ হয় নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। কিন্তু কিছুকাল সংসার করার পর তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। মীরা দেশ-বিদেশি ইংরেজি প্রবন্ধের সার সংকলন করেন। আটটি ছাপা হয় ‘প্রবাসী’তে। তিনটি ‘তত্ত্ববোধিনী’তে। এরপর দীর্ঘজীবন বাগান করে কাটিয়ে দেন।
ঠাকুরবাড়ির বৌ, মেয়েমহলের কথা যেন ফুরাতে চায় না। তিনজন গুণবতী হেমলতা, প্রতিমা ও সংজ্ঞা।
নিঃসন্তান হেমলতা ছিলেন সবার বড়মা। আদি ব্রাহ্ম সমাজে তিনি প্রথম আচার্যা। ঘরকন্না, সমাজসেবা, ধর্মচর্চার ফাঁকে ফাঁকে তিনি করেছেন সাহিত্য চর্চা। হেমলতা জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করেন কিছুকাল। তিনিও ইংরেজ শিক্ষকদের কাছে অধ্যয়ন করেছেন দুই বছর। তিনি অনুবাদও করেছেন। তাঁর ধর্ম ও অধ্যাত্ববাদের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। উপনিষদ পাঠ করেছেন মেহচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে। হেমলতা কিছু সুফিবাদের বইও পাঠ করেছেন। অনুবাদ করেন, ‘আফ্রিকায় ইসলাম’ প্রবন্ধটি। মহর্ষি তাঁর সঙ্গে ধর্মালোচনা করেন সাত বছর। মহর্ষি তাঁকে ‘হোম’ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই অগ্নিসাধনা ছিল উচ্চমার্গীয় সাধনা। মহর্ষি তাঁকে উপহার দেন নিজের দীক্ষার আংটিটি।
হেমলতার সাহিত্য চর্চায়ও অগ্রসর ছিলেন। ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নামে পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বিধবা আশ্রম দুইটির ভার ছিল তাঁর ওপর। শান্তিনিকেতনের ছেলেদের দেখাশোনার ভারও তাঁর ওপর বর্তায়। ‘দুনিয়ার দেনা, ‘দেহলি’ তাঁর গল্পগ্রন্থ। ‘দেহলি’ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান জানায় ‘লীলা পুরস্কার’ দিয়ে। ইউরোপে ভ্রমণ করেন তিনি। সেখানকার নারীমুক্তি আন্দোলনের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে। হেমলতা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় স্ত্রী।
জ্ঞানদানন্দিনীর পুত্র সুরেন্দ্রের বিয়ে হয় সংজ্ঞার সঙ্গে। বয়সে দুজনার বিস্তর ফারাক ছিল। গুণবতী সংজ্ঞা সুঅভিনেত্রী ছিলেন। ‘বিসর্জন’ নাটকে সংজ্ঞা গুণবতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন এম্পায়ার থিয়েটারে। রীতিমতো টিকিট কেটে আয়োজন করা হয়েছিল, ‘বিসর্জন’ দেখার। তাঁর রচিত ‘সেবিকার কৈফিয়ত’ এ তাঁর ধর্ম সাধনার প্রতি অবিচল আস্থার কথা ব্যক্ত হযেছে। মুক্তিকামী হেমলতার লেখায় পাই, ‘ঠাকুর আমাকে ঐশ্বর্যের মোহে ডুবিয়ে দিয়ো না। তোমার সঙ্গে যোগ রাখতে সাহায্য করো।’ স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বেরিয়ে পড়েন তীর্থ যাত্রায়। মাথা মুড়িয়ে গৈরিক বসন ধারণ করে চললেন কাশীতে। সেখানে দর্শন পেলেন অসীমানন্দ সরস্বতীর। অশান্ত মন শান্ত হলো। আশ্রয় নিরেন ভুবনেশ্বরে সাধুমার আস্তানায়।
প্রতিমা ঠাকুরবাড়ির মেয়ে ও বৌ। এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় সদ্য বিধবা প্রতিমার বিয়ে হয়। প্রতিমাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের ভরসা। মামনি, ব্রাইড মাদার। সুদীর্ঘ ৩২ বছর তিনি কবির সেবা শুশ্রুষা করেছেন। আনন্দিত চিত্তে। প্রতিমা শান্তিনিকেতনে ইংরেজি বাংলা দুই ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। মেধা ছিল দারুণ। মাত্র কয়েক বছরে তিনি সর্ববিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ‘স্মৃতিচিত্র’ গ্রন্থে অনেক স্মৃতিরই খোঁজ পাওয়া যায়। প্রতিমা ভালো লিখতে পারতেন। ছবি আঁকতেন। গৌরবের বিষয় তাঁর ‘গুরুদেবের ছবি’ রবীন্দ্র চিত্র বিচারের সঠিক মাপকাঠি। কারুশিল্পের প্রতি গভীর টান ছিল তাঁর।
কবির সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে গিয়ে সেইসব দেশের হস্তশিল্পের সঙ্গে পরিচিত হতে সচেষ্ট হয়েছেন এবং শান্তিনিকেতনে সেই বিদেশি হস্তশিল্পের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমণকালে কাপড়ের ওপর বাটিকের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন এবং বাটিকশিল্প নিয়ে এসেছেন কলাভবনের শিক্ষাক্রমে। ফ্রান্স থেকে সিরামিকসের কাজ শিখে শান্তিনিকেতনে যুক্ত করেছেন। বর্তমানে কাপড়ে বা চামড়ার ব্যাগে, ঘর সাজানোর উপকরণের শান্তিনিকেতনী বৈশিষ্ট্য যা কিছু মনোরঞ্জন করে তার সবটার জন্যে কৃতজ্ঞতা যাবে শিল্পরসিক বা বোদ্ধা প্রতিমার অনুকূলে। প্রতিমার লেখা ‘স্বপ্নবিলাসী’ পড়ে কবি বিমুগ্ধ হন। সব উৎসবেই মেয়েদের সাজের বৈশিষ্ট্য ছিল। স্মৃতিচিত্র পাওয়া যায় প্রতিমার লেখা থেকে। বাসন্তী রঙে ছোপানো কালো পেড়ে শাড়ি, খোঁপায় ফুলের মালা, কপালে খয়েরের টিপ। এই ছিল বসন্ত পঞ্চমীর সাজ। দুর্গোৎসবে ছিল নানা রঙের উজ্জ্বল শাড়ি। ফুলের গয়না। চন্দন ও ফুলের প্রসাধন। দোলে পূর্ণিমার সাজ ছিল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের সুবাসিত মালা। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা উৎসবের দিনে পরতেন সোনার গহনা। বিকেলে মুক্তোর গহনা আর রাতে হিরে জহরতের জড়োয়া গহনা। নৃত্যশিল্পী না হয়েও প্রতিমা রবীন্দ্রনাটকে ও নৃত্যনাট্যের নান্দনিক রূপসজ্জায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর রচিত ‘নৃত্য’ গ্রন্থটিতে ব্যতিক্রমী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির আদর্শগত মতবিরোধ হতো, কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে নয়। নারীশিক্ষার প্রসারকল্পে তিনি গড়ে তোলেন ‘আলাপনী সমিতি’।
ঠাকুরবাড়ির ছেলে সৌমেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হয় গুজরাটি কন্যা শ্রীমতির। রাজনৈতিক জীবনে সৌমেন্দ্র প্রথমে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেও পরে চরমপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন। শ্রীমতি অসহযোগ আন্দোলন করে কারাবরণ করেছিলেন। বিয়ের পর শ্রীমতি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। চল্লিশের দশকে ‘রচনা’ নামের নারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। দুস্থ নারীদের হাতের কাজ শেখান। দেশভাগের সময় পুরনো কাপড় দিয়ে কাঁথা সেলাই করে বিক্রি করবার ব্যবস্থা করেন। নৃত্য পরিবেশন করতে মাদ্রাজ, সিংহল, শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন। ভজনের কয়েকটি রেকর্ডও করেছিলেন। গানের স্কুল ‘বৈতালিক’ নাচের স্কুল ‘নৃত্যকলা’ স্বগৃহে গড়ে তোলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় এই বাড়ির মেয়েরাই চরকা ও তকলিতে সুতো কাটা শুরু করেছিলেন। সৌমেন্দ্রনাথ খদ্দর বিক্রি করতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। প্রকৃতি তাঁর কাছ থেকে চাদর কিনে লটকন রং করে আবার তাঁকেই উপহার দিতেন।
সুরভির লেখায় পাওয়া যায় শাড়ির সঙ্গে জামার রঙের সাদৃশ্য মিলিয়ে পরা হতো হালকা বেনারসি বা ঢাকাই জামদানি। এলো খোঁপার বদলে মেয়েরা বউরা বাঁধতেন ‘বান খোপাঁ। রুজ লিপস্টিকের ব্যবহার ছিল না। ... হাতে থাকত অস্ট্রিচ পাখির পালকের পাখা। এটি ছিল ভিক্টোরিয়ান যুগের কায়দা। হাতে আতরের ছোঁয়া। অবশ্য সুরভির ছিল বিলেতি পারফিউমের প্রতি দারুণ ঝোঁক।
পূর্ণিমার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি সুরেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ। তাঁর লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’র বিশেষত্ব হলো ঠাকুরবাড়ির প্রিয় ব্যঞ্জনগুলো এই গ্রন্থে সযত্নে বর্ণিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দৌহিত্রী নন্দিতা মীরার কন্যা। তিনি নিজগুণে ছিলেন স্বতন্ত্র। প্রতিমার নৃত্যশিক্ষা স্কুলের উজ্জ্বলতম রত্ন। ১৯৩৬ সালে তিনি কৃষ্ণ কৃপালনীকে বিয়ে করেন। কবির রোগশয্যায় নন্দিতা শুশ্রুষায় ছিলেন অক্লান্ত। নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা রপ্ত করেছিলেন। শিখেছিলেন রামকিঙ্কর প্রমুখের কাছেও। বাটিক, ব্লক, চামড়ার কাজে ছিলেন সুদক্ষ। দেওয়ালে ফ্রেসকো পেইন্টিং করতেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও করেছেন। চাকরি করেছেন দিল্লী ক্লথ মিল্সে। স্কুলে নাচও শেখাতেন। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। ১৯৪২ সালে দুজনেই জড়িয়ে পড়েন অসহযোগ আন্দোলনে।
গগনেন্দ্রনাথের ছোটমেয়ে সুজাতাও ছিলেন প্রচার বিমুখ। সেলাই ও আলপনা আঁকার জন্যে পুরস্কারও পেয়েছেন। অবন ঠাকুরের কাছে শিখেছিরেন ‘বনসাই’ এর কৌশল।
সৌদামিনীর কন্যা ইন্দুমতীর পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র হচ্ছে মম্মথ ও লীলার মেয়ে দেবিকারানি। সরোজিনী নাইডু তাঁকে বলতেন ‘ভারতীয় ছবির নাইটেঙ্গেল’। অপরূপা দেবিকা রানিকে বলা হতো ‘দি ফার্স্ট লেডি অফ দি ইন্ডিয়ান সিনেমা।’ স্বামী হিমাংশু ও দেবিকা বম্বে টকিজ তৈরি করেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘গগন কী রাগিনী’, ‘জওয়ানি কা হাওয়া’, ‘জীবন নাইয়া’ প্রভৃতি।
এবার আসি প্রতিভাদীপ্ত রূপসী অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের প্রসঙ্গে। গগনেন্দ্রনাথের প্রপৌত্রী গীতীন্দ্রনাথের কন্যা শর্মিলা। সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসারে’র জন্যে একটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। শর্মিলার বাবাকে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি স্কুলের সামনে চর ফিট করে রেখেছিলাম। তাদেরই একজন আপনার মেয়েকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ফলো করে বাড়িটি চিনে আসে।’ গগনেন্দ্রনাথ ইতস্তত করে সম্মত হলেন। অথচ শর্মিলা হতে চেয়েছিলেন চিত্রশিল্পী। অতঃপর চলচ্চিত্র জগতে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সুঅভিনেত্রী হিসেবে সবার মন জয় করলেন। ‘অপুর সংসার’ থেকে ‘মিসিসিপি মশলা’ ‘দেবী’ ‘আরাধনা’, ‘অমর প্রেম’, ‘নায়ক’ ইত্যাদি প্রচুর ছবিতে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মূলত একুশ শতকের সূচনাকাল থেকে ঠাকুরবাড়ির সদর অন্দর প্রায় সমান্তরাল হয়ে গেছে। বিশ্বসভার আলোর বিচ্ছুরণ লুটিয়ে পড়েছে অন্দরের ঘেরাটোপে।
একটি বিষয় বিস্ময়কর। ঠাকুরবাড়ির বধূরা এসেছেন বধূ হয়ে নিতান্ত বালিকা বয়সে। এবং তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য ঠাকুরবাড়ির ধারে কাছেও না। যশোহর, খুলনার নিতান্ত গ্রামীণ পরিবেশ থেকে তাঁরা উঠে এসেছেন। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অনুকূল পরিবেশে এবং উদার শিল্পরুচি সম্পন্ন পুরুষদের সহমর্মিতায় তাঁদের চেতনা এবং জীবন ধারা আমুল পাল্টে গেছে। তাঁরা হয়ে উঠেছেন শিল্পসাহিত্যের প্রতিভূ।
ক্রমে সমাজের পট পরিবর্তন হয়েছে যুগের দাবিতে। যে পরিবারে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মা অলকাসুন্দরী নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে অন্তর্জলী যাত্রায় গিয়েছিলেন, সেই পরিবারের মেয়েরা বধূরা দিকদিগন্তে আপন আলোয় পরিভ্রমণ করেছেন নারী জাগরণে ইতিহাস হয়ে আছেন। নিবিড় গবেষণার চিত্ররূপ ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ পাঠ করতে করতে বিস্ময়, শিহরণ, আনন্দ, কিছু বেদনা-দ্বন্দ্ব, কিছু প্রশ্ন, কিছুটা সদুত্তর, কিছু নিয়তি, সমাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পাঠকের মন চঞ্চল করে। সর্বোপরি সমৃদ্ধ করে।
এই রচনায় আরো কয়েকজন উজ্জ্বল নারী ব্যক্তিত্ব প্রচ্ছন্ন রয়ে গেলেন। ভবিষ্যতের পাঠক তাঁদের খুঁজে নেবেন। ৪৫০ পৃষ্ঠার এই গবেষণালব্ধ গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে পাঠক মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। রচয়িতা চিত্র দেব যদি ক্রম অনুসারে চরিত্রগুলোকে সাজিয়ে দিতেন, পর্ব বিভাগ করে তাহলে অনেকের জন্যে পাঠ করা হতো সহজতর, গতিশীল।
সর্বোপরি স্মরণযোগ্য যে, ঠাকুরবাড়ির মূল কেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিত্রা দেবের এই গ্রন্থটি উনিশ শতকে নারী জাগরণ ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিল্পসাহিত্যের মনিকাঞ্চন যোগের এক আকর সম্পদ। এই গ্রন্থটি অনুসন্ধিচ্ছু নারী পুরুষের অবশ্য পাঠ্য হতে পারে।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন