১
লালবাগের বান্নির ঠিক দুইদিন আগে ছইফুলের মাথায় একটা পরিকল্পনা আসে। তখন রাত বাজে আটটা প্রায়। এশার আযান হয়ে গেছে। বৃষ্টি হবে হবে, কিন্তু হচ্ছে না। ভ্যাঁপসা গরমও নাই। বাতাস বইছে খুব, সেই সকাল থেকে। আকাশ এই মেঘভরা আন্ধাইর তো একটু পরে মেঘ কেটে গিয়ে সাফসাফা পরিষ্কার। ঝিলমিল ঝিলমিল করা তারারা ফুটছে খুব। কালো জরির কাপড়ের যেন উপর ছোট ছোট রুপার টুকরা বসানো । তাজিয়া মিছিলে বড় সিন্দুক ঢেকে রাখা হয় যে কাপড় দিয়ে , ঠিক সেরকম।
তুতবাড়ি বাজার। সুনুর আলীর চায়ের দোকানে বাঁশের বেঞ্চে বসে লিকার চা খেতে খেতে ছইফুলের মাথায় বুদ্ধিটা আসে। দোকানের সামনা দিক মেইন রোডের মুখামুখি। পিছন দিক জংগল, টিল্লা টক্কর। ডানে চায়ের বাগান। অন্ধকার চায়ের বাগানের দিকে মুখ রেখে ছইফুল তার পরিকল্পনাটাকে আবার আগাগুড়ি সাজায়। দোকানে আরো দুইজন বসা। দুই সারি লম্বা লাকড়ির টেবিল। এরা বসেছে ছইফুলের বিপরীতে। পানের পাইকার । মুড়ইছড়া বাজার থেকে টমটম নয়তো বেবিতে করে মাল আসবে। পানের খাচাভরা স্তুপের মধ্যে পাছার এক টুকরা গুজে দিয়ে কোনমতে শরিল সামলে যাওয়া। এটাকে বলে কেজাই কুজাই যাওয়া । কে মাল আর কে যাত্রী –কোন তফাৎ নাই। রবিরবাজার গেলেই তবে খালাস।
বান্নিতে দূরদেশ থেকে নানান পাইকার আসবে। দুই দিনের মেলা। গত দুই বছর করুনায় বন্ধ ছিল। তিন বছর বিরতি দিয়ে মেলা আবার ফিরেছে। লালবাগের বান্নি এই অঞ্চলের সবচাইতে বড় বান্নি। বড় পাইকার আর মহাজনদের জন্য রাতের বেলা ফায় ফুর্তির জিনিস হিসাবে থাকবে সিতারা বানু। পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক মত করতে পারলে মোটামুটি যা আসবে , এই বাজারে সেটা অনেক । কমপক্ষে হাজার টাকা পেলেও মন্দ কি। এক সপ্তার বাজারতো চালানি যাবে। যে যুগ চলছে , মানুষের পায়ে ধরে কান্দাকাটি করলেও কেউ দশ টাকা ছাড়বে না।
লালবাগে বড় বড় মহাজনরা আসে। জাল নিয়ে আসে ঢাকার বিক্রমপুর থেকে। নরসিংদির মহাজন নিয়ে আসে লুংগি শাড়ি। যশোর থেকে বিরাট সার্কাস পার্টি । লোহার দা খুন্তি কুড়াল কড়াই আসে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে, হবিগঞ্জের ওইদিকে নুয়াপাড়া থেকে। আজমিরিগঞ্জ থেকে আসে শুটকির বড় বড় কারবারি। কী নাই লালবাগে ! এরা সবাই শো দুইশর কারবারি না। কয়েক হাজার ভাড়া খরচ করে প্রতি বছর কি শুধু মাত্র শো দুইশো লাভ করার জন্য এরা আসে ! নিশ্চই না। ফায় ফুর্তির জন্য এরা হাজার টাকা খরচ করতে কোন খাতির করবে না। বিষয় হল জিনিস বুঝে দাম। সিতারা বানু কি সস্তা মাল ! বাজারের সবচাইতে সস্তা মাল কোনটা ! শেষ শীতের বাঁধাকপি ! নাকি বারিষার দিনের নালিতা শাক ! সিতারা বানু কি এইসব গরিব, ফুটাধরা ঝিমিয়ে পড়া পাতাসাতা শাক !
যে কজন পান পাইকার তার কাছে আসে , প্রতি ভিজিটে সে পাঁচশো টাকার কম রাখে না। যেমন ভিজিট সেবার মানও সেরকম। জিনিসটাও খাসা। ধবধবে ফর্সা । সাদা চামড়ার ডিমান্ডই আলাদা। বড় রসুনের কোয়ার মতন ঠোট। খাটো সাইজে যেরকম মেদ হওয়া দরকার, সেকম আছে তার। কমও না বেশীও না। বুকে হাত দিলে মনে হয় কবুতরের উম সারা শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। এত স্নিগ্ধ, এত মোলায়েম। সে যদি এত সস্তা থাকতো তাহলে এলাকার সিএনজি ড্রাইভার আর রাজমিস্ত্রিরা দুই আড়াইশ টাকায় তাকে এতদিনে ঘুটতে ঘুটতে ভাঙা বরই বিচি বানিয়ে ছাড়তো। কিন্তু সিতারা বানু এত সস্তা না। যারা জীবনে তার কাছে একবার গেছে তারাই বলতে পারবে তার কদর কতখানি । সৌদি আরবের অরিজিনাল খেজুর যারা খেয়েছে তারা জানে ভাল খেজুর আর সস্তা খেজুরের তফাত কোন জায়গায়।
ছইফুল হল সিতারা বানুর বলতে গেলে প্রায় ডান হাত। সম্পর্কে ছইফুল সিতারা বানুর বোনের ছেলে। আপন না। চাচাতো। এ একটা সুবিধা থাকায় ছইফুল অবাধে যাতায়াত করতে পারে। স্বামী পরিত্যক্ত খালার কাছে ভাগিনা গিয়ে দেখাশুনা করবে নাতো কে করবে। এ লাইনে দুজনের প্রায় পাঁচ বছর চলে। শুরু থেকেই ছইফুল তার সাথে আছে। সেই শুরু থেকেই সিতারা বানুর ভিজিট ছিল পাঁচশো । ছইফুলের জন্য একশো। আজ পাঁচ বছর কেটে গেছে। কিন্তু বাজেট দুজনেরই এখনো সমান। পাঁচ বছরে জিনিসপত্রের দাম পাঁচ গুণ বেড়েছে। সে অনুযায়ী তাদের ভিজিটতো আরো বাড়বার কথা। এ লাইনে নতুন থাকতে যা চাহিদা , একটু পুরান হয়ে গেলে সে চাহিদা আর থাকে না। কিন্তু সিতারা বানু আল্লাহর দেয়া আশ্চর্য এক দান। যত পুরান হচ্ছে তত তার চেকনাই যেন বাড়ছে। সেগুন কাঠের ফার্নিচার যত পুরান তত তার গ্লেইস বাড়ে। সিতারা বানু যেন ঠিক সেরকম। শুধু চেহারা দিয়ে কি এ ব্যবসা চালানি যায় ! শরীর এ লাইনে প্রধান পুঁজি ।তারপরও শরীর ই সব নয়। সিতারা বানুর আচার ব্যবহার খুবই ভাল। সে তার কাস্টমারকে পর্যাপ্ত সময় দেয়। কোনদিন রাগ করে তাকে কথা বলতে দেখে নি ছইফুল। এ নিয়ে ছইফুল বহুত লেকচার ঝেড়েছে। এক দিন দুই দিন না। যতবার দেখা ততবারই। কিন্তু সিতারা বানু কঠিন হতে পারল না আজ পর্যন্ত । কিন্তু ছইফুলকে বাঁশ দিতে এক ইঞ্চি ছাড় দিতে রাজি নয় বেটি। মামলতের সময় ষোল আনা ঠিকই আদায় করে নেবে। বেটি ছইফুলকে আঘাত দিয়ে কী যে সুখ পায় ! আল্লাহ জানেন। ছইফুল যে জিনিস না করবে, সিতারা বানু সেটাই করবে সবার আগে ।
প্রথম প্রথম সিতারা বানু ঠিকই ছইফুলকে প্রতি মাথায় এক শো দিত। মানে তখন ছইফুল ই হাত ধরে ধরে কাস্টমার আনতো। আর তখন তো সারাদিন সে বলতে গেলে সিতারা বানুর বাড়িতে পড়ে থাকতো।
নতুন কাস্টমার যারা তাদের জন্য দরকার দালাল। একবার গেলে তারপর মোবাইল নাম্বার আছে। জনে মহাজনে সেটা বুঝাবুঝি হয়ে যায়। তখন দালালের আর দরকার পড়ে না। ছইফুল যদি সিতারা বানুর আপন লাং হয়ে থাকতো, তাহলে নাহয় একটা কথা ছিল। ফাঁকি দেবার সুযোগ থাকতো না । কিন্তু ছইফুলের এখন নিজের ঘর হয়েছে। বউ বাচ্চা আছে। খাসিয়া বাড়িতে জুমের সাফা কাম করা হল তার পেশা। সিতারা বানুর দালালি করে যা আসে ,এইগুলা হল তার উপরি ইনকাম। সিতারা বানুর চালাকিটা ছইফুল জানতো । কিন্তু এ নিয়ে জোরাজুরি করে কোন লাভ হবে না সেটা সে জানে।তাদের সম্পর্কটা শুধুই ব্যবসা আর খালা ভাগিনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সে মন থেকে ভাল না বাসলেও সিতারা বানুতো তাকে বাসে। সে ভালবাসা খাঁটি নাকি অভিনয় – সেটা পরীক্ষা কে করবে ! এইসব কি আর মাপজোক করে প্রমাণ করা যায় ! তবে যখনই যেত, তার হাতে শো দেড়শ টাকা তুলে দিত। মুখে বলতো কাস্টমার আসে না রে বাই। ছইফুল জোরাজুরি করতো না। এর চেয়ে এটাই বা কম কি। ঠেকা বেঠেকায় একজনতো আছে। কেউ কি আর সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁস হাত থেকে ছাড়তে চায় !
২
ছইফুল তার পরিকল্পনাগুলো মিলাতে থাকে একটার পর একটা। লালবাগের কাছের বাজার হল টিলাগাও বাজার। যদি সেখানে কারো খালি দোকান ঘর একটা নেয়া যায় , মাল রাখার কথা বলে। সন্ধ্যার পরপরই সেখানে সিতারা বানুকে ফিটিং করে রেখে দেবে। কাস্টমার আসবে দুইজন করে। আধা ঘন্টা পরপর দুই জন। প্রতি জনে পনেরো মিনিট। সিতারা বানুকে বুঝাবে ছইফুল। এরা তার বান্ধা কাস্টমার না। দূর দূরান্ত থেকে আসছে। যদি সে এদের কাছে ভালা মাইনসি দেখায় আখেরে পুটকি মারা খাবে। পনেরো মিনিট তবু অনেক সময়। শমসের নগর আজামুদ্দিনের কোঠায় প্রতি জনে সময় পায় মাত্র সাত থেকে আট মিনিট। এর বেশী হলে মেশিন নিজেই অটো বন্ধ হয়ে যায়। কাপড় সটান নামিয়ে বলবে, তোর রাস্তা তুই মাপ। সিতারা বানু এখানে টাকা রুজি করতে আসছে। এবার ছইফুল রুমের ভিতরেই থাকবে। এক মিনিটের জন্যও সে সিতারার সংগ ছাড়বে না। পনেরো মিনিট অনেক বেশী সময়। তবু সে দিচ্ছে। খোলাখুলি টিপাটিপি চুয়াচুয়ি করতে করতে আসলেই পাঁচ ছয় মিনিট চলে যায়। এগুলো ফাউ হিসাবে সে ছেড়ে দেবে। প্রতি মাথা পাঁচশো । এক টাকা কম চলবে না।
দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা হল , সে এই রাতব্যাপী ব্যবসার জন্য যে যে কাস্টমারদের সাথে যোগাযোগ রাখবে বলে ঠিক করে রেখেছে, তারা সকলেই হবে এই লংলা অঞ্চলের বাহিরা। লোকাল কাউকে রাখা মানে চোখ দিয়ে চেয়ে চেয়ে হাঁটার পরও কাচা গু’র চারির উপর পা মাড়িয়ে দেয়া। ভুলেও এই কাজ করতে চাইবে না সে। এক লোকালকে সুযোগ দিলে সে আরো দশ বারোটা নিয়ে আসবে। টাকাতো দেবে না, উলটা ছইফুলকে বেঁধে রেখে সিতারা বানুকে গাড়িতে তুলে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে ,লাশও ফেলে দিতে পারে। ভাড়াখাটা মাগীর কেস পুলিশ কেন নিবে ! রাত বিরাতে মাগী টাকা কামাতে ঘর থেকে বের হয়েছে। যাওয়ার আগে সে কি পুলিশকে বলে গিয়েছিল যে আমি অমুক অমুক জায়গায় যাচ্ছি। আর তার পরিবার ও স্বজন কোন মুখে বিচার চাইতে যাবে ! যে শুনবে সে বলবে – তোর বাড়ির বেটি অত রাইত বান্নিত কিতা করে ! আরো মূল কথা হল, সিতারা বানুর জন্য সামান্য টেনশন কে নিবে এ পৃথিবীতে ! হাতির দাইদার স্বামীতো তাকে ছেড়ে দিয়ে চিটাগাঙ্গের দিকে আরেক সংসার পেতেছে। এক ছেলে আছে বটে। কিন্তু সেতো বাপের চাইতেও এক চামচ বেশী।কোথায় থাকে, কি খায়, কি কামকাজ করে –কোন ঠিক ঠিকানা নাই। বাড়িতে আসে কালে ভদ্রে।
সুনুর আলীর দোকানের লিকার চা শেষ হতে হতে ছইফুলের খিদা লাগতে শুরু করে । সন্ধ্যাবেলা কুটি মিয়ার হোটেলে গরমাগরম চানা পেঁয়াজি খেয়েছে। তার একটু আগে বিকাল বেলা পুঞ্জি থেকে এসে ঘরে খেল আমরইল পাতা দিয়ে ছোট মাছের ঝোল। ভরা দুই প্লেট ভাত চোখের পলকে উড়িয়ে দিয়েছে। এত কিছু খাওয়ার পরও পেটটা তার চোইত মাসের মরা রোদের ছায়াপরা বিকালবেলার মাঠের মত খালি খালি মনে হচ্ছে। হালার পেট যেন পাঁচ নম্বরি ডিয়ার ফুটবল আস্ত একটা গিলে খেতে পারবে। সুনুর আলীর দোকানে পলিথিনের ভিতর রাখা আছে বাটার বন, কাছি বন, ডেনিশ, সুচ বন। হরেক রকমের বেকারি খাবার। রশিতে ঝুলানো। সারি সারি। দুই কান্দাও কলাও আছে। খেলেই খরচো। পাঁচ টাকা থেকে দশ টাকা। চা বন খাওয়ার পর এক শলা ডার্বি সিগ্রেটতো খেতেই হবে। বাড়ি ফেরার সময় তিন বাচ্চার জন্য তিনটা মামা নিতে হবে। গেল পনেরো টাকা। কিছু হুকইন কিনতে হবে। পকেটে একশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। প্রতিদিনই বাল বাতুরা কিনতে হয়। মামা কিনো। আজ তেল কিনলে কাল মাছ। আলু কিনো পেঁয়াজ কিনো ডাইল কিনো । এমন একটা দিন নাই যে কিছু কিনতে হবে না। এইসব যত মাথায় ঢুকবে, ততই চোখে ঘুলা ঘুলা সব কিছু ভাসে। মনে হয় যেন হঠাত করে কুয়াশার ভিতর আটকে পরা দিগভ্রান্ত হারিয়ে যাওয়া বগুলা পাখি। মাথায় কাজ করে না।
ছইফুল সুনুর আলীকে একটা সুচ বনের অর্ডার দেয়। চা’র কাপ শেষ। খালি বন খেতে মজা কম। দেবে নাকি আরেক কাপ দুধ চা’র অর্ডার । চায়ের কাপে বনের টুকরা ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলেই না তবে বন খাওয়া স্বার্থক হবে। কিন্তু আবার মনে হয় এতটুকুই থাকুক। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না। সে এখন একটা পরিবারের কর্তা । এইটা ভাবার পর সুক্ষ্ণ একটা অপরাধবোধ তার জাগে। সে বাজারে এসে যা মনে চায় তাই খাচ্ছে। বাড়িতে তার তিনটা বাচ্চা তিন বেলা ভাতটাই খেতে পায় কেবল। সপ্তাহে দুই দিন মাছ খায় । জুটে যায় কোনমতে। তাও তেলাপিয়া কিংবা পাংগাসের উপরে উঠে না। গোস্ত বললেতো এখন ফার্মের মুরগি- মাসে একবার কি দুইবার। তার কি এখন বাচ্চাদের মতন যা দেখে তাই খাওয়ার বয়স আছে ! সুনুর আলী ততক্ষণে পিরিচের উপর একটা সুচ বন তার সামনে রেখে দিয়ে গেছে।
ছইফুলের খিদা মরে গেছে এতক্ষণে। বনটা ফিরিয়ে দেবে কিনা , তা নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্ধে ভোগে। ফিরিয়ে দিলে বলবে , টেকা নাই নিবা। টেকার লাগি খায় রায় না । ছি ছি। টেকা দিবায় আরি অন্যদিন।সুনুর আলী বলে ফেলতে পারে। ছইফুলকে অনেক ইজ্জত দেয় বেচারি। সে যে মাগীর দালালিও করে এইটা এ এলাকার সবাই এখনো জানে না। কারণ সিতারা বানুর বান্ধা কাস্টমার আছে। সেই পুরান লোকগুলাই তার ঘাটে আসে। নতুন যদি কেউ আসে সেটা ছইফুল নিজ দায়িত্বেই সিতারার কাছে নিয়ে যায়। আর জেনেই বা লাভ কি। ছইফুল কি কাঁচা কামের মানুষ নাকি ! স্বয়ং মেম্বার সিতারার ঘাটে যাওয়ার জন্য বহুত চেষ্টা করেছিল। সিতারা বানুর বাড়িতে রাতেরবেলা গিয়ে অনেকদিন ডাকাডাকি করেছিল। সিতারা বানু উল্টা ডর দেখিয়েছে। রাতের বেলা মানুষ ডেকে মেম্বারকে সামনা সামনি বেইজ্জত করতে চেয়েছিল। সিতারা বানু যে মাগী তার প্রমাণ কি। স্বামী পরিত্যক্ত নিরীহ একটা বেটিমানুষকে রাতের বেলা বেহুদা উপদ্রব করার জন্য সিতারা বানু ইউনিয়ন অফিসে চেয়ারম্যানের সামনে নালিশ দিতে পারে। মেম্বার পরে ইন্দুরের মতন চোখা মুখটা ভোতা করে পালিয়েছিল। সিতারা বানু এইসব সাহস কার কাছ থেকে পেল ! শেষপর্যন্ত বাপের বয়সী মেম্বার ছইফুলের কাছে এসে ল্যাঞ্জা গুড়ি মেরে বসতে হয়েছিল। ছইফুল নিরাশ করে নি তাকে। পাঁচশো টাকা বখশিস আর ১০ টাকা চালের কার্ডে নাম উঠলে সে কোন মুখে না করে ! আর মেম্বারকে হাতে রাখলে লসের চেয়ে লাভই বেশী। সে হল এলাকার বটগাছ। সিতারা বানুকে দুইশো টাকা কমই দিক। তারপরও আপদে বিপদে তাকে হাতে রাখা ভাল। সিতারা বানু তার পুরান কাস্টমারদের নিয়ে নিয়মিত কারবার করে গেছে। করছে এখনো। ছইফুলকে চাইলে প্রতি সপ্তায় কিছু দিতে পারতো। পারতো না ! কিন্তু ছইফুল জোরাজুরি করে নি। শত হলেও নিজের খালাতো। আর ভালবাসা কি তাকে কম দেয় ! বেটি একা হলেই ছইফুলকে ডাকবে। ছইফুলের মুখটা কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে কান্দাকাটি করবে। “ তোর লাগি আমি নষ্ট হইলাম রে শাম কালিয়া। পরানের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে। “
৩
মেঘ কেটে যাচ্ছে। বাতাস দিচ্ছে মিঠা মিঠা। সুনুর আলীর দোকানে আরো দুইজন কাস্টমার আসে। দুজনকেই সে চিনে। ছইফুলের পাশের সিটে একজন আর মুখামুখি আরেকজন বসে। একজন বিডি আরের লাইনম্যান। আরেকজন ছইফুলের মতন খাসিয়া পুঞ্জির সাফা কামলা। আগের দুই পানকারবারি এখনো বসা। দুজনের মধ্যে একজনের মেয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। স্বামী ফিরত নিতে চাইছে। মেয়ে যেতে চাইছে না। এ নিয়ে হাদিস থেকে আইন থেকে সামাজিক নিয়ম কানুন থেকে বয়ান চলছে। মেয়ে তার স্বামীর ঘরে যাওয়ার পক্ষে একজন। আরেকজন কোনভাবেই সেটার পক্ষে না। শেষ পর্যন্ত ছইফুল তার সামনে থাকা সুচ বনটা না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই একটার সাথে আরো দুইটা একসাথে ঠুঙ্গায় করে নিয়ে যাবে। আজ আর বাচ্চাদের জন্য মামা কিনবে না। এখন মখলিছের টং থেকে এস্পেশাল দুই খিলি পান কিনবে, বাবা জর্দাসহ। সিতারা বানুর মুখনিঃসৃত জর্দার গন্ধ গোটা শরিল অবশ করে দেয়। ঘোর ঘোর অনুভূতি হয়। মনে হয় যেন উঁচু পাহাড়ি টিল্লার মাথায় নির্জনে জিরিয়ে নেওয়ার সময় আচমকা এক পাল বাতাসের মুখে নিজেকে বিলীন করে দেয়া। সিতারা বানুর কোলের কাছে নিজেকে সঁপিয়ে দিলে কিছুক্ষণের জন্য দুনিয়াদারি ভুলে থাকা যায়। তাছাড়া তাকে আগে বলে রাখা দরকার। আর মাত্র দুইদিন হাতে আছে। দুজনে মিলে সলা পরামিশ করে নেয়ার আজই হল উপযুক্ত সময়।
৪
আগেরদিন যে লোকটার সাথে প্রথমে আলাপ করেছিল তার বাড়ি শ্রীমংগল। বেটিমানুষের কসমেটিক্সের কারবারি। মুখে দাঁড়ি আছে। বয়স ছইফুলের চাইতে কম হবে। চুল ডিজাইন করে কাটা। এক হাতে ব্রেসলেট পরা। হাসলে দাঁতের পাটিগুলি শোকেসে সাজিয়ে রাখা স্টিলের কাপের মতন চিকচিক করে। ছোপ ছোপ পান খাওয়ার লাল দাগ আছে। সাদা দাঁতে লাল হালকা পানের ছোপটা তাকে মানিয়েছে ভাল। বান্নির আগের দিন সন্ধ্যাবেলা -দোকানের চাল, খুঁটিশুটি বান্ধাবান্ধি করার সময় , গাড়ি থেকে জিনিসপ্ত্র আনলোড করার সময় ,প্রচন্ড ব্যস্ততা, বিজন গাঙের পাড়ে লাইট কারেন্টের কোন কিছুই ঠিক নাই- লাইনম্যান একটা খুঁটির উপর উঠে মেইন লাইন থেকে কিভাবে কারেন্ট নেয়া যায়, তার কামকাজ করছে।
আপাততো এই গাঙের পাড়ে ঘন বাঁশঝাড়ের ভুতুড়ে ছায়ায় মোবাইলের লাইটই ভরসা। অনবরত ছোট ডায়না বড় ডায়না ঢুকছে । পিলপিল করে ঢুকছে সিএনজি টমটম। কিন্তু বেরোতে গিয়ে সব এক জায়গায় এসে হুপার মুখে মাছের ফালাফালি করার মতন ঝুটাঝুটি লাগিয়ে দিয়েছে। ছোটমোটো গাওয়ালি রাস্তা। মূলত এইটা বাঁধ । বর্ষাকালে রাক্ষুসী মনুর তান্ডব থেকে বাঁচবার জন্য বানানো হয়েছে। ইট সলিং। দুই পাড় খাড়া ঢাল। পাড় থেকে নীচে তাকালে মাথা ঘুরে। একদিকে গাঙের চর। অন্যপাড়ে বেড়া দেয়া ভিটা বাড়ি বসতি। তিনমুখি রাস্তার মুখে এসে গাড়ি টার্ন করতে হবে। এছাড়া আর বিকল্প নাই। সমস্যা করেছে বড় দুইটা ডায়না। এরা রাস্তায় ঢুকবার পর পুরা রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। ড্রাইভারদের চিল্লাচিল্লি, বাঁশঝাড়ের ঘন ছায়া, অন্ধকার নির্জন নদীর চরের মধ্যে গাড়ির হেডলাইটের আচমকা বাড়াবাড়ি ,তার উপর মেঘ থম্থম আকাশ , বৃষ্টি হব হব ভাব, কিন্তু হচ্ছে না। চোইত মাসের পুরপুড়ানি গরম পড়বার কথা, কিন্তু মৃদু ঝিরঝির বাতাসে গরম কেটে যাচ্ছে। রাত বাজে সাড়ে আটটা। ছইফুল মোবাইলে টাইম দেখে নেয়।
এ লাইনে মানুষ চিনে কথা বলা লাগে। বেটিমানুষ চিনা খুবই সহজ। অন্তরের কথা নয়। বাহিরের কথা বলছে ছইফুল। বেটিমাইন্সের পোশাক , তার শরিল, তার মুখের ভাষা, চোখের গতিবিধি –এইসব দেখে এক মুহূর্তেই বলে দেয়া যায় সে ভাল না মন্দ। অবশ্য ছিনালি করলেই যে মন্দ হয়ে যাবে আর বোরখার ভিতর বাস করলেই সাউধ হয়ে যাবে – এই বাক্য কি লাইসেন্স দিয়ে বলতে পারে ছইফুল ! সিতারা বানু ছিনাল বটে, কিন্তু তাই বলে সে কি সত্যই খারাপ ! যাই হোক এইগুলা গভীরের কথা। বেটিমানুষকে বাহিরে থেকে যতটা বিনা পরিশ্রমে চিনা যায়, বেটামানুষকে চিনা কি ততটা সম্ভব ! মাগীখোর বেটা তারাই চিনবে যারা এ লাইনে থাকতে থাকতে পোক্ত হয়ে আছে। মাগীর দালাল হতে পারে সবার কাছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা জাতে না উঠতে পারা সবচেয়ে অকাজের কাম। কিন্তু মানুষ তারা কম চিনে না। আরেকটা হল পৃথিবীর কোন সে ঈমানদার স্বামী আছে যে অন্য বেটিমানুষ দেখলে লিপ্সা করে না । আছে কেউ ! হজ্ব করা হাজী হোক আর সুট বুট পরা বারিস্টার ভদ্রলোক হোক-সুযোগ থাকলে সকলেরই কানা খালে হেউওত মারতে ইচ্ছা করে। মান সম্মানের ভয়ে আগায় না আর কি। তবে মাগীখোরদের কেউ দমাতে পারে না। গাঞ্জা সিগ্রেটের মতন এটাও তাদের একটা নেশা। না গেলে ঘুম হবে না। খাওয়া হবে না।
কসমেটিক্সের দাঁড়িওয়ালা কারবারিটাকে ছইফুলের পুরাই মাগীখোর মনে হয়েছে। যতই সে নিজেকে ছদ্মবেশ দিয়ে আগলে রাখুক, বেটিমানুষ দেখলে এর শরিলে আটালি সাপ দৌড়ায়। কেন তাকে দেখে এরকম মনে হল ছইফুলের । অভিজ্ঞতা ! আর কিছু না। নাও হতে পারে। তবে না হওয়ার চান্স একেবারেই কম।
ছইফুল সুযোগের অপেক্ষায় আছে। সামান নিয়ে মাত্র নামল বেচারি । কোথ্বেকে আসছে তাও জানে না। তবে হাঁকডাকে বুঝেছে সে সিলেটের বাহিরের কেউ না। তবে ধারেকাছেরও না। লোকাল কারবারি মেলার আগের দিন এসে জঞ্জালের মধ্যে হাঁসফাঁস করবে কোন দুঃখে ! যাই হোক ,এখুনি গিয়ে তাকে প্রস্তাব দেয়ার কোন যুক্তি দেখে না সে। ব্যবসায়ী মানুষ। সারাদিন টাকা পয়সার চিন্তা। বড় ব্যবসায়ী হলে এই গাঙ্গের পাড়ে মশার কামড় খেতে কেন আসবে ! দেশের পরিস্থিতি দিন দিন কোথায় গিয়ে পড়ছে –এক আল্লাহ ছাড়া কারো জানার কোন উপায় নেই।
নব্বই টাকা তেলের লিটার ছিল এই করোনার মধ্যেও। এখন করোনা শেষ। লকডাওন অবরোধ হরতাল কিছুই নাই। তাহলে সব জিনিসে ডাবল দাম কেন রাখে তারা ! ছইফুল মূর্খ মানুষ। তার এইসব বিষয় নিয়া কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে কিছুটা আগ্রহী হতে। মোবাইল খুললে হুজুরদের বয়ানে নানান কথা শুনা যায়। সরকার দুষে মহাজনকে। মহাজন সরকারকে। মূলে এরা দুটোই এক জোয়ালের দামা। পুঞ্জির সাফা কামে এই করোনার আগেও আড়াইশ টাকা ছিল। তেল বিড়ি আনাজপাতি কিনে আসলেই কিছু থাকবার মতন ছিল না। জিনিসের দাম গত দশ বছর ধরে শুধু বাড়তেই আছে বাড়তেই আছে। কিন্তু হঠাত করে এই কদিনে এমনভাবে বাড়ল যেন পূর্বাভাস ছাড়াই মনুর পানি রাতের ঘুমের মধ্যে ঘরের ভিতর ঢুকে গেছে। বাঁচতে হলে টাকার দরকার। চুরি দালালি ডাকাতি – মান সম্মানের চিন্তা করার সময় কোথায় এখন ! ছইফুলের মাথার উপর এখন তিন তিনটা মানুষের জীবন দাঁড়িয়ে আছে। যে কাজের জন্য আসছে সেটা তাকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। সিতারা বানু রাজি ছিল না । তার মাত্র এক পেট। একলা মানুষ। একবেলা রানলে তিনবেলা খাওয়া যায়। হপ্তায় দুইজন কাস্টমার আসলেও তার চলে। ছইফুল মনে করেছিল সে যদি বলে চল দোজখে যাই ,তাতেও সিতারা বানু রাজি হবে। কিন্তু বয়স হয়ে গেলে মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। রাতের সিদ্ধান্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে পালটে ফেলে মানুষ ।
যার যার ধান্ধায় সবাই ব্যস্ত। টাকার চাহিদা নাই কার ! বড়লোক ছোটলোক। ছোটলোকের আরও বেশী দরকার। হঠাত যদি কঠিন বেমারে ধরে ফেলে , কে তোমাকে বাঁচাবে ! তোমার ভাই ছেলেমেয়ে কোন কাজে লাগবে না টাকা না থাকলে । বেমারের কথা বললে আজরাইলও ডরায়। সিতারাও কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গিয়েছিল। তার বুকে বেদনার একটা বেমার আছে। সে বিছনায় পড়ে থাকলে তার ছেলে এসে তাকে যে অন্তত এক গ্লাস পানি খাওয়াবে –এমন আশা সে করে না। মরার পর মাটি দিতেও আসে কিনা সন্দেহ আছে।
সিতারা বানু ছইফুলের প্রস্তাবে এমন সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতন বেটি না। কিন্তু এই প্রথম সে বাড়ির বাহিরে যাচ্ছে। তাও মেলার ধারে। নিজের বাড়িতে সারাদিনে কোনদিন চারজন। এটাও সেই প্রথম দিককার কথা। পাঁচজন একদিনে নিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। আর তার কাছে যারা আসে প্রায় সকলেরই ভাইট্টলে টান মারা বয়স। পানের বড় মহাজন। ঘুরেফিরে কজন মানুষই সেই শুরু থেকে আজ অবধি আসছে যাচ্ছে। মেলা একটা বিরাট ব্যাপার। হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। কত ধান্ধার মানুষ আছে দুনিয়ায়। মাগী হল গণিমতের মাল। ইচ্ছামত কামড়াও খাও ভোগ করো। একটু বনাবনি না হলে সেপ দাও লাত মারো। মাগীর কোন বিচার নাই। যদি পৃথিমপাশার ছ্যাচড়া গুন্ডারা জানে সে সেখানে আছে, এক ঝটকায় তুলে নিয়ে কোন গাঙের পাড়ে নয়তো কোন বাগানের চিপায় ঠেসে ধরে এমন হান্দানি দিবে , ঢেঁকির যাতার তলে বরই বিচি পড়লে যেভাবে গুড়া গুড়া হয়ে যায় এরকম অবস্থা করে দেবে না কি গ্যারান্টি আছে ! হিরোইন মদ খেয়ে এরা এমন বেতাল থাকে , গাছের গুড়িসুদ্ধা পেশাবের পথে ঢুকিয়ে দিতে পারে। আজরাইল যা পারে না এরা তাই পারে। এমন দুর্দশায় পড়লে তার রেগুলার কাস্টমার বড় পানকারবারিদেরতো তাকে উদ্ধারের প্রশ্নই আসে না। মাগীর জন্য হুয়াগ দেখাতে গিয়ে জাত খুয়াবে নাকি !
ছইফুলের সাথে দোজখে যেতে এখনো সে রাজি আছে। যতই ছিনালি করুক শরিল বেচে ধান্ধা বান্ধা করুক , ভালোতো একজনকেই বাসে - তাই না ! আজ পর্যন্ত যত পুরুষই তার শরিল ছানামাখা করুক, তার শরীরতো ঠান্ডা ধাতব মরা সাপের মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। যেভাবে চোইত মাসের মাটিপুড়া রোদে ঘাসগুলি বিবর্ণ হলুদ হতে হতে মাটির নগ্ন কংকাল দেখাতে শুরু করে তারপর সেই শূন্য খা খা করা মাটিতে যখন সিজনের প্রথম বৃষ্টি হলে মাটি ফুড়ে কচি দুধঘাস উঁকি দেয়, একটা দুইটা তিনটা, তারপর পুরো মাঠজুড়ে যখন কাচা ঘাসে সবুজ হয়ে যায়- এমন সজীব প্রাণ আনতে সিতারা বানুর পুড়পুড়া জমিনের উপর কে প্রথম জল সিঞ্চন করে ! কার শ্বাসের আঘাতে তার ঠান্ডা মরা রোমকূপে হাইল ধানের চারা গজায় !
৫
যেখানে মেলা হবে সেটা ছোটমোটো একটা চর। নদী আগে বরাবর সমান্তরাল ছিল।এখন নেমে গেছে অনেক নীচে। ঘাসময় প্রান্তর হয়ে যাবে আর কিছুদিন পর। ছাটা ছাটা ঘাস, খরায় মরে জ্বলে আছে। বছরজুড়ে গরু ভইষ দিরগা দেয়া থাকে। মেলার দিন আসলেই এখানকার দৃশ্য পালটে যায়। হোক দুইটা দিন। তারপরেও পরিবর্তনটা ধরা পড়ে।
কাদা মাটিতে খালি পা ভুর ভুর করে দেবে যেতেই ছইফুলের মনে হয়, কাঁচা মাটির বোটকা গন্ধ তার নাকের ভিতর সুরসুর করে ঢুকে যাচ্ছে। সে দিনমজুর মানুষ। রাত পোহালে কোমরে দা লটকে পুবের পাহাড়ে চলে যায়। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে। যা পায় তাই দিয়েই বাজার সদাই করে। যেদিন রুজিতে যায় না সেদিন উপাস থাকা লাগে। তার মত মানুষের জীবনভর স্বপ্ন থাকে যদি ঘরের ভাত খাওয়া যেতো। ঘরে ভাত থাকলে অন্তত লবণ দিয়ে হলেও তিন বেলা খাওয়া যায়। চালের বস্তা এখন বাজারে তিন হাজার করে চলছে। ছইফুল প্রতিদিন ষাইট টাকা করে দুই কেজি আনে। ঘরে খানিয়াল তার পাঁচজন । মানুষ নয় যেন হাতির বাচ্চা পালছে সে। সামনে ভাত দেখলে তার বাচ্চারা ক্ষুধার্ত কুকুরের মতন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদিন কাম করে এসে এইসব দৃশ্য দেখলে তার ক্লান্তি আসে। যদি সামান্য ক্ষেত গিরস্তি থাকতো ...... কাঁচা মাটির গন্ধটা তার নাকের সামনে এসে আছড়ে পড়তেই অবচেতনের স্বপ্নটা আবার তাকে ক্ষণিকের জন্য বিভোর করে দেয়।
নির্জন চরাচরটা মুহূর্তের মধ্যে মানুষের কোলাহলে ভরে যায়। বড় ডিস্ট্রিক গাড়ির হেডলাইট পড়ে অন্ধকার নদীর পাড় জ্বলজ্বল করছে। রাজা শিয়ালের চোখের মতন। যেন বনবিছুটি ঝোপঝাড়েরও গুচ্ছ গুচ্ছ চোখ আছে। যেন ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রচন্ড বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ তারা। সিএঞ্জি, টমটম, মোটরসাইকেলের প্যাপু প্যাপু ক্রমাগত বাড়তেই আছে। বৃষ্টি পড়ছে নাকি পড়ছে না বুঝা যাচ্ছে না। একেকবার শরিলের উপর ক ফোঁটা পড়েতো আবার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী ক ফোঁটার জন্য ছইফুল শূন্য অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সাথে ছাতা আনে নাই। সন্ধ্যাবেলা খুব তোড়জোর ছিল বৃষ্টি পড়ার। বাতাস বইছিল খুব। ছইফুল তখন রবিরবাজারে সাটার লাগানো এক দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছিল। একটু চিন্তাতেও পড়ে গিয়েছিল বৈকি। এখন বৃষ্টি দিলে সব পন্ড হয়ে যাবে না ঠিক তবু দেরি হয়ে গেলে কোথ্বেকে কি ঝামেলা এসে হামলে পড়বে বলা যায় না কিছুই। তাও মেলার আগের রাত বলে কথা।
হঠাত আলো জ্বলে উঠল আকাশে। ছইফুল ভেবেছিল বাজ পড়ল বুঝি এসে। মেঘলা থমথমে আকাশ। বলা যায় না- নিরিবিলি ভালাসাংগা দিনে এমন করে জম্বাই ক্বারীর তাজা জুয়ান ছেলেটা মরে গেল বাজ পড়ে। কার মওত কোথায় হবে , একমাত্র তিনি মালিক ছাড়া আর কে জানবে। আলো জ্বলার সাথে সাথে মানুষের চিল্লাচিতকারে ছইফুলের সম্বিত ফিরল। লাইনে কারেন্ট জ্বলেছে। অন্ধকার ,বিদগুটে , একটানা ঝিঁঝিঁপোকার সাইরেন শুনতে শুনতে কানে মাথায় ঝিম ধরে গেছে। আলো জ্বলায় পুরা গাঙপাড় দিনের মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আলো দেখে মানুষের ক্লান্তিভারী শরিলে যেন দ্বিগুণবেগে শক্তি ফিরে আসে। “ অইতো অইতো ! সাকেরার মা কই গেলে বে !” গাঙের ওইপার থেকে কেউ জবাব দিচ্ছে “ আছি আছি “।
রাস্তার উপর সাইড করা প্রচুর গাড়ি। অন্ধকারে বুঝা যায় নি। মাল আনলোড হচ্ছে। মানুষ বাড়ছে । পিঁপড়ার লাইনের মতন ।পিলপিল করে মানুষ শুধু আসতেই আছে। আসতেই আছে। এইভাবে অপেক্ষা করলে সারা রাতেই আর অবসরে থাকা কোন মহাজনকে পাবে না সে। যত সময় গড়াচ্ছে ব্যস্ততা বাড়ছে আরো বেশী । উপায় নাই। এক দাড়িয়ালার আশায় বসে থাকলেতো তার চলবে না। কারবারি কি কেবল এক কাস্টমারের আশায় দোকান খুলে বসে থাকে ! তার এখন কাস্টমার খুঁজা জরুরি। কারেন্টের আলো পড়ে নতুন পলিথিনে মুড়ানো তাবু, সার্কাসের রঙচঙ লাগানো প্যান্ডেল, পিটানো ঢেউটিন দিয়ে বানানো দোকানঘর, জলে ভেজা পুরান বাঁশের মাথা – চকচক করে কাঁপছে । বাঁশঝাড়ের ঘন সবুজ পাতার উপর আলো পড়েছে। ছইফুলের এখন বাঁশঝাড়ের দিকে যাওয়া উচিত। সেখানে জালের কারবারি দল ইতিমধ্যে বাঁশঝাড়ের নীচে তাবু খাটিয়ে বেচাবিকি আরম্ভ করে দিয়েছে। অন্ধকারে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছইফুল কার বাল ছিঁড়ছিল তবে।
লালবাগের বড় আকর্ষণ হল জাল। উড়াল জাল, ফেলইন জাল, ধরমি জাল, মণিপুরি জাল। কী আসে না এখানে ! বাঁশঝাড়ের নীচে মাঝখানে আসা যাওয়ার পথ রেখে দুই পাশে দোকানগুলা বসে গেছে। বাঁশের মাথায় তাবু লটকে সারি সারি ঘর।কারেন্টের আলোয় আজ পুরা বাঁশঝাড় যেন সকালবেলার তাজা রোদের নীচে বসা গ্রামীণ কোন হাট। ছইফুলের দরকার এখন কাস্টমার ।জাতের কাস্টমার। যার হাত ধরে আসবে অগণিত ,পিলপিল করা পিঁপড়ার সারির মতন মানুষ। মানুষ এখানে এসে খুঁজে জাল। সে খুঁজে জালের মহাজন। মানুষ নিয়ে কারবার তার। হাতে নিলে জালের ভাল মন্দ বুঝা যায়। মানুষ বুঝা সহজ নয় অত। যাকে চোখে দেখে খুব বিশ্বাসী বলে মনে হয়, সে ই পরে ছোবল মারে। সাপকে যেমন সামান্য সুযোগ দিলে মুহূর্তেই গোটা একটা পরিবারকে তচনছ করে দিতে পারে, মানুষও তাই। “মানু চিনা অত সুজা নায় গো যাদু “। কে বলেছিল কথাটা ! ছোটবেলায় কুকিবাড়ি পাহাড়ের অপর পাড় বইট্টাং বাড়ি থেকে আসতো এক বাইদ্যা বুড়ি। কোন এক বিকালে দাঁতভাঙা বুড়িটা ছইফুলদের বাড়ির উঠানে তাবজাতি করার সময় এই কথাটা বলেছিল। ছইফুল আজো সে কথা ভুলে নি । ভুলা কি অত সহজে যায় !
মেলাতো কাল। মানুষের ঢল এসে নামবে কাল সকাল থেকে । আজ আশপাশ বাড়ির অনেকে এসেছে। এরা আজ কেউ কিনবে না। দাম যাচাই করতে এসেছে। মেলার একেবারে শেষদিন, শেষ সময় ,দোকান গুটানোর সময় এরা আসবে। তখন কম দামে পাওয়া যাবে এই আশায়।
সামনে কোন মানুষ নাই এমন একটা দোকানের মালিকের দিকে চোখ পড়ে ছইফুলের। তার কর্মচারী ছেলেটা মোবাইল টিপছে। দোকানের সামনে মাথার উপর গোলবারের মতন একটা বাঁশে ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে কটা উড়াল জাল। ছোট ছোট পাথর বান্ধা থাকায় এ জালের ওজন আর সব জালের চাইতে বেশী। মাথাভরা ঘন চুল, এক কানে দুল বান্ধা , যতন করে গোঁফ ছাঁটা । মালিক লোকটাকে মনে ধরে ছইফুলের। কিন্তু কাছে যেয়ে বলবার সাহস করতে পারে না সে।বড় বড় কালো চোখ , গম্ভীর হয়ে দোকানের সামনের দিকে চেয়ে আছে। বয়স কত হতে পারে। পঁচিশ ছাব্বিশ। এরকমই হবে। হিন্দু এবং বিবাহিত । আপাততো অতটুকু অব্যর্থভাবে নিশানা করতে পারে ছইফুল। যদি তার চিনতে ভুল হয় ! বলাতো যায় না। হিন্দুরা মদে যত পাগল নারীতে তত নয়। সে কিভাবে জানল সেটা ! এটাও অনুমানে সে ধারণা করে নিয়েছে। হতে পারে তার অনুমান ভুল ।মুড়ইছড়া চা বাগানের অনেক লেবারের সাথে পুঞ্জিতে একসাথে কাম করা সুত্রে পরিচয় আছে। জব্বার ফকিরের সাথে একবার রামনারায়ণের ঠেকে গেছিল। সেই প্রথম গাঞ্জা খাওয়া তার। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে সে যায়। সেখানে বাগানি ছাড়াও অনেক হিন্দু ছিলিম খেতে আসে। তাদের সামনে বসে বুঝেছে হিন্দুরা মদে যত পাগল মসলমান তত পাগল নারীতে। ঐ বালধুয়া পানিতে কি সুখ তারা পায় কে জানে ! নতুন কচি মেয়ের শরিলের কাচা ঘেরান যারা পায় নি তাদের জন্মই বৃথা, ছইফুল তাই মনে করে।
লোকটাকে বলবে নাকি বলবে না এ নিয়ে বেশ দুন্দুরবুন্দুরে পড়ে যায় সে। দোকানে লটকানো জালে হাত দিয়ে সে জিনিসের ভাল মন্দ যাচাই করতে থাকে। হাত দিয়ে উড়াল জালের লটকানো ছোট ছোট পাথরগুলির ওজন পরখ করে। দোকানদার আর কর্মচারী তাকে কিছুই বলে না। তার দিকে তাকায়ও না। হতে পারে তারা তাকে দেখে বুঝে ফেলেছে এ লোকটা কিছু কিনবে না। মেলার কাছাকাছি কোন গ্রাম থেকে এসেছে। যাচাই বাছাই করতে করতে মেলা চলে যাবে তবু সামান আর কিনা হবে না এদের। হতে পারে এরকম বান্দা ভেবেছে তাকে। ছইফুল খুব উশখুশ করে। কর্মচারীর সামনে বলবেই বা কিভাবে। এইসব কি যার তার সামনে বলা যায় ! লোকটার চোখে উদাসী ভাব। সেই তখন থেকেই শূন্য দৃষ্টি সামনে রেখে কী গভীর ভাবনায় ডুবেছে কে জানে ! কী অত চিন্তা করে যুবক ! সংসারে অশান্তি ! ব্যাংক লোনের গাতায় পড়ে গেছে ! করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যবসায় লাল বাত্বি জ্বলেছে ! আপনজন কারো কঠিন কোন অসুখ ! একে ঘাঁটিয়ে কোন লাভ হবে না এটা বুঝতে পারে ছইফুল। হালা ম্যান্দামারা ! হালার ঘরর হালা ! অত চিন্তা কিতা বে ! দুনিয়াত আইজ আছি কাইল নাই। অত চিন্তা করিয়া কে কার বাল ছিঁড়ল । মর গি হালা !
৬
ছইফুল এবার নিজের উপর খানিকটা খুশি হয়। জালবেচরা উদাসী মহাজন যুবকটাকে অভিসম্পাত দিতে দিতে সে নিজের জীবনের দিকে তাকায় কিছুক্ষণ। রুজি করলে খায় আর না করলে সেদিন উপাস । এইতো জীবন ! এখানে এত ঝামেলার কি আছে বুঝে না সে ! রাজ্যের টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরলে কোন সমাধান হয় ! “ ধুরো বাল ! “ এই কথাটা মুখ বিড়বিড় করে বললে সে নিজে যেন গইবি কোন শক্তি শূন্য বাতাস থেকে ধরে এনে তার শরিলে পুরে দেয়। যেভাবে বিলে মাছ ধরার সময় বড় কোন শোল মাছ ধরার পর খলইর হা করা মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বিজয়ের একটা রোমাঞ্চ পাওয়া যায় ঠিক সেভাবে। এই ম্যান্দামারার পিছনে সময় নষ্ট করা মানে হল ভোঁতা দা দিয়ে রউ মাছ কাটার মতো। ছইফুল এই বালটার পিছনে আর একটা সেকেন্ড ব্যয় করতে রাজি না। শার্টের পকেট থেকে সে ডার্বি সিগ্রেট রাখা কাগজে মুড়ানো পুটলিটা বের করে । বাজার থেকে তিনটা কিনেছিল। একটা খেয়ে শেষ। সিগ্রেট খেয়ে এবার সে কাস্টমার খুঁজবে। বাজারে কাস্টমারের অভাব নাই। একজনের সাথে বনাবনি না হলে কি দোকানদার দোকান বন্ধ করে বাজার থেকে চলে যায় ! বাজারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পড়ে থাকতে হবে । এটাই জাত কারবারির নিয়ম। ঘাড় ঘুরিয়ে ছইফুল এবার মেলার অন্যান্য দিকে চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়। কারেন্টের আলো মেলার প্রত্যেকটা কোণাকে পর্যন্ত ছাড়ে নি। আধ ঘন্টা আগে যে জায়গা বাঁশঝাড়ের গহিন অন্ধকারের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়েছিল, এখন সেটা দিনের আলো পড়বার মতন ঝকমক করছে। এখনো গাড়ি ঢুকছে অনবরত। ডায়না, ট্রলি, সিএনজি, টমটম। এতক্ষণ বালের গোদা এক মহাজনকে ধ্যান দিতে গিয়ে গাড়ির কোন শব্দ খেয়াল করে নি সে। এখন তার মনে হচ্ছে, গাড়ি আগের চাইতে আরো বাড়ছে। গত দুই বছর বান্নি বন্ধ ছিল । এইবার হয়তো তা সুদে আসলে ভরিয়ে দিতে কানায় কানায় দোকানপাট উপচানো থাকবে। সামান আছে কিন্তু টাকা কোথায় ! কে এই চাটি পাটি জুতা জামা ডেক ডেকচি লোহা লক্কর গয়না গাঁটি বাচ্চাদের খেলনা পাতি বল বেলুন গাড়ি কিনবে ! কে কিনবে ! কে ! কার হাতে টাকা আছে !
আকাশ আরো মেঘলা করেছে। দক্ষিণ দিকে বারে বারে মেঘ চিলিক মারছে। আজ বৃষ্টি নামবে। হয়তো এমন বৃষ্টি নামবে, ছাতা না আনা ছইফুল খোলা বৃষ্টি মাড়িয়ে যাওয়ার সাহস করতে পারবে না। এই মেলার বাহিরে কী ভীষণ চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশে তারারা সব চাপা পড়ে গেছে মেঘের নীচে। চন্নি নাই একফোঁটা । জালের গলি থেকে ছইফুল বের হয়ে আসে। বাহিরে এসে যেন দমটা পুরাপুরি ফেলবার জায়গা পায়। বাঁশঝাড়ের চিপায় আসলেই গরমও ছিল ভ্যাপসা। তার শরিলে ঘাম জমে গেছে। বাহিরে এসে সে খোলামেলা বাতাসের ঝাপট খায়। আহ ! এত শান্তি দিলায়গো আল্লাহ ! দোকানদাররা সব আজ দোকান মেলতে ব্যস্ত। সে হেঁটে হেঁটে কসমেটিক্সের গলিতে ঢুকতে যাবে, অমনি এক বেকারির দোকানদারের উপর তার নজর পড়ে। কারেন্টের আলোর সাজসজ্জায় মেলার পুরা অলি গলি আজ সিলেটের হাসান মার্কেট হয়ে গেছে যেন। বেকারির দোকান। কেক বিস্কুট বন লুফ নিয়ে মোটামুটি ভাল একটা জায়গা জুড়ে রেখেছে । প্রায় মধ্যবয়সী এক লোক। এও দাড়িয়ালা ! নামাজ কয়জনে পড়ে তার ঠিক নাই কিন্তু দাঁড়িতে দাঁড়িতে সয়লাব হয়ে গেছে গোটা দেশ। ছইফুলের এখনো দাঁড়ি রাখার বয়স হয় নি বলে সে মনে করে। কিন্তু আজকাল বাল উঠার আগেই দাঁড়ি রাখতে শুরু করে দেয় পুলাপাইন। তার বউ তাকে এ নিয়ে দুই দিন পর পর সবক দেয়। আরে ভাই দাঁড়ি রাখা শুরু করে দিলেই তোমার জীবন অন্য জীবন বানিয়ে ফেলতে হবে। ঈমান ঠিক রাখতে হবে। নামায পড়তে হবে প্রতি ওয়ক্ত। মিছা কথা বলা যাবে না। আল্লাহকে ভয় করতে হবে। সুদখোর মাগীখোর দেখলে একশো হাত দূরে থাকতে হবে। পারবে ছইফুল ! যে লোক মাগীর দালালি করে সে কি আল্লাহর কাছে গোপন করতে পারবে কোন কিছু ! বলা সহজ। করে দেখানো অত সহজ না। এই দেশে নেক আমলদার লোক কয়জন আছে । বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে কেউ সে সাচ্চা ঈমানদার ! বেকারির মহাজনটাকে কি মনে করে ছইফুল প্রস্তাব দেবার জন্য এগিয়ে যায়। বাট্টি গাট্টাগুট্টা লোক । দাড়িয়ালা। দাঁড়িতে আবার মেহেন্দি লাগানো। এই মেহেন্দির কারণে ছইফুল সাহস পায়। এই লোকের কাছে যেতে সে সাহস কোথ্বেকে পেল ! অভিজ্ঞতা । আর কিছু না। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কম নয়। দোকানে আর কেউ নাই। এটাই সুযোগ। যদি এখানে বনাবনি না হয় তাহলে প্রথম দাড়িয়ালার সাথে সাক্ষাত করবে । আর দেরি করবে না। বেকারির দাড়িয়ালা তাকে পাত্তা দিতে চায় না। তার হাবেভাবে বুঝাতে চায় ছইফুল একটা বাটপাড় টাইপের লোক। লোকটার ভাবনায় দোষ দেখে না ছইফুল। অচেনা জায়গা। টাউট বাটপাড়ে ভরা দেশ। কে ভাল কে মন্দ তা কি আর বুকের উপর ছাপ্পা লাগানো আছে। মাগীর লিপ্সা দেখিয়ে এইরকম বড় বড় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। চালাক মানুষ এই ফাঁদে পা দেবে না। ছইফুল তখন লোকটিকে বলে , সে আল্লাহর কসম কেটে বলছে। এইটা তার পেশা। তার যদি এতই বিশ্বাস না থাকে তাহলে কেবল কয়টা টাকা নিয়ে যে স্থানে সে বলবে সেখানে আসুক। এসে একটিবার দেখুক, সে সত্য না মিথ্যা । তারপরও কোন কাজ হয় না। লোকটা তাকে বুঝাতে চায় সে যেন নিজের রাস্তা মাপে। ছইফুল কি একটু অপমানিত হল ! মিথ্যা বলবে না । একটু তার গায়ে লেগেছে। কিন্তু পরে এটাও ভাবে, এইসব কি গায়ে রাখবার মত মানুষ সে ! মাগীর দালালি করতে গেলে শরিলের চামড়া গন্ডারের চামড়ার মতন করে নিতে হয়। গ্রামের দালাল হলে অত চিন্তার কিছু থাকে না। কাস্টমার খুঁজে খুঁজে তার কাছে চলে আসে। শহরে ঘটে উল্টাটা। এখানে জিনিসের অভাব নাই। কার মাল কে নেবে ! দালালের হাতেই পুরা ব্যবসার ভাল মন্দ নির্ভর করে শহরে।
দুইটা মানুষের কাছ থেকে ব্যর্থ হওয়ার পর ছইফুলের কি একটু চিন্তা বেড়ে গেল ! কাস্টমার না পেলে ঘরভাড়া গাড়িভাড়া পর্যন্ত গায়ের উপরে পড়বে। ঘর মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে। টিলাগাও আর রবিরবাজারের মাঝামাঝি মেইন রোডের ধারে যে বড় বড় মহাজনরা তাদের গুদামঘর বানিয়ে রেখেছে সেগুলোর যেকোন একটা নিলেই চলবে। বাজারে পরিচিত অনেক মহাজন আছে তার। বান্নির কারবারিরা দুই রাতের জন্য থাকবে বললে ৫/৬ শো টাকার বিনিময়ে যেকেউই ঘর ছাড়তে রাজি থাকবে। এইগুলাতে তেমন মাল সামান থাকেও না। নামে গুদামঘর আর কি। মূলত বাজারের কাছাকাছি একটা ভিটা কিনে দখল করে রাখা। রবিরবাজার এখন প্রায় টাওনের কাছাকাছি চলে এসেছে। দক্ষিণ দিকে রাজাপুর ব্রিজের উদ্বোধন হয়ে গেলে উপজেলা শহর কুলাউড়া টাওনকে টেক্কা দিয়ে বসবে রবিরবাজার।
ছইফুলের মাথায় এখন টেনশন ঢুকে গেছে। যেভাবে সহজ ভেবেছিল আসলে দেখা যাচ্ছে বিষয়টা অত সহজ না। সে হন হন করে কসমেটিক্সের গলি দিয়ে হাঁটে । দোকান এখনো ভরে নি ঠিকমতো। কারবারি আসছে একের পর এক। মাল আনলোড করছে। তাবু টানাচ্ছে। এইমাত্র সার্কাসের মাইকটা বাজল । হেলো হেলো ......মাইক্রোফোন টেস্টিং...... আসসালাম আলাইকুম ...... ও হিন্দু ভাইদের আদাব। ডায়মণ্ড সারকেসের পক্ষ থেকে আপনাদের জানাই এক গুচ্ছ লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। গাঙের তাজা হাওয়ার মধ্যে মাইকের সুরটা ছইফুলের ভাল লাগে। মেলার আসল আকর্ষণ হল গান বাজনা বাঁশি আর বাচ্চাদের খেলনার পুপাপুপা আওয়াজ। এইসব ছাড়া মেলার কথা কল্পনাই করা যায় না। অনেক লম্বা লম্বা গলি । কসমেটিক্সের গলিই বোধ হয় চার পাঁচটা হবে। “ কিনো রে বেটিন শরিল উদাম করিয়া কিনো। দুনিয়াতো বেটিমানুষের লাগি । ঘরও দুইবেলা ভাত না থাউক তউ আমার গয়না চাই। কানর দুল চাই। হাতর চুড়ি চাই “।
৭
মোটামুটি বেশ বড় একটা ঘর পেয়ে যায় ছইফুল। বাজারের রড সিমেন্টের মহাজন চুন্নু বাবুর প্রায় গুদামঘর বলা যায়। কিন্তু মাল রাখা নাই। তল ঢালাই করা। সাটারিঙের দরজা। তালা চাবি আছে। বড় দুইতলা বিল্ডিঙ্গের নীচের তলার ঘরটা অনেক বড় ।ছইফুলের একটা ছোটোমোটো রুম হলেই চলতো । প্রায় আধ পাওয়া বিচরার মত এত বড় ঘর দিয়ে সে কি করবে ! প্রথমে কথা ছিল প্রতি রাত পাঁচশো দিতে হবে । মহাজন জানে এখানে বান্নির কারবারিরা এসে থাকবে। বাথরুম নাই । পানির বন্দোবস্ত নাই। সারা বছর খালি পড়ে থাকে । চারিদিকে ধূ ধূ জমিন। মাঝরাতে কারো পেটে বেদনা ধরলে একটা পিকড়াকেও ডাকলে পাবে না। এমন জন মানুষ নাই শূন্য রাস্তার পাশে একটা রাতের জন্য পাঁচশো টাকা ! এ টাকায়তো রবিরবাজারে গোটা মাস থাকা যাবে ! যাবে না !
তাতেতো চুন্নু মহাজনের কিছু আসে যায় না। সে কি আর বছরে একবার আসা বান্নির কারবারির জন্য ঘরটা বানিয়েছে ! এইভাবে ঘর দেয়ারও নিয়ম নাই। যদি বোমা টোমা ফাটিয়ে দেয়া সেইসব জংগিবাহিনীরা থাকে তাহলে এদের ঘর দেয়ার অপরাধে চুন্নু মহাজনের গোটা লাইফ বরবাদ হয়ে যেতে পারে । ক বছর আগে মহররমের দিন এইভাবেইতো বোমা ফুটেছিল। ফুটে নি ! ছইফুল কি ভুলে গেছে ! আসলে ছইফুলের এইসব মনেই নাই। এইগুলা তার মাথাতেই আসে নি। মহাজন হিন্দু লোকতো , তাই ডর বেশী।
সেই বোমা মারা জংগি লোকটা মহররমের দুই দিন আগে কোথায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল ! কানিকিয়ারি জামে মসজিদে। সেই লোকটাকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে আজ সতেরো বছর পরও সে মসজিদের ইমাম মামলার আসামী। কোর্টকাছারি করতে করতে বেচারির ভিটামাটি সব শেষ। ছইফুল কি চায় চুন্নু মহাজনেরও এই দশা হোক। সে তাকে চিনে অনেক দিন আগে থেকে। পুঞ্জির যত পাকা ঘরবাড়ির মাল সামান তার বেশিরভাগই এই মহাজনের ঘর থেকে যায়। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই মহাজন ছইফুলকে দেয়। কিন্তু তাই বলে প্রতিদানে কি এইভাবে সে পিছন দিক দিয়ে আক্কিয়ালা বাঁশ ঢুকাবে ! কথা ছিল কোথায় আর গেছে কোথায় ! সামান্য একটা পড়ে থাকা ঘর ভাড়া দেবে – এ নিয়ে যে এত গ্যাঞ্জাম হবে জানলে ছইফুল আরেকটা ঘর দেখতো। এরকম ফেলে থাকা গুদাম ঘরেতো মহাজন তাকে মাগনাও দিতে পারে , পারে না ! দুইদিনেরইতো কারবার মাত্র ! এত বছর ধরে আসা যাওয়া তার দোকানে, কত খাসিয়া কাস্টমারকে তার দোকানে এনে দিল সে । আর বিশ্বাসের কথা মহাজন বলছে তাকে। ছইফুল সামান্য খাসিয়া পুঞ্জির কামলা। তার কি ঠেকা পড়েছে বাজারের বড় মহাজনদের গুয়ায় বাঁশ দিতে ! এত কিছু বলার পর কাজ হয়। বেচারি মহাজনের মাথায় কি আসল কে জানে। শেষ পর্যন্ত তাকে মাগনাই দিয়ে দেয়। “ যা তোর টেকা লাগতো নায়। দুইদিনের বেশী তিনদিন করিস না। কাইল আইয়া চাবি নিয়া যাইস”।
ঘরের এক কোণে সিতারা বানুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা পুরান শাড়ি দিয়ে ঘের বানিয়ে ফেলেছে সে। কাছাকাছি বিজলি গ্রামে তার এক ফুফু থাকেন। সেখান থেকে তোশক বালিশ চাদর চাটি টমটমে করে নিয়ে এসেছে। এখন বাজে দুপুর দুইটা। আজ সকালের দিকে বৃষ্টি দিয়েছে। ভেজা ভেজা বাতাস বইছে। রোদ নাই। মেঘলা মেঘলা ভাব। ভালবাসা করার জন্য সবচাইতে আদর্শ পরিবেশ। ছইফুলের খুব ইচ্ছে করে একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয় সামনে। “ ভালোবাসা এনটারপ্রাইজ ।“ নীচে লেখা থাকবে ছোট করে- “এখানে ভালোবাসা সুলভ মূল্যে বিক্রি করা হয়”। ডানদিকে কোণার দিকে লেখা থাকবে লাল রঙ দিয়ে , যাতে সবার চোখে ভাসে। “ প্রোপাইটর ঃ মোহাম্মদ ছইফুল হুসেন “। আজ নিজেকে তার সত্যি সত্যি বাজারের বড় মহাজনদের মত কল্পনা করতে ইচ্ছা করছে।
সিতারা বানু সন্ধ্যার পরপর বাড়ি থেকে রওয়ানা দেবে। এখন দুই ডজন রাজা কন্ডমের প্যাকেট কিনতে হবে। সিগ্রেট লাগবে দুই প্যাকেট। ডার্বি ব্রাণ্ডের। সাথে কিছু পানসুপারি থাকলে ব্যবসা আরো জমতো। মাগীর কাছে যাবার আগে ব্যাটা মানুষ যদি মুখে দুর্গন্ধ নিয়ে যায় বেইজ্জতির সীমা থাকে না তখন। আবার অনেকে আছে মাগীর ধারে গেলে মুখে খিল এটে যাবার মতন তব্দা লেগে বসে থাকে। সেদিন শতকিছু করেও আর মুখের জবান সহজ করা যায় না। তবে পান খেলে মুখের জড়তা কাটে- এটা সত্য। শক্ত হয়ে থাকা ধাতব চোপাজোড়া পানের রসে একটু ভিজে উঠলেই তেল পড়লে জং ধরা সাইকেলের ফিবুল দৌড়ার মতন ফরফর করে তালে উঠে। মাগীর অপমান অনেক বড় অপমান।
কিন্তু টেনশনের কথা হচ্ছে গতকাল সে একটা কাস্টমারকে ধরতে পারে নাই। চুন্নুবাবু ঘরভাড়া না রেখে তার এমন উপকারটা না করেছেন, এজন্য সে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবে বেচারির কাছে। নাহলে দুইদিনে ঘরভাড়া এক হাজার সে কোথ্বেকে বের করতো ! চুন্নুবাবুর ঘরে তিনবেলা কামলা খেটে এর শোধ দিতে হতো। ঘর রাস্তার ধারে আরো আছে। কিন্তু মাগনা দিতো না কেউই। চুন্নুবাবু যে বললেন , যাকে তাকে ঘর দেয়া যায় না। ঘর ভাড়া দেয়ার আগে আই ডি কার্ডের কাগজ দেখাতে হয়, পুলিশকে নাকি সে কাগজের একটা কপিও দিতে হয়। নতুন আইন । মানতে হবে। না মানলে উল্টাপালটা কিছু হলে ভাড়া দেয়ার অপরাধে মালিক ফাঁসবে । ঝামেলা অনেক আছে। যাক মাগনা ঘর ভাড়া পাওয়ায় সে বড় একটা দুঃশ্চিন্তা থেকে বেঁচে গেল। এখন যদি কোন কাস্টমার নাও আসে তাতেও মনে করে সে অত ক্ষতি হবে না। বড়জোর পাঁচশো যাবে। টাকার দরকার এখন খুব ঠিকই আছে। কিন্তু কাস্টমার না পেলে তার করার কি থাকতে পারে। কাল রাতে সে যে দাড়িয়ালাকে প্রথম ধরেছিল, কসমেটিক্সের কারবারি, সে লোকটাকে প্রস্তাব দিতেই লোকটা হেসে হেসেই উত্তর দেয় ,” ভাইজান , কারবার করবার লাগি আইছি। এইসব ধান্ধাবান্ধা করিয়া পুষাইতো নায়।“ অথচ ছইফুল জানে কসম দিয়ে বলতে পারে , সে জাত মাগীখোর। ভাল মানুষ সাজছে। ছইফুল সবার কাছ থেকে ব্যর্থ হবার পর অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিল। টাকার তার দরকার খুব। অনেক আশা করে সে বান্নির আগের রাতে এসেছে।
রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তার মনে হয় ,এইভাবে কোনদিনও কাস্টমার ধরা যাবে না। চেনা নাই জানা নাই বাউটা কেউ এসে বলল অমুক জায়গায় চলেন, ভাল জিনিস আছে। ছইফুল নিজে কি যাবে ! এখনকার সময়ে কে কাকে বিশ্বাস করে ! আপন বউ ঘুমের মধ্যে যদি বালিশ চেপে স্বামীকে মেরে ফেলতে পারে, মা যদি দুধের মধ্যে বিষ মিশায়ে তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে – ছইফুল কোথাকার এমন ঈমানদার আসল যে তার কথা বিশ্বাস করতেই হবে ! তার চাইতে আগে থাকতে কথাবার্তা না করে সাথে সাথেই কাস্টমার আনাটা কাজের কাজ হবে বলে সে মনে করে ।
৮
চোইত মাসের ভরা পূর্ণিমার রাত। আকাশে আজ মেঘ নাই। ঝলমলে রুপালি আকাশ। এমলা রাইতের লাগি সাতটা খুন করলেও নিশা কাটতো নায়। ছইফুলের আজ ঘোর লেগে যাবার দিন। রাস্তার ধারে এসে সে সিগ্রেট ধরিয়ে একা একা চন্নি উদযাপন করে। বিস্তৃত খোলা মাঠ। গত রাতে বৃষ্টি দেয়ায় ব্যাঙদের সিজন শুরু হয়ে গেছে এবার আগে আগে। ডাকছে ঘ ঘ্যা ঘ ঘ্যা। বাতাস বইছে মোলায়েম। রোডে সিএঞ্জি ডায়না ছুটছে অবিরত। রাত বারোটার পরে হয়তো গাড়ির ছুটাছুটি কমে যাবে। এমন নিরালা রাইতে কানের পাশে গাড়ির আওয়াজ হর্ন আসলেই খুব বেখাপ্পা লাগে।
গত রাতে যে দাড়িয়ালা কসমেটিক্সের কারবারি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আজ সে সবার আগে এসেছে। রাত বাজে এখন দশটা। মেলা আজকের মত শেষ। মানুষ ফিরে গেছে যে যার ঘরে। কারবারিরা এতদূর থেকে এসেছে। সাথে বউ নাই প্রেমিকা নাই। আর এমন নেশা ধরানো রাতে খালি খালি থাকবে কেউ - তা কি মানা যায় ! প্রথমে দাড়িয়ালা কসমেটিক্সের কারবারি পাঁচশো দিতে চায় নি। সে বলেছে জিনিস দেখে দাম।ছইফুলতো তাই চায়। সে কি এই কামে কাজের দিনে ঝিমিয়ে পড়া নালি শাক নিয়ে বাজারে এসেছে ! বাজারের সবচাইতে সস্তা শাকের নাম হল নালি শাক। সিতারা বানু কি নালি শাকের মতন সহজলভ্য আর সস্তা ! ছইফুল দাড়িয়ালার কথায় খুশি হয়। জিনিস দেখে দাম ! এই না হল সাচ্চা কারবারির বাচ্চা।
ঘরের ভিতর কারেন্টের বন্দোবস্ত নাই। বড় সাইজের একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে জানলার নীচে। সিতারা বানু যেখানে আছে সেটা কাপড়ের ঘের দেয়া। ভিতরে এমন মোহময় আলো , লাল লাল , যেন কাচা ভোরে ,সূর্য উঠি উঠি ভাব। মনে হয় গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানব জাতি নিঃশেষ হয়ে গেছে। রয়ে গেছে কেবল সিতারা বানু আর তার কাস্টমার। আদম হাওয়ার নতুন রুপ ধরে আবার বীজ বপণ করবে। আবার শুনা যাবে সংগীত, বাশি, গাঙের কূলকুল ধ্বনি, মিঠা বাতাসে কলমি ফুলের মূরচ্ছা যাওয়া, বৃষ্টিধোয়া আসমানের বুকে ঝলমল করা তারাদের ঢেউ। মানুষ না থাকলে পাখির গান কে শুনবে, ফুলের ঘ্রাণের কি দাম থাকবে , কাচা মাটির ঝাঁঝালো গন্ধ যদি বুকের ভিতর গিয়ে আছড়ে পড়ল না তাহলে কিসের পৃথিবী, কিসের দুনিয়াদারি । ভালোবাসা প্রেম ঘৃণা – আবার একসাথে বেড়ে উঠবে। ধীরে ধীরে। মানুষ যতদিন পৃথিবীতে আছে ভালবাসা ততদিনই থাকবে। ভালোবাসা এন্টারপ্রাইজের মালিক জনাব ছইফুল হুসেন এইসব ভাবতে ভাবতে কি একটু আনমনা হয়ে গেল !
সিতারা বানুকে দেখে কসমেটিক্সের দাড়িয়ালা মহাজন বলতে গেলে প্রায় চমকে উঠে। সে বোধ হয় এতটা আশা করে নি। তার চোখের ক্ষুধা দেখে ছইফুল মনে করে যদি এখন তাকে বলে এই নারীর রেইট এক হাজার , লোকটা না করবে না তবু। এমনকি দুই আড়াই হাজার বললেও আজ দাড়িয়ালা গাইটের সর্বস্ব খুঁয়াতে রাজি আছে। কিন্তু ছইফুল জানে সে এমন চরিত্রের লোক নয়।
সিতারা বানু এমনিতেই ধবধবে সাদা। তার কোন স্নো পাওডার ক্রিম গায়ে দিতে হয় না। তবে ছইফুলের কাছে তার রুপ আর টানে না। হাজার হোক বিবাহিত । তার উপর মেয়ে বিয়ে দিয়ে নাতি পেয়ে গেছে। হতে পারে সে অনেকদিন তাকে কাছে পেয়েছে বলে তার প্রতি টান কমে গেছে। সে যে মাঝেমধ্যে সিতারা বানুর কাছে যায়, তা কি আসলে তার শরিলের লোভে নাকি তার ভালোবাসার টানে ! – সে মনে করে ভালোবাসার টানেই সে যায়। সিতারা বানু টাকার বিনিময়ে অন্য পুরুষের সাথে বিচনায় যায় , ঠিক আছে , কিন্তু সে মানুষটা কেমন ! সে কেমন এইটা ছইফুলের চাইতে আর কে জানে ! তার আপন স্বামী হুসমত দাইদারের কুকুরের কপাল , তার যদি মানুষের কপাল থাকতো- সিতারার মত নারীকে এইভাবে ফেলে চলে যেত না। এমন মেয়ে মানুষ লাখে এক। কসমেটিক্সের দাড়িয়ালাকে দেখামাত্র সে অন্য মাগী মেয়েমানুষের মতন গুমড়া মুখ নিয়ে থাকে নি। কাস্টমার টাকা খরচ করে সামান্য সময় থাকতে এসেছে। তার সাথে মুখ গুমড়া করে বসে ভাব দেখাবার দরকার কি। বাজারের মাগীর সাথে এইখানেই সিতারার তফাৎ । তার হাসিহাসি পান খাওয়া মুখ আর সরল চোখের চাহনি দেখে মনে হবে পাশের বাড়ির ভাবী স্বামীর অজান্তে দেবরকে নিয়ে শুতে যাচ্ছে। ছইফুলের কাছে এরকমই মনে হতো প্রথম প্রথম। একটা নিষিদ্ধ গোপন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে ভেবে শরিলের রক্তপ্রবাহ আটালি সাপের মতন পাকিয়ে পাকিয়ে মাথার দিকে উঠতে থাকতো। কে জানে দাড়িয়ালার মনে হয়তো সিতারার সরল হাসি দেখে আগুনের দিকে ধাবমান পতংগের মতন ঝাপ দিতে দেরি সইছে না। এখন আর ছইফুলের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার বয়স নাই। অথচ তার এখন মাত্র সাতাশ চলে । অনেকে এ বয়সে বিয়েই করে নি। ছইফুল সেখানে দুই বাচ্চার বাপ। শরিলে কামনা , সুখ এখন আর সে আগের মতন উপভোগ করে না। বয়স বাড়লে ভালবাসার জন্য মানুষ বড় কাঙ্গাল হয়। ছইফুল এখন চোখের সামনে কিছুক্ষণের জন্য অন্য একটা দৃশ্য দেখে। সেদিন তুতবাড়ি বাজার থেকে সিতারার বাড়িতে যখন যায় রাত তখন দশটা সাড়ে দশটা হবে, অনুমানে বলছে। মাথার উপর ঝলমলে চন্নি। বাতাস বইছে ফুরফুরে। চ্যাপচ্যাপা গরমটা কাটে নি পুরাপুরি, হেঁটে আসতে যেয়ে ছইফুল ঘামতে শুরু করে দিয়েছে।
সিতারার ঘরটা নির্জন টিল্লার উপরে। আশপাশের বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে। লিচু গাছভরা ঝাঁকড়া বাড়ি। বড় উঠান। এক কোণে লিচু গাছের তলায় কুয়া আছে। পাকা ঘর। আস্তর দেয়া । চার চালা টিনের ঘর। বাড়ির পিছনে ঘন জাই বাঁশের ঝাড়। বারান্দা নাই। উঠান থেকে এক পা বাড়ালে ঘরের মূল দরজা। ঘরের এক কোণায় বর্গার সাথে লটকানো আছে কারেন্টের ভাল্ব। ফকফকা আলো পুরো উঠান জুড়ে রেখেছে।
সিতারা বানু ছইফুল আসছে দেখে আবার ভাত চড়িয়ে দেয়। বাড়ির হাঁসের পাড়া ডিম আছে। মুন্সীগঞ্জি আলুর বাকল ফেলে দিয়ে পিস পিস বড় টুকরা করে ডিমের ঝোল। বন্দুলা পাতার কড়া ঘ্রাণ মেশানো। এমন রান্না বহুদিন খায় নি ছইফুল। সিতারা রাঁধে ভালো। পশ্চিম দিকের জানলাটা খোলে দেয়া। চন্নির আলো এত পরিষ্কার যে বাঁশঝাড়ের ওপাড়ে বিলের পানির চিকচিক করে কাঁপাটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সিলিং ফ্যান চলছে। তবু সিতারা হাতপাখা পাইলিয়ে দিবে। তার বুকের আঁচল ফেলা। ভরাট স্তনের ভাঁজ হা করে আছে সিংহের মুখের মতন । কিন্তু ছইফুল সিংহের মুখে এত তাড়াতাড়ি পড়তে চায় না। তার এখন দূরে ডেকে চলা “ কাঠল পাকে” পাখির ডাকের সাথে শূন্য স্রোতে ভেসে যেতে ইচ্ছা করে। সে ক্লান্ত, ধ্বস্ত পথিক এক। তার এখন বটের ছায়ার তলে ঝিরিঝিরি বাতাসে গভীর নিদ্রায় ডুবে যেতে ইচ্ছা করে। সরীসৃপ যেভাবে ছয় মাস পাতালে চলে যায় সেভাবে যদি মানুষও কিছুদিনের জন্য চলে যেতে পারতো কোথাও ! সিতারার কাছে আসলে তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। ভুলে যায় তার স্ত্রী আছে বাল বাচ্চা আছে। সিতারাকে কি সে ভালবাসে ! তাই বা হয় কি করে ! ভালোবাসলে ঈর্ষা আসে হিংসা আসে । ভালোবাসার জন্য মাথায় রক্ত উঠে খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না মানুষ।
এই যে এখন সিতারা এক কাস্টমারের সাথে নগ্ন হয়ে নিজের শরিল বন্ধক দিয়ে শুয়ে আছে , ছইফুল যদি তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে তাহলে তার রাগ করার কথা। ক্ষুব্ধ হয়ে ক্রুদ্ধ পশুর মত আর্তনাদ করার কথা ! কথা না ! কিন্তু এইসব তার বিন্দুমাত্র হচ্ছে না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট মুখে নিয়ে সে বরং সিতারার বাড়িতে সেদিন শেষ রাতে ঝাঁকড়া লিচু গাছের নীচে কুয়ারপাড়ে গোসলের ইয়াদ করে। চোইত মাসের খোলা মাঠ পেড়িয়ে বাতাস আসে। মোলায়েম তরতাজা বাতাস। ভেজা মাটির ঘ্রাণ নাকে এসে ঝাপট মারে। বৃষ্টি দিবে ভাব আছে। চন্নি ভরা আকাশ। মেঘ নাই এক ছিটা। তবু শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হবে। গুদামঘরের দরজা জানলা বন্ধ রাখলে গরমে এক মুহূর্ত টিকে থাকা মুশকিল হওয়ার কথা । কিন্তু গত রাতের বৃষ্টির কারণে চ্যাপচ্যপা গরম কেটে গেছে। বদ্ধ ঘরে তবু সামান্য গরম লাগে। কিন্তু এটা সহ্য করা যায়। বিকালের দিকে এমন ছিল না। রাত বাড়ার সাথে উমানি বাড়ছে একটু করে। এইটার উপর ভিত্তি করে ছইফুল অনুমান করে বৃষ্টি আসতে পারে। তবে আসলেও শেষরাতে আসবে ।
৯
প্রথম কাস্টমার চলে যাওয়ার পরপরই ছইফুল একসাথে আরো তিনজনকে আনতে এবং প্রথমজনকে একটু এগিয়ে দিতে টিলাগাও বরাবর চলে যায়। কাস্টমার ডাইরেকট এসে গুদামের সামনে নামবে না। এতে সিএনজি ড্রাইভাররা সন্দেহ করতে পারে। যদি কোনভাবে এরা জেনে যায় তাহলে বাজারের গুন্ডারা খবর পেতে দেরি হবে না। তখন যা টাকা ইনকাম হয়েছে সেটাতো যাবে সাথে সিতারাকে তুলে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরবে আর কোথায় ঘুটতে ঘুটতে মেরে ফেলে রাখবে –তার কোন গ্যারান্টি নাই। আহা ! একটা মাগী বেটির জন্য কত দরদ গো ! সিতারা ছইফুল চলে যাওয়ার পর এইটা ভাবে। হোক কৃত্রিম, তবুতো তার ভাল মন্দ নিয়ে একজন অন্তত পৃথিবীতে ভাবে । আর কৃত্রিম বলেই বা কি করে ! ছইফুল আসলেই সামান্য হলেও তাকে যে ভালোবাসে , তার সুখদুখের চিন্তাভাবনা করে – এইটা কিন্তু মিথ্যা না। সিতারা বুঝতে পারে । পুরুষ মানুষকেতো তার চেনার আর বাকী নেই। সে ছইফুলকে নানা ভাবে পরীক্ষা করে দেখেছে , না , লোকটা তাকে ঘেন্নায় না। লয়ে তারা খালা ভাগিনা সম্পর্ক । আপন না হোক। ছোটকাল হতে জানাশুনা আসা যাওয়া –এইসবের মধ্যে মায়ার একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। মিথ্যা বলবে না সিতারা , সে ছইফুলকে ভালোবাসে । এই ভালোবাসার মধ্যে কোন চাওয়া পাওয়া দখলদারি নাই। সে কখনো চায় না তার জন্য আরেকটা মেয়ে আর দুই অবুঝ শিশুর জীবন এলোমেলো হোক। এভাবেই মাঝেমধ্যে ছইফুলকে পেলে সে খুশি।
এখানে আসবার একদমই ইচ্ছা ছিল না সিতারার। সে গিরস্ত বাড়ির মাগী, বাজারি নয়। যারা তার কাছে আসে , তাদের সে আগে থাকতে চিনে জানে। এদের শরিলের দুর্গন্ধও তার সওয়া হয়ে গেছে। অমুক মহাজনের বগলের গন্ধ, অমুকের নাকের শ্বাস ফেলার গন্ধ , হিন্দু মহাজন উমেশের পেট থেকে সে সবসময় মসুরি ডাল বাঘাড় দেয়ার ঘ্রাণ পায়- এইসব সে চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারবে । থাকতে থাকতে গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ভীষণ খারাপ লাগতো। বমিও করেছে কাস্টমার চলে যাওয়ার পর অনেকদিন। এখন যেমন অচেনা এক কাস্টমারের তলে শুয়ে থাকার পর মাথা গুলিয়ে উঠছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে। সেই শুরুর দিনের মতোন। তার মনে হচ্ছে বমি করে দিলে শরিলে আরাম পাবে অনেক।
বাজার থেকে ছইফুল ভাত এনেছে। ট্যাংরা মাছের ঝোল। সিতারার প্রিয় মাছ । খিদা লেগেছিল খুব। প্রথম কাস্টমার আসবার আগে আগে ঝটপট খেয়ে ফেলেছিল সে। রান্না হোটেলের হলেও খেতে মন্দ হয় নি। ভাত খাওয়ার পর পানের খিলি মুখে দিতে দিতে সে ভাবছিল টাকা পয়সার কথা। সপ্তাহে চার পাঁচজন কাস্টমার তার বান্ধা থাকে। চলে যায় মোটামুটি তার। কিন্তু ছইফুলের কথাটা মনে করে সে এবার আরো বেশী করে যেন ভাবতে চায়। টাকার দরকার নাই দুনিয়ায় কজন আছে ! আজ সে বেমার পড়লে চিকিৎসার টাকা কে তাকে দিবে ! বেমারের কথা উঠল যদি তখন তার চোখে ভাসল বিচনায় কুকড়েমুকড়ে পড়ে থাকা কোন বেটিমানুষের দৃশ্য। যার মাথার মাঝামাঝি জায়গাটা গর্ত হয়ে আছে । উপর থেকে দেখলে দেখা যায় গর্তের ভিতর সাদা সাদা কৃমি পোকা কিলবিল করতে করতে মাথার মগজ খেয়ে ফেলেছে। এমন ভয়ংকর দৃশ্যের কল্পনা করতে করতে সিতারার গা গুলিয়ে উঠে। এত কিছু দুনিয়ায় থাকতে এমন দৃশ্যই বা তার চোখের সামনে কেন দেখালেন আল্লাহ ! সে তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। না এমন খারাপি কাজ আর সে করবে না। আল্লাহ গো ! এর চাইতে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভিখ করে খাবে । তবু আর মাগীবাজি নয় । ভাবতে ভাবতে বমি করার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর এক কোণায় উবু হয়ে কয়েকবার শরিলসুদ্ধ কাঁপিয়ে বমি করতে চায়। বমি আসে না। এখানে এখন যদি সে মরে যায় ! মানুষ কি এভাবে এ অবস্থায় মরতে পারে না ! হায়াত মউতের কথা আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে !মোমবাতির মৃদু আলোর ভিতরে ঘরটাকে তার ছেলেবেলার ফেলে আসা কোন এক বিস্মৃতির ঘর বলে মনে হয়। একটিবার বাহিরে গেলে ভীষণ ভাল লাগত তার। গুমোট ঘরের ভ্যাঁপসা গন্ধ মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। গরমও কি কম লাগছে ! শাড়ি খুলে কেবল পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে থাকে। অন্ধকারে কে দেখছে তাকে ! মাগী বেটির আবার শরম ! বমিটা একবার করে ফেললে খুব আরাম পেত ! আবার সে ঘরের কোণায় যায়। উবু হয় । শরিলসুদ্ধ কাঁপিয়ে চেষ্টা করে কয়েকবার।
কিন্তু বমি করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে সিতারার এবার ধীরে ধীরে বাস্তব জ্ঞান ফিরে আসে। এতক্ষণ সে যেন ভ্রমের জগতে ছিল ! মাগী বেটির আর ডর কি ! যা হয় হবে নে ! বিচনায় ধুকে মরবার উপক্রম হলে তখন সে নাহয় ইন্দুর মারার বিষ খেয়ে নিবে এক দলা। আত্নহত্যা পাপ। তবু সে তা করবে। পোকায় খেয়ে তিল তিল করে মরে যাবার চাইতে একলগে ধুম করে মরে যাবে সে। মরার পরে সেতো দোজখে যাবেই। তখন যা হয় হবে নে। এতক্ষণ ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু প্রথম কাস্টমার তার শরিলের উপর সওয়ার হতে হতে তার গা গুলানো বমির ভাবটা ফিরে আসে আবার। লোকটা পরিষ্কার , সাদা, মুখে চাপ দাঁড়ি । যা করার পনেরো মিনিটেই করতে হবে। ছইফুল আগ থাকতে বলে দিয়েছে । বিয়াতি ব্যাটামানুষের জন্য পনেরো মিনিট যথেষ্ট সময়। লোকটা তাদের কথা রেখেছে। কথামতো তার হাতে পাঁচশ সাথে উপরি আরো খুশি হয়ে একশো দিয়ে গেছে। বলেছে আবার আসবে। আজ ভোর রাতেই নাকি আসবে আবার। কাস্টমার এরকম বললে সিতারার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার তখন থেকেই শরিল খারাপ লাগছিল। বুঝতে দেয় নি কোনভাবে। দম আটকে পড়ে থাকছিল। লোকটা যথেষ্ট পরিষ্কার, শরিলে বরং আতরের কড়া সুবাস পেয়েছে সে। তার বান্ধা কাস্টমারদের প্রত্যেকেই বুড়া, মুখে দুর্গন্ধ, পেটে মসুরি ডালের বিশ্রি গন্ধ, তবু তার গা সওয়া আছে। অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজ একটাকে নিতে নিতে শরিলটা অমন করে উঠল কেন ! এইসব জানতে পারলে ছইফুল খুব রাগ করবে। মুখে বলবে না তবু মনে মনে বলবে “ মাগী বেটির যত ঢং “। তবে সে আশা করে আরো দুই তিন জনকে নিতে পারলে আপনা আপনি তার শরিল ঠিক হয়ে যাবে।
১০
সিতারা বানুর দুই হাত ভরা কাঁচের চুড়ি। লাল আর সবুজ। হাত নাড়ালে ঝনঝন করে। ফর্সা ধবধবে হাতে মেন্দিও পরা। তারা মেলা ঘুরতে আসছে। গতরাতে বৃষ্টি দেয়ায় মেলার পুরা জায়গাটা কাদায় ল্যাটল্যাটা । মানুষ তো নয় যেন পিঁপড়ার ঢল নামছে। মাইকে সার্কাসের ক্যানভাসার চিৎকার করে যাচ্ছে অবিরাম। কোলে বাচ্চা কাঁখে বাচ্চা কাঁধে বাচ্চা। বান্নির মজাতো তাদের কাছেই। সদ্য কিনা বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ। কেউ আকাশের দিকে বড় বেলুন উড়িয়ে সূতা ধরে রেখেছে হাতে। গরম মচমচা জিলাপির ঘেরানে গোটা মেলা প্রাঙ্গন ম ম করছে। বাতাস দিচ্ছে বড় মোলায়েম । আহা ! মেলার গা ঘেঁষেই ছুটছে মনু নদী। তিরতির ঢেউ কাঁপছে । দুই পাড়ে নৌকায় যাত্রীরা আসা যাওয়া করছে। আজ সিতারা সেজেছে খুব। শাড়ি পরলে ফুটতো আরো। কিন্তু এইটাতো বিয়া বাড়ি নয়। হাজার হাজার বেগানা মানুষের ভীড়। লংলা অঞ্চলের সবচাইতে বড় মেলা। সে সিল্কের বুকে জরির কাজ করা বোরখা পরেছে। এইটা তার খুব প্রিয়। হাত ধরে আছে ছইফুলের। আজ সিতারা বাচ্চা মেয়ের মতন এ গলিতে একবার ও গলিতে একবার ছুটছে কেবল । তার উত্তেজনা দেখে ঈষৎ বিরক্ত ছইফুল। মুখে কেবলই বলছে “ বেটিমানুষরে আল্লায়ও পারছইন না ! ইয়া মাবুদ ! “ তার কুঁচকানো মুখ দেখে সিতারা আরো খুশি হয়। তার উদ্দেশ্য যে আসলে কেনাকাটা মূখ্য নয়, ছইফুলকে রাগানো – এই সহজ জিনিসটা ধরতে পারছে না দেখে সে হাসে একা একা, মুখ টিপে, নেকাবের ভিতর। তার প্রসাধনী এটা সেটা কিনার পর তারা চটপটি খায় । ছইফুলের মুখে তুলে দিতে চায় সে। কিন্তু এইটা মেলা। ঘর না। লাজ শরম নাই নাকি । ছইফুলের রাগে কপাল ঘামতে থাকে। সিতারা আরো হাসে। বলছে বলে খাইয়ে দিতো নাকি ! “ অইছে তুমি আমার প্রাণের সুয়ামী নায় যে অত গুসা করতো অইব। দয়া করি মুখ খান কালা করি রাখিও না। কেউরে জুরে খাওয়াইতে ঠেকছি না আমি !”
সিতারার কেনাকাটা শেষ। বাকী রইল শুধু খৈ। এইটা মেলা থেকে বেরিয়ে যাবার পথে কিনবে। এবার ছইফুলের জন্য সে কিছু কিনে দিবে। কি কিনবে ছইফুল ? আজ সিতারা তার জন্য কিনে দেবে। সে শুধু মুখে বলুক। তার কিছুর দরকার নাই । একটা দা কিনলেই যথেষ্ট। গরুচুদা বেটা মানুষ। সিতারা কত শখ করেছিল ছইফুল বলবে ঘড়ি কিনে দাও। কালা চশমা কিনে দাও। অন্তন্ত একটা লুংগিওতো বলতে পারতো। গরুচুদা বলে কিনা দা কিনবে ! তবু সে তাকে একটা লুংগি কিনে দেবে। মুখেতো সে না বলতেই পারে। লাজুক মানুষ ।কোনদিন চেয়ে কিছু নেয় নি। সিতারাতো নিজে বুঝতে পারে । পারে না ! ছইফুল হুসেনকে তার চাইতে আর কে ভাল করে চিনবে এ সংসারে ! তার বউ থাকতে পারে । কিন্তু ছইফুল কি তাকে ভালোবাসে ! মনে হয় না বাসে ! মানুষের চোখ দেখে বুঝা যায় তার তৃষ্ণা বেশী নাকি তার পেট ভরা ! বুঝা যায় না ! লুংগির দোকানের সামনে সিতারা একরকম জোর করে ছইফুলকে নিয়ে যায়। ভীড়। কাদা। পায়ের জুতা হাতে উঠে গেছে। মানুষ নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত, কাদার মধ্যে। এই সময় কার ঠেকা পড়েছে কারো মুখ দেখার। আবিতা মেয়েরা নিশ্চই খুব কষ্ট পাচ্ছে তাদের মুখখানা দেখাতে না পেরে। কার চোখ কার বুকে বিঁধবে –কে জানে ! স্বয়ং আল্লাহ সব দৃশ্য তৈয়ার করে রেখেছেন।
সিতারার আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই জীবনে। সে ঘর সংসার করে দেখেছে। রুপ বেঁচে দেখেছে। ভালোবেসেও দেখেছে। এখন আল্লার কাছে একটাই চাওয়া । তার ভালোবাসার মানুষটা যেন সারাজীবন এইভাবে একসাথে ঘর না বেঁধেও ভালোবেসে যেতে পারে । ভীড়ের মধ্যে সিতারা ছইফুলের হাত ধরে পিছু পিছু হাঁটে । হঠাত সিতারা পা পিছলে পড়ে যাবে অমনি তাকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে ছইফুল। পড়তে দেয় না তাকে। কিন্তু ঘাড় ফেরানো মানুষটা কে ? ছইফুলের চেহারাতো এরকম নয়। মুখের এক পাশ আগুনে জ্বলা , কয়লার আস্ত একটা পুড়া টুকরার মতন । আরেকপাশ ভালো। চোখটা ঠিক চেনা চেনা । কার মতন জানি ! খুব কাছাকাছি পরিচিত একজন । মানুষটা চোখের সামনে থেকে আসছে আর যাচ্ছে । কে হতে পারে ! কে ! কে ! সিতারার মাথা ধরে গেছে। কে জানি লোকটা ! খুব চেনার মধ্যে একজন। আরেক চোখের দিকে তাকালে ভয় লাগে। ঘুটঘুটে পুড়া কয়লার মধ্যে চোখটাও জ্বলে গেছে আগুনে। এমন চাহনি দেখে কার না ডর লাগে ! মেলার এত ভীড়ের মধ্যে সিতারার নিজেকে একা আর প্রচন্ড অসহায় দেখায়। সে চিৎকার করে গলা ফাটাতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না । গলার নীচে কেউ যেন রশি ধরে টানবার মতন জিহবার মাথা টান দিয়ে রেখেছে। প্রচন্ড গুঙাতে গুঙাতে সিতারার ঘুম ভাঙে।
১১
ঘুম ভেঙে সিতারা কিছুক্ষণ ভ্রমে থাকে। এ কোথায় আসল সে ! অন্ধকার ঘর। তবে ভোর হচ্ছে বুঝা যায়। বাহিরে থেকে আবছা দিনের আলো জানলার ফাঁক গলে ভিতরে আসছে। মাথার উপর পাকার ছাদ। তার ঘরতো পাকার ছাদ নয়। টিনের চালা। তার ভোরে উঠার অভ্যাস নাই। কতদিন হল ভোর দেখে নি সে । কতদিন হতে পারে ! দাইদার ছেড়ে যাওয়ার প্রায় ৮ বছরতো হবেই। ৮ বছর কম নয় ! এই দীর্ঘ দিন তার মনে পড়ে না কখনো ভোরে উঠেছে বলে। ছেলেবেলায় ভোর দেখতে হত প্রতিদিনই। বাপ ছিলেন নামাযী আমলদার মানুষ। ফজরের নামায তার বাচ্চাদের পড়বার তাগদা না দিলেও ভোর থাকতে মক্তবে যাবার বেলায় কিন্তু কোন ছাড় দিতেন না। কাঁচা ঘুম চোখে রেখে মুখ না ধুয়েই জমিনের আইলের উপর ছুটতে হতো ভাইবোনদের সাথে নিয়ে। দু পাশে কাঁচা সবুজ ধানগাছ, অবারিত সবুজ আর সবুজ , তার ওপাড়ে সারি সারি সুপারি গাছ, ঘন মুলি বাঁশের ঝাড় , এই বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকেই তরমুজের লাল ফালির মতন ছোপ দেখা যাবে পুব আকাশে। তার মা বলতেন লাল ডোরাকাটা বাঘ জঙ্গলের মাথার উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে। দৌড়ে চলা ছোট ভাই বোনরা একটু পিছিয়ে পড়লে তখন লাল ফালি তরমুজের আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় ভাইবোনরা বলতো “ ওউ ঘুম তাকি উঠল লাল বাঘ। ডাকতাম নি বাঘরে “ । এই কথা বলা মাত্র বাচ্চাদের মধ্যে কান্দাকাটির শোরগোল পড়ে যেত। পিচ্ছিল আইলের উপর ধপাস ধপাস করে পড়া শুরু হত তখন।
ধীরে ধীরে তার ঘোর ভাঙে। কাল দাড়িয়ালা কাস্টমারকে বিদায় করার পর নতুন কাস্টমার আনতে সেই যে গেল ছইফুল তারপরে আর এখন পর্যন্ত তাকে দেখে নি সিতারা। সেও এমন মরা ঘুম দিল , এক ঘুমে পুরা সকাল। এর মধ্যে ছইফুল কি একবারও আসে নাই ! তাই বা হয় কি করে। কাল রাতে আর একটা কাস্টমার আসে নি। সিতারার তাতে এমন কিছু ক্ষতি হয় নি। বরং দাড়িয়ালা আসার পর মনের মধ্যে যে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল, সেটা নিয়ে তখন সে বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। কয়েকবার বমি করবারও চেষ্টা করেছিল। মুহূর্তের মধ্যে এমন জ্বালাতাইশ করছিল শরিলটা, মনে মনে সে চাইছিল আর কেউ না আসলেই বরং সে এই অসুস্থতা থেকে রেহাই পাবে। ঘুম থেকে উঠার পর তার এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। বেচারি ছইফুল হয়তো কাস্টমার আর আনতে পারে নি বলে সিতারার মুখোমুখি হতে লজ্জা পাচ্ছে। নিশ্চই ভোরবেলায় হয়তো হাগামুতা করতে বাহিরে গেছে। সিতারা কোথায় পেশাব পায়খানা করবে। হালার পুয়ায় এমন ঘর রেখেছে – বাথরুম নাই , পানির বন্দোবস্ত নাই। পায়খানা যদি করতেই হয় তবে এই ভোর ভোর থাকতে জমিনের আইলে চলে যাওয়া ভাল। চোইত মাসের উদাম মাঠ। এপাড়ে দাঁড়ালে ওপাড় দেখা যায়। কেউ যে দেখবে না তার কি গ্যারান্টি আছে ! এবার ছইফুলের উপর রাগ হয় সিতারার। সে কি বাজারি বান্দিদের মতন। আন্ধার হলেই ঘরের কোণায় নিয়ে কাপড় তুলে কাম সারো । পেশাব পেলে রাস্তার ধারে বসে পড়ো, পায়খানা চাপলে দৌড়ে যেয়ে রাস্তার লাইটের ছায়ায় ভীতু জন্তুর মতন ডাইনে বামে তাকিয়ে উঠাবসা করো। নাহ ! এইবার সত্যি সিতারা নিজেকে ভীষণ অপমানিত মনে করে। ভালোবেসেছি বলে এই না যে বেটা কুত্বা বিলাইয়ের মতন যা খুশি তাই ব্যবহার করতে হবে। আজ আসুক বালের গোদা। সব কিছুর একটা সীমা আছে। এই অবস্থায় সে এখন বাহিরে গিয়ে পায়খানা যদি করেও পানি পাবে কোথায় ! চোইত মাসি জমিন খুড়লে কি ছইফুলের মার দুধের নহর ছুটবে ! যা দিয়ে সিতারা তার হাগু করা পুটকি ধুয়াবে ! হালার ঘরর হালা বাইঞ্চুত। মা চুদ্রা শালা। গতকাল বিকালে বৃষ্টি দিয়েছে যদিও কিন্তু সিজনের প্রথম পানি পেলে চোইত মাসের মাটি কি আর খাতির করে ! গরম কড়াইয়ে এক ফোঁটা পানি পড়লে যেমন সাঁত করে উঠে, এইসময় মাটিও তাই। সিতারা এবার বিচনা থেকে এক লাফে উঠে ঘরের কোণায় দুই ঠ্যাং ফাঁক করে ছর ছর করে মুতে।“ নে হালা নে । তোর মুখো মুতরাম দ্যাখ !”
মুতা শেষ করে সে আবার বিচনায় যায়। মোবাইলে একবার কল করে জিগানি দরকার। “হালার ঘরের হালা পাঁচশো পাইয়া আরেক মাগীর ধারো গেছস গি না কিতা !” । সে জানে ছইফুল এমন ধান্ধাবান্ধার মানুষ না। টাকা যা পায় সবই সে বুঝে দেবে আবার। প্রথমে সে টাকা নিতে রাজি ছিল না। সে দালাল মানুষ। কাস্টমার আর দোকানদারের মাঝখানে সে কেবলই ব্যক্তি মাত্র। কিন্তু সিতারা তাকে বলে সে কাস্টমারের সাথে টাকা আদায় করতে পারে না। একা হলে কথা ছিল। ছইফুল যখন আছে তখন সে ই নিক এই কাম । দুজনে একসাথে থাকলে যেমনটা তারা করে থাকে । আসলে সিতারা টাকা নিজে নিতে পারে। এটা এমন কোন বিষয় হল ! কিন্তু সে এইটা করে তাকে সম্মান দেখানোর জন্য । ছইফুল বুঝুক সিতারা তাকে কিভাবে কি চোখে দেখে !
কিন্তু আজ তাকে এভাবে বাজারি মাগির মতন পথেঘাটে বসিয়ে ছইফুল এই কি তার সম্মানের প্রতিদান দিল ! যত ভাবে সিতারা রাগে আগুন হতে থাকে। মোবাইলে কল করে দেখে ছইফুলের মোবাইল বন্ধ। “ধুর হালা বোইন চুদ্রা ।“ রাগ করলে সিতারার মুখ পুরাই ছিনাল বেটির মুখ হয়ে যায়। আজ সত্যি সিতারা যদি ছইফুলকে সামনে পায়- খোদার কসম সে মুখে ছেপ ফেলে দিতে পারে । রাগলে সিতারার প্রেসারও বাড়তে থাকে। অনেকক্ষণ সে ঝিম মেরে বসে থাকে। মাথার দু পাশের রগ গাছি টনটন করছে, উঠানামা করছে টিওবওয়েলের হাতলের মতন । সে হাই প্রেসারের রোগী।
সে এইবার নিজেকে বুঝায়, এখন এই বিজন জায়গায় কোনকিছু হয়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু ছাড়া আর কোন কথা থাকবে না । যেটাই হোক, এখন সে এখান থেকে বাড়ি চলে যাবে। এই মুহূর্তে , এক সেকেন্ড আর এখানে সে থাকবে না । কিন্তু এই হালার পুয়ার ফোন বন্ধ কেন ! ফোনতো বন্ধ থাকার কথা নয়। নাকি তাকে এভাবে ফেলে রেখে বাড়ি চলে গেল ! সিতারা জানে এরকম কোনদিনও করবে না ছইফুল । কিন্তু আজ ছইফুলের গালি খাওয়ার দিন। যেভাবেই হোক, আজ তাকে গালি দিতে দিতে মুখে বেদনা না উঠা পর্যন্ত তার পেটে ভাত পড়বে না। কিন্তু ফোন বন্ধ করে এতক্ষণ সে কি করে ! নাকি কাল সারা রাত আর এখানে ফিরে নাই ! তাই বা হয় কি করে ! “ ধুর বাল “ । সিতারা এবার টমটমের ড্রাইভার আখলাছকে ফোন করবে। এই ভোরবেলা ,কেউ কি কাঁচা ঘুম ফেলে রেখে আসবে ! কিন্তু আখলাছ আসবে। “আখলাছ কাকলাছ বাকলাছ” – সিতারা এই বলে ক্ষেপায় তাকে। বোইন চুদ্রা ছইফুলের সাথে আর ভায়াব না। বহুত দেখেছে। এবার ফুটো ভাগিনা।
১২
সিতারা বাড়ি ফিরে যায় আখলাছের টমটমে চড়ে। সারাদিন সে ঘুমায়। ঘুম ভাঙে তার বিকালের আসর আযানের ওয়াক্তে। বিচনায় শুয়ে শুয়ে সে আসরের আযান শুনে। তারপর ধীরে ধীরে বিচনা থেকে উঠে কুয়াপাড়ে গিয়ে গোসল সারে। ঘরে রান্ধাবাড়া কিছুই নেই। রানতে এত আলসি লাগছে আজকে। পেটে ভুখও নাই তেমন । কিন্তু কিছু একটা পেটে পড়া দরকার। নাহলে গ্যাস্ট্রিকের বেদনা ধরলে উপায় থাকবে না। ঘরে চিড়া আছে। তেলে ভেজে চিড়া কিছু খাওয়া যায়। কয়টা খেয়ে আবার ঘুমাবে। রাতে উঠলে দুইটা ভাত ফুটিয়ে খাবে নাহয়। আখলাছকে ফোন দিলে সে দুইটা ডিম আর মসুরি ডাল এনে দিয়ে যেতে পারে। ফোনটা চাইলে এখনি দিতে পারে সে। পরে মনে নাও থাকতে পারে।
ফোন হাতে নিয়ে তার খেয়াল হয় ছইফুল কেন ফোন করল না কেন এখন অবধি। এভাবেতো কোনদিনও হয় নি। রাগ গুসা যতই করুক, ছইফুলের সাথে তার সম্পর্কতো একদিন দু দিনের নয়। সে যে এভাবে না বলে আসল , সেজন্য কি ছইফুল রাগ করেছে তার উপর। কিন্তু করারতো আসলে কিছু নাই। সিতারা অন্য সবার কাছে সামান্য মাগী হতে পারে । কিন্তু ছইফুলের কাছে কি সে বিশেষ কিছু নয় ! আর ছইফুল যে তার এইভাবে চলে আসায় গাল ফুলে বসে থাকবে, অন্তত একটা ফোন দেয়ার প্রয়োজন মনে করবে না – তা কি হয় ! বিশ্বাস করা যায় !
বিপদ কি শুধু বেটিমানুষের আসে ! বেটা মানুষের আসে না !, ভাল মন্দ যাই হোক, ছইফুল তাকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর করল না সারা দিনে , তা কি সম্ভব ! রাগতো আপনজনেই করে- তাই না ! ভুল শুধু সিতারার না , ভুল ছইফুলেরও আছে। যে লোক ভালোবাসার মানুষকে ইজ্জত দেয় না, বিনিময়ে সে কিভাবে ইজ্জত আশা করে ঐমানুষটার কাছ থেকে !
১৩
ঠিক দুই দিন পর নিখোঁজ ছইফুলের লাশ মিলে মনু গাঙের পাড়ে, ঝোপেঝাড়ে ভরা , বিছুটির জংগলে। গ্রামের এক রাখাল বিছুটির জংগল পেরিয়ে গাঙের উপর নুয়ানো মাকাল বাঁশ কাটতে গেলে লাশটা আবিষ্কার করে। পচন শুরু হয়েছে কেবল। আর একদিন পেরোলে পচার গন্ধে এ এলাকায় টিকে থাকা দায় হবে। মানুষ পচার মত জঘণ্য গন্ধ দুনিয়াতে আর একটাও নাই। লাশ পাওয়ার পর অবধারিতভাবে আসে পুলিশ, সাংবাদিক। ঘন্টাখানেকের মধ্যে লাশের নাম ঠিকানার পরিচয় মিলে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ সন্দেহ করে ডাকাতির জায়ঝামেলা। মানে ডাকাত দলের মধ্যে অন্তরকোন্দলের কারণে খুনাখুনি হয়েছে। কিন্তু ছইফুল কেন ডাকাতি করবে ! পাগল নাকি !
আকলাছ আর সিতারা একে অপরে আলাপের সময় কোনভাবেই তাল মিলাতে পারছিল না। ছইফুল ডাকাইত হতে যাবে কেন ! সিতারার চাইতে ছইফুলকে আর কেউ চিনে ভাল করে ! আকলাছও বিশ্বাস করতে পারছে না।
কিন্তু ছইফুল ডাকাইত হলেই বরং তারা যেন এখন বেঁচে যায়। আকলাছ এই ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী। তার হাতে এখন সিতারার বাঁচা মরা। সে এমন ভাব ধরছে যেন সিতারার জন্য জীবন কুরবান করতে রাজি আছে। বিপদে পড়লে হাতিরে ইন্দুরে পর্যন্ত ল্যাং মারে। যে আকলাছ জীবনে চোখ তুলে সিতারার দিকে তাকাবার সাহস পায় নি সে এখন পর্যন্ত সিতারার গায়ে দু তিনবার হাত দিয়ে ফেলেছে। শালার ঘরের শালা ! মরে গিয়ে এমন বিপদে ফেলে দিল সিতারাকে । মানুষ কি জানে কয়েক সেকেন্ড সামনে তার কি ঘটবে ! ইয়া আল্লাহ মাবুদ ! এ কোন বিপদে ফেলে দিলে তুমি সিতারাকে !
সিতারার ভাত খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে খবরটা শুনার পর থেকে। এই মৃত্যুর সাথে সেতো কোনভাবেই জড়িত না। কিন্তু তার কাছ থেকেইতো ছইফুল সর্বশেষ বিদায় নিয়েছিল । তাই না ! দায় কি কোনভাবে এড়ানো যায় ! আকলাছ যেটা বলল, যারা তাকে মারছে তারা ধরে নিয়েছে মাগীর দালাল ছইফুলের হাতে অনেক টাকা আছে । সে হয়তো বলেছিল , টাকা নাই সাথে। আসলেওতো ছিল না। খুচরা কিছু ছাড়া। হয়তো তখন কথা কাটাকাটির পর্যায়ে কেউ তার বুকে ঘুষি দিয়ে আচমকা তার হার্ট বন্ধ করে দিয়েছে। বেসেবে থাকলে মানুষ একটা টমেটোর আঘাতেও মরে যেতে পারে । পারে না ! এইটা হল অনুমানের কথা । হয়তো এরকম নাও হতে পারে । হয়তো ডাকাইত সন্দেহে তাকে এলাকাবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ সে নিরীহ ভাল মানুষ একটা। কারো সাতে নাই পাঁচে নাই ।খুব বেশী লোভ লিপ্সাও নাই। এই মানুষ এমন করে মারা যাবে তা কি বিশ্বাসযোগ্য !
কিন্তু যে মরেছে সে যাক, তাকে নিয়ে পরে ভাববার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। আপাততো এখন যে চরম বিপদ সামনে- তাকে কিভাবে মুকাবিলা করা যায় সে নিয়ে সিতারা ভাবুক। সে কোনভাবেই এই খুনের সাথে জড়িত না, এইটা সে বলছে আর তার খোদা বলছে। কিন্তু পুলিশ তো আর তার কথায় চলবে না। তারা প্রথমেই বলবে, ছইফুল হুসেনের বাড়ি যুগিটিল্লা, সে কেন এত রাতে টিলাগাও আসবে । কি উদ্দেশ্য ছিল তার ! তার সাথে কে ছিল কারা ছিল। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা , পুলিশে ছুঁলে বিশ ঘা । ডাকের কথা।
যেদিন রাতেরবেলা সিতারা ছইফুলের মৃত্যুসংবাদ শুনেছিল, তার আধা ঘন্টা পরপরই সে আকলাছকে সাথে নিয়ে টিলাগাও রোডে গিয়েছিল। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এই সময় মহিলা মানুষ কি ঘর থেকে বের হয় ! কিন্তু ভাল মন্দ খোঁজার সময় কি আর এখন আছে ! এমন ভর রাতে ঘর ছেড়ে তার জীবনে কোনদিনই বের হয় নি সিতারা । সিএনজি থাকলে সুবিধা হতো বেশ। দু পাশ পর্দা দিয়ে আটকে দিলে ভিতরে কে আছে তা জানবার উপায় নাই কারো। কিন্তু টমটমেতো সে উপায় নাই। এত রাতে সে কোথায় যায় – এইটা যে দেখবে প্রশ্ন করতেই পারে , তাও একা, যদি সাথে আপন কেউ থাকতো – কোন চিন্তা ছিল না। তার মনে তখন আরেকটা প্রশ্ন উদয় হয়। যদি আকলাছকে একা পাঠায় , সেই খালি ঘরে তার কিংবা ছইফুলের কাপড়চোপড় কিছু থাকলে সে সেগুলো আনবে সাথে অন্যান্য যেকোন জিনিসপাতি যদি থাকে- সব নিশানা মুছে দিয়ে আসবে। কিন্তু একটু পরে আবার ভাবে যদি আখলাছ ভুল করে ছইফুলের ভাতের প্লেট , তার কোন কুটুম বাড়ি থেকে এনেছিল কে জানে , সেইটা যদি না নিয়ে আসে ! সেখানে কাথা বালিশ আর একটা চাটাই , সেগুলোও ছইফুল কুটুমবাড়ি থেকে এনেছে । সিতারার এখন মনে পড়ছে তার একটা আয়না , চুল বাঁধবার রাবার ব্যান্ড, ব্লাউজের বোতাম আটকানোর সেপটিফিন আর একটা পুরান শাড়ি ফেলে আসছে ওখানে। যদি থানা ইতিমধ্যে সেই ঘরে প্রবেশ করে এইসব তাদের আয়ত্বে নিয়ে ফেলে তাহলেতো এতক্ষণে তাকেও নজরদারির মধ্যে এনে ফেলেছে তারা ! হতে পারে না !
সে যে এখনো স্ট্রোক করে নি অথবা আচমকা দম বন্ধ হয়ে প্রায় মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকে নি –এটাই সে আশ্চর্য মানছে। বুকের তলা ঢিপ ঢিপ করছে অনবরত। এমনি প্রায় সে বলতো , বাঁচতে আর চায় না। মরে গেলেই বুকটা জুড়ায়। কিন্তু মৃত্যু যখন তার ঘরের ভিতর এসে পড়েছে তখন এত ডর কেন তার ! তার বারেবারেই মনে হচ্ছে এই বুঝি পুলিশ এসে তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাবে। বুকের ঢিপ ঢিপটা এত জোরে জোরে বাজছে যেন কাঁঠাল গাছে কুড়ালের ছেদ পড়ছে । ছেদ ছা ছেদ ছা । কিন্তু এইভাবে মরতে চায় না সিতারা। তার বয়স মাত্র বিয়াল্লিশ। গোটা জীবন পড়ে আছে সামনে । এখন কি তার মরবার বয়স ! সে কি আর কখনো ভরা রোইদে বাজার থেকে ফিরে কচি শসা লবণ মরিচ মেখে কচ কচ করে চাবাতে পারবে না ! আর কি কখনো আশ্বিন মাসের চন্নি রাতে জানলা খুলে বৃষ্টিধোয়া তাজা হাওয়ার পরশ নিবে না ! আর কি কখনো সে আকলাছের টমটমে বসে হাওয়া খেতে খেতে রবির বাজার যাবে না ! আধাআধি মুকামে যাবে না ! ব্রাম্মণবাজারে সত্তার আলীর হোটেলের মুরগির ঝোল খাওয়া কি তবে এ জীবনের জন্য শেষ হয়ে গেছে !
তার ডর আরো বাড়ে যখন আকলাছের টমটমে চড়ে রাতে গিয়ে দেখে গুদামঘরে তালা লাগানো । সেতো উদাম করে ফেলে এসেছিল । কে তবে তালা লাগাল ! ঘরের মালিক ! নাকি পুলিশ !
১৪
শেষ পর্যন্ত সিতারা সিদ্ধান্ত নেয় তার এলাকার মেম্বারের কাছে সব খুলে বলবে । কারণ এত ছটফটানি নিয়ে সে আর এক মুহূর্ত একা থাকতে পারবে না। মেম্বার ক্ষমতাশালী লোক। খুন খারাপি কেইস কাছারি এইসব ডালভাত তার কাছে। আকলাছ বারবার বাধা দিয়েছিল যেন মেম্বারের কাছে সে না যায়। তার মতলব হল, এইভাবে ডরের মধ্যে রেখে সিতারাকে সারাজীবন মাগনা ভোগ করবে , ব্যবসা করাবে। কথা না মানলে লাত্বি মারবে, চড় মারবে, পিটাবে ইচ্ছামত যতক্ষণ হাতের খাউজ না মিটে। সিতারা এমন অন্ধকার অনিশ্চিত জীবনের চাইতে জেলে নয়তো দূর কোন নাম না জানা শহরের রাস্তায় ভিখ করে ধুকে ধুকে মরবে , তবু অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা আকলাছের কাছে যাবে না।
মেম্বার সব শুনে সিতারাকে ভরসা দেয়। শুধু তাই না , তাকে তার চার নাম্বার বউ করবার প্রতিশ্রুতিও দেয়। আল্লাহ আসলে তার বান্দাকে কখনো বিপদে ফেলেন না। আজ তার চূড়ান্ত প্রমাণ পেল সিতারা । সে এতটা আশা করে নি। মানুষ যা আশা করে না , আল্লাহ তাই দিয়ে চমকে দেন মানুষকে। সঞ্জর আলী মেম্বারের বউ কেন ,সিতারা বরং আশা করেছিল অন্তত- বান্দির সুযোগটা যেন সে পায়। মেম্বার এর আগে তার কাছে দুই তিনবার গিয়েছিল। সিতারা পাত্তা দেয় নি। মন না মানলে মেয়েমানুষ শাড়ি খুলে সামনে দাঁড়াক না কেন তবু বেটামানুষ স্বাদ পাবে না তাতে। জোর করে বিগড়ে যাওয়া ইঞ্জিন চালানো যায়, মানুষকে পারা যায় না। সেই অতৃপ্তি মেম্বারের মনে ছিল। সিতারা বুঝতে না পারার মতন বুকাচুদি না। বান্দি যা পারে না দিতে বউ তা দিতে পারে। বউ করা মানে বান্দি চাকরানি সব একসাথে পাওয়া হয়ে যায়। সমাজের লাইসেন্স ওইটা। কেউ কিছু বলবে না। বলবার অধিকার নাই কারো।
১৫
তারপর জোইঠ আড় হাওন কেটে গেল। জোইঠারি দিতে মেম্বার স্বয়ং সিতারার মেয়ের শশুরবাড়ি গেল সিতারাসহ। এই লোকটা বোধ হয় মানুষকে চমকে দিতে ভালোবাসে। সিতারার মেয়ে কোনদিন এটার প্রত্যাশাই করে নি। মানুষ অর্থ বিত্তকে ভালো না বাসুক কিন্তু সমীহ যে করে সিতারা চোখের সামনে দেখতে পেল। যে মেয়ে কোনদিন তার মা মরল নাকি বাঁচল খবর রাখে না , সেই মেয়ে তার মায়ের বিত্তশালী সৎ স্বামী দেখেও কিন্তু ছি ছি করছে না। এতটা পরিবর্তন যে ভুয়া , ভিতরে ভিতরে মায়ের প্রতি ঘেন্না যে আছে সে জানে সিতারা। কিন্তু তারপরও ভুয়া ভালোবাসা এ বয়সে কজনইবা পায় ! মেম্বার যে তাকে ভালোবাসে –তার শরিলের কারণেইতো ভালোবাসে – তাই না ! শরিলে থলথলা চর্বি জমলে , মাজায় বিষ বেদনা থাকলে – এত ভালোবাসা কি দেখাতো ! তবে লোকটাকে বাহিরে থেকে দেখলে আগে যে প্রথমেই একটা নেতিবাচক ভাব আসতো , যেমন কথাবার্তায় রসকষ নাই, বেটিখোর, মহিলা দেখলে জিহবা দিয়া লালা পড়ে, বিচারে বসলে দুনো পার্টির কাছ থেকে টাকা খায় – এগুলো যে আদতে সত্য নয় তা সিতারা বিয়ার আগে কি বিশ্বাস করতো ! বেচারির ঘরে তিন বউ থেকে এখন আছে দুই বউ। এক বউ ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু দুজনের কেউই সিতারাকে কেন বিয়া করল এ নিয়ে টু শব্দ করার সাহস পায় নি। লোকটার আসল কথা হল মনের শান্তি। এক টুকরা শান্তি, সামান্য আনন্দ পাওয়ার জন্য সে রাত বিরাত লোক লজ্জা এইসব কেয়ার করে না। একদিন রাত দুইটায় সিতারার ঘরে নিয়ে আসে কুরফান খলিফা আর তার সাগরিদ বাদশা মিয়াকে। এত রাতে কেন ! গাজী গান শুনবার সেই অতীত দিনের সুখের স্মৃতি নিয়ে দু চার কথা বলেছিল সেদিন সকালে সিতারা। বলা মাত্র রাতের মধ্যেই গানের আসর হাজির। পাগল নাকি লোকটা ! আরেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বলল, “চলো আইজ তোমারে লইয়া মাইজগাও যাইতাম “ হঠাত ঘুম থেকে উঠেই মাইজগাও কেন ! তার এক পুরান দুস্তের বাড়িতে যাবার খায়েশ হয়েছে। যেতেই হবে।
এই তিন মাস নতুন সংসারে কাটিয়ে দিতে পেরেছে সিতারা। নতুন সংসার বলতে কি, ঘর তার আগেরটাই আছে, পুরান ভিটা। হাতির দাইদার হুসমত এখন অবধি কিছু বলে নি এসে, হয়তো বলবে, হয়তো কেন নিশ্চই বলবে। মাগনা ভিটাবাড়ি আরেকজন এসে দখল করবে – কেউ মানবে সেটা ! সিতারাও পড়ে থাকবে না এখানে। নতুন সংসার হয়ে গেলে নতুন জায়গায় যেতে হয় আর ছাড়তে হয় আগের ভিটামাটির মায়া। মেম্বার তাকে বলেছে , যুগিটিল্লার দিকে তার খাস টিল্লা আছে, সেখানে নতুন ঘর বানিয়ে দেবে। মেম্বারকে বিয়ে করার পর যে ভয় ছিল তার , সেইটা কেটে গেছে পুরোপুরি। বরং আনন্দেই আছে বলা যায়। যদি কিছু হতো , তাহলে এতদিনে তাকে ছইফুলের মত মৃত দেখতে পেত গ্রামবাসী। সিতারা জেলের অনিশ্চিত জীবনের চাইতে মুহূর্তে ঘটা উত্তেজনাকেই ডরায় বেশী। হাই প্রেসারের রোগী, ভরসা নাই একবিন্দু। ঠাস করে পড়ে মরে যেতে পারে। তবে এখন মনে হচ্ছে সেই ভয় সে কাটিয়ে উঠতে পারছে। বড় বটগাছের নীচে থাকলে ছোট গাছ গাছরার যেমন তুফানে উড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না , মেম্বার হল তার কাছে বড় বটগাছ। জেল , পুলিশ – এইসবের এত ভয় ছিল তার যে, সে এতদিনে ছইফুলকে খুব একটা মনে করে নি আগের মতন।
মাঝে মধ্যে একলা দুপুরবেলা রোদের ছায়া উঠান ছাড়িয়ে ঘরের ভেতর এসে ঢুকলে শোয়া থেকে সে চমকে উঠে। এই বুঝি শরিলে ভারী মেঘের আস্তর মেখে ছইফুল ঘরের ভিতর প্রবেশ করল এসে। কণ্ঠে বৃষ্টির আদ্রতা,” খালা কোয়াই গো ! এই লোকটা আর ফিরে আসবে না তার কাছে ! কোনদিনও না ! হায় রে ভাগ্য ! যে সিতারার বিপদের কথা চিন্তা করে লোকাল কাস্টমার কাউকে না নিয়ে দূরের কাস্টমার নিয়েছিল সেই দূরেররাই তাকে খুন করে ফেলল ! ছইফুলকে ভালোবাসতো সিতারা , এইটাতো মিথ্যা নয় একবিন্দু। কিন্তু এইটা কেমন ভালোবাসা যে, জেলে যাবার ভয়ে ভালোবাসার মানুষটার খুনের বিচার করতে দিচ্ছে না সে। এর নাম বুঝি ভালবাসা ! সিতারা যদি একটু সাহায্য করে, যদি সে বলে দাড়িয়ালা কসমেটিক্সের মহাজনের কথা, তার সুত্র ধরে নিশ্চই খুনিদের ধরা সম্ভব ! কিন্তু তা সে করবে না। যদি করতো অনেক আগেই করতো। ছইফুল আর কোনদিনও ভর সন্ধ্যাবেলায় এসে বলবে না , “চলো খালা, মহরমর মেলা দেখাত যাই”। ভর রাতে বলবে না এসে ,” আদা চা বানাও, গলাত খুশখুশি করের”। মাত্র তিন মাসে সে কি ছইফুলকে ভুলে যেতে পারল ! এর আগে তিন মাস কেন প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত ছইফুলের সাথে তার দেখা সাক্ষাত হয় নি । কিন্তু সরাসরি দেখা না হলে কি হল, কথা বলে সে মনে মনে । যত পুরুষের সাথেই সে শোক, ছইফুল ছাড়া আর কারো সাথেই সে তৃপ্তি পায় নি , আনন্দ পায় নি। যতবার তার উপর অন্য পুরুষ উঠেছে ততবারই সে প্রতিজনের মুখে ছইফুলের মুখ কল্পনা করেছে।
কিন্তু মেম্বারের সাথে ঘর করার পর সে যেন ধীরে ধীরে ছইফুলের চেনা মুখটা দূরে ফেলে আসছে। একদিন বিকালবেলা ,হাওন মাসি রোদ উঠান থেকে ঘরের চালার উপরে উঠে গেছে, সিতারা কেবল বালিশে মাথা ফেলে শোবে, অমনি একটা ডাকে সে চমকে যায়। ভয়ার্ত গলা, স্বজন হারানোর আর্তনাদ কণ্ঠের ভিতর গলে গলে পড়ছে। “ খালা কোয়াই গো “। ঠিক যেন ছইফুলের অবিকল সেই ডাক। তফাত শুধু উচ্ছাসে আর বেদনায়। ছইফুলের বউ। হাওয়ারুন। তাকে দেখে সিতারার চাপা পড়ে থাকা ভয়টা আবার চাগিয়ে উঠে। না জানি কোন বিপদের বার্তা নিয়ে আসছে সে। ছইফুল সন্মন্ধে একটা প্রশ্নেরও ঠিকঠাক জবাব দিতে পারবে না সিতারা। যদি হাওয়ারুন তার স্বামী নিয়ে কোন কথা বলে সিতারা আগামাথা কিছুই বলতে পারবে না। উলটো থতমত খেয়ে কোন দৃশ্যের অবতারণা করবে বলা মুশকিল।
হাওয়ারুনের চোখের উপর বাসী কাজলের দাগ লেপা। সিতারা তার দিকে তাকিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক সিতারা গেলে আরেকজন আসছে। স্বামী নাই বেটিনদের যাওয়ার জায়গা ঐ একটাই। কিছু সময়ের জন্য তার খুব অস্বস্তি লাগে। সেদিন ছইফুল তার সাথে না গেলে আজ হাওয়ারুনের এমন অবস্থা হয় না। তাজা ফুটফুটে একটা সংসার চোখের পলকে ছারখার হয়ে গেল। সিতারার সাধ্য নাই, নাহলে এ পরিবারের জন্য সে কিছু একটা করে দিতে পারতো। কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর কিছু হায় হায় বিলাপ ছাড়া তার কিছু করার নাই এ মুহূর্তে । তার হাতে কিছু টাকা আছে অবশ্য, কিন্তু সে তা দেবে না। গরীব মানুষদের একবার টাকা দেয়া মানে নিজ বাড়িতে উপদ্রব ডেকে আনা। তারপর দেখা যাবে , হাওয়ারুন প্রায় প্রতি সপ্তাহে এসে টাকা খুঁজছে । তার চাইতে নিজের বিপদ সে নিজেই সামাল দেয়া শিখুক। যেভাবে সিতারা একা একা শিখেছে। উজান দিকে সাঁতার কাটা না শিখলে ভাটির দিকে বেশী দূর আগাতে পারবে না। এটাই নিয়ম দুনিয়ার।
হাওয়ারুন এসেছে, সে একটা ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল। এখন টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকের লোকজন এসে তাকে প্রতিদিন হুমকি ধামকি দিচ্ছে। সে কতদিন বাপের লুকিয়ে ছিল, কিছুদিন বাচ্চাদের বাপের বাড়ি রেখে সিলেট টাওনে বাসা বাড়িতে কাম করতে গিয়েছিল। কিন্তু বাসা বাড়ির কামে তার পুষাবে না। কাজ করতে তার ভয় নাই। এখন সে এসেছে, যদি মেম্বার সাব মাঝখানে থেকে তাদের বলে দেন – আগামী তিন মাসের মধ্যে হাওয়ারুন সমস্ত টাকা তাদের পরিশোধ করে দেবে। এর মধ্যে তাকে যেন তারা বিরক্ত না করে। সোজা কথা মেম্বার সাব জামিনদার হবেন। ছইফুলের খালার সম্পর্ক ধরে সিতারা কি এই সামান্য উপকারটুকু করে দিতে পারবে না !
সিতারা জানে, ব্যাংক এইসব আলগা নিয়ম কানুন মানবে না কখনো। তাদের নিজস্ব নিয়ম কানুন আছে – তাদের নিয়মের কাছে মেম্বার চেয়ারম্যান থানা পুলিশ কোন কাজে আসবে না। তার নিজেরও এমন সমস্যা ছিল। সিতারা নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায়। একটু আগে যে ভয় আর অস্বস্তি ছিল- এখন সেইটা আর নাই। ধীরে ধীরে তার মধ্যে এতটা সাহস কিভাবে সঞ্চিত হল – সে অবাক হয়ে যায়। মেম্বারকে সে আরেক নারীর হাতে গছিয়ে দেবার মতন ভুল করতে চায় না।
আজ সিতারা যে জায়গায় এসেছে, গতকাল সে সেখানে ছিল না, আগামীদিন যে এখানে থাকবে তার ভরসা কি !
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন