জলধি / গল্প / স্টিলের আলমারী
Share:
স্টিলের আলমারী

কালো লোকটা খালি গলায় গান গাইছে। কোন বাদ্যযন্ত্র নেই। সাবওয়ে স্টেশনের শিল্পীরা একদম ফ্যালনা না। অনেকের দামী যন্ত্রানুসঙ্গ থাকে। রেকর্ড প্লেয়ার, সাউন্ডবক্স, মাইক্রোফোন অনেক কিছু। ওই লোকটার সাথে কিছুই নেই।

মাঝবয়সী কালো লোকটার জন্য রাখীর খুব খারাপ লাগে। লোকটা এমন নি:স্ব কেন? রাখী নিজে নি:স্ব বলে অন্যের দীনতা ওকে বেশী স্পর্শ করে। আজ যেন ওর কি হয়েছে। একটুতেই মন দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণটা ভালো না। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার আলামত। লোকটা গাইছেও একটা বিষণ্ণ গান। রাখীর এখন যে মনের অবস্থা সেটা নাটক বা সিনেমার দৃশ্য হলে আবহ সঙ্গীতে বিষাদগীতিই থাকতো।

কালো লোকটার সামনে একটা ডানকিন ডোনাট লেখা ঠোঙ্গা। ওটা রাখা হয়েছে কিছু ডলার পাবার আশায়। এসব ঠোঙ্গা জাতীয় কিছু দেখলে দেখেও না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি চলে যায় রাখী। আজ তেমন করল না। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ডলার ফেলল। সামান্য এক ডলার। তাতেই দেখল, কালো লোকটার মুখে কেমন আনন্দের রক্তিম আভা।

কালো মানুষের ‍মুখ আসলে খুব স্বচ্ছ। সব ধরনের অনুভূতি সহজে অভিব্যক্ত হয়। রাখী আগে দেখতে শ্যামলা ছিল। তবে এদেশে আসার পরে মুখ কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত শীতল আবহাওয়া ওকে মানিয়েছে হয়ত। বাংলাদেশে থাকতে নিজের গায়ের রঙের জন্য হীনমন্যতায় ভুগতে হত ওকে। কল্লোল ছিল অতিরিক্ত রকম ফর্সা। বাংলাদেশে এত ফর্সা পুরুষ সচরাচর দেখা যায় না। ফর্সা স্বামীর পাশে শ্যামলা স্ত্রী বেশ বেমানান লাগতো।

বিকাল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ম্যানহাটনের লেক্সিংটন ফিফটি ফার্স্ট সাবওয়ে স্টেশন। সিক্স ট্রেন প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করলে অন্যমনস্ক ভাবে নেমেছিল রাখী। ধীরে পায়ে হাঁটতে শুরু করে তারপর। ৩৭ বছর বয়সী না তরুণী, না মধ্যবয়সী এক নারী রাখী। লম্বায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফিট। শরীরে কোন মেদ নেই। যে কারনে দেখতে কম বয়সী লাগে। ম্যানহাটনের সেকেন্ড এভিনিউর টুয়েন্টি থার্ড স্ট্রিটে ইতালিয়ান এক রেস্টুরেন্টে চাকরী করে। বেতনের পাশাপাশি টিপস যা পাওয়া যায় তাতে ওর ভালো চলে যায়।

লেক্সিংটনের এই সাবওয়ে স্টেশন ধরে হাঁটলে দেয়ালের শিল্পকর্মের দিকে সব সময় ওর নজর চলে যায়। শৈশব থেকে চিত্রকলার দিকে আগ্রহ ছিল রাখীর। ছবি আঁকত রঙ তুলি দিয়ে। জ্যামাইকায় যে বাসায় এক রুমের সাবলেট নিয়ে থাকে সেখানেও ছবি আঁকার সব সরঞ্জাম কিনেছে। রুমটা চাইলে ওর মতো একা কোন মহিলার সঙ্গে শেয়ার করতে পারতো রাখী।  ও সেটা করেনি। ডলার জমানোর নেশা ওর নেই। আর কার জন্যেই জমাবে! কাজ শেষে বাড়ী ফিরে একা ঘরে মাঝে মধ্যে কাগজ আর রঙ তুলি নিয়ে বসে। হৃদয়ের সব আকুলতা মেলে ধরে ইজেলে।  কিছু একটা নিয়ে বেঁচে তো থাকতে হবে ওকে।

ডিজাইনিংয়ের ওপর পড়াশুনা করেছিল রাখী। ঢাকায় থাকাকালীন বুটিক শপ দিয়েছিল মিরপুর দশ নম্বর গোলচত্বরের কাছে। জায়গাটা তখন দারুন জমজমাট। এখনও সেরকম আছে কিনা জানেনা ও। একটু হেঁটে গেলে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়াম। তার পিছনের দিকে পল্লবীতে এক এপার্টমেন্টে ছিল ওর দারুন সাজানো গোছানো সংসার।

আজ কোন শিল্পকর্মের দিকে চোখ গেল না। আসলে দেখার সময় মিলল না।মোড় ঘুরতেই কালো লোকটার খালি গলায় গান সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিল। জানে আজ দিনটাই আচমকা আবেগী ভাবনার ফাঁদে পা দেয়ার দিন।

জীবনে কম পরিশ্রম করেনি রাখী। কত কোর্স করেছে। জীবনে বলার মতো কিছু হতে পারেনি। অতি আবেগের কারনে গুছিয়ে কোন কাজই করা হয়নি। কল্লোলের সাফল্যের সঙ্গী হতে চেয়েছিল।  হতেও পেরেছিল। কল্লোল আর একমাত্র কন্যা মেঘলা ছিল ওর পুরো পৃথিবী।  কত জায়গায় ‍ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাট সাজিয়েছে। ড্রইং রুমের সব আসবাবপত্র ছিল বেতের। ডাইনিং রুম সাজিয়েছিল কালো রডের আসবাবপত্র দিয়ে। বেডরুম ছিল কালো রঙ করা কাঠের ফার্নিচারের। বাসায় কেউ এলে রাখীর রূচির প্রশংসায় মুখর হত!

সাজানো গোছানো সেই ফ্ল্যাটে আজ থেকে অন্য কেউ বাস করবে!

কালো লোকটাকে অতিক্রম করে রাখী। সবাই ছুটছে যে যার মতো। কেউ একা। কেউ সঙ্গীসহ। রাখী একা, আবার একা না। ভাবনা হল ওর সঙ্গী। সারাক্ষণই লেগে থাকে দ্বিতীয় সত্তার মতো। এই যেমন রেলস্টেশনে এলে ওর বার বার মনে হয় বিটিভির সাদাকালো যুগের একটা নাটকের কথা। নাটকের নাম ছিল শুভ্র-সুন্দর-কল্যাণী-আনন্দ। আধা ভৌতিক এক নাটক। দুইজন পুরুষ ও দুইজন নারী একটা রেলস্টেশনে এসে আটকা পড়েছে। গন্তব্যে যাবার কোন ট্রেন নেই। আবার যেখান থেকে এসেছে সেখানেও ফিরে যাবার কোন ট্রেন নেই। ওদের আমৃত্যু থাকতে হবে ওই স্টেশনের ওয়েটিং রুমে।

নাটকটা দেখে কিশোর বয়সে কেমন ভয় মিশ্রিত অনুভূতি হয়েছিল রাখীর। কোন রেলস্টেশনে গেলে অনুভূতিটা ফিরে আসতো। মনে হত সেখানে চিরদিনের জন্য থেকে যেতে হবে ওকে। এখন আর সেই ভয়টা তাড়া করে না রাখীর। জীবনের প্রতি কি তাহলে বৈরাগ্য চলে এসেছে ওর! যে জীবনের কোন গন্তব্য নেই, ফিরে যাবার কোন জায়গা নেই, সে তো একটা স্টেশনেই বন্দী হয়ে গেছে।

লেক্সিংটনের এই স্টেশনটা যদি এভাবে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, তাহলে খারাপ হত না। কল্লোল নামে কেউ আর থাকতো না ওর জীবনে। রাখী আজও ভেবে পায়না কল্লোল ওকে ডিভোর্স করার কথা ভাববে! খুচরা দুই একটা সম্পর্ক সব পুরুষ মানুষের থাকে। রাখী সেটা টের পেয়ে বুঝতে দিত না। ভালোবাসায় ওর বিশ্বাস ছিল। একটা সময়ে ভালোবাসা শুন্যে গিয়ে ঠেকল। রাখীর থাকা না থাকা কোন অনভূতির জন্ম দিত না কল্লোলের মনে। এক আর্টিস্ট বন্ধুর সঙ্গে রাখীকে জড়িয়ে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করল। কল্লোলের আসলে একটা অজুহাতের দরকার ছিল, যাতে সম্পর্কটা ছিন্ন করা যায়।

দীর্ঘ এস্কিলেটর থেকে নামার সময় পেটের মধ্যে কেমন শুন্যতার বোধ হল। এত লোক নামছে, উঠছে, জীবন থেমে থাকে না কারো জন্য। এই যে ও দেড় বছরের মত হল চলে এল ঢাকা থেকে, কোন কিছুই থেমে থাকেনি। মাকে জড়িয়ে ধরতে না পারলে মেঘলার ঘুম আসতো না। সে এখন বাবার  সাথে দিব্যি আছে। নতুন শহরে মায়ের সংগ্রাম তাকে স্পর্শ করেনা। কখনও জানতে চায় না, মা তুমি ওখানে কি কর? এক থাক বলে খারাপ লাগে কিনা! আমার কথা মনে হয় কিনা!

প্ল্যাটফর্মে এসে কুইন্সগামী ট্রেনের অপেক্ষামান যাত্রীদের সাথে দাঁড়ায় রাখী। যাত্রীরা ছাড়াও বহু লোকজন চারপাশে। এক চাইনীজ লোক চাবি দেয়া পুতুল বিক্রি করছে। দূরে এক বয়স্ক লোক বসে আছে প্ল্যাকার্ড হাতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত যুদ্ধাহত সৈনিক হবে মনে হচ্ছে। পুরো পটভূমি যেন কেমন খাপছাড়া। রাখীর হৃদয়ে ওঠা ঝড়ের মতো।

একটা স্টিলের আলমারীর ছবি পাল্টে দিল ওর সমস্ত দিনটাকে।

বাবা-মা বিয়ে মেনে না নেবার কারনে বাড়ী থেকে পালিয়েছিল রাখী। বিয়ের সময় কল্লোল একটা প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ছিল।  পরে বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়। ‍গুরুত্বহীন জামাই হয়ে যায় তখন রাখীর বাবা-মায়ের চোখের মনি। এখন সে যুগ্ম সচিব। উচুঁ পদে থাকা জামাইকে নিয়ে গর্ব করতে চেয়েছিল রাখীর বাবা-মা। সেটা করতে না পেরে সব দোষ এখন মেয়ের।

বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের পরে কিছুই নেয়নি রাখী। সারাজীবন ওর আত্নসম্মানবোধ খুব প্রবলশুধু চেয়েছিল ওকে তারা বুঝতে পারুক। সেটা যে হয়নি তাতে বিস্মিত নয় রাখী। কারণ ও জানতো ঘটনা এমনই ঘটবে। কল্লোলের সঙ্গে বাড়ী পালানোর সময় নিজের অনেক কিছু ফেলে এসেছিল রাখী। কল্লোল জানতে চেয়েছিল, ‘কি বলছ, তোমার ব্যবহারের জিনিষ নেবেনা?’ রাখী মৃদ্ হেসেছিল। এসএসসি পাশ করার পর থেকে ও টিউশুনি করতো। সেই টাকায় কেনা কয়েকটা সালোয়ার-কামিজ আর দুইটা শাড়ি শুধু নিয়েছিল রাখী।

আর নিয়েছিল জমানো দুই হাজার টাকার প্রাইজবন্ড।

একটা খাট আর ওয়ার্ডড্রোব কল্লোলের আগে কেনা ছিল। টিভিও ছিল। পিকনিকে গিয়ে লটারিতে টিভি পেয়েছিল কল্লোল। ওর লটারি ভা্গ্য খুব ভালো ছিল। আসলে ওর সব কিছুতে ভাগ্য খুব প্রসন্ন। যেটাই করত সাফল্য পেত।

বিয়ের পরে ওদের নতুন সংসারে প্রথম ফার্নিচার ছিল একটা স্টিলের আলমারী। দুজনে মিলে কাজী পাড়ায় ফার্নিচারের মার্কেট থেকে আলমারীটা কিনেছিল ওরা। সেদিন এত খুশী লেগেছিল রাখীর যে বলার নয়! আনন্দে ওর মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ওর নতুন সংসারে প্রথম কোন দামী জিনিষ। সেটাও আবার রাখীর অনেকদিনের জমানো প্রাইজবন্ড ভাঙ্গিয়ে পাওয়া টাকায় কেনা!

তখন ওদের সাদামাটা ঘরে আভিজাত্য এনে দিয়েছিল সবুজ রঙের স্টিলের আলমারীটা। রাখী আর কল্লোলের দুজনের প্রিয় রঙ ছিল হালকা গোলাপী। রাখীর বেশীরভাগ পোষাক ছিল যে কারনে ওই রঙের। আলমারীর প্রথম তাকে সেগুলি সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছিল ও। পরের তাকে কল্লোলের শার্ট-প্যান্ট। তৃতীয় তাকে রাখীর প্রিয় কবির কবিতার বই। স্টিলের আলমারিটা বাসায় আনার প্রথমে দিনেই সুটকেস থেকে সব জিনিষ বের করে সাজিয়ে ফেলেছিল ও। চতূর্থ তাক আর সিন্দুক ছিল তখনও খালি।

দিনের মধ্যে কতবার যে আলমারিটা খুলতো আর লাগাতো রাখী। আনন্দের আবেশে মনটা বুদ হয়ে থাকতো। মনে হত ওর চেয়ে ধনী বুঝি পৃথিবীতে নেই!  কল্লোল তখন হাসতো। জিজ্ঞাসা করতো, ‘কি দেখ সারাদিন আলমারী খুলে ?’

 রাখী ছুটে গিয়ে কল্লোলের হাত ধরে আলমারীর সামনে দাঁড় করায়। ‘এই যে এই তাকে আমার কাপড় রেখেছি, এটার আমি নাম দিয়েছি- গোলাপী আহলাদ’।

কল্লোল হেসে বাঁচে না। ‘ভালো নাম দিয়েছ তো তুমি!। আর আমার পোষাক যে তাকে তার কি নাম?’ ‘ভালোবাসা’ কল্লোলকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল রাখী। কবিতার বইগুলির তাকের নাম রেখেছিল “অভিমান’।

রাখীর নামকরণ শুনে কল্লোলের তখন হাসতে হাসতে খাটে গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।

‘তুমি আসলেই খুব রোমান্টিক রাখী। এত সুন্দর নাম রেখেছ। সিন্দুক তো খালি। আমাদের তো কোন টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি নেই। যাও তোমার জমানো প্রাইজবন্ড ছিল, সেটা দিয়ে তো আলমারী কেনা হয়েছে।’

রাখী এসে খাটে শুয়ে থাকা কল্লোলের বুকে মাথা রেখে বলেছিল, আমি ওই সিন্দুকের নাম রেখেছি ‘বিশ্বাস’। এবার আর হাসেনি কল্লোল। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়েছিল রাখীর দিকে। সেদিকে তাকিয়ে রাখী খুঁজেছিল অনন্তকালের বিশ্বাসকে।

সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছিল কল্লোল। পনের বছরের সাজানো সংসার ভেঙ্গে যাওয়া, একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে আসা, অচেনা দেশে একাকী সংগ্রাম কোন কিছুরই তুলনা ছিল না ওই বিশ্বাসভঙ্গের বেদনার সঙ্গে। আজ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে ফেসবুকে কল্লোলের বিয়ের ছবি দেখল, রাখী অনেক খুঁজেও হৃদয়ের গভীরে হাহাকারের চিহ্ন খুঁজে পেলনা। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে বেদনা কিভাবে আসে।

শুধু কষ্ট লাগল একটা  ছবি দেখে। রাখী ওর অসম্ভব সাজানো গোছানো সংসারেও স্টিলের আলমারীটা রেখে দিয়েছিল ওর শোবার ঘরে। ওটা অনেকটা পার্টিশনের কাজ করতো ড্রেসিং রুমের সঙ্গে। ছবিতে দেখল আলমারীটা পিছনের বারান্দার এক কোনায় ফেলা। হয়ত ঘরের আজে বাজে জিনিষপত্র এখন সেখানে রাখা হয়।

স্টিলের আলমারিতে আহলাদ, ভালোবাসা, অভিমান আর বিশ্বাসের জায়গা করে নিয়েছে এখন অন্তহীন অবহেলা।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান