জলধি / গল্প / বিজলি সেতার
Share:
বিজলি সেতার

রেগে গাল ফুলিয়ে থাকবে? কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে কিংবা আবেগপ্রবণ হয়ে কাছে ছুটে যাবে? তাতে লাভ কী। ইনামের এতে কিচ্ছু যায়-আসে না। দিনদিন লোকটা চায়না হরফের মতো দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। রসকষ সব কই যে হারিয়ে গেলো! শেষতক মনুষ্যত্ববোধটাও বাদুড়ে শুষে খেয়েছে। এমন আজব পুরুষ জীবনে আর একটাও চোখে দেখেনি রেবা। হাসবে? সেখানেও যুক্তি! কাঁদবে? তাতেও দুনিয়ার ব্যাখ্যা! স্মৃতিরোমন্থন করবে? তার ভেতরেও মিথ-প্রবচনের ঝক্কি-ঝাঁপি! লোকটা যে কতো পদের রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি-কে জানে? এরপরও ভালো জাতের সব রস-গুণ যেন তার মধ্য থেকে প্রতিনিয়ত লীন হয়ে যাচ্ছে। লোকটার অতিমাত্রায় জ্ঞানগরিমা প্রদর্শন এবং পাণ্ডিত্যভাব মাঝেমধ্যে বিরক্তি উদ্রেক করে তার। এই যেমন গেলো পরশুর ঘটনা-অকারণেই রেবার খুব মন খারাপ হয়, কিচ্ছুটি ভালো লাগছিলো না। প্রচ- মাথাব্যথা। দূরমনা হয়ে কুকুরকুণ্ডলি পাকিয়ে নিশ্চুপ বিছানায় পড়ে রইলো সে। ঠিক সে-মুহূর্তে দাঁড়াশের বেশে লোকটা সামনে এসে দাঁড়ায় এবং খাটের বাজু ধরে যুদ্ধজয়ী বীরের মতো বত্রিশ-গাল হাসি নিক্ষেপ করে বলে-‘নারীর মুখ কালো হলে নূহের প্লাবন নামে, হাসলে পোড়ে ট্রয় নগরী-হে বিয়ে, নারী ও জন্মের দেবী হেরা; স্বর্গ-মালকিন এবং ক্রোনাসের কন্যা জুনো-তুমি কোন পথে হাঁটবে বলো?’ রেবার মেজাজটাই বিগড়ে গিয়েছিলো। এতো আমোদ কেন লোকটার ভেতরে? এমন সব ভাব দেখানো কথা বলে যে-হাসলেও দোষ, কাঁদলেও দোষ! রেবাকে এখন আবার হেরা বলতে শুরু করেছে। উফ!

রেবার খুব কান্না পাচ্ছে। বুকটা ফেটে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। কাউকে বলতেও পাচ্ছে না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলো কিনা সেটা ভেবেও দিশকুল পাচ্ছে না। হাতিনার কোণে নিরবে-নিভৃতে বসে রইলো কতক্ষণ, অজানা কষ্টে চোখ বেয়ে ঝরতে লাগলো পানি। ভেতরটা হঠাৎ আর্দ্র হয়ে উঠলো। কেউ তাকে বুঝতে চায় না। তার কথার যেন মূল্য নেই পৃথিবীতে। তার ভাবনার জল বোনা শেষ না হতেই শিকারি বকের মতো নিঃশব্দ পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালো ইনাম, আবারও পাষুণ্ড সিমারের মতো হেসে উঠলো এবং নিজেকে জাহির করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলো।

-কাঁদো নারী কাঁদো। ক্রন্দন বড় ভালো জিনিস। কান্না মানুষকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। মাইকেল জ্যাকসনও রাতের আঁধারে নিশ্চুপ, নিরালায় বারান্দায় বসে একা একা কাঁদতেন। গোটা বিশ্বজয় করে নিয়েছিলেন তিনি, তবু কান্না তার পিছু ছাড়েনি। একাত্তরে সারা বাংলার মানুষও দিনরাত কেঁদেছিলো-মুক্তির আশায়। অবশেষে মুক্তি মিললো। চোখের নোনা সমুদ্র থেকে ভেসে উঠলো সে বিজয়।

রেবার মেজাজ তিরিক্ষ হয়ে গেলো। ধৈর্যের একটা সীমা থাকা উচিত। একজন মানুষ কাঁদবে। কই সান্ত¡না দেবে-তা না, উল্টো কাঁদার জন্যে উৎসাহ যোগাচ্ছে। ইয়ার্কি-পাতরামির একটা লাগাম থাকা উচিত। কষ্টে তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে নজর না দিয়ে উল্টো রসিকতা করে বেড়ায় ইনাম। রেবা খেঁকিয়ে উঠলো।

-তোমার মাইকেল জ্যাকসন হওয়ার খায়েশ আমার নাই। পাষাণ মানুষ, কান্নার মর্ম বুঝবে কী? কতো দিন হয় মার কোনো খোঁজ-খরব পাই না, হাসপাতলে কেমন আছে কে জানে। মায়ের আদর কী জিনিস তুমি বুঝবে কীভাবে। তোমার তো মাইকেল জ্যাকসন ছাড়া দুনিয়ার আর কিছুতেই চোখ পড়ে না। তোমার অত্যাচারে মায়ের জন্যে একটু কাঁদার ফুরসতও পেলাম না।

ইনাম দাঁত কেলিয়ে হাসে। বিষয়টা তার কাছে কান্নার মতো গুরুতর ইস্যু বলে মনে হলো না।

-ওকে বাবা ভুল হয়ে গেছে। স্যরি। এবার একটু শান্ত হও প্লীজ। না কেঁদে প্রার্থনা করো মায়ের জন্যে, সেটা বরং কাজে দেবে।

রেবার হাত চেপে ধরে ইনাম, তাকে স্বাভাবিক করানোর চেষ্টা করে। রেবা হাত ছাড়িয়ে নেয়। অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখে, মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইনাম অপ্রস্তুত হয়। নিজেকে সামলায়। বিজ্ঞের ধাঁচে হাসে।

-শোন, রবিনদ্বীপের কারাবন্দি নেলসন ম্যান্ডেলা কারাবাসকালে একদিন সংবাদ পেলেন যে তার মা মারা গেছেন, খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্যারোলে মুক্তি প্রার্থনা করে মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে চেয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষ তাঁকে সে সুযোগ দেননি। বর্ণবাদবিরোধী নেতা ম্যান্ডেলা নিজের মায়ের মুখটাও শেষ দেখা দেখতে পারলেন না। তাই বলে কি তিনি হেরে গেছেন? থেমে গেছেন তিনি? থমকে গেছে তাঁর দুনিয়া? সময় একদিন রাষ্ট্রক্ষমতায়ও বসিয়েছে তাঁকে। কিন্তু প্রিয় মা-জননীকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি কেউ। তোমার মা তো সামান্য অসুস্থ। তুমি তো চাইলে এক্ষুনি গিয়ে দেখে আসতে পারো। গেলে তোমাকে কে ফেরাবে বলো? তারপরও এতো ভেঙে পড়লে কেন? একবার চিন্তা করে দেখো, পরিস্থিতিটা ম্যান্ডেলার মতো হলে তোমার হাল হতো কী?

রেবা লাল হয়ে গেলো। জেদ রুখতে পারলো না। অগ্নিশর্মা হয়ে ইনামের দিকে তাকালো।

-তুমি আসলে কী, এ্যাঁ? তোমার ভেতরে কি এতটুকু দয়ামায়া নেই? আমার মা হাসপাতালে বিমারে ভোগে, কোথায় গিয়ে একটু খোঁজ-খবর নেবে, সান্ত¡না দেবে-তা না, কেবল ঘরে বসে বসে ইতিহাসচর্চা করো। আমিও বসে বসে তোমার আজগুবি সব গপ-গুজারি গিলতে থাকি। যত্ত সব আপদ।

ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে পড়লো রেবা। ইনাম ঝাপটে ধরলো তাকে। রেবা ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয় পড়লো। দুজনের শরীরে নান্দনিক একটা ঢেউ খেলা করলো।

-ম্যাডাম, এতো চটলে কি হয়? এই পাপিষ্ট অধমের দণ্ড মওকুফ করুন, প্লীজ। জীবে দয়া করো, করুন না ম্যাডাম জীবে দয়া!

ইনামের ছেলেমানুষি আচরণে রাগের মধ্যেও হেসে ওঠে রেবা। নিজেকে সামলে নেয়। কণ্ঠে গরল মিশিয়ে বলে।

-তুমি একটু সিরিয়াস হও ইনাম; প্লিজ, সবকিছুতে ইতিহাসচর্চা আর যুক্তি-তর্ক বন্ধ করো। আমার এসব বিরক্ত লাগে। তুমি তো এমন ছিলে না, কী হলো হঠাৎ, নাকি মনে কোনো রঙ লেগেছে নতুন? ধুর, হাত ছাড়ো তো...ভাল্লাগে না এসব ন্যাকামি। ছাই।

কানের কাছে চুমো খায় ইনাম। কেঁপে ওঠে রেবা। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ইনাম আরো গাঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে তাকে।

-ম্যাডাম, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, রাগটা দমান, অনেক দূর যেতে পারবেন জীবনে। আমাদের দেশটা তো দুই দলের রাগারাগি আর ভাগাভাগিতেই শেষ; সংসারের মধ্যেও যদি রাগারাগি ঢুকে যায় তাহলে যে প্রিয় ঘরটাও মাতৃভূমির মতো নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাহলে শোনো আরেকটা ঘটনা-গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের বিষয়টা নাইবা তুললাম আজ, ম্যান্ডেলার কথাই আরেকটু শোনো- ঋ.ড. ঊব কষবৎশ নামের এক ইতর ব্যক্তি এককালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে অন্যায়ভাবে কারাবন্দি করেছিলো কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দেশ ও জাতির শান্তি-সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে চরম শত্রু ঋ.ড. ঊব কষবৎশ-কেই রাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিলেন! সমগ্র পৃথিবী অবাক হয়ে গেলো। তিনি প্রমাণ করে দিলেন রাগ নয়, উদরতা হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে কর্যকরী ঔষুধ। আপনিও সংসারের শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমার দিকে একটু উদার হোন ম্যাডাম, প্লীজ, আমার উৎপাত দেখে গোস্সা না করে-জীবে দয়া করুন!

রেবা বুঝতে পারছে না তার মেজাজ কি গরম হচ্ছে না নরম হচ্ছে। ইনামের অদ্ভুত আচরণে যারপরনাই সে বিরক্ত। কীসের সাথে কী ঢুকিয়ে দেয়, কথার কোনো আগামাথা পাওয়া যায় না। ক্ষেপে গেলেও ইনাম এমন সব শিশুসূলভ আচরণ শুরু করে দেয়, খুব মায়া হয় তখন। লোকটার পেটে আসলেই কোনো প্যাঁচগোছ নেই। সরলসোজা। কিন্তু-কী ইনাম, কী হয়ে গেলো হঠাৎ! রেবা বিস্মিত হয়। খুব ভালো নজরুল গাইতো লোকটা। সংগীতপাগল মানুষটা কেন যে হঠাৎ সাংস্কৃতিক জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো, বিদঘুটে জগতে গিয়ে মাথা ঠুকলো, বিষয়টা বোধগম্য নয়। অথচ রেবা তার গান শুনেই প্রেমে পড়েছিলো। কী ঘটলো হঠাৎ ইনামের জীবনে? মানুষটা তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না-কারণ কী? রেবার মাথায় ঢোকে না কিছু।

নিজেকে ইনামের পাঁজর থেকে ছাড়িয়ে নেয় সে। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়, ইনামের মুখের দিকে তাকায়, পলকহীন তাকিয়ে থাকে। ইনামের চোখ দুটো টলমল করছে। চিকচিক করছে পানি। কিন্তু মুখে কী চমৎকার হাসি! আজব তো, একজন মানুষের চেহারায় একই মুহূর্তে বিপরীতমুখো দুটি অনভূতি কাজ করে কীভাবে? কণ্ঠ কোমল করে রেবা।

-তোমার কী হয়েছে ইনাম? আজকাল কেমন করছে যে।

-কই, না তো, কিছু হইনি তো।

চমকে ওঠে ইনাম।

-তুমি স্বাভাবিক নও। কিছু একটা তো হয়েছে বৈকি। আজকাল কথা লুকোবার বেশ পটু হয়ে গেছো দেখছি।

-তোমার কাছে কথা লুকোবো আমি! তুমি দেবে সে সুযোগ?

রেবা তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আচমকা শব্দ করে কেঁদে ওঠে।

-তোমার কিছু একটা হয়েছে ইনাম। তুমি স্বাভাবিক নও। বলো, অফিসে কিছু হয়নি তো?

ইনাম বিস্মিত, বিব্রত এবং স্তম্ভিত। কিছুকাল তাকে বুকে সেঁধিয়ে রাখে। শরীরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। কণ্ঠে আদর মিশিয়ে ডাকে।

-রেবা?

-বলো।

-বিজলির কথা মনে আছে?

-থাকবে না কেন? আমার যে বড়দি! কখনও মনেই হয়নি জেঠুর মেয়ে। খুব আদর কতো আমাকে।

-বিজলি মেয়ে হিসেবে কেমন ছিলো রে...?

-অনেক ভালো ছিলো। দিদির মতো মানুষ আমি আজও দেখিনি। কী সুন্দর গায়কি! কী চমৎকার চেহারা! আমাকে তো দিদিই গান শেখালো। সারগাম শিখতে গিয়ে কতো বকা যে খেয়েছি তার! তাল কেটে গেলে চোখ রাঙিয়ে উঠতো। কিন্তু সেখানেও ছিলো অকৃত্রিম মায়া, দারুণ ¯েœহ। আচ্ছা, তুমি হঠাৎ দিদির কথা তুললে কেন?

রেবা বিস্মিত হয় এবং নিজেকে একটু আলাগা করে নিয়ে ইনামের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ফেলে। ইনাম সাধারণ ভাবেই উত্তর দেয়।

-না, এমনি। পাঁচ বছর হয় বিজলি মারা গেছে। তার কথা প্রায় সবাই ভুলে গেছে। গানের ক্লাসে বিজলিকে মনে হতো বাচ্চাশিশু। চলাচলতি দেখলে মনে হতো কিছুই জানে না। কিন্তু মঞ্চে দাঁড়ালে এক জাদুমাখা সুরের সম্মোহনী শক্তিতে সবাইকে মায়াজালে আটকে দিতো সে। এই বিস্ময়কর প্রতিভার অকালযাত্রা, চিতায় ওঠা-সত্যিই বেদনাদায়ক।

-হ্যাঁ, বিজলিদি আমাদের সঙ্গেও খুব সাধারণ আচরণ করতো, চলাফেরায়ও ছিলো না দম্ভ। এতো যে প্রতিভা, কখনও আচার-আচরণে প্রকাশ পায়নি। অথচ জেলাপ্রশসানের উচ্চপদীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে, শিক্ষকরাও তার প্রতিভায় ছিলেন মুগ্ধ! সুরের মূর্ছনায় যে কোনো পরিবেশ শীতল করে দিতে পারতো দিদি, বিমোহিত করে রাখতো সবাইকে।

-বিজলির শেষ দিনগুলো কেমন ছিলো বলতে পারো?

-একটা বছর তো বিছানায় গড়ালো। কতো যে কষ্ট! গানও গাইতে পারতো না শেষদিকে। যুবতী একটা মেয়ে কতক্ষণ বিছানায় লেপ্টে থাকতে পারে? বিছানার এক কোণে পড়ে থাকতো তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র সেতার। সারাক্ষণ সেতারের দিকে তাকিয়ে থাকতো দিদি। প্যালপ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো আর চোখের পানি ফেলতো। উঠে বসতেও পারতো না, শরীর কাঁপতো। কথা বলতে গেলে গলা কাঁপতো। আমরা কাছে গেলে কী যে খুশি হতো!

-তুমি মাঝেমধ্যে যেতে, তাই না?

-মাঝেমধ্যে কী, প্রতিদিনই তো দিদির খোঁজ নিতাম। বলতে গেলে আমরা প্রায় সমবয়েসি ছিলাম। দিদি খুব ভালোবাসতো আমাকে। ভালোবাসতো বলেই চুপিসারে একদিন ডেকে নিয়ে বলেছিলো, রেবা রে...এ যাত্রায় যদি সেরে না উঠি, আমি যদি মরেই যাই, আমার সেতারটা তুই ‘কণ্ঠজোয়ার সংগীত বিদ্যালয়’-এ দিয়ে আসিস বোন। দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করিস কিন্তু। কেউ দিতে না চাইলেও জোর করে হলেও দিয়ে আসিস। বলবি যে বিজলিদি মরার আগে স্কুলে দান করে গেছে এটা। কণ্ঠজোয়ারে আমার প্রিয় একজন মানুষ থাকে রে...। একা একা বিছানায় পড়ে কাতরাই, জীবদ্দশায় কেউ মনে না রাখলেও, বন্ধুরা সেতারটি দেখে দেখে অন্তত মৃত্যুর পর আমাকে মনে রাখবে। তারপর কী যে কান্না! আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

-তাই!

-হুম!

-প্রিয় মানুষটা কে ছিলো রে...?

-জানি না, দিদিকে জিজ্ঞেস করিনি। শরীরের অবস্থা দেখে করার সাহসও পাইনি। শুধু মৃত্যুর পর জেঠুর কাছে বলে সেতারটা দিয়ে এসেছি ‘কণ্ঠজোয়ার সংগীত বিদ্যালয়’ ভবনে। গুরুজিকে বলেছি মৃত্যুকালে দিদি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে দান করে গেছে সেতারটা। গুরুজি দিদিকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন, খুব আফসোস করেছিলেন। সেতারটা বুকে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

-সেতারটা খুব সুন্দর তাই না? বেশ সুর ওঠে...?

-হ্যাঁ। গানের স্কুলে গেলে দিদির সেতারের দিকে চোখ পড়লে খুব মন খারাপ হতো। বুকটা কেঁপে উঠতো। মনে পড়ে যেতো দিদিকে। দিদির রোগামুখটাই বেশি ভেসে ওঠতো চোখে। খুব কান্না পেতো তখন। গানটা তো ছেড়ে দিয়েছি সেকারণেই। ফরিদা পারভীনের ‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম’ গানটা একবার কলেজের নবীন বরণে গেয়েছিলো রয়া মিত্র। আমার যে কী কান্না পেয়েছিলো তখন! দিদির কথা খুব মনে পড়ে গিয়েছিলো। কলেজে আমার আচরণে সবাই থ হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।

-তুমিও খুব ভালো গাইতে। কত চমৎকার গায়েন ছিলে তুমি। বিজলির চেয়ে তোমার প্রতিভা কোনো অংশে কম ছিলো না। মনে আছে? শিল্পকলায় মিতালী মুখার্জীর-‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ রঙের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’ তোমার কণ্ঠে গানটা শোনার পর ক্রাশ খেয়ে গিয়েছিলাম? যেঁচে গিয়ে কথা বলেছিলাম? বিজলি তখন মাত্র শয্যাশায়ী হয়, অনুষ্ঠানে তার আরোগ্য কামনায় প্রার্থনা চেয়েছিলেন গুরুজি।

-হুম। দিদিও বলতো আমাকে দিয়ে ভালো গান হবে। কিন্তু কী করবো বলো, সবার কপালে তো সবকিছু থাকে না। আচ্ছা ইনাম, তুমি তো অসাধারণ নজরুল গাইতে। রবীন্দ্রও চমৎকারভাবে কণ্ঠে তুলতে, কিন্তু সংগীতচর্চাটা ছেড়ে দিলে কেন? কবছর হয় মঞ্চে দেখি না তোমাকে। তোমার তো পিছুটান ছিলো না। আমি কিন্তু তোমার গানের ভক্তই ছিলাম। ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরান প্রিয়’ নজরুলগীতিটা তোমার কণ্ঠে শোনার পর পাগল হয়ে গিয়েছিলাম-এখনও মনে আছে। বিসমিল্লাহ খানের সানাইও আমাকে এতো বেশি মুগ্ধ করতে পারেনি। কেন ছাড়লে গানটা?

-জানি না।

-আজব তো। নিজের সম্পর্কে নিজেই জানো না?

-মানুষ কিন্তু নিজেকেই সবার শেষে চেনে। অন্যকে চেনায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে নিজেকে চিনতে ভুলে যায় মানুষ। যখন চেনে-তখন হয় শ্মশানে, না হয় গোরস্তানে।

-কেমন? 

-পৃথিবীর সব প্রশ্নে উত্তর অন্যের কাছে আশা করাটা এক ধরনের অলসতা। নিজেকে ঝেটিয়ে দেখো, হয়তো পেয়ে যাবে।

-তোমার সঙ্গে আর পারলাম না। ধর্ম ছাড়লাম, পরিবার ছাড়লাম, তোমাকে ছাড়তে পারলাম না। বুঝতেও পারলাম না।

-ধর্ম কি সত্যিসত্যিই ছাড়তে পেরেছো? মানুষ কি চাইলেই ধর্র্ম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে? এক ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে ঢোকে মানুষ কিন্তু তাতে কি খুব বেশি লাভ হয়? ধর্মেরও কি বিন্দুমাত্র লাভ ক্ষতি হয় তাতে? আর পরিবার ছাড়লে কোথায়, আজও তো দেখি মায়ের জন্যে খুব কাঁদলে। এখনও তো তলে তলে সিদ্ধিদাতা গণেশের কাছেই আশ্রয় খোঁজো বিপদের আশঙ্কা দেখলে।

-তুমি কি বলতে চাও আমি তোমার জন্যে কিচ্ছুটি করিনি? কিচ্ছুটি ছাড়িনি?

-এমন কথা কখন বললাম?

-এই যে বললে, মায়ের জন্যে কাঁদি, এখনও যোগাযোগ রাখি; তলে তলে ধর্মকর্মও পালন করি।

-এটা তোমাকে ছোট করার জন্যে বলিনি। বলেছি, মানুষ আসলে চাইলেও অনেক কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, প্রকৃতি তাকে দেয় না। তুমি হিন্দু, বিয়ে করলে মুসলিম-তাই বলে কি মা-দুর্গার প্রতি অশ্রদ্ধা এসেছে? ভক্তি কমেছে সীতার প্রতি? বরং দুটি ধর্মের মধ্যে তুলনা, প্রতিতুলনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কখনও এটা বড় মনে হয়, কখনও ওটা বড় মনে হয়। আসলে সবগুলোই সমান। মানুষ কখনো এই সমান পজিশনে আসতে পারে না কিংবা আসতে চায়ও না। ধর্মের আবেগে মানুষ কমল দাশগুপ্ত নাম বদলিয়ে বড়জোর কামালউদ্দিন হতে পারে, এর বাইরে যাবার সাধ্যি যে কারো নাই।

-তোমার সক্রেটিসীয় বুলি আপাতত ক্ষেমা দেও। চলো, কোথাও বের হই। অনেকদিন যাওয়া হয় না কোথাও।

-তুমি ঘুরে আসো। আমার বেরুতে মন চাইছে না। মনটা খচখচ করছে কেবল।

-কেন, কী হয়েছে?

-কিচ্ছু না। আচ্ছা, গয়াতে কি বিজলির পি-দান হয়ে গেছে? শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী হিন্দুধর্মের মৃতব্যক্তির পিণ্ডদানে তো গয়াতে পাঠাতে হয়।

-সেটা তো সে-বছরই পাঠানো হয়েছে।

-ওরে দাহ করলো কোথায়?

-শ্মশানে। কেন, তুমি কি মহাশ্মশান চেনো না?

-চিনব না কেন, আসলে মৃত্যুর পর ওকে এতো দ্রুত পুড়িয়ে ফেলা হয় যে, কাউকে জানানোও প্রয়োজন মনে করেনি পরিবার। ওর যে দুচারজন ভক্ত-শুভার্থী থাকতে পারে সে খেয়াল রাখেনি কেউ? খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। কারণ, তারা একটি সাধারণ মৃহদেহ দাহ করেনি। একজন শিল্পীর দেহ শ্মশানে তুলেছিলো।

-দিদি বছরখানেক বিছানায় গড়িয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছে, পরিবারও কষ্ট সয়েছে খুব। তাই মৃত্যুর পর আর ঝামেলা বাড়ায়নি। তাড়াতাড়ি কাষ্ঠ করে স্বস্তি পেয়েছে সবাই। বেঁচে থাকতে কত যে কষ্ট পেয়েছে দিদি-চোখের পানি ঝরেছে সবার। হয়তো সেকারণে ঝামেলা বাড়ায়নি কেউ।

-ও..তাই! তাহলে, মৃত্যুও কখনও কখনও মানুষকে স্বস্তি দেয়, আপনজনদের মুক্তি দেয়!

-হতে পারে।

-আচ্ছা, রেবা, আমাদের দুজনের সম্পর্কটা তো তখন নতুন গড়লো, বিজলি কি জানতো আমাদের ডুবে ডুবে জলে খাওয়ার কথা? কখনও বলছো ওকে?

-আরে না, বলিনি। হিন্দু-মুসলিম প্রেম-সম্পর্কের কথা তো ইচ্ছে করলেই বলে বেড়ানো যায় না। তবে দিদি বোধহয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলো আমার চলাচলতিতে। প্রায়শ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি লজ্জা পেতাম, দ্রুত সটকে পড়তাম তখন। ইনাম, আমি ঠিক বুঝলাম না, দিদিকে নিয়ে হঠাৎ এতো দরদ উত্থলে উঠলো কেন তোমার।

-কারণ বিজলি মরেনি! আমি বিজলিকে দেখেছি গতকাল, তার গানও শুনেছি। তাই...

-মানে! তুমি কী পাগল হয়ে গেছো?

-সত্যি বলছি বিজলি বেঁচে আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি তাকে। তার গান আমি নিজের কানে শুনেছি।

-তোমার মাথায় সমস্যা আছে ইনাম। উল্টাপাল্টা বই পড়তে গিয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলছো। বিজলিদির ছাই-ভষ্মও পৃথিবীতে নেই। মৃত্যুর পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো, তুমি কিনা বলো বেঁচে আছে সে! তোমার যে কী হলো আজকাল। ও...তোমার তো আবার গ্রীক দেবতা জানুসের মতো সামনে-পিছে চোখ পিট করা। এসব খোয়াবি-ধান্ধা দেখাই স্বাভাবিক। 

রেবার খোঁচামারা কথায় সে বিচলিত হয়নি। খুব আবেগে ডুবে যায়। জল চিকচিক করে ওঠে চোখ। কম্পমান ঠোঁট কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা।

-একটুও মিথ্যে বলছি না রেবা। বিজলিকে আমি সত্যিসত্যিই দেখেছি। বিশ্বাস করো, সেদিন রাতে ‘কণ্ঠজোয়ার’ ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিলাম বাসায়। গভীর রাত, বাতাসটা বেশ মোলায়েম লাগছিলো। কোথাও কেউ নেই-খুব উপভোগ্য একটা পরিবেশ। ঘোর অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ কানে বেজে উঠলো সেতারের সুর। আমি চমকে উঠলাম। এতো রাতে সেতার বাজায় কে? প্রথমে ভাবলাম ওস্তাদজি বোধহয় রেওয়াজ করছেন কিন্তু সুরটা খুব পরিচিত ঠেকলো। বছর ছয়েক আগে এমন সুর আমি আরো একবার শুনেছি। ছুটে গেলাম। দরোজা জানালা বন্ধ। বাইরের ভাঙা চেয়ারে পা রেখে ভেন্টিলেটর দিয়ে তাকালাম, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম! চেয়ে দেখি-বসে আছে বিজলি, হাতে সেতার! ভেতরে ধবধবে আলোর ফোয়ারা বইছে। বিদ্যা-দেবী সরস্বতীর মতো দারুণ ভঙ্গিমায় বসে আছে সে; কী যে চমৎকার দেখতে! সাদা পোশাক পরতে আগে-পরে কখন দেখিনি তাকে। এই প্রথম দেখলাম, অনেক মানিয়েছে পোশাকটা। তার প্রিয় গোলাপি রঙের শাড়িটার চেয়েও বেশি মানিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দিকে তার খেয়াল নেই, এক মনে সেতার বাজিয়ে চলেছে, বাজনা শুনে মনে হয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ খুরশিদ খান ও রবিশঙ্করের হাতেও সেতার এতটা সুরের নান্দনিকতা পায়নি।

রেবা কিছুটা বিরক্ত, বিব্রত এবং কৌতূহলি। নিথর হয়ে গেলো পরিবেশ। চেহারায় অপার বিস্ময়। সন্দিগ্ধ এবং মৃদুকণ্ঠে সুধায়:

-তারপর?

-মুগ্ধ হয়ে তার সেতারের সুর শুনলাম। বাজানো শেষে অদৃশ্য হাতের করতালি পড়লো। কে বা কারা করতালি দিলো দেখা গেলো না। হলভর্তি মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। আমি গভীরদৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। একটুক্ষণ পর চমৎকার একটি গান ধরলো সে। দ্বিতালের। ১৯৪৪-এর দিকে সারা ভারতবর্ষজুড়ে যখন দুর্ভিক্ষের হাহাকার আর বিপন্ন মানবতা-ঐ প্রেক্ষাপটের ওপর কমল দাশগুপ্ত ও যূথিকা রায়ের যৌথ পরিবেশনায় গাওয়া কাহারবা ও দাদরা তালের বিখ্যাত সেই গানটি কণ্ঠে তুললো বিজলি। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বিজলি বিজলি-বলে চিৎকার দিতে চাইলাম, কণ্ঠ থেকে শব্দ বেরুলো না। হাততালি দেবো? সে শক্তিও নাই, হাত ওপরে তুলতে পারলাম না। অদ্ভুত আড়ষ্টতা আমাকে চেপে ধরলো। ‘আমার বলার কিছু ছিলো না, না না গো, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে, আমার বলার কিছু ছিলো না’ শ্রীমতি হৈমন্তী শুক্লার গানটা এখনও কানে বাজে। কী চমৎকারভাবে গাইলো বিজলি! গাইতে গাইতেই ভেঙে পড়লো যেন। ওর চোখে এতো জল কোত্থেকে যে এলো! অনুষ্ঠান শেষ হলো। হলরুমের সব বাতি নিভে গেলো। একমুহূর্তে কে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি চুপিসারে বাসায় চলে এলাম। তোমাকে বলার সাহস পেলাম না। জানি, তুমি বিশ্বাস করবে না।

রেবা চমকে উঠলো। ‘আমার বলার কিছু ছিলো না’-হৈমন্তী শুক্লার গানের কথা বলায় রেবা অবিশ্বাস করতে পারলো না। মৃত্যুর আগে গানটা প্রায়ই গাইতো বিজলিদি। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে খুব দরদ ঢেলে গাইতো। রেবা বিলাপ করে ওঠলো।

-তুমি কী বলছো এসব? কী বলছো ইনাম!

-আমি সত্যি বলছি রেবা। কাল রাতেও আমি বিজলির গান শুনেছি। নজরুলগীতি করলো সে। ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’-গানটা তুললো অসাধারণভাবে! রবীন্দ্রনাথের ‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’ গেয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে হলরুম ত্যাগ করলো। দূর থেকে আমি কেবল কাঁদতেই পারি, ডাক-চিৎকার করতে পারি না; হাততালিও দিতে পারি না। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। অনুভূতি জাগে কিন্তু শক্তি আসে না শরীরে। গান শেষে ধপ করে বাতি নিভে যায়। কে কোথায় যায়, জানি না। কবরখোলার মতো ভয়ংকর নিস্তব্ধতা নেমে আসে চর্তুপাশে। ভয়ে শরীর নিশপিশ করে। ভারাক্রান্ত মনে বাড়ির দিকে ছুটি।

রেবা শিউরে ওঠে, জড়িয়ে ধরে ইনামকে। বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে। হারানো দিদির মুখটা মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। কতো যে আদর করতো দিদি। তাকে গান শেখানোর কতো যে আগ্রহ ছিলো তার। এতো অসাধারণ একটি প্রতিভা অতি অল্পদিনেই নিভে গেলো! নিজ হাতে দিদি তাকে হারমোনিয়াম বাজানো শিখিয়েছে। শখ ছিলো অডিশন দিয়ে বড় জায়গায় যাবে কিন্তু হঠাৎই কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো সবকিছু। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, ডিএল রায়, অতুল ও রজনী কান্ত সবকিছু দিদির নখদর্পণে ছিলো। কী যে অসাধারণ কণ্ঠ ছিলো তার! লালনকে যে কতটা নান্দনিকভাবে কণ্ঠে তুলতে পারতো-না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’-দিদির মতো দরদমাখা সুরে আজও কারো মুখে শোনা হয়নি এসব গান। রাধারমণ থেকে হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম থেকে শচীন দেববর্মণ-কী তার কণ্ঠস্থ ছিলো না? বেঁচে থাকলে কতো বড় মাপের যে শিল্পী হতো বিজলিদি, চিন্তাও করা যায় না। রেবা চোখ মোছে এবং ইনামের হাত টেনে মাথায় তুলে নেয়।

-আমার মাথা খাও, কসম করে বলো কোনোদিন আর ওখানে যাবে না? তোমার আশায় আমি জাতধর্ম, পরিবার-পরিজন ছেড়েছি। তোমার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো ইনাম। তুমি কণ্ঠজোয়ার ভবনে গেলে আমার মরা মুখ দেখবে।

ইনাম আঁৎকে ওঠে। এ কী কা-!

-কী বলো রেবা। ধুর বোকা, এতো ভয় পাচ্ছো কেন?

-যাওয়ার যদি এতোই শখ থাকে, তবে আমাকে জবাই করে বিছানায় রেখে যেও।

রেবাকে কাছে টেনে নেয় ইনাম। তোমার কথার বাইরে কীভাবে যাই বলো? আমার জন্যে কতো কিছু ছাড়লে, সামান্য একটা বিষয় আমি ছাড়তে পারবো না? ঠিক আছে যাবো না। চলো, ক্ষুধা পেয়েছে। পেটে তুলতে হবে কিছু। তোমার সঙ্গে ঝগড়ার মজাটাই দিলে নষ্ট করে। ধ্যাৎ-।

রাতে ইনামের ঘুম হয় না ভালো। জেগে থাকে সারাক্ষণ। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে বিজলির মুখ। ঘোরের মধ্যে দেখতে পায়-হলরুমের মঞ্চে দেবী সরস্বতীর মতো বসে আছে বিজলি, চারাপাশে দিনের মতো চকচকে আলো। বিজলির উজ্জ্বল দেহের আলোকছটায় গোটা হলরুম প্রখরিত এবং মুখরিত। কিন্তু বাইরে ভীষণ অন্ধকার। আপন মনে সেতারে সুর তুলছে সে। তার হাতের স্পর্শে চনমনে হয়ে নেচে উঠেছে সেতারের এক-একটি তার। সুরের স্বর্গীয় আবেশে তন্ময় আছে সমস্ত পৃথিবী। আহা! কী নিদারুণ সুরে কণ্ঠে তুলেছে নজরুলগীতি ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়...’

রেবা বিছানা ছেড়ে দরোজার সামনে মাদুর পেতে ঘুমায়। ইনাম যেন রাতে কোথাও বেরুতে না পারে, বের হলেও যেন তাকে মাড়িয়ে যেতে হয়-মুখ্যত সে কারণেই এই কঠোরতা। ইনাম একটু পরপর বিছানা ছেড়ে ওঠে। বাতি জানালায়, রেবার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকায়, মন খারাপ হয়। আহা বেচারী! ভালোবেসে কিছুই পেলো না জীবনে, তারপরও কতো টান! কীভাবে গুটিশুটি হয়ে পড়ে আছে শীতকম্প বিছানায়। মায়া হয়। উঠে এসে কপালে চুমো কাটে। ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে রেবা। আবার বিছানায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ে ইনাম। ঘুমোনোর চেষ্টা করে। শেষ রাতের দিকে একটু একটু চোখ লেগে আসে। এছাড়া, সারাক্ষণ মনটা কেবল খচখচ করে, অজানা একটা উচাটন পেয়ে বসে। বাহির তাকে প্রবল টানে।-ধুর, কেন যে রেবাকে বলতে গেলাম? ছাই, এখন মজাটাই মাটি।

কয়েক রাত পার হয়। রেবা পাহারায় থাকে। চোখে চোখে রাখে। সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ঢুকতে বাধ্য করে তাকে। অল্পদিনে স্বাভাবিক হয়ে যায় সবকিছু। ইনামের ঘুমেও বিশেষ ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় না। রেবাকে বিছানায় এসে শুতে বলে। কোথাও যাবে না সে। তারপরও মেঝেতে ঘুমোনোর দরকার নেই। অসুখবিসুখ করতে পারে। সাপখোপ এসে কাটতে পারে। রেবা শোনে না। বেঁকে বসে এবং ঘুমিয়ে পড়ে ওখানেই। কনকনে শীতে কাঁপে, কাশে, হাঁচি দেয় কিন্তু দরোজার নাগাল ছাড়ে না।

একরাতে ঘুম কেটে গেলে ইনাম তাকিয়ে দেখে রেবা দরোজার কাছে নেই! কেবল রেবার কাপড়-চোপড়গুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে মেঝেতে। বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগে। উৎকণ্ঠিত হয়ে রেবার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে। সাড়াশব্দ পায় না। অজানা শঙ্কায় কুঁকড়ে গেলো বুক। রেবা কোথায় গেলো এতো রাতে! তার গায়ের কাপড়গুলো এভাবে পড়ে আছে কেন? খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয় সে। হদিস মিলে না। ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে পড়ে। মনের অজান্তে ‘কণ্ঠজোয়ার’ সংগীত বিদ্যালয়ের দিকে পা বাড়ায়।

আশ্চর্য, কোনো গানের সুর কিংবা সেতারের আওয়াজ আজ সে শুনতে পেলো না। ভেতর থেকে কেমন খট খট একটা ভাংচুরের শব্দ ভেসে এলো কানে। প্রবল ইচ্ছে জাগলেও রেবাকে দেয়া কথা রাখতে ভেতরে প্রবেশ করেনি সে। বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। কিন্তু দূর থেকে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে থমকে দাঁড়ায়।

একটা মানবছায়া ধীরে ধীরে কণ্ঠজোয়ার ভবন থেকে বেরিয়ে আসলো। কে সে? চাদরে নিচে লম্বমান মোটাসোটা ওটা কী? নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো ইনাম। বড় গাছটার সঙ্গে লেপ্টে থাকে কতক্ষণ। ছায়াটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, সমান্তরাল গতিতে পেছনের দিকে সরে যেতে থাকলো সে। কে এই লোক? নারী, না পুরুষ? আর হাতে ওটা কী? দূর অন্ধকারে অনুমান করা যায় না। একসময় পৌর নর্দমার কাছে এসে ছায়াটা থামে। চাদরের তল থেকে কিছু একটা বের করে আনে। ল্যাম্পোস্টের তীব্র আলোয় চিকচিক করে উঠে জিনিসটা। সফেদ আলোয় জিনিসটা শনাক্ত করতে পেরে ইনামের গলা শুকিয়ে আসে। মুহূর্তের মধ্যে নোংরা জলাশয়ের দিকে ছুঁড়ে মারে জিনিসটা। এ সময় তার আঙুলের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে টোং টোং করে জীবনের অন্তিম আর্তনাদটুকু করে উঠলো বস্তুটা। তারপর অতল জলে তলিয়ে গেলো। হয়তো এক গাদা অভিমান নিয়ে কচুরি ফেনার পেটে লুকিয়ে পড়েছে সে। এ সময় একটা চিকা চিক-চিক করতে করতে পাশ কাটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ইনাম ঘোরের ধূম্রজালে আটকা পড়ে গেলো এবং চেয়ে দেখলো, ছুঁড়ে ফেলা বস্তুটা অশরীরির মতো জলাশয় থেকে উঠে এসে ছায়ারূপী মানুষটার দেহের ভেতরে টুক করে ঢুকে পড়লো, লোকটা যেন টেরই পেলো না। ততক্ষণে লোকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামান্য চোখের পানি ফেললো, তারপর সামনে হাঁটা ধরলো।

ইনাম সংবিত ফিরে পেলো এবং চকচকে আলোয় লক্ষ করলো, তারই কোট-প্যান্ট পরে লোকটা ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে, চুলগুলো বেশ লম্বা, চেহারাটাও অচেনা নয়। জুতোজোড়াও অনেক দিনের চেনা। দ্রুত ছুট দিলো সে। অন্য পথে ঘরে ফিরলো, হন্তদন্তÍ হয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো।

কিছুকাল বাদে ঘরে ঢুকলো রেবা। জামা-কাপড় বদলে নিলো। তারপর দরোজা-লাগোয়া বিছানা গুটিয়ে ইনামের পাশে এসে শুয়ে পড়লো এবং পরম উষ্ণতায় ইনামকে জড়িয়ে ধরলো। ইনামের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো আদিম আবেশে। অসুরশক্তি নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো রেবার গায়ে। কম্পমান হাত রেবার বুকের ওপর পড়লো, উদ্ভট উটের পিঠের মতো উঁচু-উঁচুু মাংসের জমিনটুকু সমতল বানিয়ে আবাদ করার হিংস্র প্রয়াসে লিপ্ত হলো সে এবং ক্রমশ সর্বাঙ্গ মর্দন করতে করতে অস্ফুট গোঙানির মতো আওয়াজ তুলে বলতে লাগলো-প্রিয়তমা বিজলি, তোমার রেখে যাওয়া সেতারখানি আজ এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হয়েছে। এখন থেকে দিনরাত আমি তাকে বাজাবো। মনের আনন্দে বাজাবো। সুখে-দুঃখে বাজাবো। তোমার শূন্যতাকে পূর্ণতায় ভরিয়ে তুলবো।

ইনামের হাত ও ঠোঁট ধীরে ধীরে রেবার বুক বেয়ে নীচের দিকে নামতে লাগলো, একসময় যোনিপথে এসে থমকে দাঁড়ালো, সেতারের তারের মতো কি যেন একটা টং করে বেজে ওঠলো রেবার যৌনাঙ্গে। বিস্ফারিত চোখ ফেলে সে তাকিয়ে দেখলো, রেবার প্রজননপথে বসে আসে বিজলি! হাতে নেই প্রাণপ্রিয় সেতার! চকিত-বিস্ময়ে শুনতে পেলো সে, রেবার যোনিদেশে বসে বিজলি খলখলিয়ে হাসছে আর বলছে,-তোমার সেতারখানি আজ তোমাকেই ফিরিয়ে দিলাম প্রিয়তম ইনাম। এবার যতো পারো বাজাও। ওটা তো তুমিই একদিন উপহার দিয়েছিলে কোনো এক দুর্গাপূজায়!

বিজলির কথা শেষ না হতেই সাপের মতো মোড়িয়ে উঠলো রেবা, যোনিপথে ইনামের মাথা সজোরে চেপে ধরলো সে এবং দুই পা বাঁকিয়ে ইনামের পিঠ পেঁচিয়ে ধরে, রমণতৃপ্তিতে শীৎকার করতে লাগলো!



অলংকরণঃ তাইফ আদনান