এতো কিছু বলার পরও ফারুক বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিতুর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কাকে বিশ্বাস করেছে সে? কাকে ভেবেছিলো জীবন, বাঁচবে না কাকে ছাড়া? নিতু কিছুই ভাবতে পারছে না। চোখের সামনে হাজার হাজার তারা জ্বলছে। বুকটা যেনো ইটভাটার মতো পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। নিতু জ্ঞান হারানোর আগে জানলো না, ফারুক আবারো ফিরে আসবে এবং আর সব দিনের মতো তাকে বলবে - তোমাকে ভালোবাসি!
দুই.
রাস্তায় মানুষজন খুব কম। অবশ্য ভর দুপুরে রাস্তায় মানুষ কম থাকারই কথা। দু-একজন হতভাগা এই রোদে গা পেতে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করতে যাচ্ছে। ফারুক অবশ্য নিজেকে হতভাগা ভাবে না। সে ভাগ্যে ভীষণ অবিশ্বাসী। তার ধারণা কর্মই মানুষ ডোবায়-ভাসায়। নিতুর পেটে বাচ্চা বড় হচ্ছে-খবরটি শোনার পর সে ভয়ে খাবি খায় নি। বরং কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। অথচ ব্যাপারটায় ঝামেলা অনেক বেশি হওয়ার কথা। সেই ঝামেলাকে ভয়ও পাওয়ার কথা। কী কেলেঙ্কারী কথা। নিতুকে হয়তো শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে হবে। ফারুকের চাকুরি নেই তিনমাস। তার উপর নিতুর বাড়তি ঝামেলা। বুকের মধ্যে কী যেনো অলক্ষ্যে বিঁধে। বিয়ে না করলে নিতু আত্মহত্যা করবে বলেছে। ফারুক অবশ্য অ্যাবরশনের পক্ষে। অথচ নিতু মা হতে চায়। এদিকে ফারুকের হাত-পা-নাক বাঁধা। নিজে চলতে পারলেও একটা কথা ছিলো। তার উপর নিতু! এমন সব ভাবনা থেকেই সম্ভবত মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিলো। নতুবা নিতুর গায়ে সে হাত তোলে কীভাবে? ফারুক ভাবছে নিতুর কাছে আর যাবে না। সে যা কিছু চায় করুক। কিছুক্ষণ আগে নিতু যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে, সে ভাবনা ফারুকের মনের ধারে কাছেও আসে নি। আসলে হয়তো ভালো কিছু হতে পারতো। ফারুক ফুটপাতের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসে পড়ে। ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। আবার এখন কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। কী করবে বুঝতে না পেরে সে কেবল মনোযোগ দিয়ে নখ খুঁটতে থাকে।
তিন.
মাহা ক্লাসে পড়াচ্ছিলো। কিন্তু মনে মনে ভাবছিলো-আজ ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে হবে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে একটা ছেলে নখ খুঁটছিলো। এর আগেও ছেলেটাকে দেখেছে মাহা। চুপচাপ শান্ত। কখনো দেখেছে ছেলেটা হাঁটছে। কখনো মোবাইলে কথা বলছে। কখনো চা খাচ্ছে। ছেলেটার নাম জানা হয়ে উঠেনি এতো দিনেও। ‘অ-তে অলস সঙ্গ ত্যাগ করো’ সম্মিলিত চিৎকারে মাহার ভাবনার জগতে খিলান লাগে। সে তখন পর্যন্ত জানে না যে-ছেলেটা অন্য একজনকে ভালোবাসে। তার বাচ্চা সেই মেয়েটির পেটে। যেহেতু সে এসব জানে না, তাই মাহা সহাস্যে বাচ্চাদের পড়াতে থাকে-‘আ-তে আলস্য দোষের আকর।’
চার.
একটা খুন হয়েছে। যাকে খুন করা হয়েছে-তার চেহারা নেই। এসিড দিয়ে মুখটা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ডেডবডিটা দেখার পর থেকে ফারুকের গা গুলিয়ে বমি আসছে। বডিটা কার-অন্য সবার মতো সেও বুঝতে পারে না। তবে সে এটা বুঝতে পারে পুলিশের একজন এসআই তার দিকে কিছুক্ষণ ধরে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে-ই খুন করেছে মানুষটিকে। এসআই যখন কাছে এলো, জানা গেলো তার নাম মামুন। মামুন হিমস্বরে বললেন, আপনি কে? এমন প্রশ্নে ফারুক কিছুটা ভড়কে যায়। তার গলা শুকিয়ে আসে। ফারুক হড়বড় করে বলে, আমি ফারুক। এ পাড়াতেই থাকি। ঢাকা কলেজ থেকে দর্শনে মাস্টার্স করেছি গত বছর। এসআই সন্দেহজনকভাবে বললেন, আমার সাথে আসেন, কথা আছে। ফারুকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। হার্টবিটও বেড়ে যায়। বললো, কী কথা? এসআই মামুন আবারো বললেন, আসেন আমার সাথে। জরুরি কথা আছে। ফারুক আর ভাবতে পারে না। কী মুসিবতে পড়া গেল। জীবন-মরণ সমস্যা। ফারুক চোখে ঘোলা ঘোলা দেখতে শুরু করে।
পাঁচ.
মাহার বাসার একটু দূরেই ডেডবডিটা পাওয়া গেছে। স্কুল থেকে ফিরে মাহা দেখে বাসার সামনে মানুষে গিজগিজ করছে। এক মিনিট পার না হতেই অন্যদের মতো সেও জানতে পারে ডেডবডিটার কথা। মাহা ভয় পায় নি। তবে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো। ভয় পেলো ঘণ্টাখানেক পরে। ঘণ্টাখানেক পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো, একজন পুলিশ তার পছন্দের ছেলেটির সাথে কী যেন বলছে। মনে হলো, ছেলেটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ডেডবডির পেছনে ছেলেটির হাত কীভাবে থাকতে পারে? মাহার মনে এমন ভাবনা ক্ষণিকের জন্যে ঠাঁই পেলো। তারপর অদ্ভুত ঘোর হঠাৎ যেন তাকে জেঁকে ধরে। মাহা নিচে নেমে আসে। পুলিশ কর্মকর্তা তখনো রাগী রাগী চোখে ছেলেটাকে কী যেনো বলছিলো। মাহাকে দেখে পুলিশ ও ছেলেটি দুজনেই তার দিকে তাকায়। মাহা এসআইয়ের কাছে জানতে চায় কী হয়েছে। এসআই জানায় ছেলেটির নাম ফারুক। এ কথার মধ্য দিয়ে মাহা জানতে পারলো তার পছন্দের ছেলেটির একটি সুন্দর নাম আছে। তার নাম ফারুক। এরপর এসআই আর কী কী বললেন তা আর খেয়াল করে নি মাহা। ফারুকের বিমর্ষ মুখটি দেখে তার মন উদাস হয়ে গিয়েছিলো।
ছয়.
খুনের ঘটনাস্থল থেকে কেউ পছন্দের মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারে-এমন ঘটনা কারোই আগে জানা ছিলো না। মাহাও ভাবে নি এভাবে ফারুকের সাথে তার পরিচয় হবে। একটু আগে মাহার বদান্যতায় এসআইয়ের প্রশ্নগুলো ফারুককে ছেড়ে চলে গেছে। সেজন্যে মাহাকে সে ধন্যবাদ জানায়। কথায় কথায় মাহা জানায় সে একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এবং সে ফুল ভালোবাসে। ফারুকও কথায় কথায় বলে, নিতুর নামে তার একজন প্রেমিকা আছে। মাহা অদ্ভুত হাসে। ফারুক জবাবে কিছুই বলে না। মানুষের গিজগিজ ভাব এখন দূর হয়েছে। লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্যে পুলিশ নিয়ে গেছে। মাহা-ফারুকের মতো আরো দু-চারজন রাস্তায় আছে এখনো। কথায় কথায় মাহা জানায়, সে বিবাহিত। তার স্বামী গতকাল টাঙ্গাইল থেকে বাসায় আসার কথা। এখনো আসে নি। তার ফোনও বন্ধ। ফারুক চিন্তিত হয়ে উঠে। মাহা কী যেনো ভাবে। তারপরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে, বাসায় যাচ্ছি। ভালো থাকবেন। ফারুক আশ্চর্য হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাহার আচরণ কেমন যেনো আঁধার মেশানো। মাহা কি তাকে কোনোভাবে পছন্দ করে-এমন প্রশ্নটি ফারুকের মনের মধ্যে তিলমাত্র আসে না। বরং সে মনে মনে জানতে চায় মাহার স্বামী কেনো এখনো বাসায় এসে পৌঁছলো না। অবশ্য ফারুক জানে না-মাহার কাছেই এ প্রশ্নের জবাব সংরক্ষিত রয়েছে।
সাত.
নিতুর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন রাত। তার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। শিয়রে ক্লান্ত চোখ নিয়ে বাবা বসা। নিতুকে চোখ মেলতে দেখে এক মুহূর্তেই বাবার মুখ থেকে চিন্তাগুলো সব উড়ে গেলো যেনো। নিতু চারপাশে তাকায়। সে দেখছিলো ফারুক কোথাও আছে কিনা। ফারুকের প্রসঙ্গ মনে আসতেই তার মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে উঠে। বাবা যদি তার মা হওয়ার কথা শুনে-তিনি নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক করবেন। একমাত্র মেয়ে। কী কেলেঙ্কারী ব্যাপার। বাবা বললেন, কী হয়েছিলো তোর? নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলি! নিতু মৃদু হাসে। হঠাৎ মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো, বুঝতে পারি নি-বাবাকে এমন দু-এক কথায় বুঝ দেয় নিতু। মনে মনে এও ঠিক করে-সে গোপনে অ্যাবরশন করবে। সে একাই যাবে হাসপাতালে। ফারুকের কথা মনে আসতেই নিতুর চোখ দুটি আরো লাল হয়ে উঠতে থাকে।
আট.
ফারুকের সাথে পরদিন মাহার দেখা হয়েছিলো। মাহা ইঙ্গিতে কী যেনো বোঝাতে চায়। যদিও তাকে গতকালের চেয়ে আজ কিছুটা ম্লান মনে হচ্ছিলো। ফারুক জানতে চেয়েছিলো-তার স্বামী ফিরেছে কিনা। মাহা শুনে হঠাৎ করেই হেসে দিয়েছিলো। বললো-ও না আসলেই ভালো। সম্ভবত আর আসবেও না। কথাটুকু বলেই আবারও সে হাসলো বললো, মজা করে বললাম। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহা বললো, আসলে, আমার স্বামীটি জঘন্য লোক। আমি অতিষ্ঠ। আমি একবছর ধরে ডিভোর্স চাইছিলাম। ফারুকের মনে পড়লো গতকালকের লাশটির কথা। তিন টুকরো দেহটি কোন হতভাগার? তার একবারও মনে হলো না, এই লাশটি মাহার স্বামীরও তো হতে পারে! ফারুকের মনে হলো-মাহা বিবাহিত। তবু সে ফারুককে ভালোবাসে। অন্তত মাহার চোখ-মুখ, কথাগুলো সেকথাই বলছে। এসব কথা সে ভাবছে-তখন কে যেনো নিতুর মুখটি তার সামনে এনে বসিয়ে দিলো। ফারুকের খেয়াল হলো-নিতু গতকালকের পর আর ফোন করে নি। আজ নিতুর বাসায় যাওয়া দরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাহার কারণে আর যাওয়া হয়ে উঠলো না। তাকে থানায় যেতে হয়েছিলো। কারণ, পুলিশ সন্দেহবশেত মাহাকে আটক করেছে। পুলিশের সন্দেহ: মাহা তার স্বামীকে হত্যা করিয়েছে। পুলিশের কথা ফারুকের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তার মনে হচ্ছে সে কোনো ঘোরের জগতে আছে। কোনোভাবেই ফারুক সেই ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। অথচ মাহা জেলের মধ্যে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি।
নয়.
ফারুক পরের দিন নিতুর বাসায় যখন পৌঁছলো তখন বাসায় কেউ ছিলো না। নিতুর বাবা এ সময়ে অফিসে থাকেন-তথ্যটা ভালোই জানা আছে ফারুকের। আসার আগে দু-তিনবার কল করছিলো নিতুকে। নিতু কল রিসিভ করে নি। বাসায় পৌঁছে ফারুক নিতুকে প্রথম যে কথাটি বললো, সেটির জন্যে নিতু প্রস্তুত ছিলো না। আবার পরবর্তী ঘটনা শোনার জন্যে ফারুকও প্রস্তুত ছিলো না। ফারুক বললো, নিতু, যা হবার হয়ে গেছে। তোমার পেটের বাচ্চা আমার। তোমার কথাই ঠিক। আমি তোমাকে আজই বিয়ে করবো। নিতু ভাবতেই পারে নি-দুদিন আগের ফারুক আচমকা আজ আমূল বদলে যাবে। অথচ নিতু গোপনে হাসপাতালে গিয়ে অ্যাবরশন করিয়ে ফেলেছে। নিজের অনাগত সন্তানকে সে হত্যা করেছে। ফারুক যখন এ কথাটা শুনে সে আকাশ থেকে না পড়ে পারে না। নিতু কাঁদতে থাকে। ফারুক কী বলবে ভেবে পায় না। বুকটা কেমন খা খা করে। নিজেকে তার প্রতারক প্রতারক মনে হয়।
দশ.
ফারুক চেয়ারে বসে কাঁদছে। তার রুমে আরো তিনজন লোক দাঁড়ানো। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন ফারুকের বাবা, অন্যজন মা। তিনজন লোক যে রুমে বসে আছে-সে খবর ফারুকের নেই। সে বিড়বিড় করছে আর কাঁদছে। সাইক্রিয়াটিস্ট অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ফারুকের রোগটা সারার সম্ভাবনা একেবারে কম। সে নিজের মাথার মধ্যে অদ্ভুত জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। সেই জগতের চরিত্রগুলো নিয়ে সে ইচ্ছে মতো খেলছে। কিন্তু ফারুক বুঝতেই পারছে না, সে যাদের দেখছে বা যাদের সাথে কথা বলছে তাদের কোনো অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। ডাক্তারের কথা শুনে ফারুকের বাবা-মায়ের চোখের পানি বাঁধ মানতে চায় না। কাঁদতে কাঁদতে ফারুকের বাবার মনে পড়ে, ফারুক বছর খানেক আগে নিতু নামে একটা মেয়েকে ভালো বেসেছিলো। কী কারণে যেন নিতু মাস দুয়েক আগে সুইসাইড করেছে। সেই থেকে ফারুক ঘরে বসে থাকে। একা একা কথা বলে, হাসে, কাঁদে।
ফারুকের মা-বাবা তখনো জানে না, ফারুকের জগতে এখনো নিতু বেঁচে আছে। এই তো ফারুক নিতুর সামনে বসে কাঁদছে। নিতুও হু হু করে কাঁদছে। কষ্টে ফারুকের বুক ফেটে যাচ্ছে। কারণ সে তার সন্তানকে হত্যা করেছে।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন