জলধি
/ গল্প
/ বালক
বালক
ছেলেটা নাছোড়বান্দা টাইপের। কিছুতেই পিছু ছাড়তে চায় না। কিন্তু খুব চুপচাপ। যাকে বলে মহা চুপচাপ।
বকা দেয়, রহমত। সেই কমান্ডার। সাতটা প্রশ্ন করলে একটা কথার জবাব দেয়। দূর্বাঘাসের ডগা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে। বকা দিতে গিয়েও বকা দিতে পারে না। বকা দিতে গেলেই চোখ তুলে তাকায়। ছোট্ট একটা ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রহমত। তার একটা ছেলে আছে ওর মত। ছয় সাত বছর বয়স। কাছ থেকে কখনো কী চেয়ে দেখেছে তার চোখটা। রহমতের ছেলের নাম আরিফুল। আরিফুল মানে কী? ওর দাদা নাম দিয়েছিলো। ঘরে ফিরতে পারলে বাবাকে জিগ্যেস করবে সে। ছেলেটাকে কতদিন দেখেনি সে। চেহারাটাকে চোখে ভাসানোর চেষ্টা করে। কোনো কিছু চায়না সে। বাড়ি ফিরলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ছাড়তে চায়না। বুকে মায়া জাগানো চেহারা। খুব দেখতে ইচ্ছে করে রহমতের।
'জঙ্গলের মধ্যে আমাদের আস্তানা তুমি চিনলে কী করে?',
রহমত জিগ্যেস করে ছেলেটাকে।
'তোমাদের পিছ পিছ আসছি',নির্বিকারভাবে জবাব দেয়।
'বাড়ী কোন গাঁয়?'
ছেলেটা আঙুল তুলে একদিকে বলবো, 'ঐই খানে'
ছেলেটাকে বেশী প্রশ্রয় দিতে চায় না রহমত। নিরাপদ জায়গা না এটা। যেকোনো সময় গোলগুলি, পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। যুদ্ধের মাঠ মায়া দেখানোর জায়গা না। মুখের চেহারা পাল্টে ফেলে রহমত। হাতের কব্জি টা নেড়ে বার কয়েক বল বললো, যাও, 'বাড়িতে যাও। এখানে তোমার কোনো কাজ নাই।'
বকা দেয়, রহমত। সেই কমান্ডার। সাতটা প্রশ্ন করলে একটা কথার জবাব দেয়। দূর্বাঘাসের ডগা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে। বকা দিতে গিয়েও বকা দিতে পারে না। বকা দিতে গেলেই চোখ তুলে তাকায়। ছোট্ট একটা ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রহমত। তার একটা ছেলে আছে ওর মত। ছয় সাত বছর বয়স। কাছ থেকে কখনো কী চেয়ে দেখেছে তার চোখটা। রহমতের ছেলের নাম আরিফুল। আরিফুল মানে কী? ওর দাদা নাম দিয়েছিলো। ঘরে ফিরতে পারলে বাবাকে জিগ্যেস করবে সে। ছেলেটাকে কতদিন দেখেনি সে। চেহারাটাকে চোখে ভাসানোর চেষ্টা করে। কোনো কিছু চায়না সে। বাড়ি ফিরলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ছাড়তে চায়না। বুকে মায়া জাগানো চেহারা। খুব দেখতে ইচ্ছে করে রহমতের।
'জঙ্গলের মধ্যে আমাদের আস্তানা তুমি চিনলে কী করে?',
রহমত জিগ্যেস করে ছেলেটাকে।
'তোমাদের পিছ পিছ আসছি',নির্বিকারভাবে জবাব দেয়।
'বাড়ী কোন গাঁয়?'
ছেলেটা আঙুল তুলে একদিকে বলবো, 'ঐই খানে'
ছেলেটাকে বেশী প্রশ্রয় দিতে চায় না রহমত। নিরাপদ জায়গা না এটা। যেকোনো সময় গোলগুলি, পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। যুদ্ধের মাঠ মায়া দেখানোর জায়গা না। মুখের চেহারা পাল্টে ফেলে রহমত। হাতের কব্জি টা নেড়ে বার কয়েক বল বললো, যাও, 'বাড়িতে যাও। এখানে তোমার কোনো কাজ নাই।'
কথা শুনে সে। ঘনটা খানেক পর আবার উদয় হয় সে। হাতে এলুমিনিয়ামের জগ। পানি ভরা। হাতে গ্লাস। ঠাণ্ডা পানি। টিউবওয়েলের। রহমত আর তার সেনারা পানি খায় এক এক করে গ্লাসে ঢেলে। পাশে রাইফেল রাখা। ফিতের মতো গুলি। ছুঁয়ে দেখে সে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে জায়গাটা। রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো এখানে। বাঁকড়ার স্কুলে পাকিস্তানী সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে। কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে বাজার। বাজারে টহল দিচ্ছে তারা। বাজারের দোকান পাট সব বন্ধ পাকিস্তানী সেনাদের ভয়ে। যাকে ইচ্ছা ধরে আনছে। হাত পা বেঁধে। কথা বের করার জন্য মারধোর করে। আটকে রাখে।
রহমতদের হাতে এসেছে নতুন অস্ত্র স্টেনগান। তাদের শক্তিও যেন বেড়ে গেছে তাতে। মেশিনটার দিকে একনজরে চেয়ে থাকে ছেলেটা।
রহমতের বাহিনী পাকিস্তানীর স্কুলের ক্যাম্প আক্রমণের ছক আটে। সবাইকে বুঝিয়ে দিলো দায়িত্ব। আজ রাতে শুরু হবে অপারেশন।
ছেলেটা দৌড়ে আসে। হাপাতে থাকে। কোনরকমে বললো, আর্মি আসে!
ততক্ষণে তারাও আর্মির গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। মাটির রাস্তা। ধুলো উড়িয়ে তারা আসছে। রহমত বুঝতে পারলো চারদিক দিয়ে তাদের আস্তানা ঘেরাও হয়ে গেছে।
কোনো ভাবে পাকিস্তানী বাহিনী জেনে গেছে তাদের অবস্থানের কথা। তারাও অস্ত্র তাক করে অবস্থান নেয় তারা। তারা শিখেছে যুদ্ধ মানে সব সময় প্রস্তুত থাকা।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো ছোট্ট ছেলেটা। তাকে নিয়ে সে কী করবে? গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে সে নির্ঘাত প্রাণ হারাবে। কোন ঘরের ছেলে! কে তার বাবা! কে তার মা! কিছুই জানা হলো না।
রহমত তার হাত ধরে টেনে হেঁচড়ে একটা শুকনো খানার বসিয়ে রেখে বললো, আমি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে নড়বে না। একদম না। মনে থাকবে?
ছেলেটা মাথা ঝাঁকালো। মনে থাকবে। খুব খুশী সে। ভয় নেই তার কোনো। একটা যুদ্ধ দেখবে সে। এতোদিন লাঠির খেলনা বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছে। আসল যুদ্ধ দেখবে।
চারদিক ঘেরাও করে পাকিস্তানীরা গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে সব গুলি গুলো ছুটে যাচ্ছে। রহমতরাও পাল্টা গুলি ছুড়ছে। পাকিস্তানীরা
আগাতে পারছেনা। রহমতদের হাতে যে স্টেনগান আছে এটা তারা বুঝতে পারিনি। সাত্তারের হাতে স্টেনগান। সাথে আছে বাবুল।
ছেলেটা খানার মধ্যে উঠে দাড়ায়। চারদিকে কী হচ্ছে দেখতে ইচ্ছে করছে তার। বর্ষায় খানাটা পানিতে ডুবে থাকে। গায়ের ছেলেরা পানি কমে এলে সেচে শোল মাছ ধরে। বড় বড় শোল মাছ। সবাই বলে বুড়ির বাগান। বুড়ির কবর আছে এখানে। খানার পাশে বাঁশ বাগান। শুকনো পাতার ঢিবি একপাশে। পাশে ঝাড়ু। মনে হচ্ছে কেউ পাতা এক জায়গায় জামা করে রেখে গেছে। মাথার উপর দিয়ে গুলি চলে গেল তার। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল সে শুকনো পাতার ঢিবির উপর। কনুই ছিলে গেলো তার। শক্ত কী এর নিচে! লতা পাতা সরালো। এতো ফিতার মতো গুলি!
বাবুল ইশারায় বুঝালো। তাদের স্টেনগানের গুলি দরকার। গুলি শেষ।
রহমত চিৎকার করে বললো, সাত্তারের গুলি শেষ। গলায় মালার মতো গুলির ফিতা ঝুলিয়ে ছেলেটা দৌড় দিলো সাত্তারের দিকে। গলা থেকে ঝপ করে ফেললো মাটিতে, এই নাও গুলি। আরো আছে, নিয়ে আসি!
সাত্তার বললো, পাগল তুই!
মাটিতে তাকে এক হাতে চেপে শুইয়ে দিয়ে বললো, একটুও নড়বি না! মাথা উঁচু করবি না!
মাটিতে মিশে মাথা ঝাঁকিয়ে ছেলেটা বললো, ঠিক আছে।
গুলিগুলো মেশিনে ঢুকছে। বের হচ্ছে। খোলস গুলো পড়ে থাকছে। ভালই লাগছে দেখতে তার কাছে।
পাকিস্তানীদের কাছ থেকে আর কোনো জবাব আসছে না। খটকা লাগলো ছেলেটার কাছে। সে উঠে দাঁড়ালো। খুব কাছে কয়েকজন। হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো, আম গাছের আড়ালে একজন। বামে ঝোপের মধ্যে একজন। ডানে আগায় একজন। বলতে বলতে সব গুলো গুলি খেয়ে মাটিতে। ছেলেটা উল্লাসে লাফিয়ে ওঠে। সাত্তারের নাগালের বাইরে সে। হাত ইশারায় সে বললো, মাটিতে শুয়ে পড়। কাজ হলো না। চিৎকার করে বললো, শুয়ে পড়। তার কানে কিছুই ঢুকলো না। আনন্দ তার দেখে কে!
নীল হাফ প্যান্ট পড়া। গায়ে সাদা হাতা কাটা গেঞ্জি। একটা গুলি লাগলো ছেলেটার বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ডের উপর। রক্তমাখা শরীরটা নেতিয়ে পড়লো মাটিতে। চোখে ও মুখে কোনো কষ্টের ছাপ ছিলো না ছোট্ট মানুষটার। লেগে ছিলো আলো করা খুশির ঝিলিক। চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে জায়গাটা। রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো এখানে। বাঁকড়ার স্কুলে পাকিস্তানী সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে। কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে বাজার। বাজারে টহল দিচ্ছে তারা। বাজারের দোকান পাট সব বন্ধ পাকিস্তানী সেনাদের ভয়ে। যাকে ইচ্ছা ধরে আনছে। হাত পা বেঁধে। কথা বের করার জন্য মারধোর করে। আটকে রাখে।
রহমতদের হাতে এসেছে নতুন অস্ত্র স্টেনগান। তাদের শক্তিও যেন বেড়ে গেছে তাতে। মেশিনটার দিকে একনজরে চেয়ে থাকে ছেলেটা।
রহমতের বাহিনী পাকিস্তানীর স্কুলের ক্যাম্প আক্রমণের ছক আটে। সবাইকে বুঝিয়ে দিলো দায়িত্ব। আজ রাতে শুরু হবে অপারেশন।
ছেলেটা দৌড়ে আসে। হাপাতে থাকে। কোনরকমে বললো, আর্মি আসে!
ততক্ষণে তারাও আর্মির গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। মাটির রাস্তা। ধুলো উড়িয়ে তারা আসছে। রহমত বুঝতে পারলো চারদিক দিয়ে তাদের আস্তানা ঘেরাও হয়ে গেছে।
কোনো ভাবে পাকিস্তানী বাহিনী জেনে গেছে তাদের অবস্থানের কথা। তারাও অস্ত্র তাক করে অবস্থান নেয় তারা। তারা শিখেছে যুদ্ধ মানে সব সময় প্রস্তুত থাকা।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো ছোট্ট ছেলেটা। তাকে নিয়ে সে কী করবে? গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে সে নির্ঘাত প্রাণ হারাবে। কোন ঘরের ছেলে! কে তার বাবা! কে তার মা! কিছুই জানা হলো না।
রহমত তার হাত ধরে টেনে হেঁচড়ে একটা শুকনো খানার বসিয়ে রেখে বললো, আমি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে নড়বে না। একদম না। মনে থাকবে?
ছেলেটা মাথা ঝাঁকালো। মনে থাকবে। খুব খুশী সে। ভয় নেই তার কোনো। একটা যুদ্ধ দেখবে সে। এতোদিন লাঠির খেলনা বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছে। আসল যুদ্ধ দেখবে।
চারদিক ঘেরাও করে পাকিস্তানীরা গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে সব গুলি গুলো ছুটে যাচ্ছে। রহমতরাও পাল্টা গুলি ছুড়ছে। পাকিস্তানীরা
আগাতে পারছেনা। রহমতদের হাতে যে স্টেনগান আছে এটা তারা বুঝতে পারিনি। সাত্তারের হাতে স্টেনগান। সাথে আছে বাবুল।
ছেলেটা খানার মধ্যে উঠে দাড়ায়। চারদিকে কী হচ্ছে দেখতে ইচ্ছে করছে তার। বর্ষায় খানাটা পানিতে ডুবে থাকে। গায়ের ছেলেরা পানি কমে এলে সেচে শোল মাছ ধরে। বড় বড় শোল মাছ। সবাই বলে বুড়ির বাগান। বুড়ির কবর আছে এখানে। খানার পাশে বাঁশ বাগান। শুকনো পাতার ঢিবি একপাশে। পাশে ঝাড়ু। মনে হচ্ছে কেউ পাতা এক জায়গায় জামা করে রেখে গেছে। মাথার উপর দিয়ে গুলি চলে গেল তার। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল সে শুকনো পাতার ঢিবির উপর। কনুই ছিলে গেলো তার। শক্ত কী এর নিচে! লতা পাতা সরালো। এতো ফিতার মতো গুলি!
বাবুল ইশারায় বুঝালো। তাদের স্টেনগানের গুলি দরকার। গুলি শেষ।
রহমত চিৎকার করে বললো, সাত্তারের গুলি শেষ। গলায় মালার মতো গুলির ফিতা ঝুলিয়ে ছেলেটা দৌড় দিলো সাত্তারের দিকে। গলা থেকে ঝপ করে ফেললো মাটিতে, এই নাও গুলি। আরো আছে, নিয়ে আসি!
সাত্তার বললো, পাগল তুই!
মাটিতে তাকে এক হাতে চেপে শুইয়ে দিয়ে বললো, একটুও নড়বি না! মাথা উঁচু করবি না!
মাটিতে মিশে মাথা ঝাঁকিয়ে ছেলেটা বললো, ঠিক আছে।
গুলিগুলো মেশিনে ঢুকছে। বের হচ্ছে। খোলস গুলো পড়ে থাকছে। ভালই লাগছে দেখতে তার কাছে।
পাকিস্তানীদের কাছ থেকে আর কোনো জবাব আসছে না। খটকা লাগলো ছেলেটার কাছে। সে উঠে দাঁড়ালো। খুব কাছে কয়েকজন। হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো, আম গাছের আড়ালে একজন। বামে ঝোপের মধ্যে একজন। ডানে আগায় একজন। বলতে বলতে সব গুলো গুলি খেয়ে মাটিতে। ছেলেটা উল্লাসে লাফিয়ে ওঠে। সাত্তারের নাগালের বাইরে সে। হাত ইশারায় সে বললো, মাটিতে শুয়ে পড়। কাজ হলো না। চিৎকার করে বললো, শুয়ে পড়। তার কানে কিছুই ঢুকলো না। আনন্দ তার দেখে কে!
নীল হাফ প্যান্ট পড়া। গায়ে সাদা হাতা কাটা গেঞ্জি। একটা গুলি লাগলো ছেলেটার বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ডের উপর। রক্তমাখা শরীরটা নেতিয়ে পড়লো মাটিতে। চোখে ও মুখে কোনো কষ্টের ছাপ ছিলো না ছোট্ট মানুষটার। লেগে ছিলো আলো করা খুশির ঝিলিক। চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান