মীর জাফরের মনে দুর্ভাবনার অন্ত নেই। পলাশীর যুদ্ধে আর যাই হোক, তিনি তো আর জেতেন নি। জিতেছে ক্লাইভ! ক্লাইভ এখন যদি গোপন চুক্তি ভঙ্গ করে মসনদে বসে তাহলে তা প্রতিরোধ করার মত সামরিক শক্তি তার নেই। এভাবে এক ভিনদেশী কে তার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। মীর জাফর আলীর মন অনুশোচনায় ভরে উঠল। সিরাজউদ্দৌলা কে তাড়ালেন, অথচ নিজে মসনদ পেলেন না!
পড়তে পড়তে থেমে গেল মুন্তাসির। হলের জানালা দিয়ে তাকালে ইলেক্ট্রিক তার আর রঙিন পোষ্টারে মোড়ানো রাজপথ দেখা যায়। বহু রাজ-রাজড়ার উত্থান-পতনের গোড়াপত্তন হয়েছে এই পথে। পথের দু’পাশের সফেদ দেয়াল জুড়ে কোথাও রাজ উক্তি কোথাও বা রাজ বিদ্রোহের বাণী। এই বহমান জনস্রোতের প্রত্যেকটা মানুষকে আলাদা করে লক্ষ্য করে মুন্তাসির। তার মনে হতে লাগলো এই সমস্ত মানুষের মাঝে বারবার ফিরে আসে পুরাতন কলঙ্কেও লোলুপ স্পৃহা। যাকে বলে অ্যাটাভিজম প্রবণতা। মুন্তাসির বুক মার্কার দিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো পুরানো মলাটের বইটি।
হলের দোতলা থেকে আমজাদ এসেছে। ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুখোর ছাত্র। আমজাদ অনেকটা ইন্ট্রোভার্ট টাইপের হলেও সমস্ত বিষয়েই তার প্রবল জিজ্ঞাসা। অন্যদিকে মুন্তাসির বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। রাজনীতিতে সেভাবে জড়িত না থাকলেও রাজনৈতিক বাসনা আছে বোঝা যায়। যদিও মুন্তাসির ওর নরমেটিভ চয়েজ কখনও কারো কাছে স্পষ্ট করেনি। রনি এবং জয়ন্ত মুন্তাসিরের রুমমেট।
আড্ডা জমে উঠেছে। আজ ইন্টেলেক্সুয়াল কোন টপিক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। ফুটবল বিশারদ রনির প্ররোচোনায় আজকের বাকযুদ্ধ স্পেনের মাদ্রিদ আর বার্সেলোনায় গিয়ে ঠেকেছে। গত রাতের এল-ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদ জিতে গেলেও বার্সেলোনার সাপোর্টার রনি-আমজাদ জুটিকে হারানো যায় নি। সেই হারের হতাশা নিয়েই আলোচনা ইউ-টার্ন নিলো। মাঝ রাত অবধি হলো আড্ডা, আলোচনা আর তর্কযুদ্ধ। এমনিতে এই চার জনের মধ্যে তর্কাতর্কি লেগে থাকলেও ওরাই ওদের সবচেয়ে কাছের।
মাঝ রাতে সবাই চলে গেল । বাকিরা ঘুমিয়ে গেলেও মুন্তাসির জেগে আছে এখনও। ওর মধ্যে কী এক আশঙ্কা জেগে উঠেছে। মাথাটা অন্তসারশূন্য মনে হচ্ছে আবার কখনও তীব্র ভারি মনে হচ্ছে। মুন্তাসির মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে নিজেকে দেখছে। কী বীভৎস তার মুখ! কান দুটো কেমন যাচ্ছেতাই বড়। নাকটাও কেমন সারস পাখির ঠোঁটের মত যাচ্ছেতাই লম্বা । তাহলে কি সত্যি জন্মগত ভাবেই সে পাপস্পৃহা নিয়ে জন্মেছে?
সিজার ল্যামবরসো যা কিছু বলে গেছেন তার সবই কী অযৌক্তিক? লাইব্রেরীর বুক সেল্ফে রাখা ‘অন ক্রিমিনাল ম্যান’ বইটির প্রত্যেকটি লেখা তাকে দারুণ ভাবাচ্ছে । মুন্তাসির নিজের হাতের তালুর দিকে লক্ষ্য করে। হাতের তালুতে তিনটি প্রধান রেখা অসংখ্য ছোট ছোট রেখা নিয়ে স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠেছে। শুধুমাত্র এই একটি পার্থক্যে মুন্তাসির সন্তষ্ট হতে পারল না। মুন্তাসির মাইনাস পাওয়ারের চশমা পড়ে, অথচ তার মনে হচ্ছে মাঝ রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারেও সে যেন বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করার অমানুষিক ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছে সে। মুন্তাসির এসব আর ভাবতে পারছে না। নিজের জীবন কে এইসব মান্ধাতার থিসিসের সাথে আর কোরিলেট করতে চাচ্ছে না সে। তবুও তার মনে হতে লাগলো, তার কুৎসিত শারীরিক গঠন, মন ও মগজ যেন যুগ যুগান্তরের হিংস্রতা ও হিংসা বয়ে বেড়াচ্ছে।
হলরুমের জানালায় যখন ভোর নেমে এসেছে তখন বাইরে তৃষ্ণার্ত দুই তিনটে কাক ডাকছে। মুন্তাসিরের ইদানীং এভাবেই ঘুম ভাঙে। জেগে ওঠাটা যেন মরে আবার বেঁচে ফিরবার মত। ডিপার্টমেন্টের ট্যাগ লাগানো কালো টি-শার্ট পরে মুন্তাসির ক্যান্টিনে গেলো। সেখানে এখানে-ওখানে দল পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা। এই সময়ে অন্য দল কিংবা জুনিয়র কেউ সেখানে যায়না সাধারনত। কিন্তু মুন্তাসির এসব মানেনা তেমন। এদের সবার সাথেই তার বেশ হাব-ভাব। আজ এখানে বসার তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু চা খেতে খেতে কয়েকবার আমজাদের নাম শুনতে পেয়ে আড্ডাস্থলে এগিয়ে গেলো সে। ছাত্রনেতা সুখন ভাইয়ের সাথে মুন্তাসিরে সম্পর্ক ভ্রাতৃপ্রতিম। সেই অধিকারেই একটা চেয়ার টেনে বসল মুন্তাসির। সুখন, রিন্তুসহ সকলের দৃষ্টি মুন্তাসিরের দিকে। বোঝা গেলো আমজাদকে নিয়ে প্রচণ্ড নেতিবাচক আলোচনা হয়েছে এতক্ষণ। আমজাদ নাকি কিসব লিখেছে ফেইসবুক টাইমলাইনে। এসব নিয়ে আমজাদকে এর আগেও সাবধান করা হয়েছে কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করেনি। অনভিপ্রেত বিপদের আশঙ্কা বুঝে মুন্তাসির আমজাদের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল। ততক্ষণে আমজাদের লেখা নিয়ে চারিদিকে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমন অবস্থায় আমজাদকে থামাতেই হবে। মুন্তাসির ও আমজাদকে বোঝাবে, সে যেন এসব বন্ধ করে আপাতত।
ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেলো মুন্তাসির। বের হতে হতে মোবাইলের ডাটা কানেক্ট করে আমজাদের টাইমলাইনে চোখ রাখলো সে। হল পর্যন্ত যেতে যেতে সম্পূর্ন লেখাটা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলল মুন্তাসির। রাষ্ট্রের শোষণ নিপীরনের বিরুদ্ধে কী দারুণ গঠনমূলক সমালোচনা করেছে আমজাদ! মুন্তাসিরের মনে হলো এমন সত্যনিষ্ঠ সমালোচনা রাষ্ট্রের কানে পৌঁছানো উচিত। নিপীড়িত, শোষণ, তোষণের বিরুদ্ধে যে চেতনা এতটা সোচ্চার তাকে কী আটকাতে পারবে মুন্তাসির?
আমজাদের রুমে আমজাদকে পাওয়া গেলো না। সে এক দৌড়ে ছুটে গেল লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরির এক কোনে একমনে বই পড়ছে আমজাদ। সমস্ত খুলে বলার আগেই ফিক করে হেসে ফেলল আমজাদ। এ হাসি চরম দুঃসাহসের। মুন্তাসির জানে আমজাদকে দমানো যাবে না।
চারিদিকে উত্তাপ বেড়েই চলছে। ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে ফুঁসে উঠেছে ছাত্রসমাজ। বিপ্লবীর পায়ের আঘাতে ধুলোর রাজপথ হতে ধেঁয়ে আসছে প্রতিবাদের বজ্রাঘাত। মুন্তাসির বাইরে বের হয়ে আসে। মুন্তাসিরের ইচ্ছে ছিলো, একদিন সেও এমন একটা মিছিলের নেতৃত্ব দেবে। সত্য-ন্যায়ের সংগ্রামে, মুখরিত স্লোগানের উত্তপ্ত মিছিলে সে হবে বিজয়ী বীর। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিজেকে সংযত করল মুন্তাসির। খন্ড খন্ড মিছিলের স্রোত এগিয়ে যাচ্ছে সত্যভাস্কর্যের দিকে। সবার মুখের স্লোগানে আমজাদের লেখার ছোট ছোট কোটেশান। আমজাদকে নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেলো মুন্তাসিরের। আমজাদকে নিয়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিতে হবে আপাতত। ওকে যে করেই হোক বুঝাতে হবে, এসব এখন আর লেখা যাবেনা। অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই।
লাইব্রেরির লম্বা সিলিঙের ফ্যান গুলো ঘুরছে বিরামহীন। কেউ কেউ নিমগ্ন চিত্তে বই পড়ছে। মুন্তাসির আমজাদকে অনেক বুঝালো।
দ্যাখ আমজাদ, এইবার একটু থাম! এই থামা পিছায়ে জাওয়া না। এইডা একটা কৌশল। নিজেরেও তো সেইভ রাখা লাগবে না কি?
আমজাদ আবার ফিক করে হেসে বলল, সুবিধাবাদ দের শ্রেনীতে কখনও বিপ্লব আসেনারে, মুন্তা ! মুন্তাসির আমজাদকে নিয়ে নুরুদ্দিনের হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। বিকেলে টিউশানি শেষ করে সন্ধ্যার দিকে রুমে ফিরে এসেছে আমজাদ। সারাদিন উত্তাপ ছড়ানোর পরে ক্যাম্পাসটা এখন শান্ত। আমজাদের দোতলা রুমের জানালায় এসে দোল খাচ্ছে নারকেল পাতার ডগা। একটা বই খুলে পড়তে বসল আমজাদ। পড়ায় মন বসছে না। বইটা বন্ধ করে রেখে দিলো । চোখ বন্ধ করে ভাবছে আমজাদ, সে কি সত্যি জনমানুষের মুক্তির কথা লিখতে পেরেছে? আমজাদ একবার ভাবছে মুন্তাসিরে কথামত তার কি এবার একটু থামা উচিত? বাস্তিল দুর্গের পতনের খবর পেয়ে ফরাসী সম্রাট ষোড়শ লুই তার এক ঘনিষ্ঠজন কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”এটা কি রিভোল্ট”? উত্তর এসেছিল, ”না, সম্রাট, এটা রেভুলুশান”। অর্থাৎ বিপ্লবে কোন পিছুটান নেই। যেখানে থাকে শুধু সামনে এগোবার তাগিদ।
মুন্তাসির রুমে একা। রনি, জয়ন্ত ওরা কেউ আসেনি এখনও। মুন্তাসির খেয়াল করল তার ভেতর কোন একটা কিছু করার তীব্র বাসনা জেগেছে। ছাত্রনেতা হবার সুপ্ত ইচ্ছা তার ভিতরে ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে। মুন্তাসিরের বিশ্বাস, তার যোগদান প্রতিবাদী ছাত্র-সমাজের আন্দোলনে, মিছিলের স্রোতকে আরও তীব্রতর করবে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও সত্য প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে এবার সামিল হবে মুন্তাসির। নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ নদীতে হঠাত জোয়ার আসলে যেমন হয়, মুন্তাসিরের মনের অবস্থাও এখন তেমন। আগামী দিনের মিছিলের নেতৃত্ব দিতেই হবে তাকে।
আপাতত ক্যাম্পাসটা শুনশান মনে হলেও ভিতরে ভিতরে চলছে বিপ্লবের প্রস্তুতি। ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারাও বসে নেই নিশ্চই। তারাও ভাবছে কিভাবে এই আন্দোলনকে প্রতিহত করা যায়। আমজাদের মনে হচ্ছে তার এখনও অনেক সত্য বলা বাকি রয়ে গেছে। মুন্তাসিরের কাছে আজকের রাতটা যেন ঐতিহাসিক কোন রাত। চোখ বন্ধ করে ভাবছে কিভাবে এই জুলুমবাজ ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতাদের হাত থেকে ভঙ্গুর প্রায় শিক্ষা ব্যাবস্থাকে রক্ষা করা যায়।
রাত গভীর হয়ে এসেছে। মুন্তাসিরদের হলের পিছনের রাস্তায় অনেক মানুষের ভীর। অবরে সবরেও এই রাস্তায় এত রাতে জন-মানুষের ছায়া দেখা যায় না। মুন্তাসির তখনও ঘুমায়নি। ওর চিন্তাজুড়ে কি এক বিভৎস উন্মাদনা খেলা করছে। মুন্তাসির ঠিক বুঝতে পারছে, ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা কিছু একটা পরিকল্পনা করছে। রনি আর জয়ন্ত এখনও আসেনি। ওরা ক্ষমতাসীন দের সাথেই থাকে। ওখানেও এখন হয়ত ওরা থেকে থাকবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই মুন্তাসিরের মোবাইল ফোনে জয়ন্তর কল এল। জয়ন্ত অস্বাভাবিক ভাবে ফিসফিস করে বলছে, মুন্তা ভাই! আপনি তাড়াতাড়ি আমজাদ ভাইকে কোথাও চলে যেতে বলেন। ওনাকে খুব দ্রুত ক্যাম্পাস ছাড়তে বলেন!
মুন্তাসিরের মুখে আঁধার নেমে এলো। আসন্ন বিপদ থেকে আমজাদকে বাঁচাতে হবে। সে সিড়ি ভেঙে দোতলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এমন সময় মুন্তাসিরের মোবাইল ফোনটি বেঁজে উঠল। একটি অপরিচিত নম্বর থেকে। ভয়ে তটস্থ মুন্তাসির কলটি রিসিভ করল না। দ্বিতীয়বার আবার কল এলো। এবার আর এড়িয়ে যেতে পারলনা ম্ন্তুাসির। ফোনের ওপারে রিন্তু ভাই। স্বাভাবিক ভাবে বলল আমজাদকে নিয়ে ক্যান্টিনের সামনে আসতে।
মুন্তাসির, আমজাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। আমজাদকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হবে, তারপর যা হবার হবে। এই ভেবে মুন্তাসির, আমজাদকে ডাক দিল সঙ্গোপনে। এত কিছুর পরেও আমজাদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার কোন লেশ নেই। কিন্তু এই অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করাও জরুরী। আমজাদ, মুন্তাসিরকে সাথে নিয়ে নিচে নামল। চারিদিকে ঘুরঘুরে আলোহীন অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই। এটাই সুবর্ণ সুযোগ আমজাদকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়ার। আপাতত মুন্তাসির, আমজাদকে হলের মসজিদে গা ঢাকা দিতে বলল। আমজাদ অতি সন্তর্পনে মসজিদের দিকে এগিয়ে গেল। মুন্তাসির ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাতে গোনা কয়েকজন নেতা কর্মী বসে আছে। অদূরেই পায়চারি করছে রিন্তু ভাই। পেন্ডুলামের মত দুলতে দুলতে এগিয়ে আসল রিন্তু ভাই। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মুন্তাসির বলল, আমজাদকে রুমে পাই নাই। রিন্তু,মুন্তাসিরের কলার্ট ধরে বলল, আমজাদরে পাইলে কইবি, ভাই দেখা করতে কইছে। রিন্তু ভাইয়ের লাল চোখ কাঁপছে। কপালের সঞ্চিত ঘামের বিন্দু গুলো স্রোত ধারার মত ছড়িয়ে পড়ছে। মুন্তাসির বুঝতে পারছে, এ যাত্রায় বড় বাঁচা বেঁচে গেছে আমজাদ।
থমথমে রাস্তা ধরে রুমের দিকে মাথা নিচু করে এগিয়ে যাচ্ছে মুন্তাসির। ওর মাথার উপড় রেইন্ট্রি গাছের ছাউনি। তার উপড়ে মেঘ মিশ্রিত ধূসর আকাশ। মুন্তাসির সিড়ি ভেঙে চার তলায় ওর রুমে ফিরে এসেছে। সব কিছু হঠাত কেমন যেন মনে হচ্ছে । মাথাটা আবার কেমন যেন করছে। নিজের কুৎসিত চেহারার কথা মনে পড়ছে । অজানা কোন কলঙ্কের লোলুপ স্পৃহা জেগেছে তার মনে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরও প্রবল অপবিত্র বাসনায় যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে মুন্তাসির। আগামীর রাজপথে খুনজোসির মিছিলে তাকে যে নেতৃত্ব দিতেই হবে।
আগামীকালের মহা বিদ্রোহের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেখানে মুন্তাসিরে কোন ভূমিকা নেই সে চাইলেই নিজের জন্য কিছু একটা করতে পারে এখন। এমন একটা প্রেক্ষাপট সে তৈরি করতে পারে যেখান থেকে তার স্বপ্ন পূরনের রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে। নিজের স্বার্থের জন্য যা কিছু করতে সে প্রস্তুত। মুন্তাসিরের মাথায় যেন ফিরে এসেছে অতীতের প্রেত প্রতারকের তৃষিত আত্মা।
রিন্তু ভাইকে অব্যবহৃত একটি নম্বর থেকে কল দিয়ে আমজাদের অবস্থান জানিয়ে দিল মুন্তাসির। আমজাদের কিছু হোক। ব্যাপারটা আগুনে ঘি ঢালার মত হবে। আগামীর আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াতে এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছু নেই। আমজাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে আমজাদের জন্য মুন্তাসিরের আওয়াজকেই সবচেয়ে ঝাঁঝালো শোনাবে। মুন্তাসির চুপিসারে মসজিদের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। আমজাদ ও নেই। তবে কি আমজাদ আগেই পালিয়েছে এখান থেকে? মুন্তাসির ক্যান্টিনের দিকে গেল। ক্যন্টিনের পিছনে একটি পুরাতন আম গাছ, তার পাশে ব্যবহার অযোগ্য একটি ছাদ ভাঙ্গা ঘর। সেই ঘরে মোবাইলের আলোয় কয়েকটি ছায়ামূর্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুন্তাসির আরও এগিয়ে যায়। আমজাদের গোঙানী মিশ্রিত কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পাষণ্ড হায়েনাদের হাতে আক্রান্ত কান্না ভেজা আমজাদের নিরপরাধ চোখের আঁকুতি ক্ষনিকের তরে দেখলেও মুন্তাসিরের মন গলল না। সহস্র, নিজুত, লক্ষ বছরের পুরাতন পাষণের হিংসা এসে ভর করেছে তার বুকে। মুন্তাসির প্রেতাত্মার মত ফিরে আসল ওর রুমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বড় বড় চোখ দুটো দেখছে সে। ওই চোখে কোনো মানুষের জন্য মায়া থাকে না। সব কিছুর জন্য বরং ভালোই লাগছে তার। পিশাচের মত অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে মুন্তাসিরের।
মহা কলঙ্কের রাত শেষ হয়ে সকাল হয়েছে। মুন্তাসিরের ঘুম ভাঙেনি এখনও। প্রতিদিন সকালে এসে তিন চার জোড়া কাক ডাকে এখানে। কাক ডাকা সেই প্রহর পেড়িয়ে গেছে আরও আগেই। অবশেষে মানুষের হোই-হুল্লোরে ঘুম ভাঙলো মুন্তাসিরের। জানালা দিয়ে তাঁকালো সে। মিছিলে মিছিলে সয়লাব। এক একটা মিছিলের সমুদ্র যেন মহাসমুদ্রের মহা বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুন্তাসির তরিঘরি করে নিচে নামল। রাতারাতি বেমালুম বদলে গেছে ক্যাম্পাসের চারদিক। চারপাশটা কেমন যেন আগুনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মুন্তাসির সত্যভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে যায়। সেকি!! পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়েছে একটি লাশ।পাশেই পড়ে আছে ছোপ ছোপ রক্তে ভেজা হল-মসজিদের নীল খাটিয়া।
চারিদিকে তখন অগনিত জনতার জনস্রোত । সেই জনস্রোতকে একপাশে ঠেলে এগিয়ে আসছে একটি মিছিল। সেই মিছিলের নেতৃত্বে রিন্তু ভাই। হাতে কাল কাপরের ব্যানার। সেখানে লেখা “আমজাদ হত্যার বিচার চাই” । ডান, বাম, মধ্য, চরম, সব পন্থার জনস্রোত গিয়ে থামছে সত্যভাস্কর্য চবুতরে।
মুন্তাসিরের মন অনুশোচনায় ভরে উঠল। সব ব্যাবস্থাই করা হলো, অথচ নেতৃত্বের মসনদে বসা হলো না! এসব কি ভাবছে মুন্তাসির? প্রিয় বন্ধু আমজাদের নীথর দেহ এখনও পড়ে আছে মুন্তাসিরের সামনে। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল সঞ্চিত হলো, তীব্র যন্ত্রণায় বোবা কান্না করতে লাগল মুন্তাসির। তবেকি সে বাই বর্ন ক্রিমিনাল?
না, তা হয় না । যদি তাই হয়, তবে যুগ যুগান্তরের এই প্রতারণার অভিশাপ তাকেই ভাঙতে হবে। রাজপথের উঁপচে পড়া জনসমাগম ঠেলে মুন্তাসির এগিয়ে যায় সত্যভাস্কর্যের দিকে। চারিদিকের উত্তাল জনসমুদ্র পেড়িয়ে ভাস্কর্যের উঁচু পাদদেশে এসে দাঁড়াল মুন্তাসির। রিন্তুর হাত থেকে মাইক্রোফোন কেরে নিল সে। উত্তেজিত জনতা তখনও জানেনা কি হতে চলেছে। একটা বড় দম নিয়ে মুন্তাসির বলতে শুরু করল। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিন্তু ও তার দলবল কিভাবে প্রিয় বন্ধু আমজাদকে হত্যা করেছে। জন্মান্তরের প্রতারকদের হয়ে রাজপথের রাজচত্বরে দাঁড়িয়ে সে যেন নতি স্বীকার করে নিল। অবনত মস্তিস্কে মুন্তাসির স্বীকার করল, সে নিজেও একজন বিশ্বাসঘাতক। তারপর স্থবির জনসমুদ্রে যেন আচমকা একটা জলোচ্ছাসের ঢেউ বয়ে গেল।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন