গ্রামের এই পায়ে চলা সরু পথটা ধরে হেঁটে যেতে যেতে মহিবুলের মনে হলো, বাস থেকে নেমে নদীপথে গেলেই বোধহয় সহজ হতো। নৌকো নিয়ে সোজা চলে যাওয়া যেত সেই বাড়িটার ঘাটে। গ্রামের পাশ দিয়েই তো বয়ে গছে নদী। এই কি সেই নদী? যার জলে একসময় ভেসে গিয়েছিল রক্তাক্ত, গলিত-অর্ধগলিত, মাছে ঠুকরে খাওয়া অনাঘ্রাত অসংখ্য মৃতলাশ! তার বাবার কাছে তো এমনটাই শুনেছে। পাকসেনারা কত মানুষকে যে মেরে ভাসিয়ে দিয়েছে এই নদীর ঘোলা জলে! আবেদ মাসটারকেও কি মেরে ফেলা হয়েছিল? সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার পরে কোনো বিপদ নেমে আসেনি তো তার পরিবারের লোকদের ওপর? মহিবুলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনকে এ রকম সংশয় ও ভাবনা তাড়িয়ে ফিরছে বিগত বায়ান্নটি বছর ধরে। সেদিন রাতে আবেদ মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় না পেলে কী যে বিপদে পড়ত মুক্তিযোদ্ধারা!
মার্চ মাস। ঘুটঘুটে অন্ধকার এক রাত। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। চারপাশ নির্জন। শুধু নৈঃশব্দ্যের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। তবে মাঝেমধ্যে খোলা জানালার ধারে থামের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছের আড়ালে বাঁদুড়ের চেঁচামেচি অথবা তক্ষকের ডাক শোনা যায়। হঠাৎ নির্জনতা ভেদে করে বাড়ির কুকুরটা ডেকে উঠল। ঘরে ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আবেদ মাস্টার, তার স্ত্রী সালেহা বেগম, ছেলে ইলমে নূর ও মেয়ে সোহার ঘুম ভেঙে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের দরজায় টোকা পড়তে লাগল। এত রাতে কারা ঘরের দরজায় নক করতে পারে? আবেদ মাস্টার ঘরের বাতি না জ্বেলে দরজা না খোলে সিথানের বালিশ ওপর থেকে নিজের মাথাটা কয়েক ইঞ্চি ওপরে তোলে কান খাড়া করে পরিচিত কারো গলার স্বর শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু কারো গলার স্বর শোনা যায়নি। দরজায় অবিরাম টোকা পড়ছে দেখে ভয় পেয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রীকে ডাকল আবেদ মাস্টার।
দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। দেশজুড়ে পাকসেনারা হত্যা, ধ্বংস, ধন-সম্পত্তি লুট, আগুন আর মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলছে ইচ্ছেমতো। এ রকম ভয়াবহ যুদ্ধের দিনে মাঝরাতে আচমকা ঘরের দরজায় টোকা পড়লে ভয় পাওয়া অস্বাভাকি নয়। শুধু ভয় পাওয় নয়, রীতিমতো মৃত্যুভয় হওয়ার কথা। ভয় পেয়ে পাশের ঘর থেকে ইলমে নূর আর সোহা মা-বাবার ঘরে চলে এলো। সোহা মায়ের কাছে জানতে চাইল, ‘আম্মা, এত রাতে দরজায় নক করে কে?’ সালেহা বেগম মেয়ের মুখ চেপে ধরে ফিস্ফিস্ করে বলল, ‘চুপ! আস্তে কথা বল।’তখন ইলমে নূর বলল, ‘আব্বা, বাইরে কারা?’
আবেদ মাস্টার জবাব দিল, ‘জানি না, এত রাতে কারা এলো!’
সোহা বলল, ‘আমার ভীষণ ভয় করছে।’
ইলমে নূর বলল, ‘আমারও।’
সালেহা বেগম বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহ আছেন। তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।’
ঘরের ভেতরে চারটা প্রাণী ভয়ে গলাকাঁটা মোরগের মতো ছটফট করতে লাগল। ভয়ে দোয়া ইউনূস পড়ল সালেহা বেগম। আবেদ মাস্টার বিছানা থেকে নেমে কোমড়ে গামছা বেঁধে আড়াল থেকে একটা শাবল বের করে দরজার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে বলল, ‘তোরা এখানে থাক। আমি দেখছি।’
ইলমে নূর বলল, ‘আব্বা, আমি আপনার সঙ্গে আসি?’
আবেদ মাস্টার বাধা দিল, ‘না, তুই এখানেই থাক, নইলে তোর আম্মা আর সোহা ভয় পাবে।’
দরজায় অবিরাম টোকা পড়ছে। দরজাটা খোলার জন্য আবেদ মাস্টার যেই খিল ধরল অমনি সালেহা বেগম এসে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে ভয় জড়ানো গলায় বলল, ‘দরজা খোলার দরকার নাই। ওরা যদি পাকসেনা হয় তাহলে আপনাকে মেরে ফেলবে নয়তো ধরে নিয়ে যাবে।’
আবেদ মাস্টার অসহায় গলায় বলল, ‘তাহলে এখন আমি কী করব?’
এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ঘরের ভেতরে কি কেউ আছেন?’
ঘরের ভেতরে থাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। সোহা যেন কেঁদে ফেলবে। ইলমে নূর বাবার পাশে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আবেদ মাস্টারের হাতে শাবল। দরজার ওপাশ থেকে আবার ভেসে এলো, ‘কেউ কি আছেন ঘরের ভেতরে? ভয় পাবেন না, আমরা মুক্তিযোদ্ধা।’
আবেদ মাস্টার আর দেরি করল না। ঝটপট দরজা খুলে দিল। একে একে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়ল ঘরে। ততক্ষণে সবার ভয় কেটে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একজন বিনীত গলায় বলল, ‘আমরা শহর থেকে এসেছি। রাতের জন্য আপনার এখানে আশ্রয় চাই। ভোর হওয়ার আগেই চলে যাব।’
আবেদ মাস্টার অভয় দিয়ে বলল, ‘অবশ্যই আপনারা এখানে আশ্রয় পাবেন। আপনারা মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করছেন। আপনাদের আশ্রয় দিতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করব। তাছাড়া এটা আমাদের কর্তব্যও বটে।’
মুক্তিযোদ্ধারা খুশি হলো। আবেদ মাস্টার দরজাটা লাগিয়ে দিল।
পাশের গ্রামে পাকসেনাদের ক্যাম্প আছে। তাদের কানে এই খবর পৌঁছে গেলে সমস্যা হতে পারে। হয়তো রাত না ফুরাতেই ধেয়ে এসে বাড়িঘর আগুনে পোড়াবে। মুক্তিযোদ্ধারা মেঝেতে মাদুর পেতে সবাই একসঙ্গে বসেছিল। সালেহা বেগম থালা ভরে মুড়ি-চিড়া, নাড়কেলের নাড়– এনে তাদের সামনে দিয়ে বলল, ‘আপনারা এখন এগুলো মুখে দেন। ভাত চড়িয়ে দিয়েছি। বেশি দেরি হবে না। এখনই হয়ে যাবে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন বলল, ‘ভাত খেতে হবে না। এখানে রাতটা কাটানোর জন্য আশ্রয় পেয়েছি তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ। আশেপাশের গ্রামে নিশ্চয়ই রাজাকার কিংবা পাকবাহিনির লোকজন থাকতে পারে। আমরা যে এখানে অবস্থান করছি এই কথা তারা জেনে গেলে সমস্যা হবে। জয়পুরে আমাদের ক্যাম্প আছে। ভোর হওয়ার আগেই আমরা সেখানে চলে যাব।’
আবেদ মাস্টার বলল, ‘ঠিক আছে আপনারা চুপচাপ শুয়ে পড়–ন। আমি রাত জেগে পাহারা দেব।’আবেদ মাস্টারের একটিমাত্র টিনের ঘর। দু’টি কক্ষ। বাড়িতে চারজন সদস্য আর সাতজন মুক্তিযোদ্ধা। এজন্য তাদের আলাদা ঘরে বিছানা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল। তবে বাড়ির মহিলারা একদিকে আর পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা অন্যদিকে ভাগ হয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়ে গেল। আবেদ মাস্টার না ঘুমিয়ে রাত জেগে পাহারা দিতে লাগল। যখন রাত ফুরিয়ে ভোর হলোÑ ফযরের আযান পড়ল পাড়ার মসজিদে। তখনই মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম থেকে জেগে উঠল। কেউ ডেকে তুলতে হয়নি। তারা তো ঘুমায়ইনি। রাতারাতি পাকসেনা কিংবা রাজাকারদের কানে তাদের খবরটা পৌঁছে থাকলে এখনই তেড়ে আসবে এখানে। কাজেই আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। এখনই বের হতে হবেÑ এই ভেবে কমান্ডার আমজাদ হোসেনে ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলো। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তার চোখের কোণে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জমে উঠল। অশ্রুসিক্ত চোখে আবেদ মাস্টার ও সালেহা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।’
সালেহা বেগম সবনিয়ে বলল, ‘এভাবে বলবেন না। এটা আমাদেরও দায়িত্ব নয় কি?’
আবেদ মাস্টার বলল, ‘আমারও ক্যাম্পে যোগ দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একটি কিশোর ছেলে ও যুবতি মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে কীভাবে চলে যাই। আমি যুদ্ধে চলে গেলে তারা কেঁদে কেঁদে মরে যাবে।’
আমজাদ হোসেন বলল, ‘আমরা এখন যাই। যদি কোনো দিন যুদ্ধ শেষ হয় আর আমরাও বেঁচে থাকি, তাহলে স্বাধীন দেশে এসে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।’
আবেদ মাস্টার বলল, ‘তাই যেন হয়।’
গল্পটা বাবার কাছ থেকে শুনেছে মহিবুল। বায়ান্ন বছর ধরে আবেদ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করার আকাক্সক্ষা ছিল তার বাবার। কিন্তু দেখা করা হয়নি। হয়তো ভাগ্যে নেই। আজ মহিবুলকে পাঠিয়েছে। সঙ্গে নিজের কিছু লিখে দিয়েছে একটা চিঠি। বাবার চিঠি বয়ে নিয়ে ডাকপিয়ন মহিবুল এখন আবেদ মাস্টারের গ্রামে। বাবার দেওয়া ঠিকানা মতো খুঁজছে আবেদ মাস্টারের সেই বাড়িটা।
মহিবুল গ্রামের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা সরু পথটা ধরে হেঁটে চলেছে। পথটা অসর্পিল, কাঁচা। রিক্শা চলার উপযোগী নয়। তাই নামতে হয়েছে রিক্শা থেকে। আবেদ মাস্টারের বাড়িটা আর কতটুকু দূরে তা জানে না সে। সামনে একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, বাড়িটা গ্রামের একেবারে পূব মাথায়। আরেকটু এগিয়ে গেলেই প্রাইমারি স্কুল, তার পাশেই। মহিবুল আরও কিছক্ষণ হেঁটে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিমগাছের নিচে টিনের চারচালা ঘরটা আবেদ মাস্টারের। ১৯৭১ সালের কোনো এক মাঝরাতে মহিবুলের বাবা আমজাদ হোসেন ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। বায়ান্ন বছর পরে বাড়িটা খুঁজে পেতে মহিবুলের একটু অসুবিধা হলেও তখন ওই গ্রামেরই রাজাকার মতিউর রহমান ওরফে মতি মিয়া আর পাকসেনা ইসাক খানের বাড়িটা খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সেদিন তীব্র আক্রোশে আগুনের ফুল্কির মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল ইসাক খানের দু’চোখ। মাথার টুপিটা হাতের লাঠি দিয়ে গুঁতো মেরে হাওয়ায় দুলিয়ে আবার মাথায় পরে নিয়ে দুইজন পাঞ্জাবি সেনাকে ঘরের ডানে-বাঁয়ে দেখিয়ে ইসাক খান বলেছিল, ‘তুম লোক ওধার যাও, আউর তুম যাও ওধার।’
কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকে। তাকে অনুসরণ করে মতি মিয়া। সকালের সোনালি রোদ তার রাইফেলের মাথায় পিতল কিংবা সিলভারের অংশে লেগে চক্ চক্ করে ওঠে। পাকসেনারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে আবেদ মাস্টার। মেয়ে সোহা আর স্ত্রী সালেহা বেগম অন্য ঘরে। লুকিয়ে আছে তারাও। আবেদ মাস্টার ভয় পেতে থাকে। নিজের বিপন্নতার জন্য নয়। স্ত্রী ও মেয়ের জন্য। না জানি কী সর্বনাশা কাহিনি রচিত হতে যাচ্ছে এখন। সে আড়ালে লুকিয়ে থাকলেও পাকসেনাদের ঘরের ভেতরে চলাচল দেখতে পায়। এই তো এখনই তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে তারা। এখন কী করবে সে? স্ত্রী আর মেয়েকে রেখে পালিয়ে যাবে? ইলমে নূর স্কুলে চলে গেছে বলে তাকে ভয়ংকর এই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো না। আবেদ মাস্টার ঘরের এককোণে মোরগের খোপের ভেতরে লুকিয়ে আছে। হঠাৎ মতি মিয়ার চোখ পড়ে সেখানে। তাকে দেখতে পেয়ে উল্লাসে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘পাইয়া গেছি!’
ইসাক খান এগিয়ে আসে। রাইফেল তাক করে বলে, ‘তুমহারা নাম আবেদ মাস্টার?’
আবেদ মাস্টার স্বীকার করে।
ইসাক খান ফের বলে, ‘তুম ম্যারা নাম শুনলিয়া?
আবেদ মাস্টার নীরব। মতি মিয়া বলে, ‘চুপ কইরা আছস ক্যান, হারামজাদা! মুক্তিযোদ্ধা লুকাইয়া রাখছস ঘরের ভেতরে, তাই না?’
আবেদ মাস্টার বলে, ‘আমি ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।’
ইসাক খান বলে, ‘কিয়া বলতাহে? উসকো বাত নেহি মানে গা।’
এর মধ্যে ঘরের অন্য কক্ষ থেকে সোহাকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে আসে পাকসেনারা। লোভাতুর চোখে তার দিকে তাকায় ইসাক খান। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ইয়ে কৌন?’
আবেদ মাস্টার বিনয়াবনত গলায় বলে, ‘আমার মেয়ে। তাকে ছেড়ে দেন, তার কোনো দোষ নাই।’
‘চুপ!’ ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় ইসাক খান। সে যে সোহাকে দেখে খুশিই হয়েছে সেটা আবেদ মাস্টারেকে বুঝিয়ে দিতে গলার স্বর নরম করে ফের বলে, ‘এ তোমহারা লারকি হে। তোমহারা বিবি কিধার হে? বোলো, বোলো কিধার হে?’
আবেদ মাস্টার কোনো কথা না বলে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে ইসাক খানের দিকে। ইসাক খান তার খুব কাছাকাছি এগিয়ে এসে আবার বলে, ‘হামারা পাস নিউজ হায়, তোমহারা ঘরমে মুক্তি আয়া থা। আর্মস ছুপাকে রাকখা গিয়া। আব বাতা দো আর্মস কাহা ছুপা রাকখা?’
আবেদ মাস্টার বলে, ‘আমার ঘরে মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল, কিন্তু কোনো অস্ত্র রেখে যায়নি।’
ইসাক খান তার কথাটি না বুঝলেও ভাবখানা বুঝে নিয়ে পাকসেনাদের পুরো ঘর তল্লাসি করার হুকুম করে সোহাকে হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ‘তুম হামারা সাথ আউ।’
আবেদ মাস্টার কিছু বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারে না। মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও জেদ। সোহাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় ইসাক খান। কিন্তু সোহা যেতে চায় না। বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দেহে যত শক্তি আছে তত জোরে চিৎকার করে কাঁদে। ইসাক খান তার গায়ের জামা ধরে টান দেয়। ছিঁড়ে যায় জামাটা। আবেদ মাস্টার চোখের সামনে নিজের মেয়েকে এ রকম টানাহেঁচড়ে নিয়ে যাবার দৃশ্যটা দেখে সহ্য করতে পারে না। প্রবল জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘কু-উ-ত্তার বাচ্চা-আ! অরে ছাইড়া দে, ছাইড়া দে!’
ইসাক খান তখনই তার সৈনিকদের সেই ভয়ংকর হুকুমটা দিয়ে দেয়, ‘ধরো সালাকো।’ তারপর সোহাকে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে বলে, ‘সালাকো মার ঢালো, মার ঢালো সালাকো!’
পাকসেনারা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। আদেশ পাওয়া মাত্র আবেদ মাস্টারকে ধরে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলে। মতি মিয়া যেন এই সময়টার অপেক্ষাই করছিল। সে খুশিতে উদ্বেল হয়ে বলে, ‘জি হুজুর, শালারে মারবো। তবে আগে একটা একটা করে হাতের আঙ্গুল কাটব। তারপর গলায় দড়ি বেঁধে টেনেহেঁচড়ে মারব।’
মতি মিয়া ও কয়েকজন পাকসেনা মিলে আাবেদ মাস্টারের হাতের আঙ্গুল কাটার জন্য প্রস্তুত হয়। ঘরের ভেতরে আড়ালে লুকিয়ে থেকে এই দৃশ্যটা দেখে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ছুটে আসে সালেহা বেগম। স্বামীর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার স্বামীরে আপনারা মাইরেন না, ছাইড়া দেন।’
দুইজন সৈনিক সালেহা বেগমর গলা টিপে ধরে। আবেদ মাস্টার শুধু নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন পাথর হয়ে গেছে সে। অন্য দিকে সালেহা বেগমও নীরব। যখন সৈনিকদ্বয় গলা টিপে ধরেছে তখনই থেমে গেছে তার চিৎকার। থেমে গেছে শ্বাস-প্রশ্বাস আর রক্ত সঞ্চালনও। এদিকে আবেদ মাস্টারের হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে পায়ের আঙ্গুলগুলোও। চোখের কোটর শূন্য। সেখানে শুধু জমাট রক্ত। চোখ নেই। উপড়ে ফেলেছে। সম্ভবত এই দৃশ্যটা দেখেই সালেহা বেগম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দুইটি মানুষ মরে পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই। নেই কান্না করারও কেউ। মতি মিয়া ও পাকসেনারা সোহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ঘরের ভেতরে নেমে আসে কবরের নীরবতা।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কারণ গল্পের বাকি অংশ সবারই জানা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশও হয়েছে স্বাধীন। আর কমান্ডার আমজাদ হোসেনও বেঁচে আছে। কথা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে, স্বাধীন দেশে আবেদ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করবে সে। আমজাদ হোসেন শারীরিক অসুস্থতার কারণে আসতে পারেনি। আবেদ মাস্টারকে দেওয়া কথা রাখতে ছেলেকে পাঠিয়েছে। নিজের অব্যক্ত কথাগুলো লিখে দিয়েছে একটা চিঠি। চিঠি নিয়ে মহিবুল বাবার দেওয়া ঠিকানামতো বাড়িটা পেল কিন্তু সেই মানুষটা পেল না।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান