জলধি / গল্প / এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়
Share:
এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়

তখনো ভোরের শিশির ধরে রেখেছে ঘাস, মিলন কবিরাজ বাড়ি থেকে দ্রুত পা চালাল বেতনা নদীর দিকে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে দুটো দোয়াইর পেতেছে সে। বাড়ির সবার ভাগের একটা পুকুর আছে। সেখানে সে খ্যাপলা জাল দিয়ে মাছ ধরে আর মাঝে মাঝে সবার চোখ ফাঁকি দিতে ব্যবহার করে কারেন্ট জাল। বেতনা নদীর পানি মিশেছে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে। এখনো বেশ জোয়ার-ভাটা হয়। মাছ ধরাটা মিলন কবিরাজের নেশা আর কবিরাজি তার পেশা। দুটো দোয়াইরই আছে তার। নিজেদের বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সে বানিয়েছে। অবশ্য বাঁশের অভাব পড়লে ওপারে চান্দালির বাঁশবাগান থেকে রাতের অন্ধকারে কেউ কেউ বাঁশ কেটে নিয়ে আসে। পরদিন সকালে চান্দালি যখন বাঁশঝাড়ের মধ্যেই প্রাকৃতিক কাজ সারতে সারতে চারদিকে চোখ বুলায় তখন তার অন্তহীন গালিতেই বোঝা যায় বাঁশ চুরির ঘটনা ঘটেছে। সেই গালিতে মা, বৌয়ের মাসিকের ভাঙা থেকে চোরের জ্ঞাতি- গোষ্ঠীর সব নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করার মানসিক ইচ্ছা কিছুই বাদ পড়ে না।

বিকেল করে দোয়াইর পাতে মিলন কবিরাজ। বেশ রাত করে মাঝে মাঝে ক্ষ্যাপলা জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আবার কখনো ফজরের আযানের কিছু আগে দোয়াইর খুলতে যায় সে কলার ভেলায় চেপে। বর্ষা প্রায় শেষের দিকে। নদীতে তাই থই থই পানি থাকে। বাড়িতে নিয়ে যখন দোয়াইর খোলা হয় তখন চিংড়ি, বেলে, পুঁটি, চান্দা খলবল খলবল করতে করতে বের হয়। মিলন কবিরাজের তখন কুসুমের কথাই মনে হয়। সারা ক্ষণ খলবল খলবল করতে থাকে কুসুম। বেলে মাছের ডিমের মত হলুদ সুন্দর গা, চান্দা মাছের গায়ের মত ঝকঝক করে কুসুমের দাঁতগুলো, চিংড়ির মতোই সে উপরে শক্ত খোলস আবৃত করে রেখেছে। তবে কবিরাজ বলে খোলস সরিয়ে তার মনের তলটিকে ঠিক দেখে নেয় মিলন কবিরাজ। কুসুম যখন শ্বাশুড়ির অত্যাচারের কথা বলত মিলন কবিরাজের কাছে তখন তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াত। এর মধ্যে সে হেসে উঠত, বলত কোবরেজ মশাই, দ্যাও তো দেকি আমার শ্বাশুড়িকে একটা বাণ মেরে। তার জন্যি স্বামীডা আমারে তালাক দিল। ছোট একখান ছেইলে আছে। তুমি একটা তাবিজ দ্যাও। স্বামী যেন ফের আমারে ঘরে নিয়ার জন্যি পাগল হয়ে যায়। মিলন কবিরাজ বলে, সোম আর বুধ বারে ভরণ দিয়ে দেখতি হবে তোর কোনো আশা আছে কী না।
কুসুম আসে। তবে সোমবার নয় রবিবার বিকেলেই। মিলন কবিরাজের বৌ তখন কাঁথাতে ফোঁড় তুলছে। বর্ষার প্রথমে শুরু করেছিল তবে খুব বেশি এগোতে পারেনি। হাসিয়া ধাগা দিতে দিতেই অনেক সময় চলে গেছে। আশা আছে এই শীতে স্বামী-স্ত্রী নতুন কাঁথার নীচে ঘুমাবে।
কুসুম এসে কবিরাজের বৌয়ের পা ধরে কান্নাকটিÑ বু, আমার একটা উপায় করতি বলেন। ছেইলেটাকে আইজ আমার মা মারিছে দশটা টাকার জন্যি। ছেলেটা বাদাময়ালার কাছ থেইকে বাদাম খাতি চাইল। আমি বাড়ি ছিলাম না। গিইলাম ঐ পাড়ায় কটা আলো ধান ভানতি। ছেইলেটা খুব পিটে খাতি চায়। ছেইলের পিট আমার দড়া দড়া হয়ে গেছে।
কবিরাজ তখন ঘৃতকুমারীর গাছ খুঁজতে বের হয়েছিল। এক রোগীর পেটের পীড়া। তাকে দাওয়াই দিতে হবে সকালে। বাড়ি ফিরে সে দেখল কুসুমের শাড়ি আলুথালু, চুলগুলো উড়ছে, চোখে পানি। তার বুকের মধ্যে মোচড় দিল। এত রোগি আসে, এত জনের দুঃখের কথা শোনে, কই কারো বেলাতে তো এমন হয় না।
কবিরাজ কুসুমকে বলল, তুই বাড়ি যা কুসুম। সন্ধ্যে হয়ে আসতিছে। ভেলা দিই পার হবি, আলো থাকতি থাকতি যা। আমি আয়না ভরন দিই দেখপানে। আর বাড়ির উত্তর কোণে একটা তাবিজ পুতে দিয়ে আসপানে কাইল বিয়ানে। কুসুম চোখ মুছতে মুছতে পা বাড়ায় বেতনা নদীর দিকে। আকাশে তখন সবে লাল আর কমলা রঙের ছিটে লাগছে। বাতাসটা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের পাশে থাকলে যেমন হয় তেমন। কুসুম রকি মিঞার একটা ভেলা পায়। পাট পচানোর জায়গা খুঁজছিল সে। তার ভেলায় উঠে কুসুম পার হয়।
পরদিন ভোরে মিলন কবিরাজ কুসুমদের বাড়ি যায়। হাতে একটা তাবিজ। কুসুমকে বলে এগারো টাকা দিতে। কুসুম পনের টাকা এনে দেয় বাড়ির ভিতর থেকে। মিলন কবিরাজ বলে, ঠিক এগারো টাকা দিতি হবে। কুসুমের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক ওঠে। বাকিটা তোমার বকশিশ গো। কবিরাজ বাঁকা হেসে বলে, এত অল্প বকশিশে তোর স্বামী তোরে নিতি আসপে না রে! কুসুমের সারা শরীর হাসিতে দুলে ওঠে। কবিরাজের নেশা লাগে। সে বলে, রাতে জ্বিনের সঙ্গে কথা কইছি। জ্বীনরে দিই পড়া পানি খাওয়ালি সে তোর জন্যি পাগল হই ছুটে আসপি। বাড়ি থাকতি পারবে না। তার গা জ্বালা করবি। তা মেলা টাকার কারবার। কুসুমের মুখের রক্ত সরে যায়।
-- টাকার জন্যিই তো আমার ছেইলেটা এত মার খাইল। আমি টাকা কনে পাব।
মিলন কবিরাজ বলে, আপাতক একটা তাবিজ পুঁতে দিই যাই। দেখ, কাজ হলি তো মিটেই গেল। বাড়ি যাবার মুখে কুসুম কবিরাজের হাত ধরে, বাড়িত আও কবিরাজ। মা পাকান পিটে গড়াচ্ছে, দুটো মুখি দিয়ে যাও। কুসুমের ছেলে তখন বাড়ির হাতনেয় পাটি পেতে খেতে বসেছে। মিলন কবিরাজ বাড়ির দিকে ভাল করে তাকায়। দুটো মাত্র ঘর। একটাতে কুসুমের বাপ মা থাকে, আরেকটাতে কুসুম তার ছেইলে নিয়ে থাকে। ঘরের উপরে টালির ছাউনি। বেশ আগের ছাউনি মনে হয়। জায়গায় জায়গায় পলিথিন দেয়া। মনে হয় বৃষ্টির পানি পড়ে। মিলন কবিরাজ খেয়াল করে দেখল বাড়ির সামনে পেয়ারা আর আম গাছ। একটা শিউলি ফুলের গাছও আছে। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট একটা গোয়ালঘর। তার সামনে একটা ছাগল- কেটে রাখা কাঁঠালের পাতা চিবুচ্ছে। গোয়ালঘরের দেয়ালে একটা নড়বড়ে মই রাখা। কুসুমের মা একটা এনামেলের থালায় কতগুলো গরম পিঠা নিয়ে এল। কুসুম তখন টিউবওয়েলে গিয়ে ছাই দিয়ে একটা কাঁচের গ্লাস মাজছে। তারপর সে পানি নিয়ে এল।
কবিরাজ পানি খেয়ে হাসল- তোদের কলের পানি খুব মিষ্টি রে কুসুম, কলজেটা এক্কেবারে জুড়োয় গেল। কুসুম হাসে, বাঁকানো কঞ্চির মত তার শরীর বেঁকে বেঁকে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মিলন কবিরাজ তাকিয়ে থাকতে গিয়েও চোখ নামিয়ে নেয়। ছেলেটাকে বলে, কীরে, স্কুলে যাস? পিঠে মুখে সে কথা বলতে পারে না। মাথা নাড়িয়ে না জানায়। তারপর মুখের পিঠেটা কোৎ করে গিলে বলে, মা এখনো নানী বাড়ির স্কুলে ভত্তি করায়নি। আমি ক্লাস টুতি উঠিলাম। আব্বা কইল, আমারে একখান সাইকেল কিনি দিতি। নানীরা তা দিইনি। মিলন কবিরাজ আর কথা বাড়ায় না। কুসুমের মাকে বলে, চাচি গেলাম। কবিরাজ কুসুমের বিষন্ন মুখ দেখে চান্দালির বাঁশ বাগানের ভিতর দিয়ে নদীর ধারে চলে আসে।
দোয়াইরগুলো খুলতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। মাছও জমেছে বেশ। এখন বৌয়ের হাতে দিয়ে বেশি পিঁয়াজ দিয়ে ঝাল করে রান্না করতে বলবে। আমন চালের ভাত আর ছোট মাছের চচ্চড়ি। ঘরে সরষে থাকলে কিছু সরিষাও বেটে দিতে বলবে। কালকের জন্য কিছু মাছ জাল দিয়ে রাখবে বৌ। পরশু পর্যন্ত মাছের চিন্তা নেই। নদীর এপারে এসে ঘৃতকুমারীর গাছ থেকে কিছু পাতা ছিড়ে নেয়। ছোট ছেলেকে দেবে হামানদিস্তায় বাটতে। আস্তে আস্তে সে বাবার সঙ্গে কবিরাজির কাজ ধরেছে। সময় পেলে সে ছেলেকে নিয়ে বের হয় গাছ চিনাতে। ছেলের মাথা ভাল। অল্প সময়ের মধ্যে কাজ বুঝে ফেলেছে।
কুসুমের বিষয়টা নিয়ে কবিরাজ বেশ ভাবে। কিছু কুফরি তাবিজ আছে, কিন্তু সে সব করতে তার মন সায় দেয় না। মেয়েটা দেখতে বেশ তবু স্বামীর মন পেল না। কত জনের কত সমস্যা। কারো রঙ কালো বলে স্বামীর ঘর করতে পারে না, কারো ছেলে হয় না, কারো স্বামী ভাবীর সঙ্গে না হলে পাড়ার অন্য মেয়ের সঙ্গে লাইন করে। কবিরাজ মশাই হাসে। কথায় বলে, নারীর মন বোঝা কঠিন। সত্যি কথা হলো কখন কার জন্য পুরুষের মনে নেশা ধরবে, কারে সে কখন বুকে টানবে তা বলা যায় না। মনের রশি ধরে টানলেও শরীরের লাগাম টানা যায় না। আর তখন সমাজ সংসারের কথা মনেও থাকে না। বড় কঠিন পুরুষের শরীর বোঝা।
কটা পান্তা ভাত আর মরিচ পোড়া আলু ভর্তা খেয়ে কবিরাজ দাওয়াই তৈরি করতে বসে ছেলেকে নিয়ে। ওপারের বিলকিসের বাচ্চা হয় না। ওজন কমানোর জন্য কাল বড়ি নিতে এসেছিল। সে বড়ি খেলে সাত দিন শুধু পায়খানার সঙ্গে চর্বি বের হবে। তারপর হবে পাতলা ঝরঝরে গা। কেউ আবার এত চিকন তারা মোটা হতে চায়। তাদেরও বড়ি দেয় কবিরাজ। তারা এসে দুঃখের কথা বলে, শরীরে কিছু নেই। স্বামী আদর সোহাগ করে শান্তি পায় না। মিলন করিবাজ হাসে। পুরুষ মানুষের শান্তি। এ জগতে কারো কিছুতে শান্তি হয় না। যার যা আছে তা অন্যরা চায়। যার বাচ্চা হয় না তার মনে হয় ওটা পেলেই পৃথিবীর সব সুখ। যার মেয়ে আছে সে ছেলে চায়। শাড়াতলার এক ভ্যানওয়ালা একবার মিলন কবিরাজের কাছে জানতে চেয়েছিল এমন কোনো তাবিজ আছে কি না যা দিয়ে তার মেয়ে হবে। তিন ছেলে তার। দুঃখ করে বলেছিল, কবিরাজ ভাই, মেয়ে না হলি মরার পর কেউ কানবিও না। ছেইলেরা তো ভিটের মাটি নিয়েই কুত্তা কামড়াকামড়ি করবি। উঠোনের মাঝখানি বাঁশের বেড়া দিবি। একটা মেয়ে থাকলি তারে লাল ফ্রক পরিয়ি ভ্যানে নিয়ে ঘুরতাম। আমার দিলডা শান্তি পাত। আরে শান্তি! কুসুমের তো অমন চেহারা, সিনেমার নায়িকাদের মত শরীর আর হাসি, একখান ছেইলেও আছে। তবু তো স্বামী তারে তালাক দিল। পুরুষের মন বোঝা দায়!
দুুপুরের আগে আগে কুসুম এল তার ছেইলেরে নিয়ে। মুখ তার খুশিতে ডগমগ। যেন কৈ মাছের মত ফাল দি ফাল দি উঠতেছে। মিলন তখন উত্তর পাড়ার এক রোগি দেখছিল। ছোট ছেলে। বিয়ান থেকে পেট ব্যথা করছে। মনে হয় পেট ভর্তি কৃমি। কবিরাজ তাকে নিম পাতা ভেজে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়াতে বলছিল। কুুসুম সেখানেই আসে।

--কোবরেজ মশাই, ও কোবরেজ মশাই, ছেইলের বাপ আইজ চান্দালি চাচার মোবাইল ফোনে ফোন করি ছেইলের সঙ্গে কথা কইছে। তোমার তাবিজে কাজ হইছে গো কবিরাজ। আমি আমার কানের সোনার দুলখান দিব তোমারে। তুমি জ্বীন দিয়া পড়া পানি খাওয়াইয়া আমার পোলার বাপরে আনি দেও।
-- তারপর যখন শাশুড়ি আর স্বামীর মার খাবি?

--আর বইলো না কবিরাজ। শাশুড়ির মাইরের চেয়েও কথার তেজ বেশি। বাপের বাড়ি থেকে শুধু জিনিস আনতি কয়। স্বামীতো তাও রাত্রিকালে আদর করে। শাশুড়ির জ্বালা বড় জ্বালা। তার কথাতেই তো স্বামী আমারে তালাক দিল।
-- আচ্ছা, তুই যা কুসুম। আমি রাত্রিকালে জ্বীনের সঙ্গে কথা কয়ে দেখি।
কবিরাজের তখন গোসল করার সময়। গোসলের আগে সে গায়ে সরিষার তেল মাখে সারা বছর। খেয়ে আবার মাঠের দিকে যেতে হবে। বড় ছেলেটা শ্যালো মেশিনে লোকের ক্ষেতে পানি দেয়। সে মাঠে গেলে ছেলে বাড়ি ফিরে গোসল করে খাবে। কবিরাজ তাই দ্রুত করতে থাকে। মেশিন ঘরে ছোট একটা চৌকি আছে। ওখানেই একটু গড়িয়ে নেবে। গোসল করা শেষ হলে রান্না ঘরে এসে দেখল ভাত বেড়ে তরকারির বাটিগুলো গামলার মধ্যে সাজিয়ে নিয়েছে লাকির মা। মেয়েটা তার সবার বড়। সে হবার পর রতœা বেগমের নাম ধরে আর ডাকা হয়নি। মেয়েকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছে। হাঁপের টান ছিল। বড় হলে রোগ বাড়লে জামাই পাওয়া কঠিন হত। তাই দেরি করেনি। পিঁড়িতে বসে কোনো রকম নাকে-মুখে গুজে ভাত কয়টা শেষ করে মিলন কবিরাজ। যদিও রান্না বড় ভালো হয়েছিল। তবু রোগিকে যাই বলুক, চিবিয়ে চিবিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তার হাতে নেই। খাওয়ার পর ভাতের থালাতেই পানি ঢেলে হাত ধোয় সে। তারপর উঠোনে গিয়ে কাপড় নাড়ার দড়ি থেকে গামছাটা নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে মুখ মুছে রওনা দেয় মাঠের দিকে। ছোট ছেলেকে বলে যায়, পাকুড় গাছের ছাল, আকন্দের পাতা আর নিম গাছের কচি ডাল এনে রাখতে।
আকাশটা হালকা মেঘলা মেঘলা, গুমোট একটা গরম পড়েছে। মিলন কবিরাজ তার কাঁধের গামছাটা দিয়ে ঘাম মুছে নেয়। মাঠের দিকে সব সময় সে যায় না। ছোট ছেলেও যায়। মাঠে বড় ছেলে ফিরলে সে যাবে বিলের ধারে। ওদিকটাতে বেশ একটু জঙ্গল আছে। সেখান থেকে কিছু গাছ আনবে। মিলন কবিরাজের কিছু পুরুষ রোগি আছে। তারা আসে বৌকে সুখী করার দাওয়াই নিতে। বৌকে সুখী করা যদিও তাদের উদ্দেশ্য না। তবে বৌ যদি কারো কাছে তার দুঃখের কথা বলে তবে সে কথা রাষ্ট্র হতে সময় লাগবে না। তখন হাটে-মাঠে কারো কাছে মুখ দেখানো যাবে না। সেখানে পুরুষের বড় ভয়। এই একটা জায়গায় পুরুষ কাবু। ‘মেয়েলোকের চরিত্র খারাপ’ আর ‘পুরুষ লোক পারে না’ এই দুই কথার শক্তি অনেক। রাতে কবিরাজ শক্তি বাড়ানোর ঔষধ বানাবে। তার সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই ঔষধ। সাথে নিজেও একটু পরখ করবে না কি নিজের ঔষধের গুণ?

রাতটা ছিল পূর্ণিমার, নদীর পানিতে জোয়ার এসেছে। বেশ ফুলে ফুলে উঠছে। মিলন কবিরাজের লুঙ্গিটাও বাতাসে ফুলে উঠছে। লুঙ্গির নীচে আর কিছু কী ফুলে উঠছে? ঘুম আসছিল না বলে খ্যাপলা জালটা নিয়ে নদীর দিকে এসেছিল সে। এক অমোঘ আকর্ষণে ওপারে ভেলা থামায় কবিরাজ। রাত-বিরাতে চলার জন্য তার লুঙ্গির গিঁটে একটা টর্চ থাকে সব সময়। টর্চ জ্বালায় না সে। বেশ চাঁদের আলো। বাঁশবগানের মধ্যে আলো-ছায়া খেলা করছে। চাঁদটাও লুকোচুরি খেলছে মেঘের সঙ্গে। কুসুমের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। আচ্ছা, দরজা ধাক্কা দেবে! না। তা করা যাবে না। গোয়ালঘরের পাশের মইটা চোখে পড়ে। মইটা বেয়ে সে টালির ছাদে উঠে যায়। টালিগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। সরাতে বেগ পেতে হয় না। তারপর কাঠের পাটাতনের ওপরে নেমে যায়। একটু সরে আসতে নিচে নামার রাস্তাটা পেয়ে যায়। ঘরের কোণে টিমটিমে হারিকেন জ্বলছে। বিদ্যুৎের লাইন পায়নি মনে হয় এখনো। পিছনে ফিরতে দেখল কুসুম এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। ছেলেটা নেই। হয়তো নানির সঙ্গে শুয়েছে। আস্তে করে খাটে বসে দম নিল কবিরাজ। একটু থিতু হয়ে শুয়ে পড়ল সে। কুসুমের ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়াল। কুসুম তখন স্বপ্ন ভেবে মিলন কবিরাজকে আলিঙ্গন করল। তার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পতিত হল যখন সে তার শরীরে কোনো তরল পদার্থের অস্তিত্ব আবিস্কার করল। চোখ খুলে সে যা দেখল তাতে চিৎকার করতে গিয়েও শব্দটা গিলে ফেলল।

পর দিন বিকেলের কথা। মিলন কবিরাজ আর কুসুম বাড়ি থেকে বেশ দূরে গোড়পাড়া কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। কবিরাজের বৌ তখন তার নতুন পাতা কাঁথাটাতে ফোঁড় তুলছে। এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে যাচ্ছে কেন জানি সেলাই। হিসাব ঠিক থাকছে না। আসছে শীতে এই কাঁথার নীচে ...।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান