জলধি / গল্প / প্রথম সঙ্গম
Share:
প্রথম সঙ্গম

দুপুরে ইসাবেলার ফ্ল্যাটে গিয়ে ইসাবেলার সাথে গল্প করছিলো উর্মি। দুপুরের খাওয়াটাও তাই ইসাবেলার সাথে সারা হয়ে গেছে। ইসাবেলারও অনেক সময় ঊর্মির বাসায় ঢুকে অমনটি হয়।

দুই নিকটতম প্রতিবেশী যোগ দুই বান্ধবী ঊর্মি ও ইসাবেলা অবশেষে বিছানায় গড়াগড়ি করছিলো। এর ভেতর ঊর্মির এক দেবর মোবাইল ফোনে বললো, তোমাদের রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছি! রিসিপশন থেকে তোমাকে ইন্টারকমে কল দিয়ে যাচ্ছে। তুমি ধরছো না। আবার এরা বলছে তোমাকে বাইরে যেতে দেখেনি!’

ঊর্মি বললো, আমি ইসাবেলার ফ্ল্যাটে এসেছি। তুমি এসো। আমি বাসায় যাচ্ছি!

ঊর্মি ইসাবেলার ফ্ল্যাট যাওয়ার সময় ওর সর্ব কনিষ্ঠ দেবর পাপ্পুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। ভাইয়ের বাসায় বাহুল্য জিনিসের মতো পড়ে থাকা ছাড়া যার আর কোনো কাজ নেই। ঊর্মি স্বগোক্তি করলো, দুপুরবেলা নির্জন বাসা। ছেলেমেয়েরা স্কুলে। এর ভেতর চাচাতো দেবর। কেমন জানি লাগে!

ইসাবেলা বললো, বাব্বা, এই বয়সে এসে তোর এতো শিহরণ?

: তুই আমার শিহরণের কী দেখলি? শোন, রাস্তা থেকে যে গাড়ি নিয়ে অক্ষত অবস্থায় ঘরে ঢুকিস, সেটা খালি তোর ড্রাইভার ভালো গাড়ি চালায় সবসময়ই সে জন্য নয়! অন্য গাড়িগুলো তোর গাড়ির ওপর না উঠে ছেড়ে দেয় বলে।

: এই উদাহরণ দিয়ে কী বোঝালি?

: একটা পুরুষমানুষ আসবে ঘরে। অন্য কেউ বাসায় নেই, তাই পাপ্পুকে নিয়ে যাচ্ছি। দুজন নারী-পুরুষের ভেতর আরেকজন থাকলে নিজের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য লাগে।

: নোমান তোর নিজের দেবর হলেও অবিশ্বাস করতি?

: কম করতাম!

: তাহলে যারা এসব মানে না, তাদেরকে তুই অবিশ্বাস করিস?

: বিশ্বাস করার দরকার হলে তবেই না অবিশ্বাস?’

ঊর্মির এই কথাটা ইসাবেলার একটু লাগলো। কিন্তু ঊর্মির মনে হয়নি সে বাহুল্য কিছু বলছে। সে তাই স্বাভাবিক ভাবে বললো, একটু চিনি দে তো! ঘরে চিনি নেই। আর দরজাটা খোলা রাখিস চা করে তোর জন্যও পাঠাবো!

একটি ছয়তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় ওদের মুখোমুখি ফ্ল্যাট। বাড়িটিতে লিফট নেই। ঊর্মি দরজার লক খুলতে খুলতে নোমান চলে এসেছে। সবাই একসাথে ঘরে ঢুকলো। পাপ্পুর হাতে চিনি দেখে নোমান বললো, কী এমন ঘটিয়েছো ভাবি, যে মিষ্টি মুখ করানোর জন্য চিনি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছো?

ঊর্মি বললো, চিনি ফুরিয়ে গেছে। ইসাবেলার ঘর থেকে তোমার জন্য চিনি নিয়ে এলাম!’ বলেই পাপ্পুকে ঊর্মি বললো, যা তো ভাই, চা টা তুই বানা। আমার চায়ের থেকে তোর চা ভালো হয়। আমি দেখি আমার দেবর কী পয়গাম নিয়ে বউ রেখে একা এসেছে!

আমি রাতে ধারে কাছেই ছিলাম। সারারাত ঘুমাইনি। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে এই উঠে এলাম। সন্ধ্যা থেকে অফিস। আবার তোমার বাসার কাছেই ফিরতে হবে। লিলি বললো, বড় ভাইয়ের বাসায় দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে ওখান থেকে অফিসে যেও। দেখলাম বুদ্ধিটা বউ মন্দ দেয়নি!

: ভালো করেছো, এইটুকু সময়ের জন্য আবার মিরপুর যেতে…!

: তোমার বন্ধু ইসাবেলাকেও ডাকো, একসাথে গল্প করি! অনেকদিন দেখা হয় না। সেই যে আমাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলে…।

: ফোন করি!’ বলে ঊর্মি ইসাবেলাকে বললো, নোমান তোকে আসতে বলছে!

ইসাবেলা পানসে কণ্ঠে বললো, না রে তুই যাওয়ার পর আবার শুয়ে পড়েছি! চোখ লেগে এসেছে!’ ঊর্মি সংক্ষেপে ইসাবেলার না আসার খবরটা নোমানকে জানিয়ে দিলো। 

ইসাবেলা ও উর্মির সাথে বন্ধুত্ব ওই পাশাপাশি ফ্ল্যাট কেনার সূত্রে। মনে মনে তাদের মিল কতটা তা নিজেরাও জানে না। কিন্তু পুরো ভবনের মানুষ জানে পাঁচতলার দুই ফ্ল্যাটের দুই মহিলার দারুণ ভাব। একজনের প্রয়োজনে আরেকজন সব সময় সাথে থাকে!

ঊর্মি আর নোমান সমবয়সী। স্কুল-কলেজে একই সাথে লেখাপড়া করেছে। দু’জনের আচরণ দেবর-ভাবি সম্পর্রকের চেয়ে বন্ধুর মতোই বেশি। নোমান সাংবাদিকতা করে। সাথে লেখালেখিরও সামান্য অভ্যাস আছে। তবে যা লেখে প্রথম শ্রেণির হয়।

খবরের কাগজে চাকরি করার দরুণ নোমানের এমন সময়ে-অসময়ে হুটহাট করে তার এই চলে আসাটা নতুন নয়। ঊর্মি বা ওর স্বামী কামরানেরও এটা গা সওয়া। এতে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ ঊর্মি তার বিয়ের পরেও দেখেছে তাদের একান্নবর্তী পরিবার।

ঊর্মি নোমানকে বললো, তুমি কোনদিক থেকে এলে? ভাত খাবে কি না, জানতে চাইলাম না। এখনো তো দুপুর শেষ হয়নি…।

: তাই তো আমি ভাবছি, আমি এসেই ভাত খাবো। তা  বলেছিও তোমাকে। দেখছি খেয়াল করোনি! না হয় দুপুরটা একটু পড়ে এসেছে। আমার কথা না শুনে একেবারে চা করতে পাঠিয়ে দিলে!

: চা করতে পাঠিয়েছি তো কি! আমি ভাত বাড়ছি! পাপ্পু, চুলো নিবিয়ে দে ভাই!

: তুমি না বললে তুমি পাশের বাসা থেকে খেয়ে এসেছো! রান্নাকরা আছে?

: আছে, আছে! রান্না না করেই গেছি নাকি! রান্নাবান্না সেরেই গিয়েছিলাম। ইসাবেলা না খাইয়ে ছাড়লো না! তাই শোওয়া পর্যন্ত গড়ালো।

: ছাড়লো না, না কি তুমি না খেয়ে এলে না!

অই হলো। নাও তুমি শুরু করো। পাপ্পু, তোকে তো আমি খেতে দেখিনি! তুইও বস্!

পাপ্পু বললো, আমি দুইবার নাস্তা করছিলাম, তাই দেরি করে খাবো ভেবে খাইনি!

: ঠিকাছে, তোর দেরি এতক্ষণে পুরে গেছে। নোমানের সাথে এখন খা!

নোমানের সাথে পাপ্পুকেও ঊর্মি খাবার বেড়ে দিতে দিতে নোমানের দিকে তাকিয়ে বললো, হোটেলে কেন থাকতে হলো বললে না তো?

: বন্ধুরা মিলে তিনতারা হোটেলে এক ভিন্নধর্মী টপিক নিয়ে গল্প হয়েছে।

: যে টপিক নিয়েই গল্প করো, কারো বাড়ির ড্রয়িংরুমের ঢালা বিছানায় গল্প করা যেতো না! ইশ্ গল্প করার জন্য কতগুলো টাকা খরচ হলো!

: আরে টাকা কি আর আমাদের মতো ছাপোষা লেখক-সাংবাদিক কেউ দিয়েছে নাকি?

: তাহলে?

: টাকাওয়ালা কতজন কবি হতে চায়। লেখক হতে চায়। তাই আসল কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের দলে ভেড়ার জন্য তারা গাড়ি ভাড়া করে দলবেঁধে ভ্রমণ করতে নেয়। মদ খাওয়ায়।

: গতরাতেও সেরকম টোপ ছিলো?

: টোপ মানে, মহাটোপ!

: তো তোমাদের গল্পের টপিক কি ধরাবাঁধা ছিলো?

: বলতে পারো!

: কী সেটা বলো তো!

: তোমাকে বলা যাবে না! শেষে দাদাভাইকে বলে দেবে! শেষে তার সামনেই আর আসতে পারেবা না!

: আরে না!

: কথা দিচ্ছো!

: দিচ্ছি!

: প্রথম সঙ্গম!

ঊর্মি থতমত খেয়ে নোমানের দিকে তাকিয়ে তারপর পাপ্পুর দিকে তাকালো। নোমানকে বোঝালো, ওর সামনে কথাটা বলা ঠিক হয়নি!

কিন্তু ঊর্মির চোখের ইশারা এত তরিৎ ঘটে গেছে পাপ্পু তা খেয়াল করার সুযোগ পায়নি। সে খাবারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ভাতে মাখানো পাতলা ডাল চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলো। এর ভেতর নোমানের কথা শুনে মাথা না তুলেই খিকখিক করে হেসে বললো, ‘প্রথম সঙ্গম…! আমার এক মামা নতুন বিয়া হইর‌রা আনছেলে। সেই মামার গঞ্জে দোহান আছেলে। এহনও আছে। মামায় সপ্তায় একদিন  বাড়িত্ আইতে। পরদিন সকালে চইললা যাইতে। সপ্তাহর ছয়দিন মামা দোহানেই থাকতে। আর মোরা ছোডরা, বেবাকতে মামীর দারে ঘুমাইতে চাইতাম। মোর এহনো মোনে আছে, মোগো বাড়ি আর মামা গো বাড়ি তো কাছে, মানে আমার মা’য় আর বাবা’য় আছেলে চাচাতো বাইবুইন। হেইডা তো ঊর্মি আফায় মোর বাবির দারে শোনছেনই। একদিন মামী হরলে কী, সকালে আমারে গুমেরতন টাইন্যা ল্যাঙডা কইররা হ্যার নেজেন ওপর উডাইয়া লইছে। ওরে আল্লারে মামীর বেতরে বেমালা গরম। শেষে আমি দিছি মুইত্যা…! সেই গডনা জেবনেও বুলবার মতো না। ওইরোম আর জেবনেও ঠ্যাহেনাই…। নতুন মামীর গাও দিয়া বুরবুরইরা কসকো সাবানের সুবাস বাইর অইতে। হের লাইগ্যা বেবাকতে মোরা মামীর ধার ঘেইষ্ষা শুইতে চাইতাম…। মামী ছোডবেলা আমাগো গল্প যে শোনাইতে, হাসদে হাসদে আমাগো প্যাট ফাইট্টা মরণের দশা অইতে!’ কথাগুলো বলতে বলতে পাপ্পুর খাওয়া পুরোদস্তুর শেষ হয়ে গেলো। সে প্লেট নিয়ে সিঙ্কে চলে গেলো। নতুন করে চায়ের কথা আর তাকে বলতে হলো না। অবদমিত অবস্থার ভেতর থেকেও ঊর্মি আওয়াজ শুনে টের পাচ্ছে পাপ্পু চা বানাচ্ছে। কিন্তু পাপ্পু খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গেলেও ঊর্মি, নোমান আর কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। নোমান খালি বললো, ওরে বাবা, গতরাতে জনা দশেকের যা গল্প শুনলাম এ বিষয়ে, তোমার পাপ্পুর গল্প সবাইকে হার মানিয়েছে!

 : তোমার দোষ। তোমাকে কে বলেছিলো ওর সামনে এসব কথা তুলতে?’ ফুঁসে উঠে কথাগুলো বলে উর্মি।

: যা বাবা, আমি বললাম কই? তিনবার মেট্টিক ফেল করা একটা ছেলের সামনে এটুকু বলতে পারা জায়েজ আছে! আর আমি তো খালি টপিকটা বলেছি তোমাকে। তাই বলে আর বলতাম নাকি!

: আসলে তোমরা যারা সাংবাদিকতা করো, লেখালেখি করো, তোমরা সবাইকে নিজের সমান বয়স মনে করো!

: আসলেই তো তাই! একটা বয়সের পর থেকে সবার বয়সই এক! 

একসময় চা নিয়ে আসে পাপ্পু। ঊর্মি তাকে বলে তোর চা নিয়ে তুই বাসায় যা। তোর ভাবির জন্য বানিয়েছিলি তো?

: হ, আপনে বাবিরে কথা দিয়া আইছেন, সেইডা আপনে ভোললেও মুই কি ভুলি!

: ঠিকাছে! যা।

: তাইলে আমার আর আপনেরে পাহারা দেওনের কাম নাই! তাইলে কি নোমান ভাইয়ারে কইয়া দিমু কী কইছিলেন?

: তোর বলতে হবে না। তুই যা। আমি বলবোনে। ইসাবেলা খুব গরম চা ছাড়া খায় না!’ বলে পাপ্পুকে ঠেলে পাঠিয়ে দরজাটা খোলা রেখে একটা ডাইনিং চেয়ার টেনে দরজা ঠেক দিয়ে রাখলো যেন বাতাসে দরজা ঠাস করে লেগে না যায়। নোমান বললো, তুমি দরজা খোলা রাখলে যে!

: দরজা খোলা না থাকলে ওপাশ থেকে বাতাস আসবে না।

: মানুষ দেখবে যে দেবর-ভাবি দরজা খোলা রেখে গল্প করছি!

: দেবর-ভাবির দরজা বন্ধ করে গল্প করছি তা দেখার চেয়ে খোলা রেখে গল্প করছি সেটাই মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাক!

: পাপ্পু কী বলে গেল, কী বলছিলে আমার বিরুদ্ধে?

: ওকে বলছিলাম, আয় তো আমার সাথে। ভর দুপুরে নির্জন বাড়িতে দেবর আসছেন। তাও চাচাতো দেবর…।’

: তুমি চাচাতো দেবর ভাবো? আমি-আমরা কিন্তু তোমাকে আপন ভাবি-ই ভাবি!

: আমি চাাচাতোই ভাবি! কেন চাচাতো কি পর? কামরানের আপন ভাইদের  জন্য যে ফিলিং তোমাদের জন্য অন্যরকম। কিন্তু তার মূল্যও কম নয়!

: যাকগে, তো যার পাহারায় থাকতে তাকে ডেকে আনলে, দেখলে তো তিনি কত বড় ডাকাত?

: হু। কিন্তু সে তখন শেষ কথা কী বলেছে, তা শোনোনি?

: বলেছে ‘পরে আর ওরকম হয়নি’! তার মানে মামীর পরও ঘটনা আছে!

পাপ্পু সম্পর্কে নোমানকে ঊর্মির নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। নোমান সব জানে। ইসাবেলার নিজের বাড়ি খুলনা। শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। ইসাবেলার শাশুড়ি মারা গেলে শ্বশুর একেবারে বৃদ্ধ বয়সে জোয়ান বিধবা চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। সেই স্ত্রী’র গর্ভে পাপ্পুর জন্ম। ইসাবেলার শ্বশুর সম্পত্তি যা রেখে গেছেন, তা দিয়ে বেশ আয়েশেই ছেলেকে নিয়ে চলতেন ছোট শাশুড়ি। কিন্তু তিন তিনবার তার ছেলে এসএসসি ফেল করার পর স্বামীর বড় ছেলেকে অনুনয় করে সে শাশুড়ি বললেন, তোমরা যদি ওকে শাসন না করো, মানুষ না করো তাহলে তো ও মানুষ হবে না। তোমাদেরও বদনাম হবে…।’

কিন্তু ইসাবেলা এই উটকো ঝামেলা তখনো পছন্দ করে উঠতে পারেনি দেখে তাকে এক টেবিলে খাবারও দিতো না। কৌশলে হেরফের করতো। আর এটা বুঝেই ঊর্মি কাজের ছলে, মানে দোকান থেকে এটা ওটা আনার ছলে ওকে ডেকে এনে শুধু খাবারই নয়, তাকে সমবেদনার কথা বলে ভার কমিয়ে দিতো! একদিন তো প্রশ্রয় পেয়ে বিরাট গল্প ঝেড়ে ফেলেছিলো। বলছিলো, ঊর্মি আপা, কন দেহি, বাপের বয়সী বড়বাই মোরে খামাখা লইয়া আইছে। কিছু কইতেও পারি না। মোরে দিয়া কি আর রেহাপড়া অইবে কন দেহি! ওদিকে বাবি একদিন বাইয়ারে কইছে, ওয়ারে কোনো দোকানে থাকতে দাও!’ দোকানে দাও মানে কি? মুই কর্মচারিগিরি করুম? মুই তো দ্যাশে দোকানের মালিকই অইতে পারি! বাইয়ারে তো মুই কইতে পারি না, আপনেরা আমারে অভিনয় করার সুযোগ হইররা দ্যান! দোকান যত বড়ই অউক, মাইনষে দোকানদার কইবে। কিন্ত অভিনয় করলে আপাতত টাকাপয়সা না পাইলেও মানুষে তো মোরে অভিনেতা হিসাবে চেনবো! আমি ইদানীং শুইয়া শুইয়া খালি বাবি, মুই অভিনয় হরতাছি…!’ পাপ্পু তার কাছে মন খুলে কথা বলাতে সেদিন থেকেই ওর মাতৃহৃদয় ওর জন্য আরো বিগলিত হয়ে উঠেছিলো। সারাদিন ইসাবেলার শ্যেন দৃষ্টিতে ছেলেটি যখন ঝলসে থাকতো, ঊর্মি যেন পাপ্পুর জন্য এক ঝলক সুবাতাস হয়ে ঢুকতো ইসাবেলার ঘরে!

সেদিন পাপ্পুর কথাগুলোই নতুন করে নোমানকে ঊর্মি বলছিলো। নোমান বললো, তাই নাকি? ছেলেটি এমন ভাবে? অভিনেতা হতে চায়? তবে ও পারবে কিন্তু। কারণ গ্রামের অবারিত খোলা জায়গায় মানুষ হয়েছে। মায়ের অস্বাভাবিক প্রশ্রয়ে মানুষ হয়েছে। তারপর শেষ শিক্ষাটা তাকে ইসাবেলা দিয়েছে। এবার সে সুযোগ পেলে অভিনয়টা পারবে। দেখি আমি চেষ্টা করে।

: তবে দেখো ভালো কারো হাতে ছাড়া ওকে তুলে দিও না। নাহলে ওই একই ঘটনার সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া কাজের কাজ দেখো কিছু হবে না। শেষে আমার নিজেকে দায়ি মনে হবে!

 ঊর্মির ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে এসে পড়েছে। জ্যাম ঠেলে তাদের বাবার ফিরতে ফিরতে রাত হবে জানে ঊর্মি। সে নোমানকে বললো, তুমি বাবলুর ঘরে গিয়ে একটু চোখ বন্ধ করো। সন্ধ্যায় চা খেয়ে বের হয়ো!

: এই কথাটি আগে বলতে পারেতে তো! তাহলে এখানে ঝিমুতে ঝিমুতে বেহুদা সোফায় বসে বকর বকর করতে হতো না!

: না, আগে বলতে পারতাম না! আমার ছেলেমেয়ে, আমার স্বামী বাসায় ফিরে দেখবে খালি একটা বাড়িতে আমরা দুটি প্রাণি…। মানে ছেলেমেয়ে দেখবে তাদের মা আর চাচা…।

: তুমি যদি দেখো, ভাইয়া আরেক ভাবির বাড়িতে…।’ : : সেটাও খুব ভালো হয় না। এখন ছেলেমেয়ে বাসায় ফিরেছে এবার তুমি ভেতরবাড়িতে ঢুকতে পারো। আর এমনিতেও পারতে। তখন তোমাকে রেখে আমি বাহানা করে ইসাবেলার বাসায় চলে যেতাম। কিন্তু আজ তো সে পরিবেশ ছিলো না! আজকে তো  ওই হারামজাদা পাপ্পু আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে! ও এতো খারাপ…।

: এভাবে বলতে পারো না ওটা ঘটে গেছে বলে। ও অবস্থার শিকার। আর ও যদি না বলতো? এর থেকে কত মারত্মক ঘটনা মানুষের জীবনে থাকে, খালি অন্য কেউ না জনলেই সে ভদ্রলোক।

: তাহলে বুঝতেই পারছো, ওই ঘটনা ঘটানোর পরিবেশটা কখনো ঘন হয়ে উঠতে দিতে নেই! তাই দিনভর কতজন দেখে গেলো দরজা খোলা রেখে দেবর-ভাবি গল্প করে একবেলা পার করে দিলো!

:  আজ দিনের এইটকু সময় আমি বাকি জীবনে ভুলবো না। অথচ আমাদের বাড়ির মানুষ তোমার সন্ধান পেয়েছিলো আমার সূত্রে! তা ভাবতেও আমার ভালো লাগে ।

: ভাগ্যিস তোমার বোন রুনুর বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিলে। আর আমরাও হুড়মুড়িয়ে বিয়ে গায়ে হলুদ বৌভাত কোনোটা ছাড়িনি। তবে একটা ক্ষতি যে করেছো, তা তো বলিনি!

: কী সেটা?

: তোমার মতো ইউনিভার্সিটিতে আর পড়া হলো না। এক ছাপোষা, কলমপেষা অফিসারের বউ হয়ে লিফট ছাড়া একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এই মগবাজারের মগী হয়ে জীবন কাটবে বোঝা যাচ্ছে!

: কথা মিথ্যে নয় যদিও। তবে সেদিন একদিক দিয়ে এক মেয়েকে বের করে দু’মাস না যেতে আরেক মেয়েকে, মানে তোমাতে বাড়ি তুলেতে পেরেছিলো। কিন্তু তোমাকে কিন্তু আমার অতো পছন্দ ছিলো না!

: এমা তাই? তো ভাঙানি লাগাওনি কেন? আর কাকে তোমার পছন্দ ছিলো তা বলো?

: বলবো? না থাক, তুমি এই পৌঢ় বয়সে সব রহস্য একাকার করে দেবে!

: তাতেও যদি হৃদয়ে আমাদের একটু বাড়তি রং এসে লাগে…।

: লীমাকে!

: মাই গড! ওর সাথে কোনদিন আমার ভালো কাটেনি!

: তোমার তো কাটাতে হতো না…। তুমি তখন কোথায় না কোথায় থাকতে!

: সে ঠিক কথা! কিন্তু তুমি নিজের জন্য লীমাকে বলোনি কেন?

: বলেছিলাম!

: পাত্তা পাওনি? তাহলে যাও, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকো আর তার কথা ভাবো গে!

: ‘অন্তরে যার না পাই নাগাল/ বাহিরেতে জেগে রয় সে!’ ওকে ভালো লাগতো। ও প্রেমও বুঝতো। কিন্তু বিরহ দিতে পারে নাই…। পরে মনে হলো, যাকে চাই  সে লীমা নয়।

: ও তোমাদের পুরুষের ধর্ম ! যাও তো বিশ্রাম নাও গে। আমি ছেলেমেয়ে দুটোকে খাবার দিই!

: তোমাকে আজ আমি নতুন করে চিনলাম…।

: কী, আমি ভালো মানুষ নই?

: ভালো এবং মন্দের ঊর্ধ্বে কিছু একটা। আগে তো এভাবে আসিনি। তাই বুঝতে পারিনি তুমি আমাদের…, আমাকে অন্তত কী ভাবো! আজ স্পষ্ট হলো বিষয়টি।

 : দেখো নোমান, আমরা এভাবেই বড় হয়েছি আসলে।

: না না ভাবি, মন্দ বলি সে সাহস আমার নেই। তুমিই ঠিকাছো!

: সবকিছুই সবসময় সবার কাছে ঠিক লাগে না। তাই অনেক সময় অনেককিছু ভাললাগাতে আমরা যা করি, তা ঠিক করি না। যাও, এবার বিশ্রাম করোগে।’ বলে ঊর্মি নিজের কাজে চলে যায়।      



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন