জলধি / গল্প / মিলু শামসের গল্প
Share:
মিলু শামসের গল্প
উত্তরসূরি

এ বাড়িতে আজ দুটো মার্ডার হওয়ার কথা থাকলেও দারুণ দুর্দৈবের মতো লাশ হলো তিনটা। দুটো খুন প্লাস একটি স্বাভাবিক মৃত্যু। হত্যা স্বাভাবিক মৃত্যু না হলেও মৃত মানুষের পরিচয় অভিন্নÑ। লাশ। আমি বিস্মিত, স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! দুই খুনের সঙ্গে এক স্বাভাবিক মৃত্যু যোগ হবেÑ এ আমার দূর ভাবনাতেও ছিল না। ভালই হলো, জীবনের প্যারাডক্সটি উন্মোচিত হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা রইল না। তবে দীর্ঘ নাটকের শেষ দৃশ্যটি একেবারেই এ রকম হওয়ার কথা ছিল না।
ভালবাসারা বটবৃক্ষের ঝুরির মতো নামতে শুরুর কালে কাহিনীর অবকাঠামো বেশ দৃঢ় এবং সুদূরপ্রসারী ছিল। এক জোড়া মানুষ লতিয়ে উঠছিল ক্রমশ। তরতর করে ডালপালা মেলে আকাশ স্পর্শ করলে একদিন গোধূলি বেলায় ঝিঙে ফুলের মতো হলুদ আভা ছড়িয়ে গু”ছ গু”ছ ফুল  ফোটে। নীল আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসা মেঘদল সিক্ত করে ধরণী। ফসলের সংবাদ মুছে দেয় সব শুষ্কতা। কোয়েনা, আমার স্ত্রী হয়ে ওঠে উর্বর। কাহিনীর শুরু এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এটাই।
আমি ছিলাম খাঁ খাঁ রদ্দুরে পুড়ে যাওয়া বৃক্ষ। রসহীন তাৎপর্যহীন। রুখু মরুভূমি আমার শরীর। এক ফোঁটা জল সিঞ্চন নেই, যা দিয়ে সিক্ত করি কোয়েনাকে। আর কোয়েনা হয়ে উঠবে মিসরীয় মীথের অসিরিস দেবের মতো উর্বর শস্যক্ষেত্র। যা থেকে উৎপাদিত ফসল বয়ে যাবে আমার বংশলতিকায়। কিš‘ নীলনদের জলের যে প্রবাহ উর্বর করেছিল অসিরিসের দেহ, আমার সে জল কই? কী করে উর্বর হবে কোয়েনা? অথচ তাকে হতেই হবে তা। এর কোন ব্যত্যয় নেই, বিকল্প নেই। হতে পারে না। বংশের যে খান্দান বইছে আমার শিরায় তা আমাতেই থেমে যেতে পারে না। বংশের ধারা বইবে স্রোতের মতো। পূর্ব পুরুষের সম্পদ প্রাচুর্য প্রতিপত্তি সবই বয়ে যাবে সে ধারায়। আমার মৃত্যুতে তা থেমে যেতে পারে না। কিছুতেই না। সুতরাং কাহিনী শুরুর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, নিশিতাবের আগমন। নিশিতাব চক্রবর্তী। আমার বাল্যবন্ধু। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এক সঙ্গে পড়েছি। অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়েছে কিš‘ ওর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে একই রকম অটুট। আমার প্রিয় বন্ধু নিশিতাব। শিক্ষিত মার্জিত সুপুরুষ নিশিতাব। মেয়েদের মনের কাছাকাছি পৌঁছানোর অপরিসীম দক্ষতা ওর ছাত্র জীবন থেকেই। সুতরাং ওকেই নির্বাচন করি আমি। আর একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করার মতো এ খেলার যাবতীয় আনুষঙ্গিকীর বুনট একটু একটু করে গাঁথতে থাকি।
কোয়েনা-নিশিতাব উপাখ্যান সূচনা পর্ব পেরিয়ে তরতর করে এগোতে থাকে। তারপর এক ঝড়ের রাতে ফল ধরে তাতে। ঝড়টা ছিল কৃত্রিম। আসলে ওটা ছিল ফাগুনের কাল। বসন্ত বাতাস দোল খেয়ে বয়ে যায় আর দু’জন মানুষের আড়াল ভেদ করে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় কোমল কচি অপাপবিদ্ধ এক অবয়ব। আমি মুক্ত বাতাসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।
বংশ লতিকা নিরব”িছন্ন বয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা মিললে কাহিনী শক্ত অবকাঠামোয় দাঁড়িয়ে যায়।

॥ দুই ॥
সময় গড়ায়। নিশিতাবের আসা-যাওয়া অবি”িছন্ন থাকে। খেলার ছক আমি গুটাইনি। কেননা আরও একটি অবয়ব আমার প্রয়োজন ছিল।
সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। কিš‘ অদ্ভুত মানুষের মন! হঠাৎ কী যে হলো! একটি করে দিন যায় আর আমি ভেতরে ভেতরে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন টের পাই। একটি-দুটি দিন তো নয়। নবজাতকের বয়স এক বছর পেরিয়েছে। পরবর্তীটির জন্য অপেক্ষা। অপেক্ষার সময়গুলো ধীরে ধীরে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই শিশু, এই কোয়েনা, নিশিতাব কেউ কি আমার? থেকে থেকে এই ভাবনা উঁকি দিতে থাকে। অন্তর্দাহে ভস্ম হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছালে আমি উইংয়ের আড়ালে আশ্রয় নেই। সকালের পর দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল তারপর সন্ধ্যাগুলোয় আমার শুধু কাজ আর কাজ। বাতাসের গ্র্রামোফোনে বাজে নিশিতাব আর কোয়েনার শীৎকার সঙ্গীত। আমি উন্মাদের মতো দু’হাতকে ঢাল বানিয়ে চেপে ধরি নিজের দু’কান। নিজেকে কখনও হ্যামলেট মনে হয়, কখনও প্রকনি। চল”িচত্রের আনএডিটেড ফিল্ম রোলের মতো খ- খ- অসংলগ্ন  দৃশ্যে আমার মাথা ফেসবুকের এ্যাংগ্রি ইমোটিকনের মতো আগুন রং ধারণ করলে আমি শাওয়ারে মাথা গুঁজে নিজেকে সাজেশন দেইÑ ‘শান্ত হও হে পুরুষ। নিশিতাবকে তুমিই নির্বাচন করেছিলে। সুঠাম দেহী সুদর্শন উ”চ শিক্ষিত অভিজাত বংশোদ্ভূত বলে। তুমিই উৎকৃষ্ট বীজ সঞ্চারক খুঁজে এনেছিলে পরিপুষ্ট ফলের আশায়। সুতরাং তুমি শান্ত থাক। হে সামাজিক পুুরুষ, মনোযোগী হও নিজের মর্যাদাবান অব¯’ানের প্রতি। সম্পদ সম্পত্তি বেদখল হওয়া নিয়েই যে-তোমার যাবতীয় দুঃস্বপ্ন, সেই তুমিই ডেকে এনেছিলে নিশিতাবকে। সম্পত্তির সর্ষে সমান কণাও যাতে বংশলতিকার বাইরে না যায় সে জন্য তুমিই এ পরিপাটি গেমের আয়োজন করেছিলে। অধিনায়ক নিয়োগ দিয়েছিলে নিশিতাবকে। অতএব শান্ত হও।’
নিজেকে এসব সাজেশন দিতে দিতে আমি ধীর ¯ি’র শান্ত পুকুর হয়ে যাই। তারপর অমাবস্যার রাত আলো করে আবার একদিন উদ্ভাসিত হয় আরও একটি কোমল অবয়ব। তার তীব্র চিৎকার নগরীর অলিগলি পেরিয়ে বাতাসের স্তর ভেদ করে পৌঁছে যায় মহাকাশের কৃষ্ণ গহ্বরে। অফিস থেকে বাসা আকণ্ঠ ডুবে যায় বর্ণিল ফুল আর বিচিত্র মিষ্টির ঢলে। এক বেলা হৈ-হুল্লোড়ে মুখর গোটা অফিস। আত্মীয়-বন্ধুদের আগমনে বাড়িতেও উৎসবের ছোঁয়া। বয়স্করা খুঁটিয়ে দেখেন নবজাতকের মুখ, হাত, পা।
‘অবিকল বাপের মুখ’।
‘কপালটা একেবারে দাদির মতো’।
‘নাক দেখেছ, ওর দাদার ছিল এমন খাড়া নাক।’
এসব মন্তব্যের খুনসুঁটিতে ঘরের বাতাস গমগম করে। আর আমার মনে নিশিতাবের নিশি ডাক। না, এই বাড়ি এই ঘর বারান্দা কোথাও তার ছায়া নেই। কোথায় নিশিতাব? সে তো নেই। অস্তিত্বহীন তাকে কে চেনে আমি আর কোয়েনা ছাড়া? আমি ফাহমিদ সৈয়দ। স্ত্রী ও দু’সন্তান নিয়ে আমার সংসার। কোন নিশিতাব কোন কালে ছিল না। কোথাও নেই।

॥ তিন ॥
নেই। নেই। নেই। এই এক ভাবনা নিয়ত খোঁচায় আমায়। জাঁকিয়ে ডালপালা ছড়ায় আমার মগজে। দিনে-রাতে হ্যালুসিনেশন হতে থাকে। যখন তখন নিশিতাব এসে সামনে দাঁড়ায়, কেমন এক শ্লেষের হাসি নিয়ে। শুনতে পাই কোয়েনার খিলখিল হাসি, নিশিতাবের ফিসফাস। কোয়েনার পাশে শুয়ে থাকি আমি, অচেনা পুরুষ। সে ডুবে থাকে নিশিতাবে।
শিশুরা অঘোরে ঘুমায়। ওদের কপালের কালো টিপ মনে পড়িয়ে দেয় আমার শৈশব। ছোট বেলায় আব্বা আমায় প্রায়ই গোধূলি দেখাতে নিয়ে যেতেন, সরু রাস্তা পেরিয়ে আমাদের প্রায় মজে যাওয়া নদীর ধারে। আম্মা লম্বা সিঁথি কেটে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে ঘাড়ে গলায় পাউডার বুলিয়ে দিতেন। কপালের বাঁয়ে আঁকতেন কাজলের টিপ। মহুয়ার গন্ধের মতো এই সাজ আমার পুরো শৈশবের স্মৃতি হয়ে আছে। আজীবন স্মৃতির শরীর লেপ্টে ছিল তা। ওই কালো টিপ আর গোধূলির লাল সূর্য একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে হয়ত আমার রক্তে খেলা করেছে। আহা, শৈশবের দৈর্ঘ্য কেন এত খাটো হয়!
আব্বার তর্জনী ধরে ঘাসফুল মাড়িয়ে যেতে যেতে ফুলেদের কষ্টে চোখ ভেসে যেত জলে। বাড়ি ফিরে আম্মার বুকে মুখ লুকালে ফোঁপানোর শব্দে উৎকর্ণ মা সব শুনে হেসে বলতেন,
‘দুর বোকা! ও তো বুনো ফুল, মানুষ ওদের পায়ে দলে গেলেও ওরা আবার হেসে ওঠে।’
চোখ মুছিয়ে চুমু খেয়ে লেপ্টে যাওয়া কালো টিপ পূর্ণ চাঁদের মতো গোল করে দিতেন আবার।
আমার মাথায় ঘাসফুল মাড়িয়ে যাওয়ার স্মৃতি কিলবিলিয়ে ওঠে। দুটি বৃক্ষ, দুটি পূর্ণ বয়স্ক প্রাণ মাড়িয়ে গেলে কেমন হয়? আমি আঁতকে উঠি। নিজের অস্বাভাবিক চিন্তায় নিজেই বিমূঢ় হই। এ কী ভাবছি আমি! এও কি সম্ভব! কিš‘ আমার জানা ছিল না, অসম্ভবকে একবার ভাবনায় প্রশ্রয় দিলে তা আর অসম্ভব থাকে না। একটু একটু  করে সয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সম্ভব হয়ে ওঠে। এ বাড়িতে আজ তাই হয়েছে।

 ॥ চার ॥
রক্তের রং এত লাল হয় তা কি আমার জানা ছিল? হয়ত ছিল, হয়ত ছিল না, ঘাসফুল কিংবা বৃক্ষ মাড়িয়ে যাওয়ার রূপ এত বীভৎস হয়? এ... তো... বী...ভ...ৎস! ওহ্ আমার বুকের বাঁয়ে তোলপাড় করে ওঠে আরও রক্ত। আরও রক্ত। হৃদপিন্ড মুচড়ে যা”েছ। এত যন্ত্রনাও হয় মানুষের শরীরে! আমার চোখ কেন বুজে আসে! রাতের আকাশে কালপুরুষের জ্বলজ্বলে আভা দেখতে দেখতে আমি কি ঘুমিয়ে পড়ছি? আমার চারপাশে হাজার তারার মেলা। বুঝিবা ভাসছি মহাশূন্যে। তারাদের গায়ে আলো নেই কেন? সূর্য কি তবে ওঠেনি আজ? উঠেছিল তো। সে আলোয় স্নান করছিল কোয়েনা। নিশিতাব যেন শাপমুক্ত সূচকুমার। অভিমানী কাজল রেখার মান ভাঙাতে ব্যাকুল। এত ব্যাকুলতা জীবনে দেখিনি আমি। কাজল রেখা, কাজল রেখা, কোয়েনা, তুমি অমন ঝর্ণার মতো ঝরছো কেন। আমি সইতে পারছি না। থামো কোয়েনা। নিশিতাব তোমরা থামো। আকাশে কেমন ত্রিশূল ঝুলছে দেখতে পা”ছ? ঝড় উঠছে দিগন্ত কাঁপিয়ে। তোমরা অমন স্রোতের মতো ভেসে যেও না। কোয়েনা, নিশিতাব প্রিয় ফলবান বৃক্ষদ্বয় আমার, তোমরা কি আকাশের তারা হয়ে যা”ছ? সপ্তর্ষী ম-লের সাতটি তারার সঙ্গে মিশে যাবে তোমরা? কোয়েনা, আমার সন্তানের জননী! হা হা হা! সন্তান! বংশলতিকা! হায় সমাজ-সংসার! সম্পত্তির টান!

॥ পাঁচ ॥
শিশু দুটো বড় হবে সৈয়দ বাড়ির ফাহমিদ সৈয়দের সন্তান পরিচয়ে পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে। সৈয়দ বংশের সম্পত্তির বৈধ, আইনী উত্তরসূরি হবে তারা। আর একটি উপাখ্যান এ অঞ্চলে চালু থাকবে বহুকালÑ সৈয়দ বাড়ি থেকে একদিন এক সঙ্গে তিনটি লাশ বের হয়েছিল। ফাহমিদ সৈয়দ, তার স্ত্রী এবং বন্ধু। ছেলেরা ঘটা করে ‘মা বাবার’ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে। সৈয়দ বাড়ির মান বলে কথা!

অন্যরকম হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কাহিনীটি এভাবেই শেষ হয়। এ আমার দূর ভাবনাতেও ছিল না। ঘুণাক্ষরেও এভাবে নিজের কফিন আমি দেখতে চাইনি। কেই বা তা চায়।

তবে ওই যে প্যারাডক্স! তা ঘুচে গেল চিরতরে। ‘সৈয়দ বাড়ির ছেলেরা’ রক্তের প্রবাহে বয়ে নিয়ে যাক বংশের খানদান...



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন