জলধি / গল্প / লাল ঘাম কিংবা ডিওভান
Share:
লাল ঘাম কিংবা ডিওভান

প্রস্তাবটা যখন এলো একটা বাসি-বাসি গন্ধের মরে যেতে ইচ্ছে করা জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছি তখন প্রতিদিন।

একেকটা দিন বেঁচে থাকতে রীতিমতো পরিশ্রম হয়। তিতকুটে নিমপাতার স্বাদ জিভে নিয়ে ঘুমাতে যাই প্রতিরাতে; যেন একটা নোংরা খোঁয়াড়ে গরু-ছাগলের হাগা-চনা-মুত লাগা, ভেজা দুর্গন্ধী খড়ের ভেতর অপদার্থ দার্শনিকের মতো শুঁকে চলেছি জীবনটাকে। একেকটা দিন শুরু হয় যে মহান উপলব্ধি দিয়ে তা হলোঃ

‘শালার মান্দার পো সূর্য! তোমার ডেলি ডেলি না উইঠা থাকতে না পারার চুলকানিতে গোয়া মারা খায় এই নায়ক-সাজ সাজ্জাদ (নায়কের মতো সেজে থাকে যে)’

সবকিছুর শুরু পিতৃদেবের অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে। হঠাৎ-ই একদিন অফিস চলাকালীন স্ট্রোক করে আর্লি রিটায়ারমেন্টে যাবার রাস্তাটা পাকা করে ফেললেন তিনি। সেটাও প্রায় বছর পাঁচেক হতে চলল। চাকরিতে থাকা অবস্থায় ঘুস না নিয়ে তিনি আমাদেরকে উদ্ধার করলেও, রিটায়ারমেন্টের পরেও এই গোঁয়ার্তুমি বজায় থাকায় পেনশানের টাকাগুলো আজও উদ্ধার করা যায়নি।

তবে এই ধাক্কায় উদ্ধার হয়ে গেল সাভারের প্রায় হাতছাড়া হতে বসা পাঁচ কাঠার জমিটা। উদ্ধারের সাথে সাথেই ওটা বেচে দিতে হলো বা বলা যায় বেচে দেওয়ার জন্যই ওটা তড়িঘড়ি করে উদ্ধার করা হলো। ঐ জমি বেচা টাকা ব্যাংকে রেখে যে সুদ আসে সেটা দিয়েই চলে আমাদের সংসার। কয়েক মাস আগে সুদের হার কমে অর্ধেক হয়ে গেল। সেই থেকেই সংসারের রশি টানাটানি শুরু; পিতৃদেবের মেজাজ উদারা-মুদারা টপকে দপদপিয়ে তারায় উঠে গেল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অঙ্গীকারনামা নিয়ে। আর সেই থেকেই তিনি হার্টের রোগী।

আমি তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ-ই পকেট খরচ বন্ধ হয়ে গেল গরমের রাতে অপ্রত্যাশিত লোডশেডিংয়ের মতো। অনেক চেষ্টা করেও একটা পার্ট-টাইম কাজ জোগাড় করতে পারলাম না। শুরু হলো টিউশানি জীবন। একটু অবস্থাপন্ন আত্মীয়-স্বজনরা যোগাযোগ কমিয়ে দিল, কেউ কেউ ফোন ধরাও বন্ধ করে দিল। চাচা-ফুপু, মামা-খালা, সুজন-দুর্জন, বন্ধু-বান্ধবী সবার সাথে গ্রীষ্মের মৌসুমে নদীর পানির স্তর নেমে যাওয়ার মতোই নামতে লাগল সম্পর্কের স্তর।

বলা বাহুল্য যে এই পরিস্থিতিতে আমার প্রেমিক জীবনও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন। তা হবে না-ই বা কেন? একটু সুগন্ধি-ছড়ানো কাপড়-চোপড় পরে সিনেপ্লেক্সে পপকর্ন সহযোগে ইংরেজি ছবি দেখতে দেখতে প্রেমিকার হাত টেপাটেপি করতে না পারলে বা ওয়াটার কিংডমে শর্টস পরে দাপাতে না পারলে এ যুগে প্রেম হয় না-কি? কিন্তু সেই ভাগ্য কোন জ্যোতিষী আমাকে ধার দেবে?

আমার প্রেমিকাগুলোও ছিল খুব স্ট্যাটাসওয়ালা ফ্যামিলির ভদ্র সুশীল কোমলমতি কন্যা। একটা চাল-চুলোহীন ফকিরা ছোঁড়ার সাথে প্রেম করে তারা তাদের বাবা-মা’কে কষ্ট দিতে পারবে না কিছুতেই। এমনকি বাবা-মা’কে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবলেও এই কোমলমতিদের চোখ ছলছলিয়ে উঠত। এ সময় ‘ছিঃ কাঁদে না লক্ষ্মীটি’ বলে একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেই বা আমি দেব কেন? পাখির পালকের মতো ফিনফিনে ঐসব সুগন্ধি টিস্যু পেপার কিনতে পয়সা লাগে না? ঐ পয়সায় টুকটুকে কমলা পাছার একটা আস্ত সিগারেট পাওয়া যায়। প্রেম আর সিগারেট দুটোই হারাতে যাব কোন্ বোকা সন্ন্যাসী সাজতে গিয়ে?

শেষমেশ বার্ট্রান্ড রাসেলের পরামর্শে জীবনের যাবতীয় ক্রন্দন আর ঝামেলা থেকে বাঁচতে শুরু করলাম গল্প লেখা। যত মাটি মাটি ক্ষোভ, দলা দলা রাগ, জীবনে ঠকে যাওয়ার নানা মাত্রা ও রঙের উপলব্ধি সব উপুড় করে ঢেলে দিতে থাকলাম সাদা কাগজের বোকা বোকা পৃষ্ঠায়। জীবন থেকে এ এক বিদগ্ধ পলায়ন!

আহা আমার বিদগ্ধ রে!

এসব দার্শনিক চিন্তায় মাঝে মাঝে নিজেরই হাাসি পায়।

তবে এই পলায়নেও মুক্তি নেই কেননা আমার বেকার জীবন তো ঐ একইরকম রয়ে গেল। আমার কর্মহীনতা ও লেখালেখির প্রসঙ্গ উঠলেই পিতৃদেব যথোপযুক্ত ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে টেলিভিশনের টকশো’র সরকার-দলীয় বুদ্ধিজীবীদের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মা’কে বলেন-

‘ভালো চাকরির অফার নিয়ে কেউ মুদিখানার চিড়া-চানাচুরের মতো বসে নেই তোমার ছেলের জন্য। তিনি তো আবার লেখক! সুশীল মানুষ, উনি কি আর যেনতেন কাজ করবেন?’

আমার মা জননীও কোনো অংশে কম যান না। একটা সময় ছিল যখন তিনি বেশ শান্তশিষ্ট ও মুখচোরা স্বভাবের ছিলেন। নিরন্তর অভাব-অনটনে নিজের অজান্তেই পিতৃদেবের পথ অনুসরণ করতে একরকম বাধ্যই হয়েছেন; যেমন সকাল হলেই মা আমার চিলের মতো ডেকে ওঠেনঃ

‘এই সাজ্জাদ যা বাজারে যা! তোর এতো ঘুম কোন্ রাজার বালিশ থেইকা আসে রে? তোর আব্বার রাত্রের অ্যান্টি-বায়োটিক শেষ। কী হলো উঠবি না তুই?’

আমার রত্ন-গর্ভা মায়ের ধারণা আমি শুধু ঘুম আর খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ করার আগ্রহ বোধ করি না। তা তিনি সেটা ভাবতেই পারেন! যেহেতু আমার কোনো আয়-রোজগার নেই তাই এক গ্লাস পানির দিকে নিরীহ চোখে তাকিয়ে থাকাটাও আমার প্রথম মাত্রার অপরাধ। ঠিকই তো! কাজকর্ম থাকলে কি আর আমি এভাবে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় পেতাম?

এমন অভাবনীয় পিতৃ-মাতৃস্নেহে প্রতিনিয়ত অপ্সুদীক্ষিত আমি।

তো এরকম একটা রাজা মলম জীবনে যা হয় আর কী! চুরি-ছ্যাঁচড়ামিটা শিখে গেলাম শিশুর হাঁটা শেখার মতো। এই যেমন সেদিন সরালাম বাবা’র অ্যান্টিবায়োটিক কেনার টাকা থেকে। মা’কে বেশ গম্ভীর গলায় কৈফিয়ত দিলাম- ‘ওষুধের দাম বারসে।’

এই পর্যায়ে আমার জীবনের দর্শনটা হয়ে উঠল এরকম: যে কোনো পরিস্থিতিতে জীবনটাকে উপভোগ করা চাই। আমার এই বয়সটার জন্য পৃথিবী যে আয়োজন নিয়ে বসে আছে সেটা বয়সটা পেরিয়ে গেলে তো আর পাব না। তাই যতটুকু পারি চেখে দেখতে চাই।

টিউশানির অল্প টাকায় তো বেশি মউজ করা যায় না। আর তাই সুযোগ পেলেই বিভিন্ন কায়দায় সংসার খরচের টাকা থেকে সরিয়ে চা-সিগারেট-গাঁজা-কাচ্চি বিরিয়ানির লাইন লাগিয়ে দেই। অন্য সব জাহান্নামে যাক! আমার জীবনে সুখটান আর মাংস-মসলার গন্ধ চাই। পানসে শাক-পাতা ক্যাতক্যাতে জীবনে রীতিমতো ঘেন্না ধরে গেছে। ওটাকে হাতে পেলে পায়ের নিচে ফেলে নেংটি ইঁদুরের মতো চটকে লাথি দিয়ে নর্দমায় ফেলে দিতাম।

যাক যে প্রস্তাবটার কথা বলছিলাম সেখানে ফিরে আসি।

আধা-বেকার জীবনে সকাল-বিকাল মতিনের টং দোকানে পাঁচ টাকার লাল চায়ের সাথে চলে নীল-সবুজ-বেগুনী আড্ডা। এরকমই এক বিকেলে আড্ডা চলাকালীন একটা ফোন এলো। একজন শিল্পপতির সহকারীর ফোন। অফিসের ঠিকানা দিয়ে আমাকে অনুরোধ করা হলো যাতে পরের দিন দুপুরে শিল্পপতি মহোদয়ের সাথে দেখা করি।

নির্ধারিত সময়েই হাজির হলাম। ভদ্রলোকের নাম রোকনুদ্দিন খান। শুরুতেই তিনি আমার ছেপে বের হওয়া কয়েকটা গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। এরপর দিলেন প্রস্তাবটা: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে হবে আমাকে। সেজন্য যথাযথ সম্মানী দেয়া হবে আমাকে। সম্মানীর কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসে জানতে চাইলাম কী ঘটনা নিয়ে লিখতে হবে।

রোকনুদ্দিন সাহেন বললেন যে উনার বন্ধু-পত্নী’র ডায়েরি থেকে উনি আমাকে একটা এন্ট্রি পড়ে শোনাবেন। তবে ডাইরিটা আমি নিয়ে যেতে পারব না; এমনকি ওটা থেকে ফটোকপি করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আছে। আমাকে শুনে শুনে মনে রেখে গল্পটা লিখতে হবে। তবে আমি চাইলে শোনার সময় নোট নিতে পারি। এরপর উনি রিডিং গ্লাসটা পরতে পরতে তার সামনে পড়ে থাকা কমলা রঙের একটা ডায়েরি টেনে নিলেন। আমি এপাশ থেকে ডায়েরিটার রেক্সিনের জ্যাকেটের ওপর লেখা ‘ডায়েরি এন্ট্রি ১৯৭১’ শব্দগুলো শুধু পড়তে পারলাম। বেশ ভরাট গলায় পড়তে শুরু করলেন রোকনুদ্দিন সাহেব-

মে ২৫, ১৯৭১

সময়: আনুমানিক দুপুর ১২টা।

আমরা তখন থাকতাম বগুড়া শহরের একটা ভাড়া বাড়িতে। আমাদের দুই সন্তান।টগর আর বকুল। টগরের বয়স দেড় আর বকুলের আট। ওদের বাবা বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ইতিহাসের লেকচারার। ওর বেশ কয়েকজন ছাত্র মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে যাদের সাথে ওর নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কিছুদিন আগে গভীর রাতে ওদের কয়েকজন বাড়িতে এসে কিছু অস্ত্র রেখে গিয়েছে, ভোরে এসে আবার সেগুলো নিয়েও গেছে। সামনে আমার বি এ পরীক্ষা। খবর এলো যে পাকিস্তানি আর্মি সিরাজগঞ্জ পার হয়ে গিয়েছে।

আসার পথে বাজার, স্কুল, দোকানপাট, ঘরবাড়ি যেটাই সামনে পাচ্ছে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের শহরে ঢুকে পড়বে যে-কোনো দিন। আশেপাশের প্রায় সব পরিবার ইতোমধ্যেই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরাও যেতাম, আটকে গেলাম শুধু টগরের জন্য। ওদের বাবা উঠানের শেষ মাথায় একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখেছিল অতর্কিত আক্রমণে আশ্রয় নেওয়ার জন্য।

টগরকে কীভাবে নিয়ে যাব বুঝতে পারছিলাম না। জন্মের এক বছর পর থেকেই আমার ছেলেটা অসুস্থ। আমার অবহেলাই এর জন্য পুরাপুরি দায়ী। ওর প্রথম জন্মদিনের ২ দিন আগে আমি ওকে রান্নাঘরের সামনে মাদুরে শুইয়ে রেখে ভেতরে কাজ করছিলাম। রান্নাঘরটা ছিল বাড়ির পেছনে উঠানের সাথে লাগানো। রান্না করতে করতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম যে টগর মাদুরের উপরে নেই।

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যে ও হামাগুড়ি দিয়ে বারান্দার কোনার দরজাটার সামনে থেকে কী যেন একটা খুঁটে খাচ্ছে! কাছে গিয়ে দেখলাম কবুতরের পায়খানা। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টগর অসুস্থ হয়ে পড়ল।আস্তে আস্তে শরীরের মাংসগুলো হাড় থেকে আলাদা হতে শুরু করে। শরীরের চামড়া ঘোলাটে অর্ধ-স্বচ্ছ পর্দার মতো ধরে রেখেছিল ওর পুরো শরীরটাকে। সেই চামড়ার পর্দা আর ফ্যাকাসে রক্ত ভেদ করে অস্পষ্টভাবে দেখা যেত ওর ফুসফুস, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, পিত্তথলি...মাথায় রক্ত জমে ভীষণ ফুলে গিয়েছিল চারপাশটা; চোখ দুটো কোটর ছেড়ে উঠে এসেছিল চোয়ালের ওপরের হাড়ে। শুধু খাওয়ার মুখটা ছিল অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক। নল দিয়ে খাওয়াতাম ওকে; প্রথম প্রথম নল টানতে না পারলেও আস্তে আস্তে শিখে গেল। দুধ খাওয়ার সময় পরিষ্কার দেখা যেত নল বেয়ে দুধ কীভাবে ওর গলা দিয়ে পাকস্থলীতে নেমে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টিতে কোনো প্রাণ ছিল না আমার ছেলেটার; যেন কোনো কিছুই দেখছে না।তাকিয়ে আছে শুধু; একটা বোবা বোধশূন্য দৃষ্টি।

শহরের সেরা ডাক্তার শশী বাবু তার পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন কালকে। যাওয়ার আগে টগরকে দেখে জবাব দিয়ে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যে এই বাচ্চাকে আর মানুষ বলে চেনা যাবে না, ধীরে ধীরে একটা নরম মাংসের পোঁটলার মতো হয়ে যাবে ও। যেটুকু বোধশক্তি অবশিষ্ট আছে সেটাও আর থাকবে না। যত দিন যাবে ওর গায়ের চামড়া পাতলা হতে থাকবে আর এর ফলে ওর শরীরের ভেতরের সবকিছু সরাসরি বাতাসের সংস্পর্শে চলে আসবে। এই রোগ মরণরোগ। এর আগেও তিনি এই রোগের আরও দুইজন রোগী দেখেছেন। কেউই ছয় মাসের বেশি বাঁচেনি।

শশী ডাক্তারের কথা ফলতে শুরু করেছিল। বোধশক্তিহীন টগর সারাদিন চুপচাপ দোলনায় শুয়ে থাকত।হাসত না, কাঁদতও না। শুধু খাওয়ার সময় হলে একটা কাঁসার বাটি কানের খুব কাছে নিয়ে শব্দ করলে চোখ পিটপিট করে তাকাত। মা হয়ে এই জীবন্ত দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে ভীষণ ভেঙে পড়লাম এক সময়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার প্রাণের বদলে টগরের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে চাইলাম না। আমি মরে গেলে বোধশক্তিহীন অসহায় এই শিশুকে কে দেখবে?

নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলাম।আমার ছেলেটাকে আমি এভাবে মরতে দেব না কিছুতেই।

নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম টগরের মনোযোগ আকর্ষণ করার। এর মধ্যে একদিন এক কবিরাজের সন্ধান পেলাম। রোগের বর্ণনা শুনে একটা জড়িবুটির তেল দিলেন তিনি। সেই তেল ড্রপার দিয়ে প্রতিদিন ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক ফোঁটা করে দিতাম। কয়েক মাস যাওয়ার পর মনে হলো ওর পাতলা চামড়ার ওপর আস্তে আস্তে একটা অপেক্ষাকৃত ভারী প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে।

কিছুদিনের মধ্যে টগর ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকানো শুরু করল; হাসির মতো মুখভঙ্গি করে ও যেন একটু একটু করে সাড়া দিতে শুরু করেছে শব্দ-আলোর জগতের ডাকে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওকে চোখের আড়াল করতাম না এক সেকেন্ডের জন্যও। একটা দোলনা জোগাড় করে সেটা রান্নাঘর আর আমার পড়ার ঘরের মাঝামাঝি এনে রেখেছিলাম যাতে পরীক্ষার পড়া আর রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে যে কোনো সময় ওকে দেখে যেতে পারি। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তখন শুধু টগর। মাতৃত্বের একেকটা ফোঁটায় আমি বাঁচিয়ে তুলব আমার সন্তানকে।

টগর রাতে ঘুমাত খুব কম। কাছে গেলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকত আর সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিত। কী অসহায় আর মায়া-কাড়া দৃষ্টি ছিল আমার ছেলেটার!

পাকিস্তানি আর্মি যে দুপুরে আমাদের বাড়ির সামনের দরজাটা লাথি মেরে ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল, সেদিন ওদের বাবা আমাদের শহর ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে ওর এক সহকর্মীর সাথে পরামর্শ করতে গিয়েছিল। আমি আর বকুল উঠানের শেষ প্রান্তে লাকড়ি তুলছিলাম রান্নার জন্য। শব্দ শুনে চকিতে আমরা মা-মেয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্রেঞ্চে ঢুকে পড়লাম।

ট্রেঞ্চের উপরে ছিল জং-ধরা পুরোনো টিন আর মরা গাছের ডাল। ট্রেঞ্চে ঢুকতেই বুকটা যেন ভেতর থেকে খামচি দিয়ে ধরল কেউ, কারণ ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল যে টগর বারান্দার দোলনায় রয়ে গিয়েছে। মুখে হাত-চাপা দিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়তেই বকুল প্রচণ্ড ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি আমার কোনো সন্তানটাকে বাঁচাব ভাবতে ভাবতে আমার বোধ-বুদ্ধি সব এলোমেলো হয়ে গেল। বাইরে উঠানের ওপার থেকে দড়াম দড়াম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মাথার উপরের টিন একটু সরিয়ে দেখলাম পাকিস্তানি জন্তুগুলো ঘরের আসবাবপত্র তছনছ করছে। কাউকে না পেয়ে ওদের পুরো দলটা অফিসার গোছের একটা মোটা গোঁফওয়ালা লোকের নেতৃত্বে পেছনের বারান্দায় এসে টগরের দোলনাটা ঘিরে দাঁড়াল।

দূর থেকে যতটুকু বোঝা গেল তাতে মনে হলো টগরকে দেখে ওরা ভীষণ অবাক হয়েছিল। নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে কথা বলছিল ওরা। এর মধ্যে হঠাৎ-ই কেঁদে ওঠে টগর। অসুস্থ হওয়ার পর ওটাই ছিল ওর প্রথম কান্না। ঐ কান্না শুনেই আমি বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে আমার ছেলেটা; বুকের ভেতরটা যেন লোহার কুঠার দিয়ে যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে কেউ।

জন্তুগুলোর টুকরো-টাকরা কথা থেকে যা বুঝলাম তা হলো ওরা মনে করছে টগর নিশ্চয়ই কোনো হিন্দু নর-নারীর অবৈধ সন্তান। কেননা তারা মনে করে যে এই বিকৃত শিশু কোনো মুসলমান বাবা-মা’র হতে পারে না; কেননা আল্লাহ্ কখনো তার কোনো মুসলমান বান্দা-বান্দীকে এত বড়ো শাস্তি দিতে পারেন না। অফিসার গোছের গোঁফওয়ালা লোকটা চিৎকার করে বলছিল-

‘ইয়ে জরুর কোই হিন্দু কা নাজায়েজ আওলাদ হ্যায়। ইস পাপ কো খাতাম্ কারনা হামারা ডিউটি হ্যায়।’

এর পরপরই ব্রাশফায়ারের নারকীয় গর্জনে বাড়ি-উঠান গুম গুম করে কেঁপে উঠল। আমি ট্রেঞ্চের ভেতরেই চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। শুধু মনে আছে বকুল শক্ত করে আমার মুখটা চেপে ধরে রেখেছিল। আমার আট বছরের বাচ্চা মেয়েটা সেদিন অনেক শক্ত ছিল।

জ্ঞান ফিরে আসতেই দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড করে জন্তুগুলো চলে গেছে। টগরের ছোট্ট শরীরটা ফেটে পড়ে আছে চারপাশে। রক্ত, নরম হাড়, দ্বিখণ্ডিত চোখ, বহু-খণ্ডিত হাত-পা; বিভিন্ন দিকে ছিটকে যাওয়া শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কাটা টুকরোগুলো কোনটা কী চেনা যাচ্ছে না। আমার গলায় ভীষণভাবে ফেঁসে যাওয়া চিৎকারটা বের হওয়ার আগেই আমি দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারাই।’

এ পর্যন্ত পড়ে থামলেন রোকনুদ্দিন সাহেব। এর পর পেপারওয়েটটা হাতে নিয়ে ওটার ওপর আঁচড় কাটতে কাটতে বললেন,

‘১৬ই ডিসেম্বরে বাড়ির ছাদে বিজয় উৎসব দেখতে গিয়ে বিজয়ের আনন্দ মিছিল থেকে ছোঁড়া গুলিতে মারা যায় বকুল। এরপর বহুবছর অপ্রকৃতিস্থের মতো ছিলেন বকুল-টগরের মা। ঘুমের মধ্যে শুধু রক্ত দেখতেন।

টগরের মা আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন এই ঘটনাগুলো এমন কাউকে দিয়ে লেখাতে যার লেখনীর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে টগর-বকুল। আমি অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখককে অ্যাপ্রোচ করতে পারতাম কিন্তু তোমার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে তুমি ঘটনাটাকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিতে পারবে। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত কলমের একটা বাঁধা গৎ বা যাকে বলে একটা প্যাটার্ন থাকে। টগরের মা চেয়েছেন যে একটা নতুন স্বরের ভিন্ন ইডিয়মে গল্পটা জীবন্ত হয়ে উঠুক। আর গল্পটার শেষে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত’ কথাটা জুড়ে দেওয়া থাক।’

কিছুই বলতে পারলাম না। হঠাৎ খুব শীত শীত লাগতে থাকে আমার।

রোকনুদ্দিন সাহেবের অফিস থেকে প্রায় পালিয়ে এলাম। সেদিন বিকেলে আর আড্ডাতে গেলাম না। সারাটা সন্ধ্যা বিছানায় শুয়ে থেকে এপাশ-ওপাশ করলাম, একটা নির্জীব অবসন্নতায় ডুবে থাকলাম পুরোটা সময়।

চারিদিকে শুধু লাল দেখি। বিভিন্ন মাত্রা ও মেজাজের। টিভিতে দেখা সমুদ্রের পানি থেকে শুরু করে গাছের পাতা, রাস্তাঘাট, গাড়ি-ঘোড়া, ওয়ারড্রোব, ঘরের মেঝে সব টকটকে লাল। এই লালের ভেতরে একটা অচেনা শিশুর চোখ-বোজা মুখ রক্তের প্রচ্ছদে আঁকা। এই অসহ্য লাল আমার অন্য সব রঙের সংবেদনশীলতাকে ইতোমধ্যেই গ্রাস করে নিয়েছে; গোটা পৃথিবীতে যেন এখন শুধু একটাই রং।

রাতে প্রচণ্ড গরমে ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ চলে গেছে। দরজার কাছে একটা হালকা হলুদ আলোর রেখা ফুটে উঠল।কাজের ছেলেটা বাটিতে করে দুটো মোম দিয়ে গেল।

মোমের বাটিটা টেবিলে নিয়ে আমি কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসলাম। চোখের গভীরে তখনো সেই লাল রং মোমের কাঁপা কাঁপা আলোয় তিরতির করে কাঁপছে। কিছুক্ষণ লেখার চেষ্টা করলাম; হলো না কিছুই। শব্দ-বাক্যের শক্তি যে কত ঠুনকো এটা আগে বুঝিনি। কিছুক্ষণ পর মা এসে ফ্রিজ থেকে বের করা একটা অর্ধ-চাঁদ তরমুজের ফালি আমার টেবিলে ওপর রাখতে রাখতে বললেন,

‘তরমুজটা খা। গরমে আরাম পাবি। আর রাত্রের জন্য সামনের দোকান থেকে এক হালি ডিম নিয়ে আয়।’

আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘মা একটা কাজে বিজি আছি এখন। আগে বলতে পার না এইসব?’

মা কিছু না বলে চলে যায়। ফ্রিজ থেকে বের করা তরমুজের ফালিটার দিকে তাকিয়ে থাকি।ওটা থেকে একটা চিকন ঘামের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। লাল ঘাম। এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মুখ তুলে দেখি আমার চারপাশের সবকিছু আবারও লাল হয়ে গেছে।

আমার লেখার খাতা, কলম, মোম, টেবিল, তরমুজের পিরিচ, এমনকি আমার হাত। সব সদ্য ধমনি কেটে বাইরে আসা রক্তের মতো লাল।

মাঝরাতে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করে কিছু ওষুধের নাম লিখে নিলেন মা। ডাক্তার বললেন ওষুধগুলো এক্ষুনি খাওয়াতে তবে অবস্থার উন্নতি না হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালের কথা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেলে মা শুকনো হেসে বললেন, ‘হাসপাতাল নিয়ে ভাবিস না। এসবের জন্য আমার একটা আলাদা ফান্ড আছে।’

‘আচ্ছা! চুরি তাহলে মা-ও করেন?’ মনে মনে ভাবলাম। তবে দুই চুরির পার্থক্যের কথা ভেবে গরম কড়াইয়ে ছাড়া পাঁপড়ের মতো কুঁকড়ে গেলাম।

বাড়ির সামনের ফার্মেসিটা বন্ধ হবে হবে করছিল। দৌড়ে গিয়ে ওষুধের ফর্দটা মেলে ধরতেই পরিচিত দোকানদার শাহেদ ভাই সব ওষুধ বের করে দিলেন। শুধু ‘ডিওভান’ নামের ওষুধটা নেই। হঠাৎ শাহেদ ভাইয়ের কপালে চোখ পড়তে দেখি উনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টাটকা লাল।

ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে সরে আসি ওখান থেকে। বড়ো রাস্তার উপরে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা ওষুধের দোকানটায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

দ্রুত শাটার পড়ছে আশেপাশের দোকানগুলোর। উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসা সারাদিনের কর্মক্লান্ত, বিধ্বস্ত মানুষগুলোর সবার কপালেই চিকন লাল ঘামের ধারা। হাঁটতে হাঁটতে কী মনে করে সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোয় ওষুধের নামটা আরেকবার পড়ি। মায়ের লেখা বাংলায় ‘ডিওভান’ শব্দটার ‘ড’ অক্ষরটায় চোখ আটকে গেল। রোকনুদ্দিন খানের পড়ে শোনানো ‘ডায়েরি এন্ট্রি ১৯৭১’-এর ‘ড’ অক্ষরটা ডার্করুমে পানিতে চোবানো ছবির মতোই ভেসে উঠল মনের মধ্যে।

দুটো ‘ড’-এরই সরলরেখার নিচের ঘাড়টা বাঁ দিকে বেঁকে নেমে আবার নৌকার কোনার মতো ধাঁ করে ডানে উপরে উঠে গেছে।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান