জলধি / গল্প / পথের মায়া
Share:
পথের মায়া

দীর্ঘ ছুটি শেষ। ভেবেছিলাম সন্ধ্যার দিকে বেনাপোলগামী প্রথম বাসে চড়ব। যথাসময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বরিশাল পৌঁছেছিলামও। কিন্তু বাসে উঠতেই কি যে হল বলতে পারিনা; গা গুলিয়ে বমি আসে, চোখে অন্ধকার দেখি। শীতের মধ্যেও ঘামতে থাকি। শেষ পর্যন্ত সোয়েটার খুলে ব্যাগের মধ্যে ঢুকাই।

এমনটা তো কখনো হয়না ! আজ কি হল জানিনা। বাসের সুপারভাইজারকে ডেকে বলতেই ওরা হাত ধরে রেস্ট হাউজে এনে শুইয়ে দেয়। আর সাথে সাথে ঘুম। কতক্ষণে ঘুমিয়েছি জানিনা। কিন্তু মানুষের কোলাহলে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেশ রাত আর শীতে গায়ে কাঁপুনি ধরেছে। উঠে বসতেই বাস কাউন্টারের লোক দৌড়ে আসে- স্যার, এখন কেমন বোধ করছেন ?

-ভাল। কিন্তু আমার ব্যাগ?

-কোথায় ছিল ?

-গাড়ির লাগেজ বক্সে।

-স্যার গাড়ি তো আরো দুই ঘন্টা আগে ছেড়ে গেছে। তবে দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আমাদের একই মালিকের পরিবহন। বেনাপোল পৌঁছে আপনি পেয়ে যাবেন। আমরা ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।

-কিন্তু আমার সব শীত পোষাক যে ওই ব্যাগে।

-অসুবিধা হবে না স্যার। জানালা দরজা বন্ধ করে দিলে গাড়ির ভিতর ঠান্ডা লাগবে না। আর আমাদের এসি বাসের শিডিউল ছিল তিরিশ মিনিট আগে।

-ঠিক আছে। কপালে যা আছে হবে। এক বোতল জল আর কিছু হালকা খাবার নিয়ে এসো।

গাড়িতে উঠে মনে হল বাইরের তুলনায় লেপের মধ্যেই ঢুকেছি। নিশ্চিন্তে আরামে সীটে গা এলিয়ে দিই। গাড়ি ছাড়তেই অডিও সিস্টেমে মিষ্টি সুরে পুরানো দিনের হিন্দি গান বেজে ওঠে। শুনতে শুনতে আবার কখন যেন ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই।

হঠাৎ কন্ডাক্টরের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়- সামনে শিকারপুর ব্রীজ। এখানে আধাঘন্টা গাড়ি দাড়াঁবে। আপনারা ইচ্ছে করলে রাতের খাবার এখানে খেতে পারেন। আধো ঘুমের মধ্যে বেশ লাগছিল। ভাবলাম, খাবারটা খেয়ে এককাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে আসি। চোখ খুলতে ভূত দেখার মত চমকে উঠি। ঘটনার আকস্মিকতায় মনে হল ধ্বক্ করে হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে যাবে। আমার পাশের সীটে দেবযানী বসা।

যুগান্তরের অতীত একলাফে সামনে এসে দাঁড়ায়। দেবযানীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎকার খুব কাব্যিক ছিল। আমার সেদিন মনে হত- ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটা উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যবোধের শিকার। নিজেদের মধ্যেও এটা প্রায়ই প্রকাশ পেত। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ছিল অনার্স করে আসা। আমরা খানেক ছিলাম পাস কোর্সের প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ। অর্নাস পাসেরা প্রিলিম্যানারি পাসদের অবজ্ঞার চোখে দেখত। দুদলের মধ্যে বন্ধুত্বও হত না। অনার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ছিল দেবযানীর। শুধু ইংরেজী বিভাগের নয়, কলেজের যে কোন যুবক তার স্বপ্নে বিভোর ছিল। আর কিছুনা হোক হীরের দ্যূতিময় একটুকরা হাসি উপহার পেলে জীবন ধন্য যেত যে কারো।

 আমিও দূর থেকে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি আর মনে মনে ভেবেছি- মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে ? স্রষ্টা কি বিশেষ যত্নে এদের গড়েছেন ? স্বপ্নে-কল্পনায় দেবযানী এসেছে বারে বারে। কিন্তু অন্য গ্রহের মানুষের মত লাগত তাকে। তার জন্য আমার কখনো কোন অস্থিরতা ছিল না। কারণ আমি স্থির-নিশ্চিত ছিলাম- আমার মত জড়ভরতের পক্ষে দেবযানীর ভালবাসা প্রাপ্তি অসঙ্গত, অন্যায়।

লাল রঙের একটা ফিয়াট চড়ে ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে যখন নামত সকলের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জেগে উঠত। আমার কেন যেন মনে হত- দেবযানী যেমন অলৌকিক সুন্দর তেমনি ধনাঢ্য ঘরের সন্তান হলেও তার মধ্যে অন্য সবার থেকে বিনয় এবং সৌজন্যবোধ বেশি।

আমার একটা নিজস্ব জগত ছিল- পাঠাগারে পড়ে থাকাটা আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল। ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন সৌম্যদর্শন এক প্রফেসার। আমাকে বিভিন্ন সময় পাঠাগারে দেখে একদিন ডেকে পাঠান আর সেদিন আমায় স্নেহের বাঁধনে বেঁধে নেন। শ্রেণিকক্ষে আমার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ায় কারো কাছে সমীহ পেতাম আবার কারো বিষ নজর। ইতিমধ্যে সরস্বতী পূজা এসে গেল। আমার প্রিয় শিক্ষকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবৃত্তি এবং নাটক মঞ্চায়নের যাবতীয় দায়িত্ব আমার উপর বর্তায়।

পুজোর আগের দিন বিকেলে নাটকের মহড়া চলছে। এমন সময় দেবযানী আসে। তাকে দেখে যে যার মত সংলাপ ভুলে তোতলাতে থাকে। সেই মুহুর্তে আমার ভিতর বেশ অসহায়ত্ব আর অসিহষ্ণুতা জেগে ওঠে- পরশু নাটক। আর আজ যদি ঠিকমত রিহার্সেল না হয় তাহলে তোমরা এটা বন্ধ করে দাও।

কেউ কেউ আমতা আমতা করে প্রতিবাদের চেষ্টাও করে। কিন্তু সঙ্কোচে তাও জোরালো হয়না। দেবযানী এসে চুপটি করে এক কোণে বসে থাকে। মহড়া শেষ হলে বলে- আমাকে কিছুতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে ?

 ঠাট্টা করেছে মনে করে আমি বলি- হ্যাঁ দেব। আগামী বছর আমরা শেক্সপীয়ারের মার্চেন্ট অভ ভেনিস মঞ্চস্থ  করব। তোমাকে পোর্শিয়ার পার্ট দেব।

-আমরা সামনের বছর কেউ তো এখানে থাকব না। বছরই একটা কিছু দাও না !

 না, তার কন্ঠে ঠাট্টার তো কিছু নেই ! খুব আগ্রহসহকারেই তো সব কথা বলল ! আমি জিজ্ঞেস করি- তুমি কিসে অংশগ্রহণ করবে ? ব্যাগ থেকে একটা সঞ্চয়িতা বের করে বিদায় অভিশাপ কবিতার  কিছু অংশ আবৃত্তি করে শুনায়। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ, বিস্মিত। দেবযানী জিজ্ঞেস করে- আমি নিজে নিজে শিখেছি। এমনি করে বললে চলবে ?

-চলবে। কিন্তু কবিতায় তো দুজনের কন্ঠ লাগবে। আর কাকে নেবে ?

আবার সবার মধ্যে অস্থিরতা, আগ্রহের গুঞ্জনধ্বনি ওঠে। দেবযানীর পাশে তারই প্রেমিকের চরিত্রে আবৃত্তি করে কে না জীবন ধন্য করতে চায় ? অনেকেই এগিয়ে আসে আবৃত্তি করতে। কিন্তু দেবযানীই তাদের না বলে দেয়। অবশেষে বলে- তোমার কন্ঠ দারুণ মেলোডিয়াস। তুমিই আমায় একটু সঙ্গ দাও না !

আমার হৃদয়-বাগানের সব গোলাপ-কলিগুলো একত্রে রঙ্গীন পাপড়ি মেলে আর পৃথিবীর সব কোকিল এসে মনের বসন্তটাকে কলকাকলিতে মুখর করে তোলে। নিজেকে একটু সময় দিতে বলি- একবার একটু মহড়া দেওয়া দরকার। তুমি কাল  পূজার পরে এসোনা !

দেবযানী মাথা নেড়ে ধীর পায়ে গমন করে। সেদিন আর কিছুতেই মহড়া জমাতে পারলাম না। সবার মধ্যে এত অস্থিরতা কাজ করছিল যে নাটকে মনঃসংযোগ করতে পারছিল না। তাই সেদিনের মত ভঙ্গ দিয়ে বের হই।

গাঢ় কমলা রঙের একটা শাল জড়িয়ে দেবযানী অজস্র ফুলে ভরে ওঠা নাগলিঙ্গম গাছের গোড়ায় অপেক্ষা করছিল। গোধুলির আভা তার মুখে পড়ে এমন সৌন্দর্যের উদ্ভাস জাগিয়ে তুলেছিল যে স্থান কাল ভুলে আমি তার আয়ত চোখ, স্ফীত নাসারন্ধ্র, গোলাপি নিষ্পাপ ঠোঁটের প্রতিটি রেখা আবিষ্কারে মগ্ন ছিলাম। আজ বুঝি- যুবতীর ওষ্ঠ তার পবিত্রতার, সৌন্দর্যের সাক্ষ্য দেয়। শুধু অধরেই তার প্রেমের নিষ্ঠা, হৃদয়ের খবর বলে দেয় আমি বিমুগ্ধ, মোহিত, শরাহত হয়ে চেয়ে থাকি। দেবযানীকেও গাছে ঝুলে থাকা বর্ণিল নাগলিঙ্গম ফুলের মত লাগছিল। আমাকে সাদর আহ্বানে তার গাড়িতে তোলে। হাইওয়ে ধরে চলতে চলতে বলে- কাল তোমার সাথে পূজা দেব।  আমায় কি করতে হবে শিখিয়ে দাও।

-কাল পুজোয় অঞ্জলি দেবার পর ভাত খাবে, তাও নিরামিষ। আর সে পর্যন্ত উপবাস। লাল পেড়ে, কমলা সাদা রঙের সিল্কের শাড়ি পড়ে খোলা চুলে এসো। আর একদিন গাড়ি চড়ে না এলে কি তোমার কষ্ট হবে ?

দেবযানী পুজোর দিন সবাইকে চমকে দিয়ে একটা রিক্সায় এসে নামে। সেদিন মনে হয়েছিল যেন মূর্তিমতি দেবী সরস্বতী মন্দিরে প্রবেশ করছে। কিন্তু কী ! দেবযানী কি যেন  চিবুচ্ছে !

 -তোমার না উপবাস !

-হ্যাঁ কিচ্ছু খাইনি তো ?

-তোমার মুখে কি ?

- তাই বলো, খুব পিপাসা পেয়েছিল। একটা সুগার ফ্রী চুইংগাম চিবুচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই খাইনি। আমি সকালের খাবারে সাধারণতঃ তিরিশ-চল্লিশ টাকা খাই। আজ আসার পথে এক ভিক্ষুককে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিয়েছি।

আইডিয়াটা তো মন্দ নয়! সত্যিই, উপবাস সার্থক না হয়ে যায় না! আমরা যে সব কাজ করি প্রত্যেক কাজেরই একটা ব্যাখ্যা নিজের কাছে অন্ততঃ থাকা দরকার। তা না হলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

পরদিন অনুষ্ঠানে নাটকসহ সবকিছু নির্বিশেষে বিদায় অভিশাপ এর কচ-দেবযানী সবার নজর কাড়ে। যুবক-যুবতীর চোখে নাকি জল এসেছিল দেবযানীর আর্তি আর কচের নির্মম কর্তব্যপরায়ণতায়।

আমাদের কোর্স শেষ হয়ে এসেছিল। ফরম ফিল আপ-এর পর আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভিন্ন আঙ্গিকে এক রকম বিদায় অনুষ্ঠান হয়। নিয়ম ছিল- যে যার প্রিয় সহপাঠীকে একটা রক্ত গোলাপ হাতে দিয়ে এক টুকরা কেক খাইয়ে দেবে। খুব উপভোগ্য আয়োজন। সবাই দারুণ উত্তেজিত। কেউ কেউ একাধিক ফুল পাচ্ছে। অনুষ্ঠান যতই সামনে এগোয় ততই আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে যায় সবার মনে। এতগুলো বছরে কে কত বন্ধুপ্রিয়তা অর্জন করেছে, কে বেশি প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে তার অলিখিত বিবরণী প্রকাশ হচ্ছে।

আমার বন্ধু ছিল ইশতিয়াক। সেও আমার মত খানিকটা গোবেচারা। তবে অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাবা সুপ্রীমকোর্টের উকিল, রাজধানীতে বাসা। বোনের প্রবাস জীবন যাপন উপলক্ষ্যে দুতিনবার সেখানে গেছে। ধর্মান্ধতার দোষটুকু বাদ দিলে সে ভাল বন্ধু। আমরা চুপিচুপি ঠিক করি যে, দুজন পরস্পরকে ফুল দিয়ে কেক খাওয়াবো।

কিন্তু হঠাৎ হিরোশিমা বিস্ফোরণের মত একটা আকস্মিক ঘঁনায় সবাই হতচকিত, বিমূঢ়। দেবযানী আধফোটা গোলাপ কলি হাতে নিয়ে বৃত্তাকারে সবার সামনে থেকে ঘুরে আসে। রূদ্ধ নিঃশ্বাসে আমরা অপেক্ষা করছি- কার জীবন আজ ধন্য হবে! এই ফুলপরী কার হৃদয় বন্দরে নোঙ্গর ফেলবে।

দেবযানী এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। পূর্ণিমার চাঁদের মত স্নিগ্ধ এবং মিষ্টি হাসি হেসে গোলাপ কলিটি আমার হাতে দিয়ে এক টুকরা কেক মুখে দেয়। তারপর আসনে গিয়ে বসে। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। লক্ষ্য-কোটি রঙ্গীন প্রজাপতি চারপাশে পাখা বিস্তার করে নাচতে থাকে। আর উৎসব হলে নেমে এসেছিল অসহ্য নিরবতা।

সেই দেবযানী আমার পাশে বসা ! চোখ খুলতেই জিজ্ঞেস করে- কেমন আছ ?

 বিস্ময়ে আমার কথা সরছিল না। সর্বাঙ্গ চাদরে জড়ানো। শুধু মুখখানা অনুজ্জ্বল আলোয় দেখা যায়। বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বলি- তুমি এই ভাবে পথের সাথী হবে আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না।

-তোমার বিশ্বাসটা বরাবরই দুর্বল।

আমার অতীতের ভীরুতা নিয়ে এত বছর পর আজ প্রথমবার স্পষ্ট একটা খোঁচা দেয়। খোঁচাটা প্রতিহত করতে বলি, শুধু বিশ্বাস নয় আমার সবই দুর্বল।

-তুমি তো বেশ কথা বলতে শিখেছ আজকাল !

-জীবন সূর্য এখন মধ্য গগণ ছাড়িয়ে এসে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এখনও যদি দুটো কথা বলতে না পারি, পরে কি আর সময় হবে ?

-হিসেবটা যদি আরও আগে করতে ! যাক সে কথা। ঘুমের মধ্যে তো শীতে কাঁপছিলে। কোথায় যাচ্ছ এই হিমের রাতে ?

-সাতক্ষীরা ?

-সেখানে কেন ?

-রুটি-রুজির ধান্ধায় ?

-কি করছ সেখানে

-একটা কলেজে পড়াই।

-সেখানেই থাকো ?

-হ্যাঁ, তুমি ?

-আমার আর কথা বেশি বাকি নেই। সব বোধ হয় ফুরিয়ে এল-

মনে হল দেবযানীর গলাটা কেঁপে গেল। অদ্ভুত এক শীতলতা ঝরে পড়ল কন্ঠস্বরে। কিন্তু কেন ? জিজ্ঞেস করি- তুমি এমন করে বলছ কেন ?

-তোমার বোধ হয় শীতে কষ্ট হচ্ছে। আমারও আর বাড়তি শীতপোষাক নেই। এই নাও, এটাই দুজনে জড়িয়ে বসি। আর তো এই বয়সে লোকলজ্জার ভয় নেই! তার চেয়েও বড় কথা- দিন আর বাঁচি জানিনা। চোখের সামনে তুমি শীতে কষ্ট পাবে এটা মন মানবে না।

আমি স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যাই। জীবনানন্দ ভর করে মনে- জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার / তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার ! মেঠো পথে নয়, নাগরিক জীবনের এক চিলতে অবসরে, যাত্রাপথে এক গাড়িতে দুজন একা। কত না দীর্ঘ পথ, স্টেশন ছাড়িয়ে হঠাৎ দুজনের যাত্রা এক জংশনে এসে মিলে গেল! কিন্তু আজ কি বলব আর কি শুনব ? তবু মনের মধ্যে প্রচন্ড এক আকুলি-বিকুলি। জীবন চলে জরার দিকে কিন্তু প্রেমের অনুভূতি,সৌন্দর্য চেতনা কখনো মলিন হয় না, ম্লান হয় না। আজ এত বছর পরে কোন্ অনন্তে দুজনের মনের ব্যকুলতা,ভালবাসা বেঁচে রইল! কেন মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে! দেবযানীর সুরভিত চাদরখানা জড়িয়ে যেন পৃথিবীর সবটুকু উষ্ণতা, ভাললাগা আর স্থিরতার প্রশান্তিতে মনটা ভরে ওঠে। তার মধ্যে একটা বিষণ্নতার পাখিও করুণ স্বরে ডানা ঝাপটায়- আজও আমার চোখে বিশ্বের সুন্দরতম নারী দেবযানী। একদিন তার পবিত্র-সুন্দর হাতে একটা লাল গোলাপ উপহার দিয়েছিল। সেই সাথে তার হৃদয়-রত্নও কি দান করেছিল ? আজ এই নিরব নিশীথে প্রশ্ন করে দেখা যায় না ? কিন্তু এতদূর পথ পেরিয়ে এসে আজ কি জানতে চাব আর দেবযানীই বা কি উত্তর দেবে ?

-এই রাতের গাড়িতে তুমি একা যাচ্ছ কোথায় ? তোমার বর কই ?

-যাব বেনাপোল। সে ইংল্যান্ডে গেছে স্থাপত্য বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার্জনে। ওখানের ইউনিভার্সিটিতে একটা কোর্স করবে। সেও এতক্ষণে প্লেনে, কাল দমদমে দেখা হবে।

-তুমি ইন্ডিয়া যাচ্ছ ? কেন ?

-এখানের ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলল- ব্রেইনে নাকি একটা টিউমার দেখা যাচ্ছে, একেবারে প্রথম ধাপ। অপারেশন করাতে বলল। তাই আগামী কাল দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ভেলোরে যাব চিকিৎসার জন্য। ছেলে-মেয়ে দুটো শ্বশুর শাশুড়ির কাছে রেখে যেতে হচ্ছে। তাই একা যাচ্ছি। গাড়িতে উঠেই দেখি তুমি ঘুমিয়ে আছ। হঠাৎ মনে হল- শেষ যাত্রাটা বুঝি তোমার সাথেই ভাগ্যে লেখা ছিল। নইলে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে মরণ-দুয়ারে এসে হঠাৎ তোমার দেখা পাব কেন ?

আমার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে এসেছিল দেবযানীর রোগের কথা চিন্তা করে। কিন্তু শেষ কথাটা আমায় যেন চাবুক মেরে জাগিয়ে দেয়। বলি- আমাদের দেখা হঠাৎ নয়। আমার কতদিনের একান্ত সাধনা ছিল, তুমি জানো না। তোমাকে এত বেশি ভালবাসতাম যে আমার ছন্নছাড়া জীবনের সাথে তোমায় জড়িয়ে তোমার জীবনটা অর্থহীন করে দিতে চাইনি। আর আমি তো বরাবরই ভীরু, কাপুরুষ, কেচোঁর মত মেরুদন্ডহীন। তবে তোমার মত করে আজও কাউকে শুদ্ধভাবে ভালবাসতে পারিনি। জান, তোমার একটা নাম দিয়েছিলাম দেবযানী!

-সেই নামেই না হয় আজ একবার ডাক। তোমার মুখে নামটা শুনতে কেমন লাগে একটু  শুনি। পরে যদি আর সময় না হয় ?

স্থান-কাল ভুলে আমার হাতটা দেবযানীর মুখচাপা দেয়। দেবযানী হাতটা ধরে চুপ করে বসে থাকে। আমি যথাসাধ্য দেবযানীকে রোগ, মৃত্যুভয় থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। সাথে নিজের অসহায়ত্ব থেকেও মুক্তি খুঁজি- আজকাল এসব রোগ আর চিকিৎসাতীত নয় বরং সহজেই আরোগ্য হয়। আমার সবটুকু ভালবাসা দিয়েই বলছি, তুমি সহজেই সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার আমাদের দেখা হবে। আমি তোমার পথ চেয়ে থাকব।

কথাগুলো বলতে বলতে আমার ভিতর ক্রমশঃ একটা বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ওঠে। তা হয় তো দেবযানীর মাঝেও সংক্রামিত হয়। সে চুপি চুপি হাতটা আমার গলায় দিয়ে বলে- আজ আমার দেহ-মন, সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে তোমার কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। যদি তা মিথ্যেও হয় আমার এই বাড়াবাড়িটুকু তুমি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখো। যখন মৃত্যুর দিকে চলছিলাম তখন জীবনের গান হয়ে তুমি এলে। আজ আমি অনেকটাই নিঃশঙ্ক হয়ে গেছি। আমার রোগ-জীর্ণ মনের কথা নয়, আমার বিশ্বাস। জীবন-মৃত্যু কোনটার প্রতিই আমার তীব্র আকর্ষণ বা বিদ্বেষ নেই। তুমি আমার জন্য বরং এই শুভকামনা রেখো- কাল যাই হোক আমি যেন সহজে মেনে নিতে পারি।

-তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে, আমার বিনিময়ে হলেও তুমি রোগমুক্ত হও।

-এমন করে বোলো না গো ! আমি যে জীবনের জন্য আবার লোভী হয়ে উঠব !

গাড়িতে সুনশান নিরবতা। দীর্ঘ শীতার্ত রাত্রি ভোর হওয়ার সাথে সাথে আমরা গন্তব্যের কাছে পৌঁছে গেছি। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক বিদায় গ্রহণ বাকি।

দেবযানীকে সীমান্তের ওপাশে নো ম্যান ল্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে দাঁড়াই। নিয়ম, আইন আমাকে আটকে দিয়েছে। জীবনের স্বপ্ন বুকে দেবযানী ধীরে ধীরে ভারত ভূখন্ডে প্রবেশ করে।

আমি মনকে কঠোর করেই বেঁধেছিলাম- দেবযানীকে হাসিমুখে বিদায় দেব। সারা জীবন ধরে পথ আমাদের কত মায়ায় জড়িয়ে নেয়, কত মানুষ মায়ার বাঁধনে বাঁধে ! আবার পথের মাঝেই কত আপনজন হারিয়ে যায় ! অসহায় চোখে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কি- বা করার থাকে ! তবু কোনমতেই আর চোখের জল বাঁধ মানেনা। প্রথম যৌবনে যাকে ঘিরে প্রেমের রঙ্গীন স্বপ্ন দেখেছিলাম আজ তার আরোগ্য কামনায়, সুস্থ জীবনে ফিরে আসার ব্যাকুল প্রত্যাশায় চোখ দুটো বাস্পাকুল হয়ে ওঠে। বুকের ভিতর একটা কষ্ট-পাখি আর্তনাদ করে ডানা ঝাপটাতে থাকে।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান