জলধি / গল্প / উদয়ের পথে
Share:
উদয়ের পথে

ছেলে আমেরিকার বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট। থাকে ওয়াশিংটনে।করোনায় বিধ্বস্ত আমেরিকায় চলছে প্রতিষেধক আবিষ্কারের যুদ্ধকালীন তৎপরতা। নেতৃত্বে বাঙালি গবেষক চিকিৎসক। ছেলে রোজ রাত দশটায় বাবাকে ফোন করে।ঠিক ঠিক ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। দিনতিনেক আগে ফোনে বাবাকে বলেছিল ল্যাবে জোর কাজ হচ্ছে ক'দিন হয়তো ফোন করা হবে না। বাবা যেন চিন্তা না করে। বলেছিল --"আমরা সাফল্যের কাছে পৌঁছে গেছি। এবছর পয়লা বৈশাখ যাওয়া হবে না। তুমি কিন্তু কাতলা মাছের কালিয়া রাঁধতে ভুলবে না। আর প্রিয় পাবদা মাছের হালকা ঝোল। পল্টুকে বলে দিয়েছি। ও সব এনে দেবে। কাজের মাসিকে ভাল তাঁতের শাড়ি দেবে।"

          শেষ চৈত। আগামীকাল পয়লা বৈশাখ। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ছাদে গিয়ে বসল অবিনাশ। স্ত্রী-বিয়োগের পর থেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে।চারদিন আগে ছিল পূর্ণিমা। এখন মরা চাঁদের ম্লান আলোয় সামনের ঝাঁকড়াচুলো বকুল গাছটাকে রহস্যময় দেখাচ্ছে। গাছটা ছেলের বয়সী। এ কদিনে লাফিয়ে বেড়ে উঠেছে। আকাশের ঠিকানা খুঁজতে ব্যস্ত। অনন্ত আকাশ। কত ছায়াপথ, মায়াপথ। লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ দূরের সেই নক্ষত্র, যার আলো এখনো পৃথিবীতে পৌঁছায় নি। সে আসছে। আসছে আর আসছে।অবিরাম। আবার আমাদের হাসি কথা গান সেই অনন্তের অভিমুখে ছুটে চলেছে নিরন্তর। সুদূর কোন নক্ষত্রে ধাক্কা খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে? ফিরে আসবে মল্লিকার সেই উদ্দাম হাসির শব্দ? ঋকের খিলখিল হাসি? নাকি হারিয়ে যাবে মহাশূন্যের তমোগহ্বরে। সেই ব্ল্যাকহোল। অনন্ত আকাশ জুড়ে গ্যাসীয় পিন্ডের অন্ধ উন্মাদনা। ফেটে পড়বে একদিন। জন্ম নেবে নতুন বিশ্ব। পাহাড়, সমুদ্র, কুমারী অরণ্যের পবিত্র অন্ধকার। বকুলগাছের ভেতর থেকে প্যাঁচা ডেকে উঠতেই চমক ভাঙল অবিনাশের।রাস্তার কুকুরগুলো অবিনাশের খুব ন্যাওটা। ওরা বুঝতে পেরেছে অবিনাশ ঘুমোয় নি। উপর দিকে মুখ করে অস্ফুট শব্দে কিছু বলতে চাইছে। মল্লিকা মারা যাবার পর তিনদিন কিছু খায় নি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। ঋক যেদিন ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে উঠছিল, সেদিনও কুঁই কুঁই শব্দে কি যেন বলছিল। ওরা কি সব বুঝতে পারে? ধরিত্রীর গভীরে যখন ভূমিকম্পের ষড়যন্ত্র শুরু হয় তখন ওরা কি প্রলয়ের আভাস দেয়। উপর দিকে মুখ তুলে করুণ সুরে আসন্ন ধ্বংসের সতর্কতা প্রচার করে?
          আবারও স্মৃতির ভেতর চলে যায় অবিনাশ। তখন ছোট। পয়লা বৈশাখ পাত্রভোজ। বাবা সকালে ডেকে নিয়ে যেত খিড়কি পুকুরে। অবিনাশ বালতি ধরত। বাবা উড়োগাঁতি দিয়ে মাছ ধরত। ছোট ছোট ফাঁদিতে জড়িয়ে যেত ট্যাংরা, বাঁশতে। রূপোলি খয়রা মাছের ঝাঁক দুএকবার ছটফট করেই নিস্তেজ হয়ে যেত। বাবা বলতেন সূর্যের আলো দেখলেই ওরা মারা যায়। আশ্চর্য! আলো তো জীবনের প্রতীক। তাহলে আলো দেখলেই মরে কেন? তবে কি, আলো অন্ধকার, জীবন মৃত্যু একই উৎস থেকে উৎসারিত? ঠিকই তো।আকাশের নিরেট অন্ধকার থেকেই ভোরের আলো ফোটে। শ্মশানের কাঠকয়লার ভিতর থেকে সতেজ দূর্বাদল উঁকি দেয়।
           শেষ রাতে চাঁদ একটু উজ্জ্বল। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো লুকোচুরি খেলছে। ছাতারে পাখির দল ঘুমোচ্ছে। আর একটু পরেই জেগে উঠবে। দূরে কোথাও বিরহী কোকিল সপ্তস্বরা রাগিণীতে ডেকে চলেছে একটানা। পেঁচাটা ঝুপ করে নেমেই, মুখে কি একটা নিয়ে বকুল গাছের কোটরে সেঁধিয়ে গেল। শুকতারাটা বিদায়ের আগে সবটুকু আলো ঢেলে দিচ্ছে। অবিনাশের মন ঘুরছে গীতাঞ্জলির পাতায়। আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ/তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।" গুনগুন করে গেয়ে চলেছে অবিনাশ। কোন একটা গান পুরো নয়। গানের কোলাজ। পুবের আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। দেবব্রতর মন্দ্র স্বর ভিতর থেকে জাগিয়ে তুলল অবিনাশকে। কায়াহীন সুরে যুক্ত হল শব্দ, চরণ---
অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক
ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে
'আঁধারে পথ চিনবে কেমন করে?'
আমি কইনু 'চলব আমি নিজের আলো ধরে,
হাতে আমার এই যে আছে বাতি।'
           সকাল হতেই পল্টুকে নিষেধ করে বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়ল অবিনাশ। লক ডাউনের জন্য বাজারে ভিড় কিছু কম। কিলো তিনেকের একটা কাতলা, দুকেজি পাবদা আর সবজি কিনে মিষ্টির দোকানে গেল। ঋকের প্রিয় দই আর রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফিরল অবিনাশ। কাজের মাসি তো অবাক। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই তার হাতে নতুন কাপড় তুলে দিয়ে বলল আজ না পয়লা বৈশাখ। ঋক তোমাকে দিতে বলেছে। আজ আমিই রাঁধব। তোমাদের পাড়ার ছেলেগুলোকে পাত্রভোজে নিমন্ত্রণ করেছি।তুমি কাপড়টা পরে নাতিকে নিয়ে চলে আসবে। পরিবেশন করতে হবে।
          অবিনাশ মেতে উঠেছে সৃষ্টির আনন্দে। এই হাঁড়ি কড়াই মল্লিকা নিজে কিনেছিল। তার ছোঁয়া অনুভব করল অবিনাশ। মল্লিকা গুঁড়ো মশলা ব্যবহার করত না। ওতে স্বাদ কমে যায়। শীল নোড়ায় হাত দিল। শীতল অনুভূতি বিদ্যুৎ চমকের মত খেলে গেল সারা শরীর। মল্লিকা যখন বাটনা বাটত, তখন হাতের চুড়ি শাঁখা নির্দিষ্ট ছন্দে বাজত। অবিনাশ রসিকতা করে বলত, তোমাকে দেখেই গীতিকার লিখেছিল --"ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে।" সব ছন্দ আলাদা। হলুদ লঙ্কার আওয়াজ একরকম। পোস্ত বাটার ছন্দ আলাদা। ঋক আওয়াজ শুনেই দূর থেকে বলত --"আজ পোস্ত হবে মনে হচ্ছে?" দূর নক্ষত্রে ধাক্কা খেয়ে কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অবিনাশ। এই মহাবিশ্বে কোন কিছুই হারায় না। শুধু রূপান্তর হয়। বাবার মৃত্যুর পর গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন দিয়ে এসেছিল অবিনাশ। পরদিন বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টিতে খুব ভিজেছিল অবিনাশ। বাবার স্পর্শ পাচ্ছিল। অস্থি জলে মেশে। সেই জল বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ। মেঘ থেকে বৃষ্টি। চক্রের আবর্তন। গতকাল ছিল চড়ক।সেই আবর্তন। পৃথিবীও ঘুরছে আপন কক্ষপথে। জীবনের কক্ষপথ এমনি হয়তো বা। যার একপ্রান্তে জীবন, অন্য প্রান্তে মৃত্যু।
           পাড়ার ছেলেরা খেতে বসেছে। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে অবিনাশ। হঠাৎ পুলিশের জীপ এসে দাঁড়াল। ওসি গাড়ি থেকে মাথা নীচু করে নামলেন। অবিনাশের প্রাক্তন ছাত্র। ---"স্যার একটু এদিকে আসবেন। কথা ছিল।" শিক্ষকের দৃঢ়তা, আর পিতার স্নেহ মিশিয়ে অবিনাশ বলল --"কি আর বলবে। ঋক নেই।এই তো? তোমরা তো আছ। মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে তোমরা অগ্রণী সেনা। ঋকের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে আমি সামান্য আয়োজন করেছি। তোমরা কি একটু খেয়ে যাবে?" ওসি মাথার টুপি খুলে অবিনাশের পায়ের কাছে রাখল।


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন