ইদানীং সকালে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না।পাশ ফিরে টেবিল থেকে মোবাইলটা অন করে কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকি। একের পর এক গুড মর্নিং মেসেজ মোবাইলে ঢুকতে থাকে। শুভেচ্ছা বার্তা দেয়া নেয়া শেষ হলে তার পর শয্যাত্যাগ করি। কোমর্বিডিটির ফাঁদে আটকেছি। মনে আনন্দ না থাকলেও রাখতে হচ্ছে। বেঁচে থাকাটা এখন শুধু যেন নিয়ম। অথচ বছর দেড়েক আগেও দিনগুলো কি আনন্দেই না কাটিয়েছি। করোনা তখন সবেমাত্র গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি এক শুক্রবার ভোরে দু দিনের জন্য অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে পরেছিলাম। সুতনুর গাড়িতে চালকের আসনে অভীক। পিছনের সীটে সুতনু এবং আমি। সামনে বাঁদিকে বসেছে কিংশুক। আমদের ট্যুর প্ল্যান প্রাথমিক ভাবে কিংশুক সাজায় পরে আলাপ আলোচনা করে সেটা চূড়ান্ত হয়। তবে কিংশুকের সাজানো ট্যুর প্ল্যানে একটা না একটা চমক থাকে। এমনও হয়েছে চারজন এক সাথে বেরিয়েছি কিন্তু যাচ্ছি কোথায় সেটা জানে শুধু কিংশুক। সকালে ফাঁকা রাস্তায় ছুটছে গাড়ি। কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকেছে কল্লোলিনী কলকাতা। সেকেন্ড হুগলী ব্রিজ অভিমুখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। কলকাতা শহরে আপাত-নির্মিত সর্বোচ্চ টাওয়ার “দ্য ফরটি টু” কুয়াশা ভেদ করে উঁকি মারছে।
কর্মসূত্রে আমি অভীক সেন কিংশুক রায় সুতনু ভট্টাচার্য দীর্ঘদিনের বন্ধু। অভীক আমার ব্যাচমেট। চাকরিতে কিংশুক এবং সুতনু দুজনেই আমাদের থেকে কিছুটা জুনিয়ার হলেও দু তিন বছরের গ্যাপে সকলেই অবসর নিয়েছি। বছরে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে একবার বেড়ানো আমাদের প্রায় নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া উইক এন্ডে মাঝেমধ্যেই আমরা চারজন চলে যেতাম অজানা ঠিকানায়। দু তিনটে দিন রকমারি খানাপিনা নিখাদ আড্ডা এবং রসিকতায় কেটে যেত। রিটায়ারমেন্টের পরেও সেই অভ্যাস আমরা ধরে রেখেছি।
বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে টোল প্লাজায় গাড়ির গতি শ্লথ হতেই কিংশুককে জিজ্ঞাস করলাম –ভাই কিংশুক আমাদের এবারের গন্তব্য কি জঙ্গল না জল?
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীমায় কিংশুক অট্টহাসিতে ফেটে পরলো, তার পর বলে উঠল –আর দু থেকে আড়াই ঘন্টা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে মুখার্জি দা। তবে কথা দিচ্ছি, আপনাদের নিরাশ করব না। পাশে বসা সুতনুর গলায় শোনা যাচ্ছে পুরোনো দিনের গানের কলি। প্রথাগত রেওয়াজ অথবা চর্চা না থাকলেও সুতনু খুব সুন্দর গান গায়। কোনা এক্সপ্রেস পার হয়ে গাড়ি এবার বোম্বে রোডে। গান থামিয়ে সুতনু কিংশুককে বলে উঠলো –পারিসও তুই কিংশুক। সাত কান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ। সোজা-সাপটা বললেই হতো দীঘা যাচ্ছি! হো হো করে হেসে জবাব দেয় কিংশুক –আমাদের ডেস্টিনেশন দীঘা নয় সুতনু। তবে চাইলে আজ বিকেলে নয় আগামীকাল, কোন একটা সময়ে তোদের দীঘা আমি অবশ্যই ঘুরিয়ে আনব।
-অগুন্তি বার দীঘা গিয়েছিরে ভাই, আর না। পাশ থেকে বলে ওঠে অভীক।
-দীঘা কিন্তু আগের মতো নেই দাদা। গোয়া না হলেও নতুন করে সেজে ওঠা দীঘা দেখলে তুমি অবাক হতে বাধ্য অভীকদা। দীঘা ইজ ভেরি মাচ চার্মিং নাউ।
-জানি জানি। ঝাউগাছ কেটে কংক্রীটের পেভমেন্ট আর বালি সিমেন্ট পাথরের রকমারি নির্মাণ। সন্ধ্যার পর রংবাহারি আলোয় দীঘা এখন অন্যরকম লাগে। কিন্তু ঝাউগাছ আর বালিয়ারি উধাও। সাইক্লোনের ধাক্কায় এই কসমেটিক ডেভেলপমেন্ট টিকবে কদিন যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
ওদের কথার মাঝে আমি ঢুকে পরলাম –বুঝেছি কিংশুক, তুই আমাদের মন্দারমনি নয় তাজপুরে নিয়ে যাচ্ছিস। কি ঠিক বললাম তো? আমার কথার উত্তর না দিয়ে আবারও হাসিতে ফেটে পরে কিংশুক। কোলাঘাট ব্রিজের আগে স্টিয়ারিং চেঞ্জ করে চালকের আসনে এবার কিংশুক। কিছুক্ষণ পর শের ই পাঞ্জাবে জল খাবারের বিরতি। গরম গরম কচুরী মিষ্টি এবং ধূমায়িত চা দিয়ে টিফিনটা মন্দ হলো না। কোলাঘাট থার্মাল প্ল্যন্ট ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। উদরপূর্তির আনন্দে গানে মেতে উঠলো সুতনু। বিলাস বহুল গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে কিংশুক মাথা দোলাচ্ছে। হাতের তালু নয়তো জানালার কাঁচে অভীক এবং আমি তাল ঠুকছি। কে বলবে আমরা তেষট্টি অথবা পয়ষট্টি ছুঁয়ে ফেলেছি। মনে এক নদী উচ্ছাস আর আনন্দ নিয়ে ছুটে চলেছি অজানা ঠিকানায়।
কাঁথি থেকে জুনপুটের রাস্তা ধরলো কিংশুক। কিছুটা এগিয়ে বাঁক নিয়ে গাড়ি এবার মেঠো রাস্তায়। রাস্তায় মাটির চেয়ে বালি বেশি। গাড়ি কিছুতেই এগোতে চায় না। অভিজ্ঞ কিংশুক ঠান্ডা মাথায় গাড়ি এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। গাড়িতে বসা আমরা সকলেই বাকরুদ্ধ। নির্জন নিরালা জনমানবহীন প্রান্তর। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সরাসরি কিংশুককে জিজ্ঞাসা করলাম -তুই কোথায় নিয়ে চলেছিস আমাদের? চারদিকে কোন জনপ্রাণীর চিহ্নই তো চোখে পড়ছে না।
চালকের আসনে বসে এবার স্মিত হেসে কথা শুরু করলো কিংশুক –বাঙালি পর্যটকদের ঘরের কাছে দীঘার সমুদ্রতটের আকর্ষণ নতুন করে বলার কিছু নেই। তাজপুর মন্দারমনি শংকরপুর এ-সবও এখন অনেকের কাছে পুরোনো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও নতুন নতুন কিছু অজানা অচেনা সাগরবেলা আছে যেগুলো এখনও সেভাবে প্রচারের আলোয় আসেনি। কলকাতা থেকে কমবেশি দুশো কিলোমিটার দূরে সেরকমই একটি স্পটে আমি তোমাদের নিয়ে যাব। আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে। ঝাউবন, লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি, মেঘেদের আনাগোনা। সমুদ্রের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে নিরালা নিভৃতে বসে আড্ডা দিতে দিতে কিভাবে সময় কেটে যাবে বুঝতেই পারবে না। জায়গাটের নাম হচ্ছে “বগুরান জলপাই”। আশাকরি এই জায়গার নাম তোমরা আগে শোন নি।
বালির পথ শেষে আবারও মেঠো রাস্তা। দূরে কয়েকটা চালা ঘর দেখা যাচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে কাঁচা রাস্তার দুপাশে ইউক্যালিপ্টাস আর ঝাউ গাছের সারি। দুলকি চালে এগিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো সবুজে ঘেরা “সাগর নিরালা”রিসর্টে। নীল আকশের নীচে শান্ত নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ। কয়েক একর জমি নিয়ে সাজানো ঝাঁ চকচকে রিসর্ট। শহরের কোলাহল এবং ব্যাস্ত জীবনের একঘেয়েমি থেকে হাঁপ ছেড়ে দুটো দিন অনাবিল আনন্দে কাটিয়ে দেবার আদর্শ জায়গা।
দুপুরে রিসর্টের ঘরোয়া রান্নার আস্বাদ নিয়ে খানিক বিশ্রাম। তার পর বেলা শেষের আগেই পৌঁছে গেলাম সমুদ্রতটে। রিসর্ট থেকে সমুদ্র অনেক দূরে হলেও পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে মন্দ লাগে নি। সমুদ্রের জলরাশি অনেক দূরে চলে গিয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার দল মাটিতে। মনে হচ্ছে যেন লাল ফুলের কার্পেট পাতা রয়েছে। সামনে যেতেই গায়ে লাগছে নোনা হাওয়া। দূরে ভেসে যাচ্ছে জেলে নৌকা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতেই এগিয়ে আসছে সমুদ্র। অদ্ভুত মাদকতায় ডুবে গিয়েছে আমাদের শরীর ও মন। রিসর্টে ফিরে পানীয়ের সাথে দূর্দান্ত ফিশফ্রাই। তার পর হ্যামকে শুয়ে দোল খেতে খেতে সুতনুর খালি গলায় গান সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। নির্ভেজাল আড্ডা, স্মৃতি রোমন্থন এবং পান-ভোজনে কেটে গিয়েছিল দুটো দিন। খুব আনন্দ করেছিলাম।
করোনার অভিঘাতে নিজভূমে বন্দী হওয়ার আগে মেন্টালি ইয়ং আমাদের ষাটোর্ধ চারজনের সেই ঝটিকা সফর এখন শুধুই স্মৃতি। দিনগুলো কিভাবে যে কাটছে এখন! কারোর সাথে দেখা নেই। আগে কথা হতো এখন সেখানেও ভাঁটা পড়েছে। সকালের গুড মর্নিং মেসেজ দেয়া নেয়া করে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছি। কর্তা গিন্নির ব্লাড-প্রেসার, গ্লুকোমিটারে রক্তে চিনি বাড়া কমা ডাইরীতে নোট করার পাশাপাশি নতুন সংযোজন অক্সিমিটারে হাতের আঙ্গুল ঢুকিয়ে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দেখে নেয়া। বাজার হাটের ঝামেলা নেই। বাড়ির কাছে ভ্যান রিকশায় বিভিন্ন বয়সের বিক্রেতা আসে। সব্জি মাছ ফল কিনে নিই। অনলাইনে ওষুধ ডিম মাংস পাঠিয়ে দেয় ছেলে অথবা বউমা। সপ্তাহে তিন দিন সকালে প্যাকেটজাত দুধ আর মাসে দু দিন এ টি এম থেকে টাকা তুলতে বাইরে বের হই।
মাঝে মাঝে সেই ভদ্রলোকের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাস দুয়েক আগের ঘটনা। ব্যাঙ্কের এ টি এম এর সামনে রিক্সা থেকে নেমেছি। হঠাৎ বাজারের ব্যাগ হাতে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন –কতদিন পরে দেখলাম! কেমন আছো? আমার ফোন নাম্বার তো তোমার কাছে নেই। এই নাও আমার নাম্বার। আমার হাতে দশ ডিজিটের নম্বর লেখা একটা কাগজের চিরকুট দিয়ে বললেন -মাঝে মাঝে ফোন কোরো। কাছের মানুষগুলোর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেই মনটা ভালো হয়ে যায়। চলি গো, বাজার করা আছে।
কথা শেষ করে ভদ্রলোক হাঁটা লাগালেন। বুঝলাম যে ভদ্রলোক নির্ঘাৎ আমাকে কারোর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। একরকম দেখতে কত মানুষই তো হয়। তাছাড়া মুখে মাস্ক লাগানো রয়েছে, ভুল হতেই পারে। রাস্তার পাশে ওষুধের দোকান থেকে একটি কম বয়সী ছেলে আমায় ডেকে বললো -জেঠু উনি তারকাটা। রোজ সকালে বাজার করার নামে বের হন তার পর আপনার মতো কোন একজনকে ধরে দু চার কথা বলে ফোন নম্বর দিয়ে বাজারের দিকে চলে যান। একটু পরেই ফিরে আসবে। দেখবেন হাতের ব্যাগ খালি। ছেলেটির কথার সত্যতা যাচাই করার ইচ্ছে আমার হয়নি। এ টি এম থেকে টাকা তুলে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। পরে জেনেছি ভদ্রলোক আমাদের পাশের পাড়ায় বছর তিনেক আগে ফ্ল্যাট কিনেছেন। ওঁর স্ত্রী কোভিড আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। বেঁচে ফিরেছেন তবে বাহ্যিক জ্ঞান নেই। একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকে। ভদ্রলো্কের কি করুণ অবস্থা। সেদিক থেকে আমি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। কাছের মানুষ কাছেই আছে। কর্মসূত্রে ছেলে বউমা মাত্র সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরে। সরাসরি দেখা না হলেও প্রযুক্তির দৌলতে ওদের দেখি কথা বলি।
দ্যাখ কান্ড মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে গেল কি করে! ভাগ্যিস খেয়াল করেছিলাম, সুতনু ফোন করেছে।
-হ্যাঁ, বল কি খবর তোর?
-আর খবর! ভাবছি সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেন করার নামে আমরা কতটা আনসোশ্যাল হয়ে গেছি। এটা নিয়ে তোমায় পাঁচটা কল করলাম। ধরছো না দেখে তো একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম।
-সরি, ভে্রি সরি মাই ফ্রেন্ড। মোবাইল টা মিউট হয়ে গিয়েছিল। তোর খবর বল। তোর নাতিবাবু সারাদিন বাড়িতে খুব দুস্টুমি করছে তাই না!
-সে আর বলতে, তবে এখন অন-লাইন ক্লাস নিয়ে খুব মেতে আছে। ফোন করলাম কেন জান দাদা। কাল মাঝরাতে বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখেছি।
-কিরকম!
গতকাল রাতে বিছানায় শোবার আগে হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজ দেখলাম। এক ভদ্রলোক লিখেছেন “একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে চাই। বারাসাত কলোনী মোড়ের কাছাকাছি কোথাও পাওয়া গেলে খুব উপকার হতো। কারও সন্ধানে থাকলে কমেন্ট করবেন প্লীজ”।
-তার পর
ঘরের আলো নিভিয়ে কিছুক্ষণ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। অক্সিমিটারটা বিছানার পাশেই রাখা। কেনার পরে দু দিন ঘন্টায় ঘন্টায় চেক করতাম। শেষ কবে করেছি মনে নেই। খাচ্ছি ঘুমোচ্ছি ফোন-আলাপ করছি। নাতিবাবুর সাথে মজা করছি। অক্সিজেন স্যাচুরেশনের সমস্যা নেই। আর কি চাই! কিন্তু কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ দেখে বড্ড ভয় পাচ্ছি দাদা। এরপর থার্ড ওয়েভ, কি হবে জানি না। ঐ ভদ্রলোকের মেসেজটাও খুব ভাবাচ্ছিল। হাভাতে ঘরের ছেলের মতো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। ঘুম আসছে না। ঘুম চাই ঘুম। চাইলেই কি আর ঘুম আসে। প্রাণপন চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না।
-ঘুমের তো কোন দোষ নেই সুতনু! বিছানায় শুতে যাবার আগে মোবাইল ঘাটলে, আজেবাজে চিন্তা করলে ঘুম আসবে কি করে? বল তার পর কি হলো।
-বাইরে ফ্যাৎ ফ্যাৎ শব্দে উড়ে গেল একটা পেঁচা। আমার স্ত্রী প্রায় সন্ধ্যায় পেঁচাটা দেখতে পায়। পাশের বাড়ির বাগানে থাকে। জরাজীর্ণ বাড়িটা ভেঙে শুনেছি এবার রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাট হবে। পেঁচাটা উড়ে কোথায় গেল? ওর অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে না তো!
-হঠাৎ পেঁচাকে নিয়ে পরলি কেন?
-ঐ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল যে! উনি অক্সিজেন জোগার করে ফেলেছেন কিনা ভাবছিলাম। পোড়া দেশে যাই হোক না কেন সহৃদয় ব্যাক্তির আকাল এখনও হয়নি বলো দাদা। তাছাড়া ওর এলাকায় “রেড ভলান্টিয়ার্স” নিশ্চয়ই আছে। এর মধ্যেই পেঁচাটা আবার উড়ে গেল। কেন এমন করছে পেঁচাটা? বাইরে প্রকৃতির কোন সমস্যা? পেঁচাটাকে আজও আমি দেখিনি। স্ত্রীর কাছে শুনেছি গায়ের রঙ সাদা, গালে চন্দন বুটির ছোপ। মনে মনে পেঁচাটার মুখ কল্পনা করে ঘুমতে চেষ্টা করি। কোথায় ঘুম! ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির পেঁচা এসে ভিড় করেছে আমার মাথার চারপাশে। ধীরে ধীরে ওরা বদলে যাচ্ছে। জেন্ডার চেঞ্জ হচ্ছে কিনা জানিনা, কিন্তু চেঞ্জ একটা হচ্ছে। ওদের রূপ বদলের গতি এবার বাড়ছে। তীক্ষ্ণ বাঁকা ঠোট, ধূসর অবয়ব, বিশালাকার কালো ডানা। সংখ্যায় বাড়ছে ওরা। আরে আরে এরা তো হারিয়ে যাওয়া শকুন! কিশোরবেলায় কত দেখেছি খাল পাড়ে। মড়া পশুর মাংস খুবলে খেত। শকুনের ছবি দেখছি কেন! কোন হিন্ট দিচ্ছে? ভদ্রলোক কি অক্সিজেনের খোঁজ পান নি এখনও! কি নিদারুণ অসহায় অবস্থায় আমরা সবাই দাঁড়িয়ে। শ্বাস বায়ুর তীব্র আকাল। আর পারছি না, এবার ঘুমতেই হবে। আয় ঘুম আয়, আমার দুচোখ জুড়ে আয়। মায়ের ঘুম পাড়ানি গান বাজছে আমার কানে।
-অবশেষে ঘুমিয়ে পরলি তাই তো?
-হ্যাঁ, তবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। আমার চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে ঘুম ভাঙায় স্ত্রী। স্বপ্ন দেখে নাকি ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠেছিলাম। ওর কথায় কি স্বপ্ন দেখেছিলাম মনে করতে চেষ্টা করি। স্বপ্নটা ভালো নয়। সার সার মৃতদেহের মাঝে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কে যেন বলে উঠল -স্যার প্লীজ স্ট্যান্ড ইন দ্যা কিউ অ্যান্ড ওয়েট ফর ইয়োর টার্ন।
সুতনুর স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে আমি বাকরুদ্ধ। হতাশা আর অবসাদ ওকে গ্রাস করছে। ভাগ্যিস ফোন করেছিল! কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম -তুই তো সাংঘাতিক ডিপ্রেসড সুতনু।
তাই!
তাই নয়তো কি। টেলিভিশনে ঘন্টায় ঘন্টায় খবর শুনিস, টক শো দেখিস আর নেগেটিভ চিন্তায় ডুবে থাকিস। ডিপ্রেশন তো হবেই তাই না। ট্রাই টু বি পজিটিভ সুতনু, না হলে বাঁচবি না।
-কি করে পজিটিভ থাকবো দাদা। চারদিকে যা হচ্ছে!
-তবুও চেষ্টা তো করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেরা একটু সতর্ক থাকলেই হলো। অযথা আতংকগ্রস্ত হবার দরকার কি। তাছাড়া এখন অখন্ড অবসর। বই পড়, গান শো্ন। অ্যালবাম খুলে পুরোন ছবি দেখ। ভ্রমণ-স্মৃতি রোমন্থন কর। জানিস সুতনু টেলিপ্যাথি কিনা জানিনা। আজ সবার কথা খুব মনে হচ্ছিল। আমাদের বগুরান জলপাই ট্রিপের ভিডিওটা সকাল থেকে দেখছিলাম। কি আনন্দই না করেছিলাম বল।
-আর কি সেসব দিন আসবে!
-আলবত আসবে। হয়তো সময় লাগবে। ভ্যাক্সিনেশনের গতি এবং সংখ্যা বাড়লে হার্ড ইমিউনিটি অনেকটা বেড়ে যাবে দেখিস। সেরো সার্ভের রিপোর্ট তো তাই বলছে।
-হলেই ভালো।
-আমি কিন্তু একটা স্বপ্ন দেখার জন্য অপেক্ষা করছি সুতনু।
-কি স্বপ্ন দাদা!
-একদিন ভোর রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙবে। আমি জিজ্ঞাসা করবো –কে? উত্তর আসবে- দরজা খোল, আমি পৃথিবী। দেরীতে হলেও সেড়ে উঠেছি।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন