যোজনগন্ধা মায়া
হেই হেই হেই। কারো হাতে চিনির পুতুল,আসমানে ঘুড্ডি ওড়ে পতপত। কারো আছে মাটির ঘোড়া, কেউ আনন্দ করে হাওয়াই মিঠাই লৈয়া,কারো বা নকশাকাটা মাটির ঘড়া, সোলেমান বাজায় পেঁপো, পেঁপো। মেলার ঢোল করতাল, বাউলা গান, সেই সাথে ময়নাপাখি, টিয়াপাখি, আর আছে আবুশামার রঙ্গিলা বয়ান:
উত্তরে যাই দক্ষিণে চাই পাড়ের দেখা নাই
ও আমার লতিপুতি গাঁয়
পথের আগে মনের দেখা বোনের লগে ভাই
বতুয়া শাক হেলেদুলে হাওয়ারে জিগায়
উত্তরে যাই দক্ষিণে চাই পাড়ের দেখা নাই
ও আমার লতিপুতি গাঁয়।।
হৈ-হুল্লোড়, মাইকিং, দরগার মানত, নাগরদোলায় আণ্ডাবাচ্চার শিহরণ, বায়োস্কোপওয়ালার রাজ্জাক কবরী, জাফর ইকবাল ববিতা, নাদিম শবনমের ঝমাঝম।
আস্তে আস্তে কুরুমনি মেলার দিকে আসে।
এই তো এই তো আসিছেন- দাদী আসিছেন।
আসো আসো কুরুমনি দাদী, আসো।
তোমার জন্যই সব গান বাজনা করছি হে- সব তোমার জন্য।
আজ মেলার দিন- কতো খুশি- নাচগান- তুমি আজ কাঁদতে পারবে না দাদী।
এতো নাতি নাতকরের সামনে এলি না কেঁদে থাকতে পারি? দেখো দেখি কতো সুন্দর নিয়ম- তোমরা হাসবে আর আমি কাঁদবো!
আবার যদি তুমি কাঁদবেই- তাহলি এতো গানবাজনার আয়োজন করিছি কেন?
আর পারি না বাপু- মনে হয়, এক হাজার বছর ধরে এই কুরুমনি ঝুলেঝুলে লটকে আছে- শেষ হচ্ছে না। মজার কথা কী জানিস- আমাদের বংশলতিকায় এতো লম্বা আয়ু কেউ পায়নি- আমিই পেয়েছি কাছিমের আয়ু! ভালো করে দেখো তো দেখি- আমি কী মানুষ- বিবি হাওয়ার জাত- নাকি কাছিম- সত্যিসত্যিই কাছিম? কিন্তু জহরকে না দেখে আমি কেমনে মরি কও তো তোমরা? একবার খালি জহর দেখা দিক- জন্মের মতো চোখ বন্ধ করে দিবো- খালি একবার জহর আসুক!
দেখো দাদী, আমরা সবাই কুমির পীর- এর মেলা করি, গান গাই, ভোগ দিই- আশা একটাই- কুমির পীর একদিন আমাদের গ্রামের ছেলে জহরকে ফেরত আনবে- একটাই আশা দাদী- ধন চাই না, দৌলত দিয়ে কি হবে- খালি জহরকে চাই। জহর আসবে- একদিন জহর ঠিক ঠিক আসবে, লতিপুতি গাঁয়ে জহর একদিন ঠিকঠিক এসে নামবে!
আর কবে আসবে ফালু? চোখে ছানি পড়ে গ্যাছে- সবকিছু তামাতামা দেখি- আজকাল কানেও শুনি না!
চোখ বড় বড় করে দুই পাতা খুলে চাও- কুমির পীর সব আশা পূরণ করে।
তোমরা চাও আমি আরো বাঁচি- পাঁচশো বছর পথ চাইয়া থাকি- আবার কেউ কেউ চায়- আমি মরি, আজই মরি- সয়সম্পত্তি দখল নিবার নেশা!
কার কথা কও?
আছে, আছে- আশেপাশেই আছে!
কে সে?
দাইনশা, দাইনশা।
ভয় নিও না দাদী- আমরা আছি- আমরা চাই তুমি আরো বাঁচো- একসাথে জহরকে দেখি!
দিন ডাকে- বৃষ্টি আসবে, মনে কয়।
হ হ বৃষ্টি আসবে- এমন দিনেই- ঝড় তুফানের রাতে জহর ঘর থেকে বার হইছিল।
মেলা এখন ভাঙবে- আসমান কালো হয়ে আসে। দাদী চোখ খোলা রাখো- কান খাড়া করো- এমন মেঘলা দিনেই মনে কয় কুমির পীরের দোয়ায় জহর আসে- আমরা গান গাই-
উত্তরে যাই দক্ষিণে চাই পাড়ের দেখা নাই
ও আমার লতিপুতি গাঁয়
উত্তরে যাই দক্ষিণে চাই পাড়ের দেখা নাই।।
যেমন দিনে জহর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল- এমন দিনেই সে ফিরেও আসবে- কুমির পীরের রহম। আল্লাহ রসুলে নিবেদন- মা কালীর চরণে ভক্তি, পুবে ভানু যে উদয়, পশ্চিমে মহিমাকীর্তন, উত্তরে গৌতমবুদ্ধের ধ্যান, পশ্চিমে যিশুখ্রিস্টের ধাম, দক্ষিণে বিলাপ!
কে এমন বেকুব যে কুমির পীর- দশদিকে নাম তার কুমির শাহ্ বলে- এমন আহাম্মক আছে না-কি যে কুমির শাহ্’র দাপট আর বাদশাহির কথা জানে না! বাপের নাম ভুলে থাকা যায়, কিন্তু কুমির শাহ্ নামের জৌলুশ ভোলা যায় না!
শোন সকলে। আমার মন সাক্ষী দেয়- আজ রাতে আমার জন্য আজরাইল আসবে- আর পারি না- আমি হাসতে হাসতে যাবো! ভয় কিসের! বাবা কুমির পীরের রাজ্যে আমার বাস- কতো তার মাজেজা- বাবা কুমির শাহ্ জীবিত ছিলেন ১২০ বৎসর। এই ১২০ বছরের জীবনের সবটাই মৃত জিন্দেগি- মানুষটি জীবিত, কিন্তু জীবন্মৃত। অথচ কী আচানক! যেদিন মারা গেলেন- সেইদিন কবরের পাড় থেকে কুমির রূপে বিলে গিয়ে নামেন- সেদিন থেকে আমাদের সব ভার তিনার উপর।
আমার কিসের ডর!
ছেলে নাই বুড়া নাই কতোযুগ আগের কুমির পীর- তার মাজেজার কথা শুনি। শত বছর, হাজার বছর আগের কথা- কিন্তু গোরাডোরা বিলের চারপাশের সবার মনে হয়- এই তো সেদিন কুমির শাহ্ কবর থেকে উঠে নিকষ কালো রাত্রির গ্রন্থি ছিঁড়ে কৈলাগ গ্রাম থেকে ঘুঙুরে, প্রিন্টের উড়াউড়া চাদরে- একজন বুঝি আসমান থেকে নেমে আসা ফেরেশতা, একজন বুঝি নববধূর কাজলে, সোনার নাকফুলে, কান্নায় একজন কুমির কৈলাগের খালপাড়ের গোরস্তানে এক নয়া কবর থেকে আড়মোড়া ভাঙে।
বিয়ের গীতে, বাদ্যে, পানসুপারি ধানদুর্বায় নয়া বউ বুঝি গৃহস্থ বাড়ি এসে ঢোকে। নয়া বউ না কুমির, কুমির না-কী ময়ূর, ময়ূর না একটি রুইমাছের বিলের শালুকের উপর লাফিয়ে ওঠা?
একটি ঝিলিক, এক আলোড়ন কবরের উপরে উঠে আসে- ফলে মনে হয়- মুর্দা নয়, কুমিরও বুঝি নয়- চম্পক বাড়ির এক দৌড়ের নৌকা- কুমির নাও- আলো ঠিকরানো মাঝিমাল্লার দল আসমানের দরিয়ায় বৈঠা মারে:
আসমানেতে ছাড়ো নৌকা পাড়ভাঙ্গানি মাঝি
ভয় নাই তোর, না ডরাও শেখ ফরিদের গাজি।
সাত তবকে উঠে চন্দ্র মাটির কসম পাড়ি
মা ফাতেমা বোনের দোহাই তোমরা আমার হরি।
মা যে আমার আলেক সাঁই- শুনতে হইও রাজি
আসমানেতে ছাড়ো নৌকা পাড়ভাঙ্গানি মাঝি।।
এভাবে সেই কবেই বাবা কুমির শাহ্ গোরাডোরা বিলে আমাদের ভাগ্যের সিন্দুক হয়ে নামে।
ঘটনা- ঘটনা না বলে বলি দুর্ঘটনা - লতিপুতি , হাকালুকি, নলুয়াদিঘী কেবল সাতসকালে ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে- তার মধ্যেই গোরাডোরা বিলের মুখের উপর যেখানে কুমির শাহ্ পীরের হুজরাখানা- দয়ার পীর বেআদবি মাফ করো- ঠিক বিলের ওই মুখখানায় এক ছাওয়াল সোজা তালগাছের মতো খাড়া- হায় হায় করে কী - শরশর করে মুতে- হিসু করে! তালগাছের মাথা থেকে টুপ করে তালটা মাটি নাগাদ আসতেও সময় লাগে-কিন্তু তিনগ্রামের লোক হিসুকরা লোকটিকে বেড় দিয়ে ধরতে সেই সময়টুকুও লাগেনি।
লাঠিসোটা হৈহুল্লোড়ে গোরাডোরা বিলের মুখ তাতিয়ে ওঠে: অগুণতি লোকের ভিড়ে সেখানে আরো ছিল-দেড়ফুট সিরাজউদ্দৌলা, দাইনশা, মুক্তিবাহিনী আফাই আর কৃষকের বেটা হারাধন, সলিমুল্লাহ, বেশরম, ফৈজা, মরমালি, ফুটবল খেলার রেফারি বেফাশ্বা, বঙ্গু, যাত্রাদলের বিবেক লতাধর, জগাই, ফিশু, নসর, বিলাতালি, সুন্দর গ্রামের নাগর বিনন, কাকড়াবুনিয়ার সোবান, গাঙ্গিনার আনুহা, ছাতিরচরের মানিক। আরো মানুষ, লোক, জনতা। মনে হয়, তামাম দুনিয়ার এই মাথা থেকে ওই মাথা, পুবদিক থেকে পশ্চিম, উত্তর থেক দক্ষিণ বরাবর একটা ঘুন্নিবাইয়ের শিস বুঝি শঁশঁ... শঁশঁ... শঁশঁ করতে করতে কিয়ামত ঘনায়ে আসে! কেউ কোন মন্ত্র বলে না, রাগে ক্ষোভে আল্লার পয়গম্বরের নামে দোয়া করতেও ভুলে যায়। কিন্তু কেউ জানে না- কোত্থেকে এমন একটা গুঞ্জন, শূন্যতার আগায় আগায় একটা সাপের হিসহিসানি গোরাডোরা বিলের মুখের দিকে গঠিত হয়ে উঠতে থাকে। কোন আদিবাসী গুহা থেকে বুঝি শনৈশনৈ বেরিয়ে এসে বিলের বাজুর দিকে ঘনীভূত হয়ে উঠতে থাকে শিকারীর মন্ত্র:
উকু উকু কুকু কুকু উকু উকু
লুলু লুলু উউ উউ জুকু জুকু
উটুটু উটুটু উকু উকু উটুটু উটুটু
ঝিঁঝিঁ ঝিঁঝিঁ ডুডু ডুডু ঝিঁঝিঁ ঝিঁঝিঁ।
হেই, হেই কে কোথায় বল বল হরিবল হরিবল! আসো, আসো সবাই আসো বিলের মুখে চলো। হায় হায়রে ইজ্জত যায়- সব যায়- লতিপুতি গ্রামের মুখে কালি পড়ে- হায় হায়রে।
বাবা কুমির শাহ্ রক্ষা করো - বাঁচাও বিলের পানি- এই ভিক্ষা মাগি - মিনতি করি!
এই, এই কে তুমি এমন গোরাডোরা বিলের মুখে ফরফর করে তলপেট খালাশ করো !
এমন পাষাণ বেশরম তুমি কোন আক্ষেপ নাই- ভবিষ্যতের হিসাবপত্র নাই- আহারে কাঙাল বাঙলার হেঙলা পরিহাস- যদি নিজের পায়ে এমন কুড়াল মারো- কে বাঁচাবে তোমার মান- ইংরেজ-এর আগমনী সর্বনাশ আবার বাংলার ভাগ্যাকাশে কেমনে দেখা দেয়- নির্ঘাত এ লর্ড ক্লাইভের বংশধর!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছো কী- লাঠি কই, শড়কি হাঁকাও- মাথা দুই ভাগ করো।
দাইনশা ভাই, আমি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধারা- বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা- দেশে দেশে পাঠান ভিস্তি- খুঁজে বের করো- কোথায় আড়ালে আবডালে মীরজাফরের দল।
শোনেন, শোনেন ভাইয়েরা, আমার কথা একটিবার শোনেন।
কোন কথা শুনবো না- তুমি কুমির শাহ্’র পবিত্র বিল মাজার অপবিত্র করেছো- এখানে বাবা কুমির শাহ্’র বাড়ি- আমাদের দিন-দুর্দিনের উদ্ধারকর্তা, সাথী।
কী নাম তোর?
আলফ্রেড পাহান।
কী নাম?
কী নাম বলিস?
বাবু, আমার নাম আলফ্রেড পাহান।
তুমি কোত্থেকে আসো- কেমন করেইবা গোরাডোরা বিল বরাবর নামো?
কী সর্বনাশ করো আলফ্রেড পাহান! এ-আমার তিন ফসলা জমি- আমার সামান্য একখান ভুঁই- ভগবানের অপার কৃপায় আমি ভালো আছি পাহান- এই জমিতে বাবা কুমির শাহ্ থাকেন- তাই আমি এখানে চাষবাস করি না- জমি বাবা কুমির শাহ্’র নামে তুলে রাখি- আমি মানুষের বাড়ি বাড়ি কামলা কেটে চলি- চোত বোশেখে কাজের সন্ধানে দক্ষিণে যাই- ভগবানের দক্ষিণায় বড় ভালো আছি আমি- তুমি কেম্বা করে এই জমিনের মুখে পেচ্ছাব করতে পারো? হায় হায় ভগবান, তুমি কী কাজ করলা কও দেখি!
উল্টা আমরা ভাবি, যুদ্ধ সেই কবে শেষ- এতোদিন পর আমাদের জহর বুঝি মাঠের বুক দাবড়ে গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে আসে।
না ভাই আমি জহর নই- আমি আলফ্রেড পাহান!
ছাড়ো মিয়া, জহরের আশা ছাড়ো- যুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই কতো বছর হয় সেই খেয়াল আছে? এখনো জহর জহর করো- জহর আর কোনদিন আসবে না, ফাইনাল কথা বসসাইয়া দিলাম।
জহরের কথা বললে আপনার এতো গা জ্বালা করে কেন?
কুমির বাবার কী লীলা- আমরা ভাবি জহর।
আমি জহর নই ভাই- আমি অতি ভোরে এই বিলের পাড়ে মাঠে এসে নামি- আলফ্রেড পাহান। দেখি কী- একটা মেয়ে কাটা ধানক্ষেতের উপর ব্যাকুল পায়ে দৌড়ায়- পরে জানি মেয়ের নাম মনিলতা- মনিহার। আমি লুকিয়েছিলাম মহিষের আড়ালে। মনিহার পাগলপারা দৌড়ে এসে বিশালকায় মহিষের কাছে আরজি করে:
ও মহিষ, তোর চোখের পানি কই! ইন্দুরে আমার আঙ্গুল ছোবল করে- আমার আঙ্গুলে ব্যথা- মহিষ, দে তোর চোখের পানির ফোটা- আমার আঙ্গুল ধুয়ে নিই।
আমি মহিষ নই মানুষ!
কে, কে তুমি?
আলফ্রেড পাহান।
তুমি একা বন্ধের উপর কোত্থেকে আসো!
কপালের ফের। তুমি ভয় পেয়ো না।
তোমার বাবা কুমির শাহ্'র দোহাই, ভয় পেয়ো না।
বাবা কুমির শাহ্ ! আমায় বাঁচাও বাবা।
আচ্ছা আচ্ছা গো- সবাই আমারে ডাকে মনিলতা - মনিহার।
এতো সকালে তুমি বন্ধের উপর কী করো মনিহার?
বাঁইচা থাকার বড় মায়া- তাই বিষ লৈয়া হাঁটি।
কি রকম?
আমার বাপ আছে একখান- কানা বাপ! তার আবার সিংহের গর্জন- মদ গাঞ্জা খায়- আজায়গা কুজায়গায় যায়- লোকে বলে কানাসিংহ- সব তালুকদার খনকারদের সঙ্গে ওঠাবসা- বড় বড় মানী লোকেরা সব বাবাকে নিয়ে আজাগা কুজাগায় যায় - আর বাবা চায়, আমি তাদের মন রক্ষা করি। বাবা বলে, তুমি এখন ডাগর ডোগর হয়েছো মা মনিহার- আমার দুঃখে তোমার মন কাঁদে না? আমার কাছে কতো মানীগুণী লোক আসে- কেন আসে তুমি বোঝো না? একটু ডৌলনকশা করো মা - তাহলেই আমার অর্থকষ্ট থাকে না। তুমি লায়েক হয়েছো - কেন বোঝো না মা - টাকা পয়সার কষ্ট বড় কষ্ট মা মনিহার, কন্যা আমার!
তুমি খিস্টান হবা মনিহার?
ধর্ম দিবো - কী কথা কন!
আমিও তোমার ধর্ম নিবো - সমানে সমান- কাটাকাটি।
তাতে আপনার লাভ কী?
লাভ আছে মনিহার, লাভ আছে। তার আগে মনিহার, বলো তোমার আঙ্গুলে ইন্দুরের বিষ কেন আসে?
সবকিছুর আগে মান পাহান- জান তার পরে। এই যে এই বন্ধের নানা জায়গায় কতো ছোট ছোট গর্ত।
হ, হ, এই যে গর্ত - ওই যে গর্ত- সারা মাঠে গর্ত।
এইগুলি ইন্দুরের গর্ত- অনেক গর্তে সাপও থাকে!
জানি।
মনে হয়, বাড়িতে, হাটে-ঘাটে যে সাপ কিলবিল করে! নিজের জান থাকতে ওখানে নিজেরে বিলাবো না- সাপের কাছে যদি যাই- আসল সাপের কাছে যাবো।
তোমার চোখে জল টলমল করে মনিহার।
আমি মহিষের জাত পাহান- মেয়েছেলের জাত - পানিই সার!
চোখের পানির ক্ষমতা কী!
চোখের পানির কথা বাদ দেন- এইডা একটা ঠাট্টা! সব ভুলে ইন্দুরের গর্ত থেকে ধান কুড়াই- চাউল বানাই- আহারে ক্ষুধা, দারুণ ক্ষুধা!
যদি বিষধর সাপে কামড়ায়?
বাবা কুমির শাহ্'র কাছে একটাই আরজি আমার- আমারে সাপে কাটুক পাহান!
মহিষের পাশ ঘেঁষে বসো মনিহার, মনে হয় তুমি আর মহিষ দুই বোন।
না, এখন আমার যাতি হয়।
আর ধান তুলবা না?
ওই যে দাইনশা মিয়া- চারদিকে আরো লোকের ভিড়। বাড়ি আসেন- যদি মনে লয়- আমার ভাঙ্গা ঘর!
আমি ঘরে যাই না মনিহার- আকাশের নিচে থাকি। পথে-ঘাটে ঘুরি আর তার ভাঙ্গা মুখটা খুঁজি!
আমার চেয়ে ভাঙ্গা মুখ আর কারো আছে? হাসাইলেন মিয়া- ভাঙ্গা মুখ যদি লাগে- এইখানে আসেন- হাহ্ ! কী বাহারি নাম- মনিহার- এইখানে আসেন! হ মিয়া!
যে জটলা আলফ্রেড পাহানের সামনাসামনি এসে তাকে মোকাবেলা করে সেখানে দাইনশা তো আছেই; আরো আছে নানাভাবে মুক্তিবাহিনী আফাই, চাষী হারাধন, দেড়ফুট সিরাজউদ্দৌলা, আর তিন গ্রামের নানা পদের মানুষ।
মিয়ার বেটা! এখনও দেখি গোরাডোরা বিলের পাড়ে খাড়া! কী উদ্দেশ্য, কী বিধেয় ভক্করচক্কর না করে সোজাসুজি বলো।
দাইনশা মিয়া, একটু দম নেন- দম নেন। আপনার প্রেশার আছে- মাথা চক্কর দেবে।
আমার প্রেশার আমি দেখবো- আমার জন্য তোমার এতো মায়া ফলানোর দরকার নাই।
না না আমি বলছি যে আপনি ময়মুরুব্বি মানুষ- বলছি মাথা গরম করতে হলে আপনার হয়ে আমরা মাথা গরম করি- আপনি আরাম করে গাছের মুথায় বসেন।
যতো বুড়া ভাবো অতো বুড়া আমি হই নাই, মিয়ার বেটা।
তা কী আর জানি না মনে করিছেন - নতুন বিবি আনার জন্য কোথায় কোথায় পয়গাম পাঠান সেই খবরও কানে আসে! হা হা।
শোন, আমি মশকরা পছন্দ করি না। কাজের কথায় আসো- আমার মনে হয়, এই লোকের পেটে বদ মতলব আছে!
লোকটা বিপদে পড়েছে, না হয় মাথায় ছিট আছে তার বেশি আর কী হবে!
আমি বললাম, তার মিশন খারাপ, তার পেটে দাঁত।
আমার জ্ঞান, মেধা ও অভিজ্ঞতা প্রমাণ দেয় নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রত্যক্ষ বংশধর সম্পর্কে তার কোন সম্যক ধারণাই নাই- তার উইজডম শূন্যের কোঠায়- এই ঘুন্নিলাগা বেকুব জানে না নবাব সিরাজউদ্দৌলার রক্তধারা এই গ্রামে অষ্টপ্রহর জাগ্রত; প্রয়োজন সাপেক্ষে সে তার গৃহে লুক্কায়িত বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার হস্ত স্পর্শযুক্ত দেড়ফুট তরবারি হাঁকাতেও দ্বিধা করবে না, রে অবলা পথিক!
অবশ্য কার কী মতলব আমাদের চেয়ে আপনার বেশি বোঝার কথা।
পিন মেরে কথা বলবা না মিয়া- আমারে পরিস্থিতি হেন্ডেল করতে দাও।
করেন, পরিস্থিতি হেন্ডেল করেন, আর শোনেন, আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোট- কিন্তু পরিষ্কার কানে শোনেন- বিদেশী একটা লোকের সঙ্গে উল্টাপাল্টা করবেন- বাড়াবাড়ি করবেন- একদম ভুঁড়ি নামাইয়া দিবো- যান এখন তার কী ছিঁড়বেন ছিঁড়েন- আমি খবর রাখবো!
মিয়া শোন, ধানাইপানাই করবা না- বিপদে পড়বা- আমি লোক খারাপ।
আপনি লোক ভালো।
তেল দিবা না- আমার তেলে কাজ হয় না। কী মতলবে এই বিলের মুখে ঢোকো, আর কোন সাহসে কুমির পীরের মুখের উপর ঠাসঠাস করে চেনাও তার বৃত্তান্ত বলো।
না সাব, আমি কোন মতলব করি না- শুধু একটা মানুষকে খুঁজি।
কে সে মানুষ?
লক্ষ্মী।
পুরা নাম বলো।
লক্ষ্মীরাণী বিশ্বাস- নাইপতার মেয়ে, রং ময়লা, বোঁচাবাঁচা মুখ।
তার কী বিবরণ?
আপনি শুনবেন?
হ বলো।
সামান্য বিষয়- সংক্ষেপ কথা- আপনি জানেন, যুদ্ধের সময় সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যায়- কতো লোকের কপাল পোড়ে, বিষয় সম্পত্তি হারায়, জান যায়, মান যায়। আমাদের গির্জা বড় সুনসান, অসহায়- কেউ সদা প্রভুর নামে প্রার্থনা করতে পারে না- খালি ফোঁপায়, সবাই কাঁদে।
সদা প্রভুর সাত তবক আসমান আছে, আসমানের হাতে শঙ্কিত বলিরেখা, মেঘমণ্ডল দুর্ভাগ্যের আঁচড়ের মত ছিঁড়েছিঁড়ে ভিনদেশে ভেসেভেসে যায়, আলো ক্রমে নিভিয়া আসে, সন্ধ্যা আসে, সে বুঝি সন্ধ্যা নয় আর, ভয়ার্ত, দগদগে ঘা, ভয়, আতঙ্কে মুহ্যমান সজারুর কাঁটা, হা প্রভু, প্রভু দয়াময়।
জানি মিয়া, ঘুরেফিরে সেই একই কাসুন্দি গাও।
একদিন অতিভোরে- চারদিক আস্তে আস্তে ফর্সা হতে শুরু করে- যেন প্রভু যিশু নির্মল এক শিশু সারা দুনিয়াজুড়ে হাসেন- কিন্তু হঠাৎ দেখি- মাঠের ভিতর বেজান দৌড়ে একটি মেয়ে গির্জার দিকে আসে- রেভারেন্ড যশোদার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।
ফাদার আমাকে বাঁচান!
প্রভু যিশু তোমার মঙ্গল করুন!
বেশি দেরি নেই, ওরা এক্ষুণি এসে পড়বে।
প্রভু তাদের অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন। সদা প্রভু দুষ্টচরিত দমনে সুকঠিন।
দরজা খুলুন ফাদার, বড় আশা করে আপনার কাছে আসি- আমাকে যিশুখ্রিস্টের বাণী দিন- আমাতে জল ছিটান!
তুমি ভয় পেয়ো না, সদা প্রভু তোমার সঙ্গে আছেন!
না না ফাদার আমি ভয় পাই, আমার নাম যে লক্ষ্মীরাণী বিশ্বাস।
অন্যায়কারী ধ্বংস হবে। তুমি যদ্যপি ঈগলপক্ষীর ন্যায় উচ্চে আরোহণ কর, যদ্যপি তারাগণের মধ্যে তোমার বাসা স্থাপিত হয়, তথাপি আমি তোমাকে তথা হইতে নামাইব, ইহা সদা প্রভু কহেন।
আমার নাম বদলে দিন- আমাতে জল ছিটিয়ে দিন- দরজা খুলুন প্রভু!
আমাকে তুমি সুশক্ত পরীক্ষায় ফেলো না লক্ষ্মী। তোমাকে ঘরে ঢোকালে ওরা প্রভুর ঘর তছনছ করে দেবে- তুমি শান্ত হও, মনস্থির করো- প্রভুতে সমর্পণ করো, তারপর এসো!
গির্জায় লক্ষ্মীর জায়গা হয়নি- শত বিপদের মুখে লক্ষ্মী অতঃপর অজানায় বেরিয়ে পড়ে।
বিমূর্ত এক রাত্রির নিঃসঙ্গ হিম মাটির কলস। কলসের ভিতর লুকিয়ে থাকতে বোয়াল, গজাল, চিতলের ভয়াল চোখ ফাঁকি দিয়ে এক ভয়াকুল, সন্ত্রস্ত ডানকিনা মাছ একান্তে আড়াল হতে চেয়েছিল। কিন্তু মাটির কলস সহস্র ঢেউয়ের সর্বনাশে আরো একটি নির্মম ঢেউ যোগ করে মাত্র, অসহায় আর্তনাদসংকুল ডানকিনা মাছকে কলস নিজের শীতল স্নেহের জলে জায়গা দেয়নি।
ঢেউ, ঢেউয়ের হিসিহিসানির মাঝে সংক্ষুব্ধ আরো বহু ঢেউ! ঢেউ- নাকি শঙ্খিনী সাপ ক্রোধে হিসহিস করে! হা ভগবান, হা নিসঃঙ্গ কিশোরী, হা গন্ধম, হা শিকারীর চোখ- চকচকে সুরমা, তরবারির আয়াত!
আমি কেবল সেই লক্ষ্মীকে- যে ডাল থেকে ঝড়ে খসে পড়া একটি আমের পাতা, যে এক দরজা থেকে আরেক দরজায়, অন্য দরজায় মাথা কুটে মরে, বিলাপ করে- আর বলে- ও মা, ওগো বাবা, আমার মাথার চুল দিয়ে আমারে তোমাদের পায়ের সাথে বান্ধো, বেন্ধে রাখো। দুনিয়ায় এতো আগুন- আমি আগুনের উপর দিয়ে উড়ে যাই, অগ্নির লেলিহান মুখে পড়ে ছাই, দোজখের আগুন লকলক করে- আমাকে তোমাদের পায়ে বেঁধে রাখো!
আমি কেবল ওই লক্ষ্মীকে খুঁজে পেতে চাই- আমার অন্য কোন মতলব নাই।
মিয়া যাও, যাও ভাগো; পুরান পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের ঠেলা।
আমি বলি শুনুন, ফাদার মিথ্যা কহেন। এই কারণে আমি ক্রন্দন করিতেছি; আমার চক্ষু, আমার চক্ষু জলের নির্ঝর হইয়াছে; কেননা আমি আকুল স্থিরতায় জানি তিনি উদ্ধারকারী, যিনি আমার প্রাণ ফিরাইয়া আনিবেন, তিনি আমা হইতে দূরে গিয়াছেন; আমার বালকেরা অনাথ, কারণ শত্রু বিজয়ী হইয়াছে।
ঝারিঝুরি রাখো মিয়া, বড় ঠেলা সামলাও। কাজলবানু ভাবে, তুমি জহরের ক্ষতি করে আসো- তাই তুমি বিলের পানির উপর পটপট পেচ্ছাব করার বুকের পাটা রাখো। কাজলবানু রাত্রে তোমার নামে জিনের তলব করে- তোমার মতলব ইনকোয়ারি হবে- ওই দেখ, কোনাবাড়িতে তার জোগাড়যন্ত্র চলে। ঠেলা সামলাও! যদি পারো চম্পট দাও- সন্ধ্যা ঘনাবার আগে তিনমাথার মোড় পার হও, বেআক্কেল গাবগাছের মুথা!
আজকে যারা যারা এই সাদার আসরে, নেকদার আগুনের বাসরে শরিক- তাদের সবার মন সাদা করেন- যেমন সাদা বিধবার শাড়ি, যেমন সাদা মা ফাতেমার মন, যেমন সাদা কারবালায় লাল রক্তের ধারা, তেমন সাদা সাদায় মেতে ওঠেন পীর ফকিরের নামে জগৎজোড়া একূল ওকূল!
ফুলের গন্ধ শোঁকেন; সাহস ধরেন, শৌর্য রাখেন আবুবকর উমর, বুকের ভিতর জ্বলে-নিভে গোলাপ ফুলের গুমর।
ফুলের আসন ফুলের বসন ফুলের সিংহাসন
সেই ফুলেতে বসত করেন আল্লা নিরাঞ্জন।
ফুলের আসন ফুলের বসন ফুলের সিংহাসন।
আমি পারলাম না গো বন্ধেরে আনিতে
তোমরা নি দেইখাছো আমার বন্ধেরে
কদমতলায় ফুল তুলিতে...
চকিতে একটি দীর্ঘ সাদা চাদর উড়ে আসে- কাজলবানুকে স্পর্শ করে সে-যে শূন্যেতে মিলায়।
কী ধারণা হয় লতিনূর? আপনি তো জিন লতিনূর, না অন্য কেউ?
জি আমি লতিনূর।
বহুদিন থেকে আপনিই আবির্ভাব হচ্ছেন- আপনি দয়াবতী, কল্যাণকারী।
যে অজানা মানুষ বিলের মুখে মূত্রত্যাগ করে, তার বিষয় আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে- নিপতিত করে। আপনি কী সন্দর্শন প্রাপ্ত হোন?
তার সঙ্গে জহরের কোন যোগ নাই- জহরকে এখনো আলাজিলা দেখতে পাই- চিম্বুক পাহাড়ের সিথান বরাবর- যোগিনীর হাতে ন্যস্ত- একদিন জহর আসবে, আসবে।
জহরের জন্য সারাজীবন ম্যাচবাত্তির লাহান পুড়াইয়া দিলাম- কও দেখি, তার ফল কী! আগুন আর মাটির খেলা- বিজলি আর পোড়া তালগাছের লেনাদেনা- আমি মৃত্তিকা বরাবর, আমি তালগাছ দুলি- হেলিদুলি তবু মটকাই না- কতো বছর আগে, মনে হয় শত বছর, যেমন ছিলাম, জহরের জন্য নেশা করছি- এখনো নেশা গেল না, ঘোর কাটে নাই। কতদিন আগের কথা: ভাবি, দড়ি দিয়া হাতি বান্ধা যায় ছোটোমোটো মন তো বান্ধা যায় না; আমার ঘরে ভাঙ্গা খিরকি- তার ভেতর পাগলা চান্নি হুড়মুড় করে ঢোকে, আর কার লাগি মন আমার শঙ্খিনী সাপের লাহান ফণা তুলে দোলে-
শোন তাজেল গো..
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে প্রেমে মইজো না..
এতো রাতে জহর পানের বরজ থেকে আসে, ঘোরে ঘোরে হাঁটে- আমি তার পথ আগলে দাঁড়াই-
হেই, হেই কেডায়, রাত্রি নিশিতে ঢিল মারে কেডায়!
আমি!
কেডায়, নাম কী হয়?
ও নেশায় পড়ছো, ঘুনে ধরছে- তাই আমারে চেনো না! চোখ খুলে চাও- দেখো আমি কেডায়- আমি তোমার কাজল গো- নয়ন মাঝে পরো- আমি কাজলবানু!
এতো রাতে তুমি কী চাও?
তোমারে খুন করবার চাই।
এই কী কও, কী কও তোমার মাথা খারাপ হয়?
তুমি মাটির মানুষ- মাটিতে শোয়াইয়া দিয়া দেশান্তর হবো- জেল জরিমানা খাটবো। তোমার নাম লইয়া কানবো!
আমারে মাফ করো কাজল!
মাফ করার জন্য তো তোমার পথ আটকাই নাই- আসমান দিয়ে উড়ে এসে পানক্ষেতের উপর বসে যে জরিনা- আমার সঙ্গে তার কী তুলনা!
সে আকাশের পরী- মাটির মানুষ তুমি তার মর্ম কী-বা জানো!
তুমি অন্ধ হইছো জহর- চোখ খুলে দেখো- মাটিতে আমি এক সোনার খনি- ধুলাবালুর মায়া- জহর, আমি সত্য, তিন সত্য- আমার চোখের পানি খাঁটি, শরীরকাঁপা ঘাম খাঁটি- একবার মায়া বসাইয়া দেখো!
কাজল, জরিনার সঙ্গে তুমি মাটির মানুষ তোমার তুলনা হয় কিসে! জরিনার শরীরে দারুচিনির ঘ্রাণ,হাঁটাচালায় ওড়ার মাঝে চন্দ্রতারার ধুলা!
আমারে হাসাও কেন নাগর! আমার সাথে তার তুলনা নাই- আমার দেহ মাটি আর আগুনের মিশামিশি।
পথ ছেড়ে দাঁড়াও কাজল!
না, সরবো না। আজ এইপার কী ওইপার করবো।
তোমার হাতে ওটা কী- তারার মতোন ঝকমক করে!
আমার মতোন খাঁটি- তিন সত্য খাঁটি- দেখো এই দা ঝকমক করে!
দা দিয়া কী করবা?
এক কোপে তোমারে দুই ভাগ করবো- এক ভাগ আমার, আরেক ভাগও আমার, তুমি সবটুকু আমার- এই দেখো, আমি মা কালির শক্তি নিয়া খাড়াই!
কাজল, আমার কথা শোন কাজল!
ভয় নাই জহর, আজ মারবো না- যাও, ঘরে যাও। আইসো, আমার শরীরে নিশিন্দার ঘেরান আছে- আমার ঘরে আইসো জহর!
সেই রাতে জহর শরীরের ঘাম মোছারও সময় পায়নি। কাজল বানুর বাড়ির সামনে থেকে ঢালুতে নামার সঙ্গেসঙ্গে বোঝে সে সূর্যালি বাড়ির গোপাট বরাবর হাঁটে- কিন্তু বুঝতে পারে না হঠাৎ করে আজ গোপাটের উপর বটগাছ কোত্থেকে জন্মায়, সবকিছু পরিষ্কার বোঝা না বোঝার মাঝখানে সে বাড়ি এসে পৌঁছে।
তার দরোজার সামনে জহর দ্যাখে আরেকটি বটগাছ- না, না এ-তো বটগাছ নয়- তার মা কুরুমনি।
নে বাবা ধর।
এটা কি মা?
ধর বাবা, তাড়াতাড়ি কর, হাতে সময় বেশি নাই। আরেকটু বাদেই সুবেহ সাদেকের ফর্সা দেখা দেবে-তার আগেই তুমি মাঠ পার হও বাবা।
কোথায় যাবো?
তুমি ঘোরের ভিতর থাকো জহর, তাই কিছু টের পাও না।
কি টের পাবো?
দেশে মহিষে-বাঘে লড়াই শুরু হয়েছে- আমি খোয়াবে দেখি বাঘ-মহিষের লড়াই: আমরা মহিষ। মহিষের রক্ত আর চোখের পানি এক সাথে মিশে ছলাৎছল করে- আমি খোয়াব দেখি!
তার আমি কী করবো!
আমি তোমার মা- কিন্তু তার থেকেও বড় মা তোমার দেশ- দেশের আজ লাঞ্ছনা হয়- তুমি তার মান রক্ষা করো, যুদ্ধে সামিল হও। এই নাও পোঁটলা। এর ভিতর তোমার সামান্য জামাকাপড়, আর আমার বিয়ের গজমতি হার- বিপদে পড়লে খরচ করো, দেরি করো না।
যাই মা।
আর তোমার কিসের ভয়, দেশ স্বাধীন হলে তুমি জরিনার পাখে চড়ে বাড়ি ফিরে আসো। পরীর সঙ্গে তোমার বিয়ের সবই ঠিকঠাক। যাও বাবা!
আমি জানি, কোন সেই পরী। সময় আসুক। সব খুলে কবো। ঘরের পালা কাইটা যেমন বাবা মেয়ের বিয়ের লাগি টাকা জমায়- আমিও আমার বুকের সিন্দুকে লুকায়ে রাখছি একখান পরী- বাবা তোমার লাগি, সময় হলেই দেখতে পাবে। হা হা।
যোজনগন্ধা মায়া ২
দেশ যখন স্বাধীন হয় কুরুমনির সে-কি ছটফটানি- খলিফাকে নোতুন জামা বানাবার কথা বলে তো মনজিলাকে বলে: মনজিলা, মনজিলা কাল, না হয় কাল বাদে পরশু আমার ঘরে এসে পানসুপারি কেটো, জারু মিয়াকে খবর দিয়েছি, সে একখান পালা-ও করুক, কি বলো- ম্যালাদিন ভালোমন্দ কিছু খাই না, ক্ষুদের মা-কেও নিয়ে আসো- ডিমের ছালুন সবাই একসাথে বসে খাবো!
কুরুমনির জন্য কাল, কাল দিন বাদে পরশু আর আসে না। রেদুয়ান আসে, চান্দু আবার কলেজে যাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে; হাসান এসে কুরুমনিকে বলে যে, মেঘালয়ে বিভা সাংমার শিবিরে জহরের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল- জহর বলে সাতদিন পর সে বর্ডার ক্রস করবে! তাহলে কী জহর এখনো পাটগ্রামের বর্ডার ক্রস করেনি?
একদিন, একমাস, এক বৎসর, তিন বছর, পাঁচ বছর, সাত বছর, দশ বছর পেরোয়- আরো কতোদিন যায়!
কুরুমনি দ্যাখে: দিন পাল্টায়, মানুষ বদলায়, চোখের সামনে ছায়া মিলায়, এখন তো গ্রাম থেকে কেউ আর গরুর গাড়ি করে গঞ্জে যায় না- ঘর থেকে বেরোনো মাত্র ভটভটি- শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন- ধপাধপ যায় আসে- কুরুমনিকে কেউ মুখের কথাটিও জিজ্ঞেস করে না। নদীর উপর লম্বা ব্রিজ হয় কতো বড়- কিন্তু কুরুমনি যখন নদীর দীঘল বরাবর জহরের ফেরার আশায় চেয়ে থাকে- সে দ্যাখে নৌকাগুলোর গতি, নৌকা তো এখন তেমন নেই-ও, কুরুমনি ভাবে, তার জহর নৌকায় করে আসবে, প্রতিরোজ জানালার বাইরে নৌকাগুলি গুণে গুণে দ্যাখে:
এক জোনাকি দুই জোনাকি তিন জোনাকি ওড়ে
তোমার লাগি বন্ধু আমার মন যে কেমন করে।
এক জোনাকি দুই জোনাকি তিন জোনাকি ওড়ে।
এক পহর দুই পহর তিন পহর রাতি
তোমার লাগি বন্ধু আমার ঘরে জ্বলছে বাতি।
এক ফসলা দুই ফসলা তিন ফসলা ঝরে
তোমার লাগি বন্ধু আমার পরাণ কাঁপে ডরে।
এক আশিন দুই আশিন তিন আশিন গেলো
তোমার লাগি বন্ধু আমার বসন এলোমেলো।
শেষমেষ কুরুমনি সবাইকে ডেকে বলে, শোন সকলে, আর হবে না গো- আমার দিন যে শেষ হয়ে আসে- চোখে আর দেখতে পাই না, কানেও শুনি না।
কুরুমনিকে আর কেউ কিছু বলে না- সবাই ঘাড় নিচু করে রাখে।
জহর আসলে বলো- আমি আমার বিয়ের শাড়ি জহরের পরীবউ-এর লাগি রেখে গেলাম- মলমল খাস শাড়ি! কী যে সুন্দর লাগবে আমার উঠানজুড়ে পরীবউ! কী সুন্দর!
শোন সকলে। আমার মন সাক্ষী দেয়- আজ রাতে আমার জন্য আজরাইল আসবে- আর পারি না- আমি হাসতে হাসতে যাবো! ভয় কিসের! বাবা কুমির পীরের রাজ্যে আমার বাস- কতো তার মাজেজা- বাবা কুমির শাহ্ জীবিত ছিলেন ১২০ বৎসর। এই ১২০ বছরের জীবনের সবটাই মৃত জিন্দেগি- মানুষটি জীবিত, কিন্তু জীবন্মৃত। অথচ কী আচানক! যেদিন মারা গেলেন- সেইদিন কবরের পাড় থেকে কুমির রূপে বিলে গিয়ে নামেন- সেদিন থেকে আমাদের সব ভার তিনার উপর।
আমার কিসের ডর!
কুমির বুঝি কুমির নয়- মাটির আসমানের উপর পতপত করে উড়ে যায় এক সাপা ঘুড্ডি-
ঘুড্ডি কে বানাইলো রে কামেলা রইলো কই
দেখিয়া রঙ্গিলা ঘুড্ডি আমি ধান্ধা খাইয়া রই।।
কুরুমনি রাতে শোনে কে যেন তার দরজায় কড়া নাড়ে। কুরুমনি দরজায় আজরাইল ফেরেশতাকে আশা করে। দরজা খোলে। কুরুমনি দ্যাখে: কোত্থেকে উঠান আলো করে চাঁদের আলোয় ফুল আর নীরবতার আসর ঝেঁকে বসে। তার উপর অধরা ধ্বনির কেশরে সারাদুনিয়া কই থেকে কই ভেসে যায়! তামাম জগতের আসরে সহস্র ঘোড়া উড়ে যায় - চিঁহি। চিঁহি! নীলিমার মগডাল থেকে একটি কাঁচা, লাল রঙের ফোঁটা, না-কী এক তিরতির কাঁপা উড়নি উঠানজুড়ে নামে!
কুরুমনি বুঝে উঠতে পারে না- একফোঁটা লাল রং, একটি উড়ে আসা উড়নি- জহর, হায় তুমি কী জহর!
অলংকরণঃ তাইফ আদনান