জলধি
/ গল্প
/ জগন্নাথ
জগন্নাথ
'জগজীবন রাম ক্লাব'টা কোথায় খোকা ?
সে তো স্বর্গে...
প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার কোরাস-হাসি, ইকো হয়ে গেল--রেলওয়ে-ইয়ার্ডে। ট্রেন থেকে সদ্য নেমেছি। অসীম , অনন্ত, নবকুমার এবং আমি নিজে।
অসীম ধরবে---সস্তায় তবলার গুরু।
অনন্তের চাই---যাত্রার জ্যান্ত-চরিত্র
আমি খুঁজছি---গল্পের প্লট।
নবা' তো পথ হারাতেই ভালোবাসে--সেই বঙ্কিমবাবুর যুগ থেকে! খইনি ডলতে ডলতে নবকুমার একা একাই এগিয়ে গেছে ততক্ষণে, বিশ-কদম। চৈত্রের আকাশ-চাতালে সবে ফুটে উঠছে একটা দুটো সন্ধ্যাতারা ; যেন ফুটকড়াই , তারপর এক আকাশ। এদের নাড়ি নক্ষত্রের খবর আকাশবিদ ছাড়া আর কেইবা রাখে ! --যেমন ফেরিওয়ালা ; অনন্ত আকাশের নিচে নিয়ে বসেছে : পুচকা, ঘুগনি, ঝালমুড়ি, আলুকাবলির পসরা। এদের আদমশুমারি আছে ?
স্টেশন সংলগ্ন ফুটবল মাঠ। খেলার শেষে , জারসি খুলে জটলা করছে ক'জন। নবকুমার তাদেরই পাকড়াও করেছে। জোরসে কদম! --এটা কলবাজার তো ? পুরোনো রেললাইন ? জগন্নাথ সাউকে চেনো ? থাকে কোয়াটার নং ২০৫০....কোনদিকে ভাই সেটা ? --যেন দম দেওয়া ট্রয়ট্রেন ; শিবাইচন্ডী থেকে এসে থেমেছে বর্ধমান-জং। বিশাল প্রশ্নমালা। ছেলেগুলো এ-ওর দিকে তাকায়। তারপর ঠোঁট ওল্টায়।ধন্দে পড়ি আমরা। এতদূর থেকে রেল কোম্পানিকে কতকগুলো টাকা গুনতে এলাম খামকা। ইচ্ছে হল অসীমকে চাবকাই। কাকে না কাকে দেখেছে--'উত্তরপাড়ার সঙ্গীতচক্রে' !
[২ ]
সেবার উত্তরপাড়ায় আসছেন : তবলায়--শামতা প্রসাদ, কিষাণ মহারাজ আর পন্ডিত শ্যামল বোস। বাঁশিতে--পান্নালাল ঘোষ, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া আর প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। কথ্থকে--বিরজু মহারাজ।বেহালায়-শিশিরকণা ধরচৌধুরী। এলাহি ব্যাপার! বুঝলি নবা, অনন্ত, অসীম। আমি তো মাল--তবলার 'ত'ও বুঝিনা! বেহালা তো--বহুদূর--ফুটবলের বাঁশি ছাড়া ফুঁ দিইনি অন্য কোনো বাঁশিতে।
অথচ চিঠির পর চিঠি। রিলে-রেস শুরু করেছে তমালি। আমার দূর-রক্তের মামাতো-বোন। ইতিহাস অনার্সের ছাত্রী। কথ্থক শেখে। কাছে আসতে চায়। রাতভর পাশে বসে তলিয়ে যাবার শাহান-শা সুযোগ। মেয়েকে একলা-একা এ্যালাও করছে না মামা। রওনা দিলাম--ম্যানেজ করলাম মামা-মামিকে। একটা ৩০০টাকার টিকিট দেখলাম গছিয়ে গেছে পাড়ার 'দুষ্মন্ত-দল'। সন্ধ্যায় তমালির মাথায় রিঠা ঘসা চুল। পরনে কচুরিপানাফুল-রঙের চুরিদার। সর্বাঙ্গে--সাওয়ার টু সাওয়ার। কুর্তা-পাঞ্জাবিতে আমিও সেদিন--শাহানশাহ্ শাজাহান। প্রথমেই মঞ্চে এলেন --কৃষাণ মহারাজ। গোপী কৃষাণ না--কে একজনের কথ্থক নৃত্যের সঙ্গে বাজাতে বসলেন।তারপর একেএকে : হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, শ্যামল বোস প্রমুখ এলেন। কোথা দিয়ে পল-মিনিট থেকে কাবার মধ্যরাত। পেটে খিদে, চেপে বসেছে--ধোঁয়ার নেশা। হল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। সামনেই পেলাম এক ভেলপুরিওলাকে। তাই-ই খেলাম--দু-ঠোঙা। কিন্ত ভেলপুরি বেচার চেয়ে, লক্ষ্য করলাম--তবলা লহরায় তার মন বেশি। যেন বেচতে হয় তাই বেচছে--আসলে সেও শুনতে এসেছে, উচ্চাঙ্গসংগীত। ভেলপুরিতে টমেটো-সস ছড়ানো ভুলে কেবলই বলে উঠছে :"আহা-হা, এহি হ্যায় শামতাপ্রসাদ ! শুনছেন, ত্রিতালের ঠেকা :
ধা ধিন ধিন ধা / ধা ধিন ধিন ধা
না তিন তিন না / না ধিন ধিন ধা।
আমি আর তমালি তো-'থ' ! একজন
ভেলপুরিওলার একি তবলা-প্রীতি! মুখ চলার ফাঁকে , আস্তে আস্তে তাকে উস্কে দিতে লাগল তমালি। --বিহারের বিখ্যাত তবলা-বাদক কে, জানেন ? --জরুর! এহেমেজান থেরুকুয়া। বাপরে বাপ! সে কি তবলা লহরা--শুদ্ধু হাত দেখা যায়! থথ্থর করে কাঁপে--তবলা-বাঁয়া--নাম তাই থেরুকুয়া। এই যে শামতাপ্রসাদ-কে দেখলেন, তাঁর গুরু। বলেই , প্রণাম করল হাতজোড় করে। ততক্ষনে ভেলপুরিওলার নাম জেনে গেছি--জগন্নাথ সাউ। সাকিন-ঠিকানাও বিনিময় হয়ে গেছে : বর্ধমান কলবাজার, পুরোনো লাইন। জগজীবনরাম ক্লাবের সামনেই। কোয়াটার নাম্বার ২০৫০।
--আচ্ছা জগন্নাথজি ! তুমি তবলা বাজাতে পারো ? বাজাতে ভি শিখেছিলাম--লেকিন , সংসার হামাকেই তবলা বানিয়ে ছাড়লে। --কি রকম, কি রকম! ছিলাম রেলের গ্যাংম্যান। পনেরো টাকা মাস মাইনে। না বিড়ি, না চা--নেশা বলতে ছিল তবলা। প্রথম শিক্ষা দুপুরে টেবিল চাপড়ে --ক্যান্টিনে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সাত সকালের একবেলা রাঁধা ভাত গেঁজে যেত তখন। তাই-ই এক জামবাটি খেতাম পেটভরে। নেশা উঠত--ঢুলুঢুলু। সামনেই পেতাম চাঁচপোঁচ মেটে হাঁড়ি। ওই হাঁড়িতেই বেজে উঠত হস্তসাধনার বোল-বাণী :
. / / / /
তে রে কে টে
.+
. / / / / / / /
ধা ধা তে টে | ধা ধা থুন্ না।
.°
. / / / / / / / / +
তা তা তে টে | তা তা থুন্ না। ধা।।
[৩ ]
আমার তবলার আওয়াজে এ তল্লাটে কাক-পক্ষী ডানা মেলত প্রথম। সুয্যি , চোখ রগড়ে উঠে বসত বিছানায়। ঘুমঘুম চাঁদ টেনে নিত মাথার বালিশ...। বা:! ভারি ভালো বাংলা বলত তুমি , --জগন্নাথজি ! হিন্দি-বাংলা মেশানো ভাষা--যেন তোমার হাতের ভেলপুরি! কি তমালি, চলবে নাকি, আর এক ঠোঁঙা? মঞ্চে তখন, সেতারে বেজে উঠল কী যেন এক রাগ! গম্ভীর-করুণ অনবদ্য এক মিশ্রণ সেই রাগে। তমালি বললে : 'দরবারি কানাড়া'। ---'দর বাড়াচ্ছ নিজের!' 'না না, ঠিক ধরেছে খুকুমণি। যান যান, ভিতরে যান ; বিলায়েৎ খাঁর সিতার বাদন শুনুন! 'ছ্যাঃ! একজন সামান্য ছোলা-বাদামওলারও অযোগ্য তুমি। আবার মস্করা হচ্ছে !'--ভিতরে ঢুকে যায় তমালি।
[ ৪ ]
অসীমের মুখে শুনেই পোকাটা নড়ে ওঠে অনন্তর। গুড়বাড়ির যাত্রাপালায় বিপ্লব এবার সে ঘটাবেই। রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে টানা এক সপ্তাহ যাত্রাপালা। 'পিথা-পরমহংস পার্টি' এবার নামাচ্ছে : "ঘুমন্ত ঘুগনিওলা"। জগন্নাথ-তবলচির 'সত্যি হলেও গল্প'--শোনার পর তাকে নিয়ে ছিলা ছিঁড়ে যাচ্ছে অনন্তর। এবার রাসে রক্তগঙ্গা বইবে। যাত্রার মারকাটারি টাইটেল সেভাবেই লটকে রয়েছে দেওয়াল লিখন হয়ে। ঘাড় ঘোরালেই কোপ! : 'শ্মশানে হল ফুলশয্যা', 'ভোটে দাঁড়াচ্ছে ভাদ্দর-বৌ', 'ফাঁসির মঞ্চে মাটির মা', 'বাবু গো, ভালোবাসা ভালো নয়', 'অলক্ষ্মী'দি অঞ্চলপ্রধান'।
অনন্তকৃষ্ণ বসু--এম.এ.বি.এড.[বাংলা ]--হেলে পড়া সাইনবোর্ডটা, দাঁড়িপাল্লার মতো সটান সোজা করে নেয় অনন্তের স্ত্রী। মুখের বাষ্প দিয়ে, আঁচল বুলিয়ে দেয় দু-বার : মাধ্যমিক হইতে এম.এ.পর্যন্ত সন্তর্পনে বাংলা-নোটস ও সাজেশন দাতা, যত্নপূর্বক পাঠদান, অবসরে যাত্রাপালার পরামর্শদাতা ; সর্বোপরি উদীয়মান পালাকার [ 'রাতের রাধেশ্যাম' খ্যাত ]। 'সারারাত সাহিত্যের হাল-চষেছেন বাবু'-- লেবু-চা টেবিলে নামিয়ে, সোহাগ করে ঘুমন্ত স্বামীকে। অনন্তর স্ত্রী অন্তরা। এ তল্লাটের যাত্রা-সম্রাজ্ঞী। মরশুমে ১০০১ টাকা রোজে পালার খেপ খাটে। মাছির ডানার মতো স্লাইড গোঁফ ; বাঁ-চিবুকের চিলতে তিল অবশ্য ব্যালেন্স এনেছে --মুখ-লাবন্যে। ওই গোঁফ-জোড়া দেখেই , মাকুন্দ-অনন্তের প্রথম প্রেম গজিয়ে ওঠে।
--কিগো, কী নাম রাখলে যাত্রাপালার ? অনন্ত ধরমড়িয়ে উঠে বসল। আড় ভাঙল খানিক। তার বউ রিপিট করল-- কি, নতুন যাত্রাপালার খুঁজে পেলে কিছু নাম ! লাজুক চোখে অনন্ত তাকাল, অন্তরার দিকে। লেবু চায়ে চুমুক দিল। তারপর বাসি দাঁতে হেসে উঠল হো হো করে। রহস্য হচ্ছে ! আমি যে আর ধরে রাখতে পারছি না সাসপেন্স। বলো না, কি নাম রাখলে ? --'আঁধারের আলুকাবলিওলা'--বলেই বউকে সটান তুলে নিল মাথায়। --'মারভেলাস্ !' অনন্তর মাথায় দমাদম কিল মেরে আলুথালু করে দিল তার চুল--অন্তরা। 'ঘুমন্ত ঘুগনিওলা'র নাকে ঝামা ঘসে দেওয়ার মতো নাম বটে !
'পিথা পরমহংস পার্টি'-র উপর হাড়ে চটা অন্তরা। দলের কর্নধার ভবদেব বেতাল মহা ধড়িবাজ। স্রেফ বড় বড় বাতলিং--দূরদর্শনের সঙ্গে দু-বেলা নাকি বাবুর ওঠাবসা--এই আফিং ধরিয়ে আত্মসাৎ করে নেয় অনন্তর প্রথম যাত্রাপালা। টি.ভি.তে সত্যিই দেখান হয়েছিল : 'লায়লা মজনু' , 'রক্তাক্ত মসনদ' এবং 'রাতের রাধেশ্যাম'। পালাকার হিসেবে, কোথাও কিন্তু ভেসে ওঠেনি--অনন্তর নাম। শুধুই নির্দেশক --ভবদেব বেতাল। কেবল তাই-ই নয়, নায়িকা হিসেবেও প্রথম সিলেক্ট হয়েছিল--অন্তরা। ভব দেব এক্ষেত্রেও পাকাল ঘোঁট। শেষ পর্যন্ত নিল কিনা শালী--কমলিকাকে!
এবার নিজেই দল খুলেছে অনন্ত। অভিনয়ে আশপাশ গ্রামের সব টাটকা-মুখ। অবশ্য, স্ত্রী-অন্তরা নায়িকা হলেও, সমস্ত ফোকাস গিয়ে পড়েছে--জগন্নাথ তবলচির মুখে। এক্ষেত্রে কোনো কম্প্রমাইজ করার পাত্র নয় অনন্ত।পালায়-- চরিত্রের যার যা পাওনা, তাকে তা দিতে হবে বৈকি ! যাত্রার জলজ্যান্ত চরিত্র। শরীরে তেমন রক্ত নেই--মাংসও। নো মেকআপ্ নো ড্রেস। যেন , দর্শকদের মধ্যেই বেচছিল : পুচকা-চানা-ভেলপুরি-আলুকাবলি-ঝালমুড়ি... যাত্রা-শুরুর দেরি দেখে, সোজা উঠে এসেছে স্টেজে। সঙ্গে তার আদি-অকৃত্রিম--ঠ্যালাগাড়ি।
সে তো স্বর্গে...
প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার কোরাস-হাসি, ইকো হয়ে গেল--রেলওয়ে-ইয়ার্ডে। ট্রেন থেকে সদ্য নেমেছি। অসীম , অনন্ত, নবকুমার এবং আমি নিজে।
অসীম ধরবে---সস্তায় তবলার গুরু।
অনন্তের চাই---যাত্রার জ্যান্ত-চরিত্র
আমি খুঁজছি---গল্পের প্লট।
নবা' তো পথ হারাতেই ভালোবাসে--সেই বঙ্কিমবাবুর যুগ থেকে! খইনি ডলতে ডলতে নবকুমার একা একাই এগিয়ে গেছে ততক্ষণে, বিশ-কদম। চৈত্রের আকাশ-চাতালে সবে ফুটে উঠছে একটা দুটো সন্ধ্যাতারা ; যেন ফুটকড়াই , তারপর এক আকাশ। এদের নাড়ি নক্ষত্রের খবর আকাশবিদ ছাড়া আর কেইবা রাখে ! --যেমন ফেরিওয়ালা ; অনন্ত আকাশের নিচে নিয়ে বসেছে : পুচকা, ঘুগনি, ঝালমুড়ি, আলুকাবলির পসরা। এদের আদমশুমারি আছে ?
স্টেশন সংলগ্ন ফুটবল মাঠ। খেলার শেষে , জারসি খুলে জটলা করছে ক'জন। নবকুমার তাদেরই পাকড়াও করেছে। জোরসে কদম! --এটা কলবাজার তো ? পুরোনো রেললাইন ? জগন্নাথ সাউকে চেনো ? থাকে কোয়াটার নং ২০৫০....কোনদিকে ভাই সেটা ? --যেন দম দেওয়া ট্রয়ট্রেন ; শিবাইচন্ডী থেকে এসে থেমেছে বর্ধমান-জং। বিশাল প্রশ্নমালা। ছেলেগুলো এ-ওর দিকে তাকায়। তারপর ঠোঁট ওল্টায়।ধন্দে পড়ি আমরা। এতদূর থেকে রেল কোম্পানিকে কতকগুলো টাকা গুনতে এলাম খামকা। ইচ্ছে হল অসীমকে চাবকাই। কাকে না কাকে দেখেছে--'উত্তরপাড়ার সঙ্গীতচক্রে' !
[২ ]
সেবার উত্তরপাড়ায় আসছেন : তবলায়--শামতা প্রসাদ, কিষাণ মহারাজ আর পন্ডিত শ্যামল বোস। বাঁশিতে--পান্নালাল ঘোষ, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া আর প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। কথ্থকে--বিরজু মহারাজ।বেহালায়-শিশিরকণা ধরচৌধুরী। এলাহি ব্যাপার! বুঝলি নবা, অনন্ত, অসীম। আমি তো মাল--তবলার 'ত'ও বুঝিনা! বেহালা তো--বহুদূর--ফুটবলের বাঁশি ছাড়া ফুঁ দিইনি অন্য কোনো বাঁশিতে।
অথচ চিঠির পর চিঠি। রিলে-রেস শুরু করেছে তমালি। আমার দূর-রক্তের মামাতো-বোন। ইতিহাস অনার্সের ছাত্রী। কথ্থক শেখে। কাছে আসতে চায়। রাতভর পাশে বসে তলিয়ে যাবার শাহান-শা সুযোগ। মেয়েকে একলা-একা এ্যালাও করছে না মামা। রওনা দিলাম--ম্যানেজ করলাম মামা-মামিকে। একটা ৩০০টাকার টিকিট দেখলাম গছিয়ে গেছে পাড়ার 'দুষ্মন্ত-দল'। সন্ধ্যায় তমালির মাথায় রিঠা ঘসা চুল। পরনে কচুরিপানাফুল-রঙের চুরিদার। সর্বাঙ্গে--সাওয়ার টু সাওয়ার। কুর্তা-পাঞ্জাবিতে আমিও সেদিন--শাহানশাহ্ শাজাহান। প্রথমেই মঞ্চে এলেন --কৃষাণ মহারাজ। গোপী কৃষাণ না--কে একজনের কথ্থক নৃত্যের সঙ্গে বাজাতে বসলেন।তারপর একেএকে : হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, শ্যামল বোস প্রমুখ এলেন। কোথা দিয়ে পল-মিনিট থেকে কাবার মধ্যরাত। পেটে খিদে, চেপে বসেছে--ধোঁয়ার নেশা। হল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। সামনেই পেলাম এক ভেলপুরিওলাকে। তাই-ই খেলাম--দু-ঠোঙা। কিন্ত ভেলপুরি বেচার চেয়ে, লক্ষ্য করলাম--তবলা লহরায় তার মন বেশি। যেন বেচতে হয় তাই বেচছে--আসলে সেও শুনতে এসেছে, উচ্চাঙ্গসংগীত। ভেলপুরিতে টমেটো-সস ছড়ানো ভুলে কেবলই বলে উঠছে :"আহা-হা, এহি হ্যায় শামতাপ্রসাদ ! শুনছেন, ত্রিতালের ঠেকা :
ধা ধিন ধিন ধা / ধা ধিন ধিন ধা
না তিন তিন না / না ধিন ধিন ধা।
আমি আর তমালি তো-'থ' ! একজন
ভেলপুরিওলার একি তবলা-প্রীতি! মুখ চলার ফাঁকে , আস্তে আস্তে তাকে উস্কে দিতে লাগল তমালি। --বিহারের বিখ্যাত তবলা-বাদক কে, জানেন ? --জরুর! এহেমেজান থেরুকুয়া। বাপরে বাপ! সে কি তবলা লহরা--শুদ্ধু হাত দেখা যায়! থথ্থর করে কাঁপে--তবলা-বাঁয়া--নাম তাই থেরুকুয়া। এই যে শামতাপ্রসাদ-কে দেখলেন, তাঁর গুরু। বলেই , প্রণাম করল হাতজোড় করে। ততক্ষনে ভেলপুরিওলার নাম জেনে গেছি--জগন্নাথ সাউ। সাকিন-ঠিকানাও বিনিময় হয়ে গেছে : বর্ধমান কলবাজার, পুরোনো লাইন। জগজীবনরাম ক্লাবের সামনেই। কোয়াটার নাম্বার ২০৫০।
--আচ্ছা জগন্নাথজি ! তুমি তবলা বাজাতে পারো ? বাজাতে ভি শিখেছিলাম--লেকিন , সংসার হামাকেই তবলা বানিয়ে ছাড়লে। --কি রকম, কি রকম! ছিলাম রেলের গ্যাংম্যান। পনেরো টাকা মাস মাইনে। না বিড়ি, না চা--নেশা বলতে ছিল তবলা। প্রথম শিক্ষা দুপুরে টেবিল চাপড়ে --ক্যান্টিনে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সাত সকালের একবেলা রাঁধা ভাত গেঁজে যেত তখন। তাই-ই এক জামবাটি খেতাম পেটভরে। নেশা উঠত--ঢুলুঢুলু। সামনেই পেতাম চাঁচপোঁচ মেটে হাঁড়ি। ওই হাঁড়িতেই বেজে উঠত হস্তসাধনার বোল-বাণী :
. / / / /
তে রে কে টে
.+
. / / / / / / /
ধা ধা তে টে | ধা ধা থুন্ না।
.°
. / / / / / / / / +
তা তা তে টে | তা তা থুন্ না। ধা।।
[৩ ]
আমার তবলার আওয়াজে এ তল্লাটে কাক-পক্ষী ডানা মেলত প্রথম। সুয্যি , চোখ রগড়ে উঠে বসত বিছানায়। ঘুমঘুম চাঁদ টেনে নিত মাথার বালিশ...। বা:! ভারি ভালো বাংলা বলত তুমি , --জগন্নাথজি ! হিন্দি-বাংলা মেশানো ভাষা--যেন তোমার হাতের ভেলপুরি! কি তমালি, চলবে নাকি, আর এক ঠোঁঙা? মঞ্চে তখন, সেতারে বেজে উঠল কী যেন এক রাগ! গম্ভীর-করুণ অনবদ্য এক মিশ্রণ সেই রাগে। তমালি বললে : 'দরবারি কানাড়া'। ---'দর বাড়াচ্ছ নিজের!' 'না না, ঠিক ধরেছে খুকুমণি। যান যান, ভিতরে যান ; বিলায়েৎ খাঁর সিতার বাদন শুনুন! 'ছ্যাঃ! একজন সামান্য ছোলা-বাদামওলারও অযোগ্য তুমি। আবার মস্করা হচ্ছে !'--ভিতরে ঢুকে যায় তমালি।
[ ৪ ]
অসীমের মুখে শুনেই পোকাটা নড়ে ওঠে অনন্তর। গুড়বাড়ির যাত্রাপালায় বিপ্লব এবার সে ঘটাবেই। রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে টানা এক সপ্তাহ যাত্রাপালা। 'পিথা-পরমহংস পার্টি' এবার নামাচ্ছে : "ঘুমন্ত ঘুগনিওলা"। জগন্নাথ-তবলচির 'সত্যি হলেও গল্প'--শোনার পর তাকে নিয়ে ছিলা ছিঁড়ে যাচ্ছে অনন্তর। এবার রাসে রক্তগঙ্গা বইবে। যাত্রার মারকাটারি টাইটেল সেভাবেই লটকে রয়েছে দেওয়াল লিখন হয়ে। ঘাড় ঘোরালেই কোপ! : 'শ্মশানে হল ফুলশয্যা', 'ভোটে দাঁড়াচ্ছে ভাদ্দর-বৌ', 'ফাঁসির মঞ্চে মাটির মা', 'বাবু গো, ভালোবাসা ভালো নয়', 'অলক্ষ্মী'দি অঞ্চলপ্রধান'।
অনন্তকৃষ্ণ বসু--এম.এ.বি.এড.[বাংলা ]--হেলে পড়া সাইনবোর্ডটা, দাঁড়িপাল্লার মতো সটান সোজা করে নেয় অনন্তের স্ত্রী। মুখের বাষ্প দিয়ে, আঁচল বুলিয়ে দেয় দু-বার : মাধ্যমিক হইতে এম.এ.পর্যন্ত সন্তর্পনে বাংলা-নোটস ও সাজেশন দাতা, যত্নপূর্বক পাঠদান, অবসরে যাত্রাপালার পরামর্শদাতা ; সর্বোপরি উদীয়মান পালাকার [ 'রাতের রাধেশ্যাম' খ্যাত ]। 'সারারাত সাহিত্যের হাল-চষেছেন বাবু'-- লেবু-চা টেবিলে নামিয়ে, সোহাগ করে ঘুমন্ত স্বামীকে। অনন্তর স্ত্রী অন্তরা। এ তল্লাটের যাত্রা-সম্রাজ্ঞী। মরশুমে ১০০১ টাকা রোজে পালার খেপ খাটে। মাছির ডানার মতো স্লাইড গোঁফ ; বাঁ-চিবুকের চিলতে তিল অবশ্য ব্যালেন্স এনেছে --মুখ-লাবন্যে। ওই গোঁফ-জোড়া দেখেই , মাকুন্দ-অনন্তের প্রথম প্রেম গজিয়ে ওঠে।
--কিগো, কী নাম রাখলে যাত্রাপালার ? অনন্ত ধরমড়িয়ে উঠে বসল। আড় ভাঙল খানিক। তার বউ রিপিট করল-- কি, নতুন যাত্রাপালার খুঁজে পেলে কিছু নাম ! লাজুক চোখে অনন্ত তাকাল, অন্তরার দিকে। লেবু চায়ে চুমুক দিল। তারপর বাসি দাঁতে হেসে উঠল হো হো করে। রহস্য হচ্ছে ! আমি যে আর ধরে রাখতে পারছি না সাসপেন্স। বলো না, কি নাম রাখলে ? --'আঁধারের আলুকাবলিওলা'--বলেই বউকে সটান তুলে নিল মাথায়। --'মারভেলাস্ !' অনন্তর মাথায় দমাদম কিল মেরে আলুথালু করে দিল তার চুল--অন্তরা। 'ঘুমন্ত ঘুগনিওলা'র নাকে ঝামা ঘসে দেওয়ার মতো নাম বটে !
'পিথা পরমহংস পার্টি'-র উপর হাড়ে চটা অন্তরা। দলের কর্নধার ভবদেব বেতাল মহা ধড়িবাজ। স্রেফ বড় বড় বাতলিং--দূরদর্শনের সঙ্গে দু-বেলা নাকি বাবুর ওঠাবসা--এই আফিং ধরিয়ে আত্মসাৎ করে নেয় অনন্তর প্রথম যাত্রাপালা। টি.ভি.তে সত্যিই দেখান হয়েছিল : 'লায়লা মজনু' , 'রক্তাক্ত মসনদ' এবং 'রাতের রাধেশ্যাম'। পালাকার হিসেবে, কোথাও কিন্তু ভেসে ওঠেনি--অনন্তর নাম। শুধুই নির্দেশক --ভবদেব বেতাল। কেবল তাই-ই নয়, নায়িকা হিসেবেও প্রথম সিলেক্ট হয়েছিল--অন্তরা। ভব দেব এক্ষেত্রেও পাকাল ঘোঁট। শেষ পর্যন্ত নিল কিনা শালী--কমলিকাকে!
এবার নিজেই দল খুলেছে অনন্ত। অভিনয়ে আশপাশ গ্রামের সব টাটকা-মুখ। অবশ্য, স্ত্রী-অন্তরা নায়িকা হলেও, সমস্ত ফোকাস গিয়ে পড়েছে--জগন্নাথ তবলচির মুখে। এক্ষেত্রে কোনো কম্প্রমাইজ করার পাত্র নয় অনন্ত।পালায়-- চরিত্রের যার যা পাওনা, তাকে তা দিতে হবে বৈকি ! যাত্রার জলজ্যান্ত চরিত্র। শরীরে তেমন রক্ত নেই--মাংসও। নো মেকআপ্ নো ড্রেস। যেন , দর্শকদের মধ্যেই বেচছিল : পুচকা-চানা-ভেলপুরি-আলুকাবলি-ঝালমুড়ি... যাত্রা-শুরুর দেরি দেখে, সোজা উঠে এসেছে স্টেজে। সঙ্গে তার আদি-অকৃত্রিম--ঠ্যালাগাড়ি।
[৫ ]
জমবে হেভি--কি বলো অন্তরা! এমন স্ট্যান্টবাজি , ক-টা পালায় দর্শকরা পাবে জানিনা। শুনেছি , এককালে তবলায় তাবড়-তাবড় তবলচিকেও চমকে দিয়েছে জগন্নাথ।' --'হ্যাঁ--কেরামতুল্লা, আল্লারাখা পর্যন্ত তার আলুকাবলি চেখে গেছে..' অন্তরা চিমটি কাটে অনন্তকে। অনন্তও বুঝে গেছে , গন্ডারের চামড়াটাই স্যুট্ করে , সংসারী মানুষের। কথা না বাড়িয়ে তাই বলে : 'ধরো সেই লোকনৃত্যটা ; যেখানে তবলায় সঙ্গত করতে করতে মুখে রক্ত উঠছে , তবলচি-বাবা জগন্নাথের :
আরে,মাছ মাইরতে গেল শ্যাম বুড়ির বাঁধের জলে
চ্যাং মাছের খাপুর খাপুর কদম্বেরই তলে
. তুমহে বাঁশি ফুঁক।
. শ্যাম বাঁশি ফুঁক-অ-অ-অ।
পান্তা খাঁয়ে গামছা গায়ে, ঘুরছে পথে...
. রাধিকা সুন্দরী
তার--স্বামী খেদাইছে , কুল ভাঙাইছে
. রক্ষা কর হরি--
. তার মান রাখ ।
চ্যাং মাছের ঝোল খাঁইয়ে চল বৃন্দাবন
ভাদর মাসে ভজ কৃষ্ট রাধিকা মতোন
---দর্শকদের গায়ে একেবারে দাঁত ফুটিয়ে দেওয়ার মতো এ্যাকটিং চাই অন্তরা। হেসে ফেলে যাত্রা সম্রাজ্ঞী : 'তা নয় হবে , হ্যাঁগো! ওই আলুকাবলিওলাটাকে এখনও চোখেই দেখিনি। সবটাই অসীম-ঠাকুরপোর মুখে শোনা। ভাষায় হিন্দিভাষী। বাপের জন্মে যাত্রা টাত্রা করা দূরে থাক, শুনেছে তো ?' --'সেটাই তো পালাকার হিসাবে আমার প্লাস- পয়েন্ট অন্তরা! নদী আগাবে তার নিজস্ব গতিপথে। দু-দিকের নিয়মহীন কুলপ্লাবী বন্যায় পলি ফেলবে দর্শকের মনে। নতুন শস্য ফুটে উঠবে যাত্রাপালায়!'
. [৬ ]
--'এ্যাই ঝালমুড়ি , ইধার আও' অসীম হাতছানি দিল।--এই সব লাইনের-লোককে ধরতে হয় গাধা ; তা নয় কতকগুলো চ্যাংড়া ফাজিল ফুটবলার!' 'জগন্নাথ তবলচি কোথায় থাকে?'—এ প্রশ্নের জিজ্ঞাসায় , ব্যাজারমুখে পা-বাড়ালো ঝালমুড়ি। ভরসন্ধ্যেয় কোথায় বউনি হবে , তা নয়! আঙুল তুলে দেখাল--'পুছো ফুচকাওলাকো।' ফুচকাওলা আবার গলায় ওজন এনে বললে : 'বতাও বাদামওলাকো...'
. মনে হল , সবাই শশব্যস্ত। মাথায় ভারি খাবার-দাবারও দস্তুরমতো। নিদ্দির্ষ্ট কোনো গন্তব্যস্থলের দিকেই তারা যেন দৌড়চ্ছে। তাদের অনুসরণ করলাম আমরাও। পৌঁছে গেলাম এক আশ্চর্য মেহফিল্-এ! __'কোলকাতার মতো মফস্বলও তাহলে টপাটপ গিলছে--রবি, তারা...।' স্টেডিয়ামের গেটে পৎপৎ করে উড্ডীন ব্যানারের দিকে আঙুল বাড়াল নবকুমার : রবিশংকর-আলি আকবর-জাকিরহোসেন...।
. অনন্ত আড়চোখে অসীমের দিকে তাকাল : 'বাঙালি বড় শয়তান ; ক্লাসিকাল বোঝে কচু , ভান করে ভয়ঙ্কর ! তার কথায় কর্ণপাতের পরিবর্তে , হৈহৈ করে উঠল অসীম--জয় জগন্নাথ ! দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ফেরিওলার দিকে তাকিয়ে ,অনন্ত পলক ফেলতে পারেনা বহুক্ষণ।কল্পনায় এমনই এক সওদাগরের তল্লাস করছিল সে! চুনসাদা চুল , লাল গামছা- পাগড়ি মাথায়,সাদা ইঁদুরের মতো ইয়া তা-দেওয়া গোঁফ ; অন্তত আশি ছোঁয়া বয়সেও চিতাবাঘের মতো জ্বলন্ত চোখ! ওফ্! এই না হলে তবলার ওস্তাদ--যাবতীয় বোল-বাণীকে যেন পোষা পায়রার মতো, নিজস্ব পাগড়িতে জ্যান্ত পুষে রেখেছে !
. আড়চোখে একবার অসীমের দিকে তাকিয়েই , জগন্নাথের পায়ে হঠাৎ হত্যে দিয়ে পড়ে অনন্ত। অসীমকে আজ খাপ খুলতে দিলে চলবে না। সটান-শয়ান : 'উদ্ধার করুন আমাকে ওস্তাদজি। বড় বিপদে পড়ে শরণাপন্ন হয়েছি আপনার!'
. হতভম্ব হয়ে পড়ে জগন্নাথ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় যাবতীয় খদ্দের তার! আমরাও বেপথু হয়ে পড়ি অনন্তের নিখুঁত অভিনয়ে।তার সমস্যার কথা সবিস্তারে জানায় অনন্ত।জীবনে কোনোদিন কপট অভিনয় পর্যন্ত করেনি হতদরিদ্র জগন্নাথ।সন্তানবৎ-অনন্তকে কথা দিয়ে দেয় সে। এই আলুকাবলিওলাকে দিয়ে যদি তার বিন্দুমাত্রও উপকার হয়, তবে ৮০ বছর বয়সেও সে জান লড়িয়ে দেবে। শিল্পী, সাহিত্যিকরা সব 'দেওতা' ! তাদের হররোজ কুর্নিশ দেয় সে।
[ ৭ ]
এত তাড়াতাড়ি , বুড়োটাকে বোতলবন্দী করতে পারবে , ভাবেনি অনন্ত। অন্তরাও কি ছাই আন্দাজ করতে পেরেছিল এতখানি! সারাসন্ধে সে ঘরবার করেছে--টেনশনে। যাত্রার রিহার্সাল বসে তাদের বাড়িতেই। অনন্তের অবর্তমানে, তাকেই তদারকি করতে হয়েছে আজ। মন কিন্তু ছুটে গেছে জানালায় ; প্রতিটা ডাউন ট্রেনের ডাকে।
. রাত তখন ১২ টা হবে। তিন ব্যাটারি টর্চ আছড়ে পড়ল অনন্তের। তাদের টিনের ঘরে , সেই আলোয় , অন্তরার স্পষ্ট মনে হল : লাল- গামছায়, এক বুড়ো-সাদা-ঘোড়াকে বেঁধে--বাড়ি ফিরছে তার নবীন সওদাগর। --দেখো, খুঁজে এনেছি বাবাকে! --অন্তরা প্রণাম করল ঢিপ করে! বৃদ্ধ বাপ জ্ঞানে, নাকি যাত্রার লক্ষ্মীরূপে--অথবা আজ থেকেই শুরু হল সত্যিকার রিহার্সাল ; তার আনত-ভঙ্গিতে আন্দাজ পাবে ? 'দেবা ন জানন্তি...' !
. দুটোকে তিনটে করলেও চলত এত রাত্রে। তবু্ও কুকারে চাপিয়ে দিল চারটি চাল। পেঁয়াজ কেটে ডিম ভাজল পরিপাটি : 'নাও বাবা, গরম গরম খেয়ে নাও...'।
[ ৮ ]
. উঁহু , হল না--পহলে সে বোলো-- গোড়া থেকে শুরু : " টিউশনি সেরে আমার ফিরতে রাত হবে মা..তুই আবার থালা সাজিয়ে বসে থাকিস না যেন, খেয়ে নিস"। --তিনদিন ধরে এই দৃশ্যটাতেই জগন্নাথের রথ, আটকে রয়েছে। কালঘাম ছুটে যাচ্ছে অনন্তর। বারংবার অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে।এদিকে জগন্নাথের :বাড়ি বাড়ি তবলায় চাঁটি মেরেও তাহলে , মানুষ বেঁচে-বর্তে থাকে--এই অনুভবে পৌঁছাতেই শিহরণ জাগে! সে শুধুই বিড়বিড় করে : "তবলা-বেচে আবার পয়সা নেব কি বাপ.."
. অন্তরা খিঁচিয়ে ওঠে অনন্তকে খুব : 'এই জন্যই বলেছিলাম, ফুটপাতের ফুটকড়াইওলাকে দিয়ে আর যা হোক, অভিনয় হয় না..।' যাত্রাপার্টির অন্যরাও হৈচৈ করে খুব : 'বর্ধমানের দামোদর সেঁচে, দাদা আমাদের নায়ক এনেছে বটে !'
. জগন্নাথ ভারি জব্দ হয় এদের কাছে। হাত ঘুরিয়ে স্বগতোক্তি করে : 'ক্যায় করুঙ্গা ম্যায় !' রাগে ফেটে পড়ে অনন্ত : 'পন্ডশ্রম হল আমার।সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ। যাও, যাও--চা বানাও বাবুদের। চেলা কাঠ ফাড়ো গে--গিন্নিমা'র। বুরবাক কাঁহাকা।'
জমবে হেভি--কি বলো অন্তরা! এমন স্ট্যান্টবাজি , ক-টা পালায় দর্শকরা পাবে জানিনা। শুনেছি , এককালে তবলায় তাবড়-তাবড় তবলচিকেও চমকে দিয়েছে জগন্নাথ।' --'হ্যাঁ--কেরামতুল্লা, আল্লারাখা পর্যন্ত তার আলুকাবলি চেখে গেছে..' অন্তরা চিমটি কাটে অনন্তকে। অনন্তও বুঝে গেছে , গন্ডারের চামড়াটাই স্যুট্ করে , সংসারী মানুষের। কথা না বাড়িয়ে তাই বলে : 'ধরো সেই লোকনৃত্যটা ; যেখানে তবলায় সঙ্গত করতে করতে মুখে রক্ত উঠছে , তবলচি-বাবা জগন্নাথের :
আরে,মাছ মাইরতে গেল শ্যাম বুড়ির বাঁধের জলে
চ্যাং মাছের খাপুর খাপুর কদম্বেরই তলে
. তুমহে বাঁশি ফুঁক।
. শ্যাম বাঁশি ফুঁক-অ-অ-অ।
পান্তা খাঁয়ে গামছা গায়ে, ঘুরছে পথে...
. রাধিকা সুন্দরী
তার--স্বামী খেদাইছে , কুল ভাঙাইছে
. রক্ষা কর হরি--
. তার মান রাখ ।
চ্যাং মাছের ঝোল খাঁইয়ে চল বৃন্দাবন
ভাদর মাসে ভজ কৃষ্ট রাধিকা মতোন
---দর্শকদের গায়ে একেবারে দাঁত ফুটিয়ে দেওয়ার মতো এ্যাকটিং চাই অন্তরা। হেসে ফেলে যাত্রা সম্রাজ্ঞী : 'তা নয় হবে , হ্যাঁগো! ওই আলুকাবলিওলাটাকে এখনও চোখেই দেখিনি। সবটাই অসীম-ঠাকুরপোর মুখে শোনা। ভাষায় হিন্দিভাষী। বাপের জন্মে যাত্রা টাত্রা করা দূরে থাক, শুনেছে তো ?' --'সেটাই তো পালাকার হিসাবে আমার প্লাস- পয়েন্ট অন্তরা! নদী আগাবে তার নিজস্ব গতিপথে। দু-দিকের নিয়মহীন কুলপ্লাবী বন্যায় পলি ফেলবে দর্শকের মনে। নতুন শস্য ফুটে উঠবে যাত্রাপালায়!'
. [৬ ]
--'এ্যাই ঝালমুড়ি , ইধার আও' অসীম হাতছানি দিল।--এই সব লাইনের-লোককে ধরতে হয় গাধা ; তা নয় কতকগুলো চ্যাংড়া ফাজিল ফুটবলার!' 'জগন্নাথ তবলচি কোথায় থাকে?'—এ প্রশ্নের জিজ্ঞাসায় , ব্যাজারমুখে পা-বাড়ালো ঝালমুড়ি। ভরসন্ধ্যেয় কোথায় বউনি হবে , তা নয়! আঙুল তুলে দেখাল--'পুছো ফুচকাওলাকো।' ফুচকাওলা আবার গলায় ওজন এনে বললে : 'বতাও বাদামওলাকো...'
. মনে হল , সবাই শশব্যস্ত। মাথায় ভারি খাবার-দাবারও দস্তুরমতো। নিদ্দির্ষ্ট কোনো গন্তব্যস্থলের দিকেই তারা যেন দৌড়চ্ছে। তাদের অনুসরণ করলাম আমরাও। পৌঁছে গেলাম এক আশ্চর্য মেহফিল্-এ! __'কোলকাতার মতো মফস্বলও তাহলে টপাটপ গিলছে--রবি, তারা...।' স্টেডিয়ামের গেটে পৎপৎ করে উড্ডীন ব্যানারের দিকে আঙুল বাড়াল নবকুমার : রবিশংকর-আলি আকবর-জাকিরহোসেন...।
. অনন্ত আড়চোখে অসীমের দিকে তাকাল : 'বাঙালি বড় শয়তান ; ক্লাসিকাল বোঝে কচু , ভান করে ভয়ঙ্কর ! তার কথায় কর্ণপাতের পরিবর্তে , হৈহৈ করে উঠল অসীম--জয় জগন্নাথ ! দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ফেরিওলার দিকে তাকিয়ে ,অনন্ত পলক ফেলতে পারেনা বহুক্ষণ।কল্পনায় এমনই এক সওদাগরের তল্লাস করছিল সে! চুনসাদা চুল , লাল গামছা- পাগড়ি মাথায়,সাদা ইঁদুরের মতো ইয়া তা-দেওয়া গোঁফ ; অন্তত আশি ছোঁয়া বয়সেও চিতাবাঘের মতো জ্বলন্ত চোখ! ওফ্! এই না হলে তবলার ওস্তাদ--যাবতীয় বোল-বাণীকে যেন পোষা পায়রার মতো, নিজস্ব পাগড়িতে জ্যান্ত পুষে রেখেছে !
. আড়চোখে একবার অসীমের দিকে তাকিয়েই , জগন্নাথের পায়ে হঠাৎ হত্যে দিয়ে পড়ে অনন্ত। অসীমকে আজ খাপ খুলতে দিলে চলবে না। সটান-শয়ান : 'উদ্ধার করুন আমাকে ওস্তাদজি। বড় বিপদে পড়ে শরণাপন্ন হয়েছি আপনার!'
. হতভম্ব হয়ে পড়ে জগন্নাথ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় যাবতীয় খদ্দের তার! আমরাও বেপথু হয়ে পড়ি অনন্তের নিখুঁত অভিনয়ে।তার সমস্যার কথা সবিস্তারে জানায় অনন্ত।জীবনে কোনোদিন কপট অভিনয় পর্যন্ত করেনি হতদরিদ্র জগন্নাথ।সন্তানবৎ-অনন্তকে কথা দিয়ে দেয় সে। এই আলুকাবলিওলাকে দিয়ে যদি তার বিন্দুমাত্রও উপকার হয়, তবে ৮০ বছর বয়সেও সে জান লড়িয়ে দেবে। শিল্পী, সাহিত্যিকরা সব 'দেওতা' ! তাদের হররোজ কুর্নিশ দেয় সে।
[ ৭ ]
এত তাড়াতাড়ি , বুড়োটাকে বোতলবন্দী করতে পারবে , ভাবেনি অনন্ত। অন্তরাও কি ছাই আন্দাজ করতে পেরেছিল এতখানি! সারাসন্ধে সে ঘরবার করেছে--টেনশনে। যাত্রার রিহার্সাল বসে তাদের বাড়িতেই। অনন্তের অবর্তমানে, তাকেই তদারকি করতে হয়েছে আজ। মন কিন্তু ছুটে গেছে জানালায় ; প্রতিটা ডাউন ট্রেনের ডাকে।
. রাত তখন ১২ টা হবে। তিন ব্যাটারি টর্চ আছড়ে পড়ল অনন্তের। তাদের টিনের ঘরে , সেই আলোয় , অন্তরার স্পষ্ট মনে হল : লাল- গামছায়, এক বুড়ো-সাদা-ঘোড়াকে বেঁধে--বাড়ি ফিরছে তার নবীন সওদাগর। --দেখো, খুঁজে এনেছি বাবাকে! --অন্তরা প্রণাম করল ঢিপ করে! বৃদ্ধ বাপ জ্ঞানে, নাকি যাত্রার লক্ষ্মীরূপে--অথবা আজ থেকেই শুরু হল সত্যিকার রিহার্সাল ; তার আনত-ভঙ্গিতে আন্দাজ পাবে ? 'দেবা ন জানন্তি...' !
. দুটোকে তিনটে করলেও চলত এত রাত্রে। তবু্ও কুকারে চাপিয়ে দিল চারটি চাল। পেঁয়াজ কেটে ডিম ভাজল পরিপাটি : 'নাও বাবা, গরম গরম খেয়ে নাও...'।
[ ৮ ]
. উঁহু , হল না--পহলে সে বোলো-- গোড়া থেকে শুরু : " টিউশনি সেরে আমার ফিরতে রাত হবে মা..তুই আবার থালা সাজিয়ে বসে থাকিস না যেন, খেয়ে নিস"। --তিনদিন ধরে এই দৃশ্যটাতেই জগন্নাথের রথ, আটকে রয়েছে। কালঘাম ছুটে যাচ্ছে অনন্তর। বারংবার অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে।এদিকে জগন্নাথের :বাড়ি বাড়ি তবলায় চাঁটি মেরেও তাহলে , মানুষ বেঁচে-বর্তে থাকে--এই অনুভবে পৌঁছাতেই শিহরণ জাগে! সে শুধুই বিড়বিড় করে : "তবলা-বেচে আবার পয়সা নেব কি বাপ.."
. অন্তরা খিঁচিয়ে ওঠে অনন্তকে খুব : 'এই জন্যই বলেছিলাম, ফুটপাতের ফুটকড়াইওলাকে দিয়ে আর যা হোক, অভিনয় হয় না..।' যাত্রাপার্টির অন্যরাও হৈচৈ করে খুব : 'বর্ধমানের দামোদর সেঁচে, দাদা আমাদের নায়ক এনেছে বটে !'
. জগন্নাথ ভারি জব্দ হয় এদের কাছে। হাত ঘুরিয়ে স্বগতোক্তি করে : 'ক্যায় করুঙ্গা ম্যায় !' রাগে ফেটে পড়ে অনন্ত : 'পন্ডশ্রম হল আমার।সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ। যাও, যাও--চা বানাও বাবুদের। চেলা কাঠ ফাড়ো গে--গিন্নিমা'র। বুরবাক কাঁহাকা।'
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন