জলধি / গল্প / গল্পগুলো নদী হওয়ার আগে
Share:
গল্পগুলো নদী হওয়ার আগে

নার্গিসের ধিমি ধিমি চোখে পাঁচবেলা অজু করে বসে থাকে নাসির বাদশা। লোককিচ্ছার এই মানব মানবী পাঁচুই গায়েনের কণ্ঠে ওদের প্রেম নিবেদন করে-‘পিরিতের বিষে আমার জ্বলে গেলো গাও/ ওঝা হইয়া গতর চুইষা বন্ধু বিষ নামাও।’ এ গানের সুর বাঙালির চিরায়ত প্রেমের করুণ বিলাপের মতন। কবিগানে যেমন দোয়ারকির জন্য দোয়ার, ঢুলি ঢোলকের জন্য আরও অন্যান্য বাদনের জন্য বাদকদল থাকে; কিচ্ছাগানে তেমনি বাদকেরা কোরাস করে দোয়ারকির কাজ করে। গায়েন যখন ক্লান্ত হয়ে চুপ করে, দোয়াররা সেই ছেদ বুঝতে না দিয়ে কোরাস দোয়ারকি করতে থাকে।


বেশ জমে উঠেছে গানের পালা। নাহ্, আর ভাল্লাগে না। এবার উসখুস করতে থাকে ছাকু মিয়া। পাতা চেয়ার ছেড়ে পা ফেলে টানা ফুটপাতে। ভ্রাম্যমান দোকানীদের সস্তা পণ্যের ভেতর থেকে কী ভেবে হেয়াররিমুভার ও একটা বিকিনি কিনে নেয়। তারপর ঠোঁটে একটা দুর্বোধ্য হাসি লটকে বেশ লম্বা পায়ে এগুতে থাকে কতোকটা যুব্ধের মতো। হিন্দুপাড়ার তপতী গাইনের বগলে চুলের গোছাটুকু বেশ ঝুলে পড়েছে। কথাটা মনে হতেই কুতকুতে চোখে হেয়াররিমুভারের খোলাবুক ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছাকু তপতীর খোলাবুক মৃত স্মৃতিটার সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকে। বিলাপ-করুণ অভ্যস্ত কণ্ঠে রিমুভারের মডেলটি তখন কঁকিয়ে কঁকিয়ে নিজের বুক উপড়াতে শুরু করলে ছাকু সেটি থত্থরে হাতে ছুঁড়ে ফেলে খোবরা চোখে দৌড়াতে থাকে। তপতীকে ভাবলেই কেমন একটা চন্দ্রদোষ ওর মাথায় ভর করে। ও দৌড়াতেই থাকে। পায়ে পায়ে পালাতে থাকে নাগরিক কোলাহল, আলপথ, গ্রাম। বানের তোড়ের মতো ও এখন পলায়নপর। ওর বাঁ পা হঠাৎ লাফিয়ে পড়লো অপ্রস্তুত একটা ভলবো বাসের দরজায়। হেল্পার ছেলেটা খিঁচড়ে উঠে জায়গা করে দিলে কালো ডোমনা চিতার মতো ছাকু মিয়া সাপের ভঙ্গিমায় গলিয়ে যায় বাসের ভেতর। শরমংলার কাছে এসে বাসটা হল্ট দিলো। স্টপিজ পেয়ে হড়হড়িয়ে সবাই নেমে পড়লো। অবশ্য ছাকুকে সেখানে দেখা গেলো না। এই যে, তোমার উদ্দেশ্যটা কী? কো-প্যাসেঞ্জার কেউ ছাকুমিয়াকে জিজ্ঞেস করলো। ছাকু হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা আঁশকুটে গন্ধ লোকটার ফুসফুসে ঢুকে যায়। আর কিছু বলবার মতো কয়েকটি শব্দ তার স্বরযন্ত্রের ভেতরেই দম ঘুঁটে মরে পড়লো। ছাকু এতে বিব্রত হলো না, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। জেরা করে জেরবার করে দেয়ার চেয়ে এটাই বরং ভালো হলো। লোকটা সরে গেলে কেমন ওর খিদে চাগিয়ে ওঠে। ওর ক্ষুধার্ত চোখদুটো বাঙ্কে রাখা যাত্রীদের ট্র্যাভেল ব্যাগে ব্যাগে ফিরতে থাকে। যাত্রীরা উঠে এলে হঠাৎ একটা শোরগোল বেধে যায়। একজনকে বলতে শোনা গেলো, দেরি করবেন না, এখনই কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড ব্লক করতে বলুন। চোরের অ্যাকাউন্ট অপারেট করার আগেই তা করতে হবে। তখন মালামাল চুরি যাওয়া লোকটা অদ্ভূত পোড়খাওয়া গলায় বললো, দুইটা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকও ছিলো। অবশ্য অন্য কেউ ভাঙাতে পারবে না। তাহলেও ব্যাংককে স্টপ পেমেন্টের নোটিস করতে হবে। ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেনো ছাকুর দিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ঐ তো চোর! বলতেই কতোগুলো বেধড়ক হাত দুদ্দাড় ওর উপর পড়ে চললো। এ সময় ধাঁ হয়ে যাওয়ার চেষ্টা সব চোরেরই থাকে। এক্ষেত্রে ছাকুর টু মাত্র প্রচেষ্টাও চোখে পড়লো না। হতে পারে, চলন্ত বাস থেকে পালানো যায় না, অথবা ঘটনার আকস্মিকতা ওকে হতভম্ব করে দিয়েছে। চুরিটা অসলে ছাকুই যে করেছে বোঝা না গেলেও ডানাভাঙা কাক হয়ে পড়ে থেকে ও যে দমকে দমকে কঁকিয়ে চলেছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সেটি। ওর চোখে এখন রাজ্যের অন্ধকার। শেল খাওয়া পাথরের মতো আস্ত পড়ে আছে। ও অনুভব করলো কেউ একজন ভারি হাতে ওর সারা শরীর জরিপ করছে। ও যেনো এখন জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়! ক্ষীয়মাণ জমিদারির শেষে এসে সাম্রাজ্য হাতড়ে বেড়ানো এক অতীতচারী। যার শুধু স্মৃতিই রয়েছে। বর্তমান তার শুধুই তলিয়ে যাওয়ার। ওর স্মৃতির জায়ান্ট স্ক্রিনে এ সময় ভেসে ওঠে একাত্তরে দুলালের দেহ তল্লাশির ঘটনাটা। মুজাহিদ, রাজাকার, আল বদর, আল শাম্স আর শান্তি কমিটি তখন ঢেঁডড়া পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে সরগরম। ছাকু মিয়া সে সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর হিক্কা তুলে তুলে মওলানা ইউসুফের জান্নাত নসিবের দোয়ায় মশগুল হতো। মওলানা সাহেবের বদৌলতেই তো ছাকু ওর রাজাকার উপাধিটা বড় ফজলের সাথে নামের শেষে জুড়ে দিতে পেরেছিলো। রাস্তা দিয়ে চলার সময় গৌরবে সেদিন ওর স্পঞ্জে আওয়াজ উঠতো। শুদ্ধ মাখরাজে খানিক বাদে বাদেই বলে উঠতো- আল হামদুলিল্লাহ। তারপর মধুর এলাহানে বাঙালি জাত ভাইদের খবরাখবর জানতে চাইতো। মাজুর, বিমারি, মকুত-সবারই খোঁজ নিতো। আর উবু হয়ে নদীতে ভেসে বেড়ানো লাশের গন্ধে কানে গোঁজা গুলে লালা নাকে ঘঁষে নিয়ে একগাল থুতু নদীতে ছুঁড়ে দিতো। নদীর কূল ধরে তারপর নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ চিৎকার করতে করতে সরে পড়তো। কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব জেনোসাইড- অ্যাক্ট অনুযায়ী পূর্বপাকিস্তানে গণহত্যার উৎসব তখন। অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ আর হত্যাকা-ে ইয়াহিয়া খান পেছনে ফেলেছিলো চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তুলি খান, বাতু খান, নাদের শাহ, তৈমুর লং কুখ্যাত সবাইকে। পার্সিপোলিশের মতো ধ্বংসস্তুপ তখন সারা বাংলা। আরে ছাকু মিয়া যে, কিধার সে আইতাছো ভাই, হানু মোল্লা জিজ্ঞেস করলো। ক্যান, তুমি জিগাইতাছো ক্যান? বললো ছাকু মিয়া। হানু সাতপাঁচ না ভেবেই বলতে থাকলো- ছাকু ভাই, উস্ মুক্তি গো তোমরা ছাইড়ো না। ওগো খতম কর না হি হোগা। ওরা ইসলাম কি বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে। ওগো নাম নিশানা মিটায়া দেনা হোগা। ওরা তো নবীর হাদিস ভি মানলো না, হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান। আহ্হারে, বদনসীব নষ্ট পোলাপাইন! ছাকু কোনো উত্তর না করেই বংগা আর জুলু রাজাকারকে সঙ্গে করে ওষন শেখের আস্তানামুখী হয়। খারুয়ারি, সাতেংগা পেরিয়ে এই মুহূর্তে ওরা ডাকাতিয়ার পথে। একটা ঝুপসি ভূতি আওয়াল গাছের ডালে প্যাঁচার রাশভারি ডাকে রাত যে তখন মাঝপ্রহরে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো। জুলুর তখন দাঁতে দাঁতে ঠকঠকানি। গাজীর ভিটার পাশ দিয়ে যাচ্ছে ওরা। ভিটাটা কোনো জমিদার আমলের। জমিদার বাড়ির ভূতের ভিটা হওয়ার গল্পটা বংগা পাড়তে শুরু করলে ছাকু ধমকে থামিয়ে দেয়। জুলু তখন কাঁপতে কাঁপতে বলে, শুনছি এইখানে দুপুর আর রাইতে জ্বীন আসে। আর ওই যে বিল, ওইপাশে বিরিজ; সেগুলা পার হইলে এই ভিটাটাতে পিশাচ দেখা যায় অনেক রাইত হইলে। এভাবেই গোয়ারী গ্রামের জুলু রাজাকার যাদু বাস্তবতা ধরে রেখে তারপর বলে, তাহলে আসল কথা শুনো- দুলাল নাকি ওর মুক্তিবাহিনী নিয়া প্রায় রাইতই এইখানে কাটায়, খবর আছে আমার কাছে। কী কস্ জুলু? ছাকু মিয়া একটা দুরভিসন্ধির দৃষ্টি তুলে প্রশ্ন করে। হ, আইজ রাইতেও ওগো মিশন আছে শুনছি। জুলু সংবাদটি দিলে ছাকু রাজাকার আরো জোরে পা চালায়। গাজীর ভিটা জুড়ে তখন ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন। বংগা রাজাকার উৎসাহী হয়ে আড়ি পাতার চেষ্টা করেও দলছুট হওয়ার ভয়ে ছাকুর পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করে। দুলালদের রাতের খাবারে চিংড়ি মাছ দিয়ে কী যেনো একটা ফ্যাকফ্যাকে কিছু রাঁধা হয়েছিলো। স্বাদ-সোয়াদের কিছু নেই। খানিকটা টকচা টকচা। দায়ে দফায় এসবই ওদের গিলতে হয়। খাওয়া সেরে এইমাত্র দুলাল স্বদলবলে খানিকটা গড়িয়ে নিতে বিছানায় গেছে। চিরকালই দুলাল আমুদে স্বভাবের। সব সময়ই ওর খোশ মেজাজ। একটা আনিঘষা সিকি সব সময় সে বুক পকেটে সাবধানে রেখে দিতো, আর একটা চিঠি, প্রতিদিন লিখে লিখে বাড়িয়ে তুলতো। মতিন, রতন আর সাদুল্লার অনেক চেষ্টাতেও মুখ খোলেনি চিঠি আর সিকিটার ব্যাপারে। এমনকি ওই দুটো জিনিস ও কাউকে ছুঁতেও দিতো না। এ নিয়ে কারো মধ্যেই আক্ষেপ নেই, বরং কৌতুহলই অনুভব করেছিলো সবাই। সাদুল্লাই ছিলো এ বিষয়ে ভনভনে মাছির মতো, তাড়ালেও সরতে চায় না। কারো সাধ্য নেই ওকে মতলব থেকে নিরস্ত করে। নাহ্, এটা তোর দারুণ বদহ্যাবিট, কুট-কচালে টাইপের ছেলে তুই একটা, বলে দুলাল ওকে হ্যানস্তার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বজ্জাতটা সুর পাল্টানোতেও দারুণ তুখোড়। হঠাৎ ধরা গলায় বলে, আমরা কি তোমার পর দুলাল ভাই? না হলে আমাদের কাছে তুমি লুকাও ক্যান? আচ্ছা দুলাল ভাই, তুমি কি কাউরে ভালোবাসো? দড়াম করে সবার সামনে এমন একটা প্রশ্নে দুলাল থতমত খেয়ে যায়। সাদুল্লাটার জিভেরও কোনো ছিটকিনি নেই, ঠোঁটকাটা একদম। এ ব্যাপারে ওর কোনো চক্ষু লজ্জাও নেই। এ কারণেই বোধ হয় দুলালেরও একবিন্দু ইচ্ছে নেই ওকে গ্রাহ্যে আনার। লাই দিলে ঠিকই পেয়ে বসবে। হতচ্ছাড়া কোথাকার! চাপা স্বরে তিরস্কার করে দুলাল। রতন এই ফাঁকে ঘাড় ঘোরালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, বললো, আচ্ছা দুলাল ভাই, আমাদের এই লড়াই কি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে? র্ধু বোকা, তা হবে কেন, এতো আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াই, উত্তর দিলো দুলাল। রতন আবার প্রশ্ন করে, তাহলে যে আমাদের কাফের, বেইমান বলে গাল দিতে ছাড়ে না ওরা! দুলাল বলে, শোন্, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে নেমেছি সকলেই প্রায় মুসলমান। ধর্মের জন্য আমাদের জীবন বাজি। তা বলে কেউ আমাদের উপর নির্যাতন চালাবে, শোষণ করবে, অধিকার বঞ্চিত রাখবে তা কি আমরা মেনে নেবো! নিশ্চয়ই তখন আর ধর্মের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকা যাবে না, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে অধিকার আদায়ের জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এ যুদ্ধ ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ। বুঝেছি দুলাল ভাই, যতোদিন না আমরা আমাদের অধিকার বুঝে পাচ্ছি, যতোদিন না আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারছি, ততোদিন আমাদের অধিকার আদায়ের এ লড়াই চলবে। ইয়াহিয়ার জঘন্যতম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য দুর্জয় শপথ নিলাম, প্রতিজ্ঞায় অবিচল হয়ে কথাগুলো বলে রতন। প্রসঙ্গ টেনে দুলাল বলে, অধিকার আদায়ের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি বলেই তো আজকে আমরা অপরাধী। অপরাধী দেশবরেণ্য নেতা, বুদ্ধিজীবী সকলে, কারণ তারা এদেশকে ভালোবাসে। হানাদারদের কাছে, শোষকদের কাছে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছুই নেই। এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।


হঠাৎ দরজায় কড়া নড়লো। অপারেশনের চিঠিটা এসে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সালেহ আহমেদ পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান রেকি করে কমান্ডার দুলালকে এই গোপন চিঠিটা লেখেন-
ডিয়ার স্যার,
মুন্সিরহাট হাইস্কুল, স্টেশন ও কমান্ড সেন্টার- এর জন্য অ্যান্টি ফায়ার দিন। ওখানে দু’শ পাক আর্মি আছে। তারালিয়া মুন্সিবাড়িতে ৬২ জন পাকফৌজি আছে। দুইটি মেশিন গান, আটটি এল.এম.জি, একটি কেন্ডার সেট ও একটি মর্টারসহ ছোট হাতিয়ার আছে। আর ওদের আস্তানায় চারজন মুক্তিযোদ্ধাও আটক রয়েছে।
মুন্সিরহাট ব্লকের মিলিটারি প্লাটুনগুলোকে ছোট ছোট ট্রুপসে ভাগ করে একটি ট্রুপস বুঝে না উঠতেই গাজীর ভিটা ঘেরাও দিয়ে ফায়ার শুরু করে। পড়মর করে লাফিয়ে উঠে ভিটার মুক্তিযোদ্ধারা যার যার পজিশন নিয়ে নিলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভিটার পুবপাশের ছ’ঘাটি দিঘিতে ঘোড়ার গাড়ি নামার স্বপ্নে বিভোর বিজয়কেও তখন বিছানায় পাওয়া গেলো না। গা ছমছম করা জলাদুর্গম জায়গাটার তীব্র আঁশটে গন্ধের মধ্যে একথালা কচি তালশাঁস কার যেনো পায়ের উঝোটে ছড়িয়ে গেছে ঘরময়। কষ্টা স্বাদে চোয়াল আটকে আসা কয়েকটা গোল বরইও গড়াগড়ি যাচ্ছিলো ঘরের ভেতর। কিছুক্ষণ আগে লুঙ্গির তলায় গেরো দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া রাসুও নতুন কাটা দিঘির উপর লুঙ্গি ফুলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুল ধরেই রেখেছে পাক বাহিনীর ট্রুপস। গুলির অবিচ্ছিন্নতা এই মুহূর্তে মুক্তিবাহিনীকে কোনঠাসা করে দিচ্ছে। পাশ থেকে বোল্ট টেনে টেনে গুলি ম্যাগজিনে পুরে ছাকু নিজেও ৩০৩-এ তার হাতযশ দেখিয়ে যাচ্ছে। নাস্তানাবুদ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী পাক মিলিশিয়াদের ওপর এ সময় অ্যাম্বুশ করে। এতে পাঁচজন মিলিশিয়া হতাহত হয়। এর পর-পরই পুঁতে রাখা একটি শক্তিশালী ডিনামাইটের বিস্ফোরণ। হানাদারদের আরো পাঁচজন সেনা নিহত হয়। দিশা হারিয়ে হানাদাররা এবার ল্যান্ডলোডিং পজিশনে মেশিনগান ও এলএমজি চালাতে শুরু করে। সম্পূর্ণই বিধ্বস্ত হয়ে যায় গাজীর ভিটা। মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে আর কোনো আক্রমণ আসছে না বুঝতে পেরে ওরা ভিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, গভীর রাত তখন। ভূতুড়ে একটা বড় টক কুলগাছ ভিটার ছাদ জুড়ে। একদিকে পাতলাশী, মুগল মির্জার বাড়ি, আর দিকে ফাঁকা চারপাশটা, ভয়ভয় লাগে। কারেন্টও আসেনি। হারিকেনের আলোয় চলাফেরা। সামনের রাস্তা ইটের জমিনে বিছানো, খোয়া ওঠা ওঠা। ছাকু রাজাকার তাই জিপ আনতে মানা করেছিলো পাকসেনাদের, তাছাড়া জিপের শব্দে দুলালরা প্রস্তুত হওয়ারও সুযোগ পেয়ে যেতো। কুরুক্ষেত্র, ট্রয়, পিউনিখ, গাওগেমেলা, কেন্নাই সব যুদ্ধই নৃশংসতার দিক থেকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের কাছে হার মেনে গেছে। কথাগুলো মনে হতেই একটা দানব অহমিকায় ছাকুর মুখটা পিশাচের মতো হয়ে ওঠে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে জানালার চারটি শিক ভাঙা। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে রতন ও মল্লিক প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিলো জানালা পালিয়ে। কিন্তু ভিটার চারদিকেই খই ফুটছিলো বুলেটের। কেউ বেঁচে নেই। দুলাল পা মুড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, চোখদুটো খুলে দিয়ে, একটা মুক্তির স্বপ্নে মেতে। কেরোলিনের সাদা হাওয়াই শার্টের বুকে দুইটা গুলির দাগ। বুকের গর্তদুটো লালের বদলে নীল, কর্ডাইটের ঝলসানিতে পোড়া। রক্ত সেভাবে ছড়ায়নি। ছাকু উল্টে পাল্টে নিয়ে তল্লাশি শেষ করলো। পাওয়ার মধ্যে পেলো শুধু হাতের টিসট ঘড়িটা আর বুক পকেটে তোলা সেই চিঠি, অবশ্য আনিঘষা সিকিটা পেলো না। চিঠিটা মাকে লেখা, ছাকু রাজাকার পড়ে নিয়ে খুব যত্নে সেটিকে নিজের পকেটে তুলে রাখলো। তবে এ বিষয়ে ছাকুর মনোভঙ্গি কিছুই বোঝা গেলো না। ছ্যাঁ...চ শব্দে ব্রেক কষে ধরলে ছাকু একাত্তরের স্মৃতি থেকে ছিটকে পড়ে। বাসের তেলকুটে গন্ধ আর বিবিধ মানব মানবীর ঘ্রাণে ছাকুর আচ্ছন্নতা কেটে এলে ও টলতে টলতে বাস থেকে নেমে পড়ে। চুরির দায়ে গায়ের উত্তম-মধ্যম লাগা জায়গাগুলো হাতড়ে অনুভব করলো হাড়ের ধুপ্পা গজিয়ে গেছে। বিকেলের শেষ আলোটাও পড়ে এসেছে এতোক্ষণে। সন্ধ্যা ঢলতে দেরি নেই খুব। এ সময় প্রচণ্ড স্লোগানে একটা মশাল মিছিল সন্ধ্যার আকাশটাকে গোধূলিময় করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর গলায় ফাঁসির দড়ি ঝোলানো প্ল্যাকার্ডও শোভা পাচ্ছে জনতার বিক্ষুব্ধ হাতে। প্রথম সারির সবার হাতে রয়েছে প্রজ্জ্বলিত মোম। মিছিলটা দেখতে দেখতে ছাকু রাজাকার টের পাচ্ছে ওর গলায় একটা ফাঁস ক্রমশ এঁটে যাচ্ছে। সময়-রুমাল পড়ে গেলেই ও লটকে যাবে জিভ ছড়িয়ে। ছাকু আর্তনাদ করে ওঠে। সেগ্রিগেশন ওয়াল, সীমানা প্রাচীর, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ব্যারাক, স্টাফ কোয়ার্টার, জেল অফিস, কয়েদি সেল সব সবকিছুই ঘিরে ধরছে ওর চারপাশ, ওকে। দম ঘুটে যাওয়া একটা একলা কিছু ও যেনো এখন। শ্বাস-প্রশ্বাস জুড়ে ওয়াটার বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে ওর। ফাঁস দড়িটা কোনোমতো গলা থেকে ছাড়িয়ে ছাকু এবার মিছিলের পাশ ধরে উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করে। দৌড়েছিলো জগজ্জ্যোতিও একদিন; পিঠভর্তি স্প্রিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়েও পাকিস্তানিদের অস্ত্রভর্তি বার্জ ধ্বংস করে দিয়ে। দৌড়েছিলো রওশন সাংমা ও বিনয়ভূষণ সাংমাও। ওরা প্রেম করে বিয়ে করে। দুজনে স্কুলে শিক্ষকতা করতো। নিজেদের জমিতে নিজ খরচে ঘর তুলে দিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের; এই ছিলো তাদের অপরাধ। তারপর দৌড়েছিলো সমাজসেবী মৃন্ময়ী দেবীর কাছে রেডিও চাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সেই ছেলেটিও; যার শেষ ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর পর তাকে যেনো মায়ের পাশে দাফন করা হয়। একে একে সব মনে পড়ে ছাকু রাজাকারের, সব! মনে পড়ে দেশ স্বাধীন হলে গড়ের পুকুরে লুকিয়ে রাখা বেজন্মা স্মৃতিটাও! দৌড় শেষ হলে ছাকুকে গড়ের পুকুরে ডুবে যেতে দেখা যায়।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান