ট্রেন দুঘণ্টা লেট। জয়বাংলা লোকাল ট্রেন ‘জলপাই’ষ্টেশনে বিকেল তিনটায় পৌঁছানোর কথা কিন্তু সে ট্রেন পৌঁছায় বিকেল পাঁচটায়। মানুষীর সব প্ল্যান এলোমেলো হয়ে যায়। ওর ইচ্ছে ছিল, ফিরতি ট্রেনে ফিরে আসবে ঢাকায়। সেটা এখন সম্ভব হবে কিনা, সে চিন্তার ছাপ মানুষীর চোখেমুখে।
ত্রিশ বছর পর মানুষী নিজ গ্রাম, নিজ জন্মভূমিতে যাচ্ছে। মানুষীর বয়স এখন একান্ন। একুশ বছর বয়সে ডা. আবিরের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে ছিল। ছেড়ে ছিল মানে বাধ্য হয়েছিল।
ছোট্ট ষ্টেশন ‘জলপাই’। এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে থামে না। তাই মানুষীকে লোকাল ট্রেনে আসতে হয়েছে।
রেলষ্টেশন বললে, কোলাহল, লোকের হৈচৈ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, বোচকা-বেডিং মাথায় করে কুলিদের দ্রুত হেঁটে যাওয়া, এসব দৃশ্য চোখে ভাসে। কিন্তু এ ষ্টেশনে এসবের কিছুই নেই। নীরব, ছায়াময় একটি ষ্টেশন। মানুষী ছাড়া আরও দু-তিনজন লোক ট্রেন থেকে নামার পর, ট্রেনটা হুসহাস শব্দ করে চলে যায়। মাত্র কয়েক মিনিট থেমেছে এখানে।
মানুষী ষ্টেশনে একটি চায়ের স্টল, ছোট ছোট দু’টো পান সিগারেটের দোকান, একটা সিঙ্গাড়া-ছমুচার দোকান, একটা চুলকাটার সেলুন দেখতে পায়। চায়ের স্টল দেখে মানুষীর চা খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা চায়ের স্টলের সামনে বেঞ্চে বসে চা খেতে আলাদা একটা আনন্দ আছে। সেটা কি আমেরিকায় এরিজোনা শহরে পাওয়া যাবে?
মানুষী টের পায়, চায়ের স্টলে যে দু-চারজন লোক বসে আছে, তারা সবাই মানুষীর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মানুষী ভাবে, এই তাকানো উপেক্ষা করে চা খেতে যাওয়া কি ঠিক হবে? কৌতূহলী মানুষগুলো আরও কৌতূহল হয়ে ওঠবে না তো?
লম্বায় পাঁচফুট তিন ইঞ্চি, স্বাস্থ্যবতী, উজ্জ¦ল চেহারা, ঘাড় পর্যন্ত চুল ছড়ানো, নীল শাড়ি, স্লিভলেজ ব্লাউজ, সবমিলে মানুষীকে বিদেশিনী বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সকাল-বিকেল নিয়ম করে দুবেলা হাঁটা, সপ্তাহে একদিন টাচ এন্ড ফিট সেন্টারে ব্যায়াম করতে যাওয়া, এসব করে মানুষী স্বাস্থ্যটা ধরে রাখতে পেরেছে। প্রকৃত বয়স বোঝা যায় না।
মানুষী তার চাকাওয়ালা লাগেজটা টেনে, চা স্টলের দিকে দু পা এগোতেই পেছন থেকে আঠার-বিশ বছরের একটা ছেলে এসে বলে, আপনি কোথায় যাবেন? আপনি কি বিদেশ থেকে এসেছেন?
চটকরে মানুষী কোনো উত্তর না দিয়ে, ছেলেটিকে ভালো করে দেখে, পড়নে খয়েরি প্যান্ট, এখন রঙ উঠে সাদাটে। গায়ে কালো গেঞ্জি। পায়ে দুফিতার সেন্ডেল। স্বাস্থ্য মোটাও না, চিকনও না। মাঝামাঝি। নাক লম্বা। চোখের দৃষ্টি প্রখর। কথা মোলায়েম, ভাষা আঞ্চলিক না, প্রমিত। সব দেখে ছেলেটিকে মানুষীর কাছে ভদ্রই মনে হয়।
মানুষী বলে, আমেরিকায় থাকি। এখন ঢাকা থেকে ্এসেছি। তুমি ?
‘আমি বিকালে ট্রেন আসার সময় ষ্টেশনে থাকি। মানুষের সুবিধা অসুবিধা দেখি।’
‘তুমি নিশ্চয় পড়াশুনা করো, তা কিসে পড়?’
‘জয়নগর কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।’
‘গুড।’
‘আপনি কোথায় যাবেন?’
‘আমিও তো জয়নগর যাব।’
‘সে তো অনেক দূর।’
‘কত কিলো হবে?’
‘চার মাইল। ওখানে যেতে রাত হয়ে যাবে।’
মানুষীও বুঝতে পারে, শীতের বেলা। সাড়ে পাঁচটা, পোনে ছয়টায় সন্ধ্যা নেমে আসবে। তারপর ঝুপকরে শীত নামবে। শহরে যতটা না, গ্রামে তার চেয়ে অনেক বেশি। সেটা ভেবে মানুষী সাথে করে একটা উলের চাদর নিয়ে এসেছে। সেটা হাত ব্যাগের মধ্যে রাখা আছে, যাতে প্রয়োজনে টুপ করে গায়ে জড়িয়ে নিতে পারে।
‘তুমি জয়নগর কলেজে পড়। তাহলে ওদিকটা তো তোমার চেনা।’
ওরা দুজনে চায়ের স্টলে যেতে যেতে এসব কথা হচ্ছিল। ইতিমধ্যে ছেলেটি মানুষীর হাত থেকে লাগেজটা নিজের কাছে নিয়েছে। ছেলেটি হাঁটছে সামনে, মানুষী একটু পেছনে, যতটুকু পেছনে থাকলে দুজনের মধ্যে কথা বলা যায়।
হঠাৎ ছেলেটি হাঁটা থামিয়ে বলে, ম্যাডাম, ক্ষিধে না লাগলে, চা খাওয়ার দরকার নাই। চলেন, আমরা জয়নগরের দিকে যাই।
মানুষী ভাবে, ছেলেটা মন্দ বলেনি। যে কাজে এসেছি, সে কাজটা আগে শেষ করা দরকার।
‘আমরা মানে! তুমিও আমার সাথে যাবে?’
‘আমার বাড়ি এদিকে। কিন্তু আপনি বললে ওদিকে যেতে পারি। আমার চেনা পথ।’
‘তাহলে তো ভালো হয়, চলো। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম, চিনে যেতে পারব তো!’
‘চা খাবেন না?’
‘চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তোমার কথায়, আর খাব না। তুমি ঠিকই বলেছ। যেতে রাত হয়ে যাবে।’
ছেলেটি মনে মনে খুশি হয়। ম্যাডাম ওর কথা রেখেছে।
তবু ভদ্রতার খাতিরে ছেনেটি বলে, খেতে পারেন। খাটি গরুর দুধের চা। এই চা আমেরিকায় বা ঢাকায় পাবেন না।
‘তবুও খাব না। তুমি বলো, কীভাবে যেতে হবে?’
‘উত্তর পাশে ভ্যান আছে। ভ্যানে তিন মাইল যেতে হবে, তারপর একমাইল পায়ে হেঁটে। কাঁচা রাস্তা। রাস্তা খুব খারাপ। ভ্যান যাবে না। আপনার কি হাঁটার অভ্যাস আছে?’
‘আমেরিকায় সকাল-সন্ধ্যা হাঁটি। দেখি কতটা হাঁটতে পারি।’
ওরা দুজন ষ্টেশনের উত্তর পাশে যেয়ে দেখে, কয়েকটি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানওয়ালারা সবাই একযোগে এগিয়ে আসে, সবাই তাদের ভ্যানে নিতে চায়।
কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বলে, বাদল কনহানে যাবি, আমার ভ্যানে আয়।
মানুষী এতসময় ছেলেটির নাম জানতে চায়নি। লোকগুলো বাদল নামে ডাকাতে, মানুষী বুঝতে পারে, ছেলেটির নাম বাদল।
এ মুহূর্তে মানুষীর রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের, বলাইয়ের কথা মনে পড়ে। এতবছর আগের সৃষ্টি ‘বলাই’ চরিত্র এখনও সমাজে আছে। এজন্য রবীন্দ্রনাথের সব লেখা এত জীবন্ত। এত আধুনিক।
বাদল পছন্দ মতো একটা ভ্যান বেছে নিয়ে, লাগেজটা ভ্যানের মধ্যখানে রেখে, মানুষীকে বলে, আপনি সামনে বসেন। আমি পেছনে বসছি।
‘এক কাজ করো, লাগেজটা পেছনে দাও। তুমিও সামনে এসে বসো। কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।’ মানুষী ভ্যানে বসতে বসতে কথাগুলো বলে।
ভ্যানওয়ালা মানুষীর দিকে তাকিয়ে আছে, বিদেশী মানুষ। ভ্যানে চড়ার অভ্যাস আছে? ঠিক মতো বসতে পারবে?
না, মানুষী ঠিকই ভ্যানের ওপর দুহাতে ভর দিয়ে, শরীরটাকে একটু উঁচু করে, ঠিক মতো বসতে পেরেছে।
ভ্যান চলতে শুরু করে। বাদল সামনে বসলেও একহাত দিয়ে লাগেজটা ধরে রেখেছে।
শীতের বেলা। একটু আগে টুপ করে বেলা ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে। রাস্তার পাশের গাছগুলো এখনও চেনা যায়। কোনোটা আম, কোনোটা বেল, কোনোটা তাল গাছ। তাল গাছটা রাস্তা থেকে একটু দূরে, জমির আইলে। যেন দাঁড়োয়ান হয়ে জমি পাহাড়া দিচ্ছে। কিছু জমি পতিত। আবার কিছু জমিতে ধান চাষ করা হয়েছিল, ধান কেটে নেয়ার পরে, ধান গাছের গোড়া পরে আছে। দু’টো খালি জমির পরে, একটা বাঁশঝাড়, তারপর একটা আখক্ষেত। কয়েকটা আখ হেলে পড়েছে। কিছু আখের পাতা শুকনো। কিছু আখের পাতা সবুজ।
‘ম্যাডাম, জয়নগর কোন বাড়ি যাবেন, তাতো বললেন না।’ ভ্যানে উঠে দুজনের মধ্যে এতসময় কোনো কথা হয়নি। মানুষী এতসময় রাস্তার দু’ধারে তাকিয়ে তাকিয়ে গাছ দেখছিল, ফসলের মাঠ দেখছিল, পতিত জমি দেখছিল, বাঁশ ঝাড় দেখছিল।
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে, বাদলের দিকে তাকিয়ে মানুষী বলে রায়বাড়ি। জয়নগর কলেজটা আগে স্কুল ছিল। ওই স্কুলে আমি পড়েছি। স্কুলের উত্তর পাশে আমাদের বাড়ি। বাড়ি যাচ্ছি বাবা-মাকে দেখতে। ত্রিশ বছর পর।
‘ নারায়ন জেঠা আপনার বাবা হন?’
‘হ্যাঁ, আমার বাবা।’
‘উনি তো সেদিনও ষ্টেশনে আইছিলেন। উনার ছেলে অনিমেষ দুই বছর হয় মারা গেছে। গাড়ি চাপা দেছিল। তার দুই ছেলেমেয়ে।’ তথ্যগুলো ভ্যানওয়ালা দেয়।
বাদল মানুষীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, অনিমেষে মৃত্যুর কথা শুনে, ম্যাডামের মুখের ছবি পালটে গেছে। এর আগে, মুখে যে আলোটুকু ছিল, তা নিভে গেছে।
বাদল মানুষীর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে উল্টো দিকে তাকায়। ওর ভাবে, ম্যাডাম এখনই কাঁদবে। ঠিকই, একটু পরে বাদল আড়চোখে মানুষীর দিকে তাকিয়ে দেখে, ম্যাডাম বাঁ হাত দিয়ে ভ্যান ধরে রেখে, ডান হাত দিয়ে চোখ মোছতেছে।
কিছু সময়ের জন্য মানুষী-বাদলের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলে না। হয়ত এ নীরবতা আরো সময় চলত। কিন্তু ততক্ষণে ওরা পাকা রাস্তার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ভ্যান আর যাবে না। এখানে নামতে হবে। বাদল বলে, ম্যাডাম ভ্যান আর যাবে না।
মানুষী কোনো কথা বলে না। ভ্যান থেকে নেমে, পার্স থেকে একশ টাকার একটি নোট বেরকরে, লোকটিকে দিয়ে বলে, পুরোটা রেখে দিন। ফেরত দিতে হবে না।
ভ্যানে ওঠার সময় বাদল ভ্যানওয়ালার সাথে দড়াদড়ি করে, ভাড়া আশি টাকায় ঠিক করেছিল।
লোকটি বাড়তি বিশ টাকা পেয়ে, এমন একটা হাসি দেয়, যার দাম লাখ টাকার সমান। এ হাসি দেখে মানুষীর মনটা ভালো হয়ে যায়।
রাস্তা শুধু কাঁচা না, উঁচুনিচু-এবড়োথেবড়ো। বাদল লাগেজটা নিয়েছে। কিন্তু টেনে নিতে পারছে না। উঁচু করে নিতে হচ্ছে।
‘লাগেজটা নিতে তোমার কষ্ট হচ্ছে?’ মানুষী বাদলের কষ্টটা বোঝার পরেও প্রশ্নটা করে, শুধু ভদ্রতার জন্যে, সহানুভূতির মন থেকে।
বাদল বলে, না। অসুবিধা নেই। ও হাত বদল করে, একবার ডান হাত, একবার বাঁ হাত, এভাবে সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে থাকে। । অসাবধান হলেই উসঠা খাবে।
খালি হাতে হেঁটেই মানুষী হাঁপাচ্ছে। লাগেজটা হাতে করে হাঁটার তো প্রশ্নই ওঠে না। মানুষী মনে মনে বাদলকে ধন্যবাদ দেয়।
ঢাকা থেকে আসার সময় আবির বলেছিল, তুমি তো যেয়েই চলে আসবে, তা, লাগেজ নিচ্ছো কেন?
‘বাবা-মার জন্য কিছু জামা-কাপড়, কিছু কসমেটিকস, আর কিছু চকলেট নিচ্ছি। এতদিন পর বাড়িতে কে কে আছে, তা তো জানি না, আন্দাজের ওপর নিচ্ছি।’
একথার পর আবির আর কিছু বলেনি।
আমেরিকা থেকে শুধু বাবা-মাকে দেখার উদ্দেশ্যেই মানুষী বাংলাদেশে এসেছে।
সেদিনের কথা মানুষীর স্পষ্ট মনে আছে। মানুষীকে সারাদিন ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। পরের দিন গ্রামে বিচার বসবে, রায়বাড়ির মেয়ে মানুষী, একজন মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে। এতে রায়বাড়ির জাত গেছে। সেই বিচার।
নারায়ন রায় নিজে একজন পুরোহিত। গ্রামের সাবাই তাকে মান্য করে। সবাই তাকিয়ে আছে, নিজে, নিজের মেয়ের কী বিচার করে। কেউ কেউ বলছে, মেয়েকে গ্রাম ছাড়া করতে হবে।
ডা. আবির তখন জয়নগর থানা স্বাস্থ্য অফিসার। তরুণ ডাক্তার। ঢাকা থেকে এসে এখানে জয়েন করেছে। মানুষীর টাইফয়েড জ্বর হলে, ওর চিকিৎসার জন্য ডা. আবিরকে বাসায় ডাকা হয়। প্রথম দেখাতেই মানুষীকে আবিরের ভালোলেগে যায়। মানুষীর পালস দেখতে গিয়ে, মনের পালস দেখে। শরীরের তাপমাত্রা মাপতে যেয়ে, হ্রদয়ের তাপমাত্রা মাপে। একসময় মানুষী সেরে ওঠে। কিন্তু আবিরের মানুষীদের বাসায় যাওয়া-আসা থেমে থাকে না। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। একদিন ওরা গোপনে বিয়ে করে। কিন্তু সে বিয়ের খবর বেশি দিন গোপন থাকে না। কিছু দিনের মধ্যে তিন গ্রামে জানাজানি হয়। এরপর শুরু হয়, জাত গেল, জাত গেল, আন্দোলন।
সেদিন রাতেই, বাবার সম্মানের কথা ভেবে, মানুষী আবিরের হাত ধরে চলে আসে ঢাকায়। এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই দুজন আমেরিকায় চলে যায়। আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর, বাবা-মা মানুষীর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। মানুষীও এতদিন ভুলে ছিল বাবা-মাকে, একমাত্র ছোট ভাই অনিমেষকে। জয়নগর গ্রামকে, গ্রামের মানুষদের।
কিন্তু ভুলতে চাইলে কি ভুলা যায়? তাই তো এতবছর পর, মানুষী আমেরিকা থেকে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসেছে, গ্রামে যাচ্ছে বাবা-মাকে এক নজর দেখার জন্যে।
আসার সময় আবির বলেছিল, অজানা অচেনা পথ, আমাকে সঙ্গে না নাও, অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
তাতেও মানুষী রাজি হয়নি। বলেছে, প্লিজ, আমাকে আমার মতো করে যেতে দেও। আর খুব বেশি প্রয়োজন না হলে, আমাকে ফোন করো না।
আবির বুঝতে পেরেছিল, এতবছর পর বাবা-মার কাছে যাচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবে অন্য রকম একটা আবেগ থাকবে। সে আবেগে আবির হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি, এখন পর্যন্ত ফোনও করেনি।
মানুষী খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে হাঁটতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটা গর্তে পড়ে পায়ের সেন্ডেলের ফিতে ছিড়ে যায়, পায়ে ব্যাথা পায়।
বাদল একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, মানুষী ‘উ’ করে আওয়াজ করাতে, ও লাগেজটা ওখানে রেখে, ছুটে আসে। মানুষীর কাছে এসে বলে, ম্যাডাম, ব্যাথা পেয়েছেন? বরফ দেয়া লাগবে?
‘বরফ তুমি কোথায় পাবে?’
‘বরফ না পাই, পানি দেই?’
‘লাগবে না। একটু ব্যাথা পেয়েছি, সেরে যাবে। সেন্ডেলটা ছিড়ে গেল, এখন?’
‘আমার হাতে দিন।’
‘কিন্তু খালি পায়ে তো হাঁটতে পারব না।’
একথার উত্তরে বাদল কী বলবে বুঝতে পারে না।
উপায় নেই ভেবে, মানুষী লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে। যাতে করে পথটা তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে যায়।
মানুষীর মনে বাবাকে দেখার, মাকে দেখার আনন্দ জ্বল জ্বল করে। সে আনন্দের জোয়ার এতটা বেশি যে, পায়ের ব্যাথা চাপা পড়ে যায়।
একটু পরেই ওরা পৌঁছে যায় রায়বাড়ি। রাড়িটা দেখে চিনতে পারে না মানুষী। আগে উত্তর-দক্ষিন, দুই পোতায় দু’টি ঘর ছিল, এখন চার পোতায় চারটি ঘর। ঘরের দেয়াল পাকা। ছাদ টিনের। প্রতি ঘরের সিঁড়ির দুপাশে, বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ করা হয়েছে। বেঞ্চে লাল রঙ করা।
মানুষী উঠোনে দাঁড়িয়ে, চারিদিকে তাকায়। ঘরগুলো দেখে মানুষীর ভালো লাগে। উত্তর-পশ্চিম দুই ঘরের কোনে একটি লেবু গাছ। লেবু গাছের পাশে একটি মুরগির খোপ। দুই ঘরে দুটি হারিকেন জ্বলছে। অন্য ঘর দুটো অন্ধকার।
লাগেজটা উঠোনে রেখে বাদল হাক ছাড়ে, নারায়ন জেঠা দেখো কে এসেছে।
‘কেডা?’
‘আমেরিকা থেকে তোমার মেয়ে এসেছে। দরজা খুলে দেখো।’
একমিনিট। দু’মিনিট। তিনমিনিট। ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসে না। দরজাও খোলে না।
এবার মানুষী ব্যাকুল হয়ে বলে, বাবা, আমি মানুষী। তোমাকে দেখতে এসেছি, দরজা খোলো।
এবারও ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।
মানুষী কান্না জড়িত গলায় বলে, মা, ওমা। দরজা খোলো। তোমাদের একনজর দেখে চলে যাব। আমি থাকতে আসিনি।
এবার ভেতর থেকে নারায়ন নামক লোকটি বলে, আমার কোনো মেয়ে নাই। যে ছিল, সে তো অনেক আগে মারা গেছে।
একটু থেমে লোকটি আবার বলে, অনিমেষের মা অসুস্থ্য, এই মাত্র ঘুমায়েছে, তাকে ডাকা যাবে না। ওকে চলে যেতে বলো।
মানুষী কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরহয়ে আসে।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান