কল আসছে আমার মুঠোফোনে। বারবার। এমনিতে অচেনা নম্বর আমি রিসিভ করি না, কিন্তু এতবার কল দেখে সিদ্ধান্ত পাল্টাই। মনে হলো, পরিচিত কেউ হবে হয়তো। কিছু বলার আগেই কানে আসে—পলাশ, আমি শফিক।
ভেবাচেকা খেয়ে বলি, কোন শফিক?
চিনতে পারছ না আমাকে! তোমার বন্ধু। ভার্সিটিতে পড়তাম তোমার সঙ্গে। বাড়ি নরসিংদীর পলাশে। তুমি একবার সুমনের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে। এবার কি মনে পড়েছে?
চিনতে পেরে বলি, হুম। মনে পড়েছে। আমার নম্বর পেলে কোথায়?
শরীফের কাছে। শরীফ আমার ফেসবুক-বন্ধু।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শফিক বলে—দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তোমার একটা গল্প পড়লাম আজকের পত্রিকায়। বেশ ভালো লিখেছ; ফুটিয়ে তুলেছ বেশ সুন্দরভাবে। একটু থেমে শফিক আবার বলে, এই ধরনের গল্প আমি ভীষণ পছন্দ করি। গল্পকার হিসেবে তোমার নাম দেখেই আমি অনুমান করেছি। কনফার্ম হলাম শরীফের সঙ্গে কথা বলার পর।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে শফিক বলে—তুমি কি কিছু সময়ের জন্য আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?
শফিকের কণ্ঠে বেশ আবেগ। আমার মনটা দুর্বল হয়ে যায় মুহূর্তে। প্রথম যৌবনে ওর সঙ্গে কত সময় কাটিয়েছি। হায় রে সময়! পাখির ডানায় ভর করে যেন উড়ে যায়! হঠাৎ নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মনে পড়ে, ওর সঙ্গে কাটানো আমার নানা রঙের দিনগুলি। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলি—কেন পারব না! অবশ্যই পারব।
তাহলে আগামী শুক্রবার চলে এসো। আমি অপেক্ষা করব। অন্য প্রান্ত থেকে শফিক বলে।
তারপর থেকে কেবল ভাবছি, ওদের বাড়িতে যাব কি যাব না! মনে উঁকি দিচ্ছে নানা রকম প্রশ্ন। চেপে রাখতে পারছি না কৌতূহল।
দুই.
শফিক আমাদের মিসিং ফ্রেন্ড। কলেজজীবনে শফিক ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম। আমার মতো শফিকও গ্রামের ছেলে। ঢাকায় এসে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে আমার বেশি সময় লাগেনি—দুজনের বিশ্বাসে ও স্বভাবে কোথাও মিল ছিল বলে হয়তো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতায় আমরা লড়েছিলাম একসঙ্গে। চান্স পেয়ে দুজন ভর্তি হই একই ফ্যাকাল্টির দুই ভিন্ন বিভাগে। বিভাগ আলাদা হলেও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল; সেতুবন্ধ গড়ে দেয় সাহিত্যপ্রীতি।
শফিক গল্প লিখত। মজার মজার গল্প। আমার ঝোঁক ছিল পড়ার দিকে। তবে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম; ঠিক হয়ে উঠত না। না হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। আমি কল্পনাবিলাসী ছিলাম না। কবির সামান্যতম বৈশিষ্ট্যও আমার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। অনেক বন্ধু হাসাহাসি করত আমার ছন্দজ্ঞান নিয়েও। একপর্যায়ে বাদ দিই কবিতা লেখা।
শফিক আমার মতো হতাশ ছিল না। বরাবরই ছিল আশাবাদী। সাহসীও ছিল দুর্দান্ত। প্রথম বর্ষে থাকতেই ও গাঁটের পয়সা খরচ করে বইমেলায় বের করে গল্পের বই। বলে রাখি, শফিকের বাবা ছিলেন রাজনীতির মানুষ; নরসিংদীর এক নামজাদা মন্ত্রীর সহযোগী। শফিকের টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। মাসের শেষে টান পড়লে অনেক বন্ধুই ওর কাছে ধার করত। ও কাউকে নিরাশ করত না; এমনকি পরে কখনো সেই টাকা ফেরতও চাইত না।
আর আমি চলতাম টিউশনির ওপর ভর করে। অকালে বাবাকে হারিয়ে অল্প বয়সে আমাকে ধরতে হয় সংসারের হাল। মনে আছে, আমার দুঃসময়ে আমিও ওর কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম। পরে তা আর শোধ করা হয়নি; ফেরত দিতে গিয়ে খেয়েছিলাম ওর ঝাড়ি। শফিকের মন এমনই বিশাল ছিল। এই সুযোগটা অনেকে নিত তখন।
যাহোক, শফিকের গল্পের প্রথম পাঠক ছিলাম আমি। তখন না লিখলেও আমি গল্প বুঝতাম। ছোটবেলা থেকে আমি বইয়ের পোকা। লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলজীবন থেকেই পড়েছি গল্প-উপন্যাস। বিতর্ক করার সুবাদে অর্জন করেছিলাম স্পষ্ট মতামত প্রকাশের শক্তিও। যেকোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারতাম। আমার যুক্তিকে ভীষণ গুরুত্ব দিত শফিক। মনে আছে, একবার আমার মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ও একটি গল্পের পুরো আঙ্গিকই বদলে দিয়েছিল। এমনকি পাল্টে দিয়েছিল গল্পটির কাহিনিও। যদিও আমি ততটা ওর কাছে আশা করিনি।
সেবার প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পড়ার চাপে মাস দুয়েক অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতে পারিনি। সারাক্ষণ মুখ গুঁজে ছিলাম বইয়ে। হল-পাঠাগার ছাড়া পারতপক্ষে অন্য কোথাও যাইনি। পুরোপুরি বন্ধ ছিল আড্ডা। পরীক্ষা শেষের অবকাশে বাড়ি থেকে ফিরে শফিকের হলে গিয়ে শুনি অনেক দিন ধরে ও নেই। শফিকের রুমমেট ইংরেজি বিভাগের মোহন জানাল, ও নাকি পরীক্ষাও দেয়নি। এ কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। কেন পরীক্ষা দেয়নি? কী হয়েছে ওর? মোহন জানায়, হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে শফিক বাড়ি চলে গেছে। ওর কোনো খবর কারো কাছে নেই। কারো সঙ্গেই রাখছে না যোগাযোগ।
তারপর কী হলো?
শফিককে নিয়ে চালু হয়ে গেল অনেক রকমের গল্প। রং চড়ানো নানা গল্প ভাসতে থাকে ক্যাম্পাসের বাতাসে।
কেউ কেউ বলেছিল, শফিক সহপাঠিনী নীলা নামের এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। নীলা ছিল মডেল, অভিনয়ও করত মঞ্চনাটকে। নীলার মা-বাবা ছিলেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী। ফ্যাকাল্টির অনেকে নীলার পাণিপ্রার্থী হলেও কারো দিকে ফিরেও তাকাত না সে। ব্যর্থ হয়ে অনেকে ব্যঙ্গ দিয়ে বলত, নীলার চোখ আকাশের দিকে; সামনে বা মাটিতে তাকানোর সময় কোথায় তার!
শফিক ছিল নাছোড়বান্দা। যাকে একবার টার্গেট করেছে, তাকে কখনো মিস করত না। ভীষণ মনের জোর ছিল শফিকের। ও এ ধরনের গল্প আমার কাছে হরদম করত। আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। পাত্তা দিতাম না কখনো। আমি জানতাম, ও কোনো ব্যাপারেই সিরিয়াস নয়। সবকিছু ছিল ওর কাছে একরকম খেলা। ও ভীষণ খুশি হতো কোনো মেয়েকে ছ্যাঁকা দিতে পারলে। মেয়েদের প্রতি অনেকটা নিষ্ঠুর ছিল ও; তাদের কষ্ট দেখে ও মজা পেত। এর পেছনে হয়তো কোনো গূঢ় কারণ ছিল যা আমাকে ও কখনো জানায়নি।
বারবার নীলাকে প্রস্তাব দেয় ও। প্রত্যাখ্যান করে নীলা। বেশ অপমানিত হয় শফিক; বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মানসিকভাবে। একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ও ছেড়ে দেয় পড়াশোনা। এ কাহিনি আমার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ, শফিক ছিল প্রেমিক-প্রকৃতির পুরুষ। সত্যি বলতে কি, ওর কোনো প্রেমই টিকত না বেশি দিন। যখন-তখন প্রেমে পড়ত ও। নতুন প্রেমে পড়লেই এসে বলত, দোস্ত, এমন করে কাউকে জীবনে ভালোবাসিনি। এ রকম কথা ওর মুখে যে কতবার শুনেছি, তার ইয়ত্তা নেই। শফিক এমন একটা ভাব করত যেন এটাই ওর জীবনের প্রথম প্রেম। ওর প্রথম প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত আমাদের। তবু শুনতাম। শুনতে বাধ্য হতাম। কারণ আঠারো-উনিশ বছর বয়সে আদিরসের কাহিনি কোন ছেলে না পছন্দ করে।
কবিতার প্রতি ওর অনুরাগ ছিল প্রগাঢ়। নির্মলেন্দু গুণের সমস্ত প্রেমের কবিতা ছিল ওর মুখস্থ; প্রেমিকাদের হৃদয় হরণে এই গুণটি বেশ কাজে লাগাতে পারত ও। ওইগুলোর মধ্যে কিছু কবিতা যে ওর বানানো, তা শফিক না বললেও আমি বুঝতাম। কারণ, তখন আমিও ছিলাম গুণদার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক। তবে ওর মতো মুখস্থ করতাম না, কিংবা রাখতে পারতাম না।
এক প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর আরেকজন জুটিয়ে নিতে ওর সময় লাগত না। আবার এক সঙ্গে একাধিক প্রেমও শফিক করত না। এ-প্রসঙ্গে শফিক বলত, সব সময় একজন থাকে আমার পাইপলাইনে। ওর এই ধরনের কথা শুনে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আবার অনেক বন্ধুকে দেখতাম ঈর্ষায় জ্বলতে। আমি ঠিক ঈর্ষা করতাম না, তবে কষ্ট পেতাম। গোপনে। কারণ আমার দিকে কোনো মেয়ে ফিরেও তাকাত না। ভাবতে অবাক লাগত, ও কীভাবে পারে! পরক্ষণে টের পেতাম, ওর চেহারা তো আর আমার মতো নয়। ও দেখতে যে সাক্ষাৎ রাজপুত্র। তার ওপর নেই অর্থকড়ির অভাব। তাই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে শফিকের ভার্সিটি ছাড়ার গল্পটি আমি ফুৎকারে উড়িয়ে দিই। অথচ এই কাহিনিই চাউর হয়েছিল বেশি।
অন্য একজনের কাছে শুনেছি আরেক গল্প। শফিক নরসিংদী রুটে বাস দেয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল ক্যাম্পাসে। সেকালে ওই রুটে শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য কোনো বাস ছিল না। এই নিয়ে নরসিংদী-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলেরা আন্দোলনে নামে। যেহেতু শফিকের বাবা ছিলেন সাবেক মন্ত্রীর কাছের মানুষ, তাকেই এগিয়ে দেয় অনেকে। তখন ওর বাবার পার্টি ছিল বিরোধী দলে। তাই শফিকের ওপর ইচ্ছেমতো নির্যাতন করে সরকার-সমর্থিত দলের ছাত্রনেতারা। ভয় দেখায়; চাপ সৃষ্টি করে ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য। খবর পেয়ে শফিকের বাবাই নাকি হল থেকে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
এই গল্পও আমি বিশ্বাস করিনি। কারণ রাজনীতিতে বা আন্দোলনে জড়ানোর মানসিকতা ওর মধ্যে কখনো দেখিনি। আর আন্দোলনের মতো বিষয় ওর চরিত্রের সঙ্গে মোটেও যায় না। ও সব সময় আত্মমগ্ন থাকত। অন্য কারো বিষয়ে ও মাথা ঘামাতে পছন্দ করত না।
কারো কারো মতে, শফিক নাস্তিক ছিল। ধর্মকে কটাক্ষ করে লিখত। এজন্য কট্টরপন্থী ছেলেদের রোষানলে পড়ে ও। তারাই ওকে বের করে দেয় হল থেকে। ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য বিভিন্ন রকম ভয় দেখায়। হুমকি দেয়। তাই বাধ্য হয়ে ও হল ছেড়ে বাড়ি চলে যায়। এ কথাও আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি; বিশ্বাস না হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ও পুরোপুরি নাস্তিক ছিল না। তবে ওর মধ্যে ধর্ম নিয়ে সংশয় ছিল; নামাজ-রোজার প্রতি ছিল অনীহা। কিন্তু কখনো লেখায় কিংবা কথা দিয়ে অন্যদের ধর্মানুভূতিতে ও আঘাত করত না।
আমাকে একবার শফিক বলেছিল—একসঙ্গে সব ধর্ম সত্য হতে পারে না। হয় একটি সত্য, নয় সবই মিথ্যা। অথচ সব ধর্মের মানুষের কাছে তার ধর্মই কেবল সত্য, অন্য সব ধর্ম মিথ্যা। এই যুক্তি আমার মতো আস্তিক তর্কবাগীশের পক্ষেও খণ্ডন করা সম্ভব ছিল না।
হুমায়ুন আজাদের যুক্তিকে শফিক পছন্দ করলেও সম্পূর্ণ একমত ছিল না। বরং পণ্ডিত আহমদ শরীফ আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল ও। বামপন্থী ছেলেদের সঙ্গে মিশলেও শফিক বাম রাজনীতির আদর্শেও বিশ্বাস করত না। আর ওর যত গল্প আমি পড়েছি, তাতে ঈশ্বরের ব্যাপারে ওকে নিস্পৃহই মনে হতো। এ নিয়ে একটি লাইনও কোথাও পড়িনি। ওর গল্প ছিল শুধুই প্রেম ও বিরহের, যেখানে ধর্ম বা ঈশ্বর কখনো স্থান পায়নি। ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখতে বরাবরই অনাগ্রহী ছিল ও।
এ রকম আরো অনেক কাহিনি ডালপালা ছড়িয়েছে ক্যাম্পাসে; সব বানানো মনগড়া বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। প্রথম প্রথম আমরা যারা ওর কলেজের বন্ধু ছিলাম, তারা একত্র হলে ওকে নিয়ে আলাপ করতাম। কথায় কথায় চলে আসত ওর প্রসঙ্গ। একসময় শফিক হারিয়ে যায় আমাদের স্মৃতি থেকে।
তিন.
অনেক দিন ধরে উয়ারী-বটেশ্বরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সময়-সুযোগের অভাবে যেতে পারিনি। শফিকের ফোন পাওয়ার পর থেকে ভাবছি, নরসিংদী যাই আর এক ঢিলে দুই পাখি মেরে আসি। গল্পকার বন্ধু দেবাশীষকে এই প্রস্তাব দিতেই সে লাফিয়ে ওঠে।
নির্ধারিত দিনে গাড়ি নিয়ে রওনা হই। সকাল সকাল। উয়ারী-বটেশ্বর পরিদর্শন শেষে স্মৃতির ওপর ভর করে ঠিক পৌঁছে যাই ওদের বাড়িতে। দুই দশক আগে যে অজপাড়াগাঁ দেখে এসেছিলাম, তা আজ রীতিমতো শহর। রাস্তাঘাট সব পাকা। কোথাও কাঁচা রাস্তা নেই। দেশের উন্নয়ন যে শহর ছাড়িয়ে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, তা দেখে বিস্মিত হই।
তখন ওদের বাড়ি ছিল মাটির। এখন তা দোতলা রাজপ্রাসাদ। গেট থেকে চোখে পড়ে কেবল কবিতা আর কবিতা। প্রতিটি দেয়ালে সেসব কবিতা খোদাই করা। এই কবিতাগুলোর সঙ্গে আমি পরিচিত নই, কিংবা কিছুটা পরিচিত।
বাড়ির গেটে চোখে পড়ে বড় একটি নামফলক—‘কবিতাকুঞ্জ’। ভেতরে ঢুকতেই দেখি নিচতলার একটি বড় অংশ সাজানো দেশ-বিদেশের কবিতার বই দিয়ে। মনে হলো, বিশাল এক কবিতার পাঠাগার। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরতে থাকি আর ভেতর-বাইরের কবিতাগুলো পড়ার চেষ্টা করি। খেয়াল করি, প্রতিটি চরণের নিচে ছোট করে রচয়িতার নাম হিসেবে ‘শফিক চৌধুরী’ লেখা। সংবিৎ ফিরে পাই দেবাশীষের ডাকে। বলে—কী হলো?
আমার মুখে কথা সরে না।
অকস্মাৎ মনে পড়ে, আঠারো বছর আগের ব্যর্থ কবি আমি আজ একজন গল্পকার। স্বনামধন্য না বললেও এটা সত্য, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকরা আমার গল্প ছাপে। পাঠকের চাহিদার কারণে প্রকাশকও গল্পের বইয়ের পাণ্ডুলিপি চান। আর সেদিনের গল্পকার আজ সত্যিকারের কবি। শফিকের কবিতায় আমি বিনয় মজুমদারের গন্ধ পাই। তবে কি গায়ত্রী দেবীর মতো কোনো নারীই ওকে আজ কবি বানিয়েছে আপাদমস্তক!
শফিকের কবিতাগুলো সব হাতে লেখা। খাতায়। মুক্তোর মতো উজ্জ্বল ওর হস্তাক্ষর। শব্দগুলো যেন জ্বলছে। শফিকের বাবার কাছে জানলাম, ও কোনো কবিতার বই প্রকাশ করেনি। ওর বাবা চেয়েছিলেন, বই বের করে দিতে। শফিক রাজি হয়নি। বলেছে, বই করে কী হবে! ও চায় না, ওর কবিতা পৃথিবীতে অমরতা পাক। আরও বলেছে, ওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব কবিতা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়।
শফিকের বাবা ওকে ডেকে আনে আমাদের কাছে। শফিকের চাহনি বলে দিচ্ছে, ও আমাকে এখন চিনতে পারছে না। আবেগাপ্লুত হয়ে আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। সঙ্গে সঙ্গে একটু হাসি দিয়ে দূরে সরে যায় ও।
আমি শফিককে আন্তরিকতার সঙ্গেই বলি, দোস্ত, এত কবিতা তোমার, এত উৎকৃষ্ট কবিতা, বই বের করলে না কেন?
আমার প্রশ্ন শুনে শুধু একটু হাসি দিল ও। ওই হাসিতে বুঝে নিলাম, শফিক স্বাভাবিক নয়। আমাদের পাশে পাশে থাকে ও। প্রশ্ন করলে কখনো উত্তর দেয়, কখনো চুপ করে থাকে। খেয়াল করি, ওর উত্তরগুলো অসংলগ্ন।
শফিকের এমন রহস্যজনক আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করতেই ওর বাবা জানালেন, ওর আচরণ একেক সময় একেক রকম। এই ভালো তো, এই মন্দ। মাঝেমধ্যে আমাদেরও চিনতে পারে না।
ওর মায়ের দিকে তাকাতেই দেখি, চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে।
আমি শফিকের মা-বাবাকে আর কোনো প্রশ্ন করতে পারি না।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান