
নজরুল এক সম্ভবনাময় যুগে অসম্ভবের গান গেয়েছেন। ঘুমন্ত জাতিকে জাগানো, দ্বিধা বিভক্ত জাতিকে ঐক্যের সুরে বাঁধার চেষ্টা করে গেছেন সমগ্র জীবন জুড়ে। আর তার বজ্রধ্বনির ন্যায় বিপ্লবী কবিতা, জাগরণী গানের পাশাপাশি পেলব সুরে সেই অভিমানের অস্তিত্ব জানান দেয় নজরুলের গল্পগুলো। ঝড়ের মাঝে ভৈরবী সুর তাই প্রচ্ছন্নই থাকে। আর এজন্যই অনেকে বলে থাকেন তিনি কবি হিসাবে যতটা সফল, গল্পকার হিসাবে ততটা নন। ব্যাপারটা আসলে জিলিপি খেয়ে চা খাওয়ার মত, চায়ে চিনি কম মনে হয়।
নজরুল প্রায় তিনহাজার এর মত গান রচনা করেছেন, কবিতা কতগুলো লিখেছেন তার সংখ্যাই করতে পারি না। জেল খেটেছেন একটি বছর, বাংলা-ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে, সৈনিক হিসাবে কেটেছে আড়াই বছর, ১৯৪২ থেকে বাকরূদ্ধ হয়ে যান। জীবন তাকে এত কম সময় দিয়েছে যে তিনি উপন্যাস বা বড় আঙ্গিকের গল্প লেখার জন্য যেটুকু সুস্থির অবসর প্রয়োজন, তা পাননি। 'ব্যথার দান' গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো তার করাচীর সেনা ছাউনিতেই লেখা। কবিতা, গজল, গান ছিল তার সহজাত। মুহূর্তের ভাবনায় কালজয়ী লেখনীর সৃষ্টি করার অসামান্য প্রতিভা তার ছিল। আব্বাস উদ্দীন জোহরের নামায আদায় করতে করতে তিনি রচনা করে ফেলেছিলেন বিখ্যাত গজল―
"হে নামাযী, আমার ঘরে নামায পড় আজ,
দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামায।"
আহা!
যে কথা বলছিলাম, নজরুল গল্প লিখেছেন সংখ্যায় খুব বেশি নয়, অল্পই। কিন্তু ব্যক্তি নজরুল, অভিমানী নজরুল, স্নেহ-মমতা-ভালবাসার কাঙ্গাল নজরুলকে চিনতে হলে তার গল্পগুলোর কোন বিকল্প নেই। নজরুলের বেশিরভাগ গল্পই যেন 'বিদ্রোহী নজরুল', 'বিপ্লবী নজরুল'-এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই অন্য নজরুলটির আত্মকথারই ছদ্মাবরণ! তার যে গল্পগুলো গল্পের নায়কের জবানিতে বর্ণিত হয়েছে, তারা যেন আর কারুর নয়, স্বয়ং নজরুলেরই কথা বলেছে। যদি তার 'বাদল বরিষণে' গল্পের কথাই ধরি, তাহলে দেখতে পাই, সেখানে গল্পের নায়ক বার বার নিজেকে যেই বিশেষণগুলোতে নিজেই উপস্থাপন করছে সেগুলো হলো 'খাপছাড়া', 'ছন্নছাড়া', 'দাগাখাওয়া', 'পথহারা' ইত্যাদি। এদের কোনটি নজরুলের বৈশিষ্ট্য নয়? আমরা নজরুলের অনেক গল্পেই দেখতে পাই সেই খাপছাড়া, ক্ষ্যাপাটে আর খামখেয়ালি নজরুলকে। 'হেনা' গল্পের সেই সৈনিক নায়কটির কথা এখানে বলা চলে― যে কি না যুদ্ধের সময় ট্রেঞ্চের মধ্যে শহীদ বন্ধুর লাশের গায়ে ঠেস দিয়ে দিনপঞ্জি লিখতে থাকে, মৃত বন্ধুর লাশের সাথেও হেয়ালি করতে তার সৈনিক বুক কাঁপে না। মৃত লাশের সাথে সে কথা বলে― 'কি বন্ধু, একটু জল দেব নাকি মুখে?― ইস, হাঁ ক'রে তাকাচ্ছেন দেখ! না বন্ধু― না, তোমার পরপারের প্রিয়তমা হয়তো তোমার জন্য শরবতের গেলাস-হাতে দাঁড়িয়ে র'য়েছে! আহা, সে― বেচারীকে বঞ্চিত ক'রব না তার সেবার আনন্দ থেকে!’ এমন অসম্ভব বেদনাসিক্ত রূঢ় রসিকতা যে কেবল খাপছাড়া ক্ষ্যাপা নজরুলের পক্ষেই সম্ভব!
বস্তুত গল্পের বাইরে বিভিন্ন বক্তৃতায়, চিঠিতে নজরুল তো এভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতেন। আবার 'অগ্নি-গিরি' গল্পের নায়ক সবুর, যে কি না একজন নীরিহ তালিবুল এলেম, জায়গীর থাকে ত্রিশালের অবস্থাসম্পন্ন পাটোয়ারীর বাড়িতে, তাকেও আমরা দেখি গল্পের নায়িকার একদিনের অনুরাগী অনুযোগে নিজের পৌরুষ প্রমাণে এলাকার বখাটে ছেলেদের অন্যায়ের প্রতিবাদে অগ্নি-গিরির মতই প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এই প্রতিবাদও তো নজরুলেরই আপন বৈশিষ্ট্য। সুতরাং, এ কথা বললে ভুল হবে না যে নজরুলের অনেক গল্পেই নায়কের চরিত্রের আড়ালে আমরা আসলে নজরুলকেই খুঁজে পাই। কাজেই, সেই নজরুলকে চিনতে হলে তার গল্পগুলোর দ্বারস্থ আমাদের হতেই হবে।
নজরুলের যে আত্মবর্ণনামূলক গল্পগুলো অনেকটাই একজন অভিমানী, প্রবঞ্চিত মানুষের অনিয়মিত দিনলিপির ঢং এ রচিত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো 'ব্যথার দান', 'পথহারা', 'ঘুমের ঘোরে' ইত্যাদি। এই গল্পগুলোয় সব কিছু ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে প্রেমিক নজরুল, প্রেম-হারা নজরুল, প্রেয়সীকে পেয়েও হারিয়ে চোখের জলে ভাসা নজরুল। যদি প্রশ্ন করি, এরকম আত্মকথনমূলক বেদনা সঞ্চারী গল্প নজরুল কেন লিখেছেন, তার উত্তর নজরুল তার ঘুমের ঘোরে গল্পে নিজেই দিয়েছেন এভাবে, 'তবু যে লিখছি? মানুষ মাত্রেই চায় তার বেদনার সহানুভূতি, তা নইলে তার জীবনভরা ব্যথা অসহ্য হয়ে পড়ে যে! দরদী বন্ধুর কাছে তার দুঃখের কথা ক'য়ে আর তার একটু সজল সহানুভূতি আকর্ষণ ক'রে যেন তার ভারাক্রান্ত হৃদয় লঘু হয়।' হৃদয়ানুভূতির ভার লাঘব করা যে অনুভূতিসম্পন্ন মানুষমাত্রেরই জন্মজাত বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে যারা কবি, যারা সাহিত্যিক, তাদের অনুভূতির পারদটা খুব স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। তাই শত প্রতিকূল অবস্থাতেও তারা না লিখে থাকতে পারেন না। এই থাকতে না পারার কথাটাই নজরুল তার 'হেনা' গল্পে তুলে ধরেছেন গল্পের সৈনিক নায়ক সোহরাবের জবানিতে― 'এই লেখা অভ্যাসটা কি খারাব! এত আগুনের মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছি,― পায়ের নীচে দশ-বিশটা মড়া, মাথার ওপর উড়োজাহাজ থেকে বোমা ফাটছে― দুম্- দুম্- দুম্, সামনে বিশ হাত দূরে বড় বড় গোলা ফাটছে গুড়ুম গুড়ুম, পাশ দিয়ে চ'লে যাচ্ছে 'রাইফেল' আর 'মেশিনগানে'র গুলি― শোঁ শোঁ শোঁ,― তবুও এই সাতটা দিন মনের কথাগুলো খাতার কাগজগুলোকে না জানাতে পেরে জানটাকে কি ব্যতিব্যস্ত ক'রে তুলেছিল! আজ এই ক'টা কথা লিখে বুকটা হাল্কা বোধ হ'চ্ছে!'
কবিতায় বিদ্রোহের ঝঞ্ঝা তোলা নজরুল, মানবতার বিজয় গাঁথা রচয়িতা নজরুল, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবী নজরুল যেন তার সকল ক্লান্তির আশ্রয় খুঁজতেন তার গল্পগুলোয়। যদিও নজরুলের গল্পের উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করা নয়, কিন্তু গল্পেরই প্রয়োজনে নজরুল প্রকৃতিকে বিভিন্ন সময় তার গল্পে বর্ণনা করেছেন অপূর্ব উপমায়। উদাহরণ অনেক দেওয়া যাবে, তবে কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় তার 'বাদল বরিষণে' গল্প থেকে একটি নমুনা দিচ্ছি― 'আকাশভরা হালকা জলো মেঘ আমারই মত খাপছাড়া হ'য়ে যেন অকূল আকাশে কূল হারিয়ে ফিরছিল। তারই ঈষৎ ফাঁকে সুনীল গগনের এক ফালি নীলিমা যেন কোন অনন্ত-কান্নারত প্রেয়সীর কাজলমাখা কালো চোখের রেখার মত করুণ হয়ে জাগছিল!’
প্রকৃতির বর্ণনায় উপমার কথা যখন উঠলোই, তখন উপমার ব্যবহারে গল্পকার নজরুল কি ভীষণ কবি হয়ে ওঠেন তার গল্পগুলোয় তার দু'একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। বরাবর দেখে আসছি কবি সাহিত্যিকেরা প্রিয়ার সৌন্দর্যকে বিভিন্ন ফুল-ফলের উপমা দিয়ে মহিমান্বিত করেন। যেমনঃ গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট, বেতের ফলের মতো চোখ ইত্যাদি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম এক্ষেত্রেও অভিনব, প্রথাবিরোধী, উল্টোরথের যাত্রী। তিনি যেন প্রকৃতিকেই মহিমান্বিত করেছেন রমণীর দেহবল্লরীর সাথে প্রতিতুলনার মাধ্যমে। 'ব্যথার দান' গল্পে নজরুল প্রকৃতির বর্ণনায় বলছেন―
'আঙুরের ডাঁশা থোকাগুলো রসে আর লাবণ্যে ঢল-ঢল করছে পরীস্তানের নিটোল-স্বাস্থ্য ষোড়শী বাদশাজাদীদের মতো! নাশপাতিগুলো রাঙিয়ে আছে সুন্দরীদের শরম-রঞ্জিত হিঙুল গালের মতো! রস-প্রাচুর্যের প্রভাবে ডালিমের দানাগুলো ফেটে ফেটে বেড়িয়েছে কিশোরীদের অভিমান-স্ফূরিত টুকটুকে অরুণ অধরের মতো!'
কাকে রেখে কাকে দেখি! উপমেয়কে রেখে উপমাকে? এখানেই নজরুল তার গল্পের ভিতর ঢুকিয়ে আমাদের বিহ্বল করে দেয়।
গল্পের নজরুল কিংবা নজরুলের গল্প নিয়ে আরও বিস্তর কথা বলা যেতো। তবে বিস্তর বলেও যেখানে নিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, সেখানে অল্পেই সমাপ্তি টানতে হয়―নজরুলের গল্পের নায়কদের মতই খাপছাড়া ভাবে। উপসংহারে শুধু এটুকুই বলে যেতে চাই যে― বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি কাজী নজরুলকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে, চিনতে, জানতে― ঝড়ের প্রচণ্ডতার আড়ালে তার সেই অপূর্ব ভৈরবী সুর উপভোগ করতে আমাদের কাজে কাজেই ডুব দিতে হয় নজরুলের গল্পে- যেখানে জীবন আর গল্প সমার্থক হয়ে ওঠে।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান