সিগারেটে দুটো সুখটান দিতেই শরীরটা কেমন জুড়িয়ে গেল নেহালের। সাতসকালে এই ডোজটুকু না হলে স্টোমাক ক্লিয়ার হয় না। কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝামেলা আছে তার, পায়খানায় বসে জোরসে কোঁথ দিতে দিতে একেকদিন কাহিল হয়ে যায়। কোনো কোনোদিন পায়খানার স্বচ্ছ সাদা কমোডে তাজা রক্তের স্রোত বয়, তখন গা-মাথা শিউড়ে ওঠে , মনে হয় এই বুঝি মৃত্যু ঘনিয়ে এলো। কিন্তু না, ডাক্তার বলেছে, এসব এখন প্রায় সব লোকেরই হচ্ছে। গপাগপ খাচ্ছে তো লোকে, তেলেভাজা জিনিস, বিরিয়ানি, তেহারি, ভুনা খিচুড়ি, আরো কত কী! রাস্তায় রাস্তায় দেখেন না, কত সাইনবোর্ড ঝোলে, কত সব বিজ্ঞাপন? শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল নেহাল। ডাক্তারটা একটু বেশি বকবক করেছিল সেদিন, কিন্তু যতই বকবক করুক, জীবন নিয়ে অমন আশার বাণী ক’জন ডাক্তারই বা শোনায়? সব শালারা তো ছুরিকাঁচি নিয়ে বসে আছে জবাই করার জন্য।
এখন, শীতের এই নরম রোদে দাঁড়িয়ে বেনসনের ফিল্টারে শেষ টান দিতে দিতে তলপেটে যে চাপ পড়ল, তার কী হবে? আশেপাশে কোথাও কোনো পাবলিক টয়লেট আছে কি? কিন্তু তা থাকলেও তো এখান থেকে নড়াচড়া করা সমিচীন হবে না। মিসেস শিউলি এই এখনই নামবে। নেমেই যদি দেখে, তার মাস্টার্স পাশ, কেতাদুরস্ত, ফিটফাট বডিগার্ড-কাম-ড্রাইভার পায়খানা করতে ছুটেছে পাবলিক টয়লেটে, তবে নিশ্চয় অনেক বিরক্ত হবে। ম্যাডাম এমনিতে খুব ভালো মানুষ, নেহালের কোষ্ঠ-কাঠিন্যের সংবাদ শুনে নিজে থেকেই বলেছিল, ট্রিটমেন্টটা করিয়ে নাও, টাকাপয়সা যা লাগে আমি দেবো। শুনে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়েছিল সে, এই না হলো মালিক। কথায় কথায় টাকা ছুড়বে!
শেষমেশ তলপেটের চাপটা হজম করতে হলো তাকে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু নয়, দম বন্ধ করে খানিক চুপচাপ থাকো, তলপেটের উদগ্র চাপটাকে ঠেলেঠুলে খানিক ওপরে, হ্যাঁ, টেনেটুনে খানিক ওপরে তোলো—ব্যাস, অন্তত আধাঘন্টার জন্য মুক্তি। কিন্তু তারপর? না, তারপর কী হবে, তা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় নেহাল। সে জানে, আর মিনিট দশেকের ভেতর তার মোটাগাটা, হেলাদোলা, পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর বয়সী ফর্সা ম্যাডাম নিচে নামবে। ঢুকেছেও প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। সাদা রংয়ের পাঁচতলা উঁচু বিল্ডিংটার বিশাল গেট পেরোবার সময় ম্যাডাম তার ভাঙ্গাচোরা ইংরেজি আর বাংলার মিশেলে বলে গিয়েছিল, ‘নেহাল, আমি না আসা পর্যন্ত ভেতরে ঢুকবে না, আই উইল বি হেয়ার উয়িদিন ওয়ান আওয়ার। গট ইট?’ নেহাল নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়েছিল।
প্রায় একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নেহাল তাকাল তার সদ্য কেনা ফরেস্ট ঘড়িটার দিকে, সোয়া এগারোটা বাজে। ম্যাডাম ঢুকেছে কাটায় কাটায় দশটায়। অর্থাৎ, আর বেশি দেরী নেই। শীতের সকালে যে নরমসরম সূর্যটা এতক্ষণ হালকা আর মিষ্টি তাপ ছড়াচ্ছিল, বেলা বাড়ার সাথে সাথে সেটা ক্রমেই উৎকট আর তেতো হয়ে উঠল। কিন্তু মিসেস শিউলির নামগন্ধ কোথায়? এতো দেরী তো হবার কথা নয়!
নেহাল যে কিছু আঁচ করতে পারেনি, তা নয়। আজ সকাল আটটায় মিসেস শিউলি যখন তার মোটাগাটা শরীরটাকে নীল রংয়ের সিল্কের শাড়িতে মুড়ে, বডি স্প্রের তীব্র গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে টয়োটায় চড়ে বসল, তখনই সে বুঝতে পেরেছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। বহুদিন এলিটদের সঙ্গে থেকে থেকে আজকাল সে তাদের মুখ দেখেই বলে দিতে পারে, কার মনের ভেতর কী চলছে। গতরাতে পার্টিতে কোমর দুলিয়ে নেচেগেয়ে, দামী হুইস্কি টেনে, টলতে টলতে মিসেস শিউলি যখন বাসায় ফিরেছিল, তখনও তার মুখ ছিল বেশ উজ্জ্বল, ফুরফুরে। বাসায় ঢোকার সময় গাড়ি থেকে নেমে কাঁপা কাঁপা হাতে নেহালকে পাঁচশো টাকার দুটো নোটও বখশিশ দিয়েছিল। কিন্তু একরাতের মধ্যে এমন কী ঘটল যে ঐ নীল শাড়ি আর উৎকট বডি স্প্রের গন্ধে মোড়া গোলগাল মুখটা অমন কালো কুচকুচে হয়ে গেল?
স্বামীটা তার মারা গেছে হার্ট এটাক করে, তাও বছর দুয়েক হলো। একমাত্র ছেলে আমেরিকায় বিবিএ এমবিএ করতে গেছে, সেও প্রায় তিন কি চার বছরের ধাক্কা। শুধু কলেজপড়ুয়া একটা মেয়ে আছে বাড়িতে, কিন্তু সে মেয়েটাও বড় চুপচাপ গোছের। জিন্স, টি শার্ট, টপস পড়ে সারা দুনিয়ায় ফুরফুর করে উড়ে বেড়ালেও মেয়েটার মুখে কথা কম। তবে নাকটা একটু উঁচু। চাকরবাকরের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলে, মায়ের সাথে তেমন কথা বলে না। রাতে মিসেস শিউলির তো কারো সাথে ঝগড়া হওয়ার কথা নয়। অবশ্য স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে রাতে-বিরাতে দু’একজন অচেনা পুরুষকে সাথে নিয়ে মাঝেমধ্যেই নেহাল তাকে ঢুকতে দেখেছে তার ঐ দশতলা বিল্ডিংয়ে। বডিগার্ড এবং ড্রাইভার বলে এসব অতি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নেহালের নজর এড়াতে পারে না। কিন্তু গত রাতে মিসেস শিউলি তো টলতে টলতে একা একাই বাসায় ঢুকেছিল, তার সাথে কোনো পুরুষকে তো সে দেখেনি। তাহলে? আজ সকালে হুড়মুড় করে টয়োটায় চড়ে মিসেস শিউলি কেন অমন কর্কশ গলায় হাঁক ছেড়েছিল, ভেরি ফাস্ট, জিইসি হয়ে চকবাজারে চলো? তার মুখটা ছিল কালো।
অবশ্য নেহাল জানে, মাঝেমধ্যে এমনসব কারণে এদের মনমতি খারাপ হয়, যেসব কারণও বড়লোকি ধাঁচের। এই তো ক’দিন আগে ম্যাডামের বিদেশি কুকুরটা দু’বেলা না খেয়ে ছিল বলে তার সে কী হাঁসফাঁস! মিসেস শিউলি নিজেও বুঝি ঐ দু’বেলা কিছু খেতে পারেনি। কোন এক ভেটেরিনারি ডাক্তারকে কল করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, ডক্টর, প্লিজ সেভ মাই টমি। এসব দেখে শরীরটা বড্ড জ্বালাপোড়া করে নেহালের। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, বুড়িধাড়ি মাগীটার কুত্তার জন্য কত দরদ!
তা ঐ জিইসি থেকে চকবাজার যাওয়ার পথে মিসেস শিউলির সেই কাঁদো কাঁদো গলাটা আজ আবার শুনতে পেয়েছে নেহাল। মুঠোফোনে কার প্রতি যেন সদয় মিনতি ঝরে পড়ছিল তার খসেখসে গলা থেকে, আই অ্যাম পাসিং এ ভেরি ড্রেডফুল টাইম। প্লিজ সেভ মি। নেহাল ভাবল, কুত্তাটা কি আজ আবার অসুস্থ্য হয়ে গেল নাকি? ফোনের ওপাশে যে কথা বলছে, সে কি ভেটেরিনারির ডক্টর?
খানিক বাদে পঁচিশ কি ত্রিশ বছর বয়েসী একটা জোয়ান ছেলের সাথে ঢলাঢলি করে হাসতে হাসতে লিফট বেয়ে নিচে নামল মিসেস শিউলি। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা উর্দি পড়া দারোয়ান দুটো তাদের দেখে লম্বা সেলাম দিয়ে খুলে দিল গ্রিলের গেট। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাচক্যাচ টাইপের একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মিসেস শিউলি বোধহয় একটু বিরক্তই হলো। সে তার ঐ পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর বয়সী বুড়িধাড়ি গলায় সামান্য ছুকড়িসুলভ ন্যাকামি যোগ করে বলল, রবিন, ইটস সো ইরিটেটিং। হোয়াই ডোন্ট ইউ রিপ্লেস দিজ গেইটস? খাসা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটার ঠিকঠাক উত্তর কী হবে, সেটা ভাবতে ভাবতে যখন ধীর পায়ে এগোচ্ছে জোয়ানটা, সেই ফাঁকে দ্রুত এগিয়ে এসে টয়োটার দরজাটা খুলল মিসেস শিউলি, তারপর ধুপ করে বসে পড়ল পেছনের সিটে। জোয়ানটাও পিছে পিছে নেড়ি কুকুরের মতো লকপক করতে করতে এসে বসে পড়ল তার পাশের সিটে। নেহাল ততক্ষণে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছে। মিসেস শিউলি এবার জোয়ানটাকে নিয়ে জুত হয়ে বসে হালকা নরম গলায় বলল, নেহাল, স্ট্রেইট আগ্রাবাদ চলো।
বেলা বেড়েছে অনেকখানি। চকবাজার থেকে টয়োটার চাকা গড়াতে গড়াতে জামাল খান, লালখান বাজার, দেওয়ান হাট পেরিয়ে আগ্রাবাদ মোড়ে গিয়ে থামবে। টয়োটা এগোচ্ছে দু’পাশে পাহাড়ঘেরা রাস্তা ধরে। মিসেস শিউলির হালকা ভেজা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে জোয়ানটা বোধহয় আচমকা একটা কবিতা আওড়াল, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা! মিসেস শিউলি ভ্রু কুঁচকে বলল, হঠাৎ জীবনানন্দ? জোয়ানটা বলল, হ্যাঁ, নয় কেন? লিটারেচারের প্রতি আমার অন্যরকম একটা প্যাশন কাজ করে। জীবনানন্দ বলো, রবীন্দ্রনাথ বলো, নজরুল বলো, এরাই তো বাংলার হোমার, শেক্সপিয়ার, বায়রন। বলতে বলতে কোন ফাঁকে যে তার লম্বা হাতটা পাশে বসা মেদচর্বিজমা শরীরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল, তা বলা মুশকিল। অথচ কী সাবলীল, কী সহজ হাসি থৈ থৈ করছে মিসেস শিউলির মেকাপ করা মুখে! হেসে হেসে বলছে, রবিন, ইউ আর সো সিলি! তারপর খানিক ধস্তাধস্তি, খানিক ফিকফিক হাসি, খানিক চাপা গুঞ্জন ছাপিয়ে হঠাৎ মিসেস শিউলির গলাটা ষোলো বছরের ছুকড়িদের মতো ঝনঝন করে উঠল, ইউ আর এ প্রিন্স অফ দিস কান্ট্রি, সন অফ এ মিনিস্টার, ক্যান্ট ইউ সেভ মাই বিজনেস? করগুলো ফাঁকি দেওয়ার সাহস করেছিলাম তো তোমার জন্যই। এখন এই কেইসটা যদি হেরে যাই, তবে কোম্পানি বেঁচে দেউলিয়া হতে হবে, প্রেস্টিজ রক্ষা করাও মুশকিল হবে। প্লিজ ডু সামথিং ফর মি। কিন্তু রবিন এসব কোনো কথায় কর্ণপাত না করে ইচ্ছেমতো তার নাভি, বুক, ঘাড় হাতাতে শুরু করল, যেন ক্ষুধার্ত বাঘ বহুদিন পর তুলতুলে হরিণ পেয়েছে।
নেহালের শরীরটাও নিসপিস করছিল এসব দেখে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কত রংয়ের, কত ধাঁচের, কত গড়নের মেয়ে দেখেছে সে। কিন্তু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির আকাশচুম্বি খরচ মেটাতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে ঘরে ফিরে বড়জোর হাতের গাঢ় স্পর্শ আর সচিত্র নারী-পুরুষের সচল, ঘন সন্নিবেশ দেখেই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে তাকে। ভেবেছিল, বেশি নয়, এই তো টেনেটুনে দুটো ডিগ্রী জোটাতে পারলেই ওসব গড়াগড়ি খাবে তার পায়ের কাছে। গ্রামের বাড়ি থেকে মা-বাবা আর ছোট বোনটাকে শহরে এনে দুনিয়ার অত্যাশ্চর্য সব সুখ-শান্তি-আরাম-আয়েশ জোগাবে। হয় খুলশি, নাহয় নাসিরাবাদে একটা বড়সড় ফ্ল্যাট থাকবে তার, প্রত্যেক ঘরে থাকবে এটাচ বাথরুম, থাকবে ব্যালকনি, ব্যালকনিতে সাজানো থাকবে বাহারি জাতের ফুলের টব। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘ্যাড়ঘেড়ে গলা সেই বড়সড় ফ্ল্যাট, এটাচ বাথরুম, ব্যালকনি, আর ব্যালকনিতে সাজানো বাহারি জাতের ফুলগাছগুলোকে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিলো একেবারে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানিতে—নেহাল, এ্যাই নেহাল, আগ্রাবাদ হোটেলের দিকে গাড়ি নাও। কতক্ষণ ধরে ডাকছি, কোনদিকে মনোযোগ থাকে তোমার? আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে আগ্রাবাদ মোড় থেকে টয়োটার চাকা ঘুরিয়ে বামে মোড় নিলো সে।
আজ রোদটা বড় চড়া। দুনিয়ার বুক থেকে শীতের সমস্ত চিহ্ন সরে গিয়ে যেন ঠাঠা গ্রীষ্ম নেমেছে। আগ্রাবাদ হোটেলের সামনে ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে, একপাশে টয়োটাকে পার্ক করে একটা সিগারেট ধরাল নেহাল। খানিক আগে ধামাচাপা দেওয়া সেই উদগ্র চাপটা আবার গড়গড় করে উঠল তার তলপেটে। শালা মনে হয় সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুযোগ পেলেই গড়গড় শুরু করে। এবার এর একটা দফারফা না করলেই নয়। পাশেই পাবলিক টয়লেট, মলমুত্রের উৎকট গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বহুদূর পর্যন্ত। অগত্যা বাধ্য হয়ে সেখানে ঢুকেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গড়গড়ানি থামিয়ে বের হলো সে। মাসখানেক আগে একবার পাতলা পায়খানা হয়েছিল তার। ঘন ঘন টয়লেটে দৌড়ানোর সে কী জ্বালা! টানা তিনদিন কি চারদিন বিছানা আর টয়লেট, টয়লেট আর বিছানা করতে করতে জান কাহিল হয়ে যায় আর কী! মিসেস শিউলি এ নিয়ে কিঞ্চিত বিরক্তও হয়েছিল তার ওপর। তবে নেহালকে সে অবশ্য একটু স্মুথলিই হ্যান্ডেল করে, কারণ—প্রথমত সে ছিল তার স্বামী আশরাফ চৌধুরীর বিশ্বস্ত পিএস। বিশ্বস্ত আর সৎ বলে স্বামী মারা যাওয়ার পরেও তাকে রেখে দিয়েছিল সে। নেহালও আর রা কাড়েনি। মিসেস শিউলির অনেক কানেকশন, কোনো একটা দূতাবাস কিংবা সরকারী যেকোনো একটা দফতরে যদি তার সুপারিশে একবার ঢুকতে পারে, তাহলেই তো গুটি লাল। তাই তার পায়ের কাছে সে কুকুরের মতো গড়াগড়ি খায়, বিনিময়ে মিসেস শিউলিও তাকে নানান প্রতিশ্রুতি দেয়। তাছাড়া ছেলেটা বড্ড কাজের। রাত তিনটায় যদি হুইস্কি লাগে, শুধু একটা কল দাও, আধা ঘন্টার ভেতর বোতল নিয়ে বান্দা হাজির। কোনোদিন হয়তো অবেলায় বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করল, লাগাও কল, বান্দা হাজির। এজন্যই ছোটখাটো ভুলটুল হলে নেহালকে সে খুব বেশিকিছু বলে না। কিন্তু বাসায় গাড়ি ড্রাইভ করার মতো একটা পুরুষমানুষ নেই, মিসেস শিউলিও কখনো নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে না, এরকম অবস্থায় ড্রাইভার যদি অসুস্থ্য থাকে, তবে বিরক্ত হওয়াটা খুবই সঙ্গত বিষয়। কিন্তু মিসেস শিউলি সেই বিরক্তিটা চেপে গিয়েছিল। আসলে মিসেস শিউলির একটা জরুরী মিটিং ছিল প্রেসক্লাবে। নারীদের জাগরণ নাকি নারী উদ্যোক্তাদের একটা বড়সড় সভায় ভাষণ দিতে হবে তাকে। তিন তিনটা গার্মেন্টস, দুটো সিমেন্ট কারখানা, একটা বড়সড় স্টিল মিল রয়েছে যার, সাধারণ নারী উদ্যোক্তাদের সামনে তার চেয়ে বড় আদর্শ আর কোথায় খুঁজে পাবে সভার আয়োজক কমিটি? মিসেস শিউলি কিন্তু ঠিকই উপস্থিত হয়েছিল সেই মিটিংয়ে। পরেরদিন নিউজপেপারে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছিল সেই সংবাদ। একটা পুরো পাতা জুড়ে অনেকগুলো মেয়েমানুষের মাঝখানে মিসেস শিউলির হাসি হাসি মুখ জ্বলজ্বল করছিল। আজকেও কি কোনো মিটিং আছে? নারী জাগরণ না হোক, সমাজ জাগরণ বা ঐ ধাঁচের কিছু? টয়োটা থেকে নেমে ওরা দু’জন যে হোটেলের ভেতর ঢুকল, আরো কতক্ষণ লাগবে বের হতে?
এর মধ্যে প্রায় দুই কি তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে। শীতের সূর্যটা তাপ হারাতে হারাতে শীতল একটা কমলালেবুর মতো ঝুলছে পশ্চিম আকাশে, হালকা বাতাসে জমাট বাঁধার সুযোগ না পেলেও চারপাশে সাদা চাদরের মতো ফিনফিনে একটা আস্তরণ ফেলছে গোধূলির কুয়াশা। আগ্রাবাদ হোটেলের সামনেই একটা টংয়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসে পড়ল নেহাল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ কী যে হলো, কুয়াশার পাতলা আস্তরণটা তার চোখের সামনে থেকে আচমকা সরে গেল, তার বদলে ভেসে উঠল তার লুঙ্গিপড়া রোগাপাতলা বাপের চেহারা। হাঁটুর ওপর লুঙ্গির কাপড় তুলে বুড়ো লোকটা বসে রয়েছে উঁচু দালানের হাই কমোডে, লোকটার কি কোষ্ঠকাঠিন্য হলো নাকি? তার সতেরো বছর বয়েসী ছোট বোন নাজমা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে টাউনের কাকের সাথে গপ্পো করছে আর খিলখিল করে হাসছে, ছুড়িটা কি পাগল হয়ে গেল? ঐ দেখো, এবড়োথেবড়ো দাগ-ভর্তি মুখ নিয়ে তার থুড়থুড়ি বুড়ি মা’টা এসির বাতাস খেতে খেতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছে চুপচাপ। কিন্তু এখন তো মাগরেবের ওয়াক্ত, এই সময় কেন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছে সে? হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে সমস্ত দৃশ্যপট যেন উল্টেপাল্টে গেল, আবার আস্তে আস্তে গড়ে উঠল নতুন আরেকটা দৃশ্য। ঐ তো ঘন একটা বাঁশঝাঁড় দুলছে বাতাসে, বাঁশগাছের চিকন চিকন পাতা তিরতির করে কাঁপছে, বাঁশঝাঁড়ের পাশেই একটা ছিমছাম মাটির বাড়ি, বাড়িটাও দুলছে আস্তে আস্তে। কলপাড়ে ওটা কে পানি তুলছে? নাজমা না? ঐ তো দাওয়ায় বসে আছে মা, তসবি গুনছে মাথা দুলে দুলে। আর বাপটা? বাপ কই? উঁচু দালানের হাই কমোড থেকে কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা?
হোটেল থেকে মিসেস শিউলির থলথলে শরীরটা এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে, জোয়ানটা সাথে নেই। খানিক আগের ছুকড়িসুলভ ন্যাকামো এখন তার গা থেকে মুছে গেলেও কেমন একটা আমোদও যেন চিকরিমিকরি এঁকে যাচ্ছে তার সারা শরীরে। চোখেমুখে সেই আমোদ সেঁটে নিয়ে টলোমলো গলায় মিসেস শিউলি বলল, নেহাল, গাড়ি ঘুরাও। তার মেকাপ-মোছা সাদা মুখটা দেখে নেহালের গা ঘিনঘিন করে উঠল। নে মাগী, খিদা মিটসে? কুত্তার ট্রিটমেন্ট ঠিকমতো হইসে?
শীতের সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে সবে। ল্যাম্পপোস্টের ঝাপসা আলোয় কুয়াশা কিলবিল করছে দেওয়ান হাট, টাইগার পাস, জিইসির প্রশস্ত রাস্তায়। সেই কুয়াশাকে পাশ কাটিয়ে টয়োটা চলছে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুতগতিতে। গাড়ি ঘুরানোর অর্ডার এসেছে শুধু, কিন্তু গন্তব্য কোথায়, সেই অর্ডার আসেনি। সুতরাং, এখন শুধু টয়োটা হাঁকাও, যেদিকে ইচ্ছা হাঁকাও, যতক্ষণ খুশি হাঁকাও। গাড়িটাকে জিইসি দিয়ে শো করে টেনে, দুই নাম্বার গেট হয়ে সে চলল একেবারে বায়েজিদের দিকে। ওদিকের রাস্তাগুলো বড্ড ছিমছাম। কুয়াশার সাথে টয়োটার হেডলাইট ধাক্কা খেয়ে সরে সরে যাচ্ছে, দু’পাশের পাহাড়গুলোকে গাঢ় অন্ধকারের ভেতর বিশাল বিশাল মাটির ঢিবির মতো মনে হচ্ছে। ওদিকে টয়োটার পেছনে বসা মিসেস শিউলির গা থেকে ভেসে আসছে হুইস্কি আর বডি স্প্রের দ্বৈত একটা গন্ধ, সেই গন্ধে পুরো টয়োটা বুঝি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। গন্ধটা কি নেহালকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল? তার চোখের সামনে থেকে এখন কুয়াশাগুলো সরে যাচ্ছে, পাহাড়গুলোও কেমন হালকা মেঘের মতো উড়ে যাচ্ছে অন্ধকার আকাশে। কুয়াশা আর পাহাড় সরে গিয়ে নেহালের ঘুম ঘুম চোখের সামনে এখন ভাসছে মিসেস শিউলির দশতলা দালান, যে দালানে চাকরবাকর বাদ দিলে, মিসেস শিউলি আর তার জিন্স-টি শার্ট-টপস পড়া ন্যাকা খুকিটা ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণী থাকে না। নেহাল জিভ চাটতে শুরু করল। একটা, কেবল একটা ফ্ল্যাট হলেই তার ভদ্রলোক হওয়ার সাধটা জীবনের তরে মিটে যায়। ঐ ধুপসি মাগিটার মতো হাজার কোটি টাকার দরকার নেই তার। কেবল একটা কংক্রিটের ছাদ চাই, চাই ভদ্রলোকের কাতারে ওঠার জন্য একটা শক্ত পরিচয়পত্র। ঝাপসা চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে দেখল নেহাল, ঐ তো সেই ঠিকানা, ঐ তো সেই সাজানো গোছানো সুখের রাজ্য। নেহাল এখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠবে, কারো কথায় এখন কান দেবে না সে। এক ধাপ দু’ধাপ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওপরে উঠছে সে, পেছন থেকে ভেসে আসছে মিসেস শিউলির আর্তচিৎকার, নেহাল, নেহাল, দেখে চালাও। নেহাল, কী করছ তুমি, পাগল হয়ে গেলে নাকি?
না, নেহাল আজ কিছুই শুনবে না। সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে আজ রাতেই তাকে উচ্চতার সব সীমা ছাড়িয়ে যেতে হবে। টয়োটার স্টিয়ারিং এখন মুক্ত, ওটা এখন প্যাগাসাস ঘোড়ার মতো ডানা মেলে উড়ছে। উড়তে উড়তে একসময় কী যে হলো, মুখ থুবড়ে পড়লো ঘোড়াটা। ঘোড়াটার দেহে কি এখন আর প্রাণ নেই? মিসেস শিউলির মুখ থেকে আর কোনো আর্তচিৎকার বেরোচ্ছে না, তার মেকাপ-মোছা ধবধবে সাদা মুখটা অন্ধকারের দিকে স্রেফ হাঁ হয়ে রয়েছে—অন্ধকারও তার শরীরের ওপর নিজের কালো জিহ্বা বাড়িয়ে দিয়েছে, যেন চুকচুক করে চাটছে তার মেদবহুল, মোটাগাটা শরীরটা। নেহাল ছিটকে পড়েছে পাহাড়ঘেরা রাস্তার একপাশে, চোখেমুখে তার রাজ্যের ঘুম। নাজমা কি এখনো কলপাড়ে পানিই তুলছে? ছুড়িটা যে কবে একটু চটপটে হবে! ভাতমাখা হাত নিয়ে আর কতক্ষণ বসে থাকবে নেহাল? এদিকে কেরোসিনের কুঁপিটাও মিটমিট করছে, তেল ফুরাল নাকি? মা, ও মা, নাজমারে একটু তাড়াতাড়ি আইতে কও তো। তৃষ্ণায় তো জান যায়। মায়ের মুখেও কোনো আওচাও নাই। কী হলো সবার? তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে আজ রাতেই তো রওয়ানা দিতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এতোগুলা মানুষকে নিয়ে আজ ওপরে উঠতে হবে! কারো কোনো হুঁশ আছে? বাপটারও কোনো খোঁজ নেই। না, আর দেরি করা যাবে না। বেশি দেরি করলে দারোয়ান যদি গেট বন্ধ করে দেয়? রাতও তো কম হয়নি। এবার আস্তে আস্তে পা বাড়াতে শুরু করল নেহাল, এক ধাপ, দুই ধাপ, তিন ধাপ….আরো যে কত অগুনতি ধাপ। উঠতে উঠতে গলদঘর্ম হয়ে শেষমেশ সে পৌঁছে গেল উচ্চতার একেবারে শেষ সীমানায়, যেখান থেকে হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যায়। যে আকাশ দূর থেকে দেখলে বিশাল মনে হয়, কিন্তু বিশাল হলেও সেটা সত্যিকার অর্থে মহাশুন্যই।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন