জলধি
/ গল্প
/ বেওয়ারিশ মানুষ ও ক্ষুধার্ত কুকুর
বেওয়ারিশ মানুষ ও ক্ষুধার্ত কুকুর
রোয়েনার দিনগুলো থমকে আছে। থমকে যাওয়া সময়কে সচল করতে প্রথমেই ছেলেমেয়ে টিভি দেখা বন্ধ করতে বলেছে। ফেসবুকে চোখ না রাখতে বলেছে । ম্যাসেন্জার অফ রাখতে বলেছে। । রোয়েনা শেষটায় কিছুটা রাশ টানতে পেরেছে। নরম একতাল কাঁদার মত মেয়ে রোয়েনার জমজমাট সংসার এক মুহূর্তের নোটিশে ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল কবেই। তখন ভেতরে একটা বোধ কাজ করতো। ওর ভেতরের রস নিংড়ে যারা পৃথিবীতে এসেছে তাদের নতুন জীবন দিতে হবে। যে জীবনে এই জীবনের ছোঁয়া না থাকে।
তখন কিভাবে কঠিন দিনগুলো বুকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যেত সেটা শুধু নিজেই বুঝতে পারতো। কঠিন সময় কোমল হাতে ঠেলতে ঠেলতেই দেখে হাত দুটোর সাথে মনটাও শক্ত হয়ে গেছে। নির্দয় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব জানাবার জন্য তৈরি করে পৃথিবীই ওকে।
দুই সন্তান এখন দুই মহাদেশে নতুন পরিবেশে তাদের জীবনের পাখা মেলছে। প্রতিদিন স্কাইপে ওদের আনন্দময় কর্মমূখর জীবন দেখে আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।তার বেদনা সযত্নে বালিশের তলায় রেখে মৃত্যু উপত্যকা থেকে ছিনিয়ে এনেছিল জীবনের একমুঠো সুর। ছেলেমেয়েরা সেই সুরকে শব্দ সংগীতে রূপ দিয়েছে।
মিরপুর বার নম্বর সেকশনে চার কাঠা প্লটের বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে। কেয়ার টেকার আছে সিঁড়ির কাছের একটা রুমে। ওর স্ত্রীকে নিয়েই বসবাস করে। যত রকম সুযোগ সুবিধা দেয়া যায় সেগুলোর প্রত্যেকটা দিয়েই রেখেছে কেয়ার টেকারকে। ওর স্ত্রী রোয়েনার সংসার সামলায়।
সন্তান সম্ভবা কন্যার কাছে গিয়েছিল একমাসের ছুটি নিয়ে। ফিরতে পারছেনা লক ডাউনের জন্য।
এই অবরুদ্ধ সময় এলো শবেবরাত। দুই মহাদেশে থেকে ছেলেমেয়েরা জোর তাগিদ দিয়েছে শবেবরাতে প্রতিবারের মত আয়োজন করার জন্য।
মা সারাদিন ভেতরে কাঁটা নিয়ে বসবাস করছে আঠার শ স্কয়ার ফুটে একা। সেটা ছেলেমেয়ে খুব ভালো করেই জানে। তাই মাকে ব্যাস্ত রাখার জন্য এই ব্যবস্থা এটুকু বুঝতে পারে রোয়েনা। কি খাবার বানাবে কতটুকু বানাবে। কাকে দেবে আর কে খাবে। দীর্ঘকাল পরেও মানুষের অভাবই ওর কাছে প্রকট থাকলো। ওর কাছে জীবনের মানে অন্যরকম। নিজের বেদনা নিয়ে অন্যকে বিব্রত করে না। কঠিন সময় থেকে বের হবার পথ আসলে নিজেকেই করতে হয়।
বাইরের মানুষের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সহানুভূতি আদায়ের মানুষ রোয়েনা নয়। নিজের ভেতর থেকে শক্তি উৎপাদন করার অদম্য শক্তি ওর আছে। কত বিপদ উৎরে আজকের এই কঠিনে কোমল রোয়েনা। বাসায় সর্ব সাকুল্যে মানুষ মাত্র দুজন। অন্য সময় হলে শবেবরাতের পরদিন শোভন আসতো। কেউ না কেউ তো আসতোই। হলা ভাবী শামীমা ভাবী আসতো ছাদবাগানে বসে এক কাপ চায়ের স্বাদ নিতে। এই লক ডাউন সময়ে কে আসবে। ড্রাইভার ছুটিতে বুয়া মেয়ের বাড়িতে আঁটকে আছে । রোয়েনাও ছুটিতে। তবে অবসরে নয়। সারাদিন এটা ওটা ধোয়াধুয়ি চলছেই।ফাঁকে ফাঁকে টিভিতে চোখ রাখতেই হচ্ছে। সময়ে অসময়ে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে হচ্ছে।
সারা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অতি ক্ষুদ্র এক ঘাতক অনুজীব ছেলেমেয়ের অমঙ্গল আশঙ্কা ঘিরে রাখছে সারাক্ষণ। নিজের ভেতরের কান্না ওদের বুঝতে দিচ্ছে না। কিন্তু অবরুদ্ধ কান্নার সাথে নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তবুও ছেলেমেয়ে কথা রাখতেই সামনের বিগ বাজার থেকে কিছু তৈরি হালুয়া কিনে নিয়ে আসে । বহুবছর রুটি তৈরি না করতে করতে রুটি তৈরির পদ্ধতি ভুলে গেছে । যেটুকু দরকার বুয়াই তৈরি করে দিয়ে যায় রোয়েনা শুধু অফিসে যাবার সময়ে সেঁকে নেয় একটা রুটি। সেটাও কখনো সখনো। আজ আর রুটি নয় একান্ত অনিচ্ছায় হাড়িতে খানিকটা বিরিয়ানির চাল বের করে। বিরিয়ানির রান্নার আয়োজনে নিজেকে কিছুক্ষণ ব্যাস্ত রাখে। সব গুছিয়ে খাবার টেবিলে রাখে। বাগান থেকে টাটকা ফুল এনে চমৎকার করে টেবিল সাজায়।
শবেবরাত বিভিন্ন আইটেমে খাবার তৈরি করে টেবিল সাজানো রোয়েনার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
শাশুড়ী বলতো
-বৌমা এই রাইতে আল্লাহর ফিরেশতা নাইমা আসে। বাড়ি বাড়ি ঘুইরা ঘুইরা দেহে কে কি রকম খাওন খায়। আল্লাহরে যাইয়া হেই রকম খাওনের লিষ্টি দেয়। আল্লাও হেই রকম খাওন তার বান্দার কপালে লেইখা থাকে।
রোয়েনা হাসতো তর্ক করতো না।বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে শাশুড়ীর নিয়ম ধরে রেখেছে এতো বছর। অনেকটা সময় নিয়ে ইবাদত করে। মোনাজাত শেষ করে দাঁড়াতেই ছেলের ফোন। ওরাও লক ডাউনে তাই এসময়ে ফোন। নইলে এটা ওদের কাজের সময়। ছেলে বৌমার সাথে কথা শেষ করতেই মেয়ে জামাতার ফোন।
খাবারের আয়োজন কম হয়েছে তাই নিয়ে মেয়ে গাল ফুলায়। দুজন মাত্র মানুষ। রোয়েনা দীর্ঘদিন রিচ ফুড খায়না আর খাবার অপচয় পছন্দ নয় সবমিলিয়ে পরিমিত আয়োজন। ওকে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তে বলে মেয়ে। ঘরে বসেই মেয়েটা অফিসের কাজ করবে। তাই ফোন রেখে দেয়। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রত্যেকটা খাবার দেখে। গলার কাছটায় কষ্ট আঁটকে থাকে। চোখ ভিজে যায়। ছেলেমেয়েদের প্রিয় খাবার কিছুতেই মুখে তুলতে পারে না রোয়েনা। দারোয়ানের জন্য প্লেট ভর্তি করে খাবার সাজায়। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরটার জন্য খাবার সাজায়। কয়েকদিন ধরে রোয়েনা ওকে নিয়ম করে খাবার দেয়।
দারোয়ান নিয়ম মেনে খাবার নিয়ে যেতেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রোয়েনা। কুকুরটাকে দেখা যায় কিনা।। সুনশান রাস্তা। কেউ কোথাও নেই। দূর থেকে একটা কিশোর আর একজন নারী হেঁটে আসছে। হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটছে। রোয়েনার গেটের কাছাকাছি আসতেই হাত ইশারা করে দাঁড় করায়
-কোথায় যাচ্ছ?
-কুনু দিক দিশা নাই।বিয়ানকালা বাইরোছিলাম কামের উদিশে। কাম পাই নাই।
-এতো রাতে কাজ পাবে তুমি?
-বিয়ানেই আইছিলাম। হারাডা দিন খালি আটলাম। অহন বাড়ি যামু তার ট্যাহাও নাই প্যাডে খাওন নাই।
-তোমার ছেলেটাও কিছু খায়নি
-হে আমার পুলা না। কামের উদিশে আইছিলি। ঘরে বুড়া অসুক্কা মা পইড়া রইছে ছ্যাড়াডার। বাপের কুনু অদিস নাই।
রোয়েনা হাত ইশারা করে দাঁড়াতে বলে টেবিলের কাছে দাঁড়ায়। পুরো টেবিলের আয়োজন দুটো প্যাকেট করে নিয়ে নামার সময় কিছু চাল ডালও নিয়ে আসে। নিচে কুকুরটার জন্যও খাবার নিয়ে নিচে নামে রোয়েনা। গেটের কাছে কুকুরটার জন্য খাবারের প্লেট নামিয়ে রাখতেই কিশোরটি নোংরা হাতে খাবার প্লেটের কাছে বসে পড়ে।
- ওগুলো তোমার জন্য নয় কুকুর খাবে। আর হাত না ধুয়ে খাবে না একদম না।
হাত না ধুয়েই প্লেট থেকে খাবার মুখে তুলতে থাকে কিশোরটি।
- ক্ষিদার কাছে মানুষ আর কুত্তা হমান খালাম্মা।।
করোনা আতংক শুরু হবার পর ওরা নিচ তলায় হাত ধোবার ব্যাবস্থা করেছে। রোয়েনা হ্যান্ড ওয়াসের টিউব আর বালতি ভরে পানি ও মগ দূরত্ব বজায় রেখে গেট খুলে বের করে দেয়।
কিশোরটি হাত ধুতে ধুতে দেখে নিরবে কুকুরটা ওর প্লেটে রাখা খাবার খাচ্ছে। স্বল্পাহারী রোয়েনার অল্প খাবারটুকুই দুজনকে ভাগ করে দিয়েছে। কতটুকুই বা একেকজনের ভাগে পড়েছে। সারাদিনের মগজগলা রোদের ভেতর দিয়ে অনিশ্চিত সময় ঠেলে ঠেলে হেঁটে পেটে জমিয়ে এনেছে রাক্ষুসে ক্ষুধা। ওদের সামনে অপ্রতুল খাদ্য। হাত ধোয়া শেষ করে কিশোরটি রোয়েনার চোখে তাকায়। রোয়েনা ওর দৃষ্টির মানে বুঝতে চায় অথবা চায় না।
- খিদার কাছে মানুষ আর কুত্তা হমান খালাম্মা।
ওর কানে কিশোরটির কন্ঠস্বর তীব্র আওয়াজে বাজতে থাকে।
তখন কিভাবে কঠিন দিনগুলো বুকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যেত সেটা শুধু নিজেই বুঝতে পারতো। কঠিন সময় কোমল হাতে ঠেলতে ঠেলতেই দেখে হাত দুটোর সাথে মনটাও শক্ত হয়ে গেছে। নির্দয় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব জানাবার জন্য তৈরি করে পৃথিবীই ওকে।
দুই সন্তান এখন দুই মহাদেশে নতুন পরিবেশে তাদের জীবনের পাখা মেলছে। প্রতিদিন স্কাইপে ওদের আনন্দময় কর্মমূখর জীবন দেখে আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।তার বেদনা সযত্নে বালিশের তলায় রেখে মৃত্যু উপত্যকা থেকে ছিনিয়ে এনেছিল জীবনের একমুঠো সুর। ছেলেমেয়েরা সেই সুরকে শব্দ সংগীতে রূপ দিয়েছে।
মিরপুর বার নম্বর সেকশনে চার কাঠা প্লটের বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে। কেয়ার টেকার আছে সিঁড়ির কাছের একটা রুমে। ওর স্ত্রীকে নিয়েই বসবাস করে। যত রকম সুযোগ সুবিধা দেয়া যায় সেগুলোর প্রত্যেকটা দিয়েই রেখেছে কেয়ার টেকারকে। ওর স্ত্রী রোয়েনার সংসার সামলায়।
সন্তান সম্ভবা কন্যার কাছে গিয়েছিল একমাসের ছুটি নিয়ে। ফিরতে পারছেনা লক ডাউনের জন্য।
এই অবরুদ্ধ সময় এলো শবেবরাত। দুই মহাদেশে থেকে ছেলেমেয়েরা জোর তাগিদ দিয়েছে শবেবরাতে প্রতিবারের মত আয়োজন করার জন্য।
মা সারাদিন ভেতরে কাঁটা নিয়ে বসবাস করছে আঠার শ স্কয়ার ফুটে একা। সেটা ছেলেমেয়ে খুব ভালো করেই জানে। তাই মাকে ব্যাস্ত রাখার জন্য এই ব্যবস্থা এটুকু বুঝতে পারে রোয়েনা। কি খাবার বানাবে কতটুকু বানাবে। কাকে দেবে আর কে খাবে। দীর্ঘকাল পরেও মানুষের অভাবই ওর কাছে প্রকট থাকলো। ওর কাছে জীবনের মানে অন্যরকম। নিজের বেদনা নিয়ে অন্যকে বিব্রত করে না। কঠিন সময় থেকে বের হবার পথ আসলে নিজেকেই করতে হয়।
বাইরের মানুষের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সহানুভূতি আদায়ের মানুষ রোয়েনা নয়। নিজের ভেতর থেকে শক্তি উৎপাদন করার অদম্য শক্তি ওর আছে। কত বিপদ উৎরে আজকের এই কঠিনে কোমল রোয়েনা। বাসায় সর্ব সাকুল্যে মানুষ মাত্র দুজন। অন্য সময় হলে শবেবরাতের পরদিন শোভন আসতো। কেউ না কেউ তো আসতোই। হলা ভাবী শামীমা ভাবী আসতো ছাদবাগানে বসে এক কাপ চায়ের স্বাদ নিতে। এই লক ডাউন সময়ে কে আসবে। ড্রাইভার ছুটিতে বুয়া মেয়ের বাড়িতে আঁটকে আছে । রোয়েনাও ছুটিতে। তবে অবসরে নয়। সারাদিন এটা ওটা ধোয়াধুয়ি চলছেই।ফাঁকে ফাঁকে টিভিতে চোখ রাখতেই হচ্ছে। সময়ে অসময়ে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে হচ্ছে।
সারা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অতি ক্ষুদ্র এক ঘাতক অনুজীব ছেলেমেয়ের অমঙ্গল আশঙ্কা ঘিরে রাখছে সারাক্ষণ। নিজের ভেতরের কান্না ওদের বুঝতে দিচ্ছে না। কিন্তু অবরুদ্ধ কান্নার সাথে নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তবুও ছেলেমেয়ে কথা রাখতেই সামনের বিগ বাজার থেকে কিছু তৈরি হালুয়া কিনে নিয়ে আসে । বহুবছর রুটি তৈরি না করতে করতে রুটি তৈরির পদ্ধতি ভুলে গেছে । যেটুকু দরকার বুয়াই তৈরি করে দিয়ে যায় রোয়েনা শুধু অফিসে যাবার সময়ে সেঁকে নেয় একটা রুটি। সেটাও কখনো সখনো। আজ আর রুটি নয় একান্ত অনিচ্ছায় হাড়িতে খানিকটা বিরিয়ানির চাল বের করে। বিরিয়ানির রান্নার আয়োজনে নিজেকে কিছুক্ষণ ব্যাস্ত রাখে। সব গুছিয়ে খাবার টেবিলে রাখে। বাগান থেকে টাটকা ফুল এনে চমৎকার করে টেবিল সাজায়।
শবেবরাত বিভিন্ন আইটেমে খাবার তৈরি করে টেবিল সাজানো রোয়েনার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
শাশুড়ী বলতো
-বৌমা এই রাইতে আল্লাহর ফিরেশতা নাইমা আসে। বাড়ি বাড়ি ঘুইরা ঘুইরা দেহে কে কি রকম খাওন খায়। আল্লাহরে যাইয়া হেই রকম খাওনের লিষ্টি দেয়। আল্লাও হেই রকম খাওন তার বান্দার কপালে লেইখা থাকে।
রোয়েনা হাসতো তর্ক করতো না।বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে শাশুড়ীর নিয়ম ধরে রেখেছে এতো বছর। অনেকটা সময় নিয়ে ইবাদত করে। মোনাজাত শেষ করে দাঁড়াতেই ছেলের ফোন। ওরাও লক ডাউনে তাই এসময়ে ফোন। নইলে এটা ওদের কাজের সময়। ছেলে বৌমার সাথে কথা শেষ করতেই মেয়ে জামাতার ফোন।
খাবারের আয়োজন কম হয়েছে তাই নিয়ে মেয়ে গাল ফুলায়। দুজন মাত্র মানুষ। রোয়েনা দীর্ঘদিন রিচ ফুড খায়না আর খাবার অপচয় পছন্দ নয় সবমিলিয়ে পরিমিত আয়োজন। ওকে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তে বলে মেয়ে। ঘরে বসেই মেয়েটা অফিসের কাজ করবে। তাই ফোন রেখে দেয়। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রত্যেকটা খাবার দেখে। গলার কাছটায় কষ্ট আঁটকে থাকে। চোখ ভিজে যায়। ছেলেমেয়েদের প্রিয় খাবার কিছুতেই মুখে তুলতে পারে না রোয়েনা। দারোয়ানের জন্য প্লেট ভর্তি করে খাবার সাজায়। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরটার জন্য খাবার সাজায়। কয়েকদিন ধরে রোয়েনা ওকে নিয়ম করে খাবার দেয়।
দারোয়ান নিয়ম মেনে খাবার নিয়ে যেতেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রোয়েনা। কুকুরটাকে দেখা যায় কিনা।। সুনশান রাস্তা। কেউ কোথাও নেই। দূর থেকে একটা কিশোর আর একজন নারী হেঁটে আসছে। হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটছে। রোয়েনার গেটের কাছাকাছি আসতেই হাত ইশারা করে দাঁড় করায়
-কোথায় যাচ্ছ?
-কুনু দিক দিশা নাই।বিয়ানকালা বাইরোছিলাম কামের উদিশে। কাম পাই নাই।
-এতো রাতে কাজ পাবে তুমি?
-বিয়ানেই আইছিলাম। হারাডা দিন খালি আটলাম। অহন বাড়ি যামু তার ট্যাহাও নাই প্যাডে খাওন নাই।
-তোমার ছেলেটাও কিছু খায়নি
-হে আমার পুলা না। কামের উদিশে আইছিলি। ঘরে বুড়া অসুক্কা মা পইড়া রইছে ছ্যাড়াডার। বাপের কুনু অদিস নাই।
রোয়েনা হাত ইশারা করে দাঁড়াতে বলে টেবিলের কাছে দাঁড়ায়। পুরো টেবিলের আয়োজন দুটো প্যাকেট করে নিয়ে নামার সময় কিছু চাল ডালও নিয়ে আসে। নিচে কুকুরটার জন্যও খাবার নিয়ে নিচে নামে রোয়েনা। গেটের কাছে কুকুরটার জন্য খাবারের প্লেট নামিয়ে রাখতেই কিশোরটি নোংরা হাতে খাবার প্লেটের কাছে বসে পড়ে।
- ওগুলো তোমার জন্য নয় কুকুর খাবে। আর হাত না ধুয়ে খাবে না একদম না।
হাত না ধুয়েই প্লেট থেকে খাবার মুখে তুলতে থাকে কিশোরটি।
- ক্ষিদার কাছে মানুষ আর কুত্তা হমান খালাম্মা।।
করোনা আতংক শুরু হবার পর ওরা নিচ তলায় হাত ধোবার ব্যাবস্থা করেছে। রোয়েনা হ্যান্ড ওয়াসের টিউব আর বালতি ভরে পানি ও মগ দূরত্ব বজায় রেখে গেট খুলে বের করে দেয়।
কিশোরটি হাত ধুতে ধুতে দেখে নিরবে কুকুরটা ওর প্লেটে রাখা খাবার খাচ্ছে। স্বল্পাহারী রোয়েনার অল্প খাবারটুকুই দুজনকে ভাগ করে দিয়েছে। কতটুকুই বা একেকজনের ভাগে পড়েছে। সারাদিনের মগজগলা রোদের ভেতর দিয়ে অনিশ্চিত সময় ঠেলে ঠেলে হেঁটে পেটে জমিয়ে এনেছে রাক্ষুসে ক্ষুধা। ওদের সামনে অপ্রতুল খাদ্য। হাত ধোয়া শেষ করে কিশোরটি রোয়েনার চোখে তাকায়। রোয়েনা ওর দৃষ্টির মানে বুঝতে চায় অথবা চায় না।
- খিদার কাছে মানুষ আর কুত্তা হমান খালাম্মা।
ওর কানে কিশোরটির কন্ঠস্বর তীব্র আওয়াজে বাজতে থাকে।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন