পরশু রাতে তোমাকে টেলিফোনে আসল কথাগুলোই বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম পরে একবার না হয় ফোনে তোমায় বিস্তারিত জানিয়ে দেব। কিন্তু সেটাও হ’ল না। অথচ ব্যাপারটা তোমায় জানাতেই হবে এবং সেকারণেই আমার এই চিঠির অবতারণা।
নিরুদ্দেশ হবার আগে শেষ যে শনিবার দেবেশ আমার চেম্বারে আসে সেদিন আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল খুব কম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ও সেদিন কি বলতে চেয়েছিল এখন বুঝতে পারছি। দেবেশের চোখে মুখে সেদিন অদ্ভুত রকমের সংশয় আমি লক্ষ্য করেছিলাম। দামানী ইন্ড্রাস্টিজের কথা তোমার মনে আছে অতসী? তোমাদের বিয়ের আগের ঘটনা। দেবেশ তখন মন্ত্রীর সি.এ। লকআউট নিয়ে দামানীর ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সাথে দেবেশ কম্প্রোমাইজ করে বসল। দেবেশের সেই সময়কার চোখে মুখের চেহারার সাথে আমাদের শেষ সাক্ষাতের মুখচ্ছবিটার ভীষণ মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম।
পুরোন অনেক কথাই মনে পড়ছে। একদিন কি হয়েছিল বলি শোন। সন্ধ্যে নাগাদ চেম্বারে বসে আছি, হঠাৎ দেবেশ এসে হাজির। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। কেননা শনিবার ছাড়া দেবেশ সচরাচর আমার চেম্বারে আসে না। প্রশ্ন করলাম –কি ব্যাপার হঠাৎ চলে এলি, এনি প্রবলেম?
-আমি ধরা পড়ে গিয়েছি মৃগাঙ্ক।
-সে কি! কার কাছে ধরা পরলি? বউ এর হাতে হলে আমার কিছু করার নেই। অন্য কিছু হলে আমি আছি।
-বউ নয় রে দোস্ত। ধরা বোধহয় পড়ে যাচ্ছি ছেলের কাছে। বাবিন আমার প্রোফাইল খুলে সব দেখে নিয়েছে।
-ছেলে বাবার প্রোফাইলে হাত দেয় কি করে? তোর পাসওয়ার্ড ও জানে তাহলে!
-আজ-কালকার ছেলে।কম্পিউটার গেম খেলতে খেলতে কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছে কে জানে!
-ছেলে বাবার ফান্ড স্ট্যাটাস জানল তো কোন মহাভারত অশুদ্ধ হ’ল। আজ না হোক কাল জানবেই।
এরপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীমায় দেবেশের অট্টহাসি। খানিক সময় জমিয়ে আড্ডা মেরে চলে গেল। যুবক বয়সে ওর মতো আড্ডাবাজ বন্ধু আমাদের খুব কমই ছিল। ডানপিটে স্বভাব শুধু নয় দূর্জয় সাহস ছিল ওর। যেমন ধরো তোমাদের সম্পর্কটা নিয়ে তোমাদের বাড়িতে তো যথেষ্টই আপত্তি ছিল। তোমাদের ফ্যামিলি একটু অর্থোডক্স টাইপের এবং সেজন্য অনেক মানসিক নির্যাতন তোমায় সহ্য করতে হয়েছে দেবেশেকে নিয়ে। শেষমেশ তোমার দাদা যেদিন তোমাকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করল দেবেশ সেদিন মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। মোটর সাইকেল নিয়ে সোজা তোমাদের বাড়িতে ঢুকে তোমাকে নিয়ে চলে এল। তখন ওর আয় বলতে তো কিছুই ছিল না। হিম্মৎ দেখিয়েছিল বটে দেবেশ। একটা কথা না বলে পারছি না। ভালো না মন্দ সেটা পরের কথা কিন্তু ওর মধ্যে এমন কিছু কোয়ালিটি ছিল যেটা আমাদের কারোর ছিল না। ওর লীডারশিপ কোয়ালিটি ছিল দেখবার মতো এবং সবাই ওকে মেনেও নিত। এরকম টুকরো টুকরো অনেক কথা মনে পড়ছে। সামনাসামনি সেসব কথা তোমাকে কোনদিনই আর বলা সম্ভব হবে বলে মনে হয়না। আমার কি মনে হয় জানো অতসী, পার্টি ছেড়ে দেওয়াটা দেবেশের মস্ত বড় ভুল হয়েছিল। একটা সময় ওর প্রফেশন নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছিল। পার্টি ওকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিল। আমি জানিনা সে কারণেই দেবেশ দল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল কিনা। তবে আমার এখনও মনে হয় দেবেশ যদি মাটি কামড়ে পড়ে থাকতো তাহলে ঠিক আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারতো। অতীনকে দেখলে তো! কোন রকম ঝুট ঝামেলায় না গিয়ে একেবারে পার্টি অন্ত প্রাণ। ইদানীং অতীন যখন পলিটিক্যাল টক শো অ্যাটেন্ড করে তখন আমি দেবেশের কথা ভাবি। কোথায় দেবেশ আর কথায় অতীন! এই দ্যখো, সেই রাজনীতির কচকচানি শুরু করে দিয়েছি। এসব কথা বলেই বা কি হবে এখন!
দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেল তাই না। তোমার মতন আমারও খুব মনে হতো যে দেবেশ একদিন ঠিক ঘরে ফিরবেই। অন্তত তোমাদের সন্তান বাবিনের কথা ভেবে দেবেশকে ফিরতেই হবে। বাবিনের কথা ভাবতেই আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কথাচ্ছলে দেবেশ একদিন বেশ গর্ব করেই বলছিল –বাবিন আমায় কি বলে জানিস মৃগাঙ্ক। ড্যাড তুমি কি ভালো। আমার জন্য কোন কিছুর ফাঁক রাখনি। আমি রাত পর্যন্ত পড়াশুনো করলে তুমিও জেগে থাক। বসার ঘরে বসে পেপার আর বই পড়। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ ড্যাড।
শুনে আমি সেদিন বলেছিলাম –দ্যাখ তাহলে, ছেলে তোকে কি চোখে দ্যাখে এবং রেসপেক্ট করে। দেবেশ হারামজাদা কি উত্তর দিয়েছিল জান?-বেশি বকিস না। যদি কোন দিন জানতে পারে যে ওর মাকে আমি একরকম তুলে এনে বিয়ে করেছিলাম তাহলে সব চৌপাট হয়ে যাবে।
মাঝে মাঝে দেবেশকে নিয়ে আমার মনে নানারকম প্রশ্ন জাগত। বাবিন কি দেবেশের অনৈতিক অথবা অবৈধ কোন যোগাযোগের বিষয় জেনে ফেলেছে? সেকারণেই কি দেবেশ নিরুদ্দেশ? আবার পর মুহূর্তেই ভেবেছি, জানলেই বা কি এসে যায়! বাবা হিসেবে দেবেশের তো কোন ঘাটতি নেই। সন্তানের জন্য বাবা মায়েরা আজ যা নয় তাই করছে। সেদিক থেকে দেবেশকে কিছুই বলার নেই। আর লেনাদেনার ব্যাপারেও দেবেশ বরাবরের হিসেবী এবং সাবধানী। দশ হাতে পেলে ছয় নিজের চার অন্যদের। রিয়েল এস্টেট ব্যবসার জন্য দেবেশ যতগুলো জমি টেকওভার করেছে অথবা ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভার করেছে সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন হয়েছে আমার হাতে।
একটা দারুণ ইনটারেস্টিং ঘটনার কথা এবার বলি শোন। জমি, বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট নিজের পরিবর্তে অনেকেই মিসেসের নামে কিনতে পছন্দ করেন। অবাঙ্গালি এক পরিবার, পদবী দামোদরন। ভদ্রলোক মিসেসের নামে ফ্ল্যাট বুক করবেন। আইনি ভাষায় বিবাহিত মহিলাদের পেশা আমরা হাউস-ওয়াইফ লিখতেই অভ্যস্ত। মিসেস দামোদরনের পেশা হাউস-ওয়াইফ লিখেছি এমন সময় দেবেশ ইন্টারপ্ট করে বসল।
-ঘরের বউরা কি শুধু হাউস-ওয়াইফ মৃগাঙ্ক? ওরা সারাটা দিন ফ্যামিলির জন্য চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকে। কত স্যাক্রিফাইস ওদের! আর আমরা ওদের স্যাক্রিফাইসের রিওয়ার্ড দিচ্ছি একটি মাত্র শব্দে- হাউসওয়াইফ!
সেদিন আমি অনেকক্ষণ দেবেশের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। উপলব্ধি করেছিলাম তোমার প্রতি দেবেশের কি গভীর শ্রদ্ধা। মিসেস দামোদরনের পেশা বাধ্য ছেলের মতন লিখে দিয়েছিলাম –“হাউসহোল্ড ডিউটি”। আমার স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে গৃহবধূদের সম্পর্কে সমাজে যে প্রচলিত ধারণা আমিও তার বশবর্তী ছিলাম। আক্ষরিক অর্থে সেদিন দেবেশ আমার চোখ খুলে দেয়। সত্যিই তো, ঘরের বাইরে বের হওয়াটাই একটা রিক্রিয়েশন। বাইরে বেরোব, সাজগোজ করব। দশজনকে দেখব আমায় দশজন দেখবে, এসবেই কত আনন্দ। অন্যদিকে ঘরের গিন্নিদের সারাদিন হেঁসেল ঠেলা আর ঘরকন্না নিয়ে ডুবে থাকা। কিন্তু এহেন দেবেশ কোন অসতর্ক মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সেটাই আমার কাছে লাখ টাকার প্রশ্ন। ব্যাপারটা তোমাকে জানানো এবার অনেকটা সহজ হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে।
পরশু রাতে তোমায় ফোন করেছিলাম, কিন্তু বলতে পারিনি। তোমার পিসতুতো ভাই জামনগরের যে রেফারেন্সটা দিয়েছিল সেখানে আমি খোঁজ নিয়েছি। ইনফরমেশন ইজ হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট। “নির্মল নিলয়” নামে জামনগরের একটা এন জি ও তে দেবেশ বছর খানেক যাবৎ এনগেজড। এইচ আই ভি পজিটিভদের নিয়ে নির্মল নিলয় খুব ভালো কাজ করছে। দেবেশের সাথে টেলিফোনে আমার কথা হয়েছে অতসী। সামান্য কয়েকটি কথাই ও অবশ্য বলেছে। পৃথিবীটা ওর কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে অতসী। খুব বেশি হলে মাস ছয়েক। দেবেশ ইজ অলসো এইচ আইভি পজিটিভ।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান